রাজতন্ত্র, মৌলবাদ ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ

ইমানুল হক

জৈশ-ই-মহম্মদের নেতা মাসুদ আজহারের একটি ‘ওয়েবসাইট’ ছিল। তার নাম হিজাব-ই-মুঘলস্তান। সেই ওয়েবসাইটে ছিল দুই ব্যক্তির ছবি, একজন রোনাল্ড রেগান, অন্যজন স্তালিন। রেগানের পরিচিতি সেখানে দেওয়া হয়েছিল এইভাবে, ‘টাইম’ পত্রিকার মতে/শতাব্দীর সেরা মার্কিন প্রেসিডেন্ট। এবং সেখানে উদ্ধৃত করা হয়েছিল, তালিবানদের সম্পর্কে রেগানের একটি উদ্ধৃতি—’আমেরিকার প্রতিষ্ঠাতাদের মতোই তালিবানরা নৈতিক শক্তির অধিকারী’।

আর স্তালিন? ওয়েবসাইটটির মতে, অত্যন্ত ঘৃণ্য ব্যক্তি। কারণ, তিনি দেড় কোটি মানুষকে খুন করেছেন ঠান্ডা মাথায়। জৈশ-ই-মহম্মদ প্রবলভাবে কমিউনিজম বিরোধী। তারা যে ভারত রাষ্ট্রের বিরোধী তার প্রধান কারণ মূলত দুটি। এক, সেখানে ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র বিদ্যমান। দুই, রাষ্ট্রটি ‘সেমি-কমিউনিস্ট’ রাষ্ট্র। যুক্তি কী? না, সেখানে রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্র আজও চালু আছে। মাসুদ আজহার আমেরিকাকে ধন্যবাদ দিচ্ছেন—কারণ আফগানিস্তানে তালিবানদের জয়ের পিছনে মূলত কারণ দুটি। একটি পশ্চিমের অর্থ শক্তি (ওয়েলথ অব ওয়েস্ট) (অন্যটি, মুসলিমদের নৈতিক শক্তি)।

‘টরাস’ ছবির কথা মনে আছে? ২০০১ খ্রিস্টাব্দে চলচ্চিত্র উৎসবে লেনিনকে ক্ষমতালোভী, জাতিবিদ্বেষী, পুরুষতান্ত্রিক হিসেবে চিত্রিত করে এই ছবি দেখানো হয়েছিল। সেই সময় ওয়েবসাইটে খোঁজ করা হয়, ছবিটি আর কোথায় আগে দেখানো হয়েছে। দেখা যায়, রাশিয়ার বাইরে প্রথম প্রদর্শন হয়েছে নিউইয়র্কে। রাশিয়ান চলচ্চিত্র উৎসবে। উৎসবের সভাপতি প্রিন্স গজলিয়ান। রাশিয়ার জারতন্ত্রের অবশিষ্ট প্রতিনিধি। এবং উৎসবের প্রধান পৃষ্ঠপোষক গরবাচভ। যিনি প্রায়শই রেগান-বুশের সঙ্গে করমর্দন করতেন। শেষে কমিউনিস্ট পার্টির দপ্তরে তালা লাগিয়ে দিয়েছিলেন—কারণ, গণতন্ত্র সবার জন্য। কেবল কমিউনিস্টদের জন্য নয়।

‘টরাসে’-র পরিচালক আলেকজান্ডার সকুরভ আরেকটি ছবি নির্মাণ করেছিলেন হিটলারকে নিয়ে। নাম ‘মলোখ’ (গিরগিটি)। সেখানে হিটলার অত্যন্ত মানবিক চরিত্র। আমরা অবাক হতে পারি। কিন্তু জার্মান টাকায় রুশ পরিচালক সকুরভ হিটলারকে এভাবেই এঁকেছিলেন। যাক, এসব কথার বলার মূল কারণ ভিন্ন। হিটলারের জন্মদিন ২০০২ খ্রিস্টাব্দে রাশিয়ার ২০টি বড় বড় শহরে পালিত হয়েছে। কোন রাশিয়া? না, প্রায় ৬০ বছর আগে যে রাশিয়ার দেড় কোটি মানুষ নিহত হয়েছিলেন হিটলারের জন্য।

আর, সবাই জানেন মার্কিন মদতপুষ্ট ‘গণতান্ত্রিক’ রাশিয়ার পতাকা হয়েছে, লাল-সাদা-নীল। জারের আমলের পতাকা।

আফগানিস্তানে তালিবানদের প্রথমে মদত দেওয়া হয়েছিল কমিউনিস্টদের হটানোর জন্য। কমিউনিস্ট রাষ্ট্রপতি নাজিবুল্লাহকে প্রকাশ্যে ফাঁসি দেওয়ায় আমেরিকা কোনও নিন্দা করেনি। ২০০১ খ্রিস্টাব্দের ১১ সেপ্টেম্বরের পূর্ব-পরিকল্পিত ঘটনার পর আফগানিস্তানে ‘গণতন্ত্র’ ফেরানো হল। কার উদ্যোগে? আমেরিকার। কিন্তু সেজন্য কাকে বেশি দরকার? পুর্বতন রাজা জাহির শাহকে। গণতন্ত্রের পূজারী দেশ রাজাকে ফিরিয়ে আনে!

ইরানের ‘রাজা’ শাহ রেজা পহলাভির মদতদাতা কিন্তু আমেরিকা। যে কুয়েতে মেয়েদের ভোটাধিকার নেই, সেই কুয়েতের মদতদাতা আমেরিকা। যে সৌদি আরবে নারীদের পাথর ছুঁড়ে বিধান আজও কার্যকর, তার পৃষ্ঠপোষক আমেরিকা। আমেরিকার বন্ধুরাষ্ট্র সংযুক্ত যুক্তরাজ্য তথা ব্রিটেনে আজও নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র বর্তমান। আর খোদ আমেরিকাতেই তো প্রতি ৫ বছর অন্তর একজন ‘ডিক্টেটর’ নির্বাচিত হয়। মাত্র ১ লাখ ২১ হাজার ভোট গণনা না করেই নির্বাচিত করা যায় রাষ্ট্রপতি (থুড়ি প্রেসিডেন্টকে)। সে দেশে আজ পর্যন্ত কোনও নারী রাষ্ট্রপতি হওয়া দূরে থাক, প্রার্থী হওয়ার ‘ধৃষ্টতা’ পর্যন্ত দেখাতে পারেননি। (পরে, হিলারি ক্লিল্টন প্রার্থী হয়েছেন)। একই কথা প্রযোজ্য, ‘কালো’ মানুষদের সম্পর্কেও।

এতকাল আমরা শুনে এসেছি, পুঁজিবাদ ঈশ্বরের বিরোধী। বিরোধী ধর্মের। অন্ধ কুসংস্কারের। সে অভিজাততন্ত্র ও রাজতন্ত্রকে খতম করে। কিন্তু কী করছে ‘পুঁজিবাদী’ আমেরিকা? সে তো তার ‘হীনস্বার্থে’ দেশে দেশে রাজতন্ত্র ও ধর্মতন্ত্রকে পৃষ্ঠপোষকতা করছে।

শেষ উদাহরণ, ইরাক। ইরাক আরব দুনিয়ার সেই দেশ, যেখানে ধর্মনিরপেক্ষ শাসন প্রচলিত ছিল। নারী স্বাধীনতা স্বীকৃত। মোল্লাতন্ত্র মাথা তুলতে পারেনি। আর আজ, ধর্মীয় গোষ্ঠীকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে ইরাককে কব্জায় রাখার জন্য। যদিও মার্কিন অভিপ্রায় সিদ্ধ হচ্ছিল না, ইরাকি জনগণের অসমসাহসী মনোভাবের জন্য। কিন্তু মার্কিন ইচ্ছা তো দিনের আলোয় মতোই স্পষ্ট। চালাবি, কী করে দেশ চালাবি, সে প্রশ্ন করেনি আমেরিকা—উল্টে ৪০ বছর পর দেশে ফেরা জালিয়াত চালাবিই পুতুল। সরকার মার্কিন পসন্দ।

‘সেকুলারিজম’ বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক ধারণা। সে কারণে ব্রিটেনে সরাসরি রাষ্ট্রধর্ম নেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও তাই। কিন্তু বাস্তব কি তাই বলে? আমেরিকায় আজও গর্ভপাত আইন প্রণয়ন করা যায়নি। বর্ণবিদ্বেষ সেখানে প্রবলভাবে বিদ্যমান। ক্লু ক্ল্যাক্স ক্ল্যান ছাড়াও ৩২টি জাতি ও বর্ণবিদ্বেষী সংগঠন সেখানে রীতিমতো সক্রিয়। এশিয় ও অন্যান্য অধিবাসীরা সেখানে কার্যত দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক। সম্প্রতি জর্জ ফ্লয়েড হত্যা প্রমাণিত। গণতন্ত্রের এমনই চেহারা যে, রোজেনবার্গ দম্পতিদের যেমন অতীতে পুড়িয়ে মারা হয়েছে, তেমনই এখন (২০০২) শুধু যুদ্ধ বিরোধিতার কারণে ২ জন নোবেল পুরস্কার প্রাপ্ত বিজ্ঞানীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অসংখ্য ব্যক্তির চাকরি খেয়ে নেওয়া হয়েছে, অথবা তাদের শাস্তিমূলক বদলির ব্যবস্থা করা হয়েছে। মিছিল-মিটিংয়ে নিষেধাজ্ঞা জারির পাশাপাশি পুলিশের লাঠি-গুলি-কাঁদানে গ্যাস, জল কামান বহাল তবিয়তে গণতন্ত্রের পরাকাষ্ঠা জানায়। সেনেট এবং কংগ্রেস আছে বটে, কিন্তু তা ‘রাষ্ট্রপতি-র’ একনায়কতন্ত্রী কাজের বিরোধিতা সম্মিলিতভাবে কদাচিৎ করেছে।

আসলে এসব কথা বলার উদ্দেশ্য একটাই। আমেরিকার অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে একনায়কতন্ত্রী ব্যবস্থা চরমভাবে বিদ্যমান। ‘লিবার্টি’ সেখানেই ‘স্ট্যাচু’-তেই কার্যত রূপান্তরিত। আর রাষ্ট্রের স্বার্থে, ক্ষমতার স্বার্থে সে ধর্মীয় মৌলবাদের সঙ্গে আপোস করেছে, নিজের দেশের ভিতরেই। বর্ণবিদ্বেষ ও জাতিবিদ্বেষকে রাষ্ট্রীয় মদতেই জিইয়ে রেখেছে।

তাই রাশিয়া, আফগানিস্তান, কুয়েত বা ইরাকে যখন সে রাজতন্ত্রীদের ফেরায় বা ধর্মীয় মৌলবাদীদের উৎসাহিত করে (‘যখন যেমন তখন তেমন’ নীতির ভিত্তিতে) তখন তার ভিতরে কাজ করে এই অন্তর্লীন ও অবশ্যম্ভাবী প্রবণতা।

ক্ল্যাসিকাল পুঁজিবাদ আজ আর অন্তত আমেরিকায় অবশিষ্ট নেই। কিন্তু তার অনিবার্য ক্ষতিকর ঝোঁকগুলি থেকে সে মুক্ত হতে পারছে না। মানতে চান বা না চান, পুঁজিবাদ মুমূর্ষু এবং সংকটগ্রস্ত।

আমেরিকার ঋণের পরিমাণ ৭ ট্রিলিয়ন ডলার। বেকারি বড়ছে। বাড়ছে মন্দা। নয়ের দশক থেকে বিশ্ব অর্থনীতিতে এক নম্বর স্থান সে ধরে রাখতে পারেনি। অস্ত্র এবং ভোগ্যপণ্য—এই দুটি ব্যবসাতে একচ্ছত্র আধিপত্যও আর সেভাবে বজায় রাখা সম্ভব হচ্ছিল না। বিশ্বের প্রথম পাঁচটি ব্যাঙ্কের একটিও আজ আর আমেরিকান নয়। যদিও মজার কথা, আমেরিকান এক্সপ্রেস ব্যাঙ্কের বিজ্ঞাপনে ‘গ্লোবালাইজেশন’ শব্দটি প্রথম ব্যবহৃত হয়। বিশ্বায়নের নামে (বেশ্যায়ন, নিঃস্বায়ন!) নব সাম্রাজ্যবাদকে তাঁরা চাপাতে চেয়েছিল। অনেক ‘নিও লেফট’ মনে করছিলেন, আজ আর অস্ত্র নয়, চুক্তি আর আইনের মাধ্যমে আমেরিকা বিশ্বশাসন করবে। ‘সাম্রাজ্যবাদ পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ পর্যায়’ এই জাতীয় কথাবার্তা বস্তা পচা, মার্কসবাদকে সৃজনশীল হতে হবে, এমনও ভাবছিলেন কেউ কেউ। ‘মৌ’-এর গন্ধে মোহিত হয়ে কোনও কোনও বাম আরাম খুঁজছিলেন আমেরিকান বিনিয়োগকারীদের কোলে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক সংকট এবং সেই সংকট থেকে মুক্তির জন্য যুদ্ধোন্মাদনা সৃষ্টি এবং যুদ্ধ করা যে আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদের কাছে এখন একমাত্র পথ তাঁদের সবাইকে একথা গিলতে হচ্ছে কুইনাইন গেলার মতো করে।

আর কারও কারও বাড়াবাড়ি মনে হতে পারে। তবু একথা সত্য, অর্থই একমাত্র আরাধ্য দেবতা আমেরিকান শাসকদের। ‘বাহুবল ও বাক্যবল’ আজ লিখলে বঙ্কিমকে একটু নতুন শব্দ যোগ করতে হত। কারণ, লোক মানে আজ আমেরিকা। দেশ মানেও তাই। ভাষা মানেও তাই। যদিও এর বিরুদ্ধে দেশে দেশে জনমত শক্তিশালী হচ্ছে। কোন বিশেষ রাজনীতিক দল বা গোষ্ঠীর আহ্বানে নয়, নিজস্ব মতাদর্শ, বিবেক, চিন্তা, ও যুক্তির অনুসরণে দেশে দেশে প্রতিবাদী জনতা আজ এক সুপার পাওয়ার হিসেবে দেখা দিচ্ছে। সেই প্রতিবাদী জনতাকে জাত, ধর্ম, বর্ণে, দলে ভাগ করার চেষ্টা হচ্ছে। কিন্তু তা সর্বত্র সফল হচ্ছে না। অথচ রাশিয়া কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে মুসলিম মানসকে ধর্মের ভিত্তিতে সংহত করার চেষ্টা করা হয়েছিল। ইতিহাস সে কথাই বলে।

১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দে তবলিগ জামাতের একটি বিশ্ব সম্মেলন হল চিকাগোতে। সারা পৃথিবী থেকে ৬ হাজারের বেশি মুসলিম জমায়েত হলেন সেখানে। টাকা ও পৃষ্ঠপোষকতা মার্কিন সরকারের। সোভিয়েত তখন বর্তমান। আফগানিস্তানে চলছে কমিউনিস্ট শাসন। আর তাকে উৎখাতের জন্য লড়ছে মুজাহিদিনরা।

আফগানিস্তানে কমিউনিস্ট শাসনের অবসানের জন্য যে মুসলিম ‘ধর্মযোদ্ধা’রা লড়ছিল তাদের প্রশিক্ষণ, নিয়োগের ব্যবস্থা প্রথমে করত পাক গোয়েন্দা সংস্থা আই এস আই। পরে এর দায়িত্ব নেয় ইউ এস আর্মি স্পেশাল ফোর্স। এরাই ভিয়েতনামের ২০০ গ্রামে ১২ হাজার উপজাতিকের অর্থ ও অস্ত্র প্রশিক্ষণের মারফৎ ভিয়েৎকঙদের বিরুদ্ধে লড়তে শেখায়।

১৯৫২ খ্রিস্টাব্দ থেকে ইউ এস আর্মি স্পেশাল ফোর্স যুদ্ধ করার বদলে অন্য ধরনের তথাকথিত অসামরিক কৌশল নেয়। তারা নামে প্রচার যুদ্ধে, মনস্তাত্ত্বিকভাবে মানুষকে মার্কিন স্বার্থের পক্ষে নিয়ে আসার জন্য। তাদের মতবাদ হল ‘হৃদয় এবং মন’ জয়ের মতবাদ। বুদ্ধিজীবী, তরুণ, গ্রামীণ জনগণের মধ্যে এদের কাজ করার প্রবণতা বেশি।

১৯৮১ খ্রিস্টাব্দে সি আই এ-র প্রধান হলেন উইলিয়াম ক্যাসি। তিনি দায়িত্ব পাবার পরই পাকিস্তান সহ মুসলিম দেশগুলিকে নিয়ে জোট গড়ার চেষ্টা চালালেন, আফগানিস্তান থেকে কমিউনিস্ট হঠানোর জন্য। তারই অঙ্গ হিসেবে আফগান উপজাতিদের প্রথমে প্রশিক্ষণ দেওয়া হল। কিন্তু তাতেও সুরাহা হচ্ছে না দেখে, অন্য দেশ থেকে জেহাদি মুসলিম জোগাড়ের চেষ্টা হল। তারই অঙ্গ হিসেবে ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দে শিকাগোয় তবলিগ জামাতের বিশ্ব সম্মেলনের আয়োজন।

এর ফলশ্রুতিতে আরব মুসলিমদের সঙ্গে যোগ দিল আফ্রিকান মুসলিমরাও। প্রথমে তরুণ শিক্ষার্থীদের ৬ সপ্তাহের ধর্মশিক্ষা দেওয়া হয়। প্রত্যুৎপন্নমতি কাউকে পাওয়া গেলে তাকে নিয়ে যাওয়া হত পশ্চিমে। আর বাকিদের কাছে জানতে চাওয়া হত আত্মরক্ষা বা অন্য প্রয়োজনে অস্ত্র প্রশিক্ষণ নিতে তারা রাজি কিনা? বলাই বাহুল্য, অধিকাংশই রাজি হত, কারণ ৬ সপ্তাহের ধর্মশিক্ষা, তার মনোভাবে অনেকখানি পরিবর্তন এনেছে। আফগানিস্তানে ‘আল্লার শত্রু’ রাশিয়ান কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে যাওয়া তো শিক্ষার্থীর পবিত্র কাজ। তাই থেকে যায় পাকিস্তানের আই এস আই প্রশিক্ষণ শিবিরে। যার অর্থ জোগাচ্ছে তখন গণতন্ত্রের পূজারী আমেরিকা।

খোদ আমেরিকাতেও পশ্চিমের তরুণদের জন্য কয়েকটি প্রশিক্ষণ শিবির খোলা হয়। ডেট্রয়েট, ডিয়ারবর্ন, মিশিগান, লস অ্যাঞ্জেলস এবং সানফ্রান্সিসকোর সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চলে প্রশিক্ষণ চলে। নিউইয়র্ক, ডেট্রয়েট, লস অ্যাঞ্জেলসের আরব আমেরিকানদের মধ্যে ব্যাপক প্রচারাভিযান চালানো হয়। মসজিদে প্রার্থনার সময়টিকে ব্যবহার করে জানানো হয়, কীভাবে আফগানিস্তানে ইসলাম বিপন্ন এবং তার জন্য মুসলিম তরুণদের জেহাদের অংশগ্রহণ নৈতিক কর্তব্য। জন কে. কুলি তাঁর ‘আনহোলি ওয়ারস’ গ্রন্থে চমৎকার বিবরণ দিয়েছেন সি আই এ-র কর্মকাণ্ডের। এবং তিনি মন্তব্য করেছেন, সি আই এ নিজের দেশে কোনও কাজ করবে না বলে যে সনদ তৈরি করেছিল তাকেও তারা ভঙ্গ করেছে।

ব্রুকলিনে আফগান উদ্বাস্তুদের আল কিফাহ শিবিরটি কার্যত আরব, আরব-আমেরিকান এবং মুসলিম ভ্রমণকারীদের মিলনক্ষেত্রে পর্যবসিত করে সি আই এ। হয়ে ওঠে ‘আল জিহাদ’ কেন্দ্র। এই কেন্দ্র পরিচালনার ক্ষেত্রে অন্যতম প্রধান হয়ে ওঠেন প্যালেস্তাইনে গাজা স্ট্রিপে কাজ করা ‘হামাস’ গোষ্ঠীর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা গেরিলা নেতা আবদুল্লাহ আজম। তাঁর নিউইয়র্কের এজেন্ট মুস্তাফা চালাবিই তাঁর তত্ত্বাবধানে এই শিবিরটিতে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতেন। পরে সি আই এ-র সঙ্গে বিরোধ দেখা দেওয়ায় দুজনকেই মর্মান্তিক ভাবে মরতে হয়। আজম মারা গেলেন পাকিস্তানে ১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দে। গাড়ি বোমা বিস্ফোরণে। আর চালাবি নিহত হলেন ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দে নিউইয়র্কে। অর্থের অপব্যবহার নিয়ে দ্বন্দ্বই মূলত চালাবির মৃত্যুর কারণ।

আমেরিকার দোস্ত ইজরায়েলের চরম শত্রু ‘হামাস’, তবু কমিউনিস্ট হঠাতে দোস্তের দুশমনের সঙ্গে গলাগলি করতে বাধেনি সি আই এ-র। কারণ, মূল লক্ষ্য আপন স্বার্থ সিদ্ধি। সেখানে দোস্তই কে আর দুশমন-ই বা কে? অবশ্য ইজরায়েল ভালোভাবে দেখেনি আজম-আমেরিকা সুসম্পর্ক। আবদুল্লাহ আজমের মৃত্যুর পিছনে কেউ কেউ মোসাদের হাতের ছায়াও দেখেছেন। শোনা গেছে রাশিয়ান গোয়েন্দা সংস্থা কে জি বি-র নামও। আজম সি আই-এর সাহায্যে আমেরিকার ২৬টা প্রদেশে ঘুরেছিলেন তরুণ জেহাদি মুসলিম খোঁজার জন্য।

আফগানিস্তানে কমিউনিস্ট শাসনের অবসানের পর, এই জেহাদিদের সঙ্গে সি আই এ-র সম্পর্কের অবনতি ঘটতে থাকে। কারণ, মূলত তিনটি। এক প্রয়োজন ফুরিয়েছে, অতএব আর তোমাদের চিনতে চাই না, সি আই এ-র এই মনোভাব। দুই, জেহাদিদের আরও উচ্চাকাঙ্ক্ষা। তিন, সি আই এ বা মার্কিন কর্তৃপক্ষের লোভ ও বিশ্বাসঘাতকতা।

তৃতীয় কারণটির জন্য মাদক ব্যবসায়ী আফ্রিদির উদাহরণ আপাতত যথেষ্ট। মাদক ব্যবসায়ী আফ্রিদি কমিউনিস্ট হঠাতে সাহায্য করার পর আমেরিকা তাকে মাদক অপরাধী হিসেবে গণ্য করে। কথা দেয় ধরা দিলে শাস্তি কম হবে। কিন্তু স্বেচ্ছায় আমেরিকায় এসে আত্মসমর্পণ করার পর তার যাবজ্জীবন জেল হয়।

১০

কীভাবে অর্থ এসেছে আফগানিস্তানে এবং কীভাবে মুসলিম দুনিয়ায় সি আই এ-র হাত ক্রমশ প্রসারিত হয়েছে? একটি দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক।

সৌদি আরব গোয়েন্দা বিভাগে প্রথম যে অ-সৌদি লোকটি প্রধান হলেন তার নাম শেখ কামাল আদহাম। ১৯২৯ সালে তুরস্কে তাঁর জন্ম। মা তুর্কি, বাবা আলবেনিয়ান। পড়াশোনা মিশরের কায়রোয় ইংরেজি মাধ্যম ভিক্টোরিয়া কলেজে। সৌদির রাজা ফয়জলের প্রিয়তমা স্ত্রী ইফফাৎ ছিলেন তার সৎ বোন। আদহাম গোয়েন্দা প্রধান হওয়ার পরই মনোযোগ দিলেন অর্থসংগ্রহে। এবং আমেরিকার প্রসাদ লাভে। ৬০ এর দশক থেকেই মিশরের রাষ্ট্রপ্রধান আনোয়ার আল সাদাতের সঙ্গে আদহামের আলাপ ছিল। সেই আলাপের সূত্র ধরে ১৯৭০ মিশরের রাষ্ট্রপ্রধান নাসেরের মৃত্যুর পর আনোয়ার সাদাতকে আদহাম বোঝালেন সোভিয়েত যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের জন্য। সাদাত আদহামের প্রভাবে সোভিয়েত রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে মার্কিন হাত ধরতে রাজি হলেন। ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দের ১৩ জুলাই হেনরি কিসিংগার আদহামের বার্তা পেলেন, সাদাত আমেরিকার সঙ্গে কথা বলতে রাজি। এর পরের ঘটনা ঘটল দ্রুত। মিশর থেকে নাসেরের আমলে আসা সোভিয়েত দেশ সরলো। মার্কিন সেনা আবার মধ্যপ্রাচ্যে ঢুকতে আরম্ভ করল। আর আদহাম পেলেন পুরস্কার। আফগান জেহাদিদের হাতে সৌদি অর্থ পৌঁছনোর প্রধান মাধ্যম হলেন তিনি। সি আই এ-র বদান্যতায় আদহাম সাদাতের হাফ-ইংরেজ স্ত্রী জেহান সাদাতের সঙ্গে ব্যবসা শুরু করে নিজের অবস্থান আরও শক্তিশালী করলেন।

এরই মধ্যে আদহাম যোগাযোগ করলেন জেহাদিদের অর্থ কামানোর প্রতিষ্ঠান বি সি সি আই ব্যাঙ্ক অফ ক্রেডিট অ্যান্ড কমার্স ইন্টারন্যাশন্যালের (যার নাম আসলে দাঁড়ায় ‘ব্যাঙ্ক অফ ক্রুকস অ্যান্ড ক্রিমিন্যালস ইন্টারন্যাশনাল’) প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান আগা হাসান আবেদির সঙ্গে। জন্মসূত্রে আবেদি পাকিস্তানি। ১৯৭২ সালে তিনি বি সি সি আই প্রতিষ্ঠা করেন। আবেদি সৌদি ধনকুবেরদের ও সি আই এ-কে সাহায্য করেন আফগান জেহাদিদের কাছে অর্থ পৌঁছে দেওয়ার ব্যাপারে। আরব দুনিয়ার বহু রাষ্ট্রপ্রধান তো বটেই এমন কী মার্কিন রাষ্ট্রপতি জিমি কার্টারেরও ব্যক্তিগত বন্ধু ছিলেন আবেদি। আবেদি বিতর্কিত ব্যক্তি। একদলের চোখে তিনি অত্যন্ত ধূর্ত ও জালিয়াত। যদিও তাঁর মৃত্যুর পর ‘ইকনমিস্ট’ পত্রিকা দীর্ঘ একপাতা ‘অবিচুয়ারি’ ছেপে তাঁকে সৎ মানুষ হিসেবে প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করে।

আবেদি নিউইয়র্কের আর্থিক ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ব্যাঙ্ক জালিয়াতির জন্য দায়ি। ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দে তাঁর ব্যাঙ্কে লালবাতি জ্বলে। ব্যাঙ্কে জমা রাখা সাড়ে ৯ বিলিয়ন ডলার অর্থের কোনও খোঁজ মেলে না। বহু সাধারণ এশিয়, আরব এবং মার্কিন নাগরিকের ভবিষ্যৎ বিপন্ন হয়। সহজেই অনুমেয় কেন লালবাতি জ্বলল ব্যাঙ্কে। যাই হোক আদহাম এবং আবেদি জুটি আফগানি জেহাদিদের সাদা পথে টাকা পৌঁছানোর ব্যবস্থা করে ফেললেন। শুধু আফগান জেহাদিরা নয়, বি সি সি আই মারফৎ টাকা পৌঁছতে লাগল অধুনা মার্কিন নিষিদ্ধ তালিকায় আসা ‘আল নিদাল’ এবং এবং ‘আবু সয়াফ’ গোষ্ঠীর কাছে।

সি আই এ বরাবরই দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যাঙ্কগুলির ওপর নির্ভর করেছে। তালিকার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ব্যাঙ্ক অফ অস্ট্রেলিয়া, মার্কেনটাইল ট্রাস্ট, বাহামা এবং ক্যাসল ব্যাঙ্ক। কিউবায় কাস্ত্রো বিরোধী কার্যকলাপ চালাতে অর্থ গেছে শেষোক্ত ব্যাঙ্ক মারফৎ। বি সি সি আই এ-র গোপন অ্যাকাউন্ট ছিল সুইজারল্যান্ড, মিয়ামি, লন্ডন এবং আরও বহু জায়গায়। বি সি সি আইকে ব্যাঙ্ক অফ ইংল্যান্ড নিষিদ্ধ ঘোষণা করে ১৯৯১ এর জুলাই মাসে। তখন জানা যায়, বি সি সি আই কীভাবে মাদক ব্যবসায় টাকা ঢেলেছে, নিকারাগুয়ার প্রতিবিপ্লবী কন্ট্রাদের কাছে টাকা পাঠিয়েছে, দুনিয়া জুড়ে মুসলিম জেহাদিদের সৌদি এবং মার্কিন অর্থ জুগিয়েছে আর গড়ে তুলেছে ‘ব্যাঙ্কের মধ্যে ব্যাঙ্ক ব্যবস্থা’। একথা না উল্লেখ করলেও চলত, তবু জানা দরকার, বারে বারে সি আই এ, বি সি সি আই ব্যাঙ্ক আবেদির সঙ্গে সম্পর্ক অস্বীকার করেছে। কিন্তু ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম, মার্কিন এ বি সি নিউজ এবং ‘ফিনান্সিয়াল টাইমস’ দেখিয়ে দিয়েছে কীভাবে সি আই এ ‘অ্যাকাউন্ট’ সচল থেকেছে আফগান জেহাদিদের টাকা জোগানোর জন্য। লন্ডনে একাধিক শাখায়, তবে প্রধানত ক্রমওয়েল রোড শাখায় সি আই এ-র অর্থ লেনদেন হত বেশি। ব্রিটেনে থাকা চরেদের টাকা জোগাত বি সি সি আই-এর লন্ডন শাখাগুলি। আর পাকিস্তানের অর্থমন্ত্রী নিজে ‘ফিনান্সিয়াল টাইমস’-এর সাংবাদিককে জানিয়েছিলেন, কীভাবে বি সি সি আই মার্কিন অর্থ পাকিস্তান মারফৎ পৌঁছে দিত আফগান ফ্রন্টে। পরে সি আই এ-র ভারপ্রাপ্ত অধিকর্তা রিচার্ড ফের স্বীকার করেন সি আই এ-বি সি সি আই যোগসূত্রের কথা।

আর যে লাদেন-কে মারা ও ধরার জন্য আফগানিস্তানে আগ্রাসন চালানো হল সেই ওসামা বিন লাদেনের সঙ্গে সি আই এ-র যোগাযোগের ইতিহাসটুকু ভুলে যাওয়া সি আই এ-র পক্ষে সম্মানজনক হলেও ইতিহাসের ছাত্রের কাছে তা যথেষ্ট অনুধাবন যোগ্য।

১১

ওসামা বিন লাদেনের বাবার নাম মহম্মদ বিন লাদেন। জন্মসূত্রে ইয়েমেনি। যৌবনে জীবিকার সন্ধানে জন্মভূমি ইয়েমেনের হাদরামৌত অঞ্চল থেকে আসেন সৌদি আরবে। কাজ বলতে ইট বওয়া। আরব-আমেরিকান অয়েল কোম্পানি আরামকো-তে। বেতন দিনে ১ সৌদি রিয়াল বা মার্কিন মুদ্রায় কুড়ি সেন্ট। ভারতীয় মুদ্রায় সে সময় ২ টাকা। দিনের শেষে খাই খরচ বাদ দিয়ে সঞ্চয়টা জমিয়ে রাখতেন বাকি সব ইয়েমেনির মতো টিনের কৌটোয়। সঞ্চয় একটু বাড়ার পর শুরু করলেন বিন লাদেন কনস্ট্রাকশন কোম্পানি। শুরুতে খুবই ছোট। কিন্তু পঞ্চাশের দশকের শুরুতেই বড় বড় প্রাসাদ নির্মাণে ডাক পড়তে লাগল বিন লাদেন নির্মাণ সংস্থার। কিছুদিনের মধ্যেই আরবের নির্মাণ শিল্পে কিংবদন্তি হয়ে গেলেন মহম্মদ বিন লাদেন। শুধু প্রাসাদ নির্মাণ নয়—আরব, জর্ডনের রাস্তা, বিমান বন্দর বা যে কোনও বড় নির্মাণ প্রকল্প মানেই বিন লাদেন নির্মাণ সংস্থা। ব্যাপারটা এমন দাঁড়াল যে মহম্মদ বিন লাদেন ভোরে ফজরের নামাজ পড়ছেন পূর্ব জেরুজালেমে, দুপুরে জোহরের নমাজ মদিনায়, তো, সন্ধেয় মগরেবের নামাজ আদায় করছেন মক্কায়। দান ধ্যানের জন্য মহম্মদ প্রসিদ্ধ হয়ে উঠেছিলেন। ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে নিজের বিমান ধ্বংস হয়ে তিনি মারা গেলেন। রয়ে গেল তার ৫২টি সন্তান এবং বিশ্বের সর্ববৃহৎ নির্মাণ সংস্থা বিন লাদেন নির্মাণ সংস্থা।

কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে পরিচালনার সমস্যায় পড়ল সংস্থাটি। রাজা ফয়জল ছোট একটি সংস্থার প্রধানকে দায়িত্ব দিলেন চালানোর জন্য। যদিও সংস্থা গতি পেল মহম্মদ বিন লাদেনের তরুণ পুত্র ওসামা হাল ধরার পর। (লাদেন কিন্তু আসল নাম নয়, আসল নাম ওসামা)। ওসামা বিন লাদেন মানে লাদেনের পুত্র ওসামা। লাদেন বাবার নাম। ছেলের নাম ওসামা। দুনিয়া বাবার নামে ডেকে গেল ছেলেকে।

১৯৮১ সালে সি আই এ প্রধান ক্যাসি এবং তাঁর সৌদি সহযোগীরা খুঁজতে শুরু করলেন এমন একটি সংস্থা যার বাইরে সুনাম আছে, এবং যে সংস্থাটি আপাতভাবে নিরীহ এবং কেউ সন্দেহও করবে না যে, এই সংস্থা মারফৎ আফগান জেহাদিরা অর্থ পাচ্ছে। তালিকা তৈরি হল। সবচেয়ে ছোট তালিকায় উঠল বিন লাদেন নির্মাণ সংস্থার নাম। সৌদি আরবের তৎকালীন ক্ষমতাশালী বিমান ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী শংসাপত্র দিলেন, দেশের জন্য মহান অবদান রেখেছে সংস্থাটি।

ওসামার সঙ্গে বৈঠক হল সি আই এ-র কর্তাব্যক্তিদের। ওসামা যুক্ত হয়ে গেলেন আফগানিস্তানের জেহাদিদের সঙ্গে। পরে নিজেই জেহাদে গেলেন আফগানিস্তানে রাশিয়ান ও কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে। পরে তাঁর জেহাদের মুখ ঘুরে গেল আমেরিকার দিকে। ৯০ এর দশকে, ১৯৯৭-এ সি আই এ বের করল ওসামা বিন লাদেনের জীবন কথা। ৩ লক্ষ ডলার মাথার দাম ঘোষণা হল। কিন্তু নিজেদের সঙ্গে সংযোগের কথা বেমালুম চেপে দেওয়া হল। চেপে যাওয়া হল একজন প্রতিষ্ঠিত শিল্পপতিকে কীভাবে তাঁরা জেহাদিতে রূপান্তরিত করেছেন, তার ইতিহাস। আল কায়দার কথা এল, কিন্তু বাদ গেল নিজেদের কায়দা বাজি।

১২

আপাত দৃষ্টিতে মনে হতে পারে, এতবার আফগান জেহাদিদের কথা বলার দরকার কী? দরকারটা না বুঝলে বিসমিল্লায় গলদ হয়ে যাবে। আফগানিস্তানে কমিউনিস্টদের হঠাতেই তথাকথিত ইসলাম মৌলবাদীদের সঙ্গে যোগ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের। তারাই বুদ্ধি, অর্থ, অস্ত্র জুগিয়েছে। দিয়েছে প্রচার। রেগান তালিবানদের আমেরিকার প্রতিষ্ঠাতাদের সমান সম্মানজনক আসনে বসিয়েছেন। কার্টার, বুশ, ক্লিন্টন জুগিয়েছেন অর্থ। বিশ্বজুড়ে মুসলিম জেহাদি সংগ্রহ করেছে সি আই এ। আই এস আই মারফৎ ঢুকিয়েছে আফগানিস্তানে। তাদের বেতন দিয়েছে আফগানিস্তানের সরকারি সৈন্যদের থেকেও বেশি হারে। নাজিবুল্লাদের সৈন্যরা পেয়েছে মাসে ১৬৫ ডলার বেতন। জেহাদিরা ২০০ ডলার। আফগান যুদ্ধ শেষে জেহাদিরা ছড়িয়ে পড়েছে দেশে দেশে। নতুন এক মন্ত্র নিয়ে। যে মন্ত্রের অন্যতম শাসক মার্কিন বিরোধিতা।

তবে শুধু আফগানিস্তানের কথা বলা অন্যায় হবে। আলজেরিয়ায় কমিউনিস্টদের হঠাতে মদত দিয়েছে মৌলবাদীরা। মিলোসোভিচের বিরোধিতার জন্য সার্বিয়ায় দিয়েছে মদত। ইরানের বিরুদ্ধে সাদ্দামকে অস্ত্র জুগিয়েছে। ইরাকে কমিউনিস্ট দমনে সাদ্দামকে সাহায্য করেছে। মিশরে সাদাতকে মদত দিয়েছে কমিউনিস্ট সঙ্গ ছেড়ে মার্কিন ভজনা করতে। ধর্মনিরপেক্ষ বামপন্থীদের সঙ্গে সংযোগ ছিন্ন করতে সৌদি আরবের রাজাকে রাজতন্ত্র টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করেছে। ভারতের খালিস্তানি ও আসুকে মদত দিয়েছে। পাকিস্তানের স্বৈরশাসকদের পাশে বরাবরই আমেরিকা। বেনজির ভুট্টো আই এস আই ও সি আই এ সংযোগের বিরোধিতা করে অচিরেই ক্ষমতাচ্যুত। ভুট্টোর ফাঁসিদাতা জিয়াউল হক সি আই এ-র ঘনিষ্ঠ জন। ভারতের বিজেপি ঘোষিতভাবে মার্কিন বিরোধী হলেও কার্যত আজ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ক্রীতদাস। ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও উপ-প্রধানমন্ত্রী আদবানি মার্কিন মুলুকে গিয়ে সি আই এ-র দপ্তর পরিদর্শন করেছেন। এই বাংলায় মাদ্রাসার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা, কথায় কথায় তথাকথিত মুসলিম অনুপ্রবেশকারীদের বিরুদ্ধে মুখ খোলা স্বরাষ্ট্রদপ্তর লালবাজারে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এফ বি আই-কে ঢুকতে দিয়েছে ২০০১-এ। বৈঠক করছেন রাজ্য পুলিশ কর্তা। ইজরায়েলের কুখ্যাত মোসাদও চলে এসেছে লালবাজারে। সব মিলিয়ে এক মৌতাতময় মনোভূমি। তাতে কখনও ‘নারায়ের তকদিরে’-র চাষ, কখনও ত্রিশূলের। কখনও কুয়েতে নারী ভোটাধিকার না রাখায় মদত, কখনও নেপালে রাজতন্ত্র টিকিয়ে রাখতে অস্ত্র সরবরাহ।

১৩

আফগান যুদ্ধের আগে হ্যান্টিংটন নামে একজনকে বিশ্বখ্যাত বুদ্ধিজীবীর স্থান দিয়ে আফগান যুদ্ধ তথা সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধকে ‘সভ্যতার সংঘাত’ হিসেবে চিহ্নিত করতে চেয়েছিল মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ। ইরাকযুদ্ধ সেই প্রচারের বেলুনে একটা বড় বেমক্কা ফুটো করে দিয়েছে। সভ্যতার সংঘাত মানে মুসলিম আর খ্রিস্টান মানসে সুড়সুড়ি দিয়ে খ্রিস্টান মৌলবাদীদের পালে হাওয়া লাগানো গিয়েছিল। কিন্তু ইরাক আগ্রাসনের সময় গেল না। ‘খ্রিস্টান’-দের সর্বোচ্চ প্রতিনিধি পোপ ভ্যাটিকান থেকে যুদ্ধের তীব্র নিন্দা করলেন। দেশে ‘খ্রিস্টান’ ধর্মযাজক সন্ন্যাসিনীরা প্রতিবাদ মিছিল করলেন ‘মুসলিম’ ধর্মাবলম্বীদের পাশাপাশি। আর ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান, আরব দেশ সহ তথাকথিত ‘মুসলিম’ দুনিয়ায় যত বড় মিছিল হয়েছে তার থেকে অনেক বড় বড় মিছিল বের হয়েছে খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী প্রধান দেশে। সানফ্রান্সিসকো, ওয়াশিংটন, লন্ডন সহ বেশ কয়েকটি শহরে ১০ লাখ করে মানুষ মিছিল করলেন। ভাবুন, বামপন্থী পশ্চিমবাংলায় দুলাখের বেশি মানুষকে মহামিছিলে সামিল করা যায় নি, আর আমাদের রাজ্যের থেকে ২ কোটি কম জনসংখ্যার ব্রিটেনে ১০ লাখ মানুষ প্রতিবাদ মিছিল বের করেছিলেন।

তাই ‘সভ্যতার সংঘাত’ নামে ‘খ্রিস্টান’ ও ‘মুসলিম’ সম্প্রদায়ের মানুষকে পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়িয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা সাময়িক হলেও ব্যর্থ হয়েছে। আর যে সমস্ত ‘মুসলিম’ তরুণ ভাবছেন, লাদেনের পথে প্রতিবাদই আসল, তাঁদের এ থেকে শিক্ষা নিতে হবে। ‘মৌলবাদ’ শব্দটি আজ গালাগালে রূপান্তরিত। যদিও কেউ যদি সত্য সত্য মূলে থাকতে পারেন, তাকে ‘গাল’ দেওয়া কতখানি সঙ্গত—এ প্রশ্নও কেউ কেউ তুলেছেন। তবে ‘ইসলামি মৌলবাদী’ বলে যাদের আখ্যাত করা হচ্ছে—তারা কি সত্যই মূল ইসলামকে অনুসরণ করে? নাকি, এরা ক্ষমতার সন্ধানে নিয়োজিত একদল ধর্মব্যবসায়ী? যাদের প্রবল উত্থান আমেরিকার হাত উষ্ণ করেছিল, কমিউনিস্টদের ‘পতনে’-র পরে তাদের সঙ্গেই বাধল বিরোধ। ক্ষমতার রাজনীতির এ এক অদ্ভুত আপাত জটিল অথচ সরল নিয়ম। পৃথিবীতে যুগে যুগে এ ঘটনা দেখা গেছে। তবে ওসামা বিন লাদেন যদি প্রকৃতপক্ষে হজরত মহম্মদের অনুসারী হবেন, তাহলে তাঁর ছবি পাওয়া যায় কী করে, ভিডিও টেপই বা মেলে কেমন করে? ইসলাম তো ব্যক্তিপূজা বা ব্যক্তি প্রতিকৃতি নির্মাণের প্রবলতম বিরোধী। বিরোধী মুনাফা বা সুদের এবং মাদক ব্যবসারও। অথচ বি সি সি আই ব্যাঙ্ক তো সুদবিহীন ব্যাঙ্ক নয়। আর মাদক ব্যবসায়ীরা কীভাবে আফগান জেহাদে টাকা জুগিয়েছে তা যে কোনও ইতিহাসনিষ্ঠ মানুষই জানেন। যদি তালিবানরা ক্ষমতায় এসে মাদক ব্যবসা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।

রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন ‘রক্তকরবী’ নাটকে—ওদের অস্ত্রশালা, মদের ভাণ্ডার আর মন্দির পাশাপাশি। আমেরিকার ক্ষেত্রে কথাটা ভীষণভাবে সত্য। যেখানে অস্ত্র দিয়ে হয়নি, সেখানে ‘মদ, মাদক ও মেয়ে’ নীতি প্রয়োগ করেছে। যৌনতা নীতির থেকে বড় করে দেখানো হয়েছে। কমিউনিজমকে ঠেকাতে কনজিউমারিজমকে হাতিয়ার করেছে। রাশিয়া তার জ্বলন্ত প্রমাণ। আর্ন্তজালে দেখবেন রাশিয়ান মেয়েরা আজ কীভাবে লালায়িত পশ্চিমি পুরুষের শয্যাসঙ্গিনী হবার আশায়। দামি জুতো দামি কন্ডোম কেনার জন্য এক সময় লাইন দিয়েছিল রাশিয়ার তরুণ। আজ সেখানে সারি খাদ্যের জন্য। পূর্ব জার্মানিতে জিনসের দাবিতে বিক্ষোভ হয়েছিল। সৌদি আরব, মুসলিমদের পবিত্র ভূমিতে, মদ মাটিতে নিষিদ্ধ। আকাশে নয়। কারণ, মার্কিনি। যাঁরা কোরান খুঁটিয়ে পড়েছেন তারা জানেন, কোরানে শুয়োর খাওয়াও সেভাবে নিষিদ্ধ নয়, যে ভাবে নিষিদ্ধ নেশা করা। অথচ মক্কা, মদিনার দেশে মদ চলে মার্কিন শিবিরে। মানা করবে, এমন মাথা কার?

আজ ভারতে তবলিগ জামাত নিয়ে হইচই। ১৯৮৮-তে এরা ছিল মার্কিন সহচর। আফগানিস্তানে কমিউনিস্ট হঠাতে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প প্রমাণ করছেন, আমেরিকা একটা কাগুজে বাঘ। যে শুধু অস্ত্র ও সৌন্দর্য ব্যবসার প্রসাধনী বেচতে পারে। স্বাস্থ্য ব্যবস্থা পঙ্গু, বিশ্বে সবচেয়ে বেশি মানুষ করোনায় মারা গেছে আমেরিকায়। হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন নিতে হয়েছে ভারত থেকে হুমকি দিয়ে। করোনা কিট, সুরক্ষা পোশাক ছিনতাই করতে হয়েছে। মহান আমেরিকানের আর বামপন্ধীরা সঠিক হলে কিউবা, ভিয়েতনাম, চীন এবং কেরল প্রমাণ করছে ক্ষমতায় কী করতে পারে। পশ্চিমবঙ্গে তো বামপন্থ নয়, ছিল সমাজতান্ত্রিক বুর্জোয়ারা।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন