ইমানুল হক
১
দেশের ভাষা ইংরেজি জানতেন না, ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম জর্জ। সমস্যা দেখা দিল প্রশাসন পরিচালনায়। রাজা বৈঠক করছেন, কিন্তু বুঝছেন না মন্ত্রীদের ভাষা। রাজা ইংরেজি জানেন না। জানেন কেবল ফরাসি ও জার্মান ভাষা। তাই প্রয়োজন হল প্রধানমন্ত্রী নিয়োগের। ১৭০৭ খ্রিস্টাব্দে তৈরি হল প্রধানমন্ত্রী পদ। ঠিক হল মন্ত্রীসভার বৈঠকে সভাপতিত্ব করবেন এখন থেকে প্রধানমন্ত্রী। তিনি সমন্বয় সাধন করবেন মন্ত্রী, মানুষ আর প্রশাসকদের সঙ্গে। ঘটনাটি বিস্ময়কর ঠেকলেও সত্য। অষ্টাদশ শতাব্দীর ইংল্যান্ডের চেহারা ছিল আদতে এই। সব দেশেই সাধারণ মানুষের ভাষা আর শাসকের ভাষায় একটা কৃত্রিম ভেদ তৈরির চেষ্টা হয়। সাধারণ মানুষের ভাষায় সরকারি কাজ চলে না।
ইংল্যান্ডেও। একই ঘটনা ঘটত।
ইংল্যান্ডেও শিল্পবিপ্লবের পিছনে মাতৃভাষায়। বিজ্ঞানচর্চার পাশাপাশি প্রশাসনে মাতৃভাষার ব্যবহার একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাবহনকারী।
আর সংসদীয় ব্যবস্থার বিকাশে মাতৃভাষা যে কতখানি গুরুত্বপূর্ণ তা ইংল্যান্ডে প্রধানমন্ত্রী পদের সৃষ্টিতেই প্রমাণ।
২
উইলিয়াম অফ নর্মান্ডি ১০৬৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে সামন্তব্যবস্থার জন্ম দিয়ে আইন তৈরির আগে ‘টেনান্টস-ইন-চিফ’দের মতামত নেওয়া শুরু করেন। বলাই বাহুল্য রাজার মত-ই ছিল শেষকথা। ১২১৫ খ্রিস্টাব্দে ‘টেনান্টস-ইন-চিফ’রা রাজা জন-কে চাপ দিয়ে বাধ্য করলেন মহাসনদ তৈরি করতে। বলা হল, রাজা এখন থেকে রাজকীয় পরিষদের অনুমতি ছাড়া কোনও কর বা লেভি বসাতে পারবেন না। এই রাজকীয় পরিষদ থেকেই পরে সংসদীয় গণতন্ত্রের জন্ম।
৩
আধুনিক সংসদীয় গণতন্ত্রের জন্মের আগেও গণতন্ত্র ছিল। এই বাংলাতেই ৬৫০ খ্রিস্টাব্দে বপ্যটের পুত্র গোপাল রাজা নির্বাচিত হয়েছেন।
নীহাররঞ্জন রায় ‘বাঙ্গালীর ইতিহাস’ গ্রন্থে জানিয়েছেন, পৃথিবীর প্রথম পঞ্চায়েত হয়েছে এই বাংলায় আদিবাসীদের হাতে। পাঁচ হাজার বছর আগে। ষোড়শ জনপদ ছিল প্রজাত্যান্ত্রিক।
গণতন্ত্র ছিল প্রাচীন গ্রিসেও। স্পার্টা এবং এথেন্সে। প্রাচীন ইতালিও বহন করেছে গণতন্ত্রের ঐতিহ্য।
৪
ছাত্রদের এই অতীতটা জানানো ও শেখানো খুব জরুরি।
আজকাল এমন একটা ধারণা তৈরি করার চেষ্টা হচ্ছে, রাজনীতির জগৎ খুব খারাপ। অতএব এ-থেকে দূরে থাকো। এই প্রবণতা বিপজ্জনক। রাজনীতি মানে শুধু মারামারি কাটাকাটি নয়।
বিধানসভা বা লোকসভা মানে শুধু চেঁচামেচি নয়। সঠিক যুক্তি-তর্কের মাধ্যমে জন সমাজের আসল সমস্যা তুলে ধরা ও সে সমস্যা সমাধানের জন্য কার্যকর চেষ্টা করা।
৫
সরকারের পক্ষ থেকে ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে যুব সংসদ হচ্ছে। কিন্তু তার অভিজ্ঞতা কী?
ছাত্র-ছাত্রীরা তর্ক নয়, ঝগড়া করছে, ভাঙচুরের অভিনয় করছে, পরস্পরের দিকে তেড়ে যাচ্ছে। এবং দুঃখের হলেও সত্যি, এসব দেখিয়ে তারা পুরস্কারও পাচ্ছে।
৬
যুব সংসদের প্রতিযোগী শুধু নয়, বিচারকদের জন্যও নির্দেশিকা থাকা দরকার নেতিবাচকতা তথা ভাঙ্গচুর, মারামারি দেখালে নম্বর কমে যাবে।
তর্কপ্রিয় জাতি আমরা, বলেছেন, অমর্ত্য সেন। কিন্তু ঝগড়া আর তর্ক তো এক নয়।
মতান্তর হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু মতান্তর হলেই মনান্তর হবে কেন?
৭
আমরা বহু ভাল সাংসদ ও বিধায়ক পেয়েছি।
তাঁরা তাঁদের অসামান্য বক্তৃতায় মুগ্ধ করতে পেরেছেন তাঁদের বিরোধীদেরও।
৮
সাংবাদিক জীবনের অভিজ্ঞতায় পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় বিরোধী দলনেতা সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় আর তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু-র বক্তৃতা শুনেছি। ব্যক্তিগত জীবনে দুজনে দুজনার বন্ধু। কিন্তু বিধানসভায় তীক্ষ্ন প্রতিপক্ষ।
সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় তথ্য আর পরিশীলিত শ্লেষে, বক্তব্য পেশে ম্রিয়মান সরকার পক্ষ।
জ্যোতি বসু জবাব দিলেন স্বভাবসিদ্ধভাবে, কাটা কাটা ভাষায়। পাল্টা তথ্য তাঁর। সঙ্গে সরস মন্তব্য। কিন্তু ব্যক্তি আক্রমণের স্পর্শ ছিল না দুজনের বক্তৃতাতেই।
৯
আমাদের ছাত্রদের আরো বেশি করে বিতর্কে অংশগ্রহণ করা শেখাতে হবে।
শেখাতে হবে, মতান্তর মানেই মনান্তর নয়।
সব কথাতেই বিরোধিতা নয়।
নেতিবাচকতা নয়, ইতিবাচকতাই জীবনের ধর্ম।
মানুষ এডমন্ড বার্ক, ডিসরেলি, ভুপেশ দাশগুপ্ত, পিলু মোদি, জ্যোতির্ময় বসুদের মত সংসদীয় মানুষদের-ই সম্মান করে।
হই-হট্টগোল করাদের নয়।
১০
পৃথিবী যতদিন, গণতন্ত্র ততদিন।
গণতন্ত্রের মৃত্যু নেই।
ইদানীং কৃষ্ণনগরের সাংসদ মহুয়া মৈত্র নজর কাড়ছেন।
এখন প্রশ্ন একটাই, আমরা কোন উত্তরাধিকার বহন করব?
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন