ইমানুল হক
১
রুশ লেখক ইভান তুর্গেনেভের বংশের প্রথম পুরুষের নাম খান তুর্গা। জাতিতে তাতার, ধর্মে মুসলমান। জমিদারির নাম ছিল তুর্গ। তার থেকেই তুর্গেনেভ উপাধি। তুর্গেনেভের মা ছিলেন ভয়ংকর স্যাডিস্ট। অত্যাচার করে ও অত্যাচার দেখে আনন্দ পেতেন। নিজের মা সম্পর্কে তুর্গেনেভ মন্তব্য করেছিলেন, আঠারো শতকের শেষ ও উনিশ শতকের আরম্ভ বাসা বেঁধেছে এই মহিলার চরিত্রে।
চাকর-বাকরদের মানুষ বলে মনে করতেন না। সামান্য কারণে জুটতো শাস্তি। একবার জানলার ওপাশে দাঁড়ানো দুটি বাচ্চার ছায়া পড়ায় বাচ্চা দুটিকে সাইবেরিয়ায় নির্বাসনে পাঠানো হয়।
সে-কালে সাইবেরিয়া মানে ছিল, মৃত্যু, নির্দয়, হিমশীতল বরফে ঠাণ্ডায় জমে মমতাহীন মৃত্যু। অপরিমিত অর্থ, নিয়ন্ত্রণহীন ক্ষমতা উনিশ শতকের রুশ অভিজাতদের জীবনকে পাশবিক করে তোলে।
তুর্গেনেভের মা ভারভারা ছিলেন এদেরই একজন। মা-র নিষ্ঠুরতা, জমিদারি ব্যবস্থার সীমাহীন অমানবিকতা ও নৃশংসতা তুর্গেনেভকে বিদ্রোহী করে তোলে। বাগান আর বিশেষত লেবু গাছ ছাড়া সবকিছুতে জন্মায় প্রবল অবিশ্বাস। ‘জীবন্ত এক বিদ্রোহ, চারদিকে সবকিছুর প্রতি অবিশ্বাস’। অবিশ্বাস, অর্থাৎ নেতি—নিহিলিজম। ‘নিহিলিস্ত’ শব্দটি প্রথম তিনিই ব্যবহার করেন তাঁর মহৎ উপন্যাস ‘ফাদার অ্যান্ড সনস’-এ। নৈরাজ্যবাদ, অবাধ স্বাধীনতার নতুন সনদ রচিত যা হবে বিজ্ঞানের স্বার্থে।
২
১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে ১ মার্চ চালু হয় চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। লর্ড কর্ণওয়ালিস ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের স্বার্থরক্ষায় চালু করেন এই আইন। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে পুরনো ভূমি ব্যবস্থা বাংলায় অচলাবস্থা লাভ করে। জমির মালিক হলেন মূলত শহুরে বাবুরা। মাটিতে তাদের চরণ কদাচিৎ ঠেকে। ‘রামায়ণ’ রচনার কাল থেকে বাংলার যে ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা চালু ছিল, তাও রাতারাতি গেল বদলে। আড়াই হাজার বছর আগে রচিত ‘রামায়ণ’-এ বলা হয়—
বলি ষড়্ভাগমুদ্ধত্যে নৃপস্যররক্ষিতুঃপ্রজা।
অধর্মোযোহস্য সৌর্হসাস্তু রসার্যোহনুমতে।।
অর্থাৎ উৎপাদিত পণ্যের একের ছয় ভাগের তথা এক ষষ্ঠাংশ কর হিসাবে দিতে হবে। খিলজি আমলেও আলাউদ্দিন খিলজি শরিয়তি আইন চালু করলেও রাজস্বের ব্যাপারে তা মানলেন না। কারণ, শরিয়তি আইনে চাষিদের ওপর করভার অনেক কম। শরিয়তি আইনে কর একের দশ (এক দশমাংশ)। এতে চাষিদের লাভ, শাসকের ক্ষতি। শাসক তো ধর্ম ততটুকুই মানে, যতটুকু তার নিজের স্বার্থে প্রয়োজন।
মোঘল আমলে আকবর ভূমি সংস্কার করেন। টোডরমল ও আবুল ফজলের সহায়তায়। তাতেও একের ছয় অংশ কর। শিবাজির আমলে হল সাংঘাতিক। চৌথা। অর্থাৎ ২৫ শতাংশ কর। ব্রিটিশরা হাজার হাজার বছর ধরে চলে আসা ভারতীয় খাজনা প্রথাকে কলমের এক খোঁচায় বাতিল করে দিলেন। এবং তাদের শাসনে গ্রাম ও শহরের ভারসাম্য গেল বদলে। গ্রামের বদলে শহর, তাও আবার সব শহর নয়, কলকাতা হয়ে উঠল প্রধান গুরুত্বপূর্ণ। নতুন জমিদাররা মূলত চার শ্রেণির লোক—(ক) দেওয়ান, (খ) মুৎসুদ্দি, (গ) উকিল (ঘ) ব্যবসায়ী।
বিষ্ণুপুর বা বর্ধমানের মতো কিছু পুরোনো জমিদার জমিদারি কিনলেন বটে, কিন্তু কৃষ্ণনগর, নাটোরের মতো জমিদারিগুলি ধ্বংস হয়ে গেল। কৃষ্ণচন্দ্রের ইংরেজ ভজনা কোনও কাজে লাগল না।
৩
নতুন জমিদাররা অচিরেই হয়ে উঠলেন, রক্ষক নয় ভক্ষক। অসংখ্য মধ্যস্বত্ত্বভোগী সম্প্রদায় গড়ে উঠল। অক্ষয়কুমার দত্ত তার কিছুটা পরিচয় দিয়েছেন। ইজারাদার, দর-ইজারাদার, পত্তনিদার দরপত্তনিদার, ইত্যাদি ১৮টি মধ্যস্বত্ত্বভোগী সামন্ত শোষক বিদ্যমান ছিল জমিদার আর চাষির মাঝে। নির্ধারিত কর ছাড়াও আরও প্রায় ৫৬টি কর আদায় করা হত চাষিদের কাছ থেকে। জমিদার বাড়ির বিয়ে, পুজো, পৈতে, অন্নপ্রাশন, পার্বণী, দ্বিরাগমন ইত্যাদি নানা অজুহাতে অর্থ আদায়। না দিতে পারলে জরিমানা ও অত্যাচার। উপযুক্ত খাজনা, নজরআনা, উৎকোচ আদায়ের জন্য নৃশংসতম পদ্ধতিও তারা গ্রহণ করেন। এবং ব্রিটিশ শাসকরা থেকে যান উদাসীন। কারণ, সিংহাসনে সমাসীন থাকতে এছাড়া নান্য পন্থা।
ইংল্যান্ডের সার্ফ তথা ভূমিদাসদের ওপর যে অত্যাচার চালাত ইংরেজ জমিদারকুল, তাতে অভ্যস্ত, সেই শ্রেণির প্রতিনিধিরা। সুতরাং বাঙালি প্রজাদের আর্তনাদ ইংরেজ শাসকের কর্ণকুহরে প্রবেশ করেনি। করবে এ আশাই তো বাতুলতা। এ অত্যাচারের স্রষ্টা তো তারা। হূণরাও এদের কাছে নস্যি। পলাশির যুদ্ধের পর বাংলাকে যেভাবে লুঠ করা হয়েছে, তাতে তাতার দস্যু বা বর্বর গল-রাও লজ্জা পেত।
৪
সাম্রাজ্যবাদের তিনটি পর্যায়। প্রথম পর্যায়, আলেকজান্ডার থেকে তৈমুর লঙ। যাও যুদ্ধ কর, দখল করো, মানুষ মারো, অর্থ ও ধনসম্পত্তি লুঠ করো। পারলে কোনো শাসনকর্তা বসিয়ে দাও।
দ্বিতীয় পর্যায়, মোঘল সাম্রাজ্যবাদ। যাও দখল করো, শাসন কায়েম করো। চেষ্টা করো প্রজাহিতৈষী হওয়ার। তাদের সংস্কৃতিকে গ্রহণ করার।
তৃতীয় পর্যায়, শিল্প বিপ্লব পরবর্তী ব্রিটিশ সাম্রাজ্য। যাও, দখল করো, শাসন করো। কিন্তু সে দেশের নাগরিক তুমি নও। তোমার কাজ লুণ্ঠন। সে লুণ্ঠন কখনও সরাসরি, কখনও খাজনা বা করের নাম করে। চাপিয়ে দাও তোমার সংস্কৃতি।
১৭৬৫-তে দ্বৈত শাসন ব্যবস্থার শেষে ইংরেজ সরাসরি শাসকপদে অবতীর্ণ হল। শুরু হয়ে গেল শোষণের এক বিচিত্র ইতিহাস। যে বাংলা ছিল খাদ্য-শস্য ও সম্পদে বিশ্বসেরা, ১৭৭০ খ্রিস্টাব্দে, ইংরেজ শাসন শুরুর পাঁচ বছরের মধ্যেই, সেখানে দেখা দিল ভয়ংকর দুর্ভিক্ষ। যার পরিণতিতে মারা গেলেন এক কোটির বেশি মানুষ। প্রসঙ্গত, তখন বাংলার জনসংখ্যা ছিল তিন কোটি। এক তৃতীয়াংশ মানুষ মারা গেলেন। কিন্তু শাসক ইংরেজ রইল উদাসীন। তারা কর সংগ্রহে ব্যস্ত।
৫
বাংলার সাম্রাজ্যবাদী ও সামন্তবাদী সম্পর্কে নতুন মেলবন্ধনে শুরু হল এক অভূতপূর্ব অত্যাচারের রাজত্ব। এই অত্যাচার ব্রিটিশ পুঁজিকে স্থিত করার প্রয়োজনে। শুরু হল বিদ্রোহও।
৬
১৭৯৮ খ্রিস্টাব্দে রানি শিরোমণিকে সামনে রেখে চোয়াড় বিদ্রোহ। ১৮১১ খ্রিস্টাব্দে বিদ্রোহ করলেন সাঁওতাল জনজাতি। ‘দিকু’ এবং বিদেশি শোষক—দু-এর বিরুদ্ধেই এই বিদ্রোহ। ১৮১১-এর পর ১৮২০। আবার বিদ্রোহ। এর আগে বলা হল ১৮৫৭-য় একাধিক বিদ্রোহ হয়েছে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে। ডিসেম্বরে বিদ্রোহ করে ইউরোপিয়ানরাই। ক্লাইভকে বিদ্রোহ দমনের সহায়তা করে বাঙালিদের নিয়ে গড়া ‘বেঙ্গলি রেজিমেন্ট’।
১৮৩১-এ তিতুমিরের নেতৃত্বে দরিদ্র কৃষকরা বিদ্রোহ করে। ১৮৫৪-৫৫ খ্রিস্টাব্দে সিধু-কানুর নেতৃত্বে সাঁওতাল বিদ্রোহ। ১৮৫৭-তে ভারতে প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম। আর এই সময়েই দেশকে স্বশাসনে রাখার জন্য পুঁজিবাদি বিকাশের জন্য ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দে রেলপথ নির্মাণ করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। সৈন্য, পণ্য—দুই-ই দ্রুত প্রেরণের সুবিধা। ১৮৫৪-তে টেলিগ্রাফ ব্যবস্থা চালু হল। ১৮৫৪-তেই রিষড়ায় স্থাপিত হল চটকল, অকল্যান্ডের নেতৃত্বে।
৭
গড়ে উঠল নতুন মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়। বাণিজ্যিক সংস্কৃতি আর শিক্ষাগত সংস্কৃতি জন্ম দিল মধ্যবিত্ত সংস্কৃতি। একদিকে বৈষ্ণবসুলভ বিনয়, ন্যাকামি, পরশ্রীকাতরতা, অসূয়া, ঈর্ষাপরায়ণতা অন্যদিকে জানবার বুঝবার প্রতিবাদ করার প্রবণতাময় হল মধ্যবিত্ত মনন।
৮
মধ্যবিত্ত শ্রেণিতে উঠে এলেন বাঙালি লেখক, সাহিত্যিকরা। এরা মূলত নগর বা শহরবাসী। গ্রামীণ কবিরা ব্রাত্য হয়ে গেলেন। ছড়াকার, গীতিকার বা গায়করূপে এদের পরিচিতি হল। চারণ গীতিকারদের বার্তা পৌঁছল না শহরে, নাগরিক পরিমণ্ডলে। অথবা নিজ শ্রেণি স্বার্থ, ব্যক্তি চিন্তা, আত্মপরতা, আত্মমগ্নতার কারণে এরা চোখ বন্ধ করে থাকলেন বা উদাসীনতার ভান করলেন। কেউ কেউ চলে গেলেন ধর্মসংস্কার আন্দোলনে। কৃষক আন্দোলনের থেকে ধর্ম আন্দোলনকে বড় করে দেখা হল। এর পাশাপাশি ইংরেজদের কাছে যাওয়ার জন্য, ইংরেজ তোষণ ও আত্মপোষণের জন্য ইংরেজি শিক্ষার আগ্রহ সঞ্চারিত হল চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের শাবককুলের। গড়ে উঠল শিক্ষা আন্দোলন।
৯
১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে সরাসরি ইংরেজ শাসন। ইংরেজ কর্মচারীদের শাসনকার্যের সুবিধার জন্য বাংলা ভাষায় শিক্ষার প্রয়োজনে বাংলাভাষার চর্চা শুরু হল। ১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দে হুগলি থেকে ছাপা হল—’এ গ্রামার অফ দ্য বেঙ্গল ল্যাংগুয়েজ।’ লিখলেন ইংরেজ কর্মচারী ন্যাথানিয়েল ব্রাসি হ্যালহেড। ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দে স্থাপিত হল এশিয়াটিক সোসাইটি। ১৭৮৫ খ্রিস্টাব্দে জোনাথান ডানকানের নেতৃত্বে প্রকাশিত আইন সংকলন—’রেগুলেশনস ফর দ্য অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অফ জাস্টিস ইন দ্য কোর্টস অব দেওয়ানি আদালত’। ছয় বছর পর ১৭৯১ খ্রিস্টাব্দে এডমনস্টোনের উদ্যোগে প্রকাশিত হয় ফৌজদারি আইনাবলি। ১৭৯৬ খ্রিস্টাব্দে ছাপা হল কুখ্যাত কর্ণওয়ালিশ কোড। অনুবাদক ফরস্টার।
১৮০০ খ্রিস্টাব্দে জানুয়ারি মাসে স্থাপিত হয় শ্রীরামপুর মিশন প্রেস, ওই বছরের মে মাসে লর্ড ওয়েলেসলির উদ্যোগে তৈরি হল ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ। অধুনা যেখানে মহাকরণ, সেখানেই হত কলেজের ক্লাস।
১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে ঘটল দুটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। প্রথমটি, হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠা। যেখানে রামমোহন রায় আন্তরিকভাবে যুক্ত হতে চাওয়া সত্ত্বেও বড়লাটের অনুরোধে বিরত হন। দ্বিতীয়টি স্কুল বুক সোসাইটি স্থাপন। আর এরই মাঝে ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে রামমোহন রায় (১৭৭৪—১৮৩৩) পাঠ্য পুস্তকের বাইরে বাংলা গদ্য রচনা শুরু করেছেন।
১০
১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে এপ্রিল মাসে ‘বেঙ্গল গেজেট’ ও ‘সমাচার দর্পণ’ সাময়িক পত্র দুটি প্রকাশিত হয়। রামমোহন রায় ১৮২১ খ্রিস্টাব্দে দুটি সাময়িকপত্র প্রকাশ করেন। একটি ‘ব্রাহমনিক্যাল ম্যাগাজিন’ বা ‘ব্রাহ্মণ সেবধি’। অন্যটি ‘সংবাদ কৌমুদী’ (ডিসেম্বর ১৮১৮)। যুগ্ম সম্পাদক ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় (১৭৭৮ থেকে ১৮৪৮)। রক্ষণশীল মানুষটি নিজেকে বিচ্ছিন্ন করলেন রামমোহনের সঙ্গে। তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত হল ‘সমাচার চন্দ্রিকা’ (১৮২২)। ঈশ্বর গুপ্ত ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে ‘সংবাদ প্রভাকর’ নামে সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ শুরু করেন। তাঁর পত্রিকায় কৃষকদের জীবন ও যন্ত্রণার কথা প্রকাশ পায়। প্রধান লেখক অক্ষয়কুমার দত্ত। অক্ষয়কুমার দত্তের জন্ম গ্রামে। কলকাতা শহরে বাস করলেও তাঁর সঙ্গে গ্রামের নিবিড় যোগ ছিল। গ্রামের মানুষ কীভাবে জমিদার, নায়েব ও তাঁদের অধস্তনদের হাতে অত্যাচারিত হচ্ছে তার চিত্র আঁকা তাই সহজ হয়েছিল অক্ষয়কুমারের পক্ষে। সিপাহি বিদ্রোহের সময় অক্ষয়কুমার দত্ত বাঙালি মধ্যবিত্তীয় কেরানি চিন্তার বাইরে যেতে সক্ষম হয়নি। ‘ব্রিটিশের রাজলক্ষ্মী চিরদিন যেন রয়’ বলে বন্দনা গেয়েছিলেন তিনি। তাঁর পূর্বসুরী দুই বাঙালি ‘নায়ক’ রামমোহন রায় ও দ্বারকানাথ ঠাকুর ব্রিটিশ রাজের বিরোধিতা করার সাহস অর্জন করতে পারেননি। বরং তাঁদের ব্রিটিশ ভক্তি ইংরেজদের তুষ্ট করেছিল। সতীদাহ রদ আন্দোলন, তাঁকে যুগনায়কের আসনে বসিয়েছে ঠিকই, কিন্তু দেশের সাধারণ মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলক হয়ে উঠতে পারেননি রামমোহন। ‘হিন্দু’ ধর্মের কুসংস্কারের বিরোধিতা তাঁর প্রগতিশীলতার পরিচায়ক, কিন্তু ইংরেজ নীলকরদের সমর্থন তাঁর এবং দ্বারকানাথ ঠাকুরের প্রতিক্রিয়াশীল মনোভাবের সাক্ষ্যবাহী। ফরাসি সাম্য, স্বাধীনতা, মৈত্রী-র বাণীবাহক পতাকাকে নমস্কার করতে গিয়ে পা ভেঙেছেন, আবার দেশে ইংরেজি ভাষায় শিক্ষার পক্ষে সওয়াল করে দেশের মানুষের সাম্যের অধিকারকে রুদ্ধ করেছেন। ঈশ্বর গুপ্ত চাষীর পক্ষে, কিন্তু ব্রিটিশের বিরুদ্ধে নয়। বিদ্যাসাগর বাঙালি রক্ষণশীলতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন। বিধবা বিবাহ প্রবর্তন, স্ত্রী শিক্ষা বিস্তার, বর্ণপরিচয় বই লেখা বাংলা গদ্যের সৃজনশীল বিকাশ বিদ্যাসাগরকে চিরজীবী করেছে। ঔপনিবেশিক, রাজবিপ্লব প্রভৃতি শব্দ প্রথম তিনিই ব্যবহার করেছেন, কিন্তু সমাজ পরিবর্তনের লড়াইয়ে নেই।
১১
ভাষা, শিক্ষাবিপ্লবী হলেও, স্বাধীনতাকামী, শ্রমিক-কৃষকের মুক্তিকামী বিপ্লবী তিনি হতে চাননি। যদিও কার্মাটাঁড়ের সাঁওতালদের জন্য তাঁর কাজ, চিরস্মরণীয়। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ধর্মসংস্কার করেছেন, ‘এ জীবন লইয়া কী করিব’ বলে হা হুতাশ করেছেন কিন্তু দেশের মুক্তি, কৃষকের মুক্তি—তাঁর স্বপ্নের অগোচর। কারণ, এদের আর্থিক জীবন যে ব্রিটিশের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।
১২
প্যারীচাঁদ মিত্র, কালীপ্রসন্ন সিংহ চার পাশের সমাজ দেখে ক্ষুব্ধ, ক্লান্ত, বিরক্ত—সে বিরক্তি ‘আলালের ঘরে দুলাল’ (১৮৫৮) এবং ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’তে পরিস্ফুট। কিন্তু সমাজ পরিবর্তনের দায় এবং আকাঙ্ক্ষা কোনওটাই তাঁদের মধ্যে দেখা যায়নি। বিদ্যাসাগর অবশ্য ‘সাত পুরু মাটি তুলে’ ‘নতুন মানুষের’ চাষ করতে চেয়েছিলেন। বাঙালির উনিশ শতকিয় ঔপনিবেশিক দাস মনোভাবে যেমন তিনি বিরক্ত ছিলেন, তার চেয়ে বেশি রাগ সমাজপতিদের রক্ষণশীল মনোভাবে। ১৮৫৪-৫৫ খ্রিস্টাব্দে হল সাঁওতাল বিদ্রোহ। এ বছরই প্রবর্তন হল রেলপথ ও টেলিগ্রাফের। ১৮৫৪-তেই অকল্যান্ড রিষড়ায় প্রথম চটকল স্থাপন করলেন। তাঁতিরা কাজ হারালো। আর ১৮৫৭-য় প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম।
১৩
লন্ডনে ১৮৪৭ খ্রিস্টাব্দে কতকগুলি বিপ্লবী প্রলেতারিয়েত সংগঠনেরসম্মেলন থেকে গঠিত হয় কমিউনিস্ট লিগ। প্রথমে সংগঠনটি ছিল মূলত জার্মানিতে। পরে তা আন্তর্জাতিক চেহারা নেয়। শুরুতে এটি ছিল একটি গুপ্ত সংগঠন।
১৮৪৭-এ তৈরি হল কমিউনিস্ট লিগ, ওই বছরই ‘সব মানুষই ভাই’—এই শ্লোগানের পরিবর্তে এল ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’ শ্লোগান। আর ১৮৪৮ এর ফেব্রুয়ারিতে মার্কস-এঙ্গেলস প্রকাশ করলেন কমিউনিস্ট ইস্তেহার। সেখানে তাঁরা ঘোষণা করলেন, আজ পর্যন্ত বিদ্যমান পৃথিবীর ইতিহাস, শ্রেণিসংগ্রামের ইতিহাস।
১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসে প্রলেতারিয়েত ও বুর্জোয়াদের প্রথম মহাসংগ্রাম হয়। ১৮৪৮-৫০ পর্যন্ত ফ্রান্সে চলে শ্রেণিসংগ্রাম। প্যারিসে অভ্যুত্থান ঘটে। জার্মানিতে দেখা দেয় বিদ্রোহ। ইতালি আর হাঙ্গেরিতেও বিদ্রোহ হল। কিন্তু কোথাও সাফল্য সে অর্থে আসেনি।
১৮৫০ খ্রিস্টাব্দে মার্কস লিখলেন ‘ফ্রান্সে শ্রেণিসংগ্রাম’ ১৮৪৮ থেকে ১৮৫০। তাতে তাঁর মন্তব্য—কয়েকটি অধ্যায় বাদে, ১৮৪৮ থেকে ১৮৪৯ পর্যন্ত বিপ্লবের ইতিহাসের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ অংশের শিরোনাম হচ্ছে বিপ্লবের পরাজয়।
১৪
বাংলার ক্ষেত্রেও কথাটা একটু অন্যভাবে ঘুরিয়ে বলা চলে। বাংলার সাঁওতাল বিদ্রোহ কিন্তু শ্রেণিসংগ্রামই। ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে ফ্রান্সে শ্রেণিসংগ্রাম শুরু হওয়া পর্যন্ত কমিউনিস্ট লিগের কেন্দ্রীয় কমিটি ছিল লন্ডনে। ফেব্রুয়ারির শেষে বেলজিয়ামের ব্রাসেলসে স্থানান্তরিত হয় নেতৃত্ব। যার প্রধান কার্ল মার্কস।
১৮৪৮-এর ৩ মার্চ ব্রাসেলসে গ্রেপ্তার হয়ে গেলেন মার্কস। নির্বাসিত হলেন প্যারিসে। ১৮৪৮—এই লিগের উদ্যোগে কয়েকশো জার্মান শ্রমিককে জার্মানিতে ফেরত পাঠানো হল, বিদ্রোহে অংশ নেওয়ার জন্য। রচিত হল, ‘কমিউনিস্ট ইস্তেহার’ (১৮৪৮ ফেব্রুয়ারি)। জার্মানিতে উঠল কমিউনিস্ট পার্টির দাবি। বলা হল—
জার্মান জনগণের পার্লামেন্টে যাতে শ্রমিকরাও আসন গ্রহণ করতে পারেন তার জন্য জনগণের প্রতিনিধিদের বেতন দেওয়া হবে।
জনগণের সার্বজনীন সশস্ত্রীকরণ।
বিনা বেতনে সার্বজনীন শিক্ষা।
১৮৫১ খ্রিস্টাব্দে শুরু হয় বিশ্বের প্রথম কমিউনিস্ট বিরোধী মামলা। কলোন কমিউনিস্ট মামলা। ১৮৫২ খ্রিস্টাব্দের ৪ অক্টোবর থেকে ২ নভেম্বর পর্যন্ত মামলা চলে। কমিউনিস্ট লিগের কেন্দ্রীয় কমিটির বহু সদস্যের কারাদণ্ড হয়। বেআইনি ঘোষণা করা হয় ‘কমিউনিস্ট ইস্তেহার’-কে।
আর মার্কসের পরামর্শে ১৮৫২ খ্রিস্টাব্দের ১৭ নভেম্বর কমিউনিস্ট লিগ ভেঙে দেওয়া হয়। ১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দে প্রথম আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠিত হয় লন্ডনে এক মহাসম্মেলনের মধ্য দিয়ে। ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয় ‘ক্যাপিটাল’ বা ‘পুঁজি’-র প্রথম খণ্ড।
১৮৬৯-তে ‘কমিউনিস্ট ইস্তেহার’ রুশ ভাষায় প্রকাশিত হল। রুশ অনুবাদকের নাম বাকুনিন। বাকুনিন-ই প্রথম সংশোধনবাদী। তিনি অনুবাদের সময় প্রথম কয়েকটি অনুচ্ছেদের বিকৃতি ঘটান। একজন পেটিবুর্জোয়া গণতন্ত্রীর পক্ষে যা ছিল স্বাভাবিক ঘটনা।
১৫
১৮৭২ পর্যন্ত চলল সাঁ সিমো, কুরিয়ের, প্রুঁধো, বাকুনিনপন্থীদের সঙ্গে মার্কসবাদীদের মতাদর্শগত বিতর্ক। বাকুনিন মনে করতেন, রাষ্ট্র উচ্ছেদ হলেই পুঁজি উচ্ছেদ হবে। আর মার্কস উল্টো। তাঁর মত, ‘পুঁজির উচ্ছেদই সমাজবিপ্লব এবং এর ফলে সমস্ত উৎপাদন পদ্ধতিরই পরিবর্তন ঘটে’।
১৬
১৮৭২ খ্রিস্টাব্দের ১৫ আগস্ট লন্ডনে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের সভায় পড়া হল কলকাতা থেকে লেখা একটি চিঠি। ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দেই কলকাতাতে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের শাখা খোলার অনুমতি চাওয়া হয়েছে। ওই বছরই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশ্নপত্রে এল সাঁ সিমো (প্রশ্নপত্রে সেন্ট সাইমন) ও ক্যুরিয়েরের সমাজতান্ত্রিক তত্ত্ব সম্পর্কে প্রশ্ন। প্রশ্ন ওঠে, কে লিখেছিলেন চিঠি, কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকে?
ক. কে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশ্নপত্রের রচয়িতা?
খ. ১৮৭২-তে প্রকাশিত ‘বঙ্গদর্শন’-এর সম্পাদক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়?
যিনি প্রথম সরাসরি কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের উল্লেখ করেন ‘সাম্য’ সম্বন্ধে।
১৭
এবার ফিরে আসা যাক বাংলায়। কলকাতা থেকে চিঠি গিয়েছিল লন্ডনে। কলকাতাকেন্দ্রিক বাংলার রাজনীতিতে কলকাতার জন্মের ইতিহাসটা জানা খুবই জরুরি। ১৭৭২ খ্রিস্টাব্দে মুর্শিদাবাদ থেকে রাজধানী এল কলকাতায়।
১৮
আর ঠিক ১০০ বছর পর ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী থেকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রাণকেন্দ্র লন্ডনে গেল কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের শাখা প্রতিষ্ঠার অনুমতি চেয়ে চিঠি।
কী আশ্চর্য সমাপতন!
আর এরও ১০০ বছর পর ১৯৭২ বাংলা থেকে কমিউনিস্ট উচ্ছেদের জন্য শুরু হবে আধা ফ্যাসিস্ত সন্ত্রাস। এখন প্রশ্ন হচ্ছে বাংলায় কি সত্যি সত্যি কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে উঠেছিল? তাহলে কমিউনিস্ট সংস্কৃতি, কমিউনিস্ট সাহিত্য কোথায়? কমিউনিস্ট সংস্কৃতি, সাহিত্য বলে যা চালানো হচ্ছে তা তো পেটি-বুর্জোয়ার গণতান্ত্রিক সাম্যকামী রূপ। তাতে বাবু কালচারের প্রগতিশীল মোড়ক।
১৯
একথা অবশ্য অস্বীকার করার উপায় নেই, গরিব মানুষের জন্য গরিব মানুষের স্বার্থে লড়াই করেছে অনেক মধ্যবিত্ত তরুণ। এমনকী জমিদার বা বড়লোক পরিবার থেকেও কমিউনিস্ট পার্টিতে এসেছেন বহু মানুষ। কমিউনে থেকেছেন। দুঃখ দারিদ্র্য বরণ করেছেন, পার্টির জন্য, গরিবদের জন্য সম্পত্তি বিলিয়েছেন, নিজের বা নিজেদের নামে থাকা খাস জমি বিলিয়েছেন, বাবার গুদাম থেকে মজুত চাল বের করে গরিব, ভুখা মানুষদের দিয়েছে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্পের মতো বহু আদর্শবাদী যুবক। বিলেত ফেরত ব্যারিস্টার জ্যোতি বসু-রা ট্রাম শ্রমিক নেতা মহম্মদ ইসমাইলের সঙ্গে একঘরে থেকে ঘর ঝাঁট দিয়েছেন, রান্না করেছেন, কাঁধে ব্যাগ নিয়ে বাদুড়ঝোলা হয়ে বনগাঁ লোকালে চেপে প্রচার করেছেন। অনেকেই জেলে গেছেন, বিনা চিকিৎসায় মারা গেছেন বহু সম্পন্ন পরিবারের সন্তানও, কিন্তু তাতেই তো কমিউনিস্ট পার্টি বোঝায় না।
ত্যাগ তো বৌদ্ধ সন্ন্যাসী বা অন্যান্য ধর্মীয় সম্প্রদায়ের আদর্শবাদী মানুষরা করেন, নিষ্ঠ গান্ধীবাদীরাও তো কম ত্যাগী নন, শুধু ত্যাগ দিয়ে তো কমিউনিস্ট পার্টি হয় না। কমিউনিস্ট পার্টিতে মার্কসবাদী তত্ত্ব পড়াশোনা হয়নি তাও নয়; হ্যারি পলিট, ল্যাস্কি, রজনীপাম দত্তের ক্লাস করা নেতারা বিলেত থেকে এসে বহু মানুষকে ‘দীক্ষিত’ করেছেন, কিন্তু গরিব খেটে খাওয়া কৃষক বা শ্রমিককে নেতৃত্বে উন্নীত করেননি। নিজেরা নেতা হয়েছেন, ভালো করার ইচ্ছায়, ভালো হয়ে, কিন্তু শ্রেণিচ্যুত হয়ে নয়। যদিও মনে রাখা দরকার, কাকাবাবু, আব্দুল হালিম, আবদুল্লাহ রসুল, সুন্দরাইয়া, রণদিভে, বাসবপুন্নাইয়া, ই.এম.এস, জ্যোতি বসু, প্রমোদ দাশগুপ্ত, রামমূর্তি, গোপালন-রা যথেষ্ট কৃচ্ছসাধন করেছেন। জ্যোতি বসু তো ঘর ঝাঁট দেওয়া রান্না করা সব কাজই করেছেন। কিন্তু একটা মানসিকতা কাজ করেছে, আমি তোমাদের লোক, কিন্তু তোমরা আমার ক্লাসের নও। মধ্যবিত্ত পেটিবুর্জোয়া আদর্শবাদী মনোভাব। অন্যের জন্য কাজ করব, কিন্তু অন্যে কেন তার অধিকার বুঝে নেবে না?
মজুরির লড়াই, জমির লড়াই-ই তো সব নয়, তার চেয়ে বেশি সমান অধিকারের লড়াই। তা কিন্তু বাংলার কমিউনিস্ট পার্টিতে হয়নি।
২০
মার্কস এসেছেন উচ্চবিত্ত সম্প্রদায় থেকে, এঙ্গেলস তো রীতিমত ধনী। মার্কসকে সংগ্রাম করতে হয়েছে বেঁচে থাকার জন্য। রীতিমতো আর্থিক সংগ্রাম। বন্ধু কমরেড এঙ্গেলসের সাহায্য তাঁর সংসার চালিয়েছে। কিন্তু তাঁরাই তো কমিউনিস্ট পার্টির সব নন। প্রথম কমিউনিস্ট লিগ প্রতিষ্ঠায় শ্রমিকদের ভূমিকা ছিল অসামান্য। বাংলাদেশের তাত্ত্বিক লেখক এম আর চৌধুরী তাঁর ‘মার্কসবাদ বা সমাজতন্ত্রের নয়—সংশোধনবাদ ও সমাজতান্ত্রিক বুর্জোয়াদের পতন’ গ্রন্থে দেখিয়েছেন সেই ভূমিকা। ফ্রেডরিখ এঙ্গেলসের কমিউনিস্ট লিগের ইতিহাস প্রসঙ্গে গ্রন্থ থেকে সেই ইতিহাস পাই। কিন্তু বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠার চেহারাটা কেমন?
২১
মুজফ্ফর আহমেদ সম্পন্ন বাড়ির ছেলে ছিলেন না। কিন্তু বাকিরা? প্রথম দিকে বাংলার যারা কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তোলার উদ্যোগ নেন ও নেতৃত্ব দেন এদের মধ্যে কোনও শ্রমিক ছিলেন কি? দরিদ্র কৃষক?
কাকাবাবু একটি শ্রদ্ধেয় নাম। বর্তমান নিবন্ধকারেরও অপরিসীম শ্রদ্ধা তাঁর প্রতি। কিন্তু ‘কাকাবাবু’ নামটা ৭৪ সার্পেন্টাইন লেনের বাড়িতে থাকার জন্য হয়তো প্রয়োজন ছিল, কিন্তু সারাজীবন? আসলে, একটা মধ্যবিত্ত আবেগ, প্রবণতা, এবং অত্যন্ত দুঃখের হলেও সত্যি সামন্ততান্ত্রিক প্রবণতা কাজ করেছে। কমরেড নয়, কাকাবাবু, যেমন কমরেড জ্যোতি নয়, জ্যোতিবাবু।
দুজন মানুষই আমার অসম্ভব শ্রদ্ধেয়। আসলে আমি একটি প্রবণতাকে ইঙ্গিত করতে চাইছি।
মহম্মদ ইলিয়াস উঠে এসেছিলেন শ্রমিক আন্দোলন থেকে। কিন্তু সে তো অনেক পরের কথা। সংসদে প্রথমে শ্রমিক। কিন্তু মহম্মদ ইলিয়াসও তো পরে বাবু হয়ে গেলেন। বিচ্যুত হয়ে গেলেন শ্রমিকজীবন ও শ্রমিক আদর্শ থেকে। সমরেশ বসুর ‘শেকল ছোঁড়া হাতের খোঁজে’-তে নাওয়াল আগারিয়ার মধ্যে খানিকটা খুঁজে পাওয়া যায় মহম্মদ ইলিয়াসকে। শ্রমিকজীবনকে পরিত্যাগ করেছিলেন বাবু মোহে, বাবু জীবন, ভদ্রলোক জীবন পরিত্যাগ করল তাঁকে—গৌরকিশোর ঘোষের ‘সাগিনা মাহাতো’-তেও এর খানিকটা ছবি মিলবে।
২২
বাংলার কমিউনিস্ট পার্টিগুলি নানা মতদ্বৈধতা নিয়েই বহু গৌরবোজ্জ্বল লড়াই করেছে—ক্যানেল কর আন্দোলন (১৯৩৬), শিক্ষক আন্দোলন (১৯৫৪), খাদ্য আদোলন (১৯৫৯), ট্রাম ভাড়া বৃদ্ধি বিরোধী আন্দোলন (১৯৫৪), তেভাগা আন্দোলন, নকশালবাড়ি আন্দোলন (১৯৬৭), খাস জমি দখল আদোলন (১৯৬৭), অপারেশন বর্গা (১৯৭৮), খেতমজুরদের মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলন (১৯৭৮), পঞ্চায়েতি রাজ প্রতিষ্ঠা (১৯৭৮)—এতে মানুষের অর্থনৈতিক সুরাহা হয়েছে, সম্মান ও মর্যাদা বেড়েছে, বেড়েছে গণতান্ত্রিক চেতনা—কিন্তু কমিউনিস্ট মানসিকতা কি বেড়েছে?
খাসজমি দখল, অপারেশন বর্গা কোনওটাই কমিউন প্রথা দূরে থাক, সমবায় প্রথা ভিত্তিক চাষের জন্ম দিতে পারেনি। খেতমজুরের মজুরি আন্দোলন ক্রমশ অর্থনৈতিক সুবিধাবাদের আন্দোলন পর্যবসিত হয়েছে। মজুরি বেড়েছে, কাজের ঘণ্টা কমেছে, বছর ভর বংশানুক্রমে কিসান প্রথা কমেছে, দিন মজুরি বেড়েছে। বছর মাহিনা বা মাস মাহিনা-র কিসানের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কমেছে। এতে শোষণ কতটা কমেছে জানা না গেলেও পারিবারিক সম্পর্ক ক্ষয়িষ্ণু। মালিক-শ্রমিক সম্পর্ক যতটা সচেতনতায় আসে, ভালোবাসা ততটা না।
কমিউনিস্ট পার্টি বাংলায় বহু ইতিবাচকতার জন্ম দিয়েছে। জাতপ্রথার প্রভাব কমার পিছনে চৈতন্য সংস্কৃতির পর কমিউনিস্ট সংস্কৃতির অবদান অপরিসীম। চৈতন্য জাতিভেদ প্রথার বিরুদ্ধে বলেছিলেন :
যে জন বৈষ্ণবের জাতিবুদ্ধি করে।
সে অধম যেন জন্ম জন্ম যোনিতে ডুবে মরে।।
আর কমিউনিস্ট পার্টি তো জাতিভেদ প্রথার বিরোধী। চৈতন্য যবন হরিদাসের সঙ্গে একপাতে খেতে পারেননি। কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টি করা নামী ব্রাহ্মণ বাড়ির ছেলে একসঙ্গে খেয়েছে তথাকথিত নিম্নবর্গের সঙ্গে। বাড়িতে ছেলে নিন্দিত হলেও তথাকথিত ছোটলোকদের সমাজ তাঁকে মাথায় করে তুলে রেখেছে।
২৩
তপশিলি জাতি-উপজাতি সমাজে বামপন্থীদের প্রভাবের পিছনে এসব আপাত অদৃশ্য ঘটনার প্রভাব ব্যাপক। সমাজে জাত-পাতের উঁচু-নীচুর বদলে মানসিকতাকে, তাঁদের সাংস্কৃতিক বা ক্রীড়া নৈপুণ্যকে গুরুত্ব দেওয়া, তাঁদের পরিবারে গিয়ে খাওয়া-দাওয়া করা, বসা, থাকা, তাঁদের মা-বোনের সঙ্গে আত্মীয় সম্পর্ক গড়ে তোলা—কমিউনিস্ট সংস্কৃতির পরিচায়ক। পোশাক নয়, গুরুত্বপূর্ণ মানুষটি। পয়সা নয় গুরুত্বপূর্ণ মন, মানসিকতা—এসব ভাবনার ক্রিয়াশীলতার পেছনে কমিউনিস্ট পার্টির অবদান আছে।
কমিউনিস্ট সংস্কৃতির মধ্যে পড়েছে শিক্ষাবিস্তারের আন্দোলনও। ১৯০৫-এর বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে শহরাঞ্চলে জাতীয় শিক্ষা আন্দোলনের প্রভাবে বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। স্বাধীনতার পর গ্রাম্যাঞ্চলেও এই ঢেউ আছড়ে পড়ে প্রবল ভাবে। তবে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের প্রভাব শুধু শহরে নয় গ্রামেও পড়ে। তার জেরে, গত চার পাঁচ বছর ধরে বহু বিদ্যালয়ের শতবর্ষ পূর্তি অনুষ্ঠান হয়েছে। স্বাধীনতার পর হওয়া বিদ্যালয়গুলিতে বামপন্থী শিক্ষকদের প্রভাব বাড়ে উল্লেখযোগ্য ভাবে। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় নতুন শশী বা কুমুদ নয়, ‘পথের পাঁচালী’-র আদর্শবাদী প্রণবদের দেখা যায়। তাদের প্রভাবে কংগ্রেস বিরোধী এবং মার্কসবাদী হয় ছাত্রদের একটা বড় অংশ। ছাত্রীরাও মজে যায় নতুন আদর্শবাদী নায়কদের দেখে। উস্কোখুস্কো চুল, কাঁধে ব্যাগ, কবিতা-গান-নাটকে তুখোড়, একটু ভাবালু এবং রাগী, আবার যুক্তির তোড়ে ভাসাতে পারে বক্তৃতা মঞ্চ—এমন যুবকরা জয় করে নেয় তরুণীচিত্ত। এই তরুণীরা যখন শিক্ষিকা হয়ে বিদ্যালয়-মহাবিদ্যালয়ে গেলেন, নিয়ে গেলেন জাতপাতহীনতার মন্ত্র। সহজভাবে সহজ হয়ে সবার সঙ্গে মেশার বার্তা। যা কমিউনিস্ট সংস্কৃতির একটা বলিষ্ঠ দিক।
২৪
ভুখা মানুষ ধরো বই—ওটা হাতিয়ার। এই মন্ত্র নতুন স্বরে ধ্বনিত করে কমিউনিস্ট সংস্কৃতি। নিরক্ষরতা দূরীকরণ সমিতি-র মতো বহু সংগঠন সাক্ষরতা আন্দোলন নামে।
গান্ধীবাদীরাও একাজে যথেষ্ট অগ্রণী ভূমিকা নেন। বিশেষ করে বুনিয়াদী শিক্ষার শিক্ষণপ্রাপ্ত প্রাথমিক শিক্ষকরা। বৌদ্ধদের হাতে বাংলা নাটক প্রসার পায়। বাংলার নাট্য আন্দোলন, ক্লাব প্রতিষ্ঠায়, যাত্রা সংগঠনে কমিউনিস্টরা বড় সাফল্যের দাবিদার। আবৃত্তি, গান কবিতায় রবীন্দ্র-নজরুল-সুকান্ত জয়ন্তী উদযাপনে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছিলেন তাঁরা। প্রেম-প্রীতির দেশ—বাংলাদেশ। এখানে কৃষ্ণের বন্দনা। বন্দনা কালোর। কৃষ্ণকলিদের আদর বাড়ে কমিউনিস্ট সংস্কৃতিতে। শ্যামলী একহারা চেহারা অল্প বিষণ্ণ মুখ—এই মেয়েদের পছন্দ করতে থাকেন কমিউনিস্ট পার্টির কর্মীরা। অতি সুন্দরীদের একটা টান ছিলই বোহেমিয়ানদের প্রতি, কিন্তু এই নতুন বোহেমিয়ানদের ঝোঁক কৃষ্ণকলিদের দিকে ধাবিত হল। প্রেম করে পণ ছাড়া বিয়ে কমিউনিস্ট সংস্কৃতির আরেক বড় অবদান। বিয়েতে যৌতুক এমনকি ফুল বা বই ছাড়া না দেওয়া বা নেওয়া কমিউনিস্টরাই শিখিয়েছে সমাজকে। বিয়েতে বাহুল্য নয়, নয় জাঁকজমক।
শ্রদ্ধা—শ্রাদ্ধের বদলে কমিউনিস্টদের অন্যতম অবদান। শ্রাদ্ধের নামে গান্ডেপিন্ড গেলা বা গেলানো নয়, স্মৃতিচারণ—এই ধারণা বিকশিত হয়েছে কমিউনিস্ট সংস্কৃতির সাহায্যে। গরিবকেও আপনি বা তুমি বলা, তুই না বলা, ছোটদের পাড়া বা মুচিপাড়া বা বাগদিপাড়া না বলে এলাকা বা স্থানের নামে ডাকা—কমিউনিস্ট সংস্কৃতি। সংখ্যালঘুরাও সম্মান পান কমিউনিস্ট সংস্কৃতিতে, মিঞা ভাই—এর বদলে কমরেড ডাক তাঁদের সম্মানিত ও সমান করে। তার সুফলও পেয়েছিল কমিউনিস্ট পার্টি। বাংলা।
২৫
কিন্তু যখনই আভিজাত্য এসে জুড়ে বসল, বড়োলোকিপনার প্রতি ঝোঁক বাড়ল, ধনীদের তোষামুদে ও চাটুকারিতাপনা পছন্দ হল গরিবদের অকপট সত্য উচ্চারণের চেয়ে—সস্তা স্টিলের থালার মোটা চালের ভাতের চেয়ে বড়লোক বাড়ির সাদা চামড়ার হাতের পরিবেশনে মুরগির মাংস অমৃত বোধ হতে শুরু হল—নিজের সাইকেলের বদলে মিল মালিকের ছেলের মোটর সাইকেলের পিছনে চাপা—স্বস্তি ও আরামদায়ক হল—সর্বনাশ হল পার্টির, সংস্কৃতির মানুষের।
বাসের ভিড়, ট্রেনের গুঁতোগুঁতি—শেষ কবে সহায়তা পেয়েছে নেতাদের কেউ জানে না। ফলে বক্তৃতা, জীবনযাপন, সাহিত্য, শিল্প—এবং পার্টি দপ্তর থেকে সাধারণের সংস্কৃতির নির্বাসন ঘটল। বাগাড়ম্বর, তোষামোদ, চাটুকারিতা, ঈর্ষা, অসুয়া উপদলীয় চক্রান্ত, সামন্ততান্ত্রিক প্রবণতা (কর্মীদের চাকর ভাবা) কমিউনিস্ট সংস্কৃতির জায়গা নিল। স্বজনপোষণ হয়ে উঠল উপজীব্য।
২৬
ইভান তুর্গেনেভ ‘পূর্বক্ষণ’-এ লিখেছিলেন, রাজতান্ত্রিক সমাজতান্ত্রিকতার উচ্ছেদ চেয়ে, তাই মায়ের নিন্দাতেও পরান্মুখ হননি।
আর নতুন পূর্বক্ষণ এর প্রতিনায়করা দিশা হারালেন রাজতান্ত্রিক-সামন্ততান্ত্রিকতার বেড়াজালে।
যে বেড়াজাল ছিন্ন করতে বামপন্থার হাত ধরেন মানুষ।
দেশে-বিদেশে-পশ্চিমবঙ্গে।
পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থা প্রসারে মুজফফর আহমেদ, আবদুল হালিম, সৈয়দ শাহেদুল্লাহ, প্রমোদ দাশগুপ্ত, জ্যোতি বসুদের ভূমিকা অপরিসীম।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন