ব্ল্যাক লিস্ট – ১১

কাজী আনোয়ার হোসেন

এগারো

গুলির আওয়াজে উৎকণ্ঠিত হয়ে উঠেছে হোটেলের অতিথিরা। যদিও কিছুক্ষণ পর থিতিয়ে গেল সবার উত্তেজনা। ট্রাট্টুর লাশ সংগ্রহ করে থানায় নিয়ে গেল গার্ডিয়া সিভিলের তিন সদস্য। এরপর শুরু হলো খুনের তদন্তের দীর্ঘ তৎপরতা। স্কি, রিসোর্টে শান্তিরক্ষার জন্যে গার্ডিয়ার যে- ক’জন অফিসারকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে, তারা হোটেলে এসে একে একে জেরা করতে লাগল অতিথিদেরকে।

গভীর রাতে পাহাড়ের এত ওপরে প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় নিজেদের কাজ করছে তারা। ভাল মানুষ না হলে হয়তো ভাবত সকালে জেরা করলেই হবে। সুতরাং তাদের প্রতি কোন বিরক্তি বোধ করছে না রানা।

নিজেকে সৌভাগ্যবান বলে মনে হলো ওর। জেরার সময়- কেউ বলেনি হোটেল থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল ও। কনিয়্যাকের গ্লাসে চুমুক দিয়ে অপেক্ষা করল কখন জেরা করা হবে ওকে। কে বা কারা হোটেলে আসছে বা বেরিয়ে যাচ্ছে, সেটা জানার জন্যে চোখ রেখেছে লবির দরজার ওপরে। অবশ্য টরেমোলিনোসের সেই ভিলায় যাকে দেখেছে, তার সঙ্গে কারও মিল খুঁজে পেল না রানা। ফলে এটা বুঝে গেল, অন্তত এ-হোটেলে ওঠেনি কিউলেক্স।

কিছুক্ষণ পর লবির অন্যদিকে গিয়ে চোখ বোলাল প্রাডো লানোর ওপরে।- ওকে জেরা শেষ হলে লবি ত্যাগ করে সিঁড়ি বেয়ে তিনতলায় নিজেদের সুইটের দরজায় এসে থামল রানা। দরজার তালায় চাবি ভরে শুনল ওদিকের ঘরে পুরুষালী হাসি।

পরের খিলখিল হাসিটা মারিয়ার

বোধহয় নিজের কামরায় হের মুলারকে এনেছে মেয়েটা। লোকটা মধ্যবয়স্ক হলেও হাসি-ঠাট্টা ও রসিকতা দিয়ে পটিয়ে ফেলে সবাইকে। দরজা খুলে ঘরের বাতি জ্বালল রানা। আবার শুনতে পেল মেয়েলি হাসি। জোরে দু’বার শীৎকার করে উঠল মারিয়া। ডাইনিংরুমে ওকে যে আনন্দে রেখেছিল হের মুলার, এখন তার চেয়ে অনেক বেশি মজা দিচ্ছে! লোকটাকে একফোঁটা বিশ্বাস করে না রানা।

‘উহ্, কার্স! কী যে করো তুমি! নাহ্, কার্সন! এটা করে না!’

‘করলে কী হয়!’

‘করে না!’ অনুনয় করল মারিয়া।

কার্সন? ভুরু কুঁচকে গেল রানার।

তার মানে ওদিকের ঘরে হাজির হয়েছে জন কার্সন?

এবার ব্রিটিশ উচ্চারণে ইংরেজি শুনতে পেল রানা।

তীক্ষ্ণ এক দীর্ঘ শীৎকারের পর নীরবতা নেমেছে পাশের ঘরে।

সোফায় বসে অপেক্ষায় থাকল রানা।

মিনিট তিনেক পর শুনল কার্সনের কথা, ‘ডার্লিং, নাও না আরেক গ্লাস স্কচ?’

শেষবার লোকটার সঙ্গে রানার দেখা হয়েছে ম্যালাগায়। যেদিন ইয়টে খুন হলো মোরেলির ডাবল, তার পরদিন দুপুরে মারিয়া আর ওকে নিয়ে শপিঙে গিয়েছিল সে। রাতে ডিনার করেছে নামকরা রেস্টুরেন্টে। তারপর মারিয়াকে নিয়ে পরদিন সকালে সোল ই নিয়েরের উদ্দেশে রওনা হয়েছে রানা। মারিয়া বা ও একবারও বলেনি কোথায় চলেছে ওরা। সেক্ষেত্রে কার্সন কীভাবে জানল ওদের হদিস?

সেক্ষেত্রে সে কি এ-ও জানে, পিছু নিয়েছে কিউলেক্স?

হয়তো জানে!

কিউলেক্স যে এখানে এসেছে, তাতে সন্দেহ নেই রানার মনে। সে-ই খুন করেছে কিশোর ছেলেটাকে। সেটা যৌক্তিক।

অবশ্য সেক্ষেত্রে প্রশ্ন হচ্ছে: সত্যি যদি কিউলেক্সের পিছু নিয়ে থাকে কার্সন, তো তাকে ঠেকাতে বাইরে বা ইঞ্জিন- রুমের ভেতরে ছিল না কেন?

এর আবার কোন যৌক্তিক ব্যাখ্যা নেই।

রানা ‘আগে ভেবেছে, মোরেলিকে শেষ করতে এসেছে কিউলেক্স। কিন্তু এখন নতুন করে সাজাতে হবে ওর হাতের তাস। এমন হওয়ার সম্ভাবনা আছে যে, পরিচিত কোন স্পাই সংগঠনের কেউ নয় কার্সন। হয়তো সৎ ব্রিটিশ নাগরিকও নয় সে।

প্রথম পরিচয়ে বলেছে, রানাকে ভিলায় পৌঁছে দিয়ে সেই পতিতা নাইট ক্লাবে ফিরলে তার কাছ থেকে তথ্য পেয়ে টরেমোলিনোসের ভিলায় গিয়েছিল সে।

সে-রাতের দৃশ্য চোখে ভেসে উঠল রানার।

ভিলার বেডরুমে শুয়ে ছিল এক লোক। যদিও বাড়িতে ঢুকে তাকে ধরতে পারেনি রানা। জ্ঞান ফেরার পর গাড়ি নিয়ে গ্যারাজ থেকে বেরোলে যে-লোককে দেয়াল টপকে পালিয়ে যেতে দেখেছে, সে-ই হয়তো জন কার্সনের সঙ্গী!

পরে ভিলায় ঢুকে নাম ভাঁড়িয়ে রানার সঙ্গে আলাপ করেছে কার্সন। নিজের পরিচয় দিয়েছে এমআই-ফাইভ এজেণ্ট হিসেবে। খুঁজছে ঠাণ্ডা-মাথার খুনি কিউলেক্সকে।

অথচ এটা অসম্ভব নয় যে, তারই ভাড়া করা কাউকে নিজের ভিলার বেডরুমে থাকতে বলেছে কার্সন। সেই লোক ভান করেছে যে সে-ই আসলে কিউলেক্স। তারপর অভিনয় করেছে পালিয়ে যাওয়ার। পরে নকল কিউলেক্স অদৃশ্য হলে, বাড়িতে ঢুকেছে কার্সন। রানাকে বলেছে, খুনিটাকে ধরতে এসেছে সে।

সেক্ষেত্রে কার্সন নিজেই হয়তো খুনি কিউলেক্স। সোল ই নিয়েরেতে ওদের পিছু নিয়ে এসেছে। আজ একটু আগে কেবল-কারের ইঞ্জিন-রুমে রানা মনে করে খুন করেছে ছেলেটাকে। দেরি না করে ফিরে এসেছে হোটেলে। আর এখন মারিয়ার সঙ্গে শুয়ে জানতে চাইছে, রোমিয়ো মোরেলির কাছে তাকে পৌঁছে দিতে পারবে কি না রানা!

শীতের ভেতরেও মেরুদণ্ড বেয়ে ঠাণ্ডা ঘাম নামল রানার। চট্ করে চলে গেল ফোনের সামনে। সুইটের দুই কামরায় আলাদা দুটো ফোন আছে। রিসিভার তুলে লবির ডেস্কে যোগাযোগ করে বলল ও, ‘মিসেস কিংকে ডেকে দিন।’

একটু পর পাশের ঘরে রিঙের আওয়াজ শুনতে পেল রানা। দু’বার রিং হওয়ার পর কল রিসিভ করল মারিয়া। ‘হ্যালো?’

‘কোন কথা বোলো না। আমি রানা। তোমার ঘরে কার্সনের গলা শুনছি। ভঙ্গি করো, রং নাম্বারের কল পেয়েছ।’

‘সরি! মনে হচ্ছে আপনি ভুল নাম্বারে…’

‘তোমার ঘরে · ওকে আটকে রাখো। আগামীকাল. মাঝরাতে মোরেলির সঙ্গে আমার দেখা করার কথা ভেলেটায়। এই তথ্য জানাতে গিয়ে খুন হয়েছে তার দলের ছেলেটা। যদি পারো, আজ রাতে কার্সনকে নিজের ঘরে রাখো। হয়তো মোরেলির ডাবলকে সে-ই খুন করেছে।’

‘আপনি কিন্তু আমাকে খুব বিরক্ত করছেন, স্যর। আমাকে এসব বলছেন কেন? আপনি তো ভুল নাম্বারে ফোন করেছেন!’

‘কার্সনকে কিছু বলতে যেয়ো না। যা বললাম, সেটা যদি বুঝে থাকো, তো শুধু বলো: ‘আমি আপনার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করতে চাই না, স্যর। আপনাকে কোন সাহায্য করতে পারছি না।’ এরপর রেখে দেবে ফোন।’

‘আমি আপনার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করতে চাই না, স্যর। আপনাকে কোন সাহায্য করতে পারছি না।’

কল কেটে যেতেই ক্রেডলে রিসিভার রাখল রানা। পাশের ঘরে শুনতে পেল জন কার্সনের গলার আওয়াজ।

‘কে ফোন করেছিল, মারিয়া ডার্লিং?’

‘রং নাম্বার। কোথাকার এক মাতাল ইংরেজ।’

হাসতে লাগল কার্সন। ‘ঠিক বলছ তো, কিং নয় তো?’

‘লোকটার উচ্চারণ ঠিক তোমার মত,’ বলল মারিয়া। ‘এবার এসো, আরেকবার…’

‘এখনই? এত জলদি? বেশ্! আমি অবশ্য পুরো রেডি…’

‘যাহ্, দুষ্টু!’

আবারও নীরবতা নেমেছে পাশের ঘরে।

স্টিলেটো আর ওয়ালথার চেক করে পোশাক পাল্টে টার্টলনেক সোয়েটার পরে নিল রানা। মনস্থির করেছে আপাতত যাবে বারে। বেশকিছু বিষয়ে ভাবতে হবে ওকে। তা ছাড়া, রাতে এ-ঘরে থাকার কোন আগ্রহ নেই ওর।

বাতি নিভিয়ে সুইট থেকে বেরিয়ে এল রানা। দরজা লক করে নিচে নেমে দেখল, এখনও বারে আছে দু’চারজন। আজ পুলিশি ঝামেলা হওয়ার পর উত্তেজনার কারণে ঘরে গিয়ে ঘুমাতে পারেনি। ডেস্কে জিজ্ঞেস করল রানা, ‘আর সবাই কোথায়?’

‘কেন, স্যর, নাইট ক্লাবে,’ বিস্ময় নিয়ে বলল বারটেণ্ডার। ‘ওটা বেসমেন্টে।’

‘তা হলে যে গান-বাজনার আওয়াজ পাচ্ছি না?’

‘নাইট ক্লাব সাউণ্ডপ্রুফ, স্যর।’

হোটেলের সিঁড়ি বেয়ে একতলা নামল রানা। বেসমেন্টে দেখতে পেল রসদ রাখার দুটো ঘর। পাশেই বড় এক দরজা। ওটার ওপরে জ্বলজ্বল করে জ্বলছে: নাইট ক্লাব।

দরজা দিয়ে ঢুকে ডানে বার দেখতে পেল ও। ওখানে গিয়ে ড্রিঙ্কের অর্ডার দিল। বারটেণ্ডারের পরনে ফ্ল্যামেনকো ড্যান্সারের পোশাক। জুলফি নেমে মিশে গেছে চাপ দাড়িতে। চেঁছে ফেলেছে মাথার দু’দিকের চুল। দ্রুত হাতে ড্রিঙ্ক সার্ভ করল সে।

নাইট ক্লাবের অতিথিদের ওপরে চোখ বোলাল রানা। এই জায়গাটা সম্পর্কে আগে ওর কোন ধারণা ছিল না। অথচ, সময় কাটাতে হলে কিউলেক্সের মত লোকের জন্যে চমৎকার এক জায়গা এটা। অবশ্য কার্সন নিজে কিউলেক্স হলে আরও ভাল কাভার জোগাড় করে নিয়েছে সে।

টরেমোলিনোসের ভিলায় যাকে দেখেছে, তাকে নাইট ক্লাবে দেখতে পেল না রানা। একটা টেবিলের পাশে চেয়ার টেনে বসবে, এমন সময় দেখতে পেল পরিচিত একজনকে।

সে আছে একদিকের টেবিলে। তার মাথার ওপরে দেয়াল ফুঁড়ে বেরিয়ে এসেছে নকল এক চ্যাপটা পাথর। ঘুরন্ত বাতির আলো মুখে পড়তেই অন্যদিকে তাকাল সে।

মেয়েটা ক্যাথি মোনালিসা।

এই মিশনে এই মেয়ের আসলে কী ভূমিকা? – নিজেকে জিজ্ঞেস করল রানা। ক্যাথি কি জানে সোল ই নিয়েরেতে এসেছে কার্সন?

হয়তো জানে।

অথবা জানে না।

ক্যাথি হয়তো কিছু না জেনেই এসবে জড়িয়ে গেছে। নিজের কাভার পোক্ত করতে ওকে ব্যবহার করছে জন কার্সন।

লোকটা আসলে কী চায়?

তার সম্পর্কে ভুল ধারণা করছে না তো রানা?

ছায়ার ভেতর দিয়ে এগিয়ে ক্যাথি মোনালিসার পাশে গিয়ে থামল রানা, মুখে আন্তরিক হাসি। ‘হ্যাল্পে।, ক্যাথি!’

‘কিং!’ অবাক হয়েছে ক্যাথি। ‘হঠাৎ করে এখানে?’

‘কখন এলে এই রিসোর্টে?’

‘জনি আর আমি এসেছি রাত এগারোটার দিকে। শাওয়ার সেরে পোশাক পাল্টে নেমেছি ডাইনিংরুমে। কিন্তু ততক্ষণে খাবার সার্ভ করা বন্ধ করে দিয়েছে ওরা। অনুরোধ করে খাবার আনিয়ে নিয়েছি। তখন দেখলাম তোমার স্ত্রীকে। আমাদেরকে বলল হাওয়া খেতে বাইরে গেছ।’ খুশিতে চকচক করছে ক্যাথির চোখ।

‘তো একা এখানে বসে কী ভাবছ?’ জানতে চাইল রানা।

‘এসেছিলাম আমরা সব মিলিয়ে তিনজন। আমাদের সঙ্গে ছিলেন দুর্দান্ত সুদর্শন এক জার্মান লোক। তারপর ব্যাগেজে কী এক সমস্যার কথা বলে ওপরে গেল জনি। আধঘণ্টা পর ফিরে এল। তখনই আবার বিদায় নিলেন জার্মান ভদ্রলোক। এরপর জনি আর আমি কিছুক্ষণ নাচলাম। আর তারপর…’

‘জার্মান ভদ্রলোক কতক্ষণ তোমাদের সঙ্গে ছিলেন?’

ভুরু নাচাল ক্যাথি। ‘ব্যাপার কী, কিং? একেবারে পুলিশের মত করে জেরা করছ?’

‘তা নয়,’ হাসল রানা। ‘তারপর ব্যাগেজের ঝামেলা শেষ করে ফিরে এসে কী করল জনি?’

‘আগেই বলেছি, বিদায় নিল জার্মান ভদ্রলোক। তারপর সাড়ে বারোটায় মারিয়াকে বলল জনি, নিজে গিয়ে দিয়ে আসবে ওকে ওর ঘরে। খুব চনমনে দেখাচ্ছিল মেয়েটাকে। জনি আমাকে বলেছে এখানে অপেক্ষা করতে।’ এবার ভুরু কুঁচকে বিরক্তির সুরে বলল ক্যাথি, ‘তারপর থেকে বসেই আছি তো আছি, ওর আর দেখা নেই।’

বারটেণ্ডারকে ড্রিঙ্কের অর্ডার দিয়ে ক্যাথির পাশের চেয়ারে বসল রানা। মনে পড়েছে মারিয়াকে কী করতে বলে এসেছে। নরম সুরে বলল ও, ‘কিন্তু জনি যদি রাতে আর না ফেরে?’

রানার দিকে চেয়ে মুচকি হাসল ক্যাথি। ‘তা হলে ঘরে ফিরে একাই শুয়ে পড়ব।’

‘বেশি একা লাগবে না?’

‘তা তো লাগবেই।’ রানার চোখে তাকাল মেয়েটা। ‘তুমি কি আমাকে অন্যকিছু বোঝাতে চাইছ?’

‘হয়তো।’

‘আমি বোধহয় তোমার কথা বুঝতে পেরেছি।’ রানার ঊরুতে হাত রাখল ক্যাথি। ‘তো এক কাজ করো, বারটেণ্ডারের কাছ থেকে এক বোতল কনিয়্যাক নিয়ে চলে এসো আমার ঘরে। ওখানে বসে জনির জন্যে অপেক্ষা করব আমরা।’

বারটেণ্ডারের কাছ থেকে কনিয়্যাকের বোতল সংগ্রহ করে ক্যাথিকে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে চতুর্থতলায় উঠল রানা। ওর পাশে হাঁটতে গিয়ে সামান্য টলে উঠছে মেয়েটা। হ্যাণ্ডব্যাগ থেকে চাবি নিয়ে খুলল নিজেদের সুইটের দরজা। হাতের ইশারায় রানাকে বলল ঘরে ঢুকতে। নিজে সুইচবোর্ড পেয়ে জ্বেলে দিল বাতি। রানা বেডের কিনারায় বসতে না বসতেই কাগজের কাপ নিয়ে এল ক্যাথি। দুটো কাপে কনিয়্যাক ঢেলে পরস্পরকে টোস্ট করল ওরা। এক চুমুকে ড্রিঙ্ক শেষ করে রানার চোখে তাকাল ক্যাথি। ‘আগেও বলেছি, তোমার স্ত্রী খুব সুন্দরী।’

মাথা নাড়ল রানা। ‘তবে তোমার মত এত সুন্দরী নয়।’

মৃদু হাসল ক্যাথি। ‘বলবে, কীভাবে তোমাদের সাংসারিক অশান্তি শুরু হলো?’

‘ওটা তেমন কিছু নয়।’

‘আমার কিন্তু মনে হয়েছে, তোমার চেয়ে অন্য পুরুষদের সঙ্গে সময় কাটাতে বেশি ভালবাসে সে।’

‘যেমন জনি?’

‘তা বলতে পারো।’

‘জনি কি সত্যিই তোমার স্বামী?’ জানতে চাইল রানা।

হেসে এদিক-ওদিক মাথা নাড়ল ক্যাথি। ‘আমরা ভঙ্গি করি যে আসলে দু’জনে বিবাহিত।’

‘কতদিন ধরে চেনো জনিকে?’

‘হবে… মাসখানেক।’

‘প্রথম কোথায় ওর সঙ্গে দেখা হয়েছিল তোমার?’

ভুরু উঁচু করল ক্যাথি। ‘ম্যালাগায়।’

‘বলবে, কী ধরনের পেশায় আছে জনি?’

মুচকি হাসল ক্যাথি। ‘ভালবাসা দেয়ার বিযিনেসে।’

‘ঠাট্টা করছ?’

‘না তো! আমি আসলে কারও ব্যক্তিগত বিষয়ে নাক গলাই না।’

মাথা দোলাল রানা। ঠিকই বলেছে ক্যাথি। স্প্যানিশ মেয়েরা কখনও স্বামী বা প্রেমিকের বিষয়ে গোপন কিছু জানতে চায় না। সমাজটাই ওদের এমন।

‘আর তুমি?’ হাসিমুখে রানাকে দেখল ক্যাথি। তুমি নিজে কী ধরনের কাজ করো?’

‘আমি আসলে ফোটোগ্রাফার,’ বলল রানা, ‘ভাল ছবিগুলো বিক্রি করে নিজের পেট চালাই।’

‘তা-ই?’ সন্দেহ নিয়ে’ ওকে দেখল ক্যাথি। ‘আমি তো কখনও তোমার সঙ্গে ক্যামেরা দেখিনি!’

‘আমরা তো আছি ছুটিতে,’ ব্যাখ্যা দিল রানা।

‘ব্রিটিশরা বোধহয় এমনই হয়,’ বিড়বিড় করল ক্যাথি।

‘জনি কখনও বোধহয় কোন কাজ করে না, তা-ই না?’

‘আমাকে বলেছে, কাজ করে এক ব্রিটিশ কোম্পানিতে, ‘ বলল ক্যাথি। ‘বিক্রয়-কর্মী।’

নতুন খবর, ভাবল রানা। ওটাই কার্সনের কাভার স্টোরি। লোকটার সম্পর্কে আরও কিছু জানার জন্যে ক্যাথিকে জিজ্ঞেস করল ও, ‘জনি কী ধরনের জিনিস বিক্রি করে?’

‘তা আমি জানি না। কখনও জিজ্ঞেস করিনি।’

‘কখনও ব্রিটেনে যোগাযোগ করে?’

‘তা করে। অনেক ফোন কল করে নানান দেশে।’

‘তা-ই?’

‘হ্যাঁ। আমার মনে হয় ওর একজন সেক্রেটারি আছে। সে-মেয়ের সঙ্গে প্রতিদিন কথা বলে ফোনে।’

‘আচ্ছা? তো কোথায় থাকে সেই মেয়ে?’

‘সেটা জানি না। জনি ফোন করলে ঘর থেকে বেরিয়ে যাই। বা মেয়েটা ফোন করলে ওকে ডেকেও দিই। আর আমি ঘর ছেড়ে চলে না যাওয়া পর্যন্ত কথা বলে না জনি।’

‘তোমরা স্প্যানিশ মেয়েরা সত্যিই খুব ভাল,’ বলল রানা। ‘ব্রিটিশ মেয়ে হলে দরজায় কান পেতে সব শুনত। আর তারপর সেসব নিয়ে স্বামী বা প্রেমিকের সঙ্গে ঝগড়া করত।’

‘আমি আসলে এসব ঠিক বুঝি না।’ হাসল ক্যাথি।

‘কখনও শুনেছ ওর ফোনে বলা কথা?’

‘মাঝে মাঝে।’

‘লক্ষ্মী মেয়ে,’ উৎসাহ দিল রানা। ‘আমাকে শোনাও তো দেখি কী বলে ও।’

ফোনে কখনও ব্যবসা নিয়ে কথা বলে না। সবই কোন না কোন লোকের ব্যাপারে। আমি আবার তাদের কাউকে চিনি না। কখনও কথা বলে মেয়েদের সঙ্গে। তবে কারও নাম কখনও উচ্চারণ করে না।’

সিক্রেট সার্ভিসের লোক হলে তার এত কথা বলার কথা নয়, ভাবল রানা। আলতো করে স্পর্শ করল ক্যাথির গাল। ‘তুমি কখনও ওর সেক্রেটারির সঙ্গে কথা বলেছ?’

‘হ্যাঁ। তখন এমন ভাব করেছি যে আমি একটা বোকা।’ রানার দিকে চেয়ে দুষ্টু হাসল ক্যাথি।

হাত বাড়িয়ে মেয়েটার উরুতে চাপ দিল রানা। ‘আমি তো জানি, তুমি আসলে অনেক বুদ্ধিমতী মেয়ে।’

‘কিন্তু মেয়েটা ধরে নিয়েছে আমার মগজে কিছুই নেই।’

‘কী যেন নাম বললে মেয়েটার?’

‘লিনা। তার সঙ্গেই প্রতিদিন কথা বলে জনি।’

‘মেয়েটার পুরো নাম জানো, ক্যাথি?’

ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল ক্যাথি মোনালিসা।

‘তুমি যতদিন ধরে জনির সঙ্গে আছ, ততদিন ধরে মেয়েটার সঙ্গে ফোনে কথা বলছে ও?’ ক্যাথির সঙ্গে এই আলাপ ওকে কোথায় নেবে, সেটা জানে না রানা, তবে তথ্য সংগ্রহের জন্যে কথা চালিয়ে যাচ্ছে।

‘পরিচয়ের পর থেকেই তো দেখছি মেয়েটার সঙ্গে কথা বলে জনি। কখনও কখনও অন্য দেশেও ওর সঙ্গে ফোনে কথা বলেছে। বোধহয় জরুরি ব্যবসার কোন কথা।’

‘ইংল্যাণ্ডে বেশি কল করে?’

‘হুঁ। কখনও ইংল্যাণ্ড আবার কখনও ফ্রান্সে।’

‘তুমি শিয়োর যে ফ্রান্স?’

ভুরু কুঁচকে ভাবল ক্যাথি। ‘আমার তো তা-ই মনে হয়। আমি অবশ্য খুব মনোযোগ দিয়ে শুনিনি। বলো তো, এত কিছু আমার কাছ থেকে কেন জানতে চাইছ, কিং?’

‘আমি বন্ধু হিসেবে জনিকে খুব পছন্দ করি, হেসে বলল রানা। ‘তাই জানতে চেয়েছি আসলে কীসের ব্যবসা ওর।’

‘আমিও জনিকে খুব পছন্দ করি।’

‘তোমার মনে পড়ে, যে-রাতে মারিয়া আর আমি গেলাম তোমাদের সেই ভিলায়? ওই যে, আমাদের নিয়ে গেল জনি?’

‘হ্যাঁ, মনে আছে। মাত্র ক’দিন আগের কথা।’

‘সেদিন সারাবেলা কোথায় ছিল জনি?’

‘যতটা মনে পড়ে, সারাদিন বাড়িতেই ছিল।’

অর্থাৎ, ইয়টে তখন মোরেলির ডাবলকে গুলি করার সুযোগ ছিল না কার্সনের, ভাবল রানা। এর মানে কোনভাবেই কিউলেক্স নয় সে।

‘সেদিনও লিনার সঙ্গে কথা বলেছিল জনি?’

‘লিনা?’

‘ওই যে, জনির সেক্রেটারি?’

‘ওহ্! না, মনে হয় না সেদিন কথা বলেছিল। জনি সারাদিন বাড়িতে ছিল। তারপর আমাকে নিয়ে গেল সৈকতে।’

‘তারপর?’

‘নির্জন সৈকতে রোদে শুয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলাম দু’জনে, ‘ খিলখিল করে হাসল ক্যাথি। ‘দারুণ মজা লেগেছিল।’

‘আর তার পরের দিন? ইংল্যাণ্ডে ফোন করেছিল?’

‘না, সেদিনও ফোনের কাছে ভেড়েনি।’

‘আর তারপর?’

‘এরপর সকালে বোধহয় ফোন করল মেয়েটা। মানে আজ ভোরের কথা বলছি।’

‘সেই লিনা মেয়েটা?’

‘জনি বলেছে, সে খুব ভাল মেয়ে। কাজে দক্ষ। জানো, মনে মনে ওর একটা ছবি এঁকেছি। বসে আছে এক অফিসের ডেস্কে। ব্যস্ত হয়ে গুছিয়ে নিচ্ছে ফাইল।’

মাথা দোলাল রানা।

হেসে ফেলল ক্যাথি। ‘আমি যেন নিজের চোখে দেখতে পাই, ফোনে কথা বলছে সে। মাঝে মাঝে ভাবছে আমার কথা। দু’চোখে আমাকে দেখতে পারে না।’

‘জনি আর তোমার ব্যাপারে সব জানে মেয়েটা?

‘নিশ্চয়ই। এলিনা আর আমি….’

ক্যাথির বাহু ধরল রানা। আরেকটু হলে ওর বামহাত থেকে পড়ে যেত কনিয়্যাকের কাপ।

অবাক হয়ে ওর দিকে তাকাল ক্যাথি। ‘হঠাৎ কী হলো?’

‘মেয়েটার নাম এলিনা? আগে তো তুমি বলেছিলে লিনা।’

‘একটু ছোট করে নিয়ে বলেছি। তাতে দোষ কোথায়?’

কেন যেন রানার মন বলছে, এসবের ভেতরে বড় ধরনের কোন ঝামেলা আছে। যদিও সেটা ধরতে পারছে না। লিনা আসলে এলিনা। তার সঙ্গে জনি কার্সনের কীসের সম্পর্ক?

দীর্ঘশ্বাস ফেলল ক্যাথি। ‘তুমি হঠাৎ করে কোথায় হারিয়ে গেলে?’ কৌতূহলী চোখে দেখছে রানাকে।

ধীরে মাথা নাড়ল রানা। ‘না, কিছু না।’ কনিয়্যাকের কাপ পাশের টি-পয়ে রেখে ঘুরে জড়িয়ে ধরল মেয়েটাকে।

ওর বুকে আলতো করে ঠেলা দিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল ক্যাথি। উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘একটু অপেক্ষা করো। এক্ষুণি ফিরছি।’

বাথরুমে গিয়ে ঢুকল মেয়েটা। মিনিট পাঁচেক পর ফিরল পোশাক ছাড়া। মোহিনী ভঙ্গিতে কোমর দুলিয়ে এসে বসে পড়ল রানার পাশে। পরস্পরকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠল ওরা।

ঘরে বাতি জ্বললেও সেটা নিভিয়ে দিল না কেউ।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন