ইমানুল হক
১
মানুষ এক বিস্ময়কর প্রাণীর নাম। লিখেছিলেন গ্রিক নাট্যকার সোফোক্লেস (খ্রি.পূ ৪৯৭/৪৯৬—খ্রি.পূ ৪০৬/৪০৫)। মমতা—মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কে কথাটি সর্বার্থে প্রযোজ্য। মমতা এমন একজন মানুষ, যাকে আপনি গাল দিতে পারেন, রাগ করতে পারেন, ভালোবাসতে পারেন, শ্রদ্ধা করতে পারেন, কিন্তু তাঁকে উপেক্ষা? অসম্ভব? তাঁর সম্পর্কে মাঝামাঝি অবস্থান নেওয়া কিছুটা কঠিন। একপক্ষের কাছে তিনি ‘দেবী’, দুর্গার পাশাপাশি তাঁর মূর্তি পূজা হয়, কবীর সুমনের মতো আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন গায়ক বলেন, একদিন ঘরে ঘরে তাঁর মূর্তি পূজা হবে। বহু বাড়িতে একদা মমতার সভা টিভিতে দেখাবে শুনলে ধূপ ধুনো জ্বালিয়ে দিত। বিশেষত, শ্রমজীবী মহিলাদের কাছে তিনি ছিলেন সাক্ষাৎ ‘ভগবতী’, ট্রেনের মাসিক টিকিট ১৫ টাকা করে দেওয়ায়। আর এস এস একসময় বলেছিল, ‘মা দুর্গা’, আবার মুসলিমদের এক অংশ তাঁকে ‘বিপত্তারিণী’ মনে করেন, ঢেলে ভোট দেন ২০১১-র নির্বাচনে, আরেক দল অকাতরে তাঁর জন্য প্রাণ বিসর্জন দেন, গুলি খান, খান পুলিশের লাঠি।
আর বিপক্ষ? কেউ তাঁকে মনে করেন ‘স্বৈরতন্ত্রী’ (সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়), কেউ বলেন ফ্যাসিস্ট, গুন্ডাদলের সর্দার, সর্বনাশী। আবার তাঁর চরম সমালোচক বুদ্ধদেবের প্রশংসাকারী পত্রিকায় নয়ের দশকে লেখা হয়, মমতা বামপন্থী—প্রকৃত বামপন্থী। নকশালপন্থী ও বিক্ষুদ্ধ সিপিএম-রা সাধারণভাবে তাঁকে ভোট দেন ২০১১-য়। তাঁর সঙ্গে সিঙ্গুর নন্দীগ্রামের আন্দোলনে থাকেন। তাঁর নির্বাচনী জয়ের জন্য ‘লিফলেট’ বিলি করেন।
২০১১-র পর এদের একাংশই তাঁর উদ্দেশে বলবেন, নাটকে লেখাও হয়, একটাই পোস্ট বাকি সব ল্যাম্পপোস্ট। বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রও এক কথা বলেন।
২
মমতা কার্যত ‘একমেবাদ্বিতীয়ম’।
প্রচারমাধ্যমের ভাষায়, সুপ্রিমো। তিনি নিজেও তা জানেন, ২০১৬-র নির্বাচনের আগে বলেন ২৯৪টা কেন্দ্রে আমিই প্রার্থী। ২০১৯-এ একাই হয়ে ওঠেন দলের মুখ। বিজেপির তীব্র আক্রমণের মুখে নেতৃত্ব দেন দলকে। ২২ আসন পাওয়ার পরও থেমে যান না। ভয় পান না। সাহস দেখান। তার ফলও পান ২০১৯-এ লোকসভায় কালিয়াগঞ্জে ৫৪ হাজার ভোটে হারা আসন ছিনিয়ে নেন উপনির্বাচনে। বিজেপি সভাপতির কেন্দ্র খড়গপুর পর্যন্ত জিতে নেন। এন আর সি বিরোধী আন্দোলনের প্রধান মুখ হয়ে ওঠেন সারা দেশে। আসামে পাঠিয়ে দেন দলের মন্ত্রীকে। উত্তরপ্রদেশে আর এস এস কর্মীদের পুলিশ হয়ে অত্যাচারের প্রতিবাদে প্রথম যায় তাঁর দল ২২ ডিসেম্বর ২০১৯। যদিও সিপিএম তাঁকে বলেই চলেছে—বিজেপির বি টিম। ক্যা নিয়ে বিল পাসের পর মাঠে নামতে দেরি হয় মমতার। সে জায়গা জুড়ে নেয় স্বতস্ফূর্ত জনতা। আসাদউদ্দিন ওয়াইসির মিম এবং বিজেপির ক্যাডার ঢুকে পরে আন্দোলনে। ভাঙ্গচুর হয় ট্রেনে। পরে ট্রেনে পাথর ছোঁড়ার অভিযোগে গ্রেপ্তার হয় অভিষেক সরকারসহ ৬ বিজেপি কর্মী।
১৬ ডিসেম্বর মাঠে নামেন মমতা। তারপর পরপর চারদিন মিটিং মিছিল কলকাতায়। যা নজিরবিহীন। সারা ভারতে। একজন মুখ্যমন্ত্রী টানা চার দিন মিছিল করছেন নিজের রাজধানী শহরে। বিজেপি ২৩ ডিসেম্বর ২০১৯ একটি বড় মিছিল করে। পরদিন বিবেকানন্দের বাড়ি থেকে বিশাল মিছিল করে ফেললেন মমতা। যা একদা ছিল কমিউনিস্টদের অভ্যাস। অবশ্য সোস্যাল মিডিয়ায় সিপিএম সমর্থকদের টিপ্পনি চলছে ‘গট আপ’ বলে।
যে যাই বলুন তাঁকে উপেক্ষা করার ক্ষমতা নেই। তাঁকে ঠেকাতে অশোক মিত্র মৃত্যুর আগে অশক্ত শরীরে ভোট দিতে যান, ‘আনন্দবাজারে’ কলম লেখেন, আবার অশোক মিত্রের মৃত্যুর পর তাঁর বাড়িতে প্রথম ফুলের স্তবক পৌঁছয় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পক্ষ থেকে, প্রথম লিখিত শোক বার্তাও। মমতার বিশ্বস্ত লেফটেন্যান্ট নগরোন্নয়ন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম পৌঁছে যান, মমতার কাছের মানুষ শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় শুধু বাড়ি নয়, শ্মশানেও যান, তদারকি করেন শেষকৃত্যের। শঙ্খ ঘোষ ২০১১-র নির্বাচনের আগে মমতাকে সমর্থন করেন, আর ২০১২-তে তাঁর রাজ্য শাসন নিয়ে লেখেন ‘প্রতি প্রশ্নে কেঁপে ওঠে ভিটে’। কিন্তু কবি শঙ্খ ঘোষের জন্মদিনে ফুল পাঠাতে ভোলেন না মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে হারিয়ে বিপুল ভোটে জিতে ক্ষমতায় আসেন, বুদ্ধদেব তাঁর নাম পর্যন্ত করতেন না, বলতেন, ‘ওই এক মহিলা, যাঁর নামোচ্চারণ করতে ইচ্ছা হয় না’ সেই বুদ্ধদেব কেমন আছেন জানতে তাঁর বাড়ি চলে যান মমতা, তাঁর ফ্ল্যাট যাতে সুন্দর থাকে তার নির্দেশ দেন। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় মমতাকে ‘আনন্দবাজার’-এ ‘স্বৈরতন্ত্রী’ বলে লিখলেও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের শেষযাত্রায় নিজে দীর্ঘ পথ হাঁটেন। কেওড়াতলা শ্মশানে সুনীলভক্তদের উন্মাদনা ও বিশৃংখলা ঠেকাতে হাতে হাত দিয়ে চেন তৈরি মানবশৃংখল রচনা করেন; নিজে গান ধরেন ‘আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে’। সেখানে এক যুবক তাঁকে ঠেলা দিলেও তিনি কিছু বলেন না, আবার রাস্তায় কোন গাড়ি চালক তাঁর গাড়িতে ধাক্কা মারলে খুনের চেষ্টার অভিযোগে তাঁর জেল হয়। ছাড়াও পান তাঁরই বদান্যতায়।
৩
মমতা আপাতত জীবদ্দশায় ইতিহাস। ‘পটুয়াপাড়ার কন্যা’ বলা সাংবাদিক তাঁকে পরে ‘অগ্নিকন্যা’ বলতে বাধ্য হয়েছেন, ‘ব্রান্ড বুদ্ধে’র প্রশংসায় পঞ্চমুখ সংবাদপত্র তাঁর মধ্যে আবিষ্কার করে ‘মমতা ম্যাজিক’, পরে ২০১৬-তে বিধানসভা তাঁকে হারাতে মরণপণ বাজি ধরে বসে। ধর্মতলায় একসঙ্গে ২৬ দিন ধরে অনশনকারিনীই হয়ে যান তাঁর নির্বাচনী প্রতিযোগিনী। আবার তাঁর অতি বড় কট্টর সমালোচককেও স্বীকার করতে হয়, তাঁর আমলে প্রচুর কাজ হয়েছে, হচ্ছে। যদিও এতে তাঁর বিরোধীরা দুর্নীতির গন্ধ খোঁজেন। দুর্নীতি হচ্ছেও। মমতা নিজেও সেটা জানেন। প্রকাশ্যে বহুবার সতর্ক করেছেন। কিন্তু খুব লাভ হচ্ছে না। হচ্ছে না জেনে, চালু করেছেন—দিদিকে বলো। এতে কাজ খানিকটা হয়েছে। প্রশান্তকিশোরের পরামর্শ শুনছেন। আজকাল সব বিষয়ে মুখ খোলেন না। বকরিদে যাননি রেড রোডে।
আবার এটাও সত্যি, মুখে বা খবরের কাগজে বা বক্তৃতায় দুর্নীতির কথা বললেও পাঁচ বছর আগে যাঁর ‘কোমরে দড়ি বেঁধে ঘোরাব’ বলেছিলেন, পরে সরাসরি বলেছেন ‘ফ্যাসিস্ট’ তিনি এবং তাঁর প্রেরিত কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলি রাতদিন চেষ্টা করেও তাঁর ব্যক্তিগত দুর্নীতি প্রমাণ করতে পারেনি। তাঁর দলের একাধিক সাংসদ, নেতাকে গ্রেপ্তার করেও তেমন লাভ হয়নি। তাঁদের মুখ দিয়ে মমতার নাম উচ্চারণ করানো যায়নি। যদিও তাঁরা বেরিয়ে গিয়ে দুর্নীতি ও চাপের রাজনীতির কথা বলেছেন। কিন্তু প্রমাণ করতে পারেননি। তাঁর হয়ে লেখার জন্য এক সাংবাদিক জেলে। তবু টলানো যায়নি তাঁকে।
একদা অতি ঘনিষ্ঠ মুকুল রায়রা দল ছেড়েছেন। বা মমতা ছাড়তে বাধ্য করেছেন। শোভন চলে গিয়েও আবার ভাইফোঁটায় ফোঁটা নিতে যান। একে একে উদ্ধার করেন দক্ষিণ দিনাজপুর জেলা পরিষদ। ব্যারাকপুরে অর্জুন সিংয়ের জয়ের পর ব্যারাকপুর থেকে কাঁচরাপাড়া—প্রায় সব পুরসভা চলে যাচ্ছিল বা গিয়েছিল। তা ফিরিয়েছেন।
৪
মমতা একাই সামলাতে চাইছেন দলকে। তিনি উপায়হীন। মমতা ছাড়া দলে সুদক্ষ সংগঠন গড়ার লোক কম।
পার্থ চট্টোপাধ্যায়, শিশির অধিকারী, ফিরহাদ হাকিম, শুভেন্দু অধিকারী, শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়, মলয় ঘটক, অখিল গিরি, তপন দাশগুপ্ত—এই কিছু নাম।
তাঁর দলের বেশিরভাগ নেতা কলকাতা বিশেষত দক্ষিণ কলকাতা কেন্দ্রিক।
পূজা বা ক্লাব সংগঠন করা মানুষ।
এরা কাউন্সিলর/ মন্ত্রী হিসেবে জনপ্রিয়। কিন্তু রাজ্যের জননেতা এখনও হতে পারেননি সেভাবে।
মমতার নাম বাদ দিয়ে কার-ও পক্ষে একা বিধানসভা জেতা কঠিন।
সুব্রত মুখোপাধ্যায়, শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়ের শ্রমিক সংগঠন আছে।
তাতে তাঁদের অবদান আছে।
কিন্তু মমতার বিকল্প এখনও মমতাই। তাঁর সমর্থকরা মনে করেন, অন্যরা যাই করুন দিদি সৎ। এক মমতা ভবানীপুর চলে যান সমর্থক ছাড়াতে থানা থেকে, আরেক মমতা নিজের দলের সবুজ নেতা আরাবুলকে গ্রেপ্তারের আদেশ দেন। আবার যে আরাবুল রেজ্জাক মোল্লাকে মারেন, সিপিএম বলে, সেই রেজ্জাককে দলে টেনে জায়গা দেন আরাবুলের বিধানসভা কেন্দ্রেই। মন্ত্রীও করেন রেজ্জাক মোল্লাকে।
৫
মমতাকে সিবিআই, ইডি ইত্যাদি কেন্দ্রীয় সংস্থা দিয়ে জব্দ করতে চেয়েছিলেন মোদি অমিত শাহ। পারেননি।
উলটে ভারতবর্ষের সংসদীয় ইতিহাসে নতুন চিহ্ন রেখেছেন মমতা। এতকাল কেন্দ্রীয় সংস্থা সি বি আই যাকে খুশি যখন খুশি যে কোন অজুহাতে আটক করতে পারতো—কলকাতায় পুলিশ কমিশনারের বাড়িতে গিয়ে তাঁকে আটক করতে গিয়ে আটক হয়ে যান সি বি আই অফিসাররা। প্রকাশ্যে আসে সি বি আইয়ের তারিখ জাল করে নোটিশ পাঠানোর কথা। সি বি আইয়ের বিশ্বাসযোগ্যতায় বড় রকম প্রশ্ন তুলে দিতে সক্ষম হন তিনি।
সি বি আই ব্যবহার করে বিরোধী নেতা নেত্রীদের চমকানো ভড়কানোর যে রাজনীতি চলছিল তাতে খানিকটা ভাটা পড়ে। একে একে মুখ খোলেন তেজস্বী যাদব, অখিলেশ যাদব, মায়াবতী, অরবিন্দ কেজরিওয়াল, রাহুল গান্ধী।
অতীতে সিপি আই এমের নেতৃত্বে দেশে বিরোধী ‘কনক্লেভ’ হত—তাতেও ভাগ বসিয়েছেন তিনি। ২১টি দলকে নিয়ে কলকাতায় মহাসমাবেশ করেছেন। মোদিকে রাতদিন ‘ফ্যাসিস্ট’ বলে গাল দেন, আবার রাহুল গান্ধীকে বলেন, ‘বাচ্চা ছেলে’।
৬
মমতা ইমাম ভাতা দিয়েছেন। সরকার থেকে। ভুল সিদ্ধান্ত। পরে পরিবর্তন করেছেন। ওয়াকফ বোর্ড দিচ্ছে ভাতা। ওয়াকফ বোর্ড ইমাম ভাতা দিচ্ছে মামলা হওয়ার পর। শুধু ইমাম ভাতা নয়, রাজ্যের ৩২,০০০ দুর্গাপূজা কমিটিকে ১০,০০০ টাকা করে দিচ্ছেন মমতা। ২০২০-তে ৩৭ হাজার পূজা কমিটিকে দিয়েছেন ৫০ হাজার টাকা করে। দুর্গাপূজার কার্নিভ্যালের ব্যবস্থা করেছেন। এছাড়াও যা করেছেন—
* গঙ্গাসাগরে পুণ্যার্থীদের কর সম্পূর্ণ মকুব।
* কপিল মুনির আশ্রমের বিপুল সংস্কার।
* গঙ্গার ধার দিয়ে হিন্দু মন্দির দর্শনের জন্য ফেরি পরিষেবা চালু।
* দুর্গা পূজার ব্র্যান্ডিং করেছেন, চালু করেছেন কার্নিভ্যাল।
* দক্ষিণেশ্বর থেকে বেলুড় মঠ জাহাজ পরিষেবা চালু।
* দার্জিলিংয়ে ভগিনী নিবেদিতার আশ্রমের সংস্কার ও হেরিটেজ ঘোষণা।
* দরিদ্র হিন্দু পরিবারের কেউ মারা গেলে সৎকারের জন্য আর্থিক সাহায্য করেন।
* দুর্গা প্রতিমার তৃতীয় চোখ আঁকেন।
* দরিদ্র বাউল, কীর্তন শিল্পীদের ভাতা দেন।
* কালীপুজোর দিন নিজের বাড়িতে নির্জলা উপবাস করেন।
* দুর্গাপূজার থিম সং লেখেন।
৭
মমতা সম্পর্কে আমার এক সাংবাদিক বন্ধু বলেছিলেন, সিপিএমের মেধাবী ছাত্রী। কথাটা সত্য। ইতিবাচক ও নেতিবাচক দু’অর্থেই। ২০০৯-এর লোকসভা নির্বাচনের আগে সিপিএম দুটি ভুল করে। এক, মোহর কুঞ্জে টিভি সিরিয়ালের অভিনেতা-অভিনেত্রী তথা অরিন্দম শীল, রুদ্রনীল ঘোষ, ঊষসী চক্রবর্তীর পরিচালনায় নির্বাচনী প্রচার। দুই, মৌলালি যুবকেন্দ্রে ফুরফুরার এক ইমামের নেতৃত্বে মুসলিম ইমামদের সভা। এর আগে পার্ক সার্কাসে হজ হাউসে ইমাম মুয়াজ্জিনদের নিয়ে সভা। সেখানে ১০০০ টাকা করে ইমাম ভাতার দাবি ওঠে। মূলত রেজ্জাক মোল্লার আপত্তিতে সিপিএম সেদিন ইমাম ভাতা দিতে পারেনি। কথা উঠেছিল যদিও। আবার অশোক মিত্র অর্থমন্ত্রী থাকাকালীন যে সব প্রকল্প নিয়েছেন, মমতা তাকে অন্য পরিণতি দিয়েছেন। বেশিরভাগ গ্রামে এখন পিচ, মোরাম বা কংক্রিট রাস্তা। খুব কম ঘর পাওয়া যাবে যেখানে কন্যাশ্রী, সবুজশ্রী, রূপশ্রী ইত্যাদির মারফৎ অর্থ পাওয়া যায় নি। নানাধরনের বৃত্তি বা সাইকেল পায়নি এমন ছাত্রছাত্রী কম। মধ্যবিত্ত সরকারি চাকুরে অসন্তুষ্ট হলেও গরিবরা সাধারণভাবে খুশি। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সত্তর দশকে যুব নেতা হিসেবে টাটা বিড়লার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার কথা বলে ২০০৬-এ সিঙ্গুরে টাটার ন্যানো প্রকল্প আর কুখ্যাত শোষক, ইন্দোনেশিয়ার কমিউনিস্ট নিধনকারী সুহার্তোর দোসর সালিমের জন্য নন্দীগ্রামে শিল্প গড়তে গিয়ে রাজপাট এবং দলকে প্রায় পথে বসালেন। মেট্রো ক্যাশ অ্যান্ড ক্যারি এবং রিলায়েন্সকে ব্যবসা করতে দিলেন। অজস্র শপিং মল গড়তে জায়গা দিলেন। এক টাকায় জায়গা দিলেন বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়তে আজিম প্রেমজি বা অন্যদের। আর দক্ষিণপন্থী ঘরানার মমতা আধারের বিরোধিতা করলেন, শপিং মলের বিরুদ্ধে বললেন। টাটারা রাজ্য ছাড়লেন, গুজরাট গেলেন অধিকতর সুবিধার জন্য, সে প্রকল্প মুখ থুবড়ে পড়েছে। খুচরো ব্যবসায় বিদেশি বিনিয়োগের বিরুদ্ধে মুখ খুললেন। বিদেশি বিনিয়োগের বিরুদ্ধে দাঁড়ালেন। আবার বুদ্ধবাবুর মতোই শাসক হিসেবে বন্ধ অবরোধের বিরোধিতা করলেন।
আর মুখম্যন্ত্রী হিসেবে পরপর ১০ দিন কেন্দ্রের ক্যা আইন তথা হিন্দু মুসলিম নাগরিক বিভাজনের বিরুদ্ধে রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় পদযাত্রা বিরল শুধু নয়। অতি বিরল। একজনও নেই দেশে যিনি এটা পারেন।
৮
২০০৭ থেকে রাজ্যে রাজনৈতিক খুন প্রচুর বেড়ে যায়। শাসক দল সিপিএমের কর্মীরাই বেশি খুন হয়। অভিযোগ ওঠে—মমতা মাওবাদী যোগের। কিষেণজির নাম ওঠে। কিষেণজি বলেন, মমতাকে মুখ্যমন্ত্রী পদে চাই। পরে সেই কিষেণজিই খুন হয়ে যান পুলিশের হাতে। জঙ্গলমহলে ভোট বাড়ে মমতার। লালগড় হয়ে ওঠে সবুজ গড়। ২০১৯ সেই লালগড় গেরুয়াগড়ে রূপান্তরিত হয় স্থানীয় তৃণমূল নেতাদের দুর্নীতিতে, ঔদ্ধত্যে।
ঘটনা এই, মমতার আমলে রাজনৈতিক খুন কমেছে। কিন্তু ভয় দেখানো কমেনি। সিপিএম ক্ষমতা দিত মধ্যবিত্তের হাতে। মমতার আমলে গ্রামে, বস্তিতে প্রলেতারিয়েতের হাতে ক্ষমতা। কিন্তু তারা অনেকেই লুম্পেন প্রলেতারিয়েত।
৯
পঞ্চায়েত নির্বাচন হয় ২০১৮-য়। সেই নির্বাচন বহু জায়গায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় করাতে যায় তৃণমূল। ‘উন্নয়ন’ দাঁড়িয়ে যায় রাস্তায়। এক তৃতীয়াংশ আসন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। মানুষের মধ্যে অসন্তোষ বাড়ে। তার প্রতিফলন ঘটে লোকসভা নির্বাচনে। পশ্চিমবঙ্গে বাড়তি ১৬টি আসন পায় বিজেপি।
মাঝে মনে হতে থাকে বিজেপির ক্ষমতায় আসা সময়ের অপেক্ষা।
কিন্তু মমতা যে মমতাই—তা প্রমাণ করে ছেড়েছেন। বিধানসভার তিনটি উপনির্বাচন জিতেছেন। মেডিকেল কলেজের ছাত্র বিক্ষোভে প্রথমে অসহিষ্ণুহয়ে পড়লেও নবান্নে ডেকে চমৎকার সামলেছেন।
ইদানীং রাজ্যপালকে নিয়ে রাজ্যে নতুন আলোচনা। মমতার ভাষায় সমান্তরাল প্রশাসন চালাতে চাইছেন বিজেপির ক্যাডার। রাজ্যপাল নিয়ে এ রাজ্যে বিরোধ নতুন নয়। যুক্তফ্রন্টের আমলের ধরমবীর থেকে শুরু বিরোধ তারপর বামফ্রন্টের আমলে এ পি শর্মার সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগ নিয়ে দ্বন্দ্ব, ২০০০ খ্রিস্টাব্দে বীরেন শাহ বলেছিলেন, আমাকে হেয় করা হচ্ছে, গোপালকৃষ্ণ গান্ধী তো শাসক সিপিএমের ভাষায় হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন, তৃণমূল। আর একই কথা শোনা যাচ্ছে মমতার আমলেও রাজ্যপালের গলায়।
১০
মমতা মানেই অন্তহীন প্রশ্ন। এবং নানা বিপরীত প্রবণতা। একদিকে মদের বিক্রি বাড়ছে, বাড়ছে রাজস্ব, এক তারিখে বেতন পাচ্ছেন শিক্ষকরা, সময়ে পেনশন মিলছে, যদিও সরকারি কর্মীদের ডিএ দেওয়া নিয়ে হাজার প্রশ্ন, নিজে অধ্যাপক, শিক্ষক, কর্মচারী সবাইকে নিয়ে সভা করছেন নেতাজি ইন্ডোরে ডেকে। যা নজিরবিহীন। জেলায় জেলায় গিয়ে সভা করছেন। কাজের তদারকি করছেন। অফিসারদের নাম ধরে ডাকছেন। নেতাদের ধমকাচ্ছেন। প্রতিটি ব্লকের অন্তত কম করে ১০ জনকে নামে চেনেন। বিমান বসু ছাড়া রাজ্যে আর কারওর-ই এ যোগ্যতা নেই। অল্প আছে রবীন দেবের। মুকুল রায়ের। সেও মমতার সৌজন্যে।
মেয়েদের শিক্ষার জন্য ‘কন্যাশ্রী’ প্রকল্প চালু করেছেন। ফলে স্কুল কলেজে ২১ বছরের আগে বিয়ে না করার প্রবণতা বেড়েছে। স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলি সময়ে টাকা পাচ্ছে। গ্রামে শহরে রাস্তাঘাট উন্নত হয়েছে। পয়ঃপ্রণালী উন্নত। শৌচাগার বেড়েছে। স্থানীয় নেতাদের ৩০ শতাংশ কমিশনের অভিযোগ উঠলেও প্রচুর পাকা বাড়ি হয়েছে গরিব মানুষের। ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছেছে। গ্রামে বস্তিতে। দারিদ্র্য কমেছে। মিড ডে মিলের বসার ঘর দেখলে অনেক জায়গায় চমকে যেতে হয়। ভালো রেস্তোরাঁর মতো। সরকারি হাসপাতালে উন্নতি চোখে পড়ার মতো, বিনে পয়সায় ওষুধ সস্তার ওষুধের দোকান জেনেরিক নাম ওষুধের ১৭ শতাংশ দাম কম—ধন্যবাদযোগ্য। তবে সমস্যা প্রাচীন। দুর্নীতি। ‘দিদিকে বলো’-র ফলে কিছুটা কমেছে। আরো কমাতে পারলে বাংলা এক অন্য বাংলা হবে।
কাটমানি ফেরাওয়ের কথা বলা এক ঐতিহাসিক কাজ।
টাকা অনেক দলের নেতাই নেন। কিন্তু টাকা ফেরাতে বলছেন—সেই দলের সর্বোচ্চ নেত্রী—এটা বিশ্বে অভাবনীয়।
তৃণমূলকে কমাতে হবে কর্মীদের ঔদ্ধত্য। তোলাবাজি। এরা অনেকেই প্রকাশ্যে তৃণমূল। গোপনে বিজেপি। বিশেষ করে কলেজে অপ-ছাত্র নেতাদের মধ্যে এই প্রবণতা বেশি। অ-ছাত্রকে নেতা রাখা যাবে না। আর অধ্যাপকরা উঁচুপদে যেতে যত তদ্বিরে ব্যস্ত দলের কথা প্রচারে তত নয়। দলের নেতারা সভা সমিতিতে কথা বলেন, আগে খুব বাড়ি বাড়ি যেতেন, এখন সেটা কম।
মনে রাখা জরুরি মমতার প্রতিদ্বন্দ্বীরা অত্যন্ত প্রবল। মিথ্যা কথার মাস্টার। মমতা মমতাজ হয়ে গেছেন—এই তাঁদের অহরহ বাণী।
হিন্দু মুসলিম খ্রিস্টান পারসিক বৌদ্ধ আদিবাসী বিভেদ—তাঁদের প্রধান লক্ষ্য।
এদের সঙ্গে বুঝে বা না বুঝে জুটেছেন কিছু সিপিএম ক্যাডার—যাঁদের কাছে মমতা ও বিজেপি সমান শত্রু। কার্যত, তাঁদের কাছে মমতা প্রধান শত্রু। বিজেপি সম্পর্কে মুখে বললেও মনে মনে নরম।
২০০৬ থেকে ২০১১ পর্যন্ত মমতার উত্থানে নকশালরা যে কাজ করেছিলেন, সেই ভূমিকা পালন করে চলেছে সিপিএমের একাংশ। মমতা আর বিজেপি সমান শত্রু বলেন বেশ কিছু সিপিএম ক্যাডার, কিন্তু কার্যত মমতার নিন্দা তাঁদের খাবারের নিত্য মেনু। মমতার দলের দুর্নীতি, সারদা-নারদ রাতদিন প্রচারে, কিন্তু বিজেপি যে চরম দুর্নীতিগ্রস্ত, এক লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকার কেন্দ্রীয় সরকারি দুর্নীতি নিয়ে প্রায় নীরব। এর ফলে বাম ভোট বিজেপিতে যাচ্ছে। বামদের সর্বনাশ হচ্ছে। মিছিলে সভায় যাচ্ছে। কিন্তু ভোট দিচ্ছে না।
ফেসবুকে লিখে যাচ্ছে গর্বিত ৭ শতাংশ।
সাত শতাংশ ভোট পাওয়া যে লজ্জার এই বোধটাই ভুলে যাচ্ছে—ভুলিয়ে দিচ্ছে।
১১
মমতা ঐতিহাসিকভাবে একটা কাজ করছেন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্ব বিরোধ ও অন্তসারশূন্যতাকে ঐতিহাসিকভাবে তুলে ধরছেন। পয়সা দিয়ে বিচার কেনা যায়, রাষ্ট্র গোয়েন্দা সংস্থাকে দিয়ে মিথ্যা হামলা করায়, পুলওয়ামা সাজানো ঘটনা—এ-রকম সাহসী মন্তব্য সরকারের মুখ্যমন্ত্রী পদে থেকে করা ঐতিহাসিক কাজ। ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, মমতা নজরুল মঞ্চে বললেন, পুলওয়ামা ঘটনা সাজানো, এর তদন্ত করা জরুরি। সেদিন রাতেই বালাকোটে হামলা চালিয়ে সেই প্রশ্ন ঢেকে দেওয়া হল। রাজ্যপাল নিয়ে তাঁদের দলের অবস্থান—সিপিএমের পুরোনো অবস্থানের সমান। অশোক মিত্র থাকলে খুশি হতেন, এই প্রশ্নে, যে মমতা রাজ্যের হাতে অধিক ক্ষমতা চাইছেন। অর্থ, প্রতিরক্ষা, মুদ্রা ছাড়া বাকি সব ক্ষমতা—রাজ্যের হাতে ছেড়ে দেওয়ার দাবি একবার তোলেন মমতা। এন আর সি, ক্যাব/ক্যা প্রশ্নে রাষ্ট্রপুঞ্জের অধীনে গণভোট চেয়েছেন মমতা। অসামান্য। একদিন হয়তো মুজিবের ডাক শোনা যাবে তাঁর গলায়। মমতাবাদের জন্ম হবে বাংলায়।
১২
মমতাকে লড়তে হচ্ছে শুধু বিজেপি নয়, নিজের দলের দুর্বলতা, খাই খাই প্রবণতা, এবং অবশ্যই সিপিএমের বিরুদ্ধে।
করোনা ও আমফান ত্রাণে অকাতরে অর্থ দিলেন। কিছু নেতার লোভ সমস্যা বাড়াল। টাকা ফেরতও নিলেন। যা ঐতিহাসিক।
সিপিএম ভোট পাচ্ছে কম কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ায় বিজেপি বাদ দিলে আছে মূলত তাঁরাই। তাঁরা মন প্রাণ এক করে মমতা বিরোধী প্রচারে ব্যস্ত। তৃণমূল দলের দুর্বলতা—সারাক্ষণের পেশাদার কর্মী নেই। দলে সাপ্তাহিক এমনকী মাসিক বৈঠক নেই। এক সুরে কথা বলা নেই। ঘরে ঘরে আর এস এসের মতো যাওয়া নেই। ভালো মিডিয়া সেল নাই। আছেন কেবল মমতা। তিনি যা বলেন, তাও যদি ঠিক মতো রাতদিন এক করে ২০১১-র আগের মতো করে কর্মীরা পোঁছাতো তাহলে সমস্যা কমত। বাংলা বাঁচত।
বাংলা ভাষা ও বাঙালিকে নিয়ে বলেন মমতা, বাংলায় মেডিক্যাল পরীক্ষা তাঁর দাবি, নোটবন্দি প্রশ্নে সরব বাংলার স্বার্থে। দেশের স্বার্থে।
আবার হিন্দিভাষীদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় বানাতে চান। ছটপূজায় দু’দিন ছুটি দেন। সর্বভারতীয় হতে চেয়ে। ইদে ছুটি কিন্তু মাত্র একদিন।
১৩
মমতা এক বিস্ময়। নীল রক্ত নেই শরীরে। গরিব বাড়ির মেয়ে। লড়াই করে বেড়ে উঠেছেন। তাই মধ্যবিত্তের শ্রেণিচেতনায় আঘাত লাগে। রাতদিন ব্যঙ্গ চলে। তবে লিবারাল বামদের সমর্থন পেয়েছেন এই কারণে—বিশেষত শেষ দফার নির্বাচনে বিদ্যাসাগর মূর্তি ভাঙার পর।
মমতার সমস্যা হচ্ছে এই, তাঁর আদর্শের অনুসারী দল নেই। তিনি তৃণমূলের। কিন্তু তৃণমূল তাঁর যোগ্য দল নয়। তাঁর দরকার ছিল, ১৯৭৭-র আগের সিপিএমকে। আর সিপিএমের দরকার ছিল মমতার মতো একজন পালিশ করা জননেত্রীকে।
‘ব্রান্ড বুদ্ধ’ গরিবদরদী সিপিএমকে পুঁজিবাদমুখী করেছিল, সংখ্যালঘু তফশিলি জাতি জনজাতির দলকে অন্য পথে চালিত করেছিল।
মমতা সেই অভিমুখ ঘোরাতে পারতেন। তাতে রাজ্য এবং দেশ বাঁচত।
এসব কিন্তু কষ্টকল্পনা।
মনুবাদী ইগো সহজে যাওয়ার নয়। দরকার ছিল প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষে রামপন্থীদের ঠেকাতে রামধনু জোট। হচ্ছে উলটো।
ইতিহাস প্রমাণ করবে কে বা কারা ঠিক ছিলেন।
কিন্তু বহুমূল্য চুকিয়ে—সেটাই বেদনার।
তরুণ প্রজন্ম আশাকরি নতুন ভারতের জন্ম দেবে।
সেই বেদনা ঘোচাবে!
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন