অর্পিতা সরকার
এই অর্চি, দেখ না বেনারসির রংটা কী রকম হবে? পিক গ্রীন ওরা কিনেছে আমি রেডিস কিছু নিই কী বল?
অন্যমনস্ক স্বরে একট পেঁয়াজখোসা রঙের জারদৌসির ওপর হাত রেখে বলল, আজ তো মল্লারকে সঙ্গে আনতে পারতিস।
কথা শেষ হবার আগেই অদ্ভুত চোখে তাকাল রুমি।
মল্লার! ও আমার সাথে বিয়ের শপিংয়ে এসে কী করবে?
একটু উষ্ণ স্বরে অর্চি বলল, কেন, বিয়েটা তো তুই ওকেই করছিস।
রুমি একটা শাড়ি গায়ের উপর ফেলে বলল, সে তো বাবার বন্ধু শ্যামল কাকুর ছেলে, বাড়ির সকলের পছন্দ বলে!
আর তোর? আলতো করে কথাটা হাওয়ায় ভাসিয়ে দিল অর্চি।
রুমির দুই ভ্রুর মাঝে একটা বিরক্তির ভাঁজ খেলেই মিলিয়ে গেল যেন।
অর্চির হাতের পেঁয়াজ খোসা রঙের বেনারসিটা টেনে নিয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে রুমি বলল, একমাত্র তুই আমার পছন্দ বুঝিস, হয়তো আমার থেকেও কিছুটা বেশিই।
রুমির এই উচ্ছ্বাসটা আগেও দেখেছে অর্চি, সেই ক্লাস থ্রি থেকে দেখে আসছে। যখনই মানসিক দ্বন্দ্ব থেকে বেরোনোর পথ খুঁজে পায় না তখনই ওর মুখটা আনন্দে ভরে ওঠে।
রুমি ছোট্ট থেকেই খুব আদুরী। একটুতেই ঠোঁট ফোলানো বোধহয় ওর অভ্যাস ছিল। তখন ওদের দুজনেরই ক্লাস থ্রি। টিফিন টাইমে অর্চি দেখল, একটা গোলাপি গায়ের মেয়ের দু-চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে গাল বেয়ে পড়ছে। মেয়েটা মোছার চেষ্টাও করছে না।
কাউকে কিছু বলছেও না। শুধু চুপটি করে এক কোণে বসে কেঁদে চলেছে।
অর্চি তখন বন্ধুদের সাথে গোল্লা ছুটে মেতেছিল।
সেকশন বি এর দিকে পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল ও।
মেয়েটার কাছে গিয়ে বোঝার চেষ্টা করল ঠিক কী হয়েছে!
হাতের বুড়ো আঙুল থেকে রক্ত পড়ছে।
অর্চি ছুটে স্কুলের বাগান থেকে অনেকটা গাদা পাতা এনে চটকে রসটা ওর আঙুলে লাগিয়ে দিয়েছিল। মিনিট খানেক পরেই রক্ত বন্ধ দেখে মেয়েটি উচ্ছ্বসিত হয়ে বলেছিল… তুই ম্যাজিশিয়ান? পিসি সরকারের মতো ম্যাজিক জানিস?
ওর পিঠে আলতো করে ঠেলা দিয়ে রুমি বলল, তাহলে এই শাড়িটা নিলাম বুঝলি। অর্চি সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়ল।
চল চল, রুমি এবার তাড়া লাগাল, এখনও কসমেটিক্স কেনা বাকি। অর্চি বলল, লিপস্টিকটা কিন্তু ওই বিশেষ ব্র্যান্ড ছাড়া নিস না। মনে আছে তো তোর অ্যালার্জি বেরোয় কিন্তু অন্য কিছুতে।
আমার সবকিছু তোর কী করে এত নিখুঁত মনে থাকে রে অর্চি?
মন থেকে ভালোবাসলে বোধহয় সবটুকু মনে রাখা যায় রে রুমি!
না, কথাটা যাতে কোনওভাবেই রুমির কানে না পৌঁছায় তাই ও জোর করে কণ্ঠনালীর মধ্যে চেপে রাখল কথাটাকে।
রুমির বাড়িতে অর্চির অবারিত দ্বার। রুমির বেস্ট ফ্রেন্ডের তকমাটা অনেক বছর আগেই বেশ শক্ত করে এঁটে গেছে অর্চির কপালে। রুমিও কথায় কথায় বলে, ”ইউ আর মাই বেস্ট ফ্রেন্ড অর্চি। বড্ড বিশ্বাস করি তোকে।”
বন্ধুত্ব শব্দটা অনেকটা ছোট হলেও বেশ ভার বহন করতে হয়। তাই রুমির প্রতি অর্চির বন্ধুত্ব ভিন্ন অনুভূতিরা গোপন প্রকোষ্ঠে গুমরে মরেছে এতকাল।
এই অর্চি জানিস, আমি তো মল্লারকে ঠিক বুঝতেই পারছি না রে। আরে ও অনুপমের গান ভালোবাসে না। স্মরণজিতের গল্প পড়েনি। আরে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ফুচকা খায়নি কোনোদিন! তুই জাস্ট ভাবতে পারছিস, এই এলিয়ানকে নিয়ে আমি কী করে সংসার করব। তারপর আরো শোন, মল্লার পার্কস্ট্রিটের নামি রেস্তোরাঁ ছাড়া কোনোদিন ডিনার করেনি। তার মানে আমাদের ওই বেশি করে পেঁয়াজ দিয়ে টক জল দেওয়া অবনীদার ঘুগনির টেস্টই জানে না রে।
অর্চি ক্লান্ত হাসি হেসে বলল, এরপর থেকে তুইও এসবের স্বাদ ভুলে যাবি রুমি।
ধুর তুই কী যে বলিস!
রুমি হেসে উড়িয়ে দিল অর্চির অবান্তর কথা।
শুধু একটাই খটকা রয়ে যাচ্ছে ওর মনে, কেন যতই বিয়ের দিন এগিয়ে আসছে ততই মনে হচ্ছে ওর চারদিকটা একটা অপরিচিত কুয়াশাচ্ছন্ন চাদরে ঢেকে যাচ্ছে।
সেই ঘন কুয়াশার ওপারে একটা অপরিচিত মুখ, যে মুখটার আদলটা অনেকটা মল্লারের মতো। মুখের প্রত্যেকটি রেখাকে চেনার শত চেষ্টা করেও বিফলে যাচ্ছে রুমি। রুমি বুঝতে পারছে, মল্লারের মনের গভীরে ডুব দিয়ে আসল মানুষটাকে খুঁজে পাওয়া সত্যিই দুষ্কর। ওর বাইরের আবরণটা এতটাই দৃঢ় যে অন্তরের প্রবেশদ্বার নেই বললেই চলে।
অন্যমনস্ক রুমিকে ডেকে অর্চি বলল, এই পাগলি ওই দেখ তোর প্রিয় চিকেন মোমো… চল খাবি তো? আজ আমি তোকে পেট ভরে মোমো খাওয়াবো। রুমি আবিষ্ট হয়ে তাকিয়ে আছে অর্চির দিকে। মোমোর স্টলটা রুমি অনেক আগেই খেয়াল করেছে, খেতে ইচ্ছে করেছে, শুধু নিজের ইচ্ছেটাকে প্রকাশ করতে মন চাইছিল না। হয়তো অপেক্ষা করছিল, আদৌ অর্চির মনে আছে কিনা সেটাই পরীক্ষা করছিল রুমি।
না, এক্ষেত্রেও রুমি হেরেই গেল। অর্চি ঠিক মনে রেখেছে চিকেন মোমো ওর ফেবারিট। ভীষণ ভালোলাগাগুলো কখনো কখনো কষ্ট দেয়। এই মুহূর্তে রুমির মনে একটা কষ্ট কষ্ট সুখের উদ্ভব হচ্ছিল। যে অর্চি ওকে এতটা চেনে, এতটা বোঝে তাকে ছেড়ে চলে যেতে হবে ভেবেই কষ্ট হচ্ছে, আর আরেকদিকে রুমি ভাবছে, এমন কেউ পৃথিবীতে আছে যে রুমিকে সম্পূর্ণ ভাবে চেনে। হয়তো রুমির নিজের থেকেও বেশি।
সেই জন্যই তো অর্চি ওর বেস্ট ফ্রেন্ড সেই ক্লাস থ্রি থেকে।
রুমির ঠোঁটের কোণে হঠাৎ একটা আলগা হাসি খেলে গেল। ক্লাস ফাইভেও ওরা কোয়েড স্কুলেই পড়েছে। কিন্ডারগার্টেন স্কুলে ম্যামেদের যত্নের পর প্রথম হাইস্কুলে ভর্তি হয়েছে রুমি। প্রথম থেকেই ওর চিন্তা ও আর অর্চি কি একই সেকশান পাবে। নাম ডাকার সময় অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে রুমি, নিজের নাম শোনার জন্য নয়। অর্চির নামটা কখন বলবে। অর্চি ওর পাশে বসে বসে বকে চলেছে।
অস্থির রুমিকে দেখে অর্চি বলল, তুই কী জন্য এত টেনশন করছিস রে?
রুমি বলেছিল, তোর নাম তো বলল না, এ সেকশানে বলল না রে। অর্চি হেসে বলল, পাগলি ফার্স্ট নামটাই তো আমার বলল। তুই এতো টেনশান করছিস তাই শুনতে পাসনি হয়তো।
আনন্দে পাগলের মতো লাফিয়ে উঠেছিল রুমি। একটাই মজা ও আর অর্চি টিফিন ভাগাভাগি করে খেতে পারবে, অর্চিটা ম্যাথে বড় ভালো, রুমির অঙ্কের হোমওয়ার্ক নিয়ে কোনো চিন্তা থাকবে না।
অর্চির মনে হয়েছিল, ভালোই হল রুমি ওর সেকশানে পড়ল, না হলে যা ছিঁচকাঁদুনে মেয়ে, কেউ কিছু বললেই কাঁদতে শুরু করবে, অর্চি থাকলে না হয় সামলে দেবে রুমিকে। ক্লাস ফাইভের ছেলের এই আত্মবিশ্বাস দেখে রুমি বলেছিল, তুই আজ থেকে আমার সুপার হিরো।
রুমির একটা প্রশংসা বাক্যে অর্চির রক্ত কণিকারা দাপাদাপি শুরু করে দিত, আজও দেয়।
নিজেকে মনে হত স্পাইডারম্যান। মাঝে মাঝে দুঃখ হত, যখন রুমি ক্লাসের অন্য ছেলেদের সাথে হেসে হেসে কথা বলত। কেন যে কষ্ট হত সেটা আজও বুঝতে পারল না অর্চি।
রুমি রাস্তার অন্য প্রান্তে দাঁড়িয়ে হাত নাড়িয়ে ডেকে যাচ্ছে, কী রে কোন জগতে আছিস তুই! এদিকে আয়…
রাতুল পিছন থেকে এসে অর্চির পিঠে জোরে একটা থাপ্পর কষিয়ে বলল, কী রে খোঁজ খবর নেই কেন? অনেক দিন বাদে দেখা হল রাতুলের সাথে। রাতুল আর অর্চি একই মাঠে ক্রিকেট খেলতে যেত। একবার রাতুলকে নো বলে আউট দিয়েছিল বলে ফাঁকায় পেয়ে আম্পেয়ারকে পিটিয়েছিল দুই বন্ধু মিলে। সেসব বহু দিন আগের কথা। রাতুল বলল, কীরে রুমির সাথে তোর প্রেমটা কেমন চলছে?
অর্চি সামলে নিয়ে বলল, কী যাতা বলছিস? রুমি আর আমি ভালো বন্ধু। রাতুল রেগে গিয়ে বলল, রামক্যালানের মতো কথা বলিস না তো, ভালো বন্ধু! তোরা কি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির লোক নাকি রে যে ‘ভালো বন্ধু’ কথাটা ব্যবহার করতে ধরেছিস।
অন্তত আমার কাছে লুকোস না অর্চি। আমি জানি তুই ম্যাচের মাঝখানে সকলের গালাগাল খেয়েও বেরিয়ে এসেছিল রুমি সন্ধের টিউশান থেকে একা ফিরবে বলে… এটা শুধুই বন্ধুত্ব! নারে ভাই মানতে পারলাম না। অর্চি ক্লান্ত হেসে বলল, সামনেই রুমির বিয়ে। মল্লার, রুমির বাবার বন্ধুর ছেলের সাথে। রাতুলের মুখটা হাঁ হয়ে গেছে। বিস্ফারিত চোখে রাতুল বলল, আমাদের রায়দিঘীর সবাই জানে তোরা মেড ফর ইচ আদার, এখন রুমি অন্য কাউকে বিয়ে করছে আর তুই ওর সাথে শপিং-এ এসেছিল?
অর্চি ধীরে ধীরে বলল, বন্ধুত্ব কথাটা ছোট্ট হলেও এর ভারটা যে বড় বেশি রে রাতুল, তাই আর ভালোবাসি কথাটা বলে উঠতে পারিনি।
রাতুল বলল, চল আমি রুমিকে বলছি, সব কথা বলছি অর্চি। অর্চি ঘাড় নেড়ে বলল, না, কিছুতেই না।
রুমি জানে, তুই প্রথম বল মারতিস রুমির নাম করে। রুমিকে আনন্দ একবার সেক্সিবেবি বলেছিল বলে তুই আনন্দর গালে ঘুষি মেরেছিলিস। জানে এসব রুমি?
অর্চি প্রসঙ্গ পালটানোর জন্য বলল, তুই এখন কী করছিস? জব করবি, নাকি তোর বাবার ওই বিশাল ফার্নিচারের দোকানে বসবি? কাকু, কাকিমা সব ভালো তো?
রুমি কখন ওদের পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে ওরা খেয়াল করেনি।
রুমি রাতুলকে চেনে। কুশল বিনিময় করতে দেরি হল না। অর্চির মনে অজানা আতঙ্ক, রুমি কিছু শুনে ফেলেনি তো! ওর এতদিনের লুকিয়ে রাখা গোপন কথাটা ফাঁস হয়ে যায়নি তো রুমির কাছে?
রুমির মুখের শিরা উপশিরায় স্বাভাবিকত্ব দেখে তবেই অর্চি নিশ্চিত হল।
রাতুল চলে গেছে। রুমি আর অর্চি আনমনে হাঁটছে। অন্য সময় দু-জনের মধ্যে কম্পিটিশন চলে কে আগে কথা বলবে, যদিও রুমিই যেতে। রুমিকেই বলতে হয় ওর না বলা কথাগুলো। অর্চি কোনোদিনই প্রথমে চান্স পায় না। তবে রুমির ওই অভিমানী গোলাপি ঠোঁট দুটো যখন নড়ে তখন অর্চি অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে রুমির দিকে। কতবার রুমির কাছে বকুনিও খেয়েছে, ওর বলা গুরুত্বপূর্ণ কথাগুলো শোনেনি বলে।
ওদের সব কথা আজ যেন নিঃশেষ হয়ে গেছে। দুজনেই চুপচাপ হেঁটে চলেছে। মাঝে মাঝে দুজনের কড়ি আঙুল ছুঁয়ে যাচ্ছে হালকা ভাবে।
ওই বিশেষ আঙুল ছুঁইয়ে কতবার দুজনে আড়ি করেছে, কথা বলেনি একদিন। সেই আঙুলই যেন মনের বার্তাবাহক।
অসাবধানে এই ক্ষণিক ছোঁয়া কি পারবে রুমির কাছে অর্চির মনের কালবৈশাখির আভাস পৌঁছে দিতে?
নিস্তব্ধতা ভেঙে রুমি বলে উঠল, জানিস অর্চি, মল্লার না তোর মতো নয়।
ইচ্ছে করছে না কিছু বলতে, শুধু শুনতে ইচ্ছে করছে অর্চির। রুমির মুখে নিজের কথা। রুমি বলে চলেছে, এই যেমন তুই রাস্তা পার হবার সময় আমার হাতটা ধরিস, বা বলিস সাবধানে, দু-দিক দেখে… মল্লার বড্ড বেখেয়ালি। আমি ওর পাশে আছি তবুও ও ফোনে হয়তো গুরুত্বপূর্ণ কোনো মিটিং-এর আলোচনায় ব্যস্ত।
অর্চি নিজের গলার কেঁপে যাওয়াটাকে অতি সাবধানে সংযত করে বলল, বিজি ম্যান, কাজ তো থাকবেই।
রুমি অন্যমনস্ক ভাবে ঘাড় নাড়ল। রুমি বলল, চল অর্চি আজ আর শপিং করতে ভালো লাগছে না, গঙ্গার ধারে বসি।
এভাবে নিজেকে লুকিয়ে নিয়ে রুমির সামনে অভিনয় করে চলাটা সত্যিই বড্ড কঠিন। মনের সবকটা দরজাকে প্রবল চেষ্টায় বন্ধ করে রাখা প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছে অর্চির কাছে।
রুমি মল্লারের বাড়ির সম্পর্কে কিছু বলে চলেছে, অর্চি অন্যমনস্কভাবে ওর সব কথাতেই সায় দিচ্ছে।
ভীষণ ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরল রুমি। নিজের বিছানায় শরীরটাকে এলিয়ে দিয়ে মল্লারকে কল করল।
মল্লারের জন্য যে অফ হোয়াইট কালারের পাঞ্জাবিটা কিনেছে সেটাই বলতে চাইল ওকে, মল্লার একটু ঝাঁঝালো গলায় বলল, আচ্ছা রুমি তুমি কি বাচ্চা! আমার ইম্পর্টেন্ট প্রজেক্ট বাদ দিয়ে এখন আমি বিয়ের শপিং-এর গল্প শুনব?
মল্লার নিজেই কেটে দিল ফোনটা। এ প্রান্তে রুমি তখনও ফোনটা ধরেই আছে।
অন্যপ্রান্তে তখন একটা যান্ত্রিক আওয়াজ।
মনে পড়ে গেল রুমির বছর দুয়েক আগে মেজমাসির ছেলের পৈতেতে ওর বাবা আর মা মাসির বাড়ি গিয়েছিল, রুমির শরীরটা খারাপ ছিল বলে ওর যাওয়া হয়ে ওঠেনি। কথা ছিল বাবা-মা রাতেই ফিরে আসবে। হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হওয়ায় ওরা মাসির বাড়িতেই থাকতে বাধ্য হয়েছিল। রাত তখন প্রায় বারোটা। রুমি কোনোদিন একা বাড়িতে থাকেনি। অনেকক্ষণ টিভি দেখে, বই পড়ে বেশ কাটছিল। কিন্তু মধ্য রাতে ভয়টা শুরু হয়েছিল। কেমন একটা গা ছমছমে ব্যাপার। ঘরেতে টিউব লাইট জ্বালিয়েও ভয়টা কিছুতেই কাটলি না। ওর এ পর্যন্ত দেখা সমস্ত ভূতের মুভি মনে পড়ে যাচ্ছিল এক এক করে। এমনকী ঠাকুমার কাছে ছোটবেলায় শোনা ভূতের গল্পগুলোও যেন সব চোখের সামনে ভাসছিল। নিজের ছায়াটাকেই ভয় করতে শুরু করেছিল।
সেদিন রুমি অর্চিকে ফোন করেছিল। হয়তো সবে ঘুমিয়েছিল অর্চি। অত রাতে রুমির ফোন পেয়ে চমকে উঠেছিল অর্চি। ভয় পেয়ে বলেছিল, কী হয়েছে তোর? এমন লাগছে কেন তোর গলাটা!
সেই একলা থাকার রাতেও অর্চি ওর সাথে ছিল। রুমি খুব ছোট থেকেই দেখেছে, ওর সব না বলা কথা অর্চি যেন কী অদ্ভুত উপায়ে বুঝে ফেলে। আজও ঠিক তেমনি একটা ভয়ের রাত রুমির কাছে। সেদিন রুমির ভূতে ভয় করছিল আর আজ নিজেকে আয়নার সামনে দাঁড় করিয়েছে রুমি। মন মুখের আয়না এই সূত্র ধরেই ফুটে উঠেছে রুমির দ্বিধাবিভক্ত মনের ছবি। একদিকে রয়েছে পারিবারিক সম্মান আর মল্লার, অন্যদিকে রুমিকে আপন করে বোঝার মানুষটাকে হারিয়ে ফেলার যন্ত্রণা। একটা শিরশিরে অনুভূতি ওর শিরদাঁড়া দিয়ে নেমে যেতে বোধহয় বলে গেল, এখনও ভাবো!
দু-চোখে নোনতা জলের ধারাটাকে না মুছেই ফোন করল অর্চিকে। খুব সোজাসুজি একটা কথা আজ জানতে চাইবে রুমি।
অর্চির মতামতটা খুব জরুরি ওর জন্য।
অর্চি রিসিভ করতেই রুমি জিজ্ঞেস করল, এই অর্চি একটা কথা সৎ ভাবে বলবি?
অর্চি বলল, তেমন মিথ্যে তো বলিনি তোর কাছে। শুধু একদিন সিগারেট খেয়ে লুকিয়েছিলাম আর আরেকবার তোর হোমওয়ার্কের খাতা থেকে টুকেছিলাম তোকে না জানিয়ে। এর বাইরে আর মিথ্যে তো মনে পড়ছে না। শুধু অর্চির অন্তরাত্মা বলছে, সব থেকে বড় প্রবঞ্চনা তো করেছ নিজের সাথে। রুমিকে ভালোবাসে অর্চি, এই সত্যিটাও অবশ্য লুকিয়ে গেছে অর্চি।
রুমি সিরিয়াস গলায় বলল, আমার মজা করার মুড নেই। সিরিয়াসলি শুনে বল।
মল্লার কি আমার জন্য পারফেক্ট? নাকি আদৌ নয়?
নিজের হৃৎপিণ্ডের ধুক পুক আওয়াজটা অর্চির কানে এসে হাজির। রুমি কী কোনোভাবে টের পেয়ে গেছে অর্চির না বলা কথা ! আর কিছু কী অপেক্ষা করছে অর্চির জন্য! এক এক সেকেন্ডের প্রহর বড়ো দীর্ঘ লাগছে অর্চির কাছে।
রুমি বলল, কীরে তুই কি ভাবতে ভাবতে রাত কাটিয়ে দিবি? বলবি কিছু?
মল্লারের মতো অমন যন্ত্রমানবের কি নেতিবাচক ঘাড় নাড়াটা রুমি দেখতে পাচ্ছে না? অর্চি ঘাড় নেড়ে না বললেও মুখে বলল, কিন্তু তোর বিয়েটা তো আঙ্কেল ঠিক করেছিল, আর এতদিন তো তুইও মত দিয়েছিস, আর মাত্র ক-দিন বাকি তোদের বিয়ের, এখন এসব কথা কেন ভাবছিস?
মল্লার যে রুমির কোনো অনুভূতিরই মূল্য দেবে না সেটা অর্চি বুঝেছিল রুমির গত বছরের জন্মদিনের দিন। মল্লারের তো আগ্রহই ছিল না রুমিকে বোঝার বা জানার। রুমি যে অন্য মেয়েদের মতো লাল গোলাপ একেবারেই পছন্দ করে না সে টুকু পর্যন্ত মল্লার জানে না। একগুচ্ছ লাল গোলাপ হাতে নিয়ে হাজির হয়েছিল সেদিন। গেটের কাছেই অর্চির সাথে দেখা, রুমির ফোনে মল্লারের ছবি দেখে দেখে ওকে চিনতে কোনো অসুবিধাই হয়নি অর্চির। মল্লারের হাতে লাল গোলাপের ব্রাঞ্চ দেখেই প্রমাদ গুনছিল অর্চি। গোলাপ হাতে রুমির সামনে ঢুকলেই যে জন্মদিনের পুরো মেজাজটা নষ্ট হয়ে যাবে সেটা খুব ভালো করে জানত অর্চি। রুমির খুব প্রিয় বড় জেঠিমা নাকি রেগুলার একটা করে লাল গোলাপ খোঁপায় আটকাত, জেঠিমা অল্প বয়সে মারা যান। তারপর থেকেই লাল গোলাপে রুমির আপত্তি। ওটা শুধু জেঠিমারই থাক, এই মত নিয়েই চলছে ও। অর্চি মল্লারকে বোঝাতে চেয়েছিল কিন্তু একগুঁয়ে মল্লার অর্চির কথা না শুনেই গোলাপ হাতে ঢুকেছিল জন্মদিনের পার্টিতে।
ফুলটা হাতে নেবার আগে রুমি বলেছিল, আমি লাল গোলাপ পছন্দ করি না। গোলাপি টিউলিপের ব্রাঞ্চটা রুমির হাতে দিয়ে অর্চি বলেছিল, মল্লার এটাই এনেছিল। তোকে বাগানোর জন্যই হয়তো ওটা তোর হাতে দিয়েছিল। রুমি ভ্রু কুঁচকে বলেছিল, অর্চি যে কারণে আমি লাল গোলাপ পছন্দ করি না সেটা মোটেই কোনো ফানি বিষয় নয়।
মল্লার চুপ করে বিরক্ত মুখে সরে গিয়েছিল। তারপর থেকে অর্চির সাথে সামনা-সামনি হলেও কথা বলতে চায়নি মল্লার।
রুমি ফোনে তাগাদা দিল, কী রে বললি না! মল্লার কি আদৌ পারফেক্ট আমার জন্য?
অর্চি ঢোক গিয়ে বলল, অনেক রাত হল ঘুমিয়ে পর। কাল তো আবার তোর শপিং আছে। রুমি কিছুক্ষণ ধরে থেকে, ফোনটা কেটে দিল।
ঠিক কী বলত অর্চি রুমিকে? মল্লার কেন কেউই রুমির সব না বলা কথা বুঝতে পারবে না একমাত্র ও ছাড়া। কী করে বলত অর্চি, ভালো বন্ধুর আড়ালে অর্চি শুধু রুমিকেই ভালোবাসে আর হয়তো ভবিষ্যতেও বাসবে। রুমি অন্যের হয়ে গেলেও বাসবে।
অ্যাপ্লিকেশনটা অফিসে জমা দেওয়ার আজই লাস্ট ডেট। অর্চি চায় রুমির বিয়ের আগেই ট্রান্সফার নিয়ে ওদের হায়দ্রাবাদের ব্রাঞ্চে জয়েন করতে। কলকাতায় বসে রুমির বিয়ের সানাইয়ের সুর, রুমির গায়ের বেনারসির লালিমা, ওর সিঁথির রক্তবর্ণ সিঁদুর আর রজনিগন্ধার সুবাস সহ্য করা অর্চির পক্ষে সত্যিই অসম্ভব।
মল্লারের সঙ্গে আজ শপিংয়ে বেরোনোর কথা আছে রুমির। ওর হাতের আংটিটা কিনবে দুজনে মিলে।
রুমি হালকা আকাশনীল সালোয়ারটা পরতেই মনে হল, অর্চি পাশ থেকে বলল, এই কালারটা তোর জন্য পারফেক্ট। একটা এক্সপোতে গিয়ে একবার ও আর অর্চি পছন্দ করে কিনেছিল সালোয়ারটা।
রেডি হয়ে বেরোতে যাবে ঠিক সেই সময় মল্লার জানাল, সরি রুমি, আজ যাওয়া ইমপসেবেল, প্রোগ্রামটা আগামী কাল করো।
রুমি নিশ্চুপ।
ছোটবেলায় একবার মা বাবার সঙ্গে রুমি সিকিম বেড়াতে গিয়েছিল। একটা পাহাড়ের ধার ঘেঁষে গাড়িটা চলছিল। রুমি চোখ বন্ধ করে মায়ের হাতটা ধরে ছিল। বারবার মনে হচ্ছিল খাদের একেবারে ধারে ও দাঁড়িয়ে আছে। একটু অন্যমনস্ক হলেই পা পিছলে নীচে পড়ে যাবে। একটা ভয় ভয় শিহরণে কেঁপে উঠছিল রুমি।
আজ আবার সেই ছোটোবেলায় পুরোনো অনুভূতিটা ফিরে এল ওর মনে। ঠিক সেই সময়েই একটুও অস্পষ্ট নয়, স্পষ্ট একটা মুখ রুমির খোলা চোখের সামনে ভেসে উঠল। এরপর সময় নষ্ট করলে বোধহয় চূড়ান্ত দেরি হয়ে যাবে। কাঁধে ব্যাগটা নিয়ে ট্যাক্সি ধরে সোজা ছুটল নির্দিষ্ট ঠিকানায়। না আজ আর ওর সামনে কোনো আবছা পথ নির্দেশ নেই, খুব পরিষ্কারভাবে সম্মুখের পথটা ও দেখতে পাচ্ছে।
অফিসের লিফটে যথেষ্ট ভিড়। এক মুহূর্ত সময় নষ্ট করার সময় যেন রুমির হাতে নেই। ওর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে গেছে। শুধু জানাতে হবে ওকে। অফিসের সিড়ি বেয়ে রুমি ছুটছে। প্রায় হাঁফাতে হাঁফাতে ঢুকল রুমি।
ওকে দেখেই অর্চি চমকে উঠেছে। এভাবে ফোন না করে সোজা ওর অফিসে তো কখনো রুমি আসেনি। ওর তো মল্লারের সঙ্গে শপিংয়ে বেরোনোর কথা। নিশ্চয় মল্লার আবার কোনো গন্ডগোল করেছে। রুমির মুখটাও লাল হয়ে রয়েছে। অর্চির ইচ্ছে করছে ছুটে গিয়ে মল্লারের গালে ঠাসিয়ে একটা থাপ্পড় দিতে। অকারণে রুমিকে এত কষ্ট কেন দিচ্ছে ছেলেটা!
একটা চেয়ারে বসেছে রুমি। অর্চি জলের বোতলটা এগিয়ে দিল। রুমি কথা না বলে জলটা খেয়ে বলল, তোর সঙ্গে কথা আছে।
অর্চি বলল, অফিসের পরে বললে হয় না। রুমি ঘাড় নেড়ে জানাল না হয় না।
অফিসের অনেকেই দেখছে দেখে রুমিকে নিয়ে নিজের কিউবের মধ্যে ঢুকে এল অর্চি। রুমির ঠোঁট দুটো থর থর করে কাঁপছে। চোখ দুটোও চিক চিক করছে যেন।
খুব আস্তে আস্তে রুমি বলল, ঠিক তেত্রিশ মিনিট আগেই আমি প্রথম বুঝতে পারলাম আমি মল্লারকে চাই না। আমি অন্য কাউকে ভালোবাসি অর্চি। তুই হয়তো বুঝতে পারছিস আমি কাকে ভালোবাসি।
অর্চি হাত দিয়ে রুমির মুখটা চেপে ধরে বলল, একটু চুপ কর। অনেকদিন স্বপ্নে দেখেছি আমি তোকে প্রোপোজ করছি। ভোরের পাখিরা জাগিয়ে দিয়ে বলে গেছে ওটা নিছকই স্বপ্ন। আজ সেই বহুবার দেখা স্বপ্নের পুনরাবৃত্তি হোক বাস্তবের মাটিতে। হাঁটু গেড়ে সবুজ কার্পেটের ওপর বসে আছে অর্চি। হাতে আজ টিউলিপ নেই। নিজের পকেটের পেনটা নিয়ে সিনেমাটিক ঢঙে ও বলল, তুই আমার সবটুকু জানিস। তুই তো ক্লাস থ্রি থেকেই জানিস আমি ম্যাজিক জানি। তাই আজ তোর সব দুঃখটুকু নেব, আর তোকে দেব সবটুকু সুখ।
রুমি বলল, এবার চল আমার বাবাকে প্রোপোজ করবি। অর্চির পকেটে তখন ট্রান্সফারের অ্যাপ্লিকেশনটা মুচকি মুচকি হাসছে।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন