ইমানুল হক
১
রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ব্যক্তিটি বসে আছেন তাঁর দপ্তরে। দরজা ঠেলে ঢুকলেন তাঁর সচিব ফতিয়েভা। তাঁকে দেখেই ঈষৎ বিব্রত রাষ্ট্রপ্রধান। অজুহাত দেওয়ার সুরে বললেন, এই একটু কাগজ-পত্র নাড়াচাড়া করছিলাম। সচিব বিব্রত। তিনি জানেন উনি আসবেন, বেলা ১১টায়। তার আগেই উনি এসে গেছেন। দু’জনেরই বিব্রত হওয়ার মূল কারণ, ডাক্তারের নির্দেশ। নির্দেশ এই, উনি প্রতিদিন সময় মেনে কাজ করবেন। অতিরিক্ত অমানুষিক পরিশ্রম চলবে না।
উনি—লেনিন। সময়টা ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর। লেনিন ২ অক্টোবর মস্কো ফিরছেন। মে মাসের শেষে ৩৫ কিলোমিটার দূরে গোর্কিতে ছুটি কাটাতে গিয়েছিলেন। সেখানে ২৬ মে স্ট্রোক হয় তাঁর। ফলে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। অসুস্থতা এবং তজ্জনিত ‘ছুটি’ কাটিয়ে অক্টোবরে ২ তারিখে মস্কোর ক্রেমলিনে কাজে ফিরলেন তিনি। ফিরছেন, সঙ্গে ডাক্তারের নির্দেশ।
এমনই ছিলেন লেনিন। এভাবেই কাজ করে গেছেন অসুস্থ অবস্থাতেও। কিন্তু লেনিনের অসুস্থতা কি ‘সিফিলিস’ জনিত কারণে? না, চরম লেনিন বিরোধীরাও কোনওদিন একথা আগে বলেননি। আসলে লেনিন একবারই ভুল লিখেছিলেন। ‘রাষ্ট্র ও বিপ্লবে’। তাঁর মত ছিল, বিপ্লবীদের জীবিত অবস্থায় বুর্জোয়ারা তাঁদের বিরুদ্ধে কুৎসা রটায়, মরার পর তাঁদের বীর মহান বানায়।
কিন্তু লেনিন এমনই বিপ্লবী যে, মৃত্যুর ৮০ বছর পর বুর্জোয়ারা তো বটেই এমন কি সংশোধনবাদী বামপন্থীও তাঁর চরিত্র হনন করে বসে।
২
১৯২৪ সালের ২১ জানুয়ারি।
কে জানত, এটিই তাঁর জীবনের শেষ দিন।
অথচ সকাল থেকে সবকিছুই ছিল বেশ স্বাভাবিক।
ডাক্তাররা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তিনি যদি একটু ঘুরে আসেন ভালো হয়। ঘুরে আসা মানে, তাঁর প্রিয় ভ্রমণ তো শিকার যাত্রা। তাই ঠিক হল, শিকারে যাবেন তিনি। সকালে উঠে প্রাতরাশ খেলেন। তারপর এলেন বুখারিন। বুখারিন তাঁর বিশ্বস্ত কমরেড, দীর্ঘদিনের সহচর। আর এলেন বিপ্লবের ও দেশের নেতৃত্বে যাঁদের নেতৃত্ব তাঁর প্রিয়তম আকাঙ্ক্ষা—সেই শ্রমিক কমরেডরা। স্লেজে চড়লেন তিনি। গেলেন শিকারযাত্রায়। ফিরলেন দুপুরে।
খুব খুশি খুশি মুখ। যদিও ক্লান্ত কিন্তু পরিতৃপ্তি সমস্ত অন্তর জুড়ে। আর কয়েকদিনই পর ফিরবেন ক্রেমলিনে। পার্টির কাজে। দেশের কাজে। মানুষের কাজে। আগের মতোই। বিকালে খাবার খেলেন—সম্পূর্ণ শেষ করে। তারপর ঘুমোতে গেলেন। ঘুমের মধ্যেই স্ট্রোক। সন্ধ্যার মুহূর্তে। মারা গেলেন সন্ধ্যা ৬.৫০ মিনিটে।
৩
লেনিন। লেনিনকে নিয়ে ২০০১ খ্রিস্টাব্দে বাংলা হয়েছিল তোলপাড়। লেনিনের জীবনকেন্দ্রিক চলচ্চিত্র ‘টরাস’-কে ঘিরে। স্বঘোষিত লেনিন বিশেষজ্ঞরা শোনা কথায় ভর দিয়ে হাজির হয়েছিলেন মসিযুদ্ধে। পারলে অসিযুদ্ধ করে ফেলেছিলেন সেদিন। লেনিনের বিরুদ্ধে সেদিন কমিউনিস্ট শাসক থেকে বুর্জোয়া সাংবাদিক। নানা মুনির নানা মত। কেউ বলছেন, ‘লেনিন ১৯২৩ সালে ১৮ ডিসেম্বর থেকে ১৯২৪ সালের ২১ জানুয়ারি পর্যন্ত গুরুতর অসুস্থ ছিলেন’, কেউ লিখছেন, ‘তিনি ১৯২৪ সালে ২১ জানুয়ারি ভোরে মারা গিয়েছিলেন।’ কারও আবার একেবারে দ্বিধাহীন সিদ্ধান্ত—
‘লেনিনের শেষ জীবনের অসুস্থতার কথা তো সর্বজনবিদিত।’ কেউ আবার জানিয়েছেন, ‘লেনিনের প্রথম স্ট্রোক ১৯২৩ সালের ১০ মার্চ।’ আবার এক কৃষক নেতা মনে করেন, ‘লেনিন শেষ বয়সে বিকৃত মস্তিষ্ক হয়ে গিয়েছিলেন’। কোনও-কোনও কমিউনিস্ট নাট্যকার এবং বামপন্থী অভিনেতার সহানুভূতি জাগে লেনিনের অসহায়তা দেখে।
কিন্তু সত্যি কী ঘটেছিল লেনিনের জীবনে? লেনিন মানুষ। পাথর নন। আর দেবতাদের মতো শয়তান নন মোটেও। তাই অসুস্থ তিনি হয়েছেন। হতেন, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তা বলে তার অসুস্থতা তাঁকে জাতিবিদ্বেষী, ক্ষমতালোভী, পুরুষতান্ত্রিক ও অর্ধ উন্মাদ বানিয়ে দেবে—এটা কি সম্ভব? আসুন ইতিহাসের দিকে তাকানো যাক।
অতিরিক্ত শারীরিক ও মানসিক পরিশ্রম, না খেতে পাওয়া এবং সুযোগ থাকা সত্ত্বেও দেশের লোক ঠিকমতো খেতে না পাওয়ায় নিজে পর্যাপ্ত আহার করার সঙ্গে লেনিনের অসুস্থতার মূলে দায়ী ছিল একটি বড় ঘটনা।
৪
লেনিনকে হত্যা করার চেষ্টা করা হয় ১৯১৮ খিস্টাব্দের ৩১ আগস্ট। ফ্যানি কাপলান নামে এক মহিলা লেনিনের সঙ্গে কথা বলতে বলতে রিভলভার বার করে পয়েন্ট ব্ল্যাক রেঞ্জ থেকে গুলি করেন। দুটো বুলেট। একটা ঢুকে যায় কাঁধ দিয়ে প্রধান ধমনীর মধ্যে। অন্যটা হৃৎপিণ্ডের ওপরে ফুসফুসে। কিন্তু লেনিন সেই অবস্থাতেই তাঁর জন্য নির্দিষ্ট গাড়িতে উঠলেন। অনেকে এগিয়ে এলেন ওঠার জন্য সাহায্য করতে। কিন্তু লেনিন কারও কাঁধে ভর দিতে অস্বীকার করলেন। তাঁর গাড়ির চালক স্তেপান গিল লেনিনের পাশে বসে তাঁকে নিয়ে এলেন ক্রেমলিনে। সেদিনের ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে স্তেপান পরে লিখেছেন—
মাঝপথে লেনিন তাঁর আসনে এলিয়ে পড়লেন কিন্তু একবারও কোনও কাতরোক্তি বা কোনো ধরনের আওয়াজ করলেন না। তাঁর মুখ ক্রমশই সাদা হয়ে যাচ্ছিল। তাঁর পাশে বসে থাকা এক কমরেড তাঁকে ধরে রাখছিলেন। ক্রেমলিনে স্তেপান ঢোকেন ট্রটস্কি গেট দিয়ে। তিনি গেটে থাকা সান্ত্রীদের শুধু বলেন, লেনিন।
৫
ক্রেমলিনে তখন কোনো হাসপাতাল বা প্রাথমিক চিকিৎসা কেন্দ্র বা ডাক্তার ছিল না। ছিলেন ভেরা মিখাইলোভনা ভেলিচকিনা। তিনি ছিলেন বঞ্চভুয়েবিচের স্ত্রী। ঘটনাক্রমে ভেরা চিকিৎসাবিদ্যাটা জানতেন। তিনি এগিয়ে আসেন লেনিনের চিকিৎসার কাজে। ভেরা একটা মরফিয়া ইঞ্জেকশন দিলেন লেনিনকে। খবর পেয়ে তড়িঘড়ি ছুটে আসা ডাক্তাররা না আসা পর্যন্ত লেনিনের দেখভালের কাজে নিজেকে ব্যাপৃত রাখেন ভেরা। ডাক্তাররা আসার অল্পক্ষণের মধ্যেই হাজির হলেন নাদেজদা স্ক্রুপস্কায়া। লেনিনের সারা জীবনের বন্ধু, স্ত্রী, সহকর্মিনী, কমরেড। নাদেজদা লেনিনকে কিছু বলার আগেই লেনিন তাঁকে বললেন, তুমি এসেছো, কিন্তু তুমি তো ক্লান্ত। যাও, শুয়ে পড়ো গে।
নাদেজদা সেদিনের ঘটনার বিবরণ দিয়েছেন। স্মৃতিকথায় লিখেছেন, ‘কথাগুলি ছিল অপ্রাসঙ্গিক, কিন্তু তাঁর চোখ অন্যকথা বলছিল, এটাই শেষ।’
৬
লেনিন কোনওভাবে যাতে বিপর্যস্ত হয়ে না পড়েন, তাই নাদেজদা তখনই বেরিয়ে আসেন ঘর ছেড়ে। এইবার শুরু হল যুদ্ধ। মৃত্যুর সঙ্গে এক মহতী মানুষের।
গৃহযুদ্ধের কারণে ট্রটস্কি তখন মস্কোয় ছিলেন না। তিনি ছুটে এলেন মস্কোতে। সোভিয়েতের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী পরিষদে ভাষণ দিতে গিয়ে ২ সেপ্টেম্বর ট্রটস্কি বললেন, গৃহযুদ্ধে নতুন ফ্রন্ট লেনিনের বেঁচে ওঠার লড়াই। তাঁকে বাঁচিয়ে রাখাটাও আমাদের একটা যুদ্ধের সামিল।
৭
তখন তো লাল ফৌজকে লড়তে হচ্ছে ভয়ঙ্কর লড়াই। সংশোধনবাদী মেনশেভিক, প্রতিবিপ্লবী ফৌজ, দেনিকিনের শ্বেতরক্ষী দল, কর্নিলভের বাহিনীর সঙ্গে। ঘরশত্রু বিভীষণের সঙ্গে বিদেশি জার্মান ও ব্রিটিশ ফৌজের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত তখন লালফৌজ। প্রতিদিনই লালফৌজকে লড়তে হচ্ছে—জীবনমরণ লড়াই—সোভিয়েতকে রক্ষা করার। দেশের গরিব, খেটে খাওয়া মানুষ মুক্তির স্বাদ পেয়েছে, দু’বেলা দু’মুঠো খাবারের কথা ভাবতে পারছে, শ্রমিক-কৃষক, খ্রিস্টান আর মুসলমানের লড়াইয়ে তাদের ব্যস্ত করা হচ্ছে না—সেই অবস্থার স্বাদ থেকে তাঁরা যাতে বঞ্চিত না হয়, তার জন্য নতুন স্বপ্ন চোখে লড়ে যাচ্ছিলেন অসম সাহসী লাল ফৌজেরা। তার সঙ্গে তাদের নতুন লড়াই হল—প্রাণের প্রিয় নেতা, বন্ধু, সাথী কমরেড লেনিনকে বাঁচানোর লড়াই।
ইতিমধ্যে শত্রুরা উল্লসিত। দুনিয়া জুড়ে হতচকিত কমিউনিস্টরা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তো খবর বের হওয়া শুরু হয়ে গেছে, লেনিন মরলেন বলে। অনেকে ‘অবিচুয়ারি’ বা শোকবার্তাও ভেবে রাখলেন। আর পৃথিবীর নানা প্রান্তের কমিউনিস্টরা, যাঁরা লাল ঝাণ্ডার তলায় একত্রিত হয়েছেন জাত-পাত ভুলে, শ্রেণিসংগ্রামের স্বপ্নে মশগুল হয়ে তাদের পক্ষ থেকে চিঠি আর টেলিগ্রাম আসতে লাগল হাজারে হাজারে। তার কিছু নিদর্শন লেনিন মহাফেজখানায় মেলে। মস্কোতে।
অবশেষে চারদিন পর দেখা গেল, লেনিনের কিছুটা উন্নতি ঘটেছে। জিনোভিয়েভ একটা বড় বিবৃতি তৈরি করলেন—লেনিনের স্বাস্থ্যের অবস্থা, দেশবাসীকে জানিয়ে। দু’লাখ কপি ছাপা হয়ে গেল মুহূর্তে। তখন অফসেটের মতো ছাপাখানার যুগ নয়। তবু ছাপাখানার কর্মীরা প্রায় অসাধ্য সাধন করলেন—কারণ লেনিনের বেঁচে ওঠার খবরের জন্য যে লড়াকু মানুষ উদগ্রীব। শত্রুরা যে প্রতিমুহূর্তে মৃত্যুর মিথ্যা সংবাদ দিয়ে মনোবল ভাঙতে চাইছে।
লেখক, শিল্পী-সাহিত্যিক, ঐতিহাসিকরা এই সময়ে পালন করলেন বলশেভিক কর্তব্য। আবেগে ভেঙে না পড়ে তাঁরা রচনা করলেন লেনিনের, লেনিনিয় আদর্শের ভাষ্য।
এমেলিয়ান আয়রোস্লাভস্কি রচনা করলেন লেনিনের জীবনী ‘শ্রমিক বিপ্লবের মহান নেতা’। দ্রুত লেখা সেই জীবনী ছড়িয়ে পড়ল মানুষের হাতে হাতে। এমেলিয়ান এক দশক পরে বলশেভিক পার্টির ইতিহাস বিভাগের প্রধান নির্বাচিত হন। পার্টির কৃষক শাখা এক লাখ প্রচারপত্র বিলি করল। প্রচারপত্রের শিরোনাম ‘গ্রামের গরিবের নেতা ভি আই উলিয়ানভ লেনিন।’ কবিদের কবিতাতেও মূর্ত হলেন লেনিন। কবিদের মধ্যে ছিলেন মায়াকোভস্কিও।
কিন্তু শত্রুরাও থেমে নেই। তাই লেনিন ক্রমশ সুস্থ হতে থাকলেও রটনা হয়ে গেল লেনিন মারা গেছেন। আর রাতেই তাঁর মরদেহ ক্রেমলিন থেকে অপসারণ করা হয়েছে।
৮
চিরকালই শত্রুরা সিদ্ধহস্ত তথ্যহীন রটনায়। এই ঘটনা আবার করা হয়ে থাকে খাতায় কলমে নয়, ফিসফিস করে, কানে কানে। কারও কথায় এই শুনে এলুম, কেউ কেউ বলেন দেখে এলুম, কেউ বলেন, আমার সামনেই সবকিছু ঘটেছে। এভাবেই তো রটিয়ে থাকেন রটন্তী কুমার বা রটাইরা। একাজে অবশ্য ইদানীং অন্য দক্ষতার স্বাক্ষর দেখা যাচ্ছে, কাগজে কলমেও প্রকাশিত হয়ে যাচ্ছে গুজব। তবে সে ভিন্ন প্রসঙ্গ।
এদিকে রটনায় পার্টির, দেশের, সোভিয়েতের পৃথিবীজোড়া, কমিউনিস্ট আন্দোলনের ক্ষতি হচ্ছে দেখে বঞ্চব্রুয়েভিচ ঠিক করলেন লেনিন ক্রেমলিনে পায়চারি করছেন—এই অবস্থায় তার এক ছবি তুলে তা প্রকাশ ও প্রচার করার, গোটা ব্যাপারটা খুবই গোপনে সবার বন্দোবস্ত হল।
গোপনে ছবি তোলা হল এবং ছাপাও হল। কিন্তু এই ঘটনার কথা জেনে লেনিন আপত্তি করলেন। তিনি আলোকচিত্রীদের চিহ্নিত করলেন, এবং তাঁর ক্রেমলিনে হাঁটার ছবি ছাপতে নিষেধ করলেন। এই কাজটা তিনি গত হেমন্তেও করেছিলেন। এই প্রসঙ্গে রবিন ডব্লু কার্ক, যিনি তাঁর বইয়ের নাম দিয়েছেন, ‘মুখোশের আড়ালে থাকা মানুষ লেনিন’ তিনিও লিখতে বাধ্য হচ্ছেন।
‘লেনিন জানতেন এই প্রচারের মূল্য কতখানি, কেন এত প্রয়োজন। তবুও নিষেধ করলেন, কারণ তিনি চাইছেন না, পার্টিতে ব্যক্তিপূজা শুরু হয়ে যাক।’ যাঁরা মনে করেন লেনিন শেষ জীবনে ক্ষমতালোভী হয়ে পড়েছিলেন তাঁদের কাছে ক্লার্কের মন্তব্য একটি করুণ চপেটাঘাত। ক্লার্ক লিখছেন, এই ঘটনার দু’বছর পরেও লেনিন একই মনোভাব দেখিয়েছিলেন। ১৯২০ সালে গোর্কির সাময়িকপত্র ‘কমিউনিস্ট চেস্কি ইন্টারনেশিওনাল’ লেনিনের ওপর ধারাবাহিক রচনা ছাপতে শুরু করলে বিরক্ত হন লেনিন। ফলে ওই সাময়িকপত্রের লেনিন সংক্রান্ত ধারাবাহিকটি বন্ধ হয়ে যায়।
বন্ধ হয়ে যাওয়ার মূলে ছিল লেনিনের অন্যতম উদ্যোগ। যা আজকের যুগে অবিশ্বাস্য মনে হবে। মনে হবে, এই পৃথিবীর বুকে এমন একটা মানুষ হেঁটে চলে বেড়াতেন, কথা বলতেন, স্বপ্ন দেখতেন ও অন্যদের দেখাতেন।
৯
১৯২০ সালের ৩১ জুলাই সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির পলিটব্যুরো একটা প্রস্তাব নেয়। এই প্রস্তাবের খসড়া প্রস্তুত করেন স্বয়ং লেনিন। সেই প্রস্তাবে বলা হয়—কেন্দ্রীয় কমিটির পলিটব্যুরো ‘কমিউনিস্টি চেস্কি ইন্টারনাশিওনাল’-এর ১২ সংখ্যার প্রবন্ধ খুবই অনুপযুক্ত, বিশেষ করে সম্পাদকীয়, এর মধ্যে কমিউনিস্ট সুলভ কিছু নেই শুধু নয়, প্রচুর কমিউনিস্ট বিরোধী উপাদান আছে। এই ধরনের লেখা যেন আর কখনো কমিউনিস্টি চেস্কি ইন্টারনাশিওনালে ছাপা না হয়। (এই প্রবন্ধে লেনিনের সুখ্যাতি করা হয়েছিল)।
পলিটব্যুরো এই প্রস্তাব অনুমোদন করে ১৯২০ সালের ৩১ জুলাই।
আবার ফিরে যাওয়া যাক ১৯১৮ সালে। লুবোভ ক্রাসিন নামে এক ঐতিহাসিক তাঁর বইয়ে লিখেছেন, লেনিন তো জনপ্রিয় ছিলেনই, তাঁকে হত্যার চেষ্টার পর তাঁর জনপ্রিয়তা তুমুল বেড়ে গেল। এমনকী যে সব লোকের বলশেভিকদের প্রতি বিন্দুমাত্র সহানুভূতিও ছিল না, তারাও বলতে শুরু করল, লেনিন মারা গেলে ঘোর সর্বনাশ হয়ে যাবে।
১০
ফ্যানি কাপলান সর্বনাশ ঘটাতে চেয়েছিলেন লেনিনের। কিন্তু তা হল না। এক অর্থে লেনিন এবং তাঁর স্বপ্নের রাষ্ট্রের প্রচুর লাভ হল। অনেক মানুষের সমর্থন বেড়ে গেল বলশেভিকদের প্রতি। ক্ষতি হল—লেনিনের, পার্টির। লেনিনের শরীরের।
কিন্তু শরীরের সেই ক্ষতি কি তাঁকে জাতিবিদ্বেষী ক্ষমতালোভী অর্ধউন্মাদ করে তুলেছিল? দেখা যাক।
১১
ফ্যানি কাপলানের কী হল?
লেনিনকে যিনি গুলি করেছিলেন, সেই ফ্যানি কাপলান ছিলেন লেফট সোশ্যালিস্ট রেভিলিউশনারি বা বাম সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবী দলের সদস্যা। দলটি ছিল মতাদর্শগতভাবে নৈরাজ্যবাদী। এরা বলশেভিকদের হঠিয়ে ক্ষমতা দখল করতে চাইছিল। লেনিনকে হত্যা করলে সে কাজ সহজ হয়ে যাবে ভেবেছিল কাপলানের দল। সে কারণে খাবার পাওয়া যাচ্ছে না কেন, এই আলোচনার নাম করে কথা বলতে বলতে লেনিনকে অন্যমনস্ক করে দিয়ে গুলি চালায় কাপলান। লেনিন কিন্তু কাপলানের প্রশ্নের উত্তর ভালোভাবেই জানিয়েছিলেন, শীঘ্রই খাদ্য সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।
১২
আসলে নভেম্বর বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করার পরই লেনিন ও বলশেভিক পার্টিকে পড়তে হয় এক মারাত্মক সমস্যায়। কুলাকরা বা জমিদাররা বিদ্রোহ ঘোষণা করে। কারণ, লেনিনের নেতৃত্বে বলশেভিক পার্টি ব্যক্তিগত সম্পত্তি অবসান ঘটাতে জমিকে রাষ্ট্রীয় মালিকানায় আনার সিদ্ধান্ত নেয়। সিদ্ধান্ত কার্যকর করার সময় তাঁর বাধা আসে। কুলাকদের পক্ষ থেকে। যদিও গরিব কৃষকরা খুব খুশি হন। কুলাকরা বহু খাদ্য শস্য নষ্ট করে ফেলে। এবং যেখানে যেখানে সম্ভব তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এছাড়াও দেশের বহু এলাকা তখন কুলাকদের বাহিনী, শ্বেতরক্ষী দল অথবা ফরাসি ও ইংরেজদের অর্থপুষ্ট সৈন্যের দখলে। এর পরিণতিতে দেশ এক গভীর সংকটের মুখোমুখি হয়। একদিকে বহিঃশত্রু, অন্যদিকে অন্তঃশত্রু—দুয়ের মোকাবিলা করতে হয় তরুণ সোভিয়েত রাষ্ট্রকে।
১৩
এর মাঝে একরকম উৎপাত হিসেবে হাজির হল ফ্যানি কাপলানের দল লেফট সোশালিস্ট রেভ্যুলিউশনারি। যারা নামেই বিপ্লবী। আসলে প্রতিবিপ্লবী। ১৯১৮ সালের মার্চ মাস থেকেই তারা চেষ্টা করছিল যাতে ব্রেস্টলিটভস্ক চুক্তি বাতিল করা হয়। এছাড়াও তাদের লক্ষ্য হল বলশেভিক পার্টির শীর্ষ ও গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের হত্যা করা। তারই অঙ্গ হিসাবে লেনিনকে হত্যার চেষ্টা। এই ফ্যানি কাপলানকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার বিপক্ষে ছিলেন লেনিনের স্ত্রী নাদেজদা। লেনিন কিন্তু সেদিন দৃঢ়কণ্ঠে মৃত্যু দণ্ডের পক্ষে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন,
—’বিপ্লবের শত্রুকে ক্ষমা করা যায় না। মধ্যবিত্ত মানুষ হলে দুর্বলতা দেখানো যায়, কমিউনিস্ট হিসাবে যায় না’।
লেনিন আমৃত্যু লড়েছেন দলের ভিতরে ও বাইরে। প্রতিবিপ্লবী, বুর্জোয়া, সংশোধনবাদী এবং সংকীর্ণতাবাদীদের বিরুদ্ধে। ক্ষমতালোভীদের প্রতি ছিল তাঁর তীব্র ঘৃণা। চেয়েছিলেন দল ছোট হোক, কিন্তু ভালো হোক। তাই লেখা, বেটার ফিউয়ার, বাট বেটার। বরং কম হও কিন্তু ভালো হও।
এখান থেকে কি কিছু শিখবেন, তাঁর নাম ভাঙিয়ে খাওয়া কিছু লোক।
১৪
লেনিনের ‘শেষজীবন’ ‘শেষজীবন’ বলে এমন চিৎকার শুরু হয়েছে যেন লেনিন অশীতিপর বৃদ্ধ মাত্র হয়ে পড়েছিলেন। মৃত্যুর সময় লেনিনের বয়স হয়েছিল ৫৪ বছর, (‘টরাসে’-র সমর্থনকারীদের অনেকের বয়স তাঁর চেয়ে বেশি)। ১৮৭০-এর ২২ এপ্রিলে জন্ম। মৃত্যু ১৯২৪ সালের ২১ জানুয়ারি সন্ধে ৬টা ৫০ মিনিটে।
লেনিনকে ১৯১৮ সালের আগস্টে গুলি করা হয়েছিল। তার একটা বুলেট বের করা গেলেও একটা থেকে যায়। ১৯২২ সালের ২৩ এপ্রিল অপারেশন করে লেনিনের শরীর থেকে গুলিটি বের করে ফেলা হয়। না খাওয়া এবং প্রচণ্ড পরিশ্রমের জন্য লেনিন অসুস্থ হয়েছেন ঠিকই, কিন্তু তা ‘অর্ধ উন্মাদ’ ‘জাতিবিদ্বেষী, ‘ক্ষমতালোভী’-তে পরিণত হওয়ার জন্য বোধহয় যথেষ্ট নয় (অনেকেই শরীরে গুলি নিয়ে বাঁচেন, আমাদের রাজ্যেরই এক প্রাক্তন সিপিএম মন্ত্রীও এর মধ্যে ছিলেন)।
যাক ১৯২২ সাল থেকে ১৯২৪ সালের ২১ জানুয়ারি মৃত্যুর সময় পর্যন্ত অসুস্থতা এবং কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজের হিসাব দিচ্ছি।
এই হিসেবের সূত্র লেনিন—দ্য ম্যান বিহাইন্ড দ্য মাস্ক। লেখক আর ডবলু ক্লার্ক। (বইয়ের নামেই মালুম লেখক কিন্তু মোটেই কমিউনিস্ট নন। আর বইটি গরবাচ্যভের আমলে প্রাপ্ত নথিপত্রের ভিত্তিতে রচিত)। প্রকাশক লন্ডনের ফেবার অ্যান্ড ফেবার)।
১৯২২—২৭ মার্চ—২ এপ্রিল—একাদশ পার্টি কংগ্রেস।
২৭ মার্চ—কংগ্রেসের উদ্বোধক লেনিন।
১৯২২—২৩ এপ্রিল—মস্কোতে অপারেশন। অপারেশনের পর দ্রুত কাজে ফিরলেন লেনিন। (পৃষ্ঠা-৪৬৪)
১৯ মে—স্তালিনকে চিঠি—বেতার সম্প্রচারের জন্য ১ লাখ রুবল দানের পরামর্শ দিয়ে। (পৃষ্ঠা-৪৬৮)
২৬ মে—গোর্কিতে ছুটি কাটাতে লেনিন। প্রথম স্ট্রোক।
২৬ মে থেকে জুলাই-র মাঝামাঝি পর্যন্ত অসুস্থতার সময় লেনিন পড়েন ৩২টি দৈনিক পত্র, নানা ভাষায় ১৩৭টি পত্রিকা এবং অসংখ্য বই।
মধ্য জুলাই—কাজকর্ম শুরু করলেন লেনিন।
১৯২২ সাল ৫ আগস্ট—স্তালিনের সঙ্গে লেনিনের সাক্ষাৎকার। স্তালিন লিখছেন, এই সময় আমি দেখেছি লেনিনের চারদিকে বইয়ের পাহাড়। (লেনিন/ম্যান বিহাইন্ড দ্য মাস্ক, পাতা ৪৬৬)।
২ অক্টোবর—মস্কো ফিরলেন।
৩ অক্টোবর—জন কমিশার পরিষদের সভায় ভাষণ। সাক্ষাৎ করলেন ‘নিউইয়র্ক টাইমস’ পত্রিকার কার্টুনিস্ট অস্কার সিসারের সঙ্গে। অস্কার লিখেছেন অসুস্থতার কোনও চিহ্ন দেখিনি। (পাতা ৪৬৭)।
৪ অক্টোবর—স্টাডিতে পড়াশোনা।
৫ অক্টোবর—পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় ভাষণ। প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবী লুই ফিশার এদিন লেনিনকে কার্যত ছুটতে দেখেন। (পাতা ৪৬৮)।
অক্টোবরেই মস্কো গ্রান্ড অপেরায় লেনিনের ভাষণ শুনে ‘নিউইয়র্ক টাইমস’ পত্রিকার সাংবাদিক ডুরান্টি লেখেন ‘দি স্পিকারস ভয়েস ওয়াজ ফুল অ্যান্ড স্ট্রং’।
১৩ নভেম্বর—চতুর্থ কমিন্টার্নের সভায় ৩ ঘণ্টার বেশি সময় ধরে ভাষণ। জার্মান ভাষায়। চেক প্রতিনিধি বেদরিখ রুনজ লিখছেন তিনি হলের মধ্যে দিয়ে দ্রুত হেঁটে গেলেন। (লেনিন থ্রু দি আইজ অব দি ওয়ার্ল্ড। পাতা ৩১৯) জাপানি প্রতিনিধি সেন কাতাইরামা লিখছেন—লেনিন, স্পোক ফর থ্রি আওয়ার্স উইদাউট শোওয়িং দি স্লাইটেস্ট সাইনস অফ টায়ারিং অ্যান্ড উইথ অলমোস্ট নো চেনজ ইন হিজ ইনটোনেশন…(ওই বই, পাতা ৩০৯)। ‘দ্য অবজার্ভার এবং ‘ম্যানচেস্টার গার্ডিয়ান’ পত্রিকার মাইকেল ফার্বম্যানকে সাক্ষাৎকার। বিশ্ব জনমতকে প্রভাবিত করার লক্ষ্যে।
১৩ ডিসেম্বর—মস্কোয় দ্বিতীয় স্ট্রোক। ওইদিনই স্তালিনের সঙ্গে ২ ঘণ্টা আলোচনা। অনেকগুলি চিঠি লেখা। (লেনিন/ম্যান বিহাইন্ড দ্য মাস্ক, পাতা ৪৬৯)।
১৫-১৬ ডিসেম্বর ডান হাত এবং পা অবশ। ক্লার্ক লিখছেন—অলদো হি শুন বিগান টু রিকভার দি ইউজ অফ বোথ লিম্বস। (লেনিন/ম্যান বিহাইন্ড দ্য মাস্ক, পাতা ৪৬৯)।
১৯ ডিসেম্বর—চিঠির জন্য ডিকটেকশন দেওয়া শুরু করলেন। (লেনিন/ ম্যান বিহাইন্ড দ্য মাস্ক।)
২১ ডিসেম্বর—স্ত্রী নাদোজদাকে নোট।
২৩ ডিসেম্বর—লেনিনের ‘লস্ট টেস্টামেন্ট’ বলে কথিত ‘কংগ্রেসের কাছে চিঠি’ রচনা শুরু (লেনিন/ম্যান বিহাইন্ড দ্য মাস্ক, পাতা ৪৭১)।
১৯২৩ সাল ৪ জানুয়ারি—’কংগ্রেসের কাছে চিঠি’-র সংযোজন।
৬ জানুয়ারি—’সংস্কৃতি ও সমবায়’ রচনা শুরু।
১৭ জানুয়ারি—’আমাদের বিপ্লব’ রচনা।
১৬-২৫ জানুয়ারি—প্রাভদায় ‘শ্রমিক ও কৃষকের অনুসন্ধানকে কীভাবে পুনঃসংগঠিত করা উচিত’ প্রকাশ।
৫ মার্চ—জর্জিয়া প্রশ্নে স্তালিন ও ট্রটস্কিকে চিঠি। (লেনিন/ম্যান বিহাইন্ড দ্য মাস্ক, পাতা ৪৭৯)।
৬ মার্চ—অসুস্থ।
২৩ মার্চ—রচনা করলেন বিখ্যাত লেখা ‘বরং কম কিন্তু ভালো করে’ (বেটার ফিউয়ার বাট বেটার)। (লেনিন রচনাবলী, ৪৫ খণ্ড পাতা ৫৮৭)
১৭-২৩ এপ্রিল—দ্বাদশ পার্টি কংগ্রেস। শিল্প বনাম কৃষক প্রশ্নে লেনিনের পরামর্শ অনুযায়ী পার্টি কংগ্রেস সিদ্ধান্ত নিল কৃষক স্বার্থ ক্ষুণ্ণ করে শিল্প নয়। সোভিয়েতের হাতে বৈদেশিক বাণিজ্যের একচেটিয়া অধিকার দানের প্রশ্নে লেনিনের জয়। (লেনিন/ম্যান বিহাইন্ড দ্য মাস্ক, পাতা ৪৭৫)।
১৫ মে—গোর্কিতে বাস শুরু।
১৯২৪ খ্রিস্টাব্দ ১৭-১৯ জানুয়ারি ত্রয়োদশ পার্টি সম্মেলন। লেনিনের পরামর্শ অনুযায়ী নাদেজদা ট্রটস্কিবাদের বিরুদ্ধে লড়লেন।
১৯ জানুয়ারি—নাদেজদা লেনিনকে জ্যাক লন্ডনের ‘লাভ অফ লাইফ’ পড়ে শোনালেন। পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি কালিনিন এলেন। আলোচনা হল ত্রয়োদশ পার্টি সম্মেলন নিয়ে। (লেনিন/ম্যান বিহাইন্ড দ্য মাস্ক, পাতা ৪৮২।)
২০ জানুয়ারি—নাদেজদা লেনিনকে জ্যাক লন্ডনের ‘লাভ অফ লাইফ’ পড়ে শোনালেন। শুনে জোরে হাসলেন লেনিন।
২১ জানুয়ারি—পার্টিনেতা বুখারিন এবং কিছু শ্রমিক এলেন লেনিনকে স্লেজে চড়িয়ে শিকারে নিয়ে যেতে। শিকারে গেলেন। ফিরে খেয়ে বিশ্রাম নিতে গেলেন। সন্ধ্যার মুহূর্তে তৃতীয় স্ট্রোক। ৬টা ৫০ মিনিটে মারা গেলেন। (লেনিন/ম্যান বিহাইন্ড দ্য মাস্ক, পাতা ৪৮২)।
‘দেশ’-এর সুমিত মিত্র মশাই এবং বামশিবিরে লুকিয়ে থাকা ছদ্মবেশী বামপন্থীরা যদি কিছু বলেন?
লেনিনের স্বপ্নপূরণ করেন তাঁর যোগ্য শিষ্য স্তালিন (থুড়ি কমরেড, লেনিন গুরু-শিষ্য সম্পর্কে বিশ্বাসী নন)।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন