ইমানুল হক
বর্ধমানে বসে একটি সইয়েই ইংরেজ রাজত্বের সূচনা!
খাজা আনোয়ার বারবারই বাধা দিচ্ছিলেন। বলছিলেন, সই করবেন না। সম্রাট ঔরঙ্গজেব পুত্র আজিম-উস-সান তাই সই করছিলেন না। বিদ্রোহী শোভাসিংহ সহচর রহিম খাঁ-র চক্রান্তে খুন হলেন খাজা আনোয়ার। (খাজা আনোয়ারের নামে নামকরণ হয়েছে বর্ধমানের খাজা আনোয়ারা বেড়)। খাজা আনোয়ারের মৃত্যুতে সিদ্ধ হল ইংরেজদের অভিলাষ। ১৬০০০ টাকা উৎকোচ দিয়ে বাৎসরিক মাত্র তিন হাজার টাকা বিনিময়ে কলিকাতা, সুতানুটি, গোবিন্দপুর কিনে নিল ইংরেজরা।
১
কলকাতা নামকরণ কেমন করে হল, সে নিয়ে তর্ক অনেক। রাধারমণ মিত্র, পি টি থাঙ্কপন নায়ার, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, সুকুমার সেন সহ বহু ঐতিহাসিক জড়িয়েছেন বিতর্কে। কলি চুন না খাল, না দেবী কালী—কার অবস্থিতি নামের পিছনে সে দ্বন্দ্বের নিরসন হয়নি। তবে স্থানটির ঐতিহাসিকতা নির্ধারিত। পঞ্চদশ শতকের শেষে রচিত বিপ্রদাস পিপলাইয়ের ‘মনসামঙ্গল’ কাব্যে প্রথম পাওয়া যাচ্ছে কলিকাতা নামের উল্লেখ। চাঁদ সদাগর সপ্তগ্রাম যাওয়ার পথে এখানে কালীকে পূজা দিতে নেমেছিলেন। ১৫৯৬ খ্রিস্টাব্দে আকবরের সভাসদ আবুল ফজলের ‘আইন-ই-আকবরি’-তে কলকাতা নামের উল্লেখ পাওয়া যায় সপ্তগ্রামের অধীন একটি এলাকা হিসাবে। ১৫৩০ খ্রিস্টাব্দে সপ্তগ্রাম বন্দর পর্তুগিজ অধীনে আসার পর ভারত-ইউরোপ বাণিজ্য মানচিত্রে বিশেষ স্থান লাভ করে। ১৬৯০ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাসে কলকাতায় বসবাস শুরু করেন জব জার্নক। সম্রাট আওরঙ্গজেব পুত্র আজিম-উস-সানের অনুমোদনে সাবর্ণ চৌধুরিদের কাছ থেকে কলকাতা, সুতানটি, গোবিন্দপুর—তিনটি গ্রাম কিনে এই বসবাস। পরে ইংরেজরা ফলতার আরো ৫৬টি গ্রাম কেনার জন্য দিল্লি থেকে অনুমোদন আনলেও মুর্শিদকুলি খাঁ-র ভয়ে কোন জমিদার ইংরেজদের গ্রাম বেচার সাহস করেননি। ১৬৯৬ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় প্রথম কুঠি তথা কারখানা স্থাপন করে ইংরেজরা। ১৭০৭ খ্রিস্টাব্দে ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর ১৭১৫ খ্রিস্টাব্দে দুর্গ নির্মাণ করে। ১৭১৭ খ্রিস্টাব্দে দিল্লির সম্রাট ফারুখশিয়ার মাত্র তিন হাজার টাকার বিনিময়ে কলকাতায় বাণিজ্য করার অধিকার দিলেন ইংরেজদের। এখানেও এসে যাচ্ছে বর্ধমান প্রসঙ্গ। ফারুখশিয়রের পিতা আজিম-উস-সান যখন বর্ধমানে বাস করছেন, তখন অধুনা কালনা গেটের কাছে পির বায়াজিদের কাছে দেখা করতে যান ফারুখসিয়ার ও তাঁর বড়ভাই। বড়ভাই উদ্ধত, সালাম করলেন না। ছোটভাই সালাম করলেন পিরকে। সন্তুষ্ট পির নাকি আশির্বাদ করে বলেন, তুমি ভারতের সম্রাট হবে। ফারুখশিয়ার সম্রাট হয়ে বায়াজিদ পিরের স্মরণে একটি সৌধ নির্মাণ করে দেন। ১৭১৭ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজ সম্রাট প্রথম জর্জের অনুমোদনে কলকাতায় প্রথম দেওয়ানি আদালত প্রতিষ্ঠিত হয়। একই বছরে প্রতিষ্ঠিত হয় কলকাতা পুরসভা। প্রথম মেয়র হন হলওয়েল।
২
কলকাতায় ইংরেজদের বিনা অনুমতিতে দুর্গ নির্মাণ, অনৈতিকভাবে ব্যবসা পরিচালনা, সম্রাট প্রদত্ত দস্তকের অপব্যবহার, এবং এর ফলে বাঙালি তথা ভারতীয় বণিকরা ব্যবসায়িকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ক্ষুব্ধ হন বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা। অবৈধ ব্যবসা ও দুর্গ নির্মাণে সিরাজের আপত্তি মানেনি ইংরেজরা। উল্টে সিরাজের নামে মিথ্যা বদনাম রটনা করে প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করার চক্রান্ত শুরু করে ইংরেজরা। ১৭৫৬ খ্রিস্টাব্দে দাদু আলিবর্দির মৃত্যুর পর ইংরেজদের ক্ষমতাধীন কলকাতা আক্রমণ করে কলকাতা দখল করে দাদুর নামে কলকাতার নামকরণ করেন আলিনগর। পরের বছর ১৭৫৭ খ্রিস্টব্দে ২৩ জুন পলাশির প্রান্তরে মিরজাফর-জগৎশেঠদের বিশ্বাসঘাতকতায় পরাজিত হলেন সিরাজ বাহিনী। ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দেই স্থাপিত হয় কলকাতা টাঁকশাল। কিছুদিন পুতুল শাসকদের অধীনে থাকল বাংলা। মিরকাশিম পুতুল থাকতে না চাওয়ায় বাধল দ্বন্দ্ব। ১৭৬৪-তে বাংলা-বিহার-ওড়িশার শাসনভার লাভ করল ইংরেজ দস্যুপতি ক্লাইভ। তার শাসনের কুফল ফলল অচিরেই। ১৭৭০ খ্রিস্টাব্দে খাদ্যে স্বনির্ভর বাংলায় দেখা দিল ভয়াবহ মন্বন্তর। তিন কোটির মধ্যে মারা গেল এক কোটি মানুষ। মানুষ মানুষের মাংস পর্যন্ত খেল, কিন্তু বাঁচল না। বাঁচল ব্রিটিশের কোষাগার। মানুষ কমল, কিন্তু রাজস্ব বাড়ল। আর দু’বছর পর কলকাতা হল ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী।
৩
চা-তাল বাঙালি সেভাবে জানে না দার্জিলিং তৈরির ইতিহাস। নেপাল-সিকিম-তিব্বত-চিনের বাণিজ্য করতলগত করার লক্ষ্যে দার্জিলিংয়ের বিকাশ ঘটান নেপাল দরবারে থাকা ব্রিটিশ প্রতিনিধি ব্রায়ান হজসন। কলকাতা থেকে পিকিং প্রায় ২৮৮৯ মাইল বিসর্পিল পথ পরিক্রমা করেছিলেন হজসন। যার অধিকাংশটাই পদব্রজে। ব্রায়ান জনসনের এই পরিক্রমা, ইংরেজদের বাণিজ্য সম্ভাবনা এবং ইংল্যান্ডের আবহাওয়া উপযোগী বাসস্থানের পরিকল্পনা হিসেবে দার্জিলিংয়ের বাস্তবতাকে জীবনদান করেন। কলকাতা,—রাজধানী, আর গ্রীষ্মাবকাশে রাজধানী—দার্জিলিং দুটোই বাবুদের পীঠস্থান হয়ে উঠল।
আঠার শতক পর্যন্ত বাংলার প্রধান লেখকরা কেউ কলকাতাবাসী নন। এমনকি উনিশ শতকে দাঁড়িয়ে মধুসূদন, বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথরা তাঁদের সাহিত্য সৃষ্টির একটা বড় অংশ করেছেন কলকতার বাইরে। দীনবন্ধু মিত্র সম্পর্কেও একই কথা প্রযোজ্য।
৪
উনিশ শতকে ক্রমশ বাড়ল কলকাতার গুরুত্ব। বাড়ল কেন্দ্রীকরণ। বিপ্রদাস পিপলাই কলকাতার নাম উল্লেখ করেছেন। কিন্তু কলকাতা তো তখন তেমন কোনও গুরুত্বপূর্ণ স্থান নয়, যে লেখকেরা বাস করবেন।
বাংলার ইতিহাস সুপ্রাচীন। অতুল সুর জানাচ্ছেন, বাংলার ইতিহাস পাঁচ হাজার বছরের পুরোনো। ধান আবিষ্কার করে অবিভক্ত বাংলায় আদিবাসীরা। বিহারের সারণ (ছাপড়া) জেলায় প্রথম পাওয়া যায় ধান। ৩৫০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে। অর্থাৎ সাড়ে পাঁচ হাজার বছর আগে। ‘বঙ্গ’ শব্দের অর্থ কাপাস তুলো। ‘বঙ্গাল’ শব্দের অর্থ—কাপাস তুলো সমৃদ্ধ দেশ। চর্যাপদে কাপাস তুলোর উল্লেখ আছে বারে-বারে।
চর্যাপদের কবিরা কেউ রাজধানীবাসী নন। গ্রামীণ জীবন, গ্রামীণ পটভূমি তাদের কবিতার প্রধান আশ্রয়। চর্যাপদ দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীতে রচিত। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ অবশ্য মনে করেন অষ্টম থেকে দশম শতাব্দীর রচনা।
চতুর্দশ শতাব্দীর ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ লেখক বড়ু চন্ডীদাস, ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়’ লেখক মালাধর বসু রাজধানীবাসী নন। ‘রামায়ণ’ অনুবাদক কৃত্তিবাস থেকেছেন নবদ্বীপ নগরে নয়, নদিয়ার শান্তিপুরের কাছে ফুলিয়া গ্রামে।
এমনকী অষ্টাদশ শতাব্দীর কবি ভারতচন্দ্র বাস করেছেন শ্যামনগরের মূলাজোড়ে, ফরাসডাঙ্গায়। রাজধানী কৃষ্ণনগর তাঁর প্রধান আশ্রয়স্থল নয়। দিক বদলের সূচনা হল উনিশ শতকে ব্রিটিশ রাজত্বে। ১৭৭২ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা হল বাংলার রাজধানী। কিন্তু কোন লেখক পোষণ তো ব্রিটিশ রাজপুঙ্গবদের উদ্দেশ্য নয়। কোন লেখক পৃষ্ঠপোষণা পেলেন না। উল্টে উনিশ শতকে বঙ্কিমচন্দ্র ‘আনন্দ মঠ’ লিখে পেলেন বদলির ঘনঘন আদেশ। ৬ বছরে ১৩ বার। রংপুর থেকে পাটনা। পাটনা থেকে বাংলা মাত্র ৬ মাসে। মাল খোলা আর গোছানোর সময় পাবেন কখন? আর বঙ্কিমের দাদা সঞ্জীবচন্দ্রের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের চাকরিই তো স্থায়ী হল না। প্রসঙ্গত বাংলায় ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ভারতীয়দের পদে নিয়োগ শুরু হয় ১৮৬৪ (?) খ্রিস্টাব্দে। আর ডিস্ট্রিক্ট কালেক্টর পদটি তৈরি করেন ১৭৭২ খ্রিস্টাব্দে ওয়ারেন হেস্টিংস। কিন্তু সেটি সংরক্ষিত ছিল ব্রিটিশদের জন্য। চিত্তব্রত পালিত ‘বাংলার সমাজচিত্রে কলকাতা’ গ্রন্থে এর বিবরণ দিয়েছেন।
১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দের ১ মার্চ রেগুলেশন অনুযায়ী চালু হয় চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। কলকাতার বহু ব্যবসায়ী, দেওয়ান, মুৎসুদ্দি নিলামে ওঠা জমিদারি কেনন। তাদের অর্থের সঙ্গ যোগ হল বাংলা লুঠের সম্পদ। রাইটার্স বিল্ডিং, ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ, লালবাজার, হাওড়া রেলওয়ে কেন্দ্র, জিপিও, তারঘর, এশিয়াটি সোসাইটি ঘিরে বহু অফিসার-কেরানি-কর্মচারীর আবাসস্থল কলকাতা। বাংলার প্রধান ব্যবসায়ী কেন্দ্রও হল কলকাতা। আর উনিশ শতক থেকে বাংলার সংস্কৃতিও হয়ে উঠল কলকাতামুখী। যাত্রাকে প্রতিস্থাপিত করল নাটক। যে নাটকের জন্য ব্রিটিশ রাজের বিন্দুমাত্র অবদান নেই। রাশিয়ান হেরাসিম লেবেদফ ১৭৯৫ খ্রিস্টাব্দে গড়লেন থিয়েটার হল। ১৮৫০-এর পর থেকে একে একে কলকাতায় নানা রঙ্গমঞ্চ।
৫
১৭৬৫ থেকেই বাংলায় নানা বিদ্রোহ। তার কোনওটার কেন্দ্রেই নেই কলকাতা। ১৮১১ থেকে ১৮৫৬ পর্যন্ত অসংখ্য সাঁওতাল বিদ্রোহ। ১৮৩১-এ কলকাতার কাছে বারাসতের অদূরে নারকেলবেড়িয়ায় হল জঙ্গ।
কলকাতা উদাসীন।
১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে সরকারের ক্ষীর-ননীর ভাগ নিতে কলকাতার বাবুকুল ছেলেদের জন্য গড়লেন কলেজ—হিন্দু কলেজ। শুধু বর্ণহিন্দুরা পড়বেন—এই বাসনা। হীরা বুলবুলের ছেলের ভর্তি নিয়ে লাগল বিবাদ।
ধর্মসংস্কার আন্দোলন এক অর্থে বাংলার প্রথম রাজনৈতিক আন্দোলন। ব্রিটিশরা তুষ্ট হবে, অথচ বাংলার বাবুদের সংস্কৃতিবোধ প্রসন্নতা লাভ করবে, এই আকাঙ্ক্ষায় দৃঢ়সংস্কার আন্দোলন।
ইংরেজ অনুগতরা ভাগ হয়ে গেলেন দু’ভাগে।
১৮৩৭ খ্রিস্টাব্দে আদালতে ইংরেজি চালু হল। ফার্সি শিক্ষায় পড়ল ভাটা। হিন্দু-মুসলিম দূরত্ব বেড়ে গেল আর। সরকারি চাকরি থেকে মুসলিমরা কার্যত গেল হটে।
এই সময়েই জর্জ টমসনের পরামর্শে জমিদার সম্প্রদায় গড়লেন ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন (১৮৪৬)।
৬
১৮৩৭-র সিপাহি বিদ্রোহে কলকাতার বাঙালি ইংরেজ ভজনায় ব্যস্ত। ১০ বছর পরে হিন্দু-মুসলিম দূরত্ব বাড়াল হিন্দু মেলা। সরকার সন্তুষ্ট।
১৮৭৩ পাবনা প্রজা বিদ্রোহ। কলকাতার বুদ্ধিজীবী সমাজ প্রতিক্রিয়াশীল ভূমিকায়। মীর মোশাররফ হোসেন কলকাতা থেকে দূরে বসে লিখলেন ‘জমিদার দর্পণ’ ক্ষুব্ধ বঙ্কিম।
১৮৮৫ খ্রিস্টব্দে কলকাতায় প্রতিষ্ঠা হল জাতীয় কংগ্রেস।
১৯০৫-এর বঙ্গভঙ্গ ঘিরে কলকাতার রাজনীতি উঠল জমে। পূর্ববঙ্গে যাতে চলে না যায় ক্ষীর দুধ ননী—তীব্র হয়ে উঠল আন্দোলন।
পরবর্তীকালে সন্ত্রাসবাদী রাজনীতির সুবাদে কলকাতা এল রাজনৈতিক পটভূমির কেন্দ্রে।
১৯১১-তে বিহারকে বাংলা থেকে বিচ্ছিন্ন করা হল। এই বছরেই কলকাতা থেকে দিল্লিতে রাজধানী স্থানান্তরিত করে ইংরেজরা। এর প্রতিবাদে নদিয়ার ছেলে বসন্ত বিশ্বাস রাসবিহারী বসুর পরামর্শে বোমা মারেন দিল্লির শোভাযাত্রায়।
ইলবার্ট বিল (১৯১৮), সাইমন কমিশন (১৯২৮), রাউলাট কমিশন (১৯১৯) ইত্যাদি ঘিরে কলকাতাই হল বিক্ষোভের আসল ঠিকানা।
৭
বিদ্রোহ শব্দের অর্থ অনিষ্টাচারণ, বিদ্বেষ, হিংসা। নগেন্দ্রনাথ বসু ব্রিটিশ রাজত্বে বসে ‘বিশ্বকোষ’ প্রণয়ন করতে বসে এর বেশি ভাবতে পারছেন না। বিদ্রোহী শব্দ সেখানে অনুপস্থিত। আছে, বিদ্রোহিন। যার অর্থ অনিষ্টকারী, বিদ্বেষকারী, হিংসাকারী।
আর ‘বিশ্বকোষ’ গ্রন্থে প্রতিবাদ শব্দের অর্থ ১. প্রতিকূলে উক্তি, বিরুদ্ধে বলা ২. আপত্তি। (বিশ্বকোষ। খণ্ড ১২।। পৃ. ২৯৬।। পুনর্মুদ্রণ ১৯৮৮)।
আরবি শব্দ ‘ইনকিলাব’-এর অর্থ বিপ্লব, বিদ্রোহ, আন্দোলন (পৃ. ৩৫, বাংলা ভাষায় আরবি ফার্সি তুর্কি হিন্দি উর্দু শব্দের অভিধান)
ফরাসিতে ‘প্রোতেসতাসিও’—শব্দের অর্থ ‘প্রোটেস্ট’ (হারাপস ফ্রেঞ্চ-ইংলিশ ডিকশনারি, পৃ. ৩০৭, পুনর্মুদ্রণ ১৯৮৭)।
হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ গ্রন্থে জানাচ্ছেন—
১. প্রতিকূলবচন, বিরুদ্ধবাদ। ২. প্রত্যাখ্যান। ৩. প্রতিবচন, উত্তর।
প্রতিবাদী শব্দের অর্থ—১. প্রতিকূলবাদী, বিরুদ্ধবক্তা। ২. প্রত্যাখ্যাতা। ৩. উত্তরদাতা প্রতিপক্ষ, প্রত্যর্থী বিরোধী, শত্রু (বঙ্গীয় শব্দকোষ ২য় খণ্ড, সাহিত্য অকাদেমি, পৃ. ১৩৭৯, ১৯৬৬, পুনর্মুদ্রণ ১৯৭৮)।
৮
বাংলার রাজনীতি তথা রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে কলকাতার অবদান আলোচনায় ইতিবাচক দিক যেমন অনেক, নেতিবাচক প্রতিক্রিয়াও কম নয়।
কলকাতা হয়ে উঠেছে বাংলার সর্বস্ব এবং সর্বনাশ।
মহাত্মা অশ্বিনীকুমার বরিশালে বসে মহাত্মা উপাধি পেয়েছিলেন, কিন্তু বাংলার নেতা হতে পারেননি। কলকাতায় বসে কলকাতার দপ্তরে না বসে নেতা হওয়া বড় কঠিন।
কংগ্রেসি রাজনীতিতে তবু গণি খান মালদহের নেতা হয়ে রাজ্যের নেতা পেরেছেন, মালদহ-ই থেকেছে তার কার্যত সদর দপ্তর। কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টি প্রভাবিত বামপন্থী রাজনীতিতে এটা একটা অসম্ভব ঘটনা। মফস্সলের মানুষ, রাজ্যের নেতা হতে পেরেছেন তখন-ই যখন কলকাতার বাসিন্দা হয়েছেন।
প্রমোদ দাশগুপ্ত, সরোজ মুখোপাধ্যায়, বিনয় চৌধুরী—সবার ক্ষেত্রেই একথা প্রযোজ্য।
৯
এর বিপদ হচ্ছে এই, গ্রাম বাংলা মফসসলের মানুষ কী ভাবছে তার কোন প্রতিফলন ঘটছে না পার্টিতে, সরকারে।
বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, মুর্শিদাবাদ, নদিয়া, উত্তরবঙ্গ—মাঠ ভরাবে, বিধানসভা ভরাবে—কিন্তু কখনো নিয়ামক শক্তি হতে পারবে না।
পেটি বুর্জোয়া মানসিকতাময়তায় কলকাতা প্রাধান্য।
তাই উত্তরবঙ্গের কোনো প্রতিনিধি সি পি এমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীতে নেই (এখন হয়েছেন ২০১৬-র পর)।
১০
আর এই পেটি বুর্জোয়া মানসিকতা থেকেই ইংরেজি ভাষার প্রাধান্য। কমিউনিস্ট পার্টি এবং মধ্যবিত্ত সমাজে ইংরেজি জানা লোকে প্রভূত প্রাধান্য। অনেকেই মনে করেন, আমি তেমন ইংরেজি জানি না বলে, আমার তেমন উন্নতি হল না।
প্রকাশ কারাত, সীতারাম ইয়েচুরি কেন বড় নেতা? পার্টি নেতাদের ধারণা, ওরা ভাল ইংরেজি জানেন বলে।
রাজ্য শাসন করে কলকাতার মানুষ। এখন বলা ভালো দক্ষিণ কলকাতা।
এরা সবাই ভালো ইংরেজি জানেন না, তাই আশা ছিল ইংরেজি প্রাধান্য কমবে প্রশাসনে। কিন্তু তা হল কই? ভুল ইংরেজি বলব, তবু ঠিক বাংলা বলব না—এই হচ্ছে মানসিকতা। খুব কম নেতা আছেন যাঁরা বাংলা বলার সময় বাংলা বলেন। কেন বলেন না, তাঁরাই জানেন, এখন তো আবার ফর্মান জারি হয়েছে, ইংরেজিতে সই করতে হবে। একি রে বাবা, বাঙালি বাংলায় সই করতে পারবে না!
১১
সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম হবে, গ্রাম বাংলা দখল করে নেবে তৃণমূল…কলকাতার এক লালবাড়ি থাকবে নিরুত্তর। জানবেও না তারা, চিনবেও না তারা কি দুঃখ মানুষের।
১২
কলকাতা আমাদের গিলে খেয়েছে। গিলে খাচ্ছে বাংলা ভাষাকেও। বইমেলাতে ইংরেজি বইয়ের বিক্রি বাড়ছে। ভাষা ও চেতনা সমিতি ১৯৯৯ এ আন্দোলন করেছিল, বইমেলায় সব মণ্ডপে বাংলায় নাম লিখতে হবে। এবার তো দেখছি আন্দোলন করতে হবে সব মণ্ডপে বাংলা বই রাখতে হবে—এই দাবিতে। কলকাতার প্রশংসা না মিললে আজ কেউ সাহিত্যিক হয় না। কেউ বড় নেতাও। কবে বের হতে পারবো এ থেকে। কে জানে? আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি তার উত্তর দেবে?
দিতে হবে। কিন্তু কতদিনে—সেটাই দেখার।
সেই সংবাদের অপেক্ষায় থাকা?
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন