অর্পিতা সরকার
ডেডবডি দেখে কোনো মানুষ যে তার উদ্দেশে জুতো ছুঁড়তে পারে তা এই প্রথম দেখল সৌম্য। রীতিমতো চোর-ডাকাত মারা গেলেও মৃত্যুর পর সকলে তার এক টুকরো ভালো গুণ খোঁজার চেষ্টা করে থাকে। আহা অমুক লোকটা খুনি হোক তবুও নিজের মাকে ভালোবেসেছিল গো! এই ধরনের কথাই সাধারণত মৃতের উদ্দেশে বলা হয়। সেখানে সুখেনবাবুর মতো নির্বিবাদী মানুষটা মারা যাবার পর তার দুই ছেলেই ফুলের বদলে মৃতদেহের ওপর জুতো ছুঁড়েছে।
পোস্ট মর্টেমের পর অনেকেই সেই দৃশ্য দেখেছে।
সজল আর উজ্জ্বল এক মুখ থুতু ফেলে বলেছে, শালা বাপটা মরেও শান্তি দিল না। এখন থানা পুলিশ দৌড়ে বেড়াও।
অবশ্য যে বাসের সাথে ধাক্কা লেগে সুখেনবাবু মারা গেছেন, সেই বাসের মালিকের কাছে আর ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির কাছেও ছুটেছে একভাই।
বাবার মৃতদেহের বদলে টাকাটা তো ঠিক সময়েই নিতে হবে।
সৌম্য সজলের ছোটবেলার বন্ধু। তাই ওদের বাড়িতে ছোট থেকেই যাতায়াত ছিল ওর। কতবার খেলতে এসে কাকিমার হাতে লুচি, ঘুগনি খেয়ে গেছে ও। কাকু মাঝে মাঝেই পিঠ চাপড়ে বলতেন, বড় হও, মানুষ হও।
কাকু রেলে চাকরি করতেন, সকালবেলা বেরিয়ে যেতেন ফিরতে সেই সন্ধে। কাকু আর কাকিমার মধ্যে একটা অযথা দূরত্ব চোখে পড়েছিল সৌম্যর। কেমন দূরত্ব সঠিক ভাবে হয়তো বোঝাতে পারবে না সৌম্য, তবে এই অচেনা দূরত্বটা ওর বাবা-মা বা মাসি-মেসোর মধ্যে কোনোদিন দেখেইনি।
অথচ রমলা কাকিমা মানে সজলের মা কিন্তু কাকুর অসম্ভব যত্ন করতেন। কাকুও কাকিমাকে স্নেহের চোখেই দেখতেন। তবুও… ওই খটকাটা সৌম্যর চোখে লাগত। কখনো সজলকে জিজ্ঞেস করেনি। কারোর বাবা-মা সম্পর্কে কিছু জানতে চাওয়াটা বড্ড অশোভন হয়ে যায়।
তবে মাঝে মাঝে কলেজে এসে সজল বলত, কপাল করেছি বটে! আমাদের প্রেমের বয়সে এখন আমাদের বাপটা প্রেম মেরে বেড়াচ্ছে, আর সে বুড়ি মাগিও বিয়ে-থা না করে সুখেন দত্তর জন্য পসরা সাজিয়ে বসে আছে।
সৌম্য বলেছিল, তুই চিনিস সেই ভদ্রমহিলাকে?
সজল বলেছিল, চিনি বলতে একদিনই দেখেছিলাম, বাবার সাথে। ফলো করে গিয়ে দেখি, হাতিবাগানে একটা বাড়িতে থাকে, সম্ভবত চাকরি করে বুঝলি।
দুই ছেলের বাপ, ঘরে বউ আছে জেনেও যে কি করে মহিলা বাবাকে এখনও… কোনোদিন কিছু বলিনি, শুধু সমাজে আমার আর দাদার সম্মানের কথা ভেবেই।
মুখটা কালো করে সজল মাটির দিকে চোখ নামিয়েছিল। সৌম্য বুঝতে পারছিল, নিজের বাবার সম্পর্কে বন্ধুর কাছে এভাবে বলে ফেলে অন্তর্দ্বন্দ্বে ভুগছে সজল। ওকে স্বাভাবিক করার জন্যই বলেছিল, দেখ কাকু তো কোনোদিন তোদের যত্নের কোনো ত্রুটি করেননি। তাছাড়া কাকিমারও কোনো অবহেলা করেননি, তাই থাক না গুরুজনের কাজের সমালোচনা নাই বা করলাম।
তাও সজলের মধ্যে মাঝে মাঝে একটা আক্রমণাত্মক মুখ কাজ করত।
একদিন এসে বলল, শালা যার জন্য চুরি করি সেই বলে চোর। মাকে বলতে গেলাম বাবার কীর্তির কথা… সবটা শুনে মা বলল, তোমার বাবার নামে সমালোচনা করাও পাপ।
ভারতীয় নারী, পতিব্রতা নারী।
নীরব শ্রোতা হওয়া ছাড়া আর কিছু করার ছিল না এক্ষেত্রে।
তারপর তো কেটে গেছে বেশ কয়েকটা বছর। সজল আর সৌম্য দুজনেই এখন চাকুরিজীবী। সজলের দাদা উজ্জ্বলদার বিয়ের ঠিক হয়েছে, আর দু-মাস বাকি। সজল একদিন সৌম্যর বাড়িতে এসে বলে গিয়েছিল, দাদার বিয়েতে আমাদের বাড়িতে সাতদিন ধরে তুই থাকবি। আমি একা সামলাতে পারব না।
সৌম্য বলেছিল, নিশ্চয়। উজ্জ্বলদা তো আমারও দাদারে। অনেক দিন পর দুই বন্ধু প্রাণ খুলে গল্প করেছিল। শুধু যখন সৌম্য জিজ্ঞেস করেছিল, সুখেন কাকু কেমন আছেন রে? তখন সজলের চোখে দেখেছিল এক রাশ ঘৃণা।
ভালোই, বলে প্রসঙ্গটা পালটেছিল।
উজ্জ্বলদার বিয়ের আগেই ঘটে গেল এমন দুর্ঘটনা।
সুখেন কাকু মাত্র মাসখানেক আগে রিটায়ার করেছেন। অফিস সংক্রান্ত কোনো কাজেই বোধহয় অফিসে যাচ্ছিলেন, রাস্তা পেরোতে গিয়ে বাসের ধাক্কায়, ইন্টারন্যাল হ্যামারেজ বোধহয়… শরীরটা ওপর থেকে দেখে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।
কাকিমা নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে কাকুর মৃতদেহের একপাশে।
সুখেন কাকু চরিত্রহীন হতে পারেন, কিন্তু অত্যন্ত সজ্জন ব্যক্তি ছিলেন বলে পাড়ায় কখনো কারোর সাথে ঝগড়া হয়নি। পাড়ার অনেক ছেলেই এসেছে শববাহী হিসাবে।
উজ্জ্বলদা এই মাত্র ইন্স্যুরেন্সের লোকেদের সাথে কথা বলে বাড়ি ঢুকল।
ঢুকেই ভাইকে বলল, বেওয়ারিশ লাশ বলে ফেলে দিয়ে এলি না কেন? বেঁচে থাকতে তো ওনার কথায় চলতে হয়েছে আমাদের। তা হলে অবশ্য ডেথ সার্টিফিকেট পাওয়া যেত না। তাহলে ফিক্সড ডিপোজিট আর টাকা পয়সা পাওয়ার সমস্যা হত।
রমলা কাকিমা হঠাৎই উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আরেকজন কোথায়?
সে না এলে মুখে অগ্নি সংযোগ হবে না যে?
সজল, উজ্জ্বলদা অবাক চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে। তার দুই ছেলেই তো বর্তমান। তাহলে মা আবার কার কথা বলছে?
তার মানে কী ওই মহিলার সাথে অবৈধ সম্পর্কের জেরে সুখেন কাকুর কোনো অবৈধ সন্তান আছে নাকি? কাকিমা হয়তো তার অস্তিত্বের কথা জানেন, তাই আজ কাকুর মৃতদেহের সামনে তাকে আনতে চাইছেন!
উজ্জ্বলদা বলল, ওহ শুধু প্রেমিকা নয়, আবার ছেলেও আছে বুঝি বাবার?
রমলা কাকিমা হাত নেড়ে সৌম্যকে ডাকলেন।
খুব ধীরে ধীরে যে ঠিকানাটা বললেন, সেটা হাতিবাগানের কোনো একটা বাড়ির।
সজল আর উজ্জ্বলদা তাড়া দিচ্ছে সুখেন কাকুর মৃত দেহ নিয়ে শ্মশানের উদ্দেশে যেতে চায়। কিছুতেই বাবার সম্পত্তির তৃতীয় ভাগীদারকে প্রবেশ করতে দেবে না ওরা।
শান্ত রমলা কাকিমার উগ্র মূর্তি দেখে দুই ছেলেই একটু ঘাবড়ে গেছে। রমলা কাকিমা বললেন, সৌম্য ফেরার আগে ওনার দেহ এ বাড়িতেই থাকবে।
সৌম্য ততক্ষণে বাইকে স্টার্ট দিয়েছে।
হাতিবাগানে একটা গলির মধ্যে দোতলা বাড়ির একতলার ঠিকানায় পৌঁছে গেছে সৌম্য। কলিংবেল বাজাতেই একজন মহিলা দরজা খুলল। কাঁচাপাকা চুল, পরনে সবুজ সাদার একটা জামদানী, চোখে হাই পাওয়ারের চশমা, কানে দুটো ছোট কানফুল, হাতে একজোড়া সোনার বালা।
এটুকু সাজে যে কোনো মহিলাকে এতটা সুন্দর লাগতে পারে, সেটা সৌম্য এই প্রথম দেখল। গাম্ভীর্যের আবরণে একটা কোমল চোখের চাহনি।
অষ্টাদশীর গলায় ওই মহিলা বললেন, কাকে চান?
সৌম্য বলল, আপনিই মানসীদেবী?
ঘাড় নেড়ে বললেন, হ্যাঁ, কিন্তু এই মুহূর্তে তো আমি আর টিউশনি করছি না। বয়স হয়েছে। স্কুলের চাকরিটা ছাড়তে পারলেই বাঁচি।
ভদ্রমহিলা সম্ভবত সৌম্যকে কোনো কোচিং সেন্টারের হেড ভেবেছেন।
সৌম্য ভুলটা ধরিয়ে দিয়ে বলল, আমি এসেছি সুখেন কাকুর বাড়ি থেকে। আমাকে রমলা কাকিমা পাঠিয়েছেন।
সৌম্য স্পষ্ট দেখল, চমকে উঠলেন মানসীদেবী।
ধীরে ধীরে বললেন, আমি একা মানুষ। জুনিয়ার হাই স্কুলে শিক্ষকতা করি। বাকি জীবনটা আমার নিজের জমানো টাকায় চলে যাবে বাবা। রমলাকে গিয়ে বলো, মানসী বলেছে, সুখেনের কোনো সম্পত্তি আমি নেব না। সুখেনকে গিয়ে বলো, ওদের নামেই যেন সব লিখে দেয়।
সৌম্য বলল, আপনাকে একবার অন্তত ও বাড়িতে যেতে বলে দিয়েছেন কাকিমা। মানসীদেবী হেসে বললেন, সই করতে হবে…
সুখেন খুব চিন্তা করছিল। দুই ছেলে নাকি বাপের সম্পত্তি নিয়ে মারপিট করবে, রমলাকে কিছুই দেবে না। এর মধ্যে আবার আমি ঢুকলাম কী করে আমার তো কোনো দাবি নেই ওর সম্পত্তিতে!
কাকিমা বারবার সৌম্যকে বলে দিয়েছেন, হাই প্রেসারের রুগী মানসীদেবীকে যেন কোনোভাবেই ওর বাড়িতে সুখেন কাকুর মৃত্যু সংবাদ দেওয়া না হয়।
এদিকে মহিলা সম্পত্তির কেচ্ছা ভেবে কোনোমতেই যেতে চাইছেন না।
শেষে সৌম্য বলল, আসলে সুখেনকাকু একটু অসুস্থ হয়ে পড়েছেন । আপনাকে একবার দেখতে চেয়েছেন।
কথায় কাজ হল মনে হচ্ছে।
এক সেকেন্ড দেরি না করে মানসীদেবী ঘরে চাবি ঝুলিয়ে সৌম্যর বাইকে এসে বসলেন।
খুব আস্তে আস্তে জিজ্ঞেস করলেন, বেঁচে আছে তো? সেরিব্রাল নাকি? তারপরের কথাগুলো স্বগতোক্তি। এত বললাম, চিন্তা করো না। তবুও দুশ্চিন্তা করে যেত। শুধু বলতো, ও চলে গেলে নাকি রমলাকে ছেলেরা দেখবে না।
ভাবতে ভাবতে শেষে নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়ল।
বাড়ির সামনে তখন অনেক লোক।
বুদ্ধিমতী মহিলা মানসীদেবী।
সৌম্যকে বললেন, কখন হল?
সৌম্য বলল, বাস অ্যাক্সিডেন্ট!
বাড়ির ভিতরে ঢুকতেই রমলা কাকিমা জড়িয়ে ধরলেন মানসীদেবীকে।
সাধারণত এই ধরনের সম্পর্কে স্বামীর অবৈধ প্রেমিকাকে তার স্ত্রী গালাগাল দেয়, খারাপ নজরে দেখে। এক্ষেত্রে তো রমলা কাকিমাকে অত্যন্ত আধুনিকা ভাবতে হবে।
মানসীদেবীর দু’চোখে জল।
রমলা কাকিমা প্রলাপ বকছেন। তোমাকে ফাঁকি দিয়েছিলাম আমি, তাই আজ আমাকে ফাঁকি দিয়ে চলে গেল ও।
মানসীদেবী কাকিমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলছেন, এই সময় তোমাকে শক্ত থাকতে হবে রমলা। সুখেন নেই, তোমাকেই তো দাঁড়িয়ে থেকে ছেলের বিয়ে দিতে হবে।
সৌম্য শুধু অবাক হয়ে দেখছে। শুধু সৌম্য নয়, দু-ভাই— এতদিন ধরে যারা ওঁকে অনেক নোংরা কথা বলেছে তারাও হাতের কাছে মানসীদেবীকে পেয়েও সামনে কিছু বলতে পারছে না।
মানসীদেবী সুখেন কাকুর পায়ের কাছে এসে বসলেন। নিজের আঁচল দিয়ে ওনার পাটা মুছিয়ে দিলেন যেন। মাথায় ছোঁয়ালেন হাতটা। তারপর নিজের হাত থেকে আংটিটা খুলে সুখের কাকুর পায়ের কাছে রেখে দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। নির্দেশের গলায় বললেন, চুল্লিতে ভরে দিও না ওকে। ওর ওই ঘরটায় বড্ড ভয় ছিল। কাঠের চিতা সাজিয়ে ওকে দাহ করো।
শেষের দিকে গলাটা ধরে এসেছিল ওনার।
হঠাৎ রমলা কাকিমা সুখের কাকুর উদ্দেশে বললেন, আজ তুমি চলে গেছ তাই তোমার কাছে দেওয়া প্রতিজ্ঞা ভাঙলেও আর আমার কোনো ক্ষতি হবে না নিশ্চয়, আজ তোমার সামনেই আমাকে বলতে হবে সবটুকু।
ত্রিশ বছরের সব গোপন কথা। মানসীদেবী বললেন, থাক না রমলা। এই অবস্থায় ওই সব কথা নাই বা বললে। তাছাড়া পুরোনো কথা গোপন থাকাই ভালো!
রমলা কাকিমা দু-দিকে ঘাড় নেড়ে বললেন, তুমি আমাকে অনেকদিন চুপ করিয়ে রেখেছ, দুই ছেলের চোখে ওই ভগবানের মতো মানুষটার জন্য শুধু ঘৃণা দেখেছি, তবুও শুধু তোমার আর ওঁর কথা শুনে আমি ছেলেদের কাছ থেকে সবটুকু আড়াল করেছি। আজ বলতে দাও।
পাড়ার প্রচুর লোক জমে গেছে। মৃতদেহের চরিত্রের সদগুণ বদগুণ শোনার লোকের অভাব নেই। কিছুক্ষণের মধ্যেই যে লোকটা ছাইভস্মে পরিণত হয়ে যাবে, তাকেও সমাজের কাছে নিজের চরিত্রের দোষস্খলন করে যেতে হচ্ছে।
খুব ধীরে ধীরে রমলা কাকিমা বলতে শুরু করেছেন। যেন স্মৃতির এক একটি পাতার ধুলো ঝাড়ছেন সযত্নে।
চোখ দুটো মাঝে মাঝেই বন্ধ করে ফ্ল্যাশব্যাকে দেখে নিচ্ছেন ত্রিশ বছর আগের এক বৃষ্টি ভেজা সন্ধেকে।
রেললাইন ধরে পাগলের মতো ছুটছে রমলা। কোলে একটা বছর দুয়েকের ছেলে আর পেটে আট মাসের সন্তান। তিন জনেরই মৃত্যু কাম্য। স্বামী মারধোর সহ্য করাটা তখন রমলার সহ্য হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু নিজের গর্ভবতী স্ত্রীর ঘরে পরপুরুষকে ঢুকিয়ে দিয়েছিল রমলার স্বামী। ওর ব্যবসার উন্নতির জন্য। আর সহ্য করতে পারেনি রমলা, সন্তানদের নিয়ে তাই মৃত্যু চেয়েছিল সেদিন। ট্রেনটা আসছিল ধেয়ে এমন সময় একটা লোক এসে টেনে নিয়েছিল ওদের। জীবন ফিরিয়ে দিয়েছিল রমলা আর ওর কোলের সন্তানের। সেই রাতে ওকে নিজের বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিল মানুষটা। সন্তান কোলে গর্ভবতী একজন মহিলাকে নিয়ে বাড়িতে ঢুকতেই পাড়ায় রাষ্ট্র হয়ে গিয়েছিল। সুখেনের লুকিয়ে রাখা স্ত্রী আর সন্তান এসেছে। সুখেনের দাদারা মেনে নেয়নি ওর জন্য পরিবারের বদনাম হোক।
গৃহ ছাড়া হয়ে একটা ভাড়া বাড়িতে এনে তুলেছিল ওদের। দুটো দিন যেতে না যেতেই বাড়িওয়ালা লোক ডেকে ওদের বিয়ে দিয়ে দেয়। সুখেনের কোনো কথাই তখন কেউ শুনতে নারাজ। বিয়ের কদিনের মধ্যেই রমলা জানতে পারে সুখেন আর মানসীর কলেজ লাইফ থেকে প্রেমের কথা, ওদের আংটি বদলের কথা। মানসীর দিদির বিয়ে হয়ে গেলেই ওদের বিয়ে হবার কথা ছিল। সেদিন থেকে মানসীর কাছে অপরাধী হয়ে আছে রমলা। সুখেন অনেক বুঝিয়েছে মানসীকে, সংসার পাততে বলেছে অন্য কোথাও, কিন্তু মানসীর এতটাই জেদ যে কোনো ভাবেই বিয়ে করেনি। দাদাদের সংসার থেকে চলে এসে ঘর ভাড়া করে কাটিয়ে দিল জীবনটা শুধু সুখেনকে ভালোবেসে।
সজলের জন্মের পর রমলা চলে যেতে চেয়েছিল অন্য কোথাও। মানসীই জোর করে যেতে দেয়নি ওকে। দুই সন্তান নিয়ে পথে পথে ঘুরতে দেয়নি রমলাকে। তাই কোনোরকম শারীরিক সম্পর্ক ছাড়াই ও আর সুখেন স্বামী-স্ত্রীর জীবন কাটিয়েছে দিনের পর দিন। সুখেন বলেছিল, দুটো ছোট ছোটো নিষ্পাপ শিশুর চোখে নাই বা তাদের আসল বাবার পরিচয়টা প্রকট হল! আমিই ওদের বাবা। প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিল রমলা, কোনোদিন সজল আর উজ্জ্বল জানবে না, ওদের আসল বাবার পরিচয়।
ওদের জন্মদাতা তার কয়েকমাসের মধ্যেই নতুন বিয়ে করে সংসার পেতেছিল, সে খবরও রমলার কানে এসেছিল।
মানসী প্রতি পুজোয় সজল আর উজ্জ্বলের জন্য জামা কিনে পাঠাতো সুখেনের হাত দিয়ে। মানসী বলতো, ওদের বলো, ওদের মাসিমণি পাঠিয়েছে।
শব যাত্রীরা এগিয়ে চলেছে, দুই দিকে দুই ছেলের কাঁধে চড়ে চলেছে মান-অপমানের ঊর্ধ্বে থাকা একজন মানুষ। যার পরিচয় ছিল সজল-উজ্জ্বলের বাবা।
এই প্রথম দুই ভায়ের চোখের জলে ভাসতে ভাসতে তাদের বাবা চলেছে মহাপ্রস্থানের পথে। পালিত পিতার ঋণ হয়তো তারা এ জীবনে শোধ করতেও পারবে না।
পিছনে দুজন মহীয়সী মহিলা… একজন তাকে নিঃস্বার্থ ভাবে ভালোবেসেছে সারাজীবন, আর একজন মানবরূপী ঈশ্বর জ্ঞানে পূজা করে গেছেন। সৌম্য সুখেন কাকুর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখল… একটা পরিতৃপ্তির হাসি যেন বিরাজ করছে গোটা মুখ জুড়ে। নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে অন্যকে খুশি করার গর্বেই হয়তো এই তৃপ্তি।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন