সংবাদ মূলত…

ইমানুল হক

সংবাদ মূলত কুয়াশা। কাব্য আর নেই। কাব্যের নানা ব্যঞ্জনা থাকে। বোধের সঙ্গে বোধির শবদে শবদে বিয়া দিয়া, হৃদয়ের সঙ্গে মস্তিষ্কের, যুক্তির সঙ্গে কল্পনার অতিকথনে মেশানোর আর্তি থাকে শব্দ প্রতিমা, চিত্রকল্প, উপমা, রূপক ইত্যাদির আড়ালে। এখন সংবাদকে ঝিরঝিরে বৃষ্টিও ভাবতে পারেন রসজ্ঞ পাঠক, কিন্তু সে বৃষ্টি সোমবারের শীতের সকালের, অফিস যাওয়ার তাড়ায় ছাতা ভুলে ভিজে থাকার বৃষ্টি। সংবাদ যত না জানায় তার চেয়ে বেশি ভুল জানায়। খবর এবং খাবার দুই গিলি আমরা। ডাইনিং আছে আমাদের পড়ার ঘর নেই। ডাইনিংয়ে থাকে (অ) দূরদর্শন এবং ভিন্ন রুচির খাবারের সমাহার। দুই-ই গিলি। তবুও তারও মাঝে এসে পড়ে ঝড় বাতাসের মতো বিক্ষুব্ধ খবরের সুনামি। যাকে আড়াল করতে চেয়েও করা যায় না। মিডিয়া মুঘল পারেন না, ভারতের মিডিয়া সম্রাট আম্বানির বিশ্বস্ত (রি)-পোর্টার তথা সং-বাদ কুলিরাও নয়।

গত এক বছরে কত কী ঘটে গেল দেশ বিদেশ রাজ্যে। ভোট গোনা বাকি রেখেই নির্বাচিত ঘোষণা করা হয়েছিল বুশকে। ট্রাম্পকেও তাই। বছরের শুরুতেই বিশেষজ্ঞদের বিশেষ অজ্ঞ প্রমাণ করে যুদ্ধ যুদ্ধ বাজারের খেলাতেই নামলেন তিনি। মুসলিম আতঙ্কের জিগির তুলে আসা ঠেকালেন মুসলিম ভিসা ও চাকরি প্রার্থীদের। তাঁর বিদ্বেষবহ্নিতে প্রাণ গেল পাঁচ ভারতীয়। তার অনুগত সেবক যিনি কথায় টুইটার করে বসেন, একটি বাক্য-ও উচ্চারণের সময় পেলেন না। বিদেশ ভ্রমণ ও বিদ্বেষ উদ্গার অব্যাহত, ব্যাহত শুধু দেশের মানুষের জীবনধারা। নোটবন্দিতে নট হয়ে গিয়েছিল বহু মানুষের জীবন। ৫০ দিনের অপেক্ষা ৪০০ দিনেও মেটেনি। তার দোসর হয়ে এসেছে জিএসটি। বাম-তৃণ-বিজেপি সব ধরনের ছোট-বড় অর্থমন্ত্রীর অর্থহীন কাজে নাভিশ্বাস ছোট ও মাঝারি উদ্যোগের। ২০১৭-র সর্ববৃহৎ ‘পাওনা’ বিপুল বাজার দর। ৪০ টাকার নীচে কোন সবজি নেই। চাল ডাল গম মাছ মাংস সব হাতের নাগালের বাইরে। গরিব মানুষ অপুষ্টিতে ভুগছেন। দেশ দুর্নীতি অনাহার অনাচার অসহিষ্ণুতা—সব বিশ্ব নিরীক্ষাতেই পিছনের দিক থেকে সামনে। অবশ্য এখন বাসের মতো পিছন দিকে এগিয়ে যাওয়াই দস্তুর। আলাউদ্দিন খিলজির নাম সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের জন্য পদ্মাবতী সূত্রে শোনা যাচ্ছে—কিন্তু আলাউদ্দিন খিলজি বাজার দর বেঁধে দেওয়ার ফলে যে প্রায় ৬০০ বছর জিনিসের দাম বাড়েনি—সে তথ্য সংবাদ বাহিত হচ্ছে না—কোন পক্ষ থেকেই। এখন অনেকেই শুনে পণ্ডিত—তার থেকে বেশি হাবেভাবে দেখনদারিতে। ‘পদুমাবতে’-র বঙ্গীকরণ করেছিলেন দৌলত কাজী এবং আলাওল—যাঁরা জন্ম দিয়েছিলেন এই বাংলায় প্রথম অসাম্প্রদায়িক কাব্যধারার, রোসাঙ্গের মাটিতে বসে। সেখানে আজ রোহিঙ্গা বিতাড়নের অবর্ণনীয় নারকীয় অত্যাচার। আর সমাজ মেতে রয়েছে ধূলাগড়ে, বাদুড়িয়া আর বসিরহাটে।।

মনের মধ্যে উঠেছে দেওয়াল। তাই অপর-কে, ভিন্ন মতকে ভাশুর ভাদ্র বৌ সকলেই ঠাঁই দিতে নারাজ। ইজরায়েল-আমেরিকার মদতে গড়ে ওঠা আল কায়দা এবং আইসিস/আইসিল—ইরাকের তৈলক্ষেত্র, পুরোনো স্থাপত্য, ৮০০ বছরের প্রাচীন মসুল মসজিদ ধ্বংস করে কমিউনিস্ট কুর্দ গেরিলাদের নারী বাহিনীর হাতে বিপর্যস্ত হয়ে আপাতত সৌদি-ইজরায়েল-মার্কিন মদতে সিরিয়ায় ঘাঁটি গাড়ার চেষ্টায় তীব্রভাবে রত। সমাজবাদী আসাদ রাশিয়ার সহযোগিতায় তাঁদের বাড়াভাতে ছাই দিয়েছেন। তাতে মুসলিম মৌলবাদী, হিন্দু মৌলবাদী, খ্রিস্টান মৌলবাদী—সবার গোঁসা। কমিউনিজম—সাম্যবাদ উচ্চারণে ভালো। জীবনযাপনে নয়। অতএব তীব্র কুৎসা ও অপপ্রচার নিরন্তর। তবু হণ্ডুরাস, ভেনেজুয়েলায় বামপন্থীরা। ফ্রান্সে, হল্যান্ডে—মধ্যপন্থা।

হোপ ওভার হেট—ঘৃণা নয় আশা জিতেছে হল্যান্ডে। দেশে উত্তরপ্রদেশে বিদ্বেষ বিভাজন বিদেশি আতঙ্ক আর বিস্ফোরণের খেলা খেলে ইভিএম জাদুর পরশে মিডিয়ার সোল্লাস হরষে জিতেছে বিজেপি। যোগী সমাসীন সিংহাসনে। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশের বাসভবন ধোয়া হয়েছে দমকল-এ করে দুধ দিয়ে ভাসিয়ে। একা গঙ্গাজল পারেনি শুদ্ধতা রক্ষা। প্রশাসনের হাল এমন রোমিও ঠেকাতে এমন দাওয়ায় স্বামী-স্ত্রীর রাস্তায় বের হওয়া দায়। গোমাংস শুধু নয় মাছ মাংস খাওয়াও বন্ধ হয়ে গিয়েছে উত্তরপ্রদেশের বহু এলাকায়। শুধু অক্সিজেনের অভাবে মারা গেল ৪০০-র বেশি শিশু। সব মিলিয়ে এক হাজার শিশু মারা গেছেন চিকিৎসার অভাবে উত্তরপ্রদেশে। ১০০৩টির বেশি ধর্ষণ হয়েছে উত্তরপ্রদেশে, ৮৬২ জন খুন। থানায় ঢুকে হিন্দু যুব বাহিনী ও তাঁদের মদতপুষ্টরা খুন করেছে পাঁচ জন পুলিশ অফিসারকে। সবক শেখাতে। সবক ভালোই শিখেছে।

বিজেপি রাজ্যের পুলিশ? রাজস্থানে পেহলু খানকে খুন করে ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। শেখাতে, শিক্ষা দিতে। শিক্ষার জেরে ৫৬ জন নিহত। গণপিটুনিতে। তার মধ্যে এই রাজ্যের তিন জন। কিন্তু কোথাও কিছু ঘটেনি ভাব। কারণ—ওরা মুসলিম, এবং কে না জানে মুসলিম মানেই দুর্বৃত্ত। অতএব অল কোয়ায়েট অন অল ফ্রন্ট—বাম টু ডান। ‘লাভ জিহাদে’-র তত্ত্ব এসেছিল কেরালায় ২০০৯-এ। একটিও আদালতে প্রমাণিত নয়। দেশে বিজেপি-র পূর্বসূরী জনসঙ্ঘ এবং কংগ্রেসের কিছু ধর্মান্ধের বাধা সত্ত্বেও বিশেষ বিবাহ আইন পাস হয়েছিল পাস হয়েছিল নেহরুর প্রধানমন্ত্রিত্বে, আম্বেদকরের প্রণোদনায়। সে আইন মানছে না কেরালা হাইকোর্ট এমনকী অংশত সুপ্রিম কোর্টও। হাদিয়া ২৪ বছরের যুবতী। সে স্বামীর ঘরে থাকতে চায়। তাঁর পরিবার এমনকী আদালত-ও নারাজ। সুখের খবরও আছে—সুপ্রিম কোর্ট চলতে থাকা এক অমানবিক প্রথা তিন তালাক বাতিল করেছে। পশু (পড়ুন গরু) বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞায় স্থগিতাদেশ দিয়েছে। কিন্তু কৃষকদের ঋণ মকুবের প্রস্তাবে সম্মতি দিতে ভুলে গেছে।

আদালত না থাকলেও জনতার আদালত প্রত্যাখ্যাত হতে শুরু করে বিজেপি ২০১৭-তে। উত্তরপ্রদেশ ইভিএম সৌজন্যে ১৪ মহানাগরিক পদে জিতলেও তাদের ৪৫ শতাংশ প্রার্থীর জামানত বাজেয়াপ্ত। সাম্প্রতিক প্রায় সব উপনির্বাচনে হারছে বিজেপি। মণিপুর, গোয়ার কায়দায় হেরেও জিতে যাওয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু বিহারে মুখ্যমন্ত্রী পদে নীতিশ নীতিহীনতার চূড়ান্ত নজির স্থাপন করে বিজেপির সঙ্গে হাত মিলিয়ে নিজের দুর্নীতি থেকে কিছুদিনের জন্য বেঁচেছেন। মুঘলসরাই নাম পালটে দেওয়া হয়েছে। দর্শনে দীনরা ধর্ষণে ভালোই পারঙ্গম। তাই নাম ধাম জীবনদর্শন—সব ধর্ষিত। গোমাংস খাওয়ার অপরাধে মায়ের সামনে মেয়েকে ধর্ষণ করা হয়েছে। রামমন্দিরের ধুয়ো আবার উঠেছে গুজরাত নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে। যদিও রাজ্যসভা নির্বাচনে আহমেদ প্যাটেলকে ঠেকাতে নোটের গোছা ঠেকিয়ে কিছু কংগ্রেস নেতাকে ম্যানেজ করে, এমনকী আয়কর হানা দিয়েও ঠেকানো যায়নি আহমেদ প্যাটেলকে। অমিত শাহ যে অ-মিত নন, তা প্রমাণিত হয়েছে। যতই মিডিয়া তাঁকে চাণক্য বানাক। এ রাজ্যে নতুন চাণক্য মুকুলিত হয়েছেন। বোলের গন্ধ ছাড়ছে অভিষেক-পর্বে। কতটা মমতাহীন হতে পারে সময় বলবে।

অন্যদিকে সাধ্যবিত্ত স্বল্পবিত্ত সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের নাভিশ্বাস। চড়া আগুনখেকো বাজার দর। আধারে আঁধারময় তার গ্যাসীয় জীবন। লাইফ পেনসন তুলতে নাজেহাল। দেশে লাইন আর লাইন। শুধু রেল লাইন সারে না, দুর্ঘটনা কমে না। প্রতি চারদিনে একটি না একটি দুর্ঘটনা। অনেক মানুষ না মরলে খবর লাশের সঙ্গে গায়েব। আজ আর নেহরু জমানা নেই। কেউ পদত্যাগ করেন না। পদ অবশ্য বদলে যায় রাজ্যে—কেন্দ্রে। একনায়কত্মিক আস্ফালনে। স্বল্পসঞ্চয়ে সুদ কমছে, গ্যাসের দাম ২২ বার বাড়ল। পেট্রোল, ডিজেল প্রায় দৈনিক। যদিও বিজ্ঞপ্তিহীন। গুজরাত শূন্যহাতে বিজেপিকে না ফেরালে আপনার নিজস্ব সঞ্চয় ব্যাঙ্ক থেকে একটি বোতাপ টিপে শূন্য করে দিতে বিল আনছে মোদি সরকার। আমোদে থাকতে এসেছে তাজমহল, গো-সন্ত্রাস, লাভ জিহাদ, রোমিও, জামা মসজিদ, কুতুব মিনার—ইত্যাদি ধর্মীয় জীর্ণ সনাতন কু-আচার। জনগণকে জাগতে হবে—না হলে মিটবে না বাঁচা মরার সমস্যা।

গার্হস্থ্য হিংসা বাড়ছে, বৃদ্ধা বাবা-মা আদালতে না যেতে পারলে পথের প্রান্তে ঠাঁই নিচ্ছেন। সন্তান পিতামাতাকে, পিতা বা মাতা সন্তানকে হত্যা করছেন—এ খবর এখন মাঝে মাঝেই। পিতৃভূমি-মাতৃভূমি লোকালের দ্বন্দ্ব—এখন হাসি ঠাট্টার বিষয় নেই—অবরোধের।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অপছাত্র হামলা বেড়েছে, বেড়েছে তোলাবাজি—প্রতিরোধহীন।

অন্যরাজ্যে প্রতিবাদ প্রতিরোধ আছে। তাই দিল্লি বেনারস গুজরাত হিমাচল রাজস্থান—সর্বত্র শাসকশ্রেণি পরাজিত। কিন্তু এ রাজ্য? বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ের বাম ঐতিহ্য রেখেছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিশু সন্তানও তত নিরাপদ নয়। ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয়ে বেশি বেতন, ব্যবহার খারাপ, যৌন নির্যাতন—ইত্যাদি কারণে সংবাদের শিরোনামে আসছে। বাংলা মাধ্যম তো দুয়োরানী। তার শুধু নিন্দা আছে, ভরসা নেই। বাংলা সরকারি ভাষা হতে হতেও থমকে গেল। রাজ্যের প্রধান ভাষা শিক্ষার উদ্যোগ থমকে গেল গুরুংয়ের গুরু আন্দোলনে।

২০১৮-য় বাঙালি সব দিক থেকে নতুন ভাবে বাঁচে যদি।

পুনশ্চ : ট্রাম্প যুদ্ধের ডঙ্কা বাজিয়ে দিয়েছেন—জেরুজালেমকে ইজরায়েলের রাজধানী ঘোষণা করে দিয়ে। ভোটের আগে ইজরায়েল বিরোধী ট্রাম্প—ইঁদুর বনেছেন। রাজস্থানে পিটিয়ে মারা হয়েছে আফরাজুল শেখকে, মিথ্যা অভিযোগে, আখলাকের মতোই।

রাস্তায় মানুষ নেমেছে, প্রতিবাদে মঙ্গলদীপ হাতে।

কিন্তু লাখে লাখে না নামলে হিটলারের জার্মানির মতো ঘোর অমঙ্গল। আর আমাদের হিটলার আছে, কোন স্তালিন দূরে থাক ভরসা করার মতো সেনাপতি ভরোসিলভস্কিও নেই।

আর করোনা ভাইরাস দেখিয়ে দিয়েছে ছোট্ট একটা কণা অনুজীবের কাছে বোমা ট্যাঙ্ক, যুদ্ধবিমান তুচ্ছ।

জীবন এক অন্যরকম বিজ্ঞানমনস্কতা আশা করে।

আশা না নিরাশা?

ভবিষ্যৎ বলবে।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন