ইমানুল হক
ঘটনা-১
১৯৭৫-এর এক রাত। মাঝরাতে ঘুম ভেঙ্গে যায় ৯ বছরের এক বালকের। ঘুম ভাঙ্গা চোখে দেখে, মা ব্যস্ত একটি বালিশ ছিঁড়তে। বালিশটি ছিঁড়ে তার মধ্যে পুরে সেলাই করে দেওয়া হচ্ছে লাল রঙের একটি পতাকা। আর বড়দা এবং মেজদি ব্যস্ত দেওয়ালের ওপর ইংরেজি রোমান হরফে লাল রঙে লেখা ‘সি পি এম’ শব্দটি মুছতে। কোনদিন মেজদি নিজের খেয়ালে লিখেছিল, শব্দটি। খবর এসেছে আজ রাতে আবার সি আর পি তথা কেন্দ্রীয় বাহিনী আসতে পারে। ছেলেটির বাবা ছিল রাজনীতির কারণে ফেরার।
কয়েকদিন পর বাড়িতে এল একটা চিঠি। লাল রঙের। ক্রোকের নোটিশ। ব্যাঙ্কের। গ্রামের কিছু সম্পন্ন চাষী এক ফসলি জমিতে দুবার চাষ করবে বলে শ্যালো (অগভীর নলকূপ) বসিয়েছিলেন। রাস্টন, কির্লোস্কার-এর তৈরি সে সব শ্যালো ‘ফেল’ করে যায়। জল ওঠে না। চাষীর স্বপ্ন পূরণ হয় না। কিন্তু ব্যাঙ্কের ঋণ বেড়ে যায় সুদে আসলে। আসতে থাকে চিঠি, জমি ক্রোকের। এর পাশাপাশি আসতে থাকে সরকারি চিঠি। দাদা পড়াশোনার জন্য বাইরে। বালকটি পেত ডাক হরকরা বা চৌকিদারের হাত থেকে চিঠি। তার রং-ও লাল। তাতেও বকেয়া খাজনা এবং জল কর না দিলে ক্রোকের হুমকি।
লাল রঙ-এ তাই আতঙ্ক ধরে যায় বালকটির।
ঘটনা-২
ভাদ্র মাস। প্রচণ্ড গরম। গ্রামে ঘরের দাওয়ায় বসে আছেন ১০-১২ জনের একটি দল। কাজ চান তাঁরা। কাজ না দিতে পারলে অন্তত সের খানেক চাল বা গম। বাকিরা চলে যান, কিছু না কিছু নিয়ে। একজন কেবল বসে থাকেন কিছু না বলে। সুদর্শন, গায়ের রঙ সাহেবদের মতো দুধে আলতা। রোদে পুড়ে অন্যরকম দেখাচ্ছে।
—কি খবর রে মাফুজ? জিগ্যেস করেন, বালকের মা।
মাফুজ মৌন, নিরুত্তর। অনেক তাগাদায় জানা যায়, মাফুজ কাজ করতেন কলকাতায় বেঙ্গল পটারিতে। কারখানা লক আউট, বাড়ি ফিরেছেন, তিনদিন খাওয়া নেই। কাউকে বলতে পারেননি। তাই আজ বাড়ির লোকের কথা ভেবে এসেছেন এ বাড়িতে। যদি কিছু গম মেলে, নুন দিয়ে ‘জাউ’ করে খাবেন। মাফুজ বলতে পারেন না, আর। চোখের জল টপটপ করে গড়িয়ে পড়ে। চাল নিয়ে ফেরেন তিনি, এর পরে।
ঘটনা-৩
১৯৭৬। ছেলেটি ক্লাসে প্রথম হয়। তবু তার চিন্তা যায় না। সাফল্যের দুশ্চিন্তা অনেক বেশি, ফল বের হওয়ার দিন নাম ডাকা হচ্ছে। সেকালের প্রথা অনুযায়ী শেষ থেকে ডাকা। দ্বিতীয়-র নামও ডাকা হয়ে যায়। তার নাম আর ডাকা হয় না। কিন্তু সে বুঝতে পারে, সে প্রথম হয়েছে। কারণ প্রথমের নাম ডাকা হয়নি। তার মাইনে জমা পড়েনি। এবার শুখার বছর। প্রথম হয় বলে তিন মাসের মাইনে আর পরীক্ষার ফি কেবল দিতে হয়। বছরে ২৬ টাকা ৭৫ পয়সা। দরদর করে চোখের জল গড়িয়ে পড়ে। প্রগতিপত্র বা মার্কশিট দেওয়ার অনুরোধও সে করে উঠতে পারে না।
ঘটনা-৪
আজ যখন ৩৪ বছরের ‘অপশাসনে’-র কথা ওঠে তখন বালক বয়সের কথা মনে পড়ে। ১৯৭৭-এ একটি সরকারের ক্ষমতায় আসা কীভাবে বদলে দেয় মানুষের জীবন। ব্যাঙ্ক ঋণ মকুব হয়, মকুব হয় বকেয়া খাজনা, শুধু তাই নয় তিন একর পর্যন্ত জমির খাজনা মকুবের আদেশ শুনিয়ে যান, ‘আপনারা সবাই শোনো’ বলে মুকুন্দ চৌকিদার। দশম শ্রেণি পর্যন্ত বিনা বেতনে পড়ার সুযোগ মেলে গরিব, মধ্যবিত্ত, বড়লোক—সব ঘরের ছাত্র-ছাত্রীর। লাল রং আর আতংকের থাকে না। প্রিয় হয়ে ওঠে অন্য লাল। বাম আমলে জ্যোতি বসু-র সরকারে অশোক মিত্রের অর্থমন্ত্রিত্বে ঘটে এই ঘটনা।
সে সব কথা কেন যে আজ কেউ বলে না।
গ্রামে খুব কম মানুষ ছিলেন যাঁরা ছেলে মেয়েদের বছরে দু’বার জামা কাপড় কিনে দিতে পারতেন। সরপি দেওয়া, তালি মারা, রং চটা সেলাই করা পোশাক ছিল স্বাভাবিক ঘটনা। জুতো পরে বিদ্যালয়ে আসতে দেখা যায়নি, ছোটবেলায়। সেটা ছিল বড়লোকিপনা। একজন সপ্তম শ্রেণিতে জুতো পরে বিদ্যালয়ে আসায় ছেলে-মেয়েরা তো বটেই স্যাররাও ‘বাবু’ বলে হাসি ঠাট্টা করেন। সে সময় ১৯৭৭ থেকে মেয়েরা বিদ্যালয়ে এলে দু’প্রস্থ করে পোশাক পেতে থাকে। সবুজ স্কার্ট, সাদা জামা। (লাল নয়, সবুজ রং)। মেয়েরা জামা পরে বলে বিদ্যালয়ে আসতে শুরু করে বেশি সংখ্যায়। রাজ্যে এমনি নারী শিক্ষা বাড়েনি। গ্রামে ১৯৭৭-এর আগে দিন মজুরি করে পাওয়া যেত দিনে ৮০ পয়সা থেকে এক টাকা মানে মাসে ২৪ থেকে ৩০ টাকা। আর এক সের চাল। সে চালের সেরের তলায় আবার অনেক মালিক কাদা দিয়ে রাখত। কার্যত ৫০০-৬০০ গ্রাম, চাল মিলতো। সবদিন কাজ মিলত না। না খেয়ে কাটত বছরের বেশিরভাগ দিন। খাওয়া বলতে গেঁড়ি গুগলি, চুনো মাছ, আঁদাড়ে পাদাড়ে বনে বাদাড়ে থাকা মেটে আলু, কচু, ওল, শুসনি, কলমি শাক, শাঁপলা সেদ্ধ, আর কখনো-সখনো ফ্যান ভাত, চালের খুদ ভাঙার খিচুড়ি, মাইলো-যব-গমের জাউ, (আজ যা বড়লোকের মেদ কমানোর জন্য ওটস জাতীয় খাবার)। ধান রোয়া আর কাটা ছাড়া কাজ কই? বছর ভর কৃষাণের কাজ তথা বাঁধা মাইনের কাজে মিলতো ২০০ টাকা আর ১২ মন ধান। কিন্তু সম্পন্ন গ্রামেও ১০-১২ জনের বেশ লোকের কৃষাণ রাখার ক্ষমতা ছিল না। অনেক সম্পন্ন চাষিকে দেখেছি ছোটবেলায়, কার্তিকের শেষ আর অগ্রহায়ণের শুরুতে নিজেদের মধ্যে নতুন ধান বিনিময় করতে। ধান কাটার পর জমিতেই ঝেড়ে অন্যকে ধার দেওয়ার প্রথা। তার ধান উঠলে সে আবার অন্যকে দেবে। সারা বছর ধানের মরাই (গোলা) বাঁধা থাকতো এমন চাষি এক শতাংশের বেশি ছিল না। যারা সুদে টাকা খাটাত তারা অবশ্য একটু ভাল অবস্থায় ছিল। সে সময় বামফ্রন্ট সরকার ঠিক করে তপশিলি জাতির ছেলে মেয়েরা বিদ্যালয়ে এলে মাসে ২০ টাকা করে পাবে। বছরে ২৪০ টাকা। মাসে মাসে মিলতো না। বছরে দুবার। ১২০ টাকা করে। আজকে ভাবা যাবে না, কিন্তু ১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দে গরিবঘরে একসঙ্গে ১২০ টাকা অনেক টাকা। এক থেকে দেড় কুইন্টাল চাল কেনা যায়। ২ থেকে ৪ কাঠা জমি কেনা যায়। বাবা মা দেখলেন, বাগালি করার থেকে বিদ্যালয়ে পাঠালে রোজগার বেশি। সম্ভবত ১৯৮০ থেকে শুরু হল প্রাথমিক বিদ্যালয়ে টিফিন দেওয়া। কোথাও পাউরুটি-কেক কোথাও অন্যকিছু। কিছু জায়গায় কিছু অনিয়মের খবর এলেও এতে সাড়া পাওয়া যায় ভাল। খাবারের জন্যও অনেকে পড়তে এল। খালি পেটে বিদ্যে শিক্ষে হয় না, এটা অনেক মধ্যবিত্ত স্বার্থপর লোক বুঝতে চান না। (যদিও মুনি ঋষিরা বুঝতেন—’অন্নই ব্রহ্ম’ গল্প তার প্রমাণ)। খাবার দেওয়াটা জরুরি। আজকের দিনের ‘মিড ডে মিল’-এর অনেক আগে প্রথম বামফ্রট’ সরকার এই কাজ শুরু করেছিল।
সংখ্যালঘু ছাত্র-ছাত্রীদের কোন বৃত্তি আগে দেওয়া হতো না। বাম আমলেও হয়নি। কিন্তু পড়তে আসার সংখ্যা বাড়ল। কারণ খেতমজুরদের ন্যূনতম বেতনের দাবিতে বহু ধর্মঘট হয়। দু’টাকা আর দু’কেজি চালের দাবি জয়যুক্ত হয়। কিন্তু বহু জায়গায় কার্যত মেলে দেড় টাকা আর দেড় কেজি চাল। খেতমজুরদের একটা বড় অংশ ছিলেন সংখ্যালঘু ও দলিত। আর এর পাশাপাশি পঞ্চায়েতের উদ্যোগে রাস্তা তৈরি, পুকুর ও নর্দমা সংস্কার বা নির্মাণ, খেলার মাঠ তৈরির মতো নানা কাজ শুরু হয়। ‘কাজের বিনিময়ে খাদ্য’ প্রকল্পে গম মেলে। সততার সঙ্গে, হ্যাঁ সততার সঙ্গে, বহু গ্রামে কাজ হয়। এমনও হয়েছে ৩০০ টাকা এসেছে, কাজ হয়েছে ৩০০০ টাকার। গ্রামের সব মানুষকে নিয়ে। অন্য দলের মানুষ প্রথমে অনিচ্ছুক থাকলেও যোগ দিয়েছেন, রাস্তা নির্মাণে। তাঁদের কাউকেই কোষাধ্যক্ষ করা হয়েছে। এমনি গ্রামের চেহারায় বদল হয়নি। আজ বোঝা যাবে না, গ্রামের রাস্তা কী ছিল? এক হাঁটু কাদা বর্ষা থেকে আশ্বিন মাস পর্যন্ত। তাই, মানুষ স্বেচ্ছাশ্রম দিয়েছেন। খেতমজুররা মজুরি নিয়েছেন, মধ্যবিত্ত যুবক গরুর গাড়িতে কাটা মাটি এনে ফেলেছেন, কোদাল চালিয়ে বহু মাটি সমান করেছেন। এ যেন ছিল চিন চিং মাই-এর চিনা উপন্যাস, ‘বিপ্লবের গান’-এর এক ক্ষুদ্র সংস্করণ। বামপন্থী ছাত্র সংগঠন ও নেতা এবং প্রিয়ব্রত দাশগুপ্তদের মত আদর্শবান কিছু অধ্যাপকের অবদানও না বললে অন্যায় হবে। এরা এন এস এস-এর নামে বহু গ্রামে পড়ে থেকে, মশার কামড় খেয়ে রাস্তা তৈরি করেছেন। শুধু সেমিনার করেননি।
ঘটনা-৫
আমার বলার কথা এই, খেতমজুররা খাবার ও জমি পেলে ছেলে মেয়েরা পড়তে এল। (প্রসঙ্গত, পশ্চিমবঙ্গে সি পি এমের খেতমজুর সংগঠন ছিল না যাঁরা বলেন, তাঁরা তথ্য বিভ্রান্তির স্বীকার, খেতমজুর সংগঠন ৮০-র দশকের শুরুতেও ছিল। ১৯৭৮-এ গড়ে ওঠে)। বছরে দু’মাস কাজ মিলত, বাম জমানায় মিলল প্রথমে ছয় মাস। পরে সারা বছর। এখনও বহু গ্রামে সহজে খেতমজুর মেলে না। আর আগে সংখ্যালঘু মানসিকতা ছিল পড়ে কোন লাভ নেই, চাকরি দেবে না। বামপন্থীদের জাতপাতহীন ধর্মনিরপেক্ষ মানসিকতা এ ভাবনায় খানিকটা বদল আনে। ফলে তাঁদের ঘরের ছেলে-মেয়েরাও পড়তে এল। আগে গ্রামে সংখ্যালঘু পরিবারে মধ্যবিত্ত হলে ১৩-১৪, গরিব হলে ১১-১২ বছর বয়সেই মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেওয়া হতো। ‘হিন্দু’ পরিবারে এই বয়স ছিল যথাক্রমে ১৬-১৭, ১৩-১৪। এখন এটা ভাবাই যাবে না। ১৮ বছরের আগে বিয়ে খুব কম জায়গাতেই হয়। কুড়িতেই বুড়ি—এই শ্লোগান অচল করে দিয়েছিল বামফ্রন্ট সরকার। ২৪-২৫ বছর বয়সে বিয়ে এখন স্বাভাবিক ঘটনা। ‘অরক্ষণীয়া’র দিন শেষ করায় বামপন্থীদের ভুমিকার কথাও কেউ বলে না। প্রথম দিকে পণ নেওয়ার বিরুদ্ধে প্রচারে কাজ হয়েছিল। পরে অবশ্য তা অদ্ভুতভাবে বদলে গেল। পণ নেওয়া ও বেশি নেওয়া স্বাভাবিক হয়ে গেল। এছাড়া আরেকটা বিষয় বলা দরকার, গরিব আদিবাসী বা তপশিলি জাতিভুক্ত মানুষের পাড়াগুলোতে মদ্যপান ছিল স্বাভাবিক ঘটনা। তার বিরুদ্ধেও প্রচার চলে। এর ফলও ফলে। এবং প্রতিবেদকের অভিজ্ঞতা এখন এই, আদিবাসী তপসিলি পাড়ায় মদ খায় হাতে গোনা লোক, এর চেয়ে সাধারণ মধ্যবিত্ত যুবকরা মাতাল বলে পরিচিতি না পেলেও মদ খায় অনেক বেশি। পূজা-পার্বণ উৎসব মানেই একদলের কাছে মদ গাঁজা নেশার বাহানা। শিক্ষিতের হার তপশিলিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ভাবে বেড়েছে। একই কথা প্রযোজ্য সংখ্যালঘুদের ক্ষেত্রেও। আর নারীশিক্ষার হারে তো লক্ষণীয় উন্নতি বাংলায়।
বামফ্রন্ট ১৯৭৭-এর পর ক্ষমতায় আসার পর খাস জমি দখল ও বিলির আন্দোলন চলে। এতে বহু প্রান্তিক ও ভূমিহীন মানুষ জমির অধিকার পান। সমবায় পদ্ধতি চালুর চেষ্টাও হয়। এই প্রতিবেদক নিজে বর্ধমানের খণ্ডঘোষ থানার কামদেবপুর গ্রামে চাষিদের মধ্যে সমবায় প্রথায় চাষ নিয়ে উন্মাদনা প্রত্যক্ষ করেছে। কিন্তু কেন তা ঝিমিয়ে পড়ল, তা গবেষণা ও শিক্ষার বিষয়। বুদ্ধিমান ও প্রতিভাবান ছেলেদের মধ্যে একজনের জন্য খুব আফশোস হয়। গেঁড়া (ভালো নাম মনে নেই)। প্রয়াত বড়দির শ্বশুরবাড়ির গ্রামের ছেলে। তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ত। ১৯৭৪-এ। গেঁড়ার বাবা মারা যাওয়ায় তার পড়া বন্ধ হয়ে যায়। বাগালি করে দিন কাটে। গেঁড়ার অংকে ছিল দারুণ মাথা। যখন সমবায় প্রথায় চাষ শুরু হল, ১১ বছরের গেঁড়ার কী বিপুল উৎসাহ! দিন বদলের পালার স্বপ্নে সে বিভোর। চাষীদের গড়া মাচা এবং ঘরে গভীর রাত পর্যন্ত কাটিয়েছি, তার সঙ্গে। (গ্রামীণ মধ্যবিত্ত পরিবারে এ স্বাধীনতা আর বালকদের নেই। পড়া বা টিভি-র ঠেলায় এখন সব অলীক)।
ঘটনা-৬
যে মানুষ খেতে পায়, সে তার ছেলে মেয়েকে নিরক্ষর রাখতে চায় না। প্রথম শ্রেণিতে পড়ার সময় আমাদের সঙ্গে পড়ত ১৫৭ জন ছেলে মেয়ে। ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দ। ক্লাসে প্রথম দ্বিতীয় হত মেয়েরা। (পরে তারা আর তৃতীয় বা চতুর্থ শ্রেণির পর দারিদ্রের কারণে পড়েনি)। দ্বিতীয় শ্রেণিতে সেটা দাঁড়াল ৪৬। তৃতীয় শ্রেণিতে ৩৭। চতুর্থ শ্রেণিতে ১৭। আর বৃত্তি পরীক্ষার পর ১৫ জন। এর মধ্যে ৯ জন মাধ্যমিক পর্যন্ত যায়। আমাদের গ্রামের সেই প্রথম একসঙ্গে এতজনের মাধ্যমিক পড়তে যাওয়া। ১৯৮০-তে।
গ্রামে জুনিয়র হাইস্কুল ছিল। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত। মোট ছাত্র ছিল, চারটি ক্লাশ মিলিয়ে ৬৭ জন। নবম শ্রেণিতে পড়তে যেতে হয়েছে ৬ কি মি দূরের বিদ্যালয়ে, গ্রীষ্মকালে সাইকেল। বর্ষায় হেঁটে যাওয়া আসায় ৬+৬ মোট ১২ কিমি রাস্তা হাঁটা।
বিশ্বাস হবে কিনা জানি না, গ্রামে তখন মোট সাইকেল ছিল ১২টা। ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দে। আজ চারচাকা গাড়ির সংখ্যা অন্তত ৫০টি। ঘরে ঘরে মোবাইল। টিভি। সাইকেল তো এখন বাড়ির মেয়েরাও চড়ে। ফলে একাধিক সাইকেল তো আছেই। গ্রামে লোকে কুটুম বাড়ি যেতে ফুল প্যান্ট ধার করতো। ঘড়ি চেয়ে নিয়ে যেতো। ইস্ত্রি ছিল বড় জোর ৪-৫টি বাড়িতে। সাইকেল চাওয়া তো ছিল আকছার ঘটনা। কয়লার উনুনে রান্না ছিল শতকরা ১০ ভাগ বাড়িতে।
গ্রামে আজ জুনিয়ার হাইয়ের বদলে মাধ্যমিক বিদ্যালয়, সেখানে চার শতাধিক ছাত্র।
ঘটনা-৭
না খেতে পাওয়া লোক নেই। কাজের লোক পাওয়া খুব কঠিন। গৃহ পরিচারিকা ছোট বেলায় খুব সহজেই মিলতো। লোকে রাখার জন্য সাধাসাধি করতো। আজ কলকাতার থেকে বেশি টাকা দিয়েও পাবেন না। (সৌজন্য, ১০০ দিনের কাজ। সে শহুরে বাবুরা যত গালই পাড়ুন, এর বিরুদ্ধে)। মেয়েরা পড়ছে। এ পড়া ১৯৭৭-এর পর জোরদার। কারণ নতুন পোশাক শুধু নয়, বাবার কাছে পয়সা আসা। আর আত্মসচেতনতা ও আত্মমর্যাদা বৃদ্ধি বা বামপন্থীদের অবিস্মরণীয় আদর্শবাদী প্রচার ও শিক্ষার ফসল।
খেতমজুর আন্দোলন, খাস জমি বিলির পাশাপাশি অপারেশন বর্গা, পঞ্চায়েত ব্যবস্থা আর প্রাথমিকে ইংরেজি না থাকার কথা বলতে হবে। প্রাথমিকে ইংরেজি না থাকায় পড়াশোনার ভীতি কেটে গরিব ঘরের প্রথম প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা বিদ্যালয়ে আসে। বদলে যায় গ্রামের অর্থনীতির মানচিত্র। আর গরিবকে মিথ্যে দলিল লিখে ঠকানো যায় না। ৫০ টাকাকে ৫০০০ বানানো যায় না। নিজে অংক কষতে পারে বলে ধান চাল ডিম মুদি মনোহারি পোশাকের ব্যবসা করে অনেকে পয়সার মুখ দেখে। বিভূতিভূষণের ‘ইছামতী’র বহু নালু পাল-রা এখন বাস্তব।
ঘটনা-৮
ইংরেজি দেখিয়ে দেবে কে? ক্লাসে প্রথম দ্বিতীয় হওয়া মেয়েরা বিদায় নিতে বাধ্য হল অভাব আর ইংরেজির চাপে। যাদের ঘরে ভাত ছিল, তাদের ঘরের ছেলেমেয়েরা সেই স্থান নিল। আজকের বিচারে বিধান বাবুদের কি দশা হতো কে জানে। ইংরেজির মাস্টারমশাই ছিলেন বিধানবাবু।
আর বাবা-মা রা মাস্টার মশাইকে বলতেন, খুব করে মারবেন, পড়া না পারলে। (আজকে?)
বিধানবাবু যাকে মারতেন তাকে দিয়েই বাঁশ ঝাড় (পাশেই ছিল আমাদের বাঁশ ঝাড়) থেকে অনেক সময় ছড়ি কাটিয়ে আনাতেন। তার পিঠ লাল না হয়ে যাওয়া পর্যন্ত থামতেন না। মারতে মারতে বেত ভেঙ্গেও ফেলতেন। সেই জন্য দারুণ মাস্টার হিসেবে তাঁর অভিভাবক মহলে খুব খ্যাতি ছিল। কেউ নালিশ কোন দিন তো করেন নি, উলটে জানতে পারলে, দেখা হলে বলেছেন, ‘মাস্টারমশাই বেশ করেছেন, ঠেঙ্গিয়েছেন, পারলে আরো ঠেঙ্গাবেন, যদি মানুষ হয়’ (লক্ষণীয়, বড়ো নয়, মানুষ)। আর ছেলে-মেয়েদের মধ্যে ছিল প্রবল ভীতি। প্যান্টে পেচ্ছাপ করে ফেলতে দেখেছি। তৃতীয় শ্রেণিতে যখন পড়ি, দেখি, একজন চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রীকে হাত ধরে ঘোরানো হচ্ছে পড়া না পারার জন্য, আর ভয়ে তার পেচ্ছাপ ছড়িয়ে পড়ছে চারপাশে বৃত্তাকারে। এ নিদারুণ দৃশ্য প্রাথমিকে ইংরেজ পড়ানোর কথা বললেই মনে আসে। সেই মেয়েটি আর পরদিন থেকে লজ্জায় বিদ্যালয়ে আসেনি। যাঁরা প্রাথমিকে ইংরেজির জন্য কেঁদে ভাসান তাঁরা খোজ নেবেন, আজও গ্রামে (শহরেও) ভালো ভাবে ইংরেজি দেখিয়ে দিতে পারেন, এমন মানুষ ক’জন আছেন। আমার স্কুল বেলায় একটা ইংরেজি আটকালে ছ’কিমি পথ যেতে হতো। তাও দু’দিন বা তিনদিন অপেক্ষা করতে হত। টিউশনির দিনের জন্য। (প্রসঙ্গত, ১৯৯৯ থেকে আবার প্রাথমিকে ইংরেজি চালু হয়েছে। আর শহর-বাজারে ইং-মিডিয়ামের ছড়াছড়ি। বহু সুপণ্ডিত থাকার কথা!)
ঘটনা-৯
চাষীর ছেলেদের ‘বাঁকা কলম’ তথা লাঙ্গল ঠেল গে যা’ ব্যঙ্গ করতেও শুনেছি মাধ্যমিক পড়ার সময় দু’একজন মাস্টারমশাইকে। কিন্তু বামপন্থী আন্দোলনের প্রভাবে এ ব্যঙ্গ পরে বন্ধ হয়ে যায়। এই ব্যঙ্গ বন্ধের পিছনে আজ বুঝি, প্রভাব ছিল ‘সহজপাঠ’ নিয়ে আন্দোলনের। কেন জেলেকে বা চাষিকে আপনি সম্বোধন হবে না—সে নিয়ে তর্ক তুলেছিলেন বামপন্থীরা। বাংলার সামাজিক আর্থিক বদলের ইতিহাসে ‘সহজপাঠ’ আন্দোলনের প্রভাব আলোচিত হওয়া দরকার। সমাজবিজ্ঞানী পার্থ চট্টোপাধ্যায়রা যদি নজর দেন।
ঘটনা-১০
বন্যা হলেই একদল মানুষকে হাতে আঁকা সাপ আর মানুষের খড়ের চাল বা গাছে সহাবস্থানের ভীতিপ্রদ ছবি নিয়ে ভিক্ষে করতে দেখা যেত। ১৯৭৮ এর ভয়ংকর বন্যার পর কিন্তু একজনকেও ভিক্ষে করতে আসতে দেখা যায়নি। বরং গ্রামের মানুষ জল কমলে বের হন পঞ্চায়েত সদস্য বা স্থানীয় বামপন্থী নেতৃত্বের আহ্বানে ত্রাণ সংগ্রহ করতে।
অন্যদের বিপদে পাশে দাঁড়ানোর এ নজির ভুলে যাওয়া লজ্জার। আজকাল প্রায় সবাই সরকারের ভরসায় বসে থাকেন, সেটার বিপরীত ছিল এই ঘটনা। বাবার সঙ্গে ঘুরেছি গ্রামে ত্রাণ সংগ্রহে। দানের এক বিপুল সাড়া দেখেছি তখন। ১২ বছর বয়স। মুড়ি-চিঁড়ে-চাল নিয়ে আমাদের প্রিয় এক কর্মী মানুষ আর কালামের সঙ্গে গিয়েছিলাম ১৩-১৪ কিমি দূরের সুবলদহ গ্রামে (বিপ্লবী রাসবিহারী বসু-র পিতৃভূমি)। বন্যা কত ভয়ংকর হতে পারে, উঁচু এলাকার মানুষের সেই প্রথম দেখা। গিয়ে দেখি চারপাশ জলমগ্ন। প্রায় তিন কিমি রাস্তা সাঁতরে আসতে হয়েছে। ভাবছি সবাই না খেয়ে বসে আছে। গিয়ে দেখি খাদ্যের হাহাকার নেই। কারণ সরকারি ত্রাণ পৌঁছেছে আগেই। পার্টির লোকেরাও সবাই আছেন। কেজি খানেক সাইজের রুইমাছ মাছ বিক্রি হচ্ছিল ৫০ পয়সা কেজি। কিন্তু ক্রেতা ছিল না। বানের জলের মাছ বলে।
ভিখারি গ্রামে আগে ছিল ভালোই। এখানে গ্রামে ভিখারি অনেক কম। ৮০-এর দশক থেকেই ভিখারি কমতে থাকে। শহরে বেড়েছে। কিন্তু ‘তিন দিন খাইনি’ বলে দুঃখী কণ্ঠস্বর খুব কম গ্রামেই শোনা যায়।
ঘটনা-১১
গ্রামে ভিখারি কমার পিছনে আছে প্রথম বামফ্রন্টের একটি ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত। গরিব দুঃস্থ বয়স্কদের জি আর বা জেনারেল সঠিকভাবে বিলি। চাল বা গম দেওয়া হত মাসে মাসে। ১০ কেজি করে। কারা জি আর পাবে সেটা প্রথম দিকে দেখেছি, গ্রামের মানুষদের বৈঠকে ঠিক হত। পরে চলে যায় পার্টি ব্রাঞ্চের হাতে। এটা না গেলেই মঙ্গল হত। এ প্রসঙ্গে মনে পড়ে গ্রামের মানুষের বৈঠক ডাকলে মাঠ ভর্তি হয়ে যেত। মতামত চাওয়া হতো সবার। পরে পার্টির খবরদারি বেড়ে যাওয়ায় জমায়েত কমে গেল। লোকে জানত, মিটিং লোকদেখানি। সিদ্ধান্ত আগেই হয়ে আছে। ফলে মানুষ ক্ষুণ্ণ হয়ে আসা প্রথমে কমালেন। ৯০ দশক থেকে বিরল হল। গ্রাম সংসদ গড়েও তত কাজ হল না।
ঘটনা-১২
১৯৬৭-এর যুক্তফ্রন্ট সরকারের আমলে প্রথার অবসান ঘটেছিল বহু গ্রামেই। রবীন্দ্রনাথের ‘শাস্তি’ গল্পে ছিদাম-দুখিরাম দুই ভাইয়ের বেগার খাটতে যাওয়ার কথা পাঠকের মনে পড়তে পারে। যত গাল খেয়েছিল তত খাবার জোটেনি, খাবার না খেয়েই তো মাথা গরম দুখিরামের। খুন করেই ফেলে বউ রাধাকে। যার জেরে মিথ্যা দোষে জা চন্দরাকে যেতে হয় জেলে। ১৯৭৭-র পর অবসান ঘটে আরেক বিষ প্রথা গতর বন্ধক প্রথা।
অভাবের সময় টাকা বা ধান ধার নিলে, মানে যে সময় চাষের কাজ অর্থাৎ রোয়া বা ঝাড়া থাকে না, সে সময় মজুরির হার কম থাকত, চাষের সময় বাড়ত। কিন্তু যখন ধার নেওয়া হল সেই রেটেই উচ্চ মূল্যের সময় কাজ করতে বাধ্য থাকতেন খেতমজুরটি। শ্রমের অভাবী বিক্রি আর কি! বামেদের আন্দোলন, খেতমজুরির দাম বেঁধে দেওয়া এক্ষেত্রে সুফল আনে। পরে অবস্থা এমন দাঁড়ায়, আগে খেতমজুররা খাতির করত বাবুদের, পরে বাবুদের তোয়াজ শুরু হয়, কাল কাজে যাস বাবা, যেন কামাই করিস না, বলে। ১৯৭৮-এর পঞ্চায়েত নির্বাচনে একটা প্রচার দলহীন গণতন্ত্রী এবং প্রচার মাধ্যম করেছিল ‘ছোটলোকদের মাথায় তোলা’ বলে। তখন গ্রামে আর ক’টা কাগজ যেত, পড়ত-ই বা কজন, বাবুরা তো পড়ালেখা জানতেন। যাঁরা শোরগোল তোলেন, জ্যোতিবাবুর আমলে গোল্লায় গেছে বলে তাঁরা তাঁদের প্রচার সংখ্যার বৃদ্ধির মূলে যে বামফ্রন্টের তথাকথিত ‘ছোটলোকদের মাথায় তোলাটা’ দায়ী—এটা আজ মানবেন কি?
ঘটনা-১৩
বাজারি কাগজ অশোক মিত্রদের ওভারড্রাফট নিয়ে যত চেঁচামেচি করেছে তার এক শতাংশও যদি ইতিবাচক কাজগুলো নিয়ে করত। কেন্দ্র রাজ্য সম্পর্ক পুনর্বিন্যাস বা রাজ্যের হাতে অধিক ক্ষমতার দাবিকে সমর্থন করতো তাহলে দেশের ইতিহাস-ই যেত বদলে। প্রচণ্ড আর্থিক চাপের মধ্যেও বেকার ভাতা দেওয়ার কাজ কিন্তু বামফ্রন্ট-ই প্রথম করে। মাসে ৫০ টাকা, মানে বছরে ৬০০ টাকা। আবার বলছি, আজ ৫০ টাকা কিছু মনে না হলেও ১৯৭৭-এ ৫০ টাকায় ৬০ কেজি চাল বা ১০ কুইন্টাল আলু (হ্যাঁ, ১০ কুইন্টাল, আলু তোলার সময় কিনলে), বা তিন কুইন্টাল বেগুন হতে পারতো। এই সময়ে বাজার দর একটু মনে করিয়ে দেওয়া যাক। এই প্রতিবেদক দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় থেকে হাট বাজারে যেত। তাই দাম মনে আছে।
* নুন ১ কেজি —৮ পয়সা
* ডিম প্রতিটি —৮ পয়সা
* চাল ১ কেজি —৬০/৮০/১০০ পয়সা
* চিনি ১ কেজি —২ টাকা ৪০ পয়সা
* জনতা শাড়ি ১টি —১৩ টাকা
* সরষের তেল ১ কেজি —২ টাকা ৪০ পয়সা
* পোস্ত ১ কেজি —৬ টাকা (পোস্ত-র দাম ছিল বেশি)
* রুই মাছ —২.৫০ টাকা থেকে ৪ টাকা
* পুঁটি/চিংড়ি/চুনো মাছ —৪০ পয়সা সের
* বাঁধাকপি/ফুলকপি —১০-১৫ পয়সা পিস
* কচু ১ কেজি —১৫ পয়সা
* মুরগির মাংস ১ কেজি —২০ টাকা
* খাসির মাংস ১ কেজি ১০ টাকা (ছাপার ভুল নয়, মুরগির মাংসের দাম বেশি ছিল। দ্বিগুণ।)
* আলু যখন উঠতো ২০ পয়সা পাল্লাতেও পাওয়া যেত। মানে ৪ পয়সা কেজি। ১৯৮০-তে আলু আশ্বিন মাসে ৩৫ পয়সা কেজি হওয়ায় হাহাকার পড়ে গিয়েছিল।
আমি এই দর লিখছি আমার জন্মস্থান রায়না থানা এলাকার পলাশন হাটের।
আর ১৯৮১-তে পেঁয়াজ ৪ টাকা কেজি হওয়ায় কংগ্রেস দেওয়াল লিখেছিল—
পেঁয়াজ আপেল একদর
জ্যোতি প্রমোদ মাতব্বর
কলকাতায় বাস ভাড়া ছিল ১০ পয়সা আর ২০ পয়সা।
বেকার ভাতার ৫০ টাকার মূল্য কি বোঝা যাচ্ছে? তবে মাসে মাসে সবসময় মিলতো না। বছরে একসঙ্গে ৬০০ টাকা পাওয়া যেত। আমাদের গ্রামে যারা প্রথমে বেকার ভাতা পান তারা কেউ বামপন্থী ছিলেন না।
ঘটনা-১৪
এই প্রসঙ্গে বলতে হবে আরেকটি কথা। কর্মসংস্থান প্রকল্পের কথা। কর্মবিনিয়োগ কেন্দ্র মারফৎ ঋণ পাওয়া যেত। একটু আগে দেখেছেন, মুরগির দাম ২০ টাকা কেজি, মানে খাসির মাংসের ডবল। মুসলিম পরিবারের মহিলারা কেবল মুরগি চাষ করতেন। তাও বহু বাড়িতেই এ নিয়ে অশান্তি হতো স্বামী-স্ত্রীর। মুরগি শাক সবজি-র খেত নষ্ট করে। ঘরের খড়ের চাল আঁচড়ায়। ঘর নোংরা করে। মুরগি আর মুরগির ডিম বেচা পয়সায় মেয়েরা নিজের সঞ্চয়ের কাজে লাগাতেন। মুরগি খুব কম মিলত। তাই দাম ছিল চড়া। কর্মসংস্থান প্রকল্পের টাকায় বহু বেকার যুবক পোল্ট্রি চালু করেন। তাই মুরগির মাংস খাওয়া সহজ হয়। খাসির দামের থেকে সস্তা হয়। মাংস খাওয়ার সময় ৩৪ বছরের কিচ্ছু না করার কথা একটু মনে রাখবেন, অনুগ্রহ পূর্বক।
এই যে ঋণ তাতে জ্যোতি বসু-অশোক মিত্রদের সরকার প্রথম ২০ শতাংশ ভর্তুকি দেওয়া চালু করে। শুধু ব্যাংক মারফৎ ঋণ দেওয়া নয়, ছাগল গরু মোষ শুয়োর হাঁস মুরগি, সেলাই মেশিন দেয়েছে বামফ্রন্ট সরকার। এখন এমনি গ্রামে আনন্দিত জলসা বসে না টিভি-র নামে। গ্রামে পয়সা এসেছে। তাই টিভি কিনতে পেরেছে প্রায় সব মানুষ। প্রসঙ্গত, গ্রাম পিছু ১৯৭৭ এর আগে ৪ থেকে ৬টির বেশি রেডিও ছিল না। টিভি চোখে দেখেইনি মানুষ।
ঘটনা-১৫
ক্ষুদ্র চাষীদের ঋণে ভর্তুকি দান প্রথম বামফ্রন্ট সরকারের আরেকটি মহৎ অবদান। ব্যাংক ঋণ থেকে মুক্তির কথা তো শুরুতেই বলেছি। ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষিরা যাতে চাষ করতে পারেন তার জন্য মিনিকিট ধানের বীজ দেওয়া হতো। আজ যে মিনিকটের এত রমরমা এবং অন্য চালের তুলনায় দাম কম—সেটাও গাল দেওয়ার সময় মনে রাখবেন। আর দেওয়া হতো আলু, তিল সর্ষে, গমের বীজ—বিনামূল্যে গরিবদের। আমলাতান্ত্রিক কারণে কখনো সেটা দেরিতে পৌঁছত—সে নিয়ে আক্ষেপও শুনেছি।
ঘটনা-১৬
বিধবা ভাতাদের দেওয়া প্রথম শুরু করে বাম সরকার। আমার এই সালটা সঠিক মনে নেই। মাসে ৬০ টাকা। অনেকে উচ্চারণ করতে না পেরে বলতেন, পেনসিল। বিভূতিভূষণের স্বপ্নের গোপালদের কাছে আসতেন বিধবারা ‘ও বাবা গোপাল আমায় পেন্সিল দিবি নি’ বলে।
কোন সাহিত্যিকের রচনায় এ সব প্রসঙ্গ তেমন দেখিনি।
আর যাঁরা আমাদের রোদে জলে ভিজে বাঁচিয়ে রাখেন, যাঁদের ছাড়া টিভি কাগজ বিশ্ববিদ্যালয় সব জায়গায় বুকনি অচল, সমাজ ব্যবস্থা স্তব্ধ, সেই গফুরদের কারখানায় চলে যাওয়া বন্ধ করে, অনাহারে মরার হাত থেকে রক্ষা করে, যাঁরা মস্ত বড় সামাজিক দায়িত্ব পালন করেছিলেন, কৃষকদের ভাতা প্রদান করে—তাঁদের কথা ভুলে যাওয়া মস্ত বড় সামাজিক অপরাধ।
এ কথা যেন আমৃত্যু মনে রাখতে পারি।
মনে রাখতে পারি, দ্বান্দ্বিকতায়, দ্বন্দ্বে ও ধন্দে, বাংলার রাজনৈতিক সংস্কৃতি।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন