অর্পিতা সরকার
রথযাত্রা বাম্পারের টিকিটটা লক্ষ্মীর ঝাঁপির পিছনে রেখে দিয়েছিল সুনয়ন। দিন সাতেক আগে টিকিটটা কেটেছিল ও। পঞ্চাশ লক্ষ টাকার ফার্স্ট প্রাইজ।
নিজের মনে মনে সংখ্যাটার পিছনে কতগুলো শূন্য একবার হিসেব করে নিল। ধুত্তোর! দশ, কুড়ি বড়জোর একশো টাকার নোটের পিছনের শূন্যগুলো দেখতে দেখতে এতগুলো শূন্যের পাহাড়ে হারিয়ে গেল!
চোখের সামনে ভেসে উঠল ঋষিকার মুখটা। মেয়েটা মাসখানেক সময় দিয়েছিল ওকে। সুনয়ন, প্লিজ ডু সামথিং। বাবা পাত্র দেখছে। তুমি যে বললে, প্রিলি পাশ করে গেছো, মেইনেও যাবে, তাহলে এত দেরি কেন হচ্ছে সুনয়ন?
সুনয়ন একটু করুণ হেসে বলেছিল, এখন তো দেশের সব এক্সাম বন্ধ আছে ঋষিকা। জানিনা কবে আবার শুরু করবে।
ঋষিকা বিরক্তির স্বরে বলল, আমার তো গানের স্কুলটা আছে। তাহলে চলো বিয়েটা করে নিই। সুনয়ন একটু ভেবে অন্যমনস্কভাবে বলেছিল, বাবা নেই, দাদার ওপরে গোটা সংসারের ভার। আমি, বোন, মা, বউদি, ভাইপো….এখন সংসার ছেড়ে নিজের বিয়ের কথা ভাবি কী করে বলতো?
আসলে আরেকটু যদি সময় পেতাম!
ওর দিকে অসহায়ভাবে তাকিয়ে ঋষিকা বলল, আরও সময় দরকার তোমার? সাড়ে তিন বছর ধরে এক্সাম দিচ্ছ তুমি। কত জবের প্রিলি পাশ করে যাচ্ছ, মেইনে গিয়ে কয়েক নম্বরের জন্য আটকে যাচ্ছে সবগুলো, আর ঠিক কী হবার আছে বলো তো?
সুনয়ন হেসে বলল, বাদাম খাবে?
পার্কের চেয়ারে হেলান দিয়ে ঋষিকা বলল, কী ক্যাজুয়াল তুমি আমাদের রিলেশনটা নিয়ে! বাবা আমার পাত্র প্রায় ঠিক করে ফেলেছে। হেলথ ডিপার্টমেন্টে জব করে। দুই ভাই। বড় শিক্ষক আর ছোট হেলথ। ওবাড়ির সবাই খুব গান ভালোবাসে, তাই আমাকে পছন্দ করেছে। এখন বলবে, আমি ঠিক কী উপায়ে বিয়েটা ক্যানসেল করব? এতদিন না হয় পড়াশুনার দোহাই দিয়েছি। এখন তো মাস্টার্স কমপ্লিট, আর কোনো কিছু বলার তো নেই।
সুনয়ন বাদামের খোসাটা হাতের চাপে জোর করে ভেঙে পিষে দিয়ে বলল, বলবে.. তুমি একজনকে ভালোবাসো, তাই ….
ঋষিকা দূরের হলুদ হয়ে যাওয়া ঘাসের দিকে তাকিয়ে বলল, কী বলব? লকডাউনে তোমার টিউশনি ব্যাচটা বন্ধ হয়ে গেছে বলে তুমি বন্ধুর টোটো চালাচ্ছ মাস পাঁচেক?
সুনয়ন, আমার ছোট কাকা সেদিন বাবাকে বলছিল, ঋষিকাকে বলিস, টোটো ড্রাইভার কিন্তু এ বাড়ির জামাই হবে না।
জোরে নিঃশ্বাস নিয়ে সুনয়ন বলল, কলেজের দিনগুলোতে আর ফিরে যাওয়া যায় না তাই না? যখন তোমার মনে হত, আমি ইতিহাস নিয়ে রিসার্চ করব? যখন তোমার মনে হত, ফাস্ট ক্লাস পাওয়া ছেলেরা নিশ্চয়ই ভবিষ্যৎ গড়বেই। ঋষিকা তোমার মনে আছে, সেই আমাদের কলেজের ভিতরের অমলতাস গাছটার কথা। যেটা গ্রীষ্মকালে হলুদ রঙের হয়ে যেত। সবুজ পাতাগুলো অস্তিত্বরক্ষার দ্বন্দ্বে যুদ্ধ চালিয়ে যেত। কিন্তু গাছ থেকে ঝুলে থাকা ফুলগুলো সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে থাকত বলে, সবুজ পাতাগুলো যেন নিজেদের অস্তিত্ব হারাতো। সেই গাছটার নীচে বসে তুমি আর আমি গল্প করতাম, তখন তুমি বলতে, সুনয়ন তুমি ওই ফুলগুলোর মতো। আমাদের হিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টের গর্ব। আমি ওই পাতাগুলোর মতো। তোমার সংস্পর্শে ধন্য। দেখো, তারপর গত তিনবছর ধরে এত চেষ্টার পরেও যখন টিউশনি ছাড়া আর কোনো কাজ জোগাড় করতে পারলাম না, তখন মনে হচ্ছে, আমিই ওই পাতাগুলো। যে হলুদ ফুলগুলোর দিকে অপলক তাকিয়ে থাকবে, আর ফিসফিস করে বলবে, তুমি উজ্জ্বল হয়ে ফুটে থেকো প্রতিবছর। আমি ম্রিয়মাণ হয়ে রইবো তোমার আড়ালে। হাত বাড়িয়ে ছুঁতে চেয়েও পাব না, তুমি থাকবে ভীষণ রকমের কাছে, তবুও..
ঋষিকার চোখ দুটো ছলছল করে উঠেছিল। কাঁদো কাঁদো গলায় বলেছিল, চলো না শুরু করি। অন্যের হয়ে যাওয়ার থেকে আমরা লড়াইটা করতেই পারি। আমার গানের স্কুলের ইনকামটা তো আছে, সঙ্গে দুজনেই যদি টিউশনি করি…
সুনয়ন বলেছিল, এভাবে অনিশ্চিতের পথে কেন এগোবো বলতো? কেন তোমাকে টেনে আনব এমন ছন্দহীন জীবনে? তোমাকে আমি ডিজার্ভ করি না ঋষিকা। ঋষিকা বাদামের প্যাকেটটা ঘাসের ওপরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বলল, বেশ তবে তাই হোক। এক পৃথিবী হাঁটব বলে, বাড়ির গণ্ডিটুকুও পেরোতে পারলে না আমার সঙ্গে!
ঋষিকার চলে যাওয়ার দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে ছিল সুনয়ন। আস্তে আস্তে ছোট হয়ে যাচ্ছিল ঋষিকার অবয়ব, গালের টোল ফেলা হাসিটা পর হয়ে গেল মুহূর্তে। চোখের ওপরে পড়া ঋষিকার অবাধ্য চুলগুলো বড্ড নিজের ছিল এতদিন, আজ সেগুলোতেও আর সুনয়নের অধিকার থাকল না। পার্কের বেঞ্চটা যেন ওদের নিজেদের সংসার হয়ে গিয়েছিল, দীর্ঘ চারবছর এখানেই বসে ওরা কর্মক্ষেত্র থেকে কর্মখালি পেপারের কাটিং পর্যন্ত দেখেছে। তারপর চাকরি পেয়ে গেলে ঘরে কী পর্দা লাগবে আর কোন কালারের ফ্রিজ কিনবে নিয়ে ঝগড়ায় মশগুল হয়েছে। বেঞ্চের ফাঁকা জায়গাটায় একবার হাত দিয়ে স্পর্শ করেছে সুনয়ন, এখনও যেন ওর স্পর্শ লেগে আছে। চেনা ফুচকাওয়ালা এসে জিজ্ঞেস করেছে, দিদিমণি এখনও আসেনি? আজ টক বেশি দিয়ে ফুচকা খাওয়াব, পুদিনা পাতার চাটনি দিয়ে। চার বছরে ওরাও চিনে গেছে সুনয়ন আর ঋষিকার এই কর্নারের বেঞ্চটাকে। অদ্ভুত ভাবে পার্কে যতই ভিড় থাক না কেন, ওদের এই কর্নারের বেঞ্চটা ফাঁকা থাকত। ওরা যেদিনই আসত, মুচকি হেসে বলত, এখনও আমাদের সংসারটা আমাদেরই আছে। বোধহয় লোকে টের পায়, ওখানে বসলেই আমরা রেগে যাব, তাই কেউ বসে না।
উদ্ধত সূর্য যখন ঘরমুখী হয়, যখন নিজেদের ছায়া ধীরে ধীরে ছোট হয়ে যায় তখনই ওরা এসে বসত এই বেঞ্চে, সেই বেঞ্চেই শেষ দিন অনেকক্ষণ একা, সম্পূর্ণ একা বসেছিল সুনয়ন। ঋষিকার সঙ্গে কাটানো মুহূর্তগুলোকে কৃপণের মতো খরচ করছিল একটু একটু করে। সূর্য বাড়িতে ফিরে যখন তারাকে পাঠিয়ে দিয়েছিল মহাকাশকে রক্ষা করার জন্য ঠিক তখনই, বাদামওয়ালা হেসে বলেছিল, বাড়ি যাবেন না দাদা?
সম্বিৎ ফিরে পেয়েছিল সুনয়ন। বুকের বাম দিক থেকে বেরিয়ে এসেছিল ভাঙাচোরা একটা নিঃশ্বাস। ধীর পায়ে উঠে এসেছিল ওদের একটা খুঁটির ওপরে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সংসারটার ভিতরে।
বাড়িতে ঢুকেই মাকে খুঁজেছিল, একটা শেষ চেষ্টা করবে বলে। ”ঋষিকাকে বিয়ে করতে চাই” কথাটা বলতেই এগোচ্ছিল পূর্ব কোণের মায়ের ঘরটার দিকে।
ঘরের সামনে থমকে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল, মা এক জোড়া সোনার কানের দুল বোনের হাতে দিয়ে বলছে, তোর বিয়ের কানের দুটো আছে, আর ব্রোঞ্জের দু-গাছা চুরি, কিন্তু হারটা নিয়েই চিন্তা। হাতের, কানের, গলার তো দিতে হবে অন্তত? ওর পায়ের আওয়াজ পেয়েই মা ডেকেছিল, নয়ন…এদিকে আয়, আজ তোর বোনের জন্য একটা ভালো পাত্রের সন্ধান এনেছে আমাদের ঘোষালদা, চাহিদা একেবারেই নেই। সুনয়ন মৃদু গলায় প্রতিবাদ করে বলেছিল, কিন্তু মা ওর তো সবে গ্রাজুয়েশন হল, আরেকটু পড়ত না হয়। মা হেসে বলেছিল, কী হবে রে? তোকে নিয়ে তো সবার গর্ব ছিল। ভেবেছিলাম, এত ভালো আমার ছেলে পড়াশোনায়, নিশ্চয়ই চাকরি যেচে আসবে আমাদের সংসারে। তিন বছর তো চাকরির পরীক্ষা দিচ্ছিস, হয়েছে কিছু? এমন পাত্র আমি হাতছাড়া করতে চাই না। এই মাসের শেষ বিয়ের তারিখেই বিয়ে দেব রুমির।
সুনয়নের বলা হল না আর কিছুই। রুমির ঠোঁটে প্রাপ্তির হাসি। এই ভাঙাচোরা সংসার থেকে বেরিয়ে নিজের সংসারের স্বপ্ন দেখছে হয়তো। দিনরাত মা আর বউদির ফরমায়েশ খাটতে খাটতে মেয়েটাও নাজেহাল। বরং বাঁচুক রুমি। রুমির বিয়ের প্ল্যান শুনতে শুনতে ঘর থেকে বেরিয়ে এল সুনয়ন।
পাশের ঘরেও দাদা-বউদি খুব আলোচনা করছে রুমিকে নিয়েই। ওকে দেখতে পেয়েই দাদা বলল, নয়ন, বোনের বিয়ে, একেবারে হাত গুটিয়ে নিস না। কিছু অন্তত দিস আমার হাতে। অন্তত মাংস, মিষ্টির টাকাটা ব্যবস্থা কর।
ঘাড় নেড়ে চলে এসেছিল নিজের ঘরে। সিলিঙের দিকে তাকাতেই একটা ঘুরন্ত ফ্যান দেখতে পেয়েছিল, যার সাহায্য নিলে হয়তো এত প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে না। থেমে যাবে এই প্রশ্ন-উত্তরের কুইজ কুইজ খেলাটা।
চেষ্টা করতে গিয়েও মনে পড়েছিল ঋষিকা, রুমির মুখটা। দুজনেরই বিয়েটা ভেঙে যাবে ওর একটা ভুল সিদ্ধান্তে। রুমির দাদা সুইসাইড করলে পাত্রপক্ষ ওর বোনকে বাতিল করবে। আর পাড়ার অনেকেই ঋষিকা আর সুনয়নের প্রেমটা জানে। তাই সুনয়ন যদি এখন আত্মহত্যা করে তাহলে কিছুটা দোষ গিয়ে পড়বে ওই নির্দোষ মেয়েটার কাঁধে। যে ও বেকার জেনেও ওর হাত ধরতে চেয়েছিল শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত। গানের টিউশনির টাকাটাতেই বাঁধতে চেয়েছিল সম্পর্কটা। ঋষিকাকে ভালোবাসে ও, যাকে ভালোবাসে তাকে কেউ সর্বসমক্ষে বদনামের ভাগিদার করতে পারে?
মানুষ এখন শোনে কম, বলে বেশি। তাই হয়তো সব সত্যিটা না শুনেই ঋষিকাকেই দায়ী করবে ওর মৃত্যুর জন্য। এত বোঝা মেয়েটা সামলাবে কী করে?
ঘুরন্ত ফ্যানের দিকে মুচকি হেসে সুনয়ন বলেছিল, তুমি থাকো দায়িত্বহীনের পাশেই, আমি বরং তিলতিল করে যন্ত্রণা বয়ে নিয়েই বেরোব জীবিত অবস্থায়।
কেটে যাচ্ছিল দিন নিজের নিয়মে, সে কবেই বা কার জন্য অপেক্ষা করেছে! তাই ঋষিকার দেওয়া একমাস ধীরে ধীরে পনেরো দিনে এসে থেমেছে, এটাও পেরিয়ে যাবে খুব দ্রুত। না কিছুই করতে পারবে না সুনয়ন।
ঋষিকাকে দেখতে আসার খবরও পেয়েছিল সুনয়ন।
ঋষিকার দাদা বাজারে দাঁড়িয়ে দরদাম করে খাসির মাংস কিনেছিল সেদিন, ওকে দেখে ব্যঙ্গাত্মক হেসে বলেছিল, কী রে নিয়ে যাবি বাড়িতে? এত বাজার করেছি আজ যে হেঁটে যেতে পারব না। ঋষিকার বাড়িটা সুনয়নের বাড়ি থেকে হেঁটে এই চার কিলোমিটার মতো। মাঝের বড় বাজারে দাঁড়িয়ে ওকে উদ্দেশ্য করেই কথাটা বলেছিল ওর দাদা। কে জানে কেন কুড়ি টাকার জন্য রাজি হয়ে গিয়েছিল সুনয়ন। বোধহয় ঋষিকার বাড়ির সবজে গ্রিলে থুতনি ঠেকিয়ে ওকে আরেকবার দেখার লোভ সামলাতে পারেনি। অন্যের হয়ে যাওয়ার আগে আরেকবার মাত্র দেখতে চেয়েছিল ঋষিকাকে। তাই ওদের বাজার বোঝাই ব্যাগ নিয়ে হাজির হয়েছিল ঋষিকাদের বাড়িতে।
বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখতে পায়নি ওকে, শুধু ওর গলা শুনতে পেয়েছিল ভিতর থেকে, মা ডিনার সেটটা কি টেবিলে রাখব?
ব্যস্ত ছিল ঋষিকা, নতুনদের আপ্যায়নে। ফিরে আসার পথেই লটারির টিকিটে অন্য জনের ফার্স্ট প্রাইজ পাওয়ার কথাটা শুনেছিল মার্কেটে। এত কিছুর পরেও নিজের ভাগ্যকে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছিল সুনয়নের, সেটা ভেবেই হেসেছিল নিজের ওপরে! তাই টিকিট না কেটেই ফিরে এসেছিল বাড়ি, নিজের ভাগ্যকে দ্বিতীয়বার বিশ্বাস করেনি ও।
চোখের সামনে ভাসছিল প্রফেসরদের কথাগুলো। পি এইচ ডি করো সুনয়ন। কি ভেবেছিল তখন ও, স্বপ্নগুলো রামধনুর মতোই রঙিন? হ্যাঁ সেটাই ভেবেছিল। অনেক পরে বুঝেছিল, স্বপ্নের রং ঘন ধূসর। নিম্নমধ্যবিত্ত বাড়ির ছেলেমেয়েদের দীর্ঘদিন পড়াশনা করার মতো বিলাসিতা মানায় না। তাই তারা মাস্টার্স করতেই বাড়ির লোকজন হাপিত্যেস করে বসে থাকে কবে একটা যোগ্য চাকরি পাবে!
সুনয়নও পড়াশনার দীর্ঘ পথটার মাঝেই দাঁড়ি টেনে শুরু করেছিল চাকরি খোঁজা। হিস্ট্রি ওর সাবজেক্ট হলেও বাদ দেয়নি কোনো পরীক্ষাই। এমনকী পিঠে বালির বস্তা নিয়ে ছুটেওছিল পুলিশের চাকরির মাঠ পাশের জন্য। হিস্ট্রির প্রফেসর হয়ে কলেজে ঢোকার স্বপ্নটা তখন কপালের ঘাম হয়ে গড়িয়ে পড়েছিল চিবুক বেয়ে। মাঠ পাশ করতে পারেনি সুনয়ন, তাই খাঁকি পোশাক পরাও আর হয়ে ওঠেনি।
আপাতত লকডাউনের শেষে ওর টিউশন ব্যাচটা আর নেই। আবার শুরু করতে হবে নতুন করে। তাই সুজিতের দুটো টোটোর মধ্যে একটা ও চালাচ্ছে। হাত খরচটুকু তো আর দাদার কাছে হাত পেতে নিতে পারে না! তাই বাধ্য হয়েই…
সারাটা দিন রাস্তায় রাস্তায় ঘোরার পর শুনতে পেল, ঋষিকার আজ আশীর্বাদও হয়ে গেল। বিয়ে নাকি এই মাসেই।
কষ্টগুলো তরল অবস্থাতেই ছিল, তাই চোখ দিয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছিল অনবরত। খুব চেষ্টা করছিল যন্ত্রণাগুলোকে আগুনে পুড়িয়ে কঠিন করতে, কিছুতেই যেন সেগুলো অবাধ্য হয়ে বেরিয়ে না আসে ঋষিকার বিয়ের দিন।
লাস্ট মেসেজটা পেয়েছিল সুনয়ন ঋষিকার কাছ থেকে। আমার আশীর্বাদ হয়ে গেল। বিয়ে কদিনের মধ্যে। যদি বিয়ের রাতেও ডাকো, চলে যাব সব ছেড়ে।
মেসেজটা দেখেই সেদিন লটারির টিকিটটা কেটেছিল সুনয়ন। মা লক্ষ্মীর ছবির পিছনে রাখার সময় বলেছিল, তোমার তো অনেক আছে তার থেকে একটু ঐশ্বর্য না হয় দিলে আমায়। খুব কি ক্ষতি হবে? যাদের অনেক আছে, তাদেরই তো বারংবার দিয়ে যাও তুমি, পক্ষপাতদুষ্ট তুমি!
ঋষিকাকে মেসেজে শুধু একটাই কথা লিখেছিল, ভালো থেকো। আগামী জীবন সুন্দর হোক।
ঋষিকা লিখেছিল, হ্যাঁ, মানিয়ে আর মেনে নেবার জন্যই তো মেয়েরা আছে। তুমি কদিন বিরহী প্রেমিক হয়ে ঘুরবে আর আমি মনোরঞ্জন করে যাব আরেকজনের। কাঁদার সুযোগটুকুও থাকবে না আমার। ভালো থাকার অভিনয় করে যেতে হবে নিখুঁতভাবে। ভালো তো আমি থাকবই সুনয়ন, তুমিও থেকো। যখন বিয়ে করবে মনে রেখো, সে হাসলে যেন তারও গালে টোল না পড়ে। তাহলে তো আমাকেও ভুলে যাবে একদিন!
চোখদুটো জ্বলেছিল ওর। মেসেজের দিকে স্থির চোখে তাকিয়েছিল কঠিনভাবে। একফোঁটাও নোনতা জল পড়তে দেয়নি ও।
আজ একটা দারুণ খবর পেল সুনয়ন। কোনো কোনো সকাল বড্ড খুশির হয়। লটারির টিকিটে পঞ্চাশ হাজার টাকা জিতেছে ও। মা, দাদা সবাই নিশ্চিন্তের নিঃশ্বাস ফেলেছে। যাক রুমির বিয়ে নিয়ে আর চিন্তা করতে হবে না। রুমি ওর কপালে হাত বোলাতে বোলাতে বলেছে, দাদা, তুই সব টাকা কেন আমার বিয়েতে খরচ করবি রে? নিজের জন্যও কিছু রাখ প্লিজ। সুনয়ন হেসে বলেছে, ধুর পাগলি, এই টাকাটা তোর জন্যই। ইদানীং রুমির বিয়ে নিয়ে দাদা, বউদি, মা ওর সঙ্গেও আলোচনা করছে। আফটার অল ও বিয়েতে অতগুলো টাকা দিচ্ছে, তাই।
বাড়িতে সবাই একটু যেন নেকনজরে দেখছে ওকে। যাক, ফাস্ট প্রাইজ না হোক ষষ্ঠ পুরস্কার তো পেয়েছে! কপালটা ওর নেহাত মন্দ নয়, এখনও ঋষিকার বিয়ের দিন সাতেক বাকি আছে। আরেকটা টিকিট কাটা যেতেই পারে। যদি লেগে যায়, তাহলে বিয়ের আসর থেকে তুলে আনবে ওর নিজের মানুষটাকে। টিকিটটার দিকে আড়চোখে তাকাল একবার, রঙিন কাগজের টুকরো বই তো নয়। তবুও ওর মধ্যে লুকিয়ে আছে ওর আর ঋষিকার স্বপ্নপূরণের চাবিকাঠি। যদি ফাস্ট বা সেকেন্ড প্রাইজ পায় তাহলে ঋষিকাকে নিয়ে চলে আসবে নিজের কাছে, আর যদি না পায় তাহলে ঋষিকা অন্যের। ওর জীবনটাও এখন দাঁড়িয়ে আছে ফাটকা বাজারের ওপরে। সুনয়ন বন্ধুদের বলত, আমি ভাগ্যে বিশ্বাসী নই, আমি পরিশ্রমে বিশ্বাসী। কঠোর পরিশ্রমের বিকল্প হয় না। সেই সুনয়ন এখন লটারি কেটে হাত গুটিয়ে বসে ঋষিকাকে লাস্ট মোমেন্টে পাওয়ার স্বপ্ন দেখছে। দেওয়ালে ঝোলানো একটু ঘোলাটে আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজের মনেই নিজে হেসে উঠল।
বাড়িতে রুমির বিয়ের তোড়জোড় চলছে। ঋষিকার দুদিন আগেই রুমির বিয়ের ডেট ধরা হয়েছে। এখন একটাই সুবিধে বিশাল ঘটা করে বিয়ে দিতে হচ্ছে না। ওই নিকট আত্মীয়স্বজনদের ডেকে ছোটর মধ্যেই সাড়া হচ্ছে। বিয়ে বাড়িতে পঞ্চাশ জনের বেশি এলাও নেই, তাতেও নয়নের মায়ের লিস্ট আশি ছাড়িয়ে একশোর দিকে ছুটছে।
ঋষিকাও আর মেসেজ করেনি। বহুবার টাইপ করে সেন্ড করেনি সুনয়নও। তাই থমকে আছে মেসেজ বক্স। কী লিখত ও? ঋষিকার সব ভালোলাগাটুকুকে কেড়ে নিয়ে ওকে বলত, মন দিয়ে সংসার করো? বড্ড বেশি হাস্যাস্পদ হয়ে যেত না? তাই নীরব থেকেছে।
টোটো নিয়ে যাওয়ার সময় ঋষিকার বাড়ির দিকে আড়চোখে তাকিয়ে দেখেছে। বাড়ির সামনে বাঁশ রয়েছে, বোধহয় প্যান্ডেল বাঁধা হবে। ঋষিকাদের বাড়িটা আকাশনীল রঙে সেজে উঠেছে। বাড়িটাকে বোধহয় এক পোঁচ রং ধরিয়ে নিয়েছে ওর বাবা। হয়তো পুরোনোকে মুছে ফেলার আপ্রাণ প্রচেষ্টা। ঋষিকার মনটাও কী ওদের বাড়ির মতোই নতুনের আলোয় ঝকঝক করছে?
কে জানে! হয়তো সুনয়নকে ধীরে ধীরে স্মৃতির পাতায় স্থান দিচ্ছে ঋষিকা। ক্রমশ পাতাগুলো হলুদ হয়ে যাবে, তারপর হারিয়ে যাবে জীবন থেকে। সেটাই উচিত, কী হবে সুনয়নকে মনে রেখে?
ভুলতে হবে ওকেও। টাকা না থাক, চাকরি না থাক একটা জলজ্যান্ত মন তো আছে ওর। যে মনটা অবিরত জ্বালিয়েই চলেছে। চুঁইয়ে চুঁইয়ে রক্তক্ষরণ করাই যার একমাত্র কাজ। তাই ওর শরীর থেকে অনবরত রক্তক্ষরণ বন্ধ করতেই ঋষিকাকে ভুলতে হবে ওকে। সুনয়ন যত চেষ্টা করছে ঋষিকাকে ভুলতে ততই যেন জড়িয়ে পড়ছে ফেলে আসা দিনের মেঘলা বেলায়।
যাবে বাবা? আচমকা প্রশ্নে ব্রেক কষে দাঁড়াল সুনয়ন। বছর সত্তরের একজন পৌঢ় দাঁড়িয়ে আছেন। হাতে ছাতা আর একটা চটের ব্যাগ। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল দুপুর দেড়টা প্রায়। এই সময় ও বাড়ি ফেরে। বেশি দেরি হলে বউদি রাগ করে। এমনিতেই এত পড়াশনা করে ও জব পাইনি বলে সকলেরই বিরক্তির কারণ, তারপরে ওর জন্য কেউ হেঁসেল আগলে বসে থাকলে ওর নিজেরও খুব অস্বস্তি হয়। তাই বাড়ি ফেরার পথই ধরেছিল সুনয়ন। ভদ্রলোক আবার বললেন, বাবা একটু পৌঁছে দাও না। ভদ্রলোকের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। হাতের ব্যাগটা বোধহয় বেশ ভারী, এইটুকু সময়েই দুবার হাত পাল্টালেন। সুনয়ন ঘড়ির দিকে আনমনে একবার তাকিয়ে বলল, উঠুন। কোথায় যাবেন? আমি কিন্তু গোয়ালপাড়া রুটে ভীষণ নতুন, রাস্তা বলে দেবেন। ভদ্রলোক স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, আসলে এই দুপুরের টাইমটাতে গাড়ি কমে যায়। প্রায় মিনিট পনেরো দাঁড়িয়ে আছি, একা বলে কেউ নিয়ে যেতে চাইছে না। সুনয়ন হেসে বলল, আসলে একজন প্যাসেঞ্জার নিয়ে গেলে পড়তা হয় না। কথাটা বলেই নিজের মনে হাসল ও। বাহ, ও বেশ এই লাইনের মতো কথা বলতে শিখেছে তো!
বিশ্বজিৎ বলছিল, রেলে নাকি ভ্যাকেনসি বেরিয়েছে। যদিও আদৌ কবে হবে এক্সাম কেউ জানে না। তবুও ফর্মটা তো ফিলাপ করতেই হবে। এই ফর্ম ফিলাপের টাকাগুলোও যেন আজকাল যুক্তি দিয়ে হিসেবনিকেশ করতে বসেছে, বারবার বলছে অনেক তো হল প্রহসন!
অন্যমনস্ক হয়ে ছোট্ট সাঁকোটা পেরিয়ে এল সুনয়ন। ভদ্রলোক বললেন, বাঁ দিকে ঢালাই রাস্তা দিয়ে ঢুকেই হলদে বাড়িটা। নির্দিষ্ট বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে ভদ্রলোক পঞ্চাশ টাকার নোটটা এগিয়ে দিয়ে বললেন, তুমি এ রাস্তায় নতুন বাবা, এটার ভাড়া ত্রিশ নয়, একা এলে পঞ্চাশই দিই। সুনয়ন একটু অবাক হয়েই তাকাল ভদ্রলোকের দিকে। তবে যে বলে আজকাল সব মানুষই বড্ড স্বার্থপর! ভদ্রলোক ব্যাগটা নামাতে যেতেই গাড়ি থেকে নেমে সুনয়ন ওনার ব্যাগটা নিয়ে বলল, চলুন, আমি পৌঁছে দিয়ে আসি। আর এক গ্লাস জলও খেয়ে আসি। ভদ্রলোক বললেন, ধীরেন চৌধুরী, এল আই সিতে চাকরি করতাম। রিটায়ার করেছি বছর দশেক হল। এখনও বসে নেই কিন্তু, কাজ করেই চলেছি। এজেন্টদের শেখাই, ক্লাস নিই বলতে পারো। ব্যাগটা নিয়ে ওনার ছোটর ওপরে দোতলা বাড়িটার বারান্দায় এসে পৌঁছতে ভদ্রলোক বেশ জোরেই ডাকলেন, তরী…..এই তরী…..একগ্লাস জল আর মিষ্টি নিয়ে আয়।
সুনয়নের অস্বস্তি হচ্ছে এবারে। গলাটা শুকিয়ে গিয়েছিল বলে একগ্লাস জল চেয়েছিল ও। কিন্তু ধীরেনবাবু যেভাবে মিষ্টি মিষ্টি বলে চেঁচাচ্ছে তাতে তো অস্বস্তি বাড়ছে বই কমছে না। সুনয়ন বারণ করতেই বললেন, আত্মীয়স্বজন তো তেমন আসে না। বাপ-বেটির সংসার। ঘর থেকে ধীর পায়ে হাতে জলের গ্লাস আর প্লেটে দুটো সন্দেশ নিয়ে এসে বাইরের টেবিলের ওপর রাখল মেয়েটা।
সুনয়নকে দেখে ফিসফিস করে বলল, আমি তরী, আমি বেশ্যা নই। বিলিভ মি। ফিসফিস করতে করতেই ভিতরে চলে গেল।
ধীরেনবাবু মলিন হেসে বললেন, আমার মেয়ে। কলেজের থার্ড ইয়ার থেকেই এমন হয়ে গেছে। মা মরা মেয়েটাকে খুব আদরে মানুষ করছিলাম। কলেজে গিয়ে একটা ছেলে ওকে প্রোপোজ করেছিল। ও তার প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিল। সেই ছেলেটি আমার বাড়ির ফোন নম্বরটা স্টেশনের বাথরুমে লিখে দিয়েছিল। তার নীচে লিখে দিয়েছিল, পার নাইট হাজার টাকা।
রেগুলার ফোন আসত। একটাই প্রশ্ন, হাজার টাকা তো? তরী চৌধুরী তো? শুনতে শুনতে মেয়েটা ধীরে ধীরে এমন হয়ে গেল।
আসলে কী জানো বাবা, আমরা ভাবি কম, স্রোতে গা ভাসিয়ে চলি। তাই কে লিখল, কী লিখল না ভেবেই ফোন করে যেত এই নম্বরে। আমি জানতে পেরে ফোনটার কানেকশন কেটে দিয়েছিলাম, ততদিনে আমার মেয়েটা হারিয়ে ফেলেছে তার স্মৃতি। প্রথম প্রথম আমাকে বলেওনি। ওর ঘরেই ছিল ফোনটা। আমি বাড়িতে থাকতাম খুবই কম। যখন বুঝতে পারলাম তখন সব শেষ। তখন তরী নিজের দুনিয়ায় প্রবেশ করেছে, অনেক ডক্টর দেখিয়েছি জানো, কিছু উপকার হয়নি। এমনিতে ও ভীষণ নিরীহ প্রকৃতির ছিল। ফোনটা কেটে দিয়েও নিস্তার পাইনি, প্রায়ই বাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়ে থাকত কয়েকজন, উদ্দেশ্য তরীকে খারাপ নজরে দেখা। পরে শুনলাম, ফোনে না পেয়ে সেই ছেলে আর তার বন্ধুরা নাকি আমাদের বাড়ির অ্যাড্রেস লিখে দিয়েছে দেওয়ালে দেওয়ালে। তাই লোকজন আসতে শুরু করেছিল বাড়ির গেট অবধি। এখন সেসব বন্ধ হয়েছে। কিন্তু আমার তরী আর সুস্থ হয়নি। তরী বরাবরই শান্ত স্বভাবের ছিল, তাই হয়তো আঘাতটা একটু বেশিই লেগেছে। বার দুয়েক সুইসাইড করতেও গেছে। এখন ঘরের কাজকম্ম করে, নিজের মনে কবিতা বলে, কিন্তু কাউকে দেখলেই এই এক কথা।
সুনয়ন অবাক হয়ে দেখছিল ধীরেনবাবুর দিকে। এই মানুষটা চোখ বুজলেই তার মানে তরী একদম একা হয়ে যাবে! এই প্রথম ঋষিকা আর ওর সম্পর্কের বাইরের পৃথিবীটার দিকে চোখ পড়ল ওর।
এতদিন নিজের কষ্ট নিয়ে একতরফা কষ্ট পেয়েছে। নিজেকে সব থেকে দুঃখী মানুষ ভেবেছে। কিন্তু তরী আর ওর বাবাকে দেখে বুঝতে পারল, অপরাধ না করেও মানুষ কেমন বিপদে পড়ে। এরা দুজনেই কোনোরকম অপরাধ করেনি তারপরেও এভাবে দিন কাটাচ্ছে।
জলের গ্লাসটা নামিয়ে রেখে পায়ে পায়ে বেরিয়ে এসেছিল সুনয়ন। তরীর মুখটা মনে পড়ছে বারবার। নিষ্পাপ দূটো চোখ, বিবর্ণ ঠোঁট দুটো নেড়ে বলল ভয়ংকর কথা দুটো। মনে হল, কাউকে যেন চাইছে যে ওকে বলবে, আমি তোমায় বিশ্বাস করি!
রুমির বিয়েটা কেটে গেল নির্বিঘ্নে। মা ঠিকই বলেছিল, পাত্রপক্ষ অতি সজ্জন পরিবার। রুমিকে ভালোই রাখবে মনে হল। অবশ্য সাদা চোখে যেটা দেখা যায় সেটা যে ঠিক হবে এমন তো কথা নেই, মানুষ চেনা বড় ভার। তবুও বাড়ির সকলকে খুশি দেখে খুব ভালো লাগছিল সুনয়নের। আর মাত্র দুদিন পরেই ঋষিকার বিয়ে। বুকের বাম দিকটা চিনচিনে যন্ত্রণা নিয়েই সমস্ত কাজ করে চলেছে সুনয়ন। অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছে বারবার। ভুল হয়ে যাচ্ছে কাজে, মনের অস্থিরতা থাকলে খুব সাধারণ কাজও মানুষ ভুল করে এটাই প্রতিনিয়ত বুঝতে পারছিল ও।
লটারির রঙিন কাগজটা এবারে ওর দিকে তাকিয়ে বিদ্রুপের হাসি হেসে বলেছে, প্রয়োজন শুধু তোমার একার নয়, অনেকের। তাই বারবার তুমি প্রাইজ পাবে না সুনয়ন। ভাগ্যের কঠোর বাণী শুনিয়ে দিয়ে টিকিটটা বাতিল রঙিন কাগজের দলে নাম লিখিয়েছে।
সুনয়নের চোখের সামনে দিয়েই ঋষিকার বাড়িতে ঢুকেছে বরের গাড়ি। ফুলে সাজানো গাড়িতে বসিয়েই এ শহর ছেড়ে ঋষিকাকে নিয়ে চলেও গেছে। মানসিক যুদ্ধে পরাজিত হয়ে সুনয়ন এখন দীঘির মতো শান্ত। আর উথালপাথাল ঢেউ ওঠে না ওর রক্তাত্ব হৃদয়ে। ঋষিকার বিয়ে হয়ে চলে যাওয়া ওকে কঠোর বাস্তবের সঙ্গে পরিচিত করে দিয়ে গেছে। পাথুরে মাটিতে ঘষে দিয়ে গেছে ওর স্বপ্ন দেখা মনটাকে। রূপকথার গল্পগুলোকে ও এখন গল্পই ভাবে শুধু।
মাসখানেক হল ঋষিকা চলে গেছে শ্বশুরবাড়ি, লকডাউন উঠেছে সম্পূর্ণভাবে। শুধু দগদগে দাগ রেখে গেছে নিম্নমধ্যবিত্ত জীবনে। মধ্যবিত্তরা নিমেষে নেমে এসেছে নিম্নমধ্যবিত্তর দলে। সুনয়ন ফিরে পেয়েছে ওর টিউশনি ব্যাচ, কিন্তু টোটোটাও চালাচ্ছে। এক্সাম যদিও এখনও বন্ধ। আদৌ কি সারবে এই নড়বড়ে অর্থনীতি? যুক্তিবাদী মন তো না বলছে, কল্পনাপ্রবণ মনটা ফিসফিস করে বলছে, সব ঠিক হবে।
গোয়ালপাড়ার চৌমাথার দুটো প্যাসেঞ্জারকে নামিয়ে দিয়ে গাড়িটা ঘুরিয়ে নিয়ে আসার পথেই চোখে পড়ল গলির মোড়ে বেশ ভিড় হয়ে আছে।
কৌতূহলবশত এগোতেই দেখল, ধীরেনবাবুর বাড়ির সামনেই ভিড়টা জমেছে মূলত। বুকটা ধক করে উঠল, তবে কী তরী কিছু করে বসল….
দিন পনেরো আগে একদিন দেখা হয়েছিল ধীরেনবাবুর সঙ্গে। কথা হয়নি, বেশ তাড়ায় ছিলেন। শুধু হাত নেড়ে হেসেছিলেন ওকে দেখে। মানুষটাকে বেশ ভালো লেগেছিল সুনয়নের। গাড়িটাকে পাঁচিলের গায়ে রেখে কম্পিত পায়ে এগিয়েছিল ওদের বাড়ির দিকে।
একজন বেশ উত্তেজিত গলায় বলল, আরে কাল রাতেও তো গেটে দাঁড়িয়ে কতক্ষণ কথা হল আমার সঙ্গে! এখন শুনছি এই ঘটনা। আত্মীয়স্বজনরা তো তরীর জন্যই বোধহয় সম্পর্ক রাখে না। কই কেউ তো এল না। টুকরো টুকরো কথা শুনতে শুনতেই এগোলো সুনয়ন।
বাড়ির উঠানে শোয়ানো আছে ধীরেন চৌধুরীর মরদেহ। মাথার কাছে বসে আছে তরী। স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বাবার চন্দন পরা মুখের দিকে। হয়তো ভাবছে এখুনি বাবা ওকে তরী বলে ডাকে উঠবে। অপেক্ষায় রয়েছে তরী।
সুনয়ন একটু কাছে যেতেই তরী চোখ তুলে তাকাল একবার, তারপর আবার স্থির। সুনয়ন বলল, তরী, কী হয়েছিল ওনার?
তরী ফিসফিস করে বলল, আমি বেশ্যা নই, বিলিভ মি।
পাড়ার দুজন লোক ওর কাছে এসে বলল, ভোর রাতে কার্ডিয়াক এরেস্ট। কাজের বউটা কাজ করতে এসে আবিষ্কার করেছে। আসলে মেয়েটা তো পাগলা, তাই বুঝতেও পারেনি।
পাগলা কথাটা শুনে কেমন যেন ঘেঁটে গেল সব। তরী তো একদিন সুস্থ স্বাভাবিক মেয়েই ছিল। মেয়ে ছিল বলেই খুব সহজে ওর চরিত্রে দাগ লাগিয়ে দিতে পেরেছে সমাজ। পাগলা কথাটা শুনেই সুনয়ন বলল, আপনারা একটু হেল্প করুন, ওনাকে নিয়ে যেতে হবে শ্মশানে।
তরী কাঁদেনি, একফোঁটাও জল পড়েনি ওর চোখ থেকে। শুধু ধীরেনবাবুকে নিয়ে যাওয়ার সময় ওর হাতটা ধরে বলেছিল, বিলিভ মি।
সুনয়ন ওর চোখে চোখ রেখে বলল, বিশ্বাস করি তোমায় তরী। আমি জানি তোমার কোনো দোষ ছিল না। মেয়েটা কী বুঝল কে জানে, ধীরে ধীরে ঘরে চলে গেল। ধীরেনবাবুর পরলৌকিক কাজ সুনয়নই করেছিল। অবাক হয়ে ভেবেছিল, কে হয় ও ধীরেন চৌধুরীর? কী সম্পর্ক ওর সঙ্গে! চেনাও তো নয় বেশি দিনের।
পাড়ার লোক বলেছিল, বুড়োর টাকার লোভেই নাকি সুনয়ন এখন দাঁড়াতে এসেছে তরীর পাশে। মনে মনে হেসেছিল সুনয়ন। এটাই বোধহয় নিয়ম, কেউ ছিল না তরীর পাশে, উঠানে ধীরেনবাবুর মরদেহে মাছি বসছিল, যেমনি সুনয়ন এগিয়ে এসে কাজটা মেটালো অমনি ওকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিল মানুষ। সুনয়ন নাকি ধীরেনবাবুর অর্থের লোভে এসেছে ওদের উপকার করতে। সে যে যাই বলুক, এই মুহূর্তে ও তরীকে একলা ছেড়ে যেতে পারবে না।
তরীর বিক্ষিপ্ত দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে সুনয়ন বুঝেছে তরী একটা কাউকে খুঁজছে। বার দুয়েক বলেও উঠল, বাবা খাবে এসো। কাজের ভদ্রমহিলা বললেন, মেয়েটা যে কী মিশুকে, কী ভালো ছিল, কল্পনাও করতে পারবে না। হঠাৎ যে কী হয়ে গেল। সবাই ওকে খারাপ খারাপ বলতে শুরু করল, তারপর আচমকাই বন্ধ করে দিল কলেজ যাওয়া, পড়াশোনা….আস্তে আস্তে নিজের ঘরের মধ্যে গুটিয়ে নিল নিজেকে। সব কথা শোনে কিন্তু। আমি যা বলি সব শোনে। কিন্তু ওই যে, ওই এক কথা ফিসফিস করে যায় অনবরত। বাবাটা ছিল, তাও কেটে যাচ্ছিল। এখন যে কী হবে কে জানে!
আত্মীয়রা বহুদিন আগে থেকেই যোগাযোগ রাখে না। অবশ্য আত্মীয়রা কবেই আর বিপদে পাশে থেকেছে!
সুনয়ন সব কিছু মিটিয়ে বাসন্তীমাসির সঙ্গে কথা বলে ওদের বাড়ি থেকে বেরিয়েই আসতে যাচ্ছিল, ঠিক তখনই তরী পিছন থেকে এসে ওকে জড়িয়ে ধরে বলল, বিলিভ মি…..
তরীর দিকে তাকিয়ে সুনয়ন বলল, তরী তোমার বাবা মারা গেছেন, আর ফিরবেন না, তুমি জানো? তরী ওর কানের কাছে মুখটা এনে ফিসফিস করে বলল,
‘মৃত্যু নয়, ধ্বংস নয়,
নহে বিচ্ছেদের ভয়—
শুধু সমাপন।
শুধু সুখ হতে স্মৃতি,
শুধু ব্যথা হতে গীতি,
তরী হতে তীর,
খেলা হতে খেলাশ্রান্তি,
বাসনা হইতে শান্তি,
নভ হতে নীড়।’
সুনয়ন বেরিয়ে এসেছে তরীদের বাড়ি থেকে, মনে অনেকটা দোটানা নিয়ে। পাড়ার লোকজন, সমাজের লোকজন কী বলবে? হয়তো বলবে ধীরেনবাবুর অর্থ গ্রাস করার জন্যই ও ওই বাড়িতে গেছে, তার থেকে বরং ওরা মিটিয়ে নিক ওদেরটা। সুনয়ন ফিরছিল, হঠাৎই ভীষণ পরিচিত ডাক শুনে টোটোটা দাঁড় করাল। পিছন ফিরে দেখল, ঋষিকা এগিয়ে আসছে, নতুন শাড়ির আড়ষ্টতা ভেঙে। খুব স্বাভাবিক গলাতেই বলল, কী, কেমন আছো? প্রায় দুমাস হতে চলল আমার বিয়ে হয়েছে, কেমন আছি একবার খোঁজ নিলে না তো?
সুনয়ন হেসে বলল, একমাস, উনিশ দিন, আঠেরো ঘণ্টা বিয়ে হয়েছে তোমার ঋষিকা। খোঁজ নিইনি কারণ তুমি ভালো নেই শুনলেও আমি অপারগ।
ঋষিকা আলতো করে হেসে বলল, আমি ভালো আছি। ওদের বাড়ির সকলে আমাকে খুব ভালো রেখেছে। তুমিও ভালো থেকো, বন্ধুত্বটা থাকুক মনের কোণে, ওই পার্কের বেঞ্চটা থাকুক কিছু স্মৃতিবহনকারী পাহারাদার হিসাবে।
সুনয়ন, জীবনটা অনেক বড়, হারিয়ে যেও না, হেরে যেও না। মনের সঙ্গে লড়াই করে জিতে যেও, তাহলে আমি খুব খুশি হব। কথাটা বলেই ঋষিকা জোরে জোরে পা চালিয়ে চলে গেল।
বাড়ি ফিরে সুনয়ন মা আর দাদাকে ডেকে বলল, আমি একজনের দায়িত্ব নিতে চাই।
দুজনেই হতবাক। দায়িত্ব! তুই তো কিছুই করিস না সে ভাবে, কার দায়িত্ব নিবি?
সুনয়ন স্থির গলায় বলল, যার আমাকে ভীষণ প্রয়োজন।
সবটা শুনে মা বলতে চেষ্টা করেছিল, এসবের মধ্যে ঢুকিস না, সবাই বলছে যখন তখন নিশ্চয়ই মেয়েটা খারাপ ছিল।
দাদা বলল, কিন্তু ওই মেয়েটা তো পাগল, কদিন পরে ও যদি তোকে অস্বীকার করে? তখন কী করবি? তাছাড়া মেয়েটার নামে তো স্ক্যান্ডাল আছে রে।
সুনয়ন মুচকি হাসল। কদিন আগেও ও আর ঋষিকা কাটিয়েছে অন্তরঙ্গ কিছু মুহূর্ত, আজ ঋষিকা সুখী পরিবার,নতুন গয়না আর শাড়িতে রাজেন্দ্রাণী। সুনয়ন কুড়াচ্ছে ব্যর্থ প্রেমিকের সহানুভূতি, আর তরী, অকারণে কিছু বদনাম। অদ্ভুত মানুষের মন।
সুনয়ন নিজের ব্যাগপত্র গুছিয়ে নিয়ে বলল, তরীর আমাকে দরকার মা।
ভোরের সূর্য তখন নরম মেঘে ঢাকা, গড়িমসি করছে বিছানা ছাড়তে, তার আগেই সুনয়ন পৌঁছাল তরীদের বাড়িতে। বাসন্তীমাসির নিজের সংসার আছে। তাই রাতে নিজের বাড়িতে চলে যায়।
ভোরে বেল বাজাতে তরীই এসে দরজা খুলল। ঘুম চোখে বলল, সুনয়ন, আমি জানি বাবা মারা গেছে। আমিও মারা যাব।
সুনয়ন ওর হাতটা ধরে বলল, আর যদি তোমায় মরতে না দিই? যদি বলি সেদিন তোমায় দেখেছিলাম বলেই মনে হয়েছিল, আমার থেকেও দুঃখী কেউ আছে এ বিশ্বে, তাই নিজেকে শেষ করে দেবার সিদ্ধান্ত থেকে ফিরে এসেছিলাম দ্বিতীয়বার, তাহলে!
তরী কথা না বলে, সুনয়নকে দেখতে লাগল অপলক। কী গভীর সেই দৃষ্টি। মনে হচ্ছিল সুনয়নের অন্তরে প্রবেশ করে তরী দেখে নিচ্ছে ওর উদ্দেশ্যটা। ঠোঁটের কোণে একটা নরম হাসি ছড়িয়ে তরী বলল, তুমি থাকবে আমার সঙ্গে? আমার একা একা ভয় করে। যদি আবার ওরা আসে…ভয় করে খুব।
সুনয়ন বলল, আর ভয় নেই।
ধীরেনবাবুদের বাইরের বড় ঘরটাতে হিস্ট্রির কোচিং সেন্টারে নোটস দিচ্ছিল সুনয়ন, তরী ঘর থেকেই বলল, তাড়াতাড়ি করো, অফিসের দেরি হবে তো।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল সুনয়ন, তাই তো নটা বেজে গেছে। সাড়ে নটায় না বেরোলে অফিস পৌঁছাতে অনেকটা দেরি হয়ে যাবে। সেটেলমেন্ট ডিপার্টমেন্টে জবটা পেয়েছে মাস ছয়েক হল। তার আগে পর্যন্ত ওদের সংসার চলেছে ধীরেনবাবুর মান্থলি ইনকাম স্কীম আর সুনয়নের টিউশনির টাকায়। তাই চাকরিটা পেয়েও টিউশনিটা ছাড়েনি ও। তরীর অবশ্য কড়া নির্দেশ আছে, যারা গরিব, মাইনে দিতে পারবে না তাদের কাছ থেকে যেন সুনয়ন টাকা না নেয়।
তরীর আর ওর বিবাহিত জীবন বছর দুয়েকের হল। তরী এখনও মাঝে মাঝে ঘুমের ঘোরে বলে, বিলিভ মি..আমি খারাপ নই। কিন্তু এছাড়া তরী প্রায় সুস্থ। সুনয়নের সব দিকে নজর রাখে সে। সুনয়নের বাড়ি থেকে অবশ্য বউমাকে মেনে নেয়নি এখনও। তাই তরী ও বাড়িতে আজও ব্রাত্য। সুনয়ন মাঝে মাঝে যায় ওই বাড়িতে। যদিও মা ছাড়া আর কেউ কথাও বলে না ভালো করে।
সুনয়নের বিয়ের পর ঋষিকা মেসেজ করে বলেছিল, এই জন্যই তোমাকে ভালোবাসতাম, তুমি আর পাঁচজনের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। তরীর অনেক বেশি প্রয়োজন ছিল তোমায়। একদিন গিয়ে দেখে আসব প্রাক্তনের সংসার। না আসেনি ঋষিকা সুনয়নের সংসার দেখতে, শুধু বলেছিল, ভালো রেখো তরীকে।
সুনয়ন আপ্রাণ চেষ্টা করেছে তরীকে ভালো রাখার। বারবার জিজ্ঞেস করলে আবার তরী রেগে যায়, বলে, দেখছো তো আমি খুব ভালো আছি! তরী এখন রাগ করে, অভিমান করে, আনন্দে হাসে, দুঃখে কাঁদে….
তরী এখন সাজগোজও করে। সুনয়ন মনে মনে বলে, বাঁচিয়ে দিলে তরী তুমি আমায়। আমিও যে কারোর বাঁচার কারণ হতে পারি, এটা উপলব্ধি করালে তুমি। মূল্যহীন আমার জীবনটা মূল্যবান হয়ে গেল শুধু তোমার জন্য। থ্যাংক ইউ তরী।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন