ইমানুল হক
সংস্কৃতি কর্মীদের দায় কি কাউকে ক্ষমতায় আনা বা ফেলা?
(স্বগতোক্তি : জানি এ লেখা কোন পক্ষকেই সন্তুষ্ট করতে পারবে না।)
১
একদিনে কোনও কিছু হয় না, সিঙ্গুর নন্দীগ্রাম বা কামদুনি। সব অন্ধকার-ই লুকিয়ে থাকে নিজের আলোর গভীরে। ২০০১ খ্রিস্টাব্দে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মুখ্যমন্ত্রিত্বের এক বছর পূর্তির এক সপ্তাহের মাথায় ১৩ নভেম্বর পুলিশ নন্দন চত্ত্বরে চলচ্চিত্র উৎসবের বিপুল ভিড়ের মাঝখান থেকে প্রেসিডেন্সি কলেজের বাংলার এক শিক্ষককে মারতে মারতে কলার ধরে থানায় নিয়ে যায়। বহিরাগত নন, তিনি ছিলেন চলচ্চিত্র উৎসবের বৈধ প্রতিনিধি। সঙ্গীসাথীরা অসহায়ভাবে এদিক-ওদিক দৌড়ান, ছিটকে পড়ে শিক্ষকের চশমা, ডিজিটাল ডায়েরি, কেউ তুলে দেয় না। কোথায় সেগুলি গেল আজও জানা যায়নি। তখন ‘লাইভ’-এর যুগ নয়, ই টিভি দেখায় সে মারধোরের নৃশংস দৃশ্য। অশোক মিত্র, অশোক দাশগুপ্ত, অনুনয় চট্রোপাধ্যায় প্রমুখের চেষ্টায় ছাড়া পান তিনি। কিন্তু কোনও সংবাদপত্রে সে ঘটনা ঠাঁই পায় না।
প্রেসিডেন্সির সেই শিক্ষকের অপরাধ ছিল, তিনি লেনিনকে কুৎসিত, বিকৃত করে দেখানোর প্রতিবাদে ‘আজকাল’ পত্রিকায় ১৩ নভেম্বর ২০১১ ‘ছোট’ তারিখে চিঠি লিখেছিলেন।
পরদিন তাঁকে বৈধ প্রতিনিধিপত্র থাকা সত্ত্বেও নন্দনে ঢুকতে বাধা দেওয়া হয়।
এ নিয়ে কোন প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়নি। তাঁদের সমাজ ও সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘ভাষা ও চেতনা সমিতি’ কিছু পোস্টার দেয়, সেগুলি পুলিশকে দায়িত্ব দিয়ে ছিঁড়ে ফেলানো হয়। আর ২০০২ খ্রিস্টাব্দে, গত তিন বছর ধরে যে সারা রাত একুশের ভাষা শহিদ উদযাপন হত নন্দন-রবীন্দ্র সদন চত্ত্বরে তাঁর অনুমতি দেওয়া হয় না। অনেক আগে আবেদন করা সত্ত্বেও বলা হয়, অন্য কেউ আবেদন করেছে। (এখন যা শোনা যাচ্ছে প্রায়ই)। অনুষ্ঠান চলে আসে রাস্তার ধারে। আকাদেমির সামনে মেহগনি ছাতিম মঞ্চে। যেখানে ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে সারাদিন পয়লা বৈশাখ উদযাপন করে আসছেন তাঁরা। ১৯৯৯-এ অশোক মিত্র একুশে ফেব্রুয়ারি উদযাপনের সভায় বলতে এসে মাইক পাননি। খালি গলায় রবীন্দ্র মূর্তির তলায় ভাষণ দেন তিনি। বিদ্যুৎ দেওয়া হয়নি। কারণ অশোক মিত্র, অমিয় বাগচী, অরুণ মিত্র, সুচিত্রা মিত্র, কুমার রায়-রা সরকারের ভাষা নীতির বিরোধিতা করে সভা করেছিলেন।—এর কিছুদিন আগে ১০ জানুয়ারি। ২০ ফেব্রুয়ারির সভায় অন্নদাশংকর রায়, অরুণ মিত্ররা অবশ্য বিদ্যুৎয়ের সুবিধা পান।
বাংলা আকাদেমির এক কর্তা অনুনয় চট্টোপাধ্যায়ের চেষ্টায় রাত ১০ দশটায় পাওয়া গিয়েছিল বিদ্যুৎ। সেদিন পীযূষকান্তি সরকার, সুমন চট্রোপাধ্যায়, নচিকেতা, স্বাগতালক্ষ্মী, পল্লব কীর্তনীয়া সহ ৫০ জন শিল্পী গান গেয়েছিলেন সারা রাত ধরে। আর সুমন চট্টোপাধ্যায়, আজকের কবীর সুমন বলেছিলেন, উদ্যোক্তারা সিপিএমের দালাল না হলে এখানে অনুষ্ঠানের অনুমতি পেতেন না। উদ্যোক্তাদের বিড়ম্বনা না জেনেই তাঁর অসতর্ক মন্তব্য। অনুষ্ঠানের দুই সঞ্চালক ছিলেন অনিকেত চট্টোপাধ্যায় আর সুবীর মণ্ডল। সুমন চট্টোপাধ্যায়ের সিপিএম বিরোধী মন্তব্যের জবাবে এক সঞ্চালক সুবীর কিছু বললে পক্ষে-বিপক্ষে উত্তাল হন শ্রোতারা। একটু হাতাহাতিও হয়। কিন্তু আবার শান্ত হয়ে একসঙ্গে বসে সারারাত গান শোনেন তাঁরা। নকশাল আর সিপিএম, কোনও পক্ষে না থাকা মানুষ সবার কাছে সেদিন বড় হয়েছিল গান আর কবিতা। দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রদীপ ঘোষ, বিশ্বনাথ চক্রবর্তী, কাইয়ুমদারা অল্পক্ষণ থাকবেন বলে এসে আর ফিরে যাননি।
২
২০০২-এ বৈধ অনুমতি থাকা সত্ত্বেও রাত ১০টায় এসে অনুষ্ঠান বন্ধ করতে এসে পুলিশ পিছু হঠে, রাজ্য সরকারের এক মন্ত্রী শ্রীকুমার মুখোপাধ্যায় বাধা দেন। বাধা দেন শ্রোতারা। তারপরের বছর থেকে তো আকাদেমির সামনের মেহগনি গাছতলাই ঠিকানা। সে গাছ আজ মৃত। ছাতিম তার নতুন নামের হদিশ। এই ঠিকানায় এখন কলকাতায় প্রায় সব রঙের সাংস্কৃতিক প্রতিবাদ হয়। অনুষ্ঠানিক নাম রাণুছায়া মঞ্চ।
৩
রাজাবাজার বিজ্ঞান কলেজের অধ্যাপক কৌশিক গাঙ্গুলিকে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদ করেছিলেন ১৩ নভেম্বর ২০০২-এ মার খাওয়া প্রেসিডেন্সির ওই শিক্ষক, ‘উইঙ্কল টুইঙ্কল’ নাটকের পোস্টার মেরেছিলেন, রাজ্য প্রশাসনের শীর্ষ কর্তার আদবানি সখ্যের বিরুদ্ধে, মার্কিন প্রীতির প্রতিবাদে বইমেলায় ইস্তাহার বিলি করেছিলেন, ‘টরাস’ ছবির জের তো ছিলই, তাঁকে অন্যায়ভাবে এক বছর তিন মাসের মাথায় ছাত্রদের প্রবল প্রতিবাদ, ক্লাস বয়কট সত্ত্বেও বদলি করে দেওয়া হল।
আজ তো তবু প্রতিবাদ হয়।
কোন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সেদিন প্রকাশ্যে প্রতিবাদ করেননি। ব্যতিক্রম অশোক মিত্র।
ব্যতিক্রম অন্য অর্থে আরেকজন মানুষ, শঙ্খ ঘোষ, মূলত যাঁর আহ্বানে ২০০৭ এর ১৪ নভেম্বর ও ২০১৩-র ২১ জুন পথে নেমেছিলেন হাজার হাজার দলহীন মানুষ, এই মানুষেরা কাউকে ভোট দেন ঠিকই সমর্থনও করেন, কিন্তু সমালোচনা করতে ভোলেন না, নিজের প্রিয় দলেরও। সে অর্থে এরা কোন দলের নন, গণতন্ত্রের ঠিকানা।
২০০২-এ ‘ভাষা ও চেতনা সমিতি’ এবং শঙ্খ ঘোষদের আহ্বানে সব রঙের সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব গুজরাত গণহত্যার প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে অর্থ সংগ্রহ করেছিলেন।
শুভাপ্রসন্নের অবদান তো ভোলা যাবে না, যাবে না জয় গোস্বামী, বিভাস চক্রবর্তী, মাধবী চক্রবর্তী, আজিজুল হক, প্রতুল মুখোপাধ্যায়, রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত, অজিত পাণ্ডে, শুভেন্দু মাইতি, চিরঞ্জিৎ, সুব্রত ভট্টাচার্যদের এক সঙ্গে রাস্তায় নেমে কৌটো নাড়ানোর দৃশ্য।
আবার ২০০২ এর ৩ নভেম্বর ১৪ দিনের সারা রাজ্য ব্যাপী সম্প্রীতি যাত্রা শেষে তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তরের লিখিত অনুমতি সাপেক্ষে আহূত সমাপ্তি সভায় পুলিশ জানায় সভা করা যাবে না। সভাটি শেষ পর্যন্ত হয়। উপস্থিত ছিলেন অশোক মিত্র, শঙ্খ ঘোষ, অমিয় বাগচী, অশোক দাশগুপ্ত, বিভাস চক্রবর্তী, পরমেশ আচার্য, মালিনী ভট্টাচার্য, অজিত পাণ্ডে-সহ বহু মানুষ।
প্রসঙ্গত, ২০ অক্টোবর ২০০২—এই চত্বরে সম্প্রীতি যাত্রার সূচনা করেছিলেন বিমান বসু-ও।
৪
প্রথমের কথা আরেকবার বলা যাক, সিঙ্গুরের আগে তো ভাঙ্গড়। ২০০৫-এ ইন্দোনেশিয়া ভ্রমণ-ক্লান্ত ব্রান্ড যুদ্ধের সদর্প ঘোষণায় ব্যথিত সেই মার খাওয়া শিক্ষকটি ‘প্রতিদিন’ সংবাদপত্রে নিবন্ধ লেখেন—শিল্পায়ন নয়, নগরায়ণ হবে। শিক্ষকটি প্রায় সমস্ত বুদ্ধিজীবীর বাড়ি দৌড়ান। সাড়া মেলে না। উন্নত ও সংবেদনশীল সরকার তাঁকে শোকজ করে। কিছু সহকর্মী ও সহমর্মীকে পাশে পান তিনি। ২০০৬-এ নতুন সরকার আসার পর ব্রান্ড বুদ্ধের ঝনঝনানিতে যখন সবার কান পূর্ণ, তখন জ্যোতি বসুর জন্মদিনে একটি আলোচনাসভা করার সিদ্ধান্ত নেন কিছু মানুষ। ভাষা ও চেতনা সমিতি-র উদ্যোগে। বাংলার সমাজ ও রাজনীতিতে জ্যোতি বসুর অবদান। ২০০৬-এর ৮ জুলাই রবীন্দ্র সদন চত্ত্বরে সে সভার জন্য আবেদনের ফাইল তৎকালীন তথ্য ও সংস্কৃতি কর্তা পাঠান তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রীর কাছে। ৭ জুলাই সন্ধে পর্যন্ত ফাইল ফেরে না। কর্তা বলেন, তার মানে আপত্তি নেই, সভা করো। রাত ৯টায় পুলিশ জানায় কোনও সভা করা যাবে না। হুকুম বাতিল। সে সময় রবীন্দ্র সদন-নন্দন চত্বরে সভার জন্য অনুমতি লাগত না। ৮ জুলাই, জ্যোতি বসুর জন্মদিনে সি পি এমের পলিটবুরো সদস্য জ্যোতি বসুর ছবি রবীন্দ্র সদন চত্ত্বর থেকে বের করে দেওয়া হয়। ছবিটির পাশে অশোক মিত্রের একটি বক্তব্য লেখা পোস্টার ছিল—৩-এর পিঠে শূন্য, ৩ বাদ দিলে শূন্য।
ছবিটি রবীন্দ্র সদন চত্ত্বরে আবার রাখতে গিয়ে মার খান ওই শিক্ষক এবং এক তরুণ গায়ক শ্রীকুমার মহন্ত। বিকেলে সভা বাইরে, আকাদেমির সামনে। অজস্র সশস্ত্র পুলিশে মুড়ে ফেলা হয় চত্বর। প্রবল বর্ষণের মধ্যে বক্তব্য পেশ করেন প্রাক্তন মহানাগরিক কমল বসু, অজিত পাণ্ডে, রন্তিদেব সেনগুপ্ত আর ওই শিক্ষক। আর বৃষ্টির মাঝে শ্রোতাদের ভিড়ে টানা দু’ঘণ্টা দাঁড়িয়েছিলেন একজন মানুষ—নাম তাঁর শঙ্খ ঘোষ।
এমনি এমনি একজনের আহ্বান শোনে না মানুষ। তিনি শুধু জাগতে বলেন না, জেগে থাকেন। এমন নয় যে, তাঁর সিদ্ধান্তে তর্ক চলে না, এই প্রতিবেদকই একাধিকবার তর্কে জড়িয়েছে, কিন্তু মতান্তর তো মনান্তর হয়নি।
৫
আরেকজন মানুষ অশোক মিত্র, যিনি ডাকে না ফেলা চিঠি দিয়ে বুঝিয়েছিলেন কী সর্বনাশ ডাকতে চলেছে ভ্রান্ত বামেরা, শোনেনি কেউ, দেখাও করেননি সেদিন অনেকে।
২০০৭-এর ১৪ মার্চে নন্দীগ্রামে গণহত্যার পর ১৬ মার্চ প্রথম দুটি মিছিল বের হয় কলকাতায়। একটি ধর্মতলা থেকে। আসে কলেজ স্ট্রিট এলাকায়। আরেকটি বের হয় কলেজ স্কোয়ার থেকে যায় ধর্মতলা।
প্রথম মিছিলে শ দেড়েক, দ্বিতীয় মিছিলে তিন শতাধিক মানুষ হয়। প্রথম মিছিলের কিছু মুখ কলেজ স্কোয়ারের মিছিলের জমায়েতের দিকে এমন ভাবে তাকায়, যেন এরাই নন্দীগ্রামের খুনি।
আসলে প্রতিবাদটা নয়, তুমি কি আমার ছাতার তলায় আছো? এই মনোভাব বহু দিনের।
পরে বহু মুখ দেখা গেছে। কিন্তু পরের সেই প্রচারিত মুখগুলির মধ্যে মাত্র তিনজন ছিলেন দুটি মিছিলে। প্রথম মিছিলে কবীর সুমন। দ্বিতীয় মিছিলে কৌশিক সেন, শাঁওলি মিত্র। দ্বিতীয় মিছিল ডাকা হয়েছিল বুদ্ধিজীবী মঞ্চের ডাকে। ওই শিক্ষকও ছিলেন মঞ্চের সদস্যদের একজন। কিন্তু এস ইউ সি-র মানিক মুখার্জি বামফ্রন্টকে উচ্ছেদ করার ডাক দেওয়ায় প্রতিবাদ করেন ওই শিক্ষক, ফলে তাঁকে বলতে দেওয়া হয়নি।
ভোটের তাগিদ সেদিনই ছিল। এরপর থেকে ওই শিক্ষককে আর কোন সভায় ডাকা হয়নি, আসলে প্রতিবাদে যখন মিশে যায় ক্ষমতার অঙ্কে সর্বনাশ তো তখনই শুরু হয়।
৬
২০০৭-এর ১৬ মার্চে মিছিল লম্বা হওয়ার কথা ছিল। হয়নি। পরে যে ক’টি সভা বা মিছিল হয়েছে ওই শিক্ষক হাজির ছিলেন, কিন্তু লক্ষ্য করেছেন, ক্ষমতার অঙ্ক কাজ করছে, ভোটের অঙ্ক। মিছিলে এসো, কিন্তু মিছিল আয়োজনের বৈঠকে তোমরা বাদ—কেন না, তুমি কোনও ক্ষমতার পক্ষেরই লোক বাদ্যি বাজাতে তুমি অনিচ্ছুক।
৭
বাংলার সাংস্কৃতিক প্রতিবাদের একটা ঝোঁক চোখে পড়েছে, সেটা হচ্ছে ভোটের অঙ্ক। কাউকে ক্ষমতায় আনা বা ক্ষমতা থেকে ফেলাটা সাংস্কৃতিক কর্মীদের দায় হতে পারে না।
বুদ্ধিজীবীদের মঞ্চ বানানো বা সংস্কৃতি সমন্বয়ের কাজটা এতো সহজ নয়। কমিটিতে রাখা হয়, কিছু সব জায়গাতেই ঠোঁটকাটা জমায়েতের খবর পান, কিন্তু আয়োজনের বৈঠকের খবর পান না। মানুষ কিন্তু অ-দলীয়, অ-ভোটিয় মঞ্চ চান। ১৪ নভেম্বর বা ২১ জুনে ‘সেলিব্রিটি’ মুখ কিছু আলাদা হতে পারে, কিন্তু মিছিলের সলতে পাকানি হাজারে হাজারে ভিড় করা মানুষগুলোর মুখ কিন্তু অনেকটাই এক।
কিছু নতুন মুখ বাদ দিলে ব্যানার বওয়া, পোস্টার বানানো, গান গাওয়া বা স্লোগান দেওয়ার মুখগুলো সত্যিকার প্রতিবাদ মিছিলে থাকে। ২০০৭-এর ১৪ নভেম্বর এরা ছিলেন, ২০১৩-র ২১ জুনেও। দুটি মিছিল ঘনিষ্ঠভাবে দেখার সুযোগ হয়েছে। শুরু থেকে শেষ। সে থেকেই এই মন্তব্য।
৮
১৪ নভেম্বরে যাঁরা হাঁটেননি তাঁদের সঙ্গে ছবির পর্দা শেয়ার করা যাবে, টিভির পর্দা, কাগজের পাতা, আর মিছিলে যাবে না! এ কেমন কথা? এ তো নতুন অস্পৃশ্যতা। আধুনিক সমাজপতিত্ব! সিঙ্গুর আন্দোলনে ২০০৬-এর ডিসেম্বরের সময় ঝুঁকি নিয়েছিলেন কবীর সুমন, ব্রাত্য বসু, প্রতুল মুখোপাধ্যায়। বাকিরা তখন প্রকাশ্যে আসেননি। এঁরা যদি বলতেন, পরে এসেছো, প্রতিবাদে তোমাদের নেওয়া যাবে না?
২০০৭-এ কারও পালে ক্ষমতার হাওয়া না লাগলে কেউ কেউ বের হতেন কি না সন্দেহ?
২০০৬-এ ৮ জুলাই সি পি এমের তখনও পলিটব্যুরো সদস্য জ্যোতি বসুর ছবি যেদিন বের করে দেওয়া হয়েছে, সেদিন বুদ্ধবাবুর সঙ্গে নন্দন থেকে যাঁদের বের হতে দেখা গেছে তাঁদের কেউ কেউ আজ তাঁর উত্তরসূরিণীর পাশাপাশি।
৯
‘জমি হাঙ্গর দোসর’-দের বিরুদ্ধে প্রথম বই বের করেছিল ভাষা ও চেতনা সমিতি। বানিয়েছিল সিঙ্গুর নিয়ে তথ্যচিত্র।
কৃষি শিল্প বিতর্ক নিয়ে প্রেস ক্লাবে বই প্রকাশের দিনে ২০০৬ খ্রিস্টাব্দের ৩ সেপ্টেম্বর বক্তব্য পেশ করেছিলেন আর এস পি-র দেবব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়, সি পি আই-এর মঞ্জুকুমার মজুমদার। আর সি পি এমের জ্যোতি বসুর ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিত্ব কমল বসু উদ্বোধন করেছিলেন বইটির। জ্যোতি বসুর ঘনিষ্ঠ কমল বসু বলেছিলেন, এভাবে জমি নেওয়ার পরিণতি হবে ভয়ঙ্কর।
এরা বাংলার জমি আন্দোলনের কেউ নন? শুধু ১৪ নভেম্বর মিছিলে হাঁটারা প্রতিবাদী?
১০
নন্দীগ্রামে এবং খেজুরিতে ২০০৭ খ্রিস্টাব্দে দু’পক্ষের বহু মানুষ ঘর ছাড়া হয়েছিলেন। ৭ নভেম্বর ঘরে ফিরেছিলেন কিছু মানুষ। সে নিয়ে অনেক বাদ-প্রতিবাদ হয়। কিন্তু একটি মন্তব্য ‘দে হ্যাভ বিন পেড ব্যাক বাই দেয়ার অন কয়েন’—ঘৃতাহুতি দেয় লম্বা হয় মিছিল।
১১
শাসকের শাসানিতে কখন ও ভয় জাগে, কিন্তু ভয় তো ভাঙ্গেও।
সেবার ‘ওন কয়েন’ আর এবার ‘চোপ’।
মানুষকে চুপ করানো কি অত সোজা?
১২
মানুষ নীতির পক্ষে দাঁড়ায়। মেরুদণ্ড সোজা করে। শঙ্খ ঘোষেদের ডাক ছিল নীতির পক্ষে, তাই লম্বা হয়েছে মিছিল। ইতিহাস গড়েছে ১৪ নভেম্বর ২০০৭ আর ২১ জুন ২০১৩।
তাতে কে এলো আর কে এলো না পরোয়া করেন না তাঁরা।
মিছিলটা মানুষের।
ডাকটা কেউ বা কারা দেন, কিন্তু মানুষের মনেও সে ডাকের অপেক্ষা থাকে, তাই তাদের আওয়াজ সরকারি বা বেসরকারি সেলিব্রিটি ঢাক-কে ছাপিয়ে যায়।
১৩
অসহায় মানব-মানবী পূর্ণ ঘরে যদি আগুন লাগে আর কোনও অপছন্দের ব্যক্তি যদি জল দিতে আসে, তাঁকে কি বলব, না ভাই তোমায় বালতি আর জল তুমি ফেরত নিয়ে যাও। বলাটায় আত্ম-অহমিকা থাকতে পারে, যুক্তি ও মানবিকতাবোধ নেই। তা বলে তাকে নিশ্চয়ই আত্মার আত্মীয় বানানো না।
পুনশ্চ : আয়লা ত্রাণে এক সঙ্গে হাঁটবেন না বলে, কেউ কেউ আসেননি, যে কোনও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে কি একসঙ্গে পথে নামা যায় না? টিভি চ্যানেলে যদি মুখ দেখাদেখি করা যায়—এক খবরের কাগজের পাতা যদি করা যায়? তাহলে বিপন্ন মানুষের জন্য পথ কেন বিপথ হবে?
তর্ক আর ঝগড়া কেন এক মনে হবে?
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন