দ্বারকানাথ, রবীন্দ্রনাথ এবং

ইমানুল হক

জীবনের প্রথম লড়াইটা মানুষকে লড়তে হয়, তার নিজের সঙ্গে। আমি হারার আগে হার মানব না, মরার আগে মরব না, দু’বেলা—এবং বিধ নানান উচ্চারণে, নিজের সত্তাকে, নিজের মনোভূমিকে বাঁচিয়ে ও জাগিয়ে রাখতে হয় নিরন্তর।

রবীন্দ্রনাথ কি কেবল আপন প্রেরণা, প্রতিভায় নিজেকে উন্নীত করেছিলেন এক অভ্রংলিহ উচ্চতায়, যার সামীপ্যে পৌঁছনোর চিন্তাতেও কেঁপে ওঠে হৃদয়? জীবনে অজস্র লড়াই লড়তে হয়েছে তাঁকে। দু’বার আত্মহত্যার কথা ভেবেছেন। ‘চিঠিপত্রে’-র পঞ্চদশ খণ্ডে মেলে তার সাক্ষ্য।

বন্ধুপ্রতিম এন্ড্রুজ ও পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে চিঠি লিখছেন এ নিয়ে। জানাচ্ছেন ‘ডেলিবারেটলি সুইসাইড করতেই বসেছিলুম’।

অথচ নিজে হয়ে উঠেছেন অজস্র মানুষের প্রেরণার স্থল। আজও আমাদের, যাঁদের কোনো বিশেষ ঈশ্বর নেই, তাঁদের কাছে রবীন্দ্র কথা, গান, কবিতা নতুন দিক চিহ্ন। হতাশের কাছে আশা, অন্ধের কাছে আলোক শিখা তাঁর রচনা।

যে অর্থে ‘শিক্ষিত’ ব্যক্তির পরিমাপ করতে অভ্যস্ত সমাজ, তা তিনি নন। এম এ, বি এ ডিগ্রি তাঁর নেই। (ভাগ্যিস নেই) তাহলে বাংলা সাহিত্যের সমূহ সর্বনাশ হত। এক হাজার বছর তিনি এগিয়ে দিয়েছেন বাংলা ভাষাকে। চিত্রশিল্পী পরিতোষ সেন তাঁর সম্পর্কে লিখেছেন—’একমাত্র মৌলিক চিত্রশিল্পী’। জাভা থেকে যিনি নাচ, মরিশাস থেকে আখ চাষ প্রণালী, বিদেশ থেকে বাটিক করার পদ্ধতি নিয়ে আসতে চান, তিনি আবার বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র-র বসুর গবেষণাগার তৈরি করার জন্য দু’লক্ষ টাকা চাঁদা সংগ্রহের উদ্যোগ নেন।

‘রাশিয়ার চিঠি’-তে জানান যে সবচেয়ে বড়ো কাজ পড়ে আছে শ্রীনিকেতনে। কবি, দার্শনিক, সমাজতান্ত্রিক, অর্থনীতিবিদ, সমাজসংস্কারক, ঔপন্যাসিক, গীতিকার, নট ও নাট্যকার, চিত্রী, শিক্ষক, অধ্যাপক, বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাতা—কি নন তিনি? বাংলার প্রথম সমবায় ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতাও রবীন্দ্রনাথ। শিলাইদহে পতিসরে স্থাপিত হয় সেই ব্যাংক। একটা সময় চামড়ার ব্যবসাও করেছেন অর্থাভাবে। মেয়ের বিয়ের জন্যে বেচে দিতে চেয়েছেন সমস্ত গ্রন্থস্বত্ত্ব।

সেই মানুষটির জীবনে কার প্রভাব সবচেয়ে বেশি? অনেকেই বলেন, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথা। কিন্তু শুধুই কি দেবেন্দ্রনাথ? দেবেন ঠাকুরের অধ্যাত্মবোধ কি শেষ পর্যন্ত ছিল তাঁর সঙ্গী? নাকি যে মানুষটির নাম প্রায় অনুচ্চারিত ঠাকুর পরিবারে, সেই দ্বারকানাথ ঠাকুরের সংগ্রামশীল ও বহুমুখী জীবন রক্তের শিরায় শিরায় কাজ করেছে, রবীন্দ্রজীবনে? নাকি রবীন্দ্রপ্রতিভার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে তাঁদের পারিবারিক ঐতিহ্য—যে ঐতিহ্য বাধাকে অগ্রাহ্য করে নতুন পথ খুঁজে নেওয়ার।

দ্বারকানাথ ঠাকুর সম্পর্কে তাঁর জীবনীকার কৃষ্ণ কৃপালিনী লিখছেন—’ঠাকুর পরিবারের লোকেদের মুখে কিংবা বহুকাল শান্তিনিকেতনে থেকেও আমি তো এঁর নাম বড় একটা শুনিনি। হ্যাঁ, রাজা রামমোহন রায়ের কথা খুবই শোনা যেত, প্রায় দেবতাজ্ঞানে তাঁর প্রতি ভক্তি শ্রদ্ধাও নিবেদিত হত প্রচুর। অথচ যে ব্যক্তি আধুনিক ভারতের সর্বপ্রথম ও সর্বপ্রধান বিদ্রোহীর নিত্য সঙ্গী হয়ে, তাঁর হাতে হাত লাগিয়ে আমৃত্যু তাঁর সঙ্গে কাজ করলেন, এমনকী রাজার মৃত্যুর পরে তাঁর তথাকথিত অনুগত ভক্তের দল যখন নবগঠিত ব্রাহ্ম সমাজ পরিহার করতে উদ্যত হল, তখন তিনি সমাজকে জিইয়ে রাখলেন, তিনি কেন অবজ্ঞাত উপেক্ষিত হয়ে রইলেন? এই বিস্মৃতপ্রায় লোকটি কি তবে কূলে কালি দিয়েছিলেন বলে পরিবারের কেউ তাঁর নাম উচ্চারণ করে না? যে লোকটি এত লোকের শ্রদ্ধা অর্জন করেছিলেন, মৃত্যুর পর তাঁকে এত তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা হল কেন?’

ভবিষ্যৎ গবেষকদের এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে।

বর্ধমান জেলার কুশ গ্রামের কিছু বাসিন্দা জীবন ও জীবিকার জন্য পাড়ি দিয়েছিলেন পূর্ববঙ্গে। কুশ গ্রামের বাসিন্দা তাই কুশারী। রবীন্দ্রনাথদের আদি কৌলিক পদবী কুশারী। রবীন্দ্রনাথের বংশের আদি পুরুষ খুলনা জেলার দিবাভোগ গ্রামের জগন্নাথ কুশারী। জগন্নাথের পুত্র পুরুষোত্তম বিদ্যাবাগীশ।

রবীন্দ্রনাথদের যে ‘পীরআলি’ (পিরালি) ব্রাহ্মণ বলা হয়, অর্থাৎ ‘যবন সংসর্গ’-র অপবাদ দেওয়া হয় তার শুরু এই জগন্নাথ বা পুরুষোত্তম থেকে। এটা একটা মত। অন্য মত ভিন্ন। নদীয়া পণ্ডিত সমাজের সভাপতি যোগেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য-র মত; ‘বলা হয় ঠাকুর বংশের পূর্বপুরুষ পঞ্চানন কলকাতায় পা দেবার অর্ধশতাব্দীকাল পরেও পিরালিরা সদ ব্রাহ্মণের প্রাপ্য মর্যাদা পেয়ে আসছিলেন। কিন্তু তাঁরা অর্থবিত্তে সমৃদ্ধ ও প্রভাবশালী হবার পর বাগবাজারের বাবু দুর্গাচরণ মুখোপাধ্যায় সমাজের চোখে তাঁদের হেয় প্রতিপন্ন করার উদ্দেশ্যে জোট বাঁধেন। হয়তো কলকাতার ধনী ও বনেদী কায়স্থরাও গোপনে দুর্গাচরণের এই ষড়যন্ত্রে উসকানি দিয়ে থাকবেন।’ (সূত্র হিন্দু কাস্টস অ্যান্ড সেক্টস যোগেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, প্রকাশক, থ্যাকার, স্পিঙ্ক অ্যান্ড কোং, কলকাতা-১৮৯৬; দ্য ডিগ্রেডেড ব্রাহমিনস—দ্য পিরালি টেগোর অফ ক্যালকাটা—পার্ট সিক্স, পৃ. ১১৯-১২৪)।

পুরুষোত্তম বিদ্যাবাগীশ সুপণ্ডিত মানুষ। পুরুষোত্তমের না তাঁর পিতা কার জন্য ‘পীরালি দোষ’ সে নিয়ে বিতর্ক। অবশ্য বিতর্ক বহু। একটি মত—পীরালি ব্রাহ্মণ শুকদেবের মেয়ের পাণি গ্রহণ করেন জগন্নাথ। অন্য মত, যশোহরে গঙ্গা নদীতীরে প্রাতঃ অবগাহন শেষে পুরুষোত্তম দেখেন শুকদেব তাঁর কাছে প্রার্থীর ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে। প্রার্থনা—কন্যার পাণিগ্রহণ। ধার্মিক ব্রাহ্মণ প্রার্থীকে ফেরান কী করে?

পুরুষোত্তমের অধস্তন পঞ্চম পুরুষ মহেশ্বর ও শুকদেব। তাঁরা বাস করতেন যশোহরে। মহেশ্বর বা মহেশের পুত্র পঞ্চানন কুশারী। পারিবারিক বিবাদে বিরক্ত হয়ে অথবা উন্নতিকল্পে পঞ্চানন কাকা শুকদেবকে নিয়ে হাজির হন গঙ্গাতীরে গোবিন্দপুরে। গঙ্গা মিশে যায় হুগলি নদীতে আর গোবিন্দপুর হয় কলকাতার অংশ। গোবিন্দপুর ছিল ছোট গ্রাম। কয়েক ঘর জেলের বাস। শুকদেব ও পঞ্চাননের বলিষ্ঠ, দেবতার মত চেহারা। জেলেরা ভক্তি শ্রদ্ধা করে ডাকত ঠাকুর। ‘ঠাকুর শব্দটি এসেছে তুর্কি ‘তগগর’ থেকে। ‘তগগর’ মানে বড়। পঞ্চানন উদ্যমী পুরুষ। জাহাজি ইংরেজ সাহেবদের ফাইফরমাশ খাটতে খাটতে খানিকটা ইংরাজি শিখলেন। গোরারা জেলেদের মুখে শুনলেন পঞ্চাননদের পরিচয় ঠাকুর। ঠাকুর গোরা সাহেবদের মুখে বিকৃত হয়ে দাঁড়াল ‘টেগোর’ বা ‘টাগুর’।

পঞ্চাননের দুই ছেলে জয়রাম ও সন্তোষরাম। পঞ্চাননের সুপারিশে জয়রাম পেলেন ইংরেজের চাকরি। ১৭০৭ খ্রিস্টাব্দে জয়রাম ও সন্তোষরাম দুই ভাই কলকাতার প্রথম কালেক্টর র‍্যালফ সেলডনের সুপারিশে হলেন আমিন। আমিনের কাজ জমি জরিপ এবং সুতানটি ও তার সন্নিহিত এলাকার রাজস্ব আদায়। জয়রাম বিত্তশালী হন। বাড়ি করেন সম্পন্ন এলাকা ধর্মতলায়। ১৭৪১-৪২ খ্রিস্টাব্দে বর্গি আক্রমণের যুগে কলকাতাকে রক্ষার জন্য ‘মারাঠা ডিচ’ নামে খাল কাটাই হয়। দায়িত্বে জয়রাম। কাজকারবার, ঠিকাদারি, দালালিতে জয়রাম হলেন আরও ধনী। মারাঠা ডিচ আজকের সার্কুলার রোড। জয়রাম যুক্ত ছিলেন ফোর্ট উইলিয়াম নির্মাণের কাজেও, জয়রাম মারা গেলেন ১৭৫৬-য়।

জয়রামের চার পুত্র। আনন্দীরাম, গোবিন্দরাম, নীলমণি, দর্পনারায়ণ। আনন্দীরাম ভালো ইংরেজি জানতেন। মারা যান অকালে, নীলমণি ও দর্পনারায়ণ ঠাকুর পরিবারের সম্পত্তি বৃদ্ধি করেন। ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দুই ভাই একসঙ্গে ছিলেন। নীলমণি বাইরে থাকতেন। কাজের জন্য। ওড়িশা, চট্টগ্রামে। সম্পত্তি নিয়ে বিবাদ বাধল ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে। দর্পনারায়ণ নীলমণিকে একলাখ টাকা ও শালগ্রাম শিলা ছাড়া কিছু দিলেন না। নীলমণি চলে এলেন পাথুরিয়াঘাটার বাড়ি ছেড়ে জোড়াসাঁকোয়। গড়লেন কুঁড়েঘর—পাথুরিয়াঘাটার তুলনায়। নীলমণি মারা গেলেন ১৭৯৩-এ। নীলমণির তিন ছেলে। বড় ছেলে রামলোচন, মেজো ছেলে রামমণি এবং ছোট ছেলে রামবল্লভ। নীলমণির মেজছেলে রামমণি কাজ করতেন কলকাতা পুলিশ বিভাগে। রামমণির দুই স্ত্রী। মেনকা ও দুর্গামণি। মেনকার দুই সন্তান—রাধানাথ ও দ্বারকানাথ। মেনকার ছেলে দ্বারকানাথ ঠাকুরকে দত্তক নেন রামলোচনের স্ত্রী অলকাসুন্দরী। রামলোচন ছিলেন বাইজী নাচ গান নিয়ে ব্যস্ত। অলকাসুন্দরী ধর্মের আশ্রয় নেন।

দ্বারকানাথের জন্ম ১৭৯৪ খ্রিস্টাব্দে। ১৭৯৯-তে তাঁকে দত্তক নেন অলকাসুন্দরী। ছোটবেলায় মা অলকাসুন্দরীর কাছে ধর্মেকর্মে দীক্ষা। যদিও পরে সে-সব বর্জন করেন। অলকাসুন্দরীর জীবনধারা মানেননি দ্বারকানাথ। তাঁর জীবনধারা মানেননি স্ত্রীও। দ্বারকানাথ ‘কার অ্যান্ড টেগোর’ কোম্পানি গঠন করেন। হন বহুবিত্তশালী। স্বয়ং ইংল্যান্ডের রানি তাঁর আনুকূল্যপ্রার্থী ছিলেন। নিন্দুকেরা বলেন রানির গর্ভে দ্বারকানাথের সন্তান।

দ্বারকানাথের জীবনে বহু বিপর্যয় আসে। মৃত্যুও হয় বিদেশে। তাঁর মৃত্যুর পর পুত্র দেবেন্দ্রনাথকে পড়তে হয় বিপুল অর্থসংকটে।

ঠাকুর পরিবারে বারে-বারে সংকট এসেছে। সংকট মুক্তির পথে এসেছে সাফল্য। ‘মুক্তধারা’র অনুরণন যেন ঠাকুর পরিবারে। সংকটই যেন জেদি করে তুলেছে ঠাকুর পরিবারের সন্তানদের। রবীন্দ্রনাথ তাঁর অন্যতম দৃষ্টান্ত। প্রতিভার পাশাপাশি রক্তধারাকেও আমাদের স্মরণ রাখা জরুরি।

‘যোগাযোগ’-এর মধুসূদন চরিত্রে দ্বারকানাথ ঠাকুরের ছায়া আছে।

দ্বারকানাথ ঠাকুর বাঙালি পুঁজিপতিদের চরিত্র বুঝতে সহায়ক। তবে তাঁর দার্ঢ্য, পরবর্তী প্রজন্ম বজায় রাখতে সক্ষম হল না। ব্যতিক্রম রবীন্দ্রনাথ। এক ভিন্নধারার চরিত্র তিনি।

ভিন্ন ধারা থেকে তিনি রাশিয়া যাওয়াকে তীর্থযাত্রা বলে মনে করেন। যে রাশিয়া সাম্যবাদী—সমাজতন্ত্রের স্বপ্নে বিভোর। মার্কসবাদী নন। কিন্তু একটা কল্পিত সমাজতান্ত্রিক জীবনবোধে উদ্দীপিত। সমাজতন্ত্রী রাশিয়া গঠনের মূল কারিগর ভ্লাদিমির ইলিচ উলিয়ানভ—লেনিন। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত সমান সক্রিয়। রবীন্দ্রনাথের মতোই।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন