অর্পিতা সরকার
মর্নিং ওয়াকে বেরিয়ে একটু হালকা পায়ে হেঁটেই একটা বেঞ্চে এসে বসে পড়ল মণিময় চক্রবর্তী। জীবনে তার বড় বিতৃষ্ণা এসে গেছে। সত্যি বলতে কী, হাই ব্লাডপ্রেশার বা সুগারের জন্য ও হাঁটতে বেরোয় না সাত সক্কালে বরং সাবিত্রীর হাত থেকে পালাবে বলেই বের হয়।
না হলে ভোর থেকে ওই একই কথা, এত নোলা কেন? রোগ বাঁধানোর সময় মনে ছিল না? সাবিত্রীকে খুব বলতে ইচ্ছে করে মণিময়ের যে সুগার, প্রেশার কোনোটাই ঠান্ডা লাগা বা জ্বর নয় যে বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে বাঁধবে।
বলতে তো অনেক কিছুই ইচ্ছে করে মণিময়ের, কিন্তু ও বেশ জানে সাবিত্রীর সঙ্গে তর্কে জেতা ওর কম্ম নয়। সাবিত্রী যেন চলতি ফিরতি এনসাইক্লোপিডিয়া। ওর অজ্ঞাত কিছুই নেই। সব বিষয়ে মণিময়কে জ্ঞান দিতে থাকে চব্বিশঘণ্টা। মণিময় রেলের উঁচু পোস্টে চাকরি করে। বয়েস সাতান্ন বছর। যদিও বয়েসের ছাপ ওর শরীরে এখনও সেভাবে থাবা বসাতে পারেনি। সুগার, প্রেশার থাকলেও এখনও মণিময়কে পঁয়তাল্লিশের দোরগোড়ায় বলে চালানো যায়। হাতের মুঠোয় সাত থেকে দশ বছর ও বেশ লুকিয়ে রাখতে পারে। মাথা ভর্তি কলপ করা চুল আর জিন্স টি শার্টে ওকে এখনও বেশ হ্যান্ডসাম লাগে। তুলনামূলকভাবে সাবিত্রী বুড়িয়েছে বেশি। ভারী চেহারায় বয়েসও জানান দেয় বেশি। অবশ্য সে নিয়ে ওর কোনো আক্ষেপ নেই। শুধু একটু ভালো ব্যবহারের প্রত্যাশী ছিল মণিময়। মাঝে মাঝেই সাবিত্রী বেশ তির্যকভাবে তাকিয়ে বলে, এত সাজগোজ করে ট্রেন চালাতে যাচ্ছ? মণিময় আজও স্ত্রীকে বোঝাতে পারেনি, রেলে চাকরি মানেই ট্রেন চালানো নয়। এমনকী নতুন গাড়ি কেনার পরেও সাবিত্রী শ্বশুরবাড়ির সকলের সামনেই বলেছিল, তোমাদের জামাই ট্রেন চালাতে পারলেও গাড়ি পারে না। তাই ড্রাইভার রাখতে হয়েছে।
সাবিত্রীর একটা অদ্ভুত স্বভাব লক্ষ্য করেছে মণিময়, একবার যা মাথায় ঢুকে যাবে তাকে কিছুতেই মাথা থেকে বের করা সম্ভব নয়। অগত্যা মণিময় আজও ট্রেনের ড্রাইভার হয়েই রয়ে গেলেন।
সাবিত্রী উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেছিল, নেহাত অশিক্ষিত নয়, তবুও এসব কিম্ভূত যুক্তির সঙ্গেই বেঁচে আছে এত কাল। সাবিত্রী আসলে মণিময়ের মায়ের ছেলেবেলার বান্ধবীর মেয়ে, তাই মায়ের পরম স্নেহের পাত্রী ছিল। মণিময়ের পছন্দের কোনো ধার দিয়ে না গিয়েই মা সাবিত্রীকে এ বাড়ির বউ হিসেবে নিয়ে এসেছিল। মণিময় আর সাবিত্রী দুজনে দুই মেরুর বাসিন্দা। মণিময় শৌখিন, শান্ত, রোমান্টিক মানুষ। অকাল বর্ষণে উদ্বেলিত হয় ওর হৃদয়। শরতের আকাশের পেঁজা মেঘের ভেলায় ভেসে সে পাড়ি দিতে চায় অজানার প্রান্তরে। পোশাক আশাক পছন্দের ব্যাপারেও খুব চুজি।
আর সাবিত্রী সম্পূর্ণ তার উল্টো। বাইরে বেড়াতে যাওয়াতে তার প্রবল আপত্তি। আচমকা বৃষ্টি নামলে হয় বড়ি নয় ছাদে মেলা শুকনো কাপড়ের শোকে ও মুহ্যমান হয়ে বৃষ্টিকেই শাপ দেয়। কখনো দুদণ্ড বসে গল্প করার সময় যেন তার নেই। কাজও নেই অবসরও নেই। বড্ড যান্ত্রিক মানুষ সাবিত্রী, ওর অনুভূতির সূক্ষ্ম তারগুলো যেন বাঁধতেই ভুলে গেছেন ভগবান। এদিকে প্রবল অনুভূতিপ্রবণ মণিময়ের মনের মধ্যে চলে অবিরত দ্বন্দ্ব।
সাবিত্রীকে বিয়ের প্রথম দিন থেকে ও যে ভাবে চায় তার সিকি ভাগও পায় না। সাবিত্রী সংসারের কাজ করে, কর্তব্যও করে, তবুও যেন একটা বড় ফাঁক থেকে যায় ওদের মনের মধ্যে। সেই ফাঁক ধীরে ধীরে বড়সড় ফাটল তৈরি করেছে। যদিও সাবিত্রী সেই ফাটলের আঁচটুকুও পায়নি কোনোদিন। তার কাছে সংসার মানে রোজদিন মাছের ঝোল ভাত, টিফিনে মণিময়ের বরাদ্দ রুটি তরকারি, রবিবার মাংস, দিনে বার দুই চা খাওয়া। সাবিত্রী টিভি সিরিয়ালের পোকা। কাজের অতিরিক্ত সময় ও টিভি দেখে, পাশে কাজের মেয়ে উর্মিলাও বসে থাকে। দুজনের বহু পর্যালোচনা চলে পরের সিনে নায়িকা বেঁচে উঠবে না মরে যাবে সেই নিয়ে। সাবিত্রীর জীবনে না আছে কোনো লক্ষ্য, না স্বপ্ন। এমন এক স্বপ্নহীন মানুষের সঙ্গে জীবন কাটাতে কাটাতে মণিময় ভুলেই গেছে স্বপ্ন দেখতে। এত বছর নির্বিবাদে সংসার করার পর ইদানীং মনটা বড় বিদ্রোহ করে ওঠে। মনে হয় ঠিক কী পেলাম মানিয়ে নিতে নিতে?
আর তখনই রাগ নামক ব্যাধি এসে বলে সব ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া যায়, সাবিত্রীর কথায় কথায় ভুলভাল নির্দেশ, অল্প জানা লোকজনের যুক্তির বেড়াজাল, অফিসের কলিগদের সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা, সবকিছুতে চিৎকার করে প্রতিবাদ করতে ইচ্ছে করে মণিময়ের। ইচ্ছে তো করে অনেক কিছুই, কিন্তু শেষপর্যন্ত নিজেকে সামলে নিয়ে ফিরে আসে স্বাভাবিক জীবনে। যেখানে ওকে সবাই আক্রমণ করলেও ওকে থাকতে হবে মুখ বন্ধ করে। প্রতিবাদ করলেই মণিময়ের বড্ড ভালো মানুষ নামটা যাবে ঘুঁচে।
ইদানীং একটা নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করেছে ও, যতটা সম্ভব বাইরে থাকার প্রচেষ্টা। ভোরে উঠে মর্নিংওয়াকের নাম করে পার্কে এসে বসে থাকে ঘণ্টাখানেক, বাজারে দুটো আলু-পটল কিনতে গিয়েও সময় কাটায় বেশি, অফিস থেকে ফিরেও স্টেশনে বেশ কিছু ট্রেনের আনাগোনা দেখে তবেই বাড়ি ফেরে ও। মুখচোরা বলে বন্ধুবান্ধব বরাবরই বেশি নেই মণিময়ের। তাই একলাই থাকে ও।
এই যেমন পার্কের বেঞ্চটাতে বসে আছে সামনের সবুজের দিকে তাকিয়ে।
পাশের বেঞ্চে মণিময়েরই সমবয়সি জনাপাঁচেক মানুষ বসে আছে। বার কয়েক চেষ্টাও করেছে ওরা মণিময়কে ওদের দলে টানতে, কিন্তু একদিনের আড্ডায় বসেই ও বুঝে গেছে এদের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আছে নিজের সন্তান নয় পুত্রবধূ, নয় স্ত্রী। পুত্রবধূর ছোট ছোট মডার্ন পোশাক থেকে শুরু করে জামাইয়ের স্যালারি পর্যন্ত উঠে আসে আলোচনায়। দমবন্ধ হয়ে আসছিল মণিময়ের। তাই বাধ্য হয়ে উঠে এসেছিল দলছুট হয়ে।
সাবিত্রী বলে, মিশুকে নয় মোটেই। আর পাঁচটা মানুষের মতো সংসার নিয়ে ভাবনা নেই মণিময়ের! কে জানে হয়তো ঠিকই বলে! মণিময় কোনোদিন মুখের ওপর বলে উঠতে পারেনি, কিসের সংসার সাবিত্রী? না আছে একটা সন্তান না তার ভাবনা! যা মাইনে পাই দুজনের বিলাসিতা করে কাটিয়েও ব্যাংকে জমে মোটা অঙ্কের টাকা। সেটাই দুজনের মৃত্যুর পরে কি হবে তাই জানে না মণিময়। বলতে পারে না সাবিত্রীকে কারণ সাবিত্রীর মহিলাজনিত সমস্যার জন্যই ওদের বাচ্চা হয়নি। দত্তক নিতে চেয়েছিল মণিময়, সেখানেও বাদ সেধেছিল সাবিত্রী, কার না কার সন্তানকে নাকি সে আপন করতে পারবে না। এরপরেও সেই মানুষটাকে কীভাবে ভালোবাসা যায় জানে না মণিময়। তবুও আছে, একসঙ্গেই আছে ওরা। এক ছাদের নীচেই। সাবিত্রী নিজেকে ঘোর সংসারী আখ্যা দিয়েছে আর মণিময়কে সৃষ্টিছাড়া। এই তকমা নিয়েই আপাতত মণিময় চক্রবর্তী বেঁচে আছে। অন্যমনস্ক মণিময় দেখছিল একটা নাম না জানা গাছের মাথায় একটা সবজে রঙের অচেনা পাখি বসে আছে আনমনে। কী সুন্দর এই বন্ধুত্ব, কেউ কারোর পরিচিত নয়, অথচ কী অবলীলায় গাছের আশ্রয়ে বসে রয়েছে পাখিটা।
আপনার পাশে একটু বসতে পারি স্যার? আচমকা সম্বিৎ ফিরে পেয়ে মণিময় দেখল, একটি বছর ছাব্বিশ-সাতাশের অত্যন্ত সুন্দরী মেয়ে জগিং শ্যুট পরে, কানে হেডফোন লাগিয়ে হাঁপাচ্ছে।
মণিময় সংকোচে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, নিশ্চয়! বোসো।
মেয়েটি আলগা হেসে বলল, আমি তো আপনাকে উঠতে বলিনি, বলেছি আপনার পাশে বসতে পারি? ওদিকের বেঞ্চগুলো ভর্তি তাই…
মণিময় যন্ত্রচালিতের মতো বেঞ্চের এক কোণে বসে পড়ল আড়ষ্ট হয়ে। মেয়েটি সাবলীলভাবে নিজের ডান হাতটা বাড়িয়ে বলল, আমি ঐশ্বর্য। সরি আমি কারোর মা, মামনি নই, শুধুই ঐশ্বর্য। আসলে একটু বয়স্ক মানুষরা অল্পবয়সি দেখলেই প্রথমে মা, মামনি দিয়ে শুরু করে খানিকক্ষণ পরে আমার পার্সোনাল লাইফে প্রবেশ করতে চায় নিশ্চিন্তে। ওটা আমি একেবারেই পছন্দ করি না। বয়েসের দোহাই দিয়ে মানুষের পার্সোনাল লাইফে প্রবেশ করায় আমি ঘোর বিরোধী। আর শাসন করার ভঙ্গিমাটিও আমার বড্ড কৃত্রিম লাগে।
মণিময় বলল, আমি মণিময় চক্রবর্তী। বয়েস সাতান্ন, রেলে কর্মরত। আমি সাধারণত মানুষের প্রাইভেসিকে সম্মান জানাতে পছন্দ করি, অন্য কেউ সেটা করুক এটাই চাই, যদিও তা পাই না।
মণিময় দেখছিল, এই প্রজন্ম কত অবলীলায় নিজেদের কথা বলে দিতে পারে, অথচ ও পারে না সামান্য সাবিত্রীর মুখোমুখি হয়ে নিজের পছন্দ, অপছন্দটুকু বোঝাতে।
ঐশ্বর্য কান থেকে হেডফোন খুলে বলল, সবুজের পার্থক্য বোঝেন? নাকি সবুজ বললে চোখের সামনে একটাই রং ভেসে ওঠে?
মণিময় একটু থমকে গিয়ে বলল, না, অন্তত পাঁচটা শেড ভেসে ওঠে। ওই যে, ওই গাছটার সবুজটা হল, হলদে আর নীলের মিশ্রণ। ঘাসের সবুজটা সবজে আর হলুদের মিশ্রণ। ওই যে ওই বট গাছের পাতাটা সবুজ আর সবুজের মেলবন্ধন, টিয়ার রংটা, সবুজের থেকে কেউ জোর করে খানিকটা নিয়ে অন্য কাউকে দিয়ে দিয়েছে যেন তাই কিছুটা ফিকে।
ঐশ্বর্য উৎসাহের আতিশয্যে বলল, ও মাই গড! ইউ আর গর্জিয়াস। ঠিক এমনই ভাবনা আমারও। কিন্তু কাউকে বোঝাতেই পারি না রঙের প্রকারভেদগুলো। বড়জোর হালকা সবুজ আর গাঢ় সবুজে সীমাবদ্ধ রাখে সবাই। তুমি কিন্তু ব্রিলিয়ান্ট। তারপরেই জিভ কামড়ে বলল, সরি, আমি আপনাকে তুমি বলছি।
মণিময় এমন একটা সাবলীল প্রাণবন্ত মেয়ের দিকে তাকিয়েছিল অপলক। সামনে দিয়ে দুজন মধ্যবয়স্ক পরিচিত ভদ্রলোক পেরোনোর সময় বলে গেল, আহা এই বয়েসেও কচি জোটানো যায় তাহলে!
ঐশ্বর্যর সামনে এমন কথা শুনে কানের লতি লাল হয়ে যাচ্ছিল ওর। কিন্তু মণিময় লক্ষ্য করল মেয়েটার মধ্যে কোনোরকম হেলদোল নেই। একই গলার স্বরে বলল, তুমি কী লজ্জা পাও নাকি এসব কথায়? আরে ধুর, এরা তো ফ্রাস্ট্রেশনের রোগী। নিজেরা ভীষণভাবে বিফল জীবনে, তাই এভাবে ব্যর্থতা উগলে দেয়। এদের কথায় কান দিও না।
আমি একজন ওয়াইল্ড লাইফ ফটোগ্রাফার। আমি ঘন অন্ধকারেও রং খুঁজে পাই। আমার ছবিগুলো দেখো তুমি। নিজের মোবাইলের গ্যালারিতে গিয়ে দেখাচ্ছিল ছবিগুলো।
ঐশ্বর্যর ভিজে ভিজে হাতের আঙুলগুলো ছুঁয়ে যাচ্ছে মণিময়কে। লীনতাপের কারণেই কিনা জানে না, মণিময়ের মৃতপ্রায় জীবনটা যেন মুহূর্তে সজীব হয়ে উঠছে। আজ মণিময় বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল অন্য একটা উদ্দেশ্য নিয়ে। এখন আর সেই উদ্দেশ্যে স্থির নেই ও, কোথাও একটা ভাঙন ধরেছে ওর মনের কোণে, সেটা ও বেশ বুঝতে পারছে।
মণিময় প্রায় চিৎকার করে বলে উঠল, জেব্রা? আমার সব থেকে পছন্দের পশু। আসলে কী জানো ঐশ্বর্য আমাদের জীবনের দুটোই মাত্র রং, সাদা আর কালো। এই সাদার ওপরে অন্য শেড ঢেলে আমরা অন্য রং বানাই। আর কালো তো আমাদের বিলাসিতা। দুঃখ থেকে মনখারাপ আবার ঔদ্ধত্য থেকে অহংকার সব প্রকাশ করি কালো দিয়ে। এই দুটো রং একই শরীরে এভাবে ধারণ করে জেব্রা।
ঐশ্বর্য উৎসাহের আতিশয্যে ওর প্রায় গায়ের কাছ ঘেঁষে বসে বলল, তোমার ভালো লাগছে মণিময়? এই প্রথম কেউ আমার তোলা ছবি দেখে এতটা প্রশংসা করল। নাহলে আর সকলে তো হয় আমার রূপের, নয় আমার জব প্রোফাইলের প্রশংসা করে। আচ্ছা বলত, পিকক গ্রীন রংটা কোন কোন রঙের মিশ্রণে তৈরি?
কথা বলতে বলতে ওরা দুজনেই খেয়াল করেনি মর্নিং ওয়াকের টাইম কখন যেন অতিবাহিত হয়ে গেছে। মণিময়ের ফোনটা ভাইব্রেট করে উঠল।
রিসিভ করতেই ও প্রান্তের চিৎকার শোনা গেল, বাড়ি ফিরে, গিলে তারপর অফিস যাবে নাকি ওখান থেকেই যাবে?
স্বপ্নের ঘোরটা কেটে গিয়ে রূঢ় বাস্তবের মাটিতে আছড়ে পড়ল মণিময়। ধীর শান্ত বিষণ গলায় বলল, আসছি।
ঐশ্বর্য হেসে বলল, তোমার বেটারহাফ বুঝি খুব রাগী?
মণিময় নরম হাসল। মনে মনে বলল, আজ তুমি আমায় বাঁচিয়ে দিলে ঐশ্বর্য।
ঐশ্বর্য হাসতে হাসতেই বলল, কাল আসছ তো? কাল আমি ক্যামেরা নিয়ে আসব, তোমাকে ফটোগ্রাফির খুঁটিনাটি শেখাব।
গতকাল রাতেও সাবিত্রী বেশ কয়েকটা কথা শুনিয়ে দিয়েছিল মণিময়কে। মণিময় শুধু একটাই কথা বলেছিল, সুগার পেশেন্ট বলে কী রুটিতে রেগুলার ডুমুরের তরকারি খাওয়া সম্ভব? আলু ছাড়া অন্য কিছু তো একটু করিয়ে রাখতে পারো ঊর্মিলাকে দিয়ে। সাবিত্রী তখন ডিমের কারি দিয়ে রুটিটা মুখে ঢুকিয়ে বেজার মুখে বলল, রোগ বাঁধানোর সময় মনে ছিল না? এখন নোলা করে লাভ কী? ওই তো ঘোষগিন্নি বলল, ডুমুরের তরকারি ছাড়া নাকি কিছুই খাওয়া উচিত নয়। এমনকী ভাতও নয়। তাও তো আমি মাছের সবজি ঝোল দিই সকালে অফিসের ভাতে।
বড় রসগোল্লা আর ডিমের কারি দিয়ে রুটি খাচ্ছিল সাবিত্রী। বহুবার মণিময় রিকোয়েস্ট করেছে, যে শুধু ডুমুরের তরকারি দিয়ে বরাদ্দ দুটো রুটি খাওয়ার সময় যেন সাবিত্রী বসে বসে এত লোভনীয় খাবার না খায়। মানুষ তো! লোভ তো হয়! সাবিত্রীর পাতে রাজভোগ থেকে শুরু করে আলুর দম, ডিমের কারি, ছোলার ডাল আর মণিময়ের ডুমুরের তরকারি।
এ হেন অত্যাচার সাবিত্রী ঠিক কেন করে, মণিময় বুঝতেও পারে না! সুগার লেভেল ওর এমন কিছু বেশি নয়, নরম্যালের থেকে দশ কুড়ি বেশি থাকে ফাস্টিংএ। কিন্তু ওই যে সাবিত্রীর মাথায় একবার ঢুকে গেছে যে ও অসুস্থ রোগী তাই এমন অত্যাচার আজ বারো বছর ধরে সহ্য করে চলেছে মণিময়। হ্যাঁ, আজ থেকে বারো বছর আগের ব্লাড টেস্টের রিপোর্টে ওর ডায়াবেটিস ধরা পড়েছিল। সেদিন থেকে সাবিত্রীর অত্যাচারে ওর জীবনটা পুরো নরক হয়ে গেছে।
কাল রাতে বড় আবদার করেই মণিময় বলেছিল, একটা রাজভোগ আমাকেও দিও তো। ব্যস, শুরু হয়েছিল সাবিত্রীর বাক্যবান। দত্তগিন্নি বলেছে, মিষ্টি খাওয়া মানে সুগার রোগীর কাছে নাকি বিষ খাওয়ার সমান। ভালোবাসি বলেই তো দিই না! ভালোবাসা শব্দটা সাবিত্রীর মুখে বড় বেমানান। আসলে সাবিত্রী ভালোবাসা শব্দের অর্থ জানে না। তার কাছে সিঁথিতে টকটকে সিঁদুর পরে, চওড়া শাঁখা পরে পাশের বাড়ির গিন্নির কাছে স্বামীর নামে যথেচ্ছ নিন্দে করা মানে ভালোবাসা। জনসমক্ষে মণিময়কে অপদার্থ প্রমাণ করে সাবিত্রীর বড় প্রাপ্তি। এটাই নাকি ভালোবাসা! আসলে মণিময় যে ভিতরে ভিতরে ক্ষয়ে যাচ্ছে সেটা দেখার দায়িত্ব ওর নয়। পুরুষ মানুষের চোখের জলের দাম সমাজ কমই দেয়, সাবিত্রী কাঁদলে সবাই তখন দুষবে মণিময়কে। সাবিত্রীর মুখে নিজের একটা প্রশংসা কোনোদিন শোনেনি মণিময়, বরং নিন্দে শুনতে শুনতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল।
রুটি দুটো কোনোমতে ওই ডুমুরের তরকারি দিয়ে বিনা বাক্যে শেষ করে উঠে গিয়েছিল মণিময়।
ভেবেছিল, আজকের রাতটাই হোক ওর জীবনের শেষ রাত্রি। টাকাপয়সা যা সাবিত্রীর নামে জমিয়েছে তাতে ওর দিব্য চলে যাবে। এভাবে আর পারছে না।
সেই ভেবেই পার্কে গিয়েছিল আজ সকালে। রোজকার মর্নিং ওয়াকের জায়গায় একটু বসে সোজা যাবে মেইন রোডে। লরির তলায় পিষে দেবে নিজের শরীরটাকে। বাঁচার আর কোনো কারণ ও সত্যিই খুঁজে পায়নি নিজের জীবনে। আচমকাই মৃত্যুকে আহ্বান করার মুহূর্তে পরিচয় হয়ে গেল ঐশ্বর্যর সঙ্গে। অদ্ভুত রকম একটা প্রাণশক্তির সন্ধান পেল যেন। জীবনের এখনও একটু বাকি আছে এটা উপলব্ধি করল এই প্রথম। মণিময়ের কথা যে কারোর কাছে এত গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে এটা এই প্রথম উপলব্ধি করল ও। অফিসের নিম্নস্তন কর্মচারীরা ছাড়া আর কেউই তেমন মন দিয়ে মণিময়ের কথা শোনে না। কারণ আত্মীয়-পরিজনের সামনে সাবিত্রী বারংবার মণিময়ের নামে খারাপ কথা বলে বলে প্রমাণ করে দিয়েছে যে মণিময় আদপে একজন স্বার্থপর, লোভী মানুষ।
সাবিত্রীর কাছে শান্তিপ্রিয়র সমার্থক স্বার্থপর।
আজ অফিস যাওয়ার সময় কালো জিরে আর পটল দিয়ে ট্যালট্যালে মাছের ঝোল খেয়েও হাসি মুখে বেরিয়ে গেল মণিময়। যেতে যেতেই ভাবছিল, মানুষের মৃত্যুর যেমন কারণ থাকে তেমনি বেঁচে থাকারও একটা কারণ লাগে। আপাতত আগামীকাল পার্কে যাওয়াটাই মণিময়ের বেঁচে থাকার কারণ। সামনে দিয়ে একটা দ্রুতগামী দূরপাল্লার ট্রেন চলে গেল, ওর নীচে ঝাঁপিয়ে পড়ার ইচ্ছেটা আপাতত নেই মণিময়ের, এই মুহূর্তে ওর মনে হচ্ছে কখন আগামীকাল ভোরটা আসবে।
অফিস থেকে ফিরে টিভিতে খবর বা অন্য কিছু দেখার অভ্যেস ছাড়তে হয়েছে মণিময়কে সাবিত্রীর জন্যই। শুকনো মুড়ি আর চিনি ছাড়া ছানা ওর রেগুলারের সন্ধের টিফিন। সেটাও কোনোমতে ঊর্মিলা ঠক করে নামিয়ে রেখে চলে যায় টেবিলে। সাবিত্রী আর ঊর্মিলার তখন সিরিয়াল দেখার টাইম, তাই মণিময়ের চিনি ছাড়া সন্ধের চাটা আর জুটত না। ও নিজেই বানিয়ে নিতো। ঘরের ছোট টিভিটা খুললেই তেড়ে আসত সাবিত্রী, ঘরের আওয়াজ বাইরে গেলে নাকি সিরিয়ালের অর্ধেক আওয়াজ শোনা যায় না। তাই টিভি বন্ধ করতে হয়েছে ওকে। বহুবার ইচ্ছে হয়েছে মণিময়ের দুটো টিভিই হাতুড়ি দিয়ে ভেঙে দিতে, কিন্তু ওই যে মণিময় শান্তিপ্রিয় তাই আর ঝামেলা না বাড়িয়ে টিভি বন্ধ করে সকালের কাগজে চোখ বুলিয়েছে। অথবা স্মার্ট ফোনে টুকটাক ঘাঁটাঘাঁটি করেছে। জেলখানার আসামি মনে হয় ওর নিজেকে। অথবা সার্কাসের বাঘ, যাকে রিং মাস্টারের চাবুকের ঘায়ে উঠতে বসতে হয় সর্বদা।
রাতে সেই সেদ্ধ তরকারি নিয়ে আর উচ্চবাচ্য করল না মণিময়। ভোর হবার আকাঙ্ক্ষায় প্রতিটা মুহূর্ত যাপন করছিল ও।
ভোর থাকতে উঠে পড়ে রেডি হয়েছিল মণিময়। অন্যদিন মর্নিং ওয়াকের যে বিশাল ইচ্ছে থাকে তা নয়, বরং ভোরের ঘুমটা বেশ আরামের। তবে সাবিত্রী ঘুম থেকে উঠেই শুরু করে নানারকমের দোষারোপ, তার থেকে বাঁচতেই পালিয়ে আসে ও।
সেই পালিয়ে আসার প্রচেষ্টা থেকেই ভোরে বেরোনোটা অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। তবে অন্যদিনের ভোরের মতো নয় আজকের ভোরটা। আজ কেউ একজন অপেক্ষা করবে মণিময়ের জন্য। ভাবতেই অবাক লাগছে কেউ একজন অপেক্ষা করবে! শ্লথ হয়ে যাওয়া পা দুটো একটু জোরে চালালো ও।
নির্দিষ্ট বেঞ্চের কাছে পৌঁছানোর আগেই দেখল মেরুন ট্রাকসুট পরে বসে আছে ঐশ্বর্য।
ওকে দেখেই চঞ্চল হয়ে হাত নাড়ল, জোরে চেঁচিয়ে বলল, হেই ম্যান, রান প্লিজ।
মণিময় নিজের সংযম হারিয়ে একটু দৌড়েই পৌঁছালো বেঞ্চের কাছে।
পাশে বসতেই ঐশ্বর্য বলল, তুমি কিন্তু বেশ হ্যান্ডসাম আছো। সাতান্ন বোঝা যায় না। মণিময় লজ্জা পেয়ে বলল, সময়ে বাচ্চা হলে তোমার মতো মেয়ে হয়ে যেত। ঐশ্বর্য কপট রাগে চোখ পাকিয়ে বলল, তাই বলে আমায় সোনামণি বলে ডাকবে না কিন্তু। নো নেভার। আমরা কিন্তু ফ্রেন্ড।
চলো, ওইদিকে এক ঝাঁক পাখি আর কাঠবিড়ালি দেখেছি, তোমাকে দিয়ে ওদের ছবি তোলাব।
মণিময়কে ক্যামেরার ফাংশন বোঝাতে বোঝাতে বলল, শোনো, আমার সদ্য ব্রেকআপ হয়েছে, তাই আপাতত আমি একটু অফমুডে আছি, মেজাজ খারাপ করে কথা বললে প্লিজ কিছু মনে করো না যেন। মণিময় মুচকি হেসে বলল, বেশি নরম স্বরে কেউ আমার সঙ্গে কথা বললে আমি একটু অস্বস্তিতে পড়ি, আসলে চড়া গলার স্বর শোনা দীর্ঘদিনের অভ্যেস কিনা তাই।
ঐশ্বর্য হাত ধরে হ্যাচকা টান দিয়ে বলল, চুপ। ওদিক দিয়ে নয়, এদিক দিয়ে এসো, কাঠবিড়ালিগুলো ওইদিকেই আছে চুপটি করে। পায়ের আওয়াজ পেলেই ভোকাট্টা।
মণিময় পা টিপে টিপে এগোচ্ছিল, ঠিক যেন ছোটবেলার লুকোচুরি খেলা। এভাবেই ছোটবেলায় ওরা দেশের বাড়ির বাগানে লুকোচুরি খেলত, পা টিপে টিপে এগিয়ে গিয়ে ধাপ্পা দিয়ে দিত।
আপাতত মণিময়ের ঠিক সেরকম একটা ফিলিং হচ্ছে। সাবিত্রীর পরচর্চা, ফিক্সড ডিপোজিট, এলআইসি, সংসার খরচের বিরক্তিকর আলোচনা মুহূর্তের জন্য ভুলে গিয়ে ঐশ্বর্যর সঙ্গে সন্তর্পণে এগোল ও। সামনেই তিনটে কাঠবিড়ালি ঘাসের মধ্যে লুটোপুটি খাচ্ছে। ঐশ্বর্য মণিময়ের কানের কাছে মুখটা এনে ফিসফিস করে বলল, ক্যামেরাটা নাও আমার হাত থেকে। কথা বলবে না, ইশারা করবে বুঝলে। ওরা অতি চালাক, এখুনি পালাবে।
মণিময়ের অল্পবয়সে ছবি আঁকার বিস্তর নেশা ছিল। বিয়ের পর সাবিত্রী বলেছিল, বসে আঁকো প্রতিযোগিতায় নাম দেওয়ার দিন শেষ, তাই ঘরময় ওসব রং তুলি সরাও দিকিনি। অবাক হয়ে তাকিয়েছিল নিজের সদ্য বিবাহিত বউয়ের দিকে। তারপর দেখেছিল, একটা ফাঁকা বালতির মধ্যে সব গুঁজে ঢুকিয়ে দিয়ে স্টোর রুমে রেখে দিয়েছিল সাবিত্রী। বিস্ময়ের ঘোর কাটার পরে আর তুলি ধরা হয়নি কখনো।
ঐশ্বর্য বলল, এই যে, কবিতা পরে ভাববে, আমার কাঠবিড়ালি যদি পালায় না তাহলে দেখো, আমি তোমায় কী করি? কুইক বেশ কয়েকটা শট নাও। বাঁদিক চেপে নেবে তাহলে তিনটেরই লেজ পাবে।
মণিময় বেশ কয়েকটা ছবি তুলল। ঐশ্বর্য বলল, মিথ্যুক! তুমি পেশাদার ফটোগ্রাফার, আমাকে পরিচয় দাওনি কেন? মণিময় ভয়ে ভয়ে বলল, ভালো তুলতে পারিনি বলে মজা করছ? ইনসাল্ট করার পদ্ধতি নয় তো এই প্রশংসা?
ঐশ্বর্য হেসে বলল, নারে বাবা, মিথ্যে কেন বলব তোমায়? এই দেখ, ছবিগুলো দেখ জাস্ট।
এই মণিময়, তুমি সত্যিই ফটোগ্রাফার নও? মণিময় ঘাড় নেড়ে বলল, হান্ড্রেড পার্সেন্ট সত্যি! আমি চিত্রশিল্পী হতে চেয়েছিলাম, রং তুলিতে বাঁধতে চেয়েছিলাম নিজেকে, হয়নি।
মুখে একটু আওয়াজ করে ঐশ্বর্য বলল, আমিও ওয়াইল্ড লাইফ ফটোগ্রাফার হতে চাই, তাই আইটির চাকরিটা ছাড়তে চাই। আরে সেই নিয়েই তো রণিতের সঙ্গে আমার ঝামেলা, আর তার জেরে ব্রেকআপ। ও আর আমি একই অফিসে জব করি, আমি জবটা ছাড়ব বললেই শুরু হয় অশান্তি। এভাবে অন্যের নির্দেশ মতো জীবন চালাতে পারব না আমি। তাই সম্পর্কটা থেকে বেরিয়ে এলাম! কষ্ট হয় না তা নয়, ভালোবাসে রণিত আমাকে খুবই, সেটা আমি জানি। কিন্তু ওই যে অন্যের ইচ্ছেয় নিজেকে চালনা করব এটা ভাবতেই পারি না বুঝলে? নিজেকে কেমন যেন ক্রীতদাস মনে হয়। প্রাণ খুলে যদি নাই বাঁচলাম তাহলে আর কিসের বাঁচা?
মণিময় উদাস গলায় বলল, কত বছরের সম্পর্ক তোমাদের? ঐশ্বর্য বলল, তা হয়ে গেল বছর সাতেক। সেই কলেজ লাইফ থেকেই। আসলে কি জানো, আমার আর রণিতের মধ্যে একটা ছোট্ট পার্থক্য আছে, রণিত ভীষণ প্রাকটিক্যাল আর আমি কল্পনাপ্রবণ। বাস্তবটা বুঝেও অস্বীকার করতে ভালোবাসি। সৃষ্টিছাড়া জীবন কাটাতে পছন্দ করি আমি। মণিময় একটা বেঞ্চে বসে বলল, তার মানে রণিতকে ছেড়ে তোমার কষ্ট হচ্ছে তাই তো?
ঐশ্বর্য মুখটা বেঁকিয়ে বলল, তা হচ্ছে। আসলে বাঁদরটা আমায় বড্ড ভালোবাসে কিনা। তাই একটু মিস করছি। রণিত বার বার ফোন করছে, অফিসেও দেখা করতে এসেছিল আমার কিউবে, আমি ফিরিয়ে দিয়েছি। মণিময় বলল, কিন্তু কারণটা ঠিক কী? চাকরি করেও তো ফটোগ্রাফার হওয়া যায় তাই না? ছুটির দিনগুলোতে যদি ফটোগ্রাফি চর্চা চলে ক্ষতি কী?
ঐশ্বর্য মুচকি হেসে বলল, না ক্ষতি কিছুই নেই। তবে আমি বাইরে গিয়ে ছবি তুলব, অফিসের ভার বাদ দিয়ে। বুঝলে মণিময়, এইটুকু তো জীবন বাঁচতে হবে নিজের মতো করে। কালকেই হয়তো শুনলে একটা অ্যাক্সিডেন্টে আমি মারা গেলাম, তখন রইলো পড়ে আমার চাকরি, রইলো আমার ইচ্ছেরা। তাই যে কদিন বাঁচব নিজের ইচ্ছের ডানায় ভর করে বাঁচব। অন্তত মৃত্যুর আগে যেন আফসোস না থাকে। মণিময় নির্নিমেষ তাকিয়ে আছে ঐশ্বর্যর দিকে। একটা বাচ্চা মেয়েও ওর থেকে স্বাধীন, কী সুন্দর ডানা মেলে উড়ছে আকাশে। আর ওর পা দুটোকে কেউ দড়ি দিয়ে এমন বেঁধে দিয়েছে যে এখন দুটো ডানা লাগিয়ে দিলেও ও ঝটপট করবে কিন্তু উড়তে পারবে না।
মণিময় বলল, তোমার ফোন নম্বরটা দাও তো?
ঐশ্বর্য বলল, তুমি ফেসবুকে নেই? তাহলে আমি রিকু পাঠাব। মণিময় হেসে বলল, তা একটা অ্যাকাউন্ট খুলেছিলাম বটে, অ্যাকটিভ নই সেভাবে, তবে আছে। ঐশ্বর্য নিজের ফোন বের করে বলল, নাও, আমার রিকোয়েস্টটা একসেপ্ট করো দেখি।
একটা খরগোশকে কোলে নিয়ে মিষ্টি করে হাসছে ঐশ্বর্য, এটাই ওর প্রোফাইল পিক। ঐশ্বর্য হো হো করে হেসে উঠে বলল, আরে তুমি কী ডিফেন্সে এক্সাম দেওয়ার আগে এই ছবিটা তুলেছিলে? এটা তোমার ডিপি?
ওই গাছটার নীচে দাঁড়াও এখুনি। মণিময় যেন প্রাইমারি স্কুলে পড়ে, টিচারের নির্দেশ মতো গিয়ে দাঁড়াল রাধাচূড়া গাছের নীচে। হলুদ ফুলে ছেয়ে আছে নীচেটা। ঐশ্বর্য বলল, হাসি কই? প্রাণখুলে হাসো দেখি….হি হি অথবা হো হো যেকোনো পোজ নাও। বিদেশি কায়দায় চিজ বলতে হবে না তোমায়। ওর কথা বলার ধরনেই বহুবছর পরে প্রাণখুলে হেসে ফেলল মণিময়। ক্যামেরা তাক করাই ছিল, উঠে গেল ছবিটা। ঐশ্বর্য বলল, রাতে পাঠাচ্ছি তোমায়। এটা ডিপি করবে বুঝলে?
বাধ্য ছেলের মতো ঘাড় নেড়ে মণিময় বলল, বেশ।
ঐশ্বর্য বলল, কাল সন্ধেতে তোমার সময় হবে? তাহলে একটু কফি খেতে যেতাম। মণিময় একটু অস্বস্তি নিয়েই বলল,আমার সঙ্গে? তোমার বাবা-মা কিছু বলবেন না? ঐশ্বর্য হেসে বলল, তারা এই শহরে থাকে না। মুম্বাইয়ে থাকে। ফোনে যোগাযোগ হয়। আমি রেন্টে একটা ফ্ল্যাট ভাড়া করে থাকি। আসলে একা থাকতে ভালোবাসি আমি। মনের মতো না হলে খেজুরে গল্প জুড়ে সময় নষ্ট করতে পারি না। রণিতই এতদিন বন্ধু কাম লাভার ছিল, তাই একা লাগেনি। আমি কলকাতায় মানুষ, দাদুর কাছে। দাদু মারা যেতে মামার কাছেই ছিলাম। এখন একা থাকি। যাইহোক, তুমি যদি যেতে চাও জানিও, চলো বাই।
যেতে যেতেও ঘুরে এসে ঐশ্বর্য বলল, থ্যাংকস মণিময়। মণিময় বলল, ফর হোয়াট? ঐশ্বর্য বলল, এমনি। কারোর জীবন বাঁচিয়ে দিলে বলে। ওই যে বললে, ফোন করবে আমায়, তাই বুঝলাম কেউ একজন আছে আমায় ফোন করার। অপেক্ষায় থাকব অন্তত। আর শোনো মণিময়, তোমায় আমি মিথ্যে বললাম, রণিত এই সাতদিনে একটাও কল করেনি আমায়, অফিসে দেখলে চিনতেও পারেনি। আমি ওকে ভালোবাসি পাগলের মতো। কাল ভোরে তুমি আসবে তো? ছুটে চলে গেল ঐশ্বর্য। মণিময় স্পষ্ট দেখল ওর চোখে এক বিন্দু জলের রেখা।
বাড়ি ঢুকতেই সাবিত্রী বলল, এতক্ষণ ছিলে কোথায়? এত দেরি হচ্ছে কেন?
হঠাৎ করেই মণিময়ের ভিতরে যেন ঐশ্বর্য ভর করল। বেশ দৃঢ়তার সঙ্গে বলল, আমার ইচ্ছে তাই দেরি করেছি। আমার বাড়িতে আমি কখন ঢুকব সেটা কী তুমি ঠিক করে দেবে? সাবিত্রী বোধহয় সামনে স্বয়ং মহাদেবকে দেখলেও এতটা বিস্মিত হত না যতটা হল মণিময়ের কথা শুনে। বিবাহিত জীবনে এমন কথা এই প্রথম শুনল সাবিত্রী। তাই প্রথম চমকটা কাটাতে একটু সময় লাগল। তারপরেই নিজস্ব ভঙ্গিমায় বলে উঠল, এত চ্যাটাং চ্যাটাং কথা শিখলে কোথা থেকে? এতদিন তো গলার স্বর শোনা যেত না। সাবিত্রী যখন ঝগড়ার ঢঙে কথা বলে তখন ওর হিতাহিত জ্ঞান কোনোদিনই থাকে না। যুদ্ধ জয়ের আশায় ও যারপরনাই আক্রমণ করে।
তবে আজ শান্তিপ্রিয় মণিময়ের মধ্যে একটা অদ্ভুত শক্তি কাজ করছে। জীবনটা বড্ড ছোট, তাই নিজের ইচ্ছেদের গুরুত্ব দিতে হবে। মণিময় বেশ দৃঢ় আর গম্ভীর স্বরে বলল, যেটা বলছি মন দিয়ে শোনো, আজ থেকে আমার যেভাবে ইচ্ছে সেভাবে চলব, আমার যেকোনো ইচ্ছেয় বাধা দিতে এলে আমি এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাব কোনো মেসে। কথাটা একটু মাথায় রেখো। রাতে আলু বাদ দিয়ে অন্য সবজি দিয়ে একটা তরকারি বানিয়ে রাখবে ঊর্মিলাকে দিয়ে। ডুমুরের তরকারি আমি আর খাবো না। আমার শরীর স্বাস্থ্য, মন এসব নিয়ে তোমাকে আর না ভাবলেও চলবে। আমারটুকু আমিই ভেবে নেব।
হতভম্ব সাবিত্রীকে পাস কাটিয়ে বাথরুমে ঢুকল মণিময়। শাওয়ারের জলে ধুয়ে যাচ্ছে ওর সাতান্নর শরীর। যার রন্ধ্রে রন্ধ্রে পরাধীনতা আর ভয় বাসা বেঁধেছিল কর্কট রোগের মতো। বুকের ওপরে বসে থাকা মিথ্যে অভিনয় করা পাথরটা ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে। নিজেকে খুব কষ্ট করে ওই জগদ্দল পাথরের ফাঁক দিয়ে টেনে বের করছে মণিময়। রক্তাক্ত ক্ষতবিক্ষত আমিটাকে দেখে চমকে উঠল মণিময়।
এত বছর ধরে ওর মধ্যে কীভাবে বেঁচেছিল এই ক্ষতবিক্ষত মানুষটা? শিরদাঁড়াহীন, ভঙ্গুর মণিময়ের দিকে হাতটা বাড়িয়ে দিল ও, ফিসফিস করে বলল, ওঠো মণিময়, আর কদিনই বা বাঁচবে, উড়তে না পারো ডানা তো ঝাপটাও। স্নান সেরে পুরোনো মণিময়ের খোলস থেকে একটু বেরিয়ে এসেই দেখল, সাবিত্রী খাটে বসে কাঁদছে। এই দৃশ্য মণিময়ের ভীষণ পরিচিত। বিয়ের পর থেকে সাবিত্রীর মতের বিরুদ্ধে একটা কিছু ঘটলেই ও এমন কাঁদতে বসে যায়। মণিময় এত বছর এরকম অবস্থায় পড়লে নিজের ভুল না থাকলেও ভুল স্বীকার করে শান্তি রক্ষা করেছে। আজ যেন কেমন একটা অদ্ভুত রকমের শক্তি কাজ করছিল ওর মধ্যে। নত না হবার শক্তি। স্বাধীনভাবে বাঁচতে চেয়েছে কাউকে আঘাত না করেই, তাতেও যদি অন্যায় হয় তাহলে সে অন্যায়ের জন্য ভুল স্বীকার আজ আর মণিময় করবে না ঠিক করে নিয়েই খাবার টেবিলের কাছে এগিয়ে গিয়ে বলল, ঊর্মিলা, খেতে দাও। ঊর্মিলা রান্নাঘর থেকে হেঁকে বলল, একটু নিয়ে যাও দাদাবাবু। মণিময় টেবিলে বসে বলল, না তুমিই ভাতটা বেড়ে টেবিলে দিয়ে যাও, আজ থেকে তাই করবে, যদি না পারো বলো, এ মাসের মাইনে দিয়ে দেব, চলে যেও।
আসলে ঊর্মিলা বেচারি জানত এ বাড়ির মালকিন সাবিত্রী, তাই ওকে তৈলমর্দন করলেই চলবে, বাড়ির এই ফালতু মানুষটাকে এত পাত্তা না দিলেও চলবে। কথা না বাড়িয়ে খাবার ধরে দিল সাবিত্রী, আঁচলে চোখের জল মুছে চলেছে। দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টার ত্রুটি করেনি সাবিত্রী, কিন্তু আজকের মণিময় সিদ্ধান্ত নিয়েই নিয়েছে, আর মেরুদণ্ড বাঁকাবে না। খাওয়া শেষ করে বেরিয়ে এল ও। বেশ হালকা লাগছে আজ। কত বছর পরে স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ করতে পেরেছে ও। অফিসে বসেই দুটো কাজ সেরে নিল মনে করে। অন্যদিনের মতোই বিকাশ সামনে দাঁড়িয়ে বলল, চক্রবর্তীদা, আমার একটা কাজ করে দেবে, আমি হাফে ছুটি নেব একটু। মাসে বার চারেক বিকাশের কাজ করে দেয় মণিময়। সকলের এক্সট্রা ছুটি দরকার আছে, মণিময়ের তো নেই, তাই অন্যের বেগার খেটে দেয় ও। মণিময় মুচকি হেসে বলল, সরকার কি আমায় বেশি মাইনে দেয় হে বিকাশ? নিজের কাজ নিজে করো, আর কতদিন অন্যের ঘাড়ে বন্দুক চাপিয়ে ফাঁকিবাজি করবে? আজ আমার অন্য কাজ আছে, পারব না ভায়া। বিকাশ অবাক হয়ে দেখছিল মণিময়কে। এমন মুখের ওপরে না বলতে তো মণিময় পারত না। তাই অফিসের অনেকেই এ সুযোগ নিয়ে এসেছে এতদিন, আজ হঠাৎ হলটা কী?
মণিময় দেখল, হোয়াটসআপে সকালের তোলা তিনটে ছবি ঢুকল। নীচে লেখা যেটা তোমার ইচ্ছে সেটা প্রোফাইল পিক করতে পারো। তিনটেই দারুণ। ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটে উঠল মণিময়ের। মনে মনে বললো, এই নতুন মণিময়কে ফিরে পাওয়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ ঐশ্বর্য।
নিজের প্রোফাইল পিকটা চেঞ্জ করতেই নীচে কমেন্ট এল, এই হাসিটাই খুঁজছিলাম। ঐশ্বর্যর কমেন্টের সঙ্গে সঙ্গেই মেসেঞ্জারে মেসেজ এল মণিময়ের কলেজের বন্ধু শিবশঙ্করের। মেয়েটা কে রে, তোর ছবিতে মেসেজ করছে? তোর কোনো রিলেটিভ? জীবনে কোনোদিন বন্ধুর খোঁজ না নেওয়া শিবশঙ্করের প্রশ্নের উত্তরে মণিময় লিখল, না রিলেটিভ নয়, বন্ধু। শিবশঙ্কর আবার লিখল, এই বয়সের বন্ধু? সে কী রে, কচি মেয়েটার সঙ্গে সম্পর্ক রাখছিস নাকি? বউদি জানে তো?
মণিময় লিখল, না জানে না। আমার সব বন্ধুর খবর তোর বউদি জানে না। এমনকী তোকেও চেনে না তোর বউদি। ভালো থাকিস, কাজে আছি পরে কথা বলব। নিজের মনেই একচোট হেসে নিল মণিময়।
ভোর ভোর পার্কের বেঞ্চে এসে বসেছে মণিময়। এখনও ঐশ্বর্য আসেনি দেখেই মণিময় সামনের বাঁধানো রাস্তাটাতে একটু পায়চারি করছিল, দেখছিল ঐশ্বর্য আসছে খুব অবশ পায়ে হেঁটে। রোজকার মতো দমকা হাওয়ার বেগে নয়। অনেকটা প্রাণশক্তি মণিময়কে দিয়ে দেওয়ার পরে একটু ক্লান্ত কি! ওর সামনে এসে বলল, আজ আর ওয়াক করতে ইচ্ছে করছে না জানো তো! মণিময় ঐশ্বর্যর হাতটা ধরে বলল, তুমিই শিখিয়েছো নিজের ইচ্ছেয় বাঁচার মূলমন্ত্রটা। আজ নিজের ইচ্ছে মতো আমি একটা বড়সর কাজ করে ফেলেছি, কথা দাও রাগ করবে না, বা বন্ধুত্বের দাবি অস্বীকার করবে না। ঐশ্বর্য হেসে বলল, কী ব্যাপার গুরু, আজ তো ফুলফর্মে আছো দেখছি। প্রপোজ করবে নাকি? তা করে দাও, রাখব কিনা একটু ভাবতে সময় দিতে হবে। মণিময় হেসে বলল, পাগলি।
বেশ কিছুক্ষণ কাটল কোনো কথা না বলে, শুধু ঐশ্বর্যর উপস্থিতিটাই যেন অনেকটা টাটকা বাতাস ভরে দেয় মনিময়ের রুগণ ফুসফুসে। ঐশ্বর্যর তোলা বেশ কিছু ছবি দেখলো মণিময়। চলে আসার সময় ঐশ্বর্য বলল, আজ সন্ধেতে দেখা হচ্ছে। বাড়ি ফিরেই অন্যরকম পরিবেশ দেখল মণিময়। সাবিত্রী সকালে সিরিয়ালের রিক্যাপ না দেখে মণিময়ের জামা প্যান্ট ভাঁজ করে রাখছে, এতদিন এগুলো মনিময় নিজেই করত। খাবার টেবিলেও দেখল বেশ সরঞ্জাম হাজির। আজ সকালের চা টাও নিজেকে করতে হল না মণিময়কে। এত দেরি কেন হল প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হল না ওকে। নিজের মনে মনেই বলল, প্রবাদগুলো মিথ্যে নয় তাহলে! কথাতেই আছে মানুষ শক্তর ভক্ত।
রেস্টুরেন্টে আগেই চলে এসেছে মণিময়। ঐশ্বর্য এখনও ঢোকেনি। কেক, ফুল, গিফ কিনতে একটু সময় লেগেছিল মণিময়ের। যদিও ঐশ্বর্য কিছুই বলেনি, কিন্তু ওর প্রোফাইলে ওর কিছু বন্ধুর হ্যাপি বার্থ ডে উইশ দেখেই বুঝেছিল, কেন আজ মেয়েটা সন্ধেটা ওর সঙ্গে কাটাতে চাইছে। বাবা-মায়ের সংগে যে তেমন বনিবনা নেই তা মণিময় টের পেয়েছিল প্রথম দিন থেকেই। আসলে উচ্ছল ঝরনার সঙ্গে তাল মেলানোর ক্ষমতা সকলের নেই। ঝরনাকে বাঁধ দিতে গেলেই বন্যার সম্ভবনা প্রবল। বরং নিজের ঢঙে চলতে দিলে সে বাধ্য থাকে বেশি। ঐশ্বর্য ঢুকছিল রেস্টুরেন্টে। ঠিক যেন কড়া রোদে শুকনো মার দেওয়া শাড়ি। জলের ছিটে দিয়ে নরম করতে হবে, নাহলে ভীষণ রকম ঋজু। চোখের কোণে অনেকটা জল গম্ভীর হয়ে ধ্যানস্থ। সজোরে আঘাত না পেলে ওই জল গড়িয়ে পড়ার কোনো সম্ভবনা নেই। রেস্টুরেন্টের নিয়ন আলোয় মায়াবী লাগছিল ঐশ্বর্যর মুখটা। ওর সামনের টেবিলে বসে বলল, কিছু অর্ডার করলে? মণিময় বলল, দু মিনিট, আমার একজন গেস্ট আসবে, তারপরে অর্ডার করব, তার আগে তুমি একটা কফি খেতেই পার। বিরক্তিতে মুখটা কুঁচকে ঐশ্বর্য বলল, গেস্ট? এখানে? কিন্তু কেন? আজ তো তোমার সঙ্গে আমার মিট ছিল, এই গেস্ট জোটালে কোথা থেকে? মণিময় হেসে বলল, আরে রাগছো কেন? ফেসবুকে আলাপ করলাম, ফোন নম্বর জোগাড় করলাম, তারপর ইনভাইট করলাম এখানে। ঐশ্বর্য গম্ভীর হয়ে বলল, এখানে না ডাকলেই পারতে আজকে।
কথা শেষ হবার আগেই রণিত এসে একটা ফুলের বুকে আর চকলেট ঐশ্বর্যর সামনে ধরে বলল, হ্যাপি ব্যার্থ ডে জেদি, গোঁয়ার। রাগ তো কখনো কখনো আমারও হয় রে। সব সময় তোর রাগ আমিই ভাঙাই, এবারে আশা করেছিলাম তুই এগিয়ে আসবি, কিন্তু না, তুই তো হিমালয় তাই মহম্মদকেই আসতে হবে। ঐশ্বর্যর চোখের কোণের জলটা টুপ করে ঝরে পড়ল গাল বেয়ে। রণিত বলল, তোর বন্ধু আমায় বলল, ঐশ্বর্য এমনিই জেদি, গোঁয়ার থাকবে, পাল্টাবে না একফোঁটাও। পাল্টে গেলে তো সে ঐশ্বর্য থাকবে না, তুমি যাকে ভালোবাসো সে পাল্টে গেলে তোমার ভালো লাগবে? আমিও ভেবে দেখলাম, তুই পাল্টে গেল আমি ঝগড়া করব কার সঙ্গে? অগত্যা তোর বন্ধুর নির্দেশ মতো হাজির হলাম এখানে।
মণিময় বলল, তোমাদের মান অভিমান মিটলে এই অফিস ফেরত অভুক্ত ব্রাহ্মণটা একটু খেতে পেত আরকি। ঐশ্বর্য হেসে বলল, আজ আমি ট্রিট দেব। মণিময় কেকটা বের করে বলল, কেটে ফেল দিকি, এটা হল ডিপ ভায়োলেট কালারের। লাইট ব্লু আর সাদার মিশ্রণে তৈরি হয়েছে। ঐশ্বর্য অনেকটা কেক নিয়ে মণিময়ের মুখে মাখিয়ে দিয়ে বলল, আমার সঙ্গে ইয়ার্কি হচ্ছে! রণিত হেসে বলল, এই যে মণিময়, তোমায় বাপু আঙ্কেল, দাদাভাই বলতে পারব না। তুমি যখন ঐশ্বর্যর বন্ধু তখন আমারও বন্ধু। এই মেয়েকে নিয়ে গোটা জীবন চলতে হবে তাই তোমার পরামর্শ চাইই চাই।
দূর থেকে দেখল মণিময়, ছুটতে ছুটতে আসছে ঐশ্বর্য, ভোরের আলোয় উদ্ভাসিত ওর মুখ। এসেই মণিময়কে জড়িয়ে ধরে বলল, তুমি কী করে বুঝলে আমার মনের কথা, রণিতকে ছাড়া আমার সত্যি কষ্ট হচ্ছিল জানো। মণিময় বলল, তবুও তোমায় আমি সোনামণি বা মামণি ডাকব না, ওসব ন্যাকামি আমার মোটে সহ্য হয় না। অনাবিল হাসিতে ভরে উঠছে পার্কের ওদের নিজস্ব বেঞ্চটা। ঐশ্বর্য বকবক করে বলেই চলেছে রণিতের কথা, ধৈর্যবান শ্রোতা পেয়ে কথা যেন শেষই হচ্ছে না ওর। মণিময় হাসছে, প্রাণখুলে হাসছে, বাঁচতে চায় ও অনেকদিন এই পৃথিবীতে। এমন সব আচমকা গড়ে ওঠা বন্ধুদের আশায়।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন