ইমানুল হক
ভারতীয় শিক্ষা কাঠামোর ভেতরে যে মেকলের ভূত বাস করে তার শক্তি ত্রৈলোক্যনাথের লুল্লু ভুতের চেয়েও অনেক বেশি। তাই কমিউনিস্ট পার্টিতে মেকলেবাদ সত্য, মার্কসবাদ পরাজিত। গান্ধী তো ভোটের জন্য নামাবলী। তাঁর প্রতি মমতা কোথায়? মাঝে মাঝে যেতে হবে মূর্তির তলায় মালা দিতে। মার্কস-গান্ধী তো মহাকরণের লালবাড়ি যাওয়ার পথেই পরে। রাম আর বাম-এর খুব অমিল থাকে না।
১
ভারতের প্রচলিত শিক্ষানীতি লর্ড মেকলে শিক্ষানীতি থেকে খুব একটা সরে আসেনি। আজও মেকলে মিনিটস-এর মাধ্যমেই শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে ইংরেজি চালুর সুপারিশ করা হয়। তার কুফল আমরা আজ হারে হারে টের পাই। মেকলের পুরো নাম লর্ড টমাস ব্যাবিংটন মেকলে।
মেকলে মূলত একজন ইতিহাসবিদ। ভিক্টোরিয় যুগে তিন ধরনের ইতিহাস চর্চা চলে। রোমান্টিক, বৈজ্ঞানিক, দার্শনিক। মেকলে পরিচিত রোমান্টিক ইতিহাস চর্চাকারী হিসেবে। মেকলের বাবা জাকারি মেকলে ছিলেন উদারনৈতিক মানুষ। ক্রীতদাস প্রথার বিরোধিতা করে আর্থিক সমস্যার মুখে পড়েন। ব্যবসায় লালবাতি জ্বলে। ছেলে মেকলে কষ্ট করে কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন। ধ্রুপদী গবেষক হিসাবে তাঁর নাম ছড়ায়।
তার জীবনচরিত বৈচিত্র্যময়। আইনবিদ, সাংসদ। গভর্ণর জেনারেলের কাউন্সিল সদস্য, শিক্ষানীতি প্রণেতা (মেকলে মিনিটস, আসল নাম এডুকেশন মিনিটস), পে মাস্টার জেনারেল, সাহিত্য ও ইতিহাসবিদ এবং শিক্ষা উপদেষ্টা।
২
মেকলে ভারতের বহু বছর কাটিয়েছেন। শিক্ষা উপদেষ্টা, পরে রূপান্তরিত হন সাম্রাজ্যবাদী ইংল্যান্ডের সমরসচিব তথা যুদ্ধমন্ত্রীতে। এহেন মেকলে ভারতে যাঁরা ইংরেজ সাম্রাজ্য বিস্তারে পুরোধা ব্যক্তিত্ব সেই ক্লাইভ, হেস্টিংসদের জীবনচরিত ও সমসাময়িক ইতিবৃত্ত লিখেছেন। ইতিহাস অনুসন্ধিৎসুদের জন্য রচনাটি মনোপ্রদ।
মেকলের কিছু মন্তব্য তুলে দেওয়া হল। মেকলে-র শিক্ষানীতি অনুসরণকারী, পাঁচ বছর বয়সে ইংরেজি না জানলে নাকি শিক্ষা সম্পূর্ণ হতে পারে না, বা রবীন্দ্র সার্ধশতবর্ষে সরকারি বিদ্যালয়ে ইংরেজি মাধ্যম চালুর জন্য শিবারবে বাংলা মাত করেছেন, তাঁদের উপলব্ধির জন্য।
ক. নন্দকুমারের ফাঁসি নিয়ে বাঙালি জাতির প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে মেকলের মন্তব্য বাঙালিরা সাধারণত দ্বন্দ্ব-কলহে নারীসুলভ দুর্বলচিত্ত। কিন্তু যে দুর্বিপাকের কোনো প্রতিকার নেই, সেটা তারা নীরবে মেনে নিতে জানে।
খ. ভারতীয়দের সম্পর্কে তাঁর মন্তব্য ভারতে কাকের দল রুগ্ন শকুন পেলে ঠোকরে ঠোকরে তা যমের ঘরে পাঠিয়ে দেয়। ভারতে কোনো বড়ো মানুষ বিপদে পড়লেও তার অবস্থা দাঁড়ায় রুগ্ন শকুনের।
ভারতীয় সরকার শুধু অভিপ্রায় জ্ঞাপন করবেন যে অমুক ব্যক্তির সর্বনাশ কাম্য। কোনো কথা নেই, ঘণ্টার মধ্যে তার বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ উপস্থিত হবে, এবং অভিযোগের সপক্ষে এমন সব অবস্থা প্রমাণাদি করা হবে যে, এশীয়দের মিথ্যাচারিতা বিষয়ে যার কোনো ধারণা নেই—তার মনে হবে উক্ত প্রমাণাদি সন্দেহাতীত এবং চূড়ান্ত। হতভাগ্য ব্যক্তির স্বাক্ষর অবিশ্যি জাল করা এবং তার বাড়িতে এমন সব কাগজপত্র রেখে আসা হবে যাতে ধারণা করা চলে যে লোকটা রাজদ্রোহী।
গ. বিচারব্যবস্থা সম্পর্কে তাঁর মন্তব্য, সুপ্রিম কোর্ট তার নিজস্ব এলাকায় সরকার থেকে স্বাধীন। হেস্টিংস বিচক্ষণ ব্যক্তি, তিনি জানতেন সুপ্রিম কোর্ট ক্ষমতার দুর্গ, হাতে রাখলে একসময় কাজ দেবে। তিনি পথও চলেছেন এদিকটায় খেয়াল করে। বিচারকবৃন্দ, বিশেষ করে প্রধান বিচারপতি, কাউন্সিলের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের প্রতি ক্ষুব্ধ। এই ভয়াবহ যন্ত্র এখন ক্রিয়াশীল করার সময় এসেছে। (আমাদের দেশে আজও সরকারের বিচার ব্যবস্থাকে ব্যবহার করার প্রবণতার ইতিহাসটা লক্ষণীয়)।
ঘ. সিরাজের ইংরেজ বিরোধিতার কারণ সম্পর্কে অদ্ভুত অনৈতিহাসিক ধারণা পোষণ করেন তিনি। আর উমিচাঁদ সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি হিন্দুর দোষ ও গুণ বর্ণনা করেন এইভাবে হিন্দুর সকল গুণাবলী তাঁর মধ্যে লক্ষ্য করি। পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা, চাতুর্য, দক্ষতা, অধ্যবসায় সবই তাঁর ছিল। হিন্দুর সকল বদগুণগুলিও তিনি আয়ত্ত করেছিলেন।
ঙ. বাঙালিদের সম্পর্কে তাঁর বিশ্লেষণ : বাঙালিরা যা কিছু করে ঢিলে ঢালাভাবে করে। নিশ্চেষ্ট বসে থাকাতেই তার সকল আনন্দ। গতর খাটানোর কথা উঠলেই সে কুঁকড়ে যায়। তবে বিবাদ, বিসংবাদে তাদের বাকপটুত্ব তুলনারহিত। প্রতারণা ও ছল চাতুরিতে এদের জুড়ি অন্যত্র মেলা ভার।
চ. অন্যত্র তাঁর সংযোজন : মৌমাছির যেমন হুল, বাঙালির তেমন প্রতারণা। আর ভারতীয়দের বিদ্যাবুদ্ধি সম্পর্কে তাঁর প্রবল ব্রিটিশ আত্মম্ভরিতা—আমি এমন একজন প্রাচ্যবাদীকেও খুঁজে পাইনি যিনি অঙ্গীকার করবেন, যে, ভালো একটি ইউরোপিয়ান লাইব্রেরির একটা তাকে যা আছে তা সমগ্র ভারত এবং আরবের সমস্ত সাহিত্যেও নেই।
৩
এই ভদ্রলোকটির এই জ্ঞানটি ছিল না যে, বাঙালিদের অর্থনৈতিক প্রতিপত্তি গড়ে উঠেছিল কোন শিক্ষাবলে? পৃথিবীতে সপ্তদশ শতকে সারা পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী এলাকা ছিল অবিভক্ত বাংলা।
তিনি নিজেই লিখেছেন, ইন্ডিয়া হাউস পরিণত হয় একটা লটারি হাউসে, ফলে সবাই সুযোগ গ্রহণের কথা ভাবতে শুরু করে। যখন রটে গেল যে, পৃথিবীতে একটা অঞ্চল রয়ে গেছে, যেখানে জনৈক কর্নেল হঠাৎ উপহার হিসেবে পেয়ে যান আর্ল অব বাথ বা মারকুইস অব রকিংহাম তুল্য সম্পত্তি, যখন রটে যায় যে কোনো ব্রিটিশ কর্মকর্তা যাঞ্চা করা মাত্র পেয়ে যায় দশ বা বিশ হাজার পাউন্ড, তখন সমাজে একটা আন্দোলন শুরু হয়, জ্বরাভাবে আক্রান্ত হয় সবাই, সবাই চায় রাতারাতি ধনবান হতে।
কোনো শিক্ষা, উন্নত বিজ্ঞানশীলতা ছাড়া কি সমাজের আর্থিক উন্নতি হতে পারে। বাংলা ছিল এক শিল্প ও কৃষিতে উন্নত এক অঞ্চল। সে উন্নতি এসেছিল গণশিক্ষার হাত ধরে। আমাদের শুভঙ্করী গণিত, আজকের অক্সফোর্ড গবেষণায় প্রমাণ করেছে, জমিজমা মাপের জন্য মেট্রিক পদ্ধতির চেয়ে ঢের উন্নত ছিল।
আর আরব সম্পর্কে যেটুকু বলতে হয়, বীজগণিতের জন্ম আরবে। আল খওয়ারজিমি বীজগণিতের উদ্গাতা। ওয়ান, টু, থ্রি, ফোর বলে যে সব সংখ্যাকে আমরা ইংরিজি বলে জানি, সেগুলি আসলে আরবি। কবিতার জন্মও আরবে। পৃথিবীর প্রথম গদ্য গ্রন্থ—আল কোরান-এর সৃষ্টি আরবে। ক্রীতদাস প্রথার মুক্তি আরবে। নারী স্বাধীনতার সূত্রপাত এখানে। কন্যা সম্পত্তির মালিক হয় প্রথম আরব-এ।
প্রথম হরফের জন্ম মিশরে। প্রথম প্যাপিরাস তথা পাণ্ডুলিপি, বর্ষপঞ্জি, বই, বাজার, চা-চক্র, কফি-হাউস প্রথা, দরজায় পর্দা ঝোলানো—এসবের সূতিকাগার আরবভূমি।
মেকলে বোধহয় বাংলার সম্পদের গর্বে বিজ্ঞান ও শিল্পে স্ফীত হয়ে দম্ভোক্তি করতে শিখেছেন।
৪
হেস্টিংস সম্পর্কিত মেকলের লেখার শিরোনাম : ভারতে হেস্টিংস ইংল্যান্ডে তার বিচার।
সকলে জানেন, হেস্টিংসের বিচারে প্রখ্যাত বাগ্মী ও লেখক এডমন্ড বার্ক কী ভূমিকা নিয়েছিলেন।
আট বছর ধরে ইংল্যান্ডের হেস্টিংসের বিচার চলে। এডমন্ড বার্ক ছিলেন প্রধান অভিযোক্তা। ভারতে কীভাবে অন্যায় শাসন চালিয়েছেন হেস্টিংস তার দীর্ঘ প্রতিবেদন পেশ করেন বার্ক।
হেস্টিংসের পক্ষ সমর্থনকারীদের একটি যুক্তি ইংল্যান্ডে সাড়া জাগায়। বেনারসে, যেখানে রাজা চৈত্য সিং-এর প্রতি তীব্র অন্যায় সাধিত হয়, সেখানকার ব্রাহ্মণরা হেস্টিংসের নামে একটি মন্দির নির্মাণ করেছেন। এটা জেনে সভার মত প্রভাবিত হয়, হেস্টিংসের পক্ষে সহানুভূতির হাওয়া বয়। এডমন্ড বার্ক ভারত ও ভারতীয় সমাজ, ধর্ম, সংস্কৃতি সম্পর্কে প্রচুর পড়াশোনা করেছিলেন। তিনি এর চমৎকার জবাব দেন। বলেন, ব্রাহ্মণ কোনও দেবতার পূজা করে অনুরাগ থেকে, কোনও দেবতার পূজা করে বিরাগ থেকে। আলোক ও সূর্য দেবতার মন্দির গড়ে অনুরাগে, আর গুটি বসন্ত ও খুন-খারাপির অপদেবতার মন্দির গড়ে সন্তুষ্ট করতে। হেস্টিংস একজন অপদেবতা। হাউস অব কমনস এমন জবাব পেয়ে চমৎকৃত ও বিস্মিত হয়।
৫
মিথ্যার বেসাতি করবে না, তবু তারা জয়ী হবে অন্যায়ভাবে। লেডি ম্যাকবেথ।
মমতার যে পূজা করছে লোকে সেটা কি অপদেবতার পূজা? এটা জানা ও বোঝার আগে আমাদের একটু ইতিহাস ঘাঁটা জরুরি।
ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠা হয় ১৯২০ খিস্টাব্দে তাসখন্দে। ১৯২১ থেকে ১৯২৪-এর মধ্যে চারটি ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করে ব্রিটিশ সরকার। প্রথম ও দ্বিতীয় পেশোয়ার ষড়যন্ত্র মামলা, মস্কো ষড়যন্ত্র মামলা এবং কানপুর বলশেভিক ষড়যন্ত্র মামলা। ১৭ মার্চ ১৯২৪ কানপুর ষড়যন্ত্র মামলায় দোষী সাব্যস্ত হন মানবেন্দ্রনাথ রায়, মুজফফর আহমেদ, এস এন ডাঙ্গে, শওকত ওসমান, সিঙ্গারাভেলু, চেট্টিয়ার, গোলাম হোসেন এবং আর সি শর্মা।
এরপর ১৯২৫-এর ডিসেম্বরে কানপুরে অনুষ্ঠিত হয় পার্টির সম্মেলন। সম্মেলনের অন্যতম আয়োজক ছিলেন সত্যভক্ত। তিনি সম্মেলন পরিত্যাগ করেন, তাঁর কথা না শোনায়। তাঁর দাবি ছিল, জাতীয়তাবাদী কমিউনিজম।
আজকাল মাঝে মাঝে মনে হয়, কমিউনিস্ট পার্টিগুলি জাতীয়তাবাদী হয়ে উঠেছে। কারগিল যুদ্ধ, পরমাণু বোমা বিস্ফোরণ প্রশ্নে ভূমিকা দেখে। আবার বাবরি মসজিদ—রামমন্দির প্রশ্নে তাঁদের ইতিহাস চেতনা ভোট বাক্সের দিকে এতদূর লক্ষ্য রাখে যে, ধর্মনিরপেক্ষ মানুষও ভয় পেয়ে যান—তফাত কোথায়? পুরাণ ইতিহাস হল কবে?
পুরাণ প্রতিমা মামলার পক্ষ? আদালত পঞ্চায়েত হয়ে যায়—আর সবাই বলেন, আহা দারুণ শান্তি সহাবস্থান।
৬
১৯৪২-এর কমিউনিস্ট পার্টি পড়ে এক অদ্ভুত সংকটে। একদিকে ব্রিটিশ ‘ভারত ছাড়ো’ এই আওয়াজ, অন্যদিকে জনযুদ্ধের নীতি অনুযায়ী ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে সহযোগিতার নীতি পরিপোষণা। মধ্যবিত্ত আবেগ থেকে পার্টি যা করার তাই করে। বাড়াবাড়ি করে। ব্রিটিশদের সঙ্গে সহযোগিতায়। ফলে বিচ্ছিন্নতা বাড়ে। কেউ কেউ নেতাজিকে ‘তোজোর কুকুর’ বলে বসেন। লোকে রেগে গেলেও কিছু করার নেই। ফ্যাসিবাদীদের সাহায্যে ব্রিটিশ বিতাড়নের চিন্তা ছিল ভুল। তা বলে নেতাজিকে ‘তেজোর কুকুর’ বলা মারাত্মক প্রমাদ। অবশ্য মধ্যবিত্ত পরিচালিত পার্টি কোনও সংকটে ঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে? বাড়াবাড়ি করেছে। নিজে ডুবেছে। ডুবিয়েছে তার অগণিত সমর্থকদেরও।
১৯৪২, ১৯৪৯, ১৯৬৪, ১৯৭৪, ১৯৭৯, ১৯৯৬, ২০০৭—প্রতিটি ক্ষেত্রেই একবগ্গা নীতি বিপদ ঘটিয়েছে। ১৯৪৯-এ ‘ঝুটা আজাদি’ শ্লোগান ভুল ছিল না। কিন্তু জনগণকে বাদ দিয়ে এক অ্যাডভেঞ্চারিজম সর্বনাশ ডেকেছে। চিন-ভারত যুদ্ধে চিন আক্রমণকারী বলে ডাঙ্গেপন্থীরা ভুল করেছেন, কমরেডদের সরিয়ে দিয়েছেন। ১৯৭৪-এ ইন্দিরা গান্ধীকে আধা ফ্যাসিস্ত ঘোষণা করে জয়প্রকাশ নারায়ণের হাত ধরে ফ্যাসিস্ত জনসঙ্ঘীদের (পরবর্তীকালের বিজেপি) সঙ্গে যৌথ আন্দোলনে যাওয়া, বা ১৯৭৯-তে চরণ সিং-এর সরকার গঠনে সহায়তা প্রদান মারাত্মক ভুল।
১৯৮৯-এ একই ভুল। রাজীব গান্ধীর জনবিরোধী নীতির বিরোধিতা করতে গিয়ে বিজেপি-র সঙ্গে পরোক্ষ সঙ্গ দিয়ে ভি পি সিংয়ের সরকার গঠনে সাহায্য করা আর এক মহা প্রমাদ। যদিও ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, ভারতের সর্বকালের সেরা ধর্মনিরপেক্ষ প্রধানমন্ত্রীদের অন্যতম বিশ্বনাথপ্রতাপ সিং। সামাজিক ন্যায়ের যে আন্দোলন বাস্তবায়িত হয়েছে এবং হচ্ছে তাতে বিশ্বনাথ প্রতাপের অবদান আম্বেদকরের পরেই।
১৯৯৬-এ সি পি এম, সি পি আই (এম) হতে চাইল না। নিজেদের সম্পর্কে অতি ধারণা (আমরা কমিউনিস্ট) জ্যোতি বসুকে প্রধানমন্ত্রী হতে দিল না। দিলে ভারত এবং কমিউনিস্ট পার্টির চেহারাটাই পাল্টে যেত। বিজেপির এই উত্থান ঘটত না।
ভূমি সংস্কার, ক্ষেত মজুর, শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি, বিনা বেতনে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার সুযোগ, প্রাথমিকে ইংরেজি না রাখা, পঞ্চায়েতি ব্যবস্থা—যা করেছিল সি পি এম, তা দিয়ে বাকি ভারতকে একটা বার্তা পাঠাতে পারত। আর ১৯৯৬-এ বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য মুখ্যমন্ত্রী হলে এত টাটাপ্রেমী-ও হতেন না।
তখনকার বাস্তবতা ছিল আলাদা। পার্টিটা এতটা কর্তাভজা হয়ে যায়নি। একটা কথা না লিখে পারা যাচ্ছে না, অনিল বিশ্বাস মানুষ হিসাবে ভালো হলেও পার্টি পরিচালনার পদ্ধতি পার্টির সাড়ে সর্বনাশ করেছে। পার্টির মিটিংগুলি আনুষ্ঠানিক হয়ে যায়। দু-তিন জনে মিলে সিদ্ধান্ত নিয়ে পার্টির মিটিংগুলোকে রিপোর্টিং কেন্দ্রে রূপান্তরিত করেন তিনি।
যৌথ নেতৃত্ব ছাড়া কমিউনিস্ট পার্টি থাকতে পারে নাকি। তবে, এটা একা অনিল বিশ্বাসের দোষ নয়। পার্টিকে গণপার্টি করে তোলার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন প্রমোদ দাশগুপ্ত তা পার্টির ব্যক্তিকেন্দ্রিকতার একটা বড়ো কারণ। এক দশক পরে ২০০৬-এ সিঙ্গুরে টাটাপ্রীতি ভোট ভীতির কারণ হয়ে দাঁড়াল। আসলে মেকলে প্রভাবিত শিক্ষানীতি ভেতরে ভেতরে একটা কথা খুব ভালো করে চারিয়ে দেয়—তুমি শিক্ষিত, তুমি ইংরেজি জানো, তুমি কর্ত,ত্বের অধিকারী, কৃষক শ্রমিক ওরা তোমার মুখাপেক্ষী। আর মার্কস এঙ্গেলস-লেনিন-স্তালিন-মাও শেখান, ওরাই তোমার নেতা। ওরা বিপ্লব করবে তোমরা হবে সহযোগী শক্তি। কিন্তু ভারতীয় ব্যবস্থায় মেকলে-ই জেতেন, মার্কস পরাজিত।
তাই ২০০৬-এর নির্বাচনে নির্বাচন কমিশন ও মমতা-র সৌজন্যে নির্বাচন জিতে কারও কারও মনে হল এটা শিল্পায়নের জন্য জনাদেশ, তাই সহাস্য সাক্ষাৎকার, জীবনের সেরা দিন ঘোষণা—টাটা মউ দিনকে। অথচ মানুষ জানিয়ে দিয়েছিলেন, তাঁরা কৃষিজমি দেওয়া চান না। যে দু-জায়গায় জমি নেওয়ার কথা হয়েছিল, সেই দু’জায়গাতেই হার। ভাঙ্গড় এবং সিঙ্গুর।
৭
সিঙ্গুরেই ছিল সিঁদুরে মেঘ। তা কালবৈশাখী হল নন্দীগ্রামে। সালিম সেলাম ঠুকতে গিয়ে সিদ্দিকউল্লাহর দলের হাত ধরে মমতার উত্থান। রাজনীতিতে আদর্শের সঙ্গে অর্থ ও পেশিশক্তি লাগে তা সিদ্দিকউল্লাহের বোঝার আগে অধিকারী পরিবার বুঝে যান।
গলার স্বর-ও বদলে গিয়েছিল অনেকের। মাথাও ঠিক থাকছিল না মিডিয়ার প্রচার পেয়ে। বুদ্ধকে ব্র্যান্ড বানিয়ে ডুবিয়েছিল। সিদ্দিকউল্লাহ-ও সেই গুরুত্ব পেলেন না। তবে সাচার কমিশনের সুপারিশ আর সিদ্দিকউল্লাহ-র হুঙ্কারে বাংলার সংখ্যালঘু নতুন স্বর পেয়েছেন। তাতে সর্বনাশ হল সি পি এমের। কেউ যদি থামাতেন বুদ্ধবাবুদের, কাজ হত। কিন্তু কে থামাবে? ইয়েচুরি কারাত কারও সে শক্তি নেই। গৌতম দেব জ্যোতি বসুকে দিয়ে একটা চেষ্টা করিয়েছিলেন, যাতে রাজ্যে শিল্পায়ন হয় এবং বিরোধী ও সরকার পক্ষ একজোট হয়ে কাজ করে। তা ভেস্তে দেওয়া হয় সুভাষ চক্রবর্তীকে হাতিয়ার করে।
মহাজাতি সদনে বৈঠক ভাঙল। বাংলার বাম রাজনীতির সাড়ে সর্বনাশ শুরু সেদিন।
৮
মমতার রাজনীতিতে প্রবেশ সত্তর দশকে। সত্তর দশকেই পরিচিত পান। দ্য টেলিগ্রাফ লিখেছিল, প্রয়োজনে প্রতিবেশিনীর বাড়ির সঙ্গে ঝগড়াও করতে পারতেন। ১৯৭০-এর শুরুতে স্থানীয় নেত্রী হিসাবে রাজনীতি শুরু। জন্ম ১৯৫৫-য় ৫ জানুয়ারি। আইন পড়েছেন যোগেশচন্দ্র আইন কলেজে। বি এড শ্রী শিক্ষায়তনে। এম এ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ১৯৭৬ সালে হন প্রদেশ মহিলা কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদিকা। ১৯৮০ পর্যন্ত ওই পদে ছিলেন। ১৯৮৪-তে ইন্দিরা হাওয়ায় সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের পরাজয়ে লোকসভা যাত্রা। লালু আলম মাথা না ফাটালে মমতার কপাল এত খুলত কিনা কে জানে?
আর মমতাকে মুখ্যমন্ত্রীর সার্থক স্বপ্ন দেখাতে শুরু করলেন বুদ্ধবাবু। এককালে লিখেছিলাম, আলিমুদ্দিনে মমতার ছবি টাঙানো দরকার, এখন কালিঘাটের আরাধ্য বুদ্ধ।
৯
তবে সকলেই তো মেকলের সন্তান। যেমন দেবা তেমনি দেবী। মমতারও মাথা ঘুরে গেছে। মাওবাদীরা সরে গেছে মাও সে তুঙ-এর নীতি থেকে। ব্রিটিশরা ছাড়া এত আদিবাসী হত্যা আর কেউ বাংলায় করেনি। প্রতিদিন গরিব আদিবাসীদের হত্যা করে চলেছেন অ-আদিবাসী নেতাদের নির্দেশে।
নয়াকৃষ্ণ কার বাঁশি বাজাচ্ছেন, তারাই ভালো জানেন। মমতার মাও প্রীতি তার ক্ষতি ডেকে আনছে। আবার গুরুংদের জন্য তার মমতা স্বস্তিদায়ক নয়। মাওমাতা গুরুং-এর যত দিদিগিরি করবেন, তত সি পি এমের লাভ। পুরোনো নকশালপন্থীরা, বামপন্থীদের একটা অংশ মমতাকে পেটি বুর্জোয়া মনে করতেন, মনে করতেন সি পি এমের ঔদ্ধত্য থেকে মুক্তি এনে দেবেন। তাঁদের কারও কারও মোহভঙ্গ হয়েছে, হচ্ছে।
এঁরা সেই দশ শতাংশ যাঁরা সি পি এম ছেড়ে মমতার দিকে ঢলেছিলেন। সংখ্যালঘুরা আর আগের মতো মমতাময়ী নন। বিশেষত বাবরি রায়ের পর তাঁর হিরন্ময় নীরবতা। তবে শহরে গরিব মানুষের একটা বড় অংশ এখনো মমতাকে দিদি বলে ভাবে। যেখানে ক্ষমতায় এসেছে দিদিমণির দল সেখানে মানুষ দাদাগিরির ঠেলায় উল্টো পথ ভাবছেন, কিন্তু যেখানে এখনো সি পি এম—সেখানে অন্য স্বর।
১০
তবে হাওয়া একটু থমকেছে। নাট্যকাররাও টের পাচ্ছেন মঞ্চ তত ভালো নয়। সামান্য বিরোধিতা-ও সহ্য হচ্ছে না, নয়া প্রভুদের। শিল্পী বুঝেছেন, সব শুভ নয়। অনেকেই ব্রাত্য। সুমন নিয়ে চলবে না। প্রতিদিন যমের দরবারে নচিকেতা-ই যেতে পারেন। তাই আনন্দ একটু কম। আর আপাতত ভোট এখন শাঁখের করাত। মমতার ভয়ে সি পি এম একটু ভালো হয়েছে বা হওয়ার ভান করছে। মমতা ভয় না থাকলে কি করবে বলা মুশকিল। তবে দিদিমণি একাই একশো।
কোন কাগজের কে সম্পাদক হবেন, তাও কেউ কেউ ঠিক করে দিচ্ছেন। গোল্ডমেয়ার, সিরিমাভো বন্দর নায়েক, ইন্দিরা গান্ধী, মার্গারেট থ্যাচার, বেনজির ভুট্টো, খালেদা জিয়া, হাসিনা, জয়ললিতা, মায়াবতী—সব মহিলা নেত্রী-ই দলের একমাত্র পুরুষ এবং নারী—তাঁরাই।
মমতাদেবী-ও তার ব্যতিক্রম নন। আর সোনিয়া? তাঁর একটু পালিশ আছে।
১১
মেকলে লিখেছিলেন, বাঙালিরা সাধারণত দ্বন্দ্ব-কলহে নারীসুলভ দুর্বল চিত্ত, কিন্তু যে দুর্বিপাকের কোনো প্রতিকার নেই, সেটা তারা নীরবে মেনে নিতে জানে। যে বাঙালিকে মেকলে চিনতেন, তারা বাবুশ্রেণি। বাঙালি কৃষক-শ্রমিকদের তো তিনি চিনতেন না। এটাই যা ভরসা। মার্কস ভবিষ্যতে এ-কারণে জিতে যাবেন বলেই মনে হয়। সে অবশ্য আজ বা কাল নয়। পরশুর অন্য প্রভাতের গল্প।
ক্ষমতার বড় দায়, জাত থাকার কি উপায়? এ নামেই হয়তো একটা বই টেকচাঁদ ঠাকুর লিখে ফেলতেন। ক্ষমতার প্রতি মমতা থাকবে—আবার আদর্শ রক্ষা হবে, এও কি সম্ভব? হয়তো সম্ভব, কিন্তু বিধি বাম বুদ্ধের প্রতি। তাই শেষরক্ষা হয় না। বুদ্ধ মানুষটি আর্থিক বিষয়ে সৎ, মার্কসবাদ নিয়ে এককালে পড়াশোনাও করেছেন, কিন্তু মার্কসবাদের মূল কথা বিস্মৃত হয়ে পুঁজিবাদের শরণাপন্ন হয়ে নিজে ডুবেছেন, দলকেও ডোবাচ্ছেন। আর দলের অবস্থা ক্রুশ্চেভের গল্পের মতো। সবাই আড়ালে প্রশ্ন করবেন, কিন্তু সামনে সবাই অসম্ভব ভাল মানুষ। চৈতন্যদেব নিজেও জানতেন না, একুশ শতকের পশ্চিমবঙ্গে তাঁর বিপুল ভক্তবাহিনী হাত তুলে অপেক্ষমান। কেউ কেউ আবার কণিষ্কও। নিজেরা যত না, অন্যকে কণিষ্ক বানাতে বেশি তৎপর নয় বামেরা। আর কেন না জানে, কালাপাহাড়রা চিরকাল—বাঁশের চেয়ে কঞ্চি দড়, নীতিকে সার্থক প্রমাণ করতে ব্যগ্র।
মমতার প্রসিদ্ধি ছিল, তাঁর সুখ্যাত অস্থিরমতিত্বের জন্য। কিন্তু গত ২০০৬—২০১১ থেকে মমতা অদ্ভুতভাবে সুলভ আচরণ করেছেন। কারা তাঁর পরামর্শদাতা জানি না, কিন্তু তাতে বামপন্থী ঘরানার ছাপ স্পষ্ট। এ ঘরানাটা নকশালি ঘরানা নয়, ঠিক ঠাক বলতে গেলে সি পি এম ঘরানা। আরও ঠিক ঠাক হবে যদি বলা হয়, সি পি আই (এম) ঘরানা। সি পি আই (এম) যখন সি পি (এম) কংগ্রেস পার্টি (মডিফায়েড) হয়নি সেই সময়কার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দেখানোর কমিউনিস্ট ঘরানাটা অসম্ভব আয়ত্ত করেছেন মমতা।
যেখানে কোনো ঘটনা সেখানে রাতে-বিরেতে ছুটে যাচ্ছেন। ভুল না ঠিক পরের কথা, কিন্তু ছুটছেন মমতা।
সিঙ্গুর থেকে টাটার বাই বাই করে চলে যাওয়াটার সুফল সি পি এম নিতে পারেনি। অথচ রাজ্য জুড়ে ‘সিমপ্যাথি ওয়েভ’ তৈরি হয়েছিল। এক মহিলার কালো পতাকা রাজ্য জুড়ে লক্ষ পতাকা হয়নি, সি পি এমের ক্লাবসুলভ আচরণের জন্য। সবাই সবাইকে টেক্কা দিতে ব্যস্ত। কিন্তু মমতাকে টেক্কা দেবে কে? সে ব্যাপারে কেউ নেই।
প্রথমত, সিঙ্গুরে না করে ৩০ কিমি দূরে বর্ধমান জেলার কোন এলাকায় করলে এত ঝক্কি পোয়াতে হত না সি পি এম-কে। এমন নয় যে-কোনও ঝামেলা হত না। হতো হয়তো, কিন্তু সামলানোর ক্ষমতা বর্ধমান জেলা সি পি এম-এর ছিল। হুগলির ওই এলাকাটিতে সি পি এম অবস্থানগতভাবে দুর্বল। তারপর আছে অন্তর্দ্বন্দ্ব। সুহৃদ দত্তকে ফাঁসানো হয়েছে—এ বিশ্বাস কোন অবাস্তব কল্পনা নয়। মমতা সার্থকভাবে নানা মহলকে ব্যবহার করতে পেরেছেন—সি পি এম তা পারেনি। আর লালগড় সবুজ গড় হতে পেরেছিল পরিকল্পনাগত ভুলের জন্য। আদিবাসীরা বরাবরের সি পি এম সমর্থক। কেন তাঁরা ক্ষুব্ধ—তার কারণ অনুসন্ধান না করেই তাঁদের ‘দেখে নেব’ ভাব করে শত্রু বানিয়ে দেওয়া হল।
আর শেষ পর্যন্ত এঁরা ভিড়লেন মমতার শিবিরে। মুসলমানরা কংগ্রেসের মুসলিম বিরোধী আচরণের জন্য ধর্মনিরপেক্ষ সি পি এম-এ আশ্রয় নিয়েছিল। তাঁদের জঙ্গির সঙ্গে সমার্থক করে দেয় বুদ্ধ প্রশাসনের একাংশ। শাসন প্রধানকে অনেকেই সেকুলার মনে করেন না। সংখ্যালঘুরা শুধু বঞ্চিত তাই নয়, যাঁরা কোনওভাবে চাকরি পেয়েছেন, তাঁদের নানাভাবে নাকাল করতে চায় কিন্তু লোক।
সি পি এম রাজ্যকে সন্দেহ নেই, ধর্মনিরপেক্ষতার পাঠ দিয়েছিল। ১৯৯৯ থেকে নতুন প্রবণতা এল। কার্গিল যুদ্ধের সময় বহু উচ্চশিক্ষিত এবং ব্যবসায়ী নাকাল হল। কথায় কথায় একটু বিদ্রোহী হলেই আই এস আই চর বা অন্য কোন বদনাম দিয়ে দেওয়া হতে লাগল। অনেকটা হুইসপারিং ক্যাম্পেন করে।
কলকাতা পুরসভা ২০০৫-এ মমতা নির্বুদ্ধিতা করে সি পি এম-এর হাতে তুলে দিয়েছিলেন। মমতাকে মহাকরণে না বসিয়ে থামেননি কিছু সি পি এম নেতা। যত না তৃণমূল বিরোধিতা তার থেকে অনেক বেশি সময় নিজেদের লোককে কাঠি দিতে ব্যস্ত এরা।
ক্ষমতার কিছু আঠা থাকে। কে নিজেদের মতাদর্শে বিশ্বাসী সেটা না বুঝেই, অথবা তাঁকে প্রতিদ্বন্দ্বী ভেবে সরিয়ে দেওয়ার জন্য নানান আয়োজন। পুরসভা এসেছিল রুপোর থালায়। মহাকরণ সোনার থালায় সাজিয়ে কালিঘাটে পাঠানো হয় রাজ্যে।
২০০৯—২০১১ দেশে মার্কিনি ছায়ার সন্ধান পান অনেকে।
করোনা আক্রান্ত সময়ে আমেরিকাকে চেনা জরুরি।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন