বাজপেয়ি থেকে মোদি

ইমানুল হক

বাজপেয়ি থেকে মোদি

‘হিন্দু’ শব্দটি ফার্সি শব্দ। ভারতবর্ষ যে এক পরমতসহিষ্ণু পরধর্মসহিষ্ণু দেশ—’হিন্দু’ শব্দেই তার প্রমাণ। মুঘল যুগে ব্রাহ্মণরা নিজেদের হিন্দু বলত না। হিন্দু মানে ছিল এ-দেশিয় মানুষ। ব্রাহ্মণেরা বলতেন, মুঘলদের তোমরাও বিদেশি আমরাও বিদেশি। তাই আমরা জিজিয়া কর দেব না। মুঘল আমলে ব্রাহ্মণদের জিজিয়া কর দিতে হত না। ‘হিন্দু’ শব্দটি প্রযুক্ত হত ভারতীয় বোঝাতে। ‘ভারত’ নামকরণ হয়েছে ‘ভরত’ নামে এক জনজাতির নাম থেকে। ‘বর্ষ’ মানে পর্বত সীমানা। ভরত নামে কোন পৌরাণিক রাজার থেকে ভারতের নাম হয়নি। এটি একটি সুপরিকল্পিত মিথ্যা প্রচার যে, ভরত রাজা থেকে ভারতের নাম।

‘হিন্দু’ শব্দটি আবার ব্রিটিশ আমলে ব্রাহ্মণদের বোঝাতে লাগল। তফশিলি জাতি উপজাতি তাদের হিসেবে হিন্দু নয়। আর এস এস বজরং দল হিন্দু মহাসভা আবার যে অর্থে ‘হিন্দু’ বোঝে তা গান্ধী বা রবীন্দ্রনাথ বোঝেননি। আর এস এস নামে হিন্দুত্ববাদী। কাজে মনুবাদী। সাধারণ হিন্দুর কল্যাণ তার প্রার্থিত নয়। মনুবাদী ব্রাহ্মণ্যবাদ তাদের অন্বিষ্ট।

বিজেপিকে ‘হিন্দুত্ববাদী’ বলা মানে তাদের সম্মান দেওয়া। (যেমন সি পি এম কে কমিউনিস্ট বা তৃণমূলকে গান্ধীবাদী বলা।) বিজেপির ‘হিন্দুত্ববাদ’ আর ‘হিন্দুত্ব’ সম্পূর্ণ আলাদা বিষয়। হিন্দু এক জীবনধারা। তাতে রাম এবং রাবণ দুজনেই পূজ্য। রাম পূজ্য উত্তর ভারতে। রাবণ দক্ষিণ ভারতে। আবার বাংলায় রাম ততখানি শ্রদ্ধার পাত্র নন। সীতা তাঁদের কাছে অনেক বড়। ‘রাম’ শব্দ বাঙালি বলে নানা অপ শব্দ বোঝাতে। রাম খচ্চর, রামপাঁঠা, রাম বোকা, রাম হারামি—এসব উত্তর ভারত ভাবতেই পারবে না। হিন্দুত্ব শিখবো রামকৃষ্ণদেবের কাছে। নরেন্দ্রনাথ তথা বিবেকানন্দের কাছে। রামকৃষ্ণ হিন্দু ছিলেন—দু’বছরের জন্য মুসলমান হয়েছিলেন। বিবেকানন্দ মূর্তিপূজায় বিশ্বাসী ছিলেন না। এক মুসলমান মাঝির মেয়েকে কুমারী হিসেবে বরণ করে পূজা করেছিলেন।

মোদি পূর্ব গুজরাত ছিল সম্প্রীতির পীঠস্থান। সেখানে ফৈয়াজ খাঁর সমাধি ছিল। সাধক কবি গীতিকার ফৈয়াজ খাঁর গানে পুলকিত চমকিত হত গুজরাত। সুরাত স্টেশনে একটি অসাধারণ পংক্তি দেখেছি ১৯৯৮-এর ফেব্রুয়ারিতে।

মন্দির মসজিদ গির্জা নে

বাঁট লিয়া ভগবান কো।

সাগর বাঁটো জমিন বাঁটো

মৎ বাঁটো ইনসান কো

এই ইনসান বা ইনসানিয়ৎ খুব বড় কথা। মনুষ্যত্ববোধ খুব জরুরি। হিন্দু ধর্মে ৪৬ হাজার জাতি আছে। মনুবাদী বিধানে সেখানে অস্পৃশ্যতা, জাতিভেদ ঢুকেছে। এছাড়া আছে শৈব, বৈষ্ণব, শাক্ত ইত্যাদি ধারা। কেউ মাংস ছাড়া চলেন না, কেউ তৃণ বা ফলমূলছাড়া ভোজন করেন না। কারও কাছে ভগবান সখা, কারও কাছে প্রভু। কেউ বিশ্বাস করেন শিব মন্ত্রে, কেউ তুষ্ট নারায়ণে।

কারও ভক্তি হরি বা কৃষ্ণে।

কালী আর চণ্ডীর ছিল ঘোর বিবাদ।

কিন্তু আধুনিক হিন্দু ধর্মে তাঁরা পাশাপাশি পুজিতা হন। শিব আর বিষ্ণু ভক্তরা আজকাল হানাহানি করেন না। একই মন্দিরে তাঁরা পূজিত।

নারায়ণ শিলা আর শিবলিঙ্গে মারামারি নেই।

পৃথিবীর ইতিহাস কয়েক কোটি বছরের। মানুষের ইতিহাস ২০ লাখ বছরের। অতিকায় বানরজাতীয় থেকে মানুষ। শ্রমের বির্বতনের ফলে মানবজাতির সৃষ্টি। মানুষের সংজ্ঞা হচ্ছে—যে অস্ত্র তৈরি করতে পারে। আর সকল প্রাণীকে লড়তে হয় তার শরীর দিয়ে। শুধু মানুষ অস্ত্র তৈরি করতে পারে। তার অস্ত্র মূলত দ্বিবিধ। এক শারীরিক অস্ত্র, দুই মানসিক অস্ত্র। মানসিক অস্ত্রের মধ্যে আছে সাহিত্য শিল্প সংগীত। ধর্ম হয়ে উঠল এক মানসিক অস্ত্র। একের উপর অন্যের প্রভুত্ব করার সবচেয়ে শক্তিশালী মানসিক অস্ত্র ধর্ম। এই ধর্ম হাত ধরে রাষ্ট্রের। সরকারের। রবীন্দ্রনাথ তো কবেই লিখেছেন যে,

ওদের অস্ত্রশালা, মদের ভাণ্ডার আর মন্দির পাশিপাশি।

রবীন্দ্রনাথ বুঝেছিলেন, ধর্মের বেশে মোহ যরে এসে ধরে অন্ধজন সে শুধু মারে আর মরে।

ধর্মের নামে জাতের জাতির নামে পৃথিবীতে যত মানুষ হত্যা হয়েছে আর কোন কারণে তা হয়নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাৎসিবাদের উত্থানে ভূমিকা নিয়েছিল ধর্ম ও জাতি বিদ্বেষ।

ইজরায়েল—যা ইহুদিদের ওপর অত্যাচার কমাতে মুসলিমদের দান করা ভূখণ্ডে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল—তা আগ্রাসী নাৎসিধর্ম নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে। ইজরায়েলের সংস্কৃতিমন্ত্রী মিরিয়াম মিবি রেগেভ, যিনি জন্মসূত্রে মহিলা, তিনি সগর্বে উচ্চারণ করছেন আমি নাৎসিবাদী। নাৎসিবাদ সমর্থন করি। হাজার হাজার শিশু নিহত হয়েছে, হচ্ছে গাজা প্যালেস্টাইনে। অথচ একদিন ইহুদিরাই ছিল নির্যাতিত নাৎসিবাদীর হিটলারি বাহিনী দ্বারা। তাঁদের ধর্মবিশ্বাসের কারণে গ্যাস চেম্বারে মরতে হয়েছে। আজ প্রায় এক দশা প্যালেস্টাইন গাজার মানুষের। তাঁদের মানবাধিকার ভূলুণ্ঠিত। অথচ দেশে দেশে ইজরায়েলি পণ্য। কোক পেপসি সহ হাজার জিওন ও মার্কিনপণ্য প্রগতিশীলদের পর্যন্ত অবশ্য ভক্ষ্য পেয়।

আইসিসের জন্ম দেওয়া হয়েছে। বর্তমান মর্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছিলেন, আইসিস তৈরি করা হয়েছে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিন্টনের প্রত্যক্ষ মদতে। ম্যাকেইন নামে এক সেনেটার বারবার উড়ে গেছেন মধ্যপ্রাচ্যে। আইসিস প্রধান বাগদাদির সঙ্গে বৈঠক করেছেন। প্রচার মাধ্যম একথা চেপে রাখে যে, বাগদাদির আসল নাম জন এলিয়ট। তিনি একজন ইহুদি। মুসলিম নন। ইজরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের বিশ্বস্ত এজেন্ট। খেয়াল করে দেখবেন, আইসিস পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীনতম বৃহৎ মসুলের মসজিদ বোমা মেরে ধ্বংস করে দেয়। ইরাক, সিরিয়ার দশ লাখ মুসলমানকে হত্যা করেছে। প্যারিসে বোমা মেরেছে, কেন না ফ্রান্স বেগড়বাই করছিল ন্যাটোর যুদ্ধ প্রচেষ্টায় আর জড়িত থাকতে। কিন্তু ভুলেও মাত্র ১৫ কিলোমিটার দূরে থাকা ইজরায়েলে একটি বোমাও ছোঁড়ে না। এখন আইসিস সিরিয়ায় পর্যুদস্তপ্রায়। মার্কিন মদতপুষ্ট আল-কায়েদার সন্ত্রাসী সিরিয়ার আধা সমাজতান্ত্রিক আসাদের সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছিল ন্যাটোর সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে। ইরাকে কমিউনিস্ট মিলিশিয়া, কুর্দ মিলিশিয়া ও বামপন্থী নারী গেরিলা বাহিনীর হাতে মার খেয়ে ইরাকের তেলভান্ডার লুঠ করে, তারা পালিয়ে এসেছিল সিরিয়ায়। এখন সিরিয়ার গণফৌজ ও রাশিয়ার সম্মিলিত আক্রমণে দিশাহারা হয়ে পৌঁছেছে প্যালেস্টাইন সীমান্তে। লড়ছে মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে। যে গেরিলা ও মুক্তিযোদ্ধারা জন্মসূত্রে মুসলিম।

গত পাঁচ বছরে পৃথিবীতে মুসলিমদের নয় নয় করে ১০টি ১০ লাখি মিছিল হয়েছে আইসিসের বিরুদ্ধে। ‘আইসিস মুসনমালদের শত্রু’—একথা জানাতে। কিন্তু মার্কিন প্রাসাদ পুষ্টে মিডিয়া তথা প্রচারমাধ্যম মুসলিম সন্ত্রাসবাদী হিসেবে দেখিয়েই আত্মতুষ্ট।

আর এস এসের এক ভারতীয় নেতা দেবেন্দ্র পান্ডে বলেছিলেন, আর এস এস পাকিস্তানের আই এস আই থেকে অর্থ সাহায্য পায়। আই এস আই এই টাকা পায় মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সি আই এ থেকে। বিশ্বাস না হলে সমঝোতা এক্সপ্রেসে বোমা হামলায় অভিযুক্ত ‘স্বামী’ অসীমানন্দ (বঙ্গসন্তান)-এর জবানবন্দি পড়ুন। ‘ক্যারাভানে’ পাবেন। আর্ন্তজালে। অসীমানন্দ আর এস এস সদস্য। কিন্তু আর এস এস প্রধান মোহন ভাগবতের কাজকর্মে বিরক্ত হয়ে ‘অভিনব ভারত’ নামে একটি সংগঠন গড়েছিলেন। মোহন ভাগবতকে মারতে। কেন? অসীমানন্দের বক্তব্য, মোহন ভাগবত পাকিস্তানের টাকা খেয়ে সমঝোতা এক্সপ্রেসসহ যে ৭টি জায়গায় বিস্ফোরণ ঘটাতে বলেছেন, তাদের, সেখানে মারা গেছেন সংখ্যাগুরু হিন্দুরাই।

আর এস এসের ইতিহাস ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের দালালির ইতিহাস। তাঁরা চেয়েছিল ব্রিটিশরা ক্ষমতায় থাকুক। জামাত-ই-ইসলামির এক নেতা মওদুদিও তাই চেয়েছিলেন। তিনি পাকিস্তানে গেলে তাঁকে জেলে পাঠায় জিন্না সরকার। কারণ, তাঁর বক্তব্য ছিল, পাকিস্তান হওয়ায় মুসলমানদের লাভ নয় ক্ষতি হয়েছে।

আর এস এসের আনুষ্ঠানিক জন্ম ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে। কিন্তু এর গোড়াপত্তন শুরু হয় ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় ‘হিন্দু মেলা’ পত্তনের মধ্য দিয়ে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসকদের তুষ্ট করতে মোঘলদের আগ্রাসনকারী এবং ব্রিটিশদের মুক্তিদাতা হিসেবে বন্দনা শুরু হয়। বঙ্কিমের মত প্রগতিশীল লেখকও এই ফাঁদে পা দেন। যদিও তিনি বলেছিলেন, চাকুরি আমার জীবনের অভিশাপ। তা চাকরি রক্ষার্থে ‘আনন্দমঠ’-এ হিন্দু মুসলিম বিদ্বেষ দেখা গেল। ব্রিটিশকে রাজা করার বাসনা উদ্গীরণ হল। যদিও বঙ্কিম ইংরেজদের মনে মনে ঘৃণা করতেন। অজস্র লেখায় তার প্রমাণ মিলবে।

উনিশ শতক আমাদের সর্বস্ব ও সর্বনাশ। একদিকে তথাকথিত নবজাগৃতি অন্যদিকে হিন্দু-মুসলিম বিভাজনের ঘোষিত ও অঘোষিত রাজনীতি। ‘জল’ এবং ‘পানি’ আলাদা শব্দ হয়ে গেল। যে দুটো রাজ্যে—বাংলা এবং মহারাষ্ট্রে—উনিশ শতকে ইংরেজ বিরোধী মধ্যবিত্তের উত্থান জরুরি ছিল—কলকাতা এবং মুম্বাই বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার কারণে সেখানে সাহিত্য সংস্কৃতিতে মুসলিমদের বিদেশি হিসেবে চিহ্নিত করার প্রচেষ্টা হল। নতুন নায়কের জন্ম দেওয়া হতে থাকল। অত্যাচারী প্রতাপাদিত্য হলেন বরণীয়। রবীন্দ্রনাথ প্রতিবাদ করলেন, ‘বউ ঠাকুরাণীর হাট’ লিখে। কিন্তু তিনিও মেতে গেলেন, শিবাজী বন্দনায়। শিবাজী মসজিদ নির্মাণ করছেন, তাঁর গোলন্দাজ প্রধান দেহরক্ষী প্রধান অর্থমন্ত্রী গোয়েন্দা প্রধান মুসলিম। শিবাজী যে জনগণের ওপর বিপুল করভার (২৫ শতাংশ) চাপিয়ে দিয়েছিলেন, তা ভুলিয়ে দেওয়া হল। ‘রামায়ণে’ আছে এক ষষ্ঠাংশ অর্থাৎ এক টাকায় ১৬ পয়সা কর। তুর্কি, সুলতানি, মোঘল আমলে শরিয়ত মেনে হল তা ১০ পয়সায় কমল। ব্রিটিশ আমলে গেল বেড়ে। ২৫-৩০ শতাংশ কর। শিবাজী বন্দনায় মেতে উঠল দেশ। সবচেয়ে বেশি যিনি মন্দির গড়ার জন্য জমি দান করেছিলেন, ব্রাহ্মণদের নিষ্কর জমি দান করেছিলেন, সেই আওরঙ্গজেব হলেন ঘৃণিত। ভুলে যাওয়া হল আওরঙ্গজেব ছয়টি দোহা লিখেছিলেন রাম এবং ভগবানকে নিয়ে। তাঁর অভিষেকে একসপ্তাহ ধরে উৎসব চলেছিল দিল্লিতে।

১০

মোঘল আমলে ভারতবর্ষের সীমা সবচেয়ে বেশি প্রসারিত হয়। দেশের জি ডি পি বেড়ে হয় ২৭%-৩৫%। পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী এলাকা হয় পুর্বভারত তথা বাংলা। বাংলায় ক্লাইভের ‘গর্দভ’ মিরজাফরের রাজত্বকালের শুরুতে এবং সিরাজের আমলে স্বর্ণমুদ্রা এবং রৌপ্য মুদ্রা প্রচলিত ছিল। তখন ইংল্যান্ডে চলতো কাগজের নোট বা তামার মুদ্রা। পাঁচটা লন্ডন শহর ঢুকে যেতে পারত, মুর্শিদাবাদ শহর দেখে উপলব্ধি ক্লাইভের। সিরাজের সভাসদদের ১৯ জনের মধ্যে ১৯ জনই হিন্দু। প্রধানমন্ত্রী কাশ্মীরি ব্রাহ্মণ মোহনলাল। দাদু আর্লিবাদি খানের শ্রাদ্ধে সংস্কৃত মন্ত্র উচ্চারণ হয়। তবু তাঁকে খলনায়ক বানাল ইংরেজ ইতিহাস। এক পত্নী থাকা বিরল ব্যাপার। সিরাজের তা ছিল। মদ খেতেন না। বীর ছিলেন। ইংরেজদের হারিয়ে কলকাতা দখল করেছিলেন। বিশ্বাসঘাতকতায় পরাজিত হলেন। বঙ্কিম লিখছেন, পলাশীতে যুদ্ধ নয়, তামাশা হয়েছিল।

ভারতে আর যাই থাক, সাম্প্রদায়িকতা ছিল না। হিন্দু-মুসলিম দ্বন্দ্ব, দাঙ্গার ইতিহাস উনিশ শতকের আগে নেই। হিন্দু বা মুসলিম যে-কোনও শাসকই ধর্মনিরপেক্ষতা বজায় রাখার চেষ্টা করতেন। মসজিদের পাশাপাশি মন্দির বা মন্দিরের পাশাপাশি মসজিদ নির্মাণ করতেন। যে-কোনও বড় মসজিদের পাশে মন্দির পাবেন। কাশীর বিশ্বনাথ মন্দিরের পাশেই বাকি মসজিদ।

দক্ষিণেশ্বরের কালীমন্দির ঢোকার মুখে পীরের মাজার তার প্রমাণ। বনদেবী হয়েছেন বনবিবি, সত্যনারায়ণ হয়েছেন সত্যপীর। ওলাওঠা বা কলেরার দেবী ওলাইচণ্ডী হয়েছেন ওলাবিবি। হাওড়ায় প্রখ্যাত লেখক শংকরীপ্রসাদ বসুর বাড়ির এলাকার নাম ওলাবিবি তলা। আমার জন্মস্থানে ওলাইচণ্ডী পূজায় সব ধর্মের মানুষ যোগ দেন মেলায়। বেনারসে রামলালার খড়ম ও লাল কাপড় তৈরি করেন মুসলিম কারিগর। বিসমিল্লাহের সানাইয়ে শুরু হয় কাশীর বিশ্বনাথ মন্দিরের পুজা।

১১

অযোধ্যায় রামের মন্দির ভেঙে মসজিদ হয়েছে একথা সত্য হলে রামায়ণ অনুবাদক তুলসীদাস তা লিখতেন না? এক ব্রিটিশ আমলা প্রথম এই তত্ত্ব হাজির করেন, দেশ জুড়ে হিন্দু মুসলিমের মিলিত বিদ্রোহ নিরসনে। ১৮৫৭-র মহাবিদ্রোহ তথা স্বাধীনতা সংগ্রামের কারণে এই বিভাজনের কাজে সদাব্রতী হয় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা। কলকাতা, মুম্বাই, মাদ্রাজে বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করা হল—চেহারায় ভারতীয় মনন চিন্তন পোশাক সংস্কৃতিতে ব্রিটিশ সেবাদাস বানাতে। তথাকথিত ইংরেজি শিক্ষা বিশেষত ইতিহাস শিক্ষা ভারতকে ইন্ডিয়া ও ভারতে বিভক্ত করেছে। বঙ্কিমের ভাষায় নব্য ব্রাহ্মণের জন্ম দিয়েছি। ইংরেজি জানারা নব্য-ব্রাহ্মণ। এরা অনেকেই ব্রিটিশের তোষণে ও শোষণে-মুসলিমদের বিরুদ্ধে তাত্ত্বিক যুদ্ধ শুরু করলেন। কিছু প্রতিষ্ঠান তৈরি হল। যারা বোঝাতে লাগল মুসলমান এবং হিন্দুরা সম্পূর্ণ আলাদা। তাদের খাদ্য রুচি সংস্কৃতি সব আলাদা। ওরা বাবরের সন্তান। ভুলে যাওয়া হল ৬২৯ খ্রিস্টাব্দে কেরালায় তৈরি হয়েছে প্রথম মসজিদ। মহম্মদ ঘুরি এসেছেন এদেশে ১১৯২ খ্রিস্টাব্দে। ব্রাহ্মণরা উচ্চপদ পেয়েছেন মুঘল আমলে। রানা প্রতাপের বিরুদ্ধে যুদ্ধে আকবরের সেনাপতি রাজপুত মানসিংহ এবং রানা প্রতাপের ভাই শক্তসিংহ। ভুলিয়ে দেওয়া হল, রানাপ্রতাপের সেনাপতির নাম হাকিম শূর বা হাকিম মীর। জন্মসূত্রে আফগান মুসলমান। লড়াই ছিল ক্ষমতার। ধর্মের নয়।

১২

আর্যসমাজ সবচেয়ে বড় ক্ষতি করল। দয়ানন্দ সরস্বতী করলেন গোরক্ষিণী সভা সমিতি। প্রথম দাঙ্গা হল বিহারের জামালপুরে ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দে। গোরুকে কেন্দ্র করে। ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে পূর্ববঙ্গে বাংলাভাগ বা বঙ্গভঙ্গকে ঘিরে দাঙ্গা। বাংলায় এটি প্রথম দাঙ্গা। এই দাঙ্গার প্রেক্ষাপটে রবীন্দ্রনাথের মোহভঙ্গ ঘটে। স্বদেশী আন্দোলন থেকে সরে আসেন। ‘গোরা’ লেখেন ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে। স্বদেশী আন্দোলনের এক নেতা অরবিন্দের আদলে ‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাসের সন্দীপ চরিত্র নির্মাণ করলেন। এর আগে বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে পশ্চিমবঙ্গ ও পূর্ববঙ্গে বিরোধ বাধল। পূর্ববঙ্গের নবাব ও মুসলমান নেতারা চেয়েছিলেন বঙ্গভঙ্গ—কারণ কলকাতা রাজধানী হওয়ায় তাঁরা বঞ্চিত। হাইকোর্ট নেই, ঢাকায়। নেই বিশ্ববিদ্যালয়। সরকারি কাজের সুযোগ কম। টাকা কম। বরাদ্দ কম। অশোক মিত্র ২০০৫-এ আক্ষেপ করে লিখেছিলেন, ১৯০৫-এর বঙ্গভঙ্গ মেনে নিলে ১৯৪৭-এর বাংলাভাগ বা দেশভাগ হত না। এত মানুষকে উদ্বাস্তু বা নিহত হতে হত না।

১৩

মুসলিম লিগ জন্ম নিল কংগ্রেসের মধ্যে নরমপন্থী ও চরমপন্থী বিভেদের মাঝে—বঙ্গভঙ্গের প্রতিক্রিয়ায়। ১৮৬৭ থেকে নানা নামে চলত হিন্দু পুনরুত্থানবাদী আন্দোলন। অনুশীলন যুগান্তর ইত্যাদি বিপ্লবী সন্ত্রাসবাদী দলে কালীর সামনে শপথ নিতে হওয়ায় মুসলিম যুবকরা রাস্তা পাচ্ছিলেন না। মুসলিম লিগ হল ভুল রাস্তা। ১৯২০/২৬-এ কমিউনিস্ট পার্টি গঠিত হওয়ার পর এই মুসলমানরা নবদিশা পেল। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ নতুন স্বপ্ন দেখালেন। হিন্দু মুসলিম ঐক্যের প্রতীক হলেন। কংগ্রেসের মধ্যে থাকা নরম হিন্দুত্ব বা মুসলমানত্ব নয়—তিনি নিলেন ধর্মনিরপেক্ষ রাস্তা। ১৬ জুন ১৯২৫ মারা গেলেন দেশবন্ধু। এই সময় জন্ম হল রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ বা আর এস এস-এর। ১৯২৫-এর ২৭সেপ্টেম্বর প্রতিষ্ঠিত হয় আর এস এস।

১৪

হিন্দুত্ববাদের নতুন সংজ্ঞা শুনল দেশ। একদিকে আম্বেদকরদের নেতৃত্বে তফশিলি জাতির উত্থান হচ্ছে, অন্যদিকে কমিউনিস্ট পার্টি। কৃষক বিদ্রোহ হচ্ছে। ছাত্ররা ১৯৩৬-এ ছাত্র ফেডারেশন গড়ল। উদ্বোধনী ভাষণ দিলেন জওহরলাল নেহেরু। শ্রমিক আন্দোলন হচ্ছে। গান্ধীও মাঝে মাঝে জমিদার ও ধনী বিরোধী মন্তব্য করতে বাধ্য হচ্ছেন। ১৯৩৭-এর নির্বাচনে যাতে তফশিলিরা হিন্দু হিসাবে গণ্য হয়—তার জন্য গান্ধীজী সচেষ্ট। এই সময় হিন্দুত্ববাদের নতুন সংজ্ঞা প্রচার শুরু হল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আর এস এস কাজ করল ব্রিটিশ গুপ্তচরের।

স্বাধীনতার পর প্রথম জাতীয় পতাকা পোড়াল আর এস এস। ১৯৫০-এর ২৬ জানুয়ারি দেশ হল সাধারণতন্ত্র। প্রমাদ গণল জমিদার ও বৃহৎ জমি সম্প্রদায়। নতুন সংবিধানে সবার এক ভোট। ধনীরও যা গরিবেরও তাই। সংবিধান গ্রহণের দু’বছর আগে ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের ৩০ জানুয়ারি নিহত হলেন গান্ধী। আর এস এস ক্যাডারের হাতে। আর এস এস নিষিদ্ধ হল। সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল তখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনিই নিষিদ্ধ ঘোষণা করলেন। পরে আর এস এস মুচলেকা দিল তারা রাজনীতিতে অংশ নেবে না। নিষিদ্ধতা উঠল। আর এস এস বিরোধিতা করল স্বতন্ত্র দল, জনসঙ্ঘ ইত্যাদি রাজনৈতিক সংগঠনের নামে, নেহেরুর প্রগতিশীল কাজের। মেয়েদের গৃহবন্দি রাখতে চায় তাঁরা। দিতে চায় না সম্পত্তির অধিকার। ডিভোর্সের অধিকার। বিরোধিতা করলেন সংসদে এইসব আইনপাসের। সংবিধানের অন্যতম কারিগর ভীমরাও আম্বেদকার আইনমন্ত্রী তখন। বাধ্য হলেন পদত্যাগে।

১৫

আর এস এসের আন্তর্জালে একটি ওয়েবসাইট আছে। আর এস এস ডট ও আর জি। তাতে ১৯৪২ এর পরই ১৯৪৬। চার বছরের কার্বক্রমের কোনও হদিস তারা দেয়নি। কেন দেয়নি; সহজেই বোঝা যায়—এই সময়কাল ব্যস্ত ছিল ব্রিটিশের তীব্র ও নির্লজ্জ ভজনা। মজার কথায় চরম হিন্দু সাম্প্রদায়িক আর এস এস এবং চরম মুসলিম সাম্প্রদায়িক মওদুদি গোষ্ঠী ভারতের স্বাধীনতা চাননি। দু’পক্ষই চেয়েছিলেন ব্রিটিশ থাকুক। ব্রিটিশ থাকলে রাজতন্ত্র থাকবে, বৃহৎ ব্যক্তি মালিকানা বহাল তবিয়তে বর্ধমান হবে, ব্রিটিশদের গোপন সাহায্যও পাবে। যদিও দু’পক্ষই প্রকাশ্যে যুক্তি সাজিয়েছিল অদ্ভুত। আর এস এস ও হিন্দু মহাসভাপন্থীদের বক্তব্য—দেশ স্বাধীন হলে ভারত সেকুলার নেহেরুদের হাতে যাবে। তাতে ব্রাহ্মণদের বিপদ। মওদুদির যুক্তি, দেশ স্বাধীন হলে হিন্দু মৌলবাদীরা দেশের দখল নেবে। তুলনায় ব্রিটিশ ভালো। তফশিলি জাতি উপজাতির কিছু নেতারও মনে হয়েছিল, ব্রিটিশ থাকলে এসসি/এসটিরা যে ‘ন্যায়’ পাচ্ছেন ব্রাহ্মণ্যবাদীদের হাতে দেশ গেলে তা মিলবে না।

১৬

স্বাধীন ভারতের প্রথম আইনমন্ত্রী আম্বেদকার। পাকিস্তানের প্রথম আইনমন্ত্রী যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল, আম্বেদকরকে সংবিধান পরিষদে বাংলা থেকে পাঠাতে যিনি সবচেয়ে ভূমিকা নিয়েছিলেন, সেই যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল। আম্বেদকর পদত্যাগ করার পর নেহেরু ক্ষিপ্ত হলেন কংগ্রেসের মধ্যে থাকা হিন্দুত্ববাদীদের ওপর। পদত্যাগের হুমকি দিয়ে তিনি হিন্দু মহিলাদের সম্পত্তির অধিকার, বিচ্ছেদের অধিকার আইন পাস করালেন। কংগ্রেসের তীব্র বিরোধিতাকে উপেক্ষা করে জমিদারি প্রথা লোপ আইন (১৯৫১) আনলেন।

১৭

নেহেরু একটার পর একটা প্রগতিশীল পদক্ষেপ নিচ্ছেন, ক্ষিপ্ত হয়ে উঠছেন মৌলবাদীরা। ১৯৫২-র নির্বাচনে নেহেরুকে হারাতে একজন সাধুকে প্রার্থী করল।

জনসংঘ, স্বতন্ত্র পার্টিসহ বহুদলের পরোক্ষ সমর্থন ছিল। এই সময়ই নেহেরুকে বিপদে ফেলতে, হিন্দু ভোট এককাট্টা করতে শুরু হল আর এস এসের গো-রক্ষা আন্দোলন। ১৯৫২-তে মোট আসন ছিল ৪৮৯। নেহেরুর নেতৃত্বে কংগ্রেস জিতল ৩৬৪ (৪৪.৯%) আসনে। সেবার ভোট পড়েছিল ৪৫.৭ শতাংশ। মোট ভোটার ছিলেন ১৭ কোটি তিন লাখ। বিরোধী দল-নেতা হন কমিউনিস্ট পার্টির এ কে গোপালন। কমিউনিস্ট পার্টি পেয়েছিল ১৬টি আসন (৩.২৯ শতাংশ); অখিল ভারতীয় হিন্দু মহাসভা পায় সারা দেশে ৪টি আসন (০. ৯৫ শতাংশ)। অখিল ভারতীয় রামরাজ্য পরিষদ ৩টি আসন (১.৯৭ শতাংশ) ভারতীয় জনসংঘ—আসন ৩টি (৩.০৬ শতাংশ), বলশোভিক পার্টি কোন আসন পায়নি (০.০২ শতাংশ)। অবিভক্ত সি পি আই পায় ১৬টি আসন (৩.২৯ শতাংশ)—আর এস পি, ফরওয়ার্ড ব্লক আলাদা ভাবে লড়ে। আর এস পি পায় ৩টি আসন (০.৪৪ শতাংশ) ফরওয়ার্ড ব্লক (মার্কসবাদী) ১টি আসন লাভ করে (০.৯১ শতাংশ)/ ফরওয়ার্ড ব্লক (রুইকার গোষ্ঠী) কোনও আসন পায়নি। কিসান মজদুর প্রজা পার্টি পায় ৯টি আসন (৫.৭৯ শতাংশ)। সিডিউল্ড কাস্ট ফেডারেশনের মেলে ২টি আসন (২.৩৮ শতাংশ)। এই দলের নেতা ছিলেন আম্বেদকর। তিনিই এর প্রতিষ্ঠাতা। আম্বেদকর নিজে পরাজিত হন বোম্বে উত্তর কেন্দ্র থেকে। ১,৩৮,১৩৭ ভোটে কংগ্রেসের প্রার্থীর কাছে। বিজেপি-র পূর্বসূরী জনসঙ্ঘের (প্রতিষ্ঠা ১ অক্টোবর ১৯৫১) প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। তিনি কলকাতা থেকে নির্বাচিত হন। ১৯৪৭-র আগে তিনি মুসলিম লিগের সঙ্গে জোট করে সরকার গড়েন বাংলায় এবং সিন্ধুপ্রদেশে। শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি রাজনীতিতে আসেন ১৯২৯-এ। কংগ্রেসে যোগ দিয়ে। বঙ্গীয় ব্যবস্থাপকসভার সদস্য হন। ১৯৩৭-এ নির্দল সদস্য হয়ে জেতেন। ফজলুল হকের মন্ত্রিসভায় ১৯৪১-৪২ খ্রিস্টাব্দে অর্থমন্ত্রী হিসেবে কাজে করেন হিন্দু মহাসভার নেতা হিসেবে। ১৯৪৭ খিস্টাব্দের ১৫ আগস্ট নেহেরু মন্ত্রিসভার সদস্য হন। শিল্প এবং সরবরাহ মন্ত্রী। ১৯৫০-এর ৮ এপ্রিল নেহেরু-লিয়াকত চুক্তির প্রতিবাদে মন্ত্রিসভা ছাড়েন। ১৯৫১-তে আর এস এস নেতা গোলওয়ালকরের পরামর্শে জনসঙ্ঘ গড়েন। ১৯৫২-তে ভোটে জেতেন। জনসঙ্ঘের প্রার্থী হয়ে।

১৯৫২-এর ২৬ জুন প্রথম বিরোধিতা করেন কাশ্মীরে ৩৭০ ধারার। কাশ্মীর যেতে পারমিট প্রথা বাতিল করার দাবি তোলেন। শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যুর পরে কাশ্মীরে যেতে পারমিট প্রথা বাতিল হয়েছে। কিন্তু নাগাল্যান্ড, মিজোরাম, অরুণাচল প্রদেশে এবং সিকিমে (আংশিক) পারমিট প্রথা আজও বহাল আছে। প্রঙ্গত, ১১ ডিসেম্বরে ক্যা আইন পাসের পর মণিপুর, (৩০ ডিসেম্বর ২০১৯ বিজ্ঞপ্তি), মিজোরামে ইনার লাইন-এ পারমিট চালু হল। শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় যখন মন্ত্রিসভার সদস্য তখনই ৩৭০ ধারা (১৯৫০-এর ২৬ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে) অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

শ্যামাপ্রসাদ সংবিধান পরিষদ বা মন্ত্রিসভায় এই নিয়ে কোনও আপত্তি তোলেননি। ৩৭০ ধারার রচয়িতা গোপালস্বামী আয়েঙ্গার। রূপায়ণে সক্রিয় ভূমিকা নেন বল্লভভাই প্যাটেল। আপত্তি তুলেছিলেন সংবিধান পরিষদে একজন ব্যক্তি। নাম হজরত মোহানি, ‘জয়হিন্দ’ স্লোগানের উদ্গাতা ছিলেন। তিনি কমিউনিস্ট মনোভাবের মানুষ।

১৮

শ্যামাপ্রসাদের মৃত্যুতে জনসঙ্ঘ হীনবল হয়ে পড়ে। ১৯৬৪-এ কাশ্মীরে পারমিট প্রথা উঠে গেল। চীন ভারত যুদ্ধের বছরে বিশ্বহিন্দু পরিষদ প্রতিষ্ঠা করে তাঁরা। ১৯৭৫-এ জরুরি অবস্থা জারি হলে আর এস এস আবার নিষিদ্ধ হয়। ভারতীয় জনসংঘ ১৯৭৭-এ জনতা দল প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা নেয়। ১৯৭৪-এ পশ্চিমবঙ্গের সি পি আই (এম) জনসঙ্ঘের সঙ্গে মিলে জয়প্রকাশ নারায়ণের আন্দোলনে অংশ নেয়। এর প্রতিবাদে সিপিআই (এম)-এর তৎকালীন সম্পাদক পি. সুন্দরাইয়া পদত্যাগ করেন। তিনি পার্টিকে একটি চিঠি লিখে পার্টির সাধারণ সম্পাদক ও পলিটব্যুরো সদস্যপদ ত্যাগ করেন। কারণ হিসেবে বলেন, আধা-ফ্যাসিস্ট ইন্দিরাকে ঠেকাতে ফ্যাসিস্ট জনসঙ্ঘের হাত ধরা হচ্ছে। এটা আগামী দিনে মারাত্মক বিপদের জন্ম দেবে। সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনকে দুর্বল করবে। জনসঙ্ঘ ১৯৭৪-র আগে কার্যত অচ্ছুৎ ছিল। কংগ্রেস বা কমিউনিস্ট কোনও দল এদের সঙ্গে কাজ করেনি। জয়প্রকাশ নারায়ণের আন্দোলনে যোগ দিয়ে তারা মূল স্রোতে এল। ১৯৭৭-এ ইন্দিরার পতনের পর মোরারজি দেশাই প্রধানমন্ত্রী হলেন, সেই মন্ত্রিসভায় দুটি গুরুত্বপূর্ণ পদ পেলেন জনসঙ্ঘের দুই নেতা আটলবিহারী বাজপেয়ি এবং লালকৃষ্ণ আদবানি। বাজপেয়ি বিদেশমন্ত্রী। আদবানি তথ্য ও সম্প্রচার। সিকন্দর বখত পূর্ত, শ্রম ও পুনর্বাসন দপ্তরের মন্ত্রী ছিলেন। পরে বিজেপিতে যোগ দেন। সহ-সভাপতি হন। আরও পরে ১৯৯৬-এ বাজপেয়ি সরকারের মন্ত্রী হন। ২০০২ পর্যন্ত শিল্পমন্ত্রী ছিলেন। তাঁকে দিয়েই বিজেপির রাজ্যপাল পদে নিজের লোক বসানো শুরু ২০০২-এ। কেরালায় রাজ্যপাল করে পাঠানো হয় তাঁকে। বিজেপিও সংখ্যালঘু তোষণ করে। মুখতার হুসেন নাকভি, শাসনওয়াজ হুসেন কোনও আন্দোলন ছাড়াই বিজেপি-র নেতা। ১৯৮৯-এ বাজপেয়ির সভায় কোরান তেলাওয়াত করা হয়।

১৯

১৯৭৫-এ জরুরি অবস্থায় রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ নিষিদ্ধ হলে তারা নতুন সংগঠন গড়ে। অখিল ভারতীয় লোকসংঘর্ষ সমিতি। ১৯৭৭-এর ২২ মার্চ আর এস এসের ওপর নিষেধাজ্ঞা উঠে যায়। জনসংঘ জনতা দলে যোগ দেয় ১৯৭৭-এ। জনতা দল ১৯৭৭-এ বিপুল ভাবে জেতে। জনতা দল গঠিত হয় ১৯৭৭ খ্রিস্টাব্দের ২৩ জানুয়ারি। সংগঠন কংগ্রেস, জনসঙ্ঘ, ভারতীয় লোকদল মিলে জনতা দল গঠিত হয়। পরে জগজীবন রামের নেতৃত্বের কংগ্রেস ফর ডেমোক্রেসি যোগ দেয়। ১৯৭৭-এ ক্ষমতায় এল জনতা দল। বেশ কিছু নতুন কর্মসূচি নেয়। তার একটি ‘কাজের বিনিময়ে খাদ্য’। সস্তায় শাড়ি ও ধুতি দেওয়া শুরু করে। ১২-১৪ টাকা দাম। নাম জনতা কাপড়। জনতা ধুতি। চিনি ও কেরোসিনের দাম বেঁধে দেয়। গঠন করে মণ্ডল কমিশন। ১ জানুয়ারি ১৯৭৭। সাংসদ বিপি মণ্ডলের নেতৃত্বে গঠিত হয় এই কমিশন। সামাজিক ও শিক্ষাগতভাবে পিছিয়ে পড়াদের চিহ্নিত করবে। এই কমিশন রিপোর্ট দেয় ১৯৮৩-তে। কিন্তু তা ঠান্ডাঘরে চলে যায়। ইন্দিরা বা রাজীব গান্ধী কোনও উদ্যোগ নেন না। এখানে প্রথম ওবিসি-র কথা বলা হল। সামাজিক শিক্ষাগত ও অর্থনৈতিক মাপকাঠি দেখে এই ওবিসি বা অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির জন্য সংরক্ষণের সুপারিশ করে মণ্ডল কমিশন। কমিশন বলে ভারতের জনসংখ্যার ৫২ শতাংশ পিছিয়ে পড়া। (বর্তমানে দেশে ওবিসি ভুক্ত জাতের সংখ্যা ৫০১৩)। ইন্দিরা ও রাজীব গান্ধী বেশ কিছু বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। ইন্দিরা ব্যাঙ্ক জাতীয়করণ, খনি জাতীয়করণ করেন। রাজন্যভাতা বিলোপ করেন। এতে জমিদার ও রাজা এবং ধনিক শ্রেণি খুব ক্ষিপ্ত। তাঁরা জনসঙ্ঘ এবং স্বতন্ত্র দল এবং সংগঠন কংগ্রেসকে অর্থ সাহায্য করতে থাকেন ইন্দিরার পরাজয়ের জন্য। ১৯৭১-এর বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধে জয়ের পর ইন্দিরা একনায়কতন্ত্রী হয়ে ওঠেন। এশিয়ার মুক্তিসূর্য, ইন্দিরা ইজ ইন্ডিয়া—এসব মদগর্বী শ্লোগান তাঁর মাথা ঘুরিয়ে দেন। ১৯৭১-এ মার্কসবাদী কমিউনিস্টদের সাহায্য নিলেও পশ্চিমবঙ্গে খুন জখমের রাজনীতি করে তাঁর দল—’ফাইট টু ফিনিশ’ নীতি নিয়ে। ফল হয় বিপরীত। ১৯৭৫-এ এলাহাবাদ হাইকোর্টে রাজনারায়ণের করা মামলায় ইন্দিরার জয় অনৈতিক বলে রায় দেয়! এবং ইন্দিরা গান্ধীকে পদত্যাগ করতে ও ৬ বছরের জন্য নির্বাচনে দাঁড়াতে পারবেন না বলে জানিয়ে দেয়। এতে বিপন্ন ইন্দিরা জরুরি অবস্থা জারি করলেন ১৯৭৫-এর ২৫ জুন। সেদিন জয়প্রকাশের নেতৃত্বে প্রায় সব বিরোধী দলের আইন অমান্য ও অসহযোগ আন্দোলন শুরু করার দিন। সে সময় বর্তমান দিনের মতো রেইড রাজ শুরু হয়। আয়কর বিভাগকে লেলিয়ে দেওয়া হয়। রামনাথ গোয়েঙ্কার ‘ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসে’ আয়কর হানা হয়। বিরোধী রাজনৈতিক নেতা ও সাংবাদিকদের গ্রেপ্তার করা হয়। পরিণতিতে ১৯৭১ বিপুল ভোটে জয়ী ইন্দিরা ১৯৭৭-এ বিপুলভাবে পরাজিত, এর সঙ্গে ছিল অর্থনৈতিক সংকট, বেকারি, দারিদ্র্য, মূল্যবৃদ্ধি, আর্থিক কেলেঙ্কারি, স্বাধীনতাহীনতা, জোর করে রাজ্যসরকার ভাঙা, বিরোধীদের কথায় কর্ণপাত না করা—প্রচারমাধ্যমের তীব্র নিয়ন্ত্রণ। (ঠিক যেন আজকের ভারত)। তার জবাব দেন মানুষ। ১৯৭৭-এ।

২০

১৯৭৯-তে দেখা দিল জুলাই সংকট। জনসঙ্ঘ বিহার উত্তরপ্রদেশে দাঙ্গা করে, সে নিয়ে মন্ত্রিসভায় প্রচণ্ড বির্তক হয়। বিশেষ করে আলিগড় এবং জামশেদপুর দাঙ্গায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। জনতা দলের বেশিরভাগ অংশ দাবি করলেন জনসঙ্ঘকে আর এস এস ছাড়তে হবে। দ্বৈত সদস্য পদ চলবে না। এর মাঝে জনতা দল (সেকুলার) নামে একটা সংগঠন তৈরি হয়ে গেল। নেতৃত্বে চরণ সিং।

২৮ জুলাই ১৯৭৯ জনতা সরকারের পতন ঘটল। চরণ সিংহ কিছুদিনের জন্য প্রধানমন্ত্রী হলেন। তাঁরও পতন ঘটল। নির্বাচন হল ১৯৮০-তে। ইন্দিরা গান্ধী আবার ক্ষমতায় ফিরলেন। জনতা পার্টি পেল মাত্র ৩১টি আসন। এর আগের নির্বাচনে পেয়েছিল ২৯৫টি আসন। সঙ্গে ছিল সিপিআই (এম)—২২, সি এফ ডি—১৩, ফরওয়ার্ড ব্লক—২, আর এস পি—৪, অকালি দল—৯। ইন্দিরা কংগ্রেস ১৯৭৭-এ পেয়েছিল ১৫৪টি আসন। ১৯৮০-তে বেড়ে দাঁড়াল—ইন্দিরা কংগ্রেস ৩৬২ (৪৩.৭ শতাংশ)। মোরারজি দেশাইয়ের নেতৃত্বের জোট সাকুল্যে ৫১টি, জনতা দল ৩১টি। আবার কথা উঠল দ্বৈত সদস্য পদ তথা আর এস এসের সদস্যপদ ছাড়তে হবে। ১৯৮০-র এপ্রিলে দ্বৈত সদস্য পদ নিষিদ্ধ হল। মানুষ দাঙ্গা অশান্তি সাম্প্রদায়িক রাজনীতি ভালোভাবে নিচ্ছে না। আর এস এসের পরামর্শে আদবানিরা বেরিয়ে গিয়ে নতুন দল গড়লেন ভারতীয় জনতা পার্টি (বি জে পি)—৬ এপ্রিল ১৯৮০। কিন্তু ভারতে এই হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি মুখ থুবড়ে পড়ল ১৯৮৪ তে। ইন্দিরা গান্ধী খুনের প্রতিবাদে দেশ ঢেলে ভোট দিল রাজীব গান্ধীর কংগ্রেসকে। বি জে পি মাত্র ২টি আসন পেল সংসদে।

২১

এরমধ্যে রাজীব গান্ধী ১৯৮৫-তে একটি মারাত্মক ভুল করে বসলেন। বয়স কম। বুদ্ধিদাতারাও ভুল। ১৯৮৫-তে শাহবানু মামলার রায় বের হল। মধ্যপ্রদেশের ইন্দোরের শাহবানু নামে এক ৬২ বছরের এক বৃদ্ধা মহিলা তাঁর স্বামী আহমেদ খানের বিরুদ্ধে খোরপোশ চেয়ে মামলা করেন। ১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দে। মধ্যপ্রদেশ হাইকোর্ট ১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দে রায় দেয় খোরপোশ দিতে হবে। স্বামী ধনী। তবু মানেন না। সুপ্রিম কোর্টে যান। সুপ্রিম কোর্ট ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে ২৩ এপ্রিল ১৯৮৫ এক ঐতিহাসিক রায় দেয়—খোরপোশ দিতে হবে। প্রধান বিচারপতি ওয়াই ভি চন্দ্রচূড়ের নেতৃত্বে পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চ (রঙ্গনাথ মিশ্র, ডি. এ দেশাই, ও চিনাপ্পা রেড্ডি, ই. এস ভেঙ্কটরামাইয়া) রায় দেন খোরপোশ না দিলে শাস্তি হবে। মুসলিম মৌলবাদীরা বিরোধিতা করে। তাদের দিকে তাকিয়ে রাজীব গান্ধী ভুল করলেন। সংসদে ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা। মুসলিম মহিলা বিল এনে এই রায় বাতিল করে দিলেন। ১৯৮৬-তে এল ‘দ্য মুসলিম উওম্যান’ (প্রোটেকশন অন রাইটস অফ ডিভোর্স) অ্যাক্ট ১৯৮৬ পাস হয়ে গেল। এতে হিন্দু মৌলবাদীরা চটল। তাদের সন্তুষ্ট করতে এক মাস পর আর এক মহা ভুল করলেন রাজীব গান্ধী। বাবরি মসজিদের তালা খুলে দিলেন। ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে কিছু লোক বাবরি মসজিদ চত্বরে রামলালার মূর্তি ফেলে আসেন। জহরলাল নেহেরু এবং বল্লভভাই প্যাটেল বলা সত্ত্বেও সেই মূর্তি ফৈজাবাদের জেলাশাসক সরাননি। (তিনি ও তাঁর স্ত্রী পরে জনসংঘের সাংসদ হন)। সেই থেকে বছরে হিন্দু মৌলবাদীরা একবার করে পুজো করে আসতেন। এবার তালা খেলার পর দৈনিক পূজা শুরু হল। সাধারণ লোক প্রবেশ করতে শুরু করল। আর এস এস ও বিজেপি মিলে তৈরি করল রাম জন্মভূমি ন্যাস। মন্দির বানাতে দিতে হবে।

এর প্রতিক্রিয়ায় তৈরি হল বাবরি মসজিদ অ্যাকসন কমিটি। এর মধ্যে রামমন্দিরের হাওয়া তুলে ১৯৮৯-এর নির্বাচনে বিজেপি ৮৬টি আসন পেল। মূলত উত্তরভারত থেকে। রাজীব গান্ধীর নামে বোফর্স দুর্নীতির অভিযোগে তখন ভারত উত্তাল। (পরে কিছুই প্রমাণ হয়নি)। রাজীব হারলেন। জিতলেন তাঁর অর্থমন্ত্রী, যিনি দুর্নীতির অভিযোগে অন্যমাত্রা এনে দিয়েছিলেন, সেই বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং। ১৯৮৭-এ আবার জনতা দল পুনরুজ্জীবিত করেন। ১৯৮৯-এ জনতা দল সরকার গড়ে। দুই পরস্পরবিরোধী শক্তির মদতে। তাঁর চেয়ারের একটা খুঁটি বিজেপি। অন্যটি বামফ্রট। বিজেপির রাম থেকে বাঁচতে তিনি সামাজিক ন্যায়ের কথা তুলে ধরেন। ১৯৮৩ থেকে পড়ে থাকা মণ্ডল কমিশনের রায় তিনি কার্যকর করার কথা ঘোষণা করেন ১৩ আগস্ট ১৯৯০। ২৭ শতাংশ সংরক্ষণ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। সুপ্রিম কোর্ট তা স্থগিত করে দেয় । পরে ১৯৯২-এর ডিসেম্বরে ওবিসি সংরক্ষণে সম্মতি দেয় সুপ্রিম কোর্ট। কিন্তু মণ্ডল কমিশনের রায় কার্যকর করার কথা ঘোষণার জেরে তাঁর সরকার পড়ে যায়। বিজেপি রাস্তায় নামে। ছাত্র-যুবরা আন্দোলন করে উত্তর ভারতে। কারণ উত্তর ভারতে ২০ শতাংশ উচ্চবর্ণ। দক্ষিণ ভারতে আন্দোলন হয়নি। কারণ উচ্চবর্ণ—১০ শতাংশ-এর বেশি নয়। আর সরকারি চাকরির প্রতি নির্ভরতা দক্ষিণ ভারতে কম। বিজেপির সঙ্গে কংগ্রেসও বিরোধিতা করে ২৭ শতাংশ সংরক্ষণের। দিল্লিতে রাজীব নামে এক ছাত্রের আত্মাহুতির পর আন্দোলন জোরদার হয়। নরেন্দ্র মোদি গুজরাতে সংরক্ষণ বিরোধী আন্দোলনে যোগ দেন। পরে মুখ্যমন্ত্রী হয়ে নিজের তেলি সম্প্রদায়কে ওবিসি-র তালিকাভুক্ত করেন।

মণ্ডল কমিশন ঠেকাতে আদবানি আসরে নামেন কমণ্ডলু নিয়ে। রামমন্দির গড়ার দাবিতে ১৯৯০-এর ৩০ অক্টোবর তিনি রথযাত্রা শুরু করেন। পরে বিহারে গ্রেপ্তার হয়ে যান। মজার কথা, যে বিজেপি তফশিলি জাতি উপজাতি সংরক্ষণের তীব্র বিরোধী তাদের সমর্থকদের মধ্যে বাংলায় সংরক্ষিতদের পাল্লাভারি।

২২

১৯৯০-এর ২ ডিসেম্বর ভিপি সিংহ সরকারের পতন ঘটল। বিজেপি সমর্থন প্রত্যহার করায় সংখ্যালঘু সরকার হিসেবে ক্ষমতায় আসেন চন্দ্রশেখর। (১০ নভেম্বর ১৯৯০—২১ জুন ১৯৯১)। এরপর নির্বাচন। কংগ্রেস ক্ষমতায় এল নরসিংহ রাওয়ের নেতৃত্বে। (২১ জুন ১৯৯১—১৬ মে ১৯৯৬)। বিজেপি এই সময় তাদের শক্তিবৃদ্ধি করে নরসিংহ রাওয়ের পরোক্ষ মদতে। অযোধ্যায় করসেবা করে। অবশেষে ৬ ডিসেম্বর ১৯৯২ প্রকাশ্য দিবালোকে বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলে। সারাদিন নাকি নরসিংহ রাও ঘুমিয়ে ছিলেন। জ্যোতি বসুসহ কেউ তাঁকে ফোনে পাননি। এই সময় অর্থমন্ত্রী হিসেবে উদার অর্থনীতির জন্ম দিলেন মনমোহন সিংহ। টাকাকে পূর্ণরূপান্তর যোগ্য করলেন। বিজেপি মুখে এর বিরোধিতা করলেও পরে এই পথেই হেঁটেছে। ১৯৯৬-এ কংগ্রেস হারল। ত্রিশঙ্কু দশা। বিরোধীরা জ্যোতি বসুকে প্রধানমন্ত্রী হতে বললেন। সিপিআই (এম) কেন্দ্রীয় কমিটির হঠকারী সিদ্ধান্তে সিপিএম সরকারে গেল না। জ্যোতি বসু প্রধানমন্ত্রী হলেন না। বিজেপি ফেটে পড়ল উল্লাসে। বাজপেয়ি সরকার গড়ার ডাক পেলেন। হলেন ১৩ দিনের প্রধানমন্ত্রী। ১৬ মে ১৯৯৬ থেকে ১ জুন ১৯৯৬ নামে হলেও কার্যত ১৩ দিন। অনাস্থায় হেরে বিদায় নিলেন। ক্ষমতায় এল বিরোধী জোট। কংগ্রেসের সমর্থনে। কর্ণাটকের এইচ ডি দেবেগৌড়া প্রধানমন্ত্রী। ১ জুন ১৯৯৬ থেকে ৩২৪ দিন প্রধানমন্ত্রী রইলেন। পতন ঘটল সীতারাম কেশরীর প্রধানমন্ত্রী হওয়ার তীব্র বাসনায়। দেবেগৌড়া উচ্চারণ করলেন—ওল্ড ম্যান ইন এ হারি। এরপর প্রধানমন্ত্রী হলেন সংযুক্ত জনতা দলেরই ইন্দ্রকুমার গুজরাল। দেবেগৌড়া ছিলেন ৩২৪ দিন ক্ষমতায়। ১৯ মার্চ ১৯৯৯ পর্যন্ত গুজরাল থাকলেন ৩৩২ দিন। আবার বাজপেয়ি—১৯৯৮-এর ১৯ মার্চ। তারপর অক্টোবরে হল ভোট। ১০ অক্টোবর ১৯৯৯ শপথ নিলেন বাজপেয়ি। ৫ বছরের জন্য। বাজপেয়ি প্রথম দফাতেই পরমাণু বোমা বিস্ফোরণ ঘটালেন ১১ মে ১৯৯৮। পরের বছর জুনে হল কার্গিল যুগ্ধ। সংসদে হামলা হল বাজপেয়ি আমলেই। এটাও সাজানো বলে অনেকের অভিযোগ। আফজল গুরুর গাড়ি হামলায় ব্যবহৃত হয়েছে—এই অভিযোগে তাকে ফাঁসি দেওয়া হয়। অথচ সাধ্বী প্রজ্ঞার বাইক বিস্ফোরণে ব্যবহৃত হওয়ার পর তিনি বিজেপির সাংসদ।

২৩

বাজপেয়ি আমলে পেঁয়াজের দাম ৮০ টাকা হয় (মোদি আমলে চাষি পাঁচ পয়সার পেঁয়াজ বেচেছেন ১৪ জানুয়ারি ২০১৯, আর ক্রেতা কিনেছেন ডিসেম্বরে ১৫০ টাকা থেকে ২০০ টাকা কেজি দরে)। সৈন্যদের কফিন কেনায় কেলেঙ্কারি হয়। ঘুষ নেওয়ার অভিযোগে পদত্যাগ করতে হয় বিজেপি সভাপতি বঙ্গারু লক্ষ্মণকে। বাজপেয়ি জমানায় ২০০২ খ্রিস্টাব্দের ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে মাসাধিক কাল ধরে চলে গুজরাত গণহত্যা। ২৭ ফেব্রুয়ারি গোধরায় ট্রেনে আগুন লাগে। এ নিয়ে উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় কমিশনের রিপোর্ট আছে। তাতে এটিকে দুর্ঘটনা বলা হয়েছে। পাঠক খেয়াল করে দেখবেন, আগুন জানলা দিয়ে বাইরে আসছে। ভেতরে থেকে লাগানো। বাইরে থেকে নয়। ওই কামরায় কোনও করসেবক ছিলেন না। চারজন মুসলিম ছিলেন। এর মধ্যে একজনের নাম মহম্মদ। যিনি জীবিত ছিলেন। এবং রেল থেকে পাঁচ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ পান।

গুজরাত গণহত্যার দায়ে বাজপেয়ি প্রথম গুজরাতের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে পদত্যাগ করতে বলেন। বলেন, রাজধর্ম পালন করতে। কিন্তু কিছুই হয়নি। সরকারের তৎকালীন উপপ্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লালকৃষ্ণ আদবানির মদতে নরেন্দ্র মোদি মুখ্যমন্ত্রী থেকে যান। (নরেন্দ্র মোদি তাঁর কৃতজ্ঞতার মাশুল দিচ্ছেন আদবানিকে দলে সম্পূর্ণভাবে কোণঠাসা করে)। গুজরাত গণহত্যা নিয়ে নানাবতী শাহ কমিশন হয়। সেই কমিশনে আই পি এস অফিসার সঞ্জীব ভাট জানান, মুখ্যমন্ত্রী পুলিশকে নিষ্ক্রিয় থাকতে বলেছিলেন। জানিয়েছিলেন, হিন্দুদের তাঁদের রাগ প্রকাশ করতে দিতে। এর ফলে সঞ্জীব ভাট প্রথমে চাকরি থেকে বরখাস্ত, পরে অপসারিত হন। বর্তমানে তাঁকে ৩০ বছরের এক পুরানো মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়েছে।

মন্ত্রিসভার বৈঠকে সঞ্জীব শাহের থাকার কথা নয়। ছিলেনও না। ছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হারীণ পাণ্ডিয়া। তিনি গোধরা থেকে মৃতদেহ আমেদাবাদ গান্ধীনগরে আনার বিরোধিতা করেন। বলেন, এতে ক্ষতি হবে। শান্তি বিঘ্নিত হবে। মোদি তো অশান্তিই চাইছিলেন। কারণ, ২৭ ফেব্রুয়ারির দুদিন আগে গুজরাত বিধানসভার তিনটি আসনে উপনির্বাচনের ফল বের হয়। একটিতে মোদি জেতেন। রাজকোট-২ আসনে। ব্যবধানও আহামরি নয়। মাত্র ১৪,৭২৮ ভোটে।

উপনির্বাচন হয়েছিল ২১ ফেব্রুয়ারি। আরও ২টি আসনে। দুটিই ছিল বিজেপি-র দখলে। বরোদা নগরের সয়াজিগঞ্জ আসন ও সুরাটের মহুভা আসন। দুটিতেই জেতেন কংগ্রেস প্রার্থী। যথাক্রমে ২২,৫৪৩ এবং ১২,৬৯৫ ভোটে।

১৯৯৮ এ রাজকোট-২ আসনে বিজেপি জিতেছিল ২৭০০০ ভোটে। মাত্র চার মাস বিজেপি হাইকম্যান্ড কেশুভাইকে সরিয়ে নতুন মুখ নরেন্দ্র মোদিকে এনেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী পদে। তা যে ব্যর্থ—তা প্রমাণিত হয়ে গেল উপনির্বাচনে। এই ভোটে বোঝা গেল কংগ্রেসের গুজরাটে ক্ষমতায় আসা সময়ের অপেক্ষা। এর আগে ২০০০ খ্রিস্টাব্দে সেপ্টেম্বর জেলা পরিষদ, তালুক পঞ্চায়েত এবং পুরসভা নির্বাচনে বিপুল ভোটে জিতেছে কংগ্রেস। সবরকণ্ঠ লোকসভা এবং সবরমতী বিধানসভার উপনির্বাচনেও হেরেছে বিজেপি। জিতেছে কংগ্রেস।

এই অবস্থায় সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের তাস খুব জরুরি ছিল মোদির কাছে।

তাই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হারীণ পাণ্ডিয়ার কথা শোনা হল না। ৫৮ জনের দেহ আনা হল আমেদাবাদে। হল শোক মিছিল। ডি.এন.এ টেস্ট করা হল না। কোনও মৃতদেহেরই। কার মৃতদেহ অনেকেই জানেন না। আরএসএস মিছিল করল। টিভি দেখাল। সব কাগজ ছাপল। জনমত গঠন হল। আগে থেকে ছকে রাখা গণহত্যা আরম্ভ হল গুজরাত জুড়ে। ২০০০ নারী ধর্ষিতা হলেন ৩০০০ পুরুষ খুন। গর্ভ চিরে ভ্রূণ নিয়ে ত্রিশূলের ডগায় নাচাল উন্মত্ত সংঘী সেনারা। পুলিশ কোথাও বাধা ছিল না। উল্টে সামান্য প্রতিবাদ হলে পুলিশ গুলি চালিয়ে ছত্রভঙ্গ করে পথ করে দিল আর এস এস, বিজেপি ও বিশ্বহিন্দু পরিষদের কর্মীদের। পুলিশের জিপে করে নিয়ে যাওয়া হয় পেট্রল, ঘর পোড়াতে। শ্লোগান উঠল, ‘ইয়ে অন্দর কা বাত হ্যায়, পুলিশ হামারা সাথ হ্যায়।’ (উত্তরপ্রদেশে ডিসেম্বর ২০১৯-এ প্রায় এক ঘটনা) এই প্রথম দেখা গেল নারী নারীকে রক্ষা করে না—ভুল বুঝিয়ে আশ্রয় দেওয়ার নাম করে গণধর্ষণের মুখে ঠেলে দেওয়া হয় মুসলিম নারীদের। পুলিশের ডিজি, নামে মুসলিম হওয়ায় আক্রান্ত হন। তাঁর দেহরক্ষী নামের ব্যাজ ছিঁড়ে তাঁকে বাঁচান। বিপরীত ঘটনাও ছিল। হিন্দু প্রতিবেশী বাঁচিয়েছে মুসলিমকে। নরেন্দ্র মোদির দাদা প্রহ্লাদ মোদি এবং মোদির পরিত্যক্তা স্ত্রী যশোদাবেন নিজেদের গ্রামে দাঙ্গা করতে দেন না। ব্রাহ্মণ পুরোহিত বাঁচিয়েছিলেন মেদিনীপুরের ১৫ জন মুসলিম নির্মাণ কর্মীকে। নামাবলী পরিয়ে ট্রেনে চাপিয়ে দিয়েছিলেন। গুজরাতে কিছু মুসলিম ভেবেছিলেন বিজেপি করলে বাঁচবেন। বাঁচেননি। বরোদার প্রাক্তন বিধায়ক, গণিভাই কুরেশি বরোদার মুসলিমদের রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। গুজরাত গণহত্যার পর সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ ঘটিয়ে, মুসলিমদের ব্যবসা বাণিজ্য চৌপাট করে বিধানসভা নির্বাচনে জিতে ১২ বছর মুখ্যমন্ত্রী থেকে গেলেন নরেন্দ্র মোদি।

২৪

১৯৯৯ থেকে ২০০৪ বাজপেয়ি সরকার এমন ভাবে শাইনিং ইন্ডিয়ার প্রচার চালিয়েছিল—মনে হচ্ছিল, আবারও ফিরবে তাঁরা। বাজপেয়ি আদবানি ছাড়াও খুব শক্তিশালী হয়ে উঠেছিলেন প্রমোদ মহাজন। নিজের ভাইয়ের হাতে খুন হয়ে যান পরে। ২০০৪-এ হেরে বিদায় নেন বাজপেয়ি। লোকে তখন বলতো—বাজপেয়ি মুখোশ অদবানি মুখ। পরে আদবানি দলেও কোণঠাসা হন, জিন্নাহের প্রশংসা করে। বাজপেয়ি অসুস্থ হয়ে মারা গেলেন ২০১৮-য়। লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে গেল তাঁর জীবন। বাবরি ধ্বংসের আরেক কারিগর মুরলিমোহর যোশি টিকিট পাননি। রাজ্যপালও বানায়নি দল। অপমানিত। অবসৃত। জীবদ্দশায় কৃতকর্মের ফল ভোগ করছেন। উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী কল্যাণ সিং—কোথায় কেউ জানে না।

২৫

২০০৪-২০১৪ দশ বছর চলে কংগ্রেসের শাসন। শিক্ষার অধিকার আইন, তথ্য অধিকার আইন, শিশু ও কিশোরদের দুপুরের খাবার, খাদ্য নিরাপত্তা আইন, মহাত্মা গান্ধী রোজগার যোজনা—প্রভৃতি ঐতিহাসিক কাজ করে কংগ্রেস সরকার। সোনিয়া গান্ধী নিজে প্রধানমন্ত্রী না হয়ে প্রধানমন্ত্রী করেন মনমোহন সিংহকে। ২০০৪-এ বামপন্থীদের সমর্থনে চলে ইউপিএ-১ সরকার, ২০০৮-এ মার্কিন সরকারের সঙ্গে পরমাণু চুক্তি নিয়ে বাধে বিরোধ। কংগ্রেস সরকার থেকে সমর্থন তুলে নেন বামপন্থীরা। তাতেও সরকার পড়ে না। কিন্তু ২জি কেলেঙ্কারি, দিল্লিতে নির্ভয়া কাণ্ডে দেশ আলোড়িত হয়। মুম্বাইয়ে পাক জঙ্গি হামলা হয়। সেখানে মারা যান ১৩৬ জন মানুষ। ভারতে ২০০৮-এ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র সচিব আর কে সিং উচ্চারণ করেন ‘গৈরিক সন্ত্রাসবাদ’ শব্দ। কারণ, বিজেপি যখন ক্ষমতায় ছিল না সেই সময় তারা একের পর এক বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। এগুলো আমাদের কথা নয়। ২৬ সেপ্টেম্বর ২০০৮ মুম্বাই বিস্ফোরণে নিহত আই পি এস হেমন্ত কারকারের পেশ করা তদন্ত রিপোর্ট বলা হয়েছে। এন আই এ আজও মামলা চালাচ্ছে আদালতে। যদিও খুব নরমভাবে। অন্যতম মূল অভিযুক্ত সাধ্বী প্রজ্ঞার জামিনের বিরোধতা করেনি। মামলা থেকে সরে যেতে বাধ্য হওয়া সরকারি আইনজীবী অভিযোগ করেছেন, তাঁকে নরম মনোভাব নিতে বলেছে এন আই এ কর্তারা।

সাধ্বী প্রজ্ঞা, মিলিটারি ক্যাপ্টেন দয়ানন্দ, স্বামী অসীমানন্দদের করা বিস্ফোরণের খতিয়ান—

১) নান্দেড় বিস্ফোরণ—৫ এপ্রিল ২০০৫

২) মুম্বাই ট্রেন বোমা বিস্ফোরণ—১১ জুলাই ২০০৬

৩) মালেগাঁও বোমা বিস্ফোরণ—৮ সেপ্টেম্বর ২০০৬

৪) সমঝোতা এক্সপ্রেস বিস্ফোরণ—১৯ ফেব্রুয়ারি ২০০৭

৬) আজমির শরিফ দরগা বিস্ফোরণ—১১ অক্টোবর ২০০৭

৭) উত্তরপ্রদেশ আদালতে ধারাবাহিক বিস্ফোরণ—২৩ নভেম্বর ২০০৭

৮) জয়পুর বোমা বিস্ফোরণ—১৩ মে ২০০৮

৯) দিল্লিতে ধারাবাহিক বোমা বিস্ফোরণ—১৩ সেপ্টেম্বর ২০০২

প্রথমে প্রত্যেকটি থেকে ধরা হয়েছিল মুসলিমদের। পরে এটিএস বা অ্যাকসন টেকেন স্কোয়াড গড়া হয়। তাতে দেখা যায় এর মূল চক্রী সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল দয়ানন্দ, অসীমানন্দ, সাধ্বী প্রজ্ঞা প্রমুখ। সাধ্বী প্রজ্ঞা বর্তমানে অসুস্থ বলে জামিনে মুক্ত এবং বিজেপি সাংসদ।

২৬

২০১১ থেকে দেশে তৈরি হল তীব্র বিক্ষোভ। আন্না হাজারের দুর্নীতি বিরোধী আন্দোলন দেশে বিদেশে ঢেউ তোলে। রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্কহীন মানুষও দুনীর্তি বিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। দিল্লির বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিয়াল, পুডুচেরির বর্তমান রাজ্যপাল কিরণ বেদির রাজনীতিতে অভিষেক এই আন্দোলনে। কংগ্রেস দুনীর্তিগ্রস্ত—এই মনোভাব গড়ে ওঠে জনমানসে। আর এস এস হাজার হাজার ক্যাডার ও খাবার সরবরাহ করে। ওঠে লোকপাল নিয়োগের দাবি। সেই দাবি মানা হয়। কিন্তু গুজরাতে লোকপাল নিয়োগ হয়নি। মোদি সরকারের আমলে লোকপাল নিযুক্ত হল ২০১৯-এ নির্বাচনের মুখে। সেখানে কোনও মন্ত্রীর বিরুদ্ধে অভিযোগ জমা পড়েছে বলে শোনা যায়নি। যদিও ক্যাগ রিপোর্ট অনুযায়ী বর্তমানে এক লাখ ৩৬ হাজার কোটির দুর্নীতি কেন্দ্র সরকারের।

আন্না হাজারে ২০১১-র ৪ এপ্রিল অনশনে বসেন। তাঁর পাশে তখন দাঁড়ান অরুন্ধতী রায়, আমির খান, মেধা পাটকররা। আন্না হাজারে ২০১৯-এ অনশনে বসলেও মিডিয়া মাথা ঘামায়নি। ফুটেজ দেয়নি। আন্না হাজারেও নিছক একটা বিবৃতি দিয়ে সরে যান।

দুনীতি বিরোধী আন্দোলনের রেশ মিটতে না মিটতেই ২০১২-র ১৬ ডিসেম্বর ২৩ বছর বয়সী এক ফিজিওথেরাপির্স্ট ইন্টার্ন, (সংবাদমাধ্যম তাঁকে নির্ভয়া, দামিনী, জ্যোতি সিংহ পাণ্ডে নামে লিখেছে) চলন্ত বাসে ধর্ষিতা হন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন চন্দ্রপ্রতাপ পাণ্ডে, তাঁর বন্ধু। তাঁকে পেটানো হয়। দিল্লির মুনিরা এলাকায় এই বেদনাদায়ক ঘটনার অভিঘাতে মেয়েটি ১৫ দিন পর সিঙ্গাপুরে মারা যান। তাঁর ওপর নৃশংস অত্যাচারের প্রতিবাদে সারা দেশ মুখর হয়। মনমোহন সিং সরকারের পতনে আন্না হাজারের আন্দোলন ও নির্ভয়া কাণ্ড বড় ভূমিকা নেয়। ২০১৩ খ্রিস্টাব্দে গুজরাতে আয়োজিত হয় ‘ভাইব্রান্ট গুজরাত’ সভা। দেশের তাবড় শিল্পপতিরা যোগ দিয়ে গুজরাতের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রীর সুখ্যাতি করেন। গুজরাত মডেলের নাম শোনা যেতে থাকে, সারা দেশে।

২০১৪-তে হল নির্বাচন। ‘মোদি মোদি’ আওয়াজে মুখর দেশ। জিতলেন নরেন্দ্র মোদি। ৩০১টি সব মিলিয়ে আসন। এই প্রথম বিজেপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেল।

মোদি নির্বাচনের আগে বলেছিলেন, আচ্ছে দিন বা সুদিনের কথা। কিন্তু কার্যত কী হয়েছে দেখছেন দেশ ও দেশের জনগণ। চরম মন্দা চলছে। সঙ্গে তীব্র মূল্যবৃদ্ধি। পেঁয়াজ ৮০ পার। পেট্রল ৮৩ টাকা। ব্যাঙ্ক উঠে যাচ্ছে। রেলে তিন লাখ কর্মী ছাঁটাই। বিশ্বভারতীর মতো ঐতিহ্যবাহী কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকারের বেতন দেওয়া বন্ধ। নিজেদের জমানো টাকায় বেতন হয়েছে। ত্রিপুরা, আলিগড়, জামিয়া কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের এক দশা। উচ্চ শিক্ষায় বরাদ্দ মাত্র ৪০০ কোটি। ভারতের ইতিহাসে এই প্রথম রিজার্ভ ব্যাঙ্ক থেকে তোলা হয়েছে ১.৭৬ ট্রিলিয়ন বা এক লাখ ৭৬ হাজার হাজার হাজার কোটি টাকা। বৈদেশিক ঋণ ছিল ৪৯ লক্ষ কোটি টাকা। এখন ১০২ লক্ষ কোটি টাকা। ১০০% বৃদ্ধি পেয়েছে। গাড়ি শিল্পে ১৩ লাখ ছাঁটাই। জামশেদপুরের মতো জায়গায় টাটা ইস্পাত সহ ৩৫টি শিল্প বন্ধের মুখে। কোথাও নতুন চাকরি নেই। ঝাড়খণ্ডে ফলে হেরেছে বিজেপি ২০১৯-এর ডিসেম্বরে।

তার মধ্যে বাড়ছে বিদ্বেষ। এ পর্যন্ত গণ পিটুনিতে ৫৩ জনকে প্রকাশ্যে পিটিয়ে মেরে ভিডিয়ো ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। দিল্লি স্টেশনে পর্যন্ত ২৯ আগস্ট ক্বারী ওয়ায়েসকে খুন করা হয়েছে। উত্তর পূর্বাঞ্চলে বিজেপি সরকার গোমাংস সরবরাহ করছে আর উত্তরভারতে খেতে বাধা দিচ্ছে। বাকি পৃথিবীতে গোমাংস রপ্তানি করছে। এখন ব্রাজিলকে ছাপিয়ে এক নম্বরে।

কাশ্মীরে ঢোকা ও বেরোনোর অনুমতি নাই। রাহুল গান্ধীকে পর্যন্ত ফেরত পাঠানো হয়েছে। সীতারাম ইয়েচুরি সুপ্রিম কোর্টের আদেশ নিয়ে গেছেন। আই এ এস টপার শাহ ফয়জলকে হার্ভাডে পড়াতে যেতে দেওয়া হয়নি। অর্থনীতি চরম বিপর্যস্ত। দীর্ঘদিন জেলে আটকে রাখা হয়েছিল দুই প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ফারুক আবদুল্লাহ ও ওমর আবদুল্লাহকে। সদ্য মুক্ত। মেহবুবা মুফতি।

২৭

স্বাস্থ্য শিক্ষা কৃষি জ্বালানি (গ্যাস) রেল পরিবহণের মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে ভতুর্কি বন্ধ করে দিচ্ছে বা দিতে চলেছে মোদি শাহ সরকার। অথচ শুধু আদানি আম্বানির মতো বৃহৎ সংস্থাকে কর ছাড় দিয়েছে ৬ লক্ষ কোটি। পশ্চিমবঙ্গের মোট বাজেটের প্রায় ১২ গুণ টাকা। ব্যাঙ্ক ঋণ মকুব করেছে তিন লক্ষ কোটি টাকা। আর নীরব মোদি, ললিত মোদির মতো লোকেরা ব্যাঙ্কের টাকা লুঠ করে পালিয়েছে ৭২ হাজার কোটি টাকা। সেই লুঠ ঢাকতে ব্যাঙ্ক সংযুক্তি হচ্ছে। ২৭টি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ছিল তা কমে এখন ১২টি। ১৫টি ব্যাঙ্ক উধাও। রেলে ২৩ লাখ কর্মচারী ছিলেন এখন ১৩ লাখ। কমাবে তিন লাখ। ত্রিপুরায় ৮২০টি স্কুল বেসরকারি হাতে। কলেজও বিক্রির চেষ্টা। ২০০৪ থেকে নতুন নিযুক্ত কেউ পেনশন পান না—পশ্চিমবঙ্গ ছাড়া সারা দেশে। ত্রিপুরায় ডিসেম্বর মাসে কলেজ শিক্ষকদের বেতন সময়ে হয়নি। আসামে ৫১ হাজার চুক্তিশিক্ষক ছাঁটাই।

রিজার্ভ ব্যাঙ্ক থেকে তুলে নেওয়া হয়েছে ১.৭৬ ট্রিলিয়ন টাকা। যা সাধারণ মানুষের জমা টাকার গ্যারান্টি। থাকার কথা ১২ শতাংশ মজুত। রইল ৫.৫ শতাংশ। এ ঘটনা ভারতের ইতিহাস ঘটেনি।

জিডিপিতে পাকিস্তানের চেয়েও পিছিয়ে। পাকিস্তান ৩.৪ শতাংশ ভারত ২৩.৯ শতাংশ বাংলাদেশ ৫.২৫ শতাংশ অর্থনীতিতে কোনও দিশা নেই। শুধু বাক্য ও বাণীর ফুলঝুড়ি। কাগজে পাতা জোড়া বিজ্ঞাপন। তাই বেশিরভাগ মিডিয়ার মুখ বন্ধ। আনন্দবাজার, টেলিগ্রাফ, হিন্দু—সমালোচনা করছে—তাই সরকারি বিজ্ঞাপন বন্ধ।

দেশে চরম অর্থনৈতিক মন্দা। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ বলেছেন, এটা ম্যানমেড মন্দা। মনমোহন সিংহের আমলে বৃদ্ধি ছিল ১০.৭ শতাংশ।

বৃদ্ধিতে এশিয়ার শীর্ষে এখন বাংলাদেশ ৫.২৫ শতাংশ। ডলার ও টাকা সমান হবে বলে প্রতিশ্রুতি ছিল। হয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের টাকার সমান।

এখন ভারতীয় এক টাকা বাংলাদেশি ১.১২ টাকা।

২৮

তার মাঝে কাশ্মীর ও আসামে চরম সংকট। কাশ্মীরের ৩৭০ ধারা তুলে দেওয়া হয়েছে। দুটি ভাগে ভেঙে দেওয়া হয়েছে জম্মু ও কাশ্মীরকে। জম্মু ও কাশ্মীর এবং লাদাখ কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল। জম্মু ও কাশ্মীরে দিল্লির ধাঁচে বিধানসভা থাকবে। লাদাখে বিধানসভা নাই। এক বছরের বেশি মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধ। ৬০০০-এর বেশি ব্যক্তি গ্রেপ্তার। প্রাক্তন তিন মুখ্যমন্ত্রীকে আটক করা।

ক্ষুধা দারিদ্র্য, শান্তি সূচকে ভারতের স্থান নামছে। অশান্তি ও দুর্নীতিতে সামনের সারিতে। সাংবাদিক হত্যায় প্রথম চারে। তথ্য অধিকার আইন কার্যত তুলে দিল। মনরেগায় মজুরি বাড়েনি। অথচ সাংসদ মন্ত্রীদের বেতন হাজার হাজার টাকা বাড়ল। (করোনা কাণ্ডে ৩০ শতাংশ কমেছে।)

সব কথা সাথ সব কা বিকাশ উধাও।

আশ্বাস—প্রমাণ আসামের ১৯ লাখ রাষ্ট্রহীন মানুষ।

দাঙ্গা বেড়েছে। বেকারি বেড়েছে। ৬ লাখ ৮০ হাজার কারখানা বন্ধ ২০১৬-এর পর থেকে।

প্রতিশ্রুতি ছিল জিনিসের দাম কমবে।

পেঁয়াজ ৮০ টাকা আদা ৩৫০ টাকা কেজি। পোস্ত ৭০০ থেকে বেড়ে ১৮০০ টাকা কেজি।

হেঁসেলে আগুন। বাজারে আগুন।

মনে অশান্তি।

সুদিন কবে আসবে?

২৯

মোদির টাইম লাইন—

আগস্ট ২০১৪—জনধন যোজনা।

সেপ্টেম্বর ২০১৪—মেক ইন ইন্ডিয়া।

অক্টোবর ২০১৪—স্বচ্ছ ভারত অভিযান।

জানুয়ারি ২০১৫—পরিকল্পনা কমিশন তুলে দেওয়া হল। এল নীতি আয়োগ।

ফেব্রুয়ারি ২০১৫—সয়েল হেলথ কার্ড প্রকল্প।

মে ২০১৫—স্মার্ট সিটি ১০০টি গড়ার কথা। একটিও হয়নি।

জুলাই ২০১৫—ডিজিট্যাল ইন্ডিয়া (ভারতের রেকর্ড সৃষ্টিকারী ইন্টারনেট বন্ধ ১৫৭ বার)।

আগস্ট—২০১৫—গ্যাসে ভর্তুকি ছাড়ো।

নভেম্বর ২০১৫—বিহারে মোদির প্রথম পরাজয়।

এপ্রিল ২০১৬—স্টার্ট আপ ইন্ডিয়া চালু। ফসলবীমা যোজনা

মে ২০১৬—উজ্জ্বলা গ্যাস যোজনা। আসামে ক্ষমতায় এল বিজেপি। চালু হল এন.আর.সি।

জুলাই ২০১৬—কাশ্মীরে বুরহান ওয়ানির হত্যা। শান্ত কাশ্মীরে অশান্তি শুরু।

২০১৬—৮ নভেম্বর—দেশে নোট বন্দি চালু।

পুরোনো ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট বাতিল। বলা হল—জাল নোট থাকবে না। কাশ্মীরে পাথর ছোঁড়া বন্ধ হবে। মোদি ৫০ দিন সময় চাইলেন। উন্নতি না হলে তাঁকে জ্যান্ত জ্বালিয়ে দিতে বললেন। কার্যত, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক বলছে ১২১ শতাংশ জাল নোট বেড়েছে ৫০০ টাকার।

অজস্র হরেক রকমের হরেক রঙের নোট। আসল নকল তফাত করাই দুর্দায়। দৃষ্টিহীনেরা সমস্যায় পড়ছেন। আকার বদলানোয়। অরুণ জেটলি জানিয়েছিলেন, জাল নোট .০০০২ শতাংশ। এখন রিজার্ভ ব্যাঙ্ক বলছে ১২১ শতাংশ।

১১ মার্চ, ২০১৭—উত্তরপ্রদেশে বিধানসভা নির্বাচন। বিজেপির বিপুল জয়। ৪০৩টির মধ্যে ৩২৪টি আসনে জয়। সমাজবাদী পার্টি—৫৪, বি এস পি—১৯, অন্যান্যরা ৬।

৮ জানুয়ারি ২০১৯—নাগরিকত্ব বিল পাস করা হল লোকসভায়।

বর্ষাকালীন অধীবেশনে ৩৬টি বিল আইনে পরিণত করলেও নাগরিকত্ব বিল উত্থাপন করেইনি রাজ্যসভায়।

১৪ ফেব্রুয়ারি—প্রভিডেন্ট কাণ্ডের টাকা খাটছে এমন সংস্থা আই.এল.এফ.এস নিজেদের দেওলিয়া ঘোষণা করল।

দুপুরে হামলা পুলওয়ামায় সেনা বাহিনীর ক্যারাভানে। মৃত ৪২ জন সৈনিক। কোনও তদন্ত কমিশন আজ পর্যন্ত গঠিত হয়নি। কেউ পেনসন পর্যন্ত পাননি।

২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯—পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রশ্ন তুললেন, পুলওয়ামা বিস্ফোরণ নিয়ে। বললেন, দিল্লি জানে কারা হামলা করেছে।

২৫ ফেব্রুয়ারি রাতে (২৬ ফেব্রুয়ারি)—বালাকোটে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক।

২৩ মে ২০১৯—ভারতের লোকসভা নির্বাচনের রায় বের হল। বিজেপির বিপুল জয়। একাই ৩০২ আসন।

৩০ মে ২০১৯—প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিলেন নরেন্দ্র মোদি।

২১ জুন ২০১৯—নতুন করে মুসলিম মহিলা বিল পেশ হল সংসদে।

২৫ জুলাইে ২০১৯—রাজ্যসভায় পেশ হল মুসলিম মহিলা বিল।

৩০ জুলাই ২০১৯—রাজ্যসভায় পাশ ল দ্য মুসলিম উওমেন (প্রোকেটশন অফ রাইটস অন ম্যারেজ) বিল ২০১৯।

৫ আগস্ট ২০১৯—অমিত শাহ, ভারতের নতুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, রাজ্যসভায় কাশ্মীরের ৩৭০ ধারা বাতিলের প্রস্তাব পেশ করে জানালেন, রাষ্ট্রপতি এতে সম্মতি দিয়েছেন।

২৭ আগস্ট ২০১৯—রিজার্ভ ব্যাঙ্ক থেকে এক লাখ ৭৬ হাজার কোটি টাকা তুলে নিল।

৩০ আগস্ট ২০১৯—ব্যাঙ্ক সংযুক্তি। ২৭টি ব্যাঙ্ক কমে হল ১২টি।

৩১ আগস্ট ২০১৯—কেন্দ্রীয় ১২টি বিশ্ববিদ্যালয়ের বেতন দিল না কেন্দ্র সরকার। নিজেদের তহবিল থেকে বেতন।

২২ সেপ্টেম্বর ২০১৯—আমেরিকার হাউস্টনে ‘হাউডি মোদি’ অনুষ্ঠানে একসঙ্গে ভাষণ মোদি ও ট্রাম্পের। ট্রাম্পের হয়ে নজিরবিহীনভাবে ভোট চাইলেন। বললেন, ভোট ফর ট্রাম্প। (ফল, ট্রাম্প পরাজিত)।

২৪ অক্টোবর ২০১৯—পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের মৌ চুক্তি স্বাক্ষর হল। কর্তারপুরে করিডরে ভিসামুক্ত প্রবেশাধিকার দিল পাক সরকার। ভারতীয়দের। শিখরা যাতে ভিসা ছাড়াই গুরুদ্বার দরবার সাহিব শিখ যেতে পারেন, তার অনুমতি দিল পাকিস্তান সরকার।

৩১ অক্টোবর ২০১৯—জম্মু কাশ্মীর লাদাখ আইন কার্যকর হল। লাদাখে ছাত্র মিছিল বের হল—ইনার লাইন পারমিট চালুর দাবিতে।

৯ নভেম্বর ২০১৯—রাজজন্মভূমি ন্যাসকে বাবরি মসজিদের জায়গায় মন্দির গড়ার অনুমতি দিল রঞ্জন গগৈয়ের নেতৃত্বে সুপ্রিম কোর্ট।

২৭ নভেম্বর ২০১৯—হায়দরাবাদে গণধর্ষণ।

৩ ডিসেম্বর ২০১৯—উন্নাও-য়ে গণধর্ষিতা বিচার না পেয়ে গায়ে আগুন দিলেন।

১১ ডিসেম্বর ২০১৯—রাজ্যসভার পাশ হল ক্যা বা নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন।

১২ ডিসেম্বর ২০১৯—জামিয়া মিলিয়া, কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে দিল্লি পুলিশ ও আর এস এস ক্যাডারদের পুলিশের পোশাক পরে হামলা।

১৫ ডিসেম্বর ২০১৯—জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীরা নামলেন রাস্তায়। জেগে উঠল তরুণ ভারত।

১৬ ডিসেম্বর ২০১৯—দিল্লিতে শাহিনবাগে শুরু মহিলাদের অবস্থান। ২৫ মার্চ ২০২০ সকালে তুলে দেওয়া হয়।

২২ ডিসেম্বর ২০১৯—দিল্লিতে জনসভায় মোদি বললেন, ২০১৪ থেকে সরকারে এন আর সি নিয়ে কোনও আলোচনাই হয়নি।

২৩ ডিসেম্বর ২০১৯—জার্মান ছাত্র লিন্ডেনথাল ক্যা বিরোধী আন্দোলনে যোগ দিয়ে বহিষ্কৃত।

২৪ ডিসেম্বর ২০১৯—অমিত শাহ—এন আর সি নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। ২০ মার্চ সুপ্রিম কোর্টে হলফনামা পেশ হল।

২ জানুয়ারি ২০২০—আসামের বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সোনোয়াল বললেন, ক্যা আইন অসমিয়া হিসেবে মানা কঠিন।

৩ জানুয়ারি ২০২০—রাজস্থানের যোধপুরে অমিত শাহ—সবাই এক হলেও পিছু হঠব না। ক্যা আইন মানতে হবেই সবাইকে।

৩ জানুয়ারি ২০২০—গুজরাতের আহমেদাবাদে গুজরাত বিধানসভার অধ্যক্ষ রাজেন্দ্র ত্রিবেদী বললেন, ব্রাহ্মণরা জন্মেছেই অন্যদের আশীর্বাদ করার জন্য। আমরা ব্রাহ্মণ এবং আমাদের ডি এন এ-তে আছে ব্রাহ্মণ রক্ত।

তিনি বলেন, ভারতে আটজন নোবেল পেয়েছেন, তার মধ্যে সাতজন ব্রাহ্মণ। অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ও ব্রাহ্মণ।

২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০—মার্কিন রাষ্ট্রপতির ভারত ভ্রমণে।

২৪—২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২০—দিল্লি গণহত্যা। নিহত ৫৩ জন।

১৪ মার্চ ২০২০—ভারতে করোনায় মহামারী আইন জারি।

২০ মার্চ ২০২০—মোদির প্রথম করোনা ভাষণ।

২২ মার্চ ২০২০—লক ডাউন। থালা বাসন বাজানো।

২৪ মার্চ ২০২০—সারা দেশে লকডাউন।

২৪ মার্চ ২০২০—মোদির দ্বিতীয় করোনা ভাষণ। রাত ৮টায়। রাত ১২টা থেকে সারা দেশে লকডাউন। ২১ দিনের জন্য। ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত। কারখানা অফিস ট্রেন সব বন্ধ। দেশে করোনা রোগীর সংখ্যা ৫৫০।

২৫ মার্চ ২০২০—বিমান বন্ধ। নির্মলা সীতারামণের ভাষণ ও প্যাকেজ ঘোষণা।

২৫ মার্চ ২০২০—সকালে মোদির বারাণসীর উদ্দেশে ভাষণ। অযোধ্যায় রামনবমী পালন। মুখ্যমন্ত্রি যোগী আদিত্যনাথের রামন্দিরে রামলালা প্রতিষ্ঠা।

২৯ মার্চ ২০২০—দুপুরে দিল্লির রাস্তায় লাখ লাখ শ্রমিক। বাড়ি ফিরতে।

২৯ মার্চ ২০২০—বিকেলে স্বরাষ্ট্র দপ্তরের ঘোষণা। এবার থেকে করোনা রোগীর হিসেব দেবে ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ মেডিক্যাল রিসার্চ নয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক।

৩০ মার্চ ২০২০—নিজামউদ্দিন মারকাজে করোনা আক্রান্ত হয়েছে বলে জানাল কেন্দ্রীয় সরকার।

২ এপ্রিল ২০২০—নিজামউদ্দিনের রোগীরা থুতু দিয়েছে বলে প্রচার শুরু হল।

৫ এপ্রিল ২০২০—সারা দেশে মোমবাতি জ্বালানো হল, দীপ। এবং বাজি পুড়ল।

৯ এপ্রিল ২০২০—জানা গেল থুতু দেওয়ার কথা মিথ্যা।

৯ এপ্রিল ২০২০—৯টায় দ্বিতীয়বার লকডাউন ঘোষণা। ১৫ এপ্রিল থেকে ৩ মে পর্যন্ত।

৪—১৭ মে ২০২০—তৃতীয় লকডাউন।

১২ মে ২০২০—মোদির অর্থনৈতিক সুবিধার ঘোষণা।

১৭—৩১ মে ২০২০—চতুর্থ লকডাউন।

২০ মে ২০২০—পশ্চিমবঙ্গে আমফান।

২৩ মে ২০২০—মমতা ও মোদির একত্র সফর।

২৯ মে ২০২০—গালওয়ানে চীনা সোনা উপস্থিতির কথা জানাজানি হল।

১ জুন ২০২০—পঞ্চম লকডাউন। আনলক—১।

৯ জুন ২০২০—অমিত শাহের ৭২ হাজার এল ই ডি নিয়ে বিহার ভাষণ।

১০ জুন ২০২০—অমিত শাহের পশ্চিমবঙ্গ ভাষণ।

১৫ জুন ২০২০—গালওয়ান উপত্যকায় ১৫ জন ভারতীয় সৈন্যের মৃত্যু।

১ জুলাই ২০২০—মোদির মন কি বাত। খনি নিলাম।

১ জুলাই ২০২০—আনলক—২। দেশে ১৫১টি ট্রেন বিক্রির সিদ্ধান্ত।

২ জুলাই ২০২০—রেলে কর্মী সংকোচন। খনি ধর্মঘট শুরু তিনদিনের জন্য।

৭ নভেম্বর ২০২০—আমেরিকার নির্বাচনের ফল প্রকাশ। ট্রাম্প পরাজিত।

১০ নভেম্বর ২০২০—বিহার নির্বাচনের ফল।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন