অর্পিতা সরকার
ওর দার্জিলিংয়ে আসার উদ্দেশ্য একটাই.. ম্যালে বসে বেশ কিছুক্ষণ ধ্যানগম্ভীর কাঞ্চনজঙ্ঘার দিকে অপলক তাকিয়ে থাকা। আর ক্যাভেন্টার্সের ব্রেকফাস্ট খাওয়া। এবারেও তার ব্যতিক্রম নেই। অফিসে দিন পাঁচেকের ছুটি ম্যানেজ করে পৌষালী চলে এসেছে দার্জিলিং। সেভেন পয়েন্ট হোটেলে এর আগে ও কখনো ওঠেনি। এবারেই প্রথম এল। অফিস কলিগ মহাশ্বেতার কথা শুনেই নিজের পুরোনো হোটেল ছেড়ে এখানে আগমন। হোটেলটার ডেকোরেশন অসাধারণ। কাঞ্চনজঙ্ঘার যদি মর্জি ভালো থাকে তাহলে হোটেলের জানালা দিয়েই তাকে দেখা যাবে। তবে অভিমানী কাঞ্চনজঙ্ঘার দর্শন দেবার মন কবে হবে সেই নিয়ে পর্যটকরা ভারী উদ্বিগ্ন হয়ে থাকে। পৌষালীর অবশ্য সে নিয়ে কোনো আক্ষেপ নেই। দার্জিলিং এমনিতেই ওর চোখে ভীষণ রকমের সুন্দরী। সে মুকুট পরে থাকুক বা না থাকুক।
ড্রেস চেন করে ট্রেন জার্নির অবসাদটুকু কাটিয়ে নিয়ে বেরিয়ে পড়বে ভেবেই রিসেপশনে একটা চা আর চিকেন মোমোর অর্ডার দিয়ে এসেছিল। রুমের বেলটা বাজতেই গায়ে একটা স্কার্ফ জড়িয়ে দরজাটা খুলল পৌষালী। শুদ্ধ বাংলায় ছেলেটা বলল, ডিনারে কী নেবেন আগে থেকে বলে দেবেন ম্যাডাম। ট্রে-টা সেন্টার টেবিলে নামিয়ে রেখে ছেলেটা বলল, আপনি কি একাই এসেছেন ম্যাডাম? আর কেউ কি আসবে দু-দিন পরে? ছেলেটার এতটা কৌতূহলে বিরক্ত হতে গিয়েও সামলে নিয়ে পৌষালী বলল, আমি একাই এসেছি। একাই থাকব। ছেলেটি ঘাড় নেড়ে বলল, আচ্ছা ম্যাডাম।
ইদানীং কারোর সাধারণ কথাতেও ও রেগে যাচ্ছে। হাইপার টেনশনের ওষুধ পর্যন্ত খেতে হচ্ছে ওকে নিয়মিত। তবুও আজ বছর বাইশেই ছেলেটার সরল চোখদুটোর দিকে তাকিয়ে না রেগেই উত্তর দিল ও। সাধারণত এই বয়েসের ছেলের এমন নিষ্পাপ মুখ ও দেখেনি এর আগে।
দুটো মোমোতে ফুঁ দিয়ে স্যুপটা চামচে করে মুখে ঢেলে নরম চিকেনের তৃপ্তি জিভে নিতে না নিতেই আবার বেল বাজল।
ভ্রু কুঁচকে দরজাটা খুলল পৌষালী। ছেলেটা এক বোতল জল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে হাসি মুখে। ছেলেটার হাত থেকে জলটা নিয়ে পৌষালী বলল, ব্যস, এখন আর কিছু দরকার নেই। আমি একটু একা থাকতে চাই। যখন দরকার হবে আমি বেল বাজিয়ে দেব। ছেলেটা একমুখ হেসে বলল, ম্যাডাম আপনার গাইড লাগবে না? পৌষালী বলল, এত বার দার্জিলিং এসেছি যে রাস্তাঘাট মুখস্থ, তাই গাইড লাগবে না। ছেলেটা নাছোড়বান্দা। আগ বাড়িয়ে বলল, আমার নাম মিতাস। এই অফসিজনে তো তেমন টুরিস্ট আসে না। তাই হোটেল প্রায় ফাঁকাই থাকে। আমরাই গাইড হয়ে দু-পয়সা কামিয়ে নিই। পৌষালীর কেমন যেন মায়া লাগল। মুচকি হেসে বলল, বেশ তোমাকে আমি গাইড করতে রাজি আছি। কিন্তু আমাকে এমন কিছু অজানা পথের বাঁকে নিয়ে যেতে হবে যেখান থেকে আমি হারিয়ে যেতে পারি স্বচ্ছন্দে।
মিতাস ঘাড় নেড়ে বলল, আচ্ছা ম্যাডাম। কাল ভোরে আমরা বেরুবো।
পৌষালী পশমের বাহারি কোটটা গায়ে চাপিয়ে পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল ম্যাল রোড দিয়ে। ঝকঝকে সাজানো ম্যাল রোড দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মনে হয়, জীবনটা বোধহয় সত্যিই এতটা বেরঙিন নয়। এখনও বোধহয় অল্প রং রয়ে গেছে গ্রীষ্ম শেষের কৃষ্ণচূড়ায়।
পায়ে পায়ে ম্যালের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে পৌষালী। ওই বেঞ্চটাতেই এসে বসেছিল ও আর অপূর্ব। ওর প্রথমবার দার্জিলিং ভ্রমণ ছিল সেটা। ওদের হানিমুনে। অপূর্বর হাতটা চেপে ধরে ও বলেছিল, ওই দেখ কাঞ্চনজঙ্ঘা।
তখন বড্ড রঙিন ছিল পৌষালীর চারপাশটা। অপূর্ব আর ও একটা ছোট্ট পৃথিবী গড়ে তুলেছিল দার্জিলিংয়ের এই বেঞ্চে বসে। বিয়ের মাত্র দশদিন পরেই ছিল ওদের হানিমুন। পৌষালীর মা সবটুকু গুছিয়ে দিয়েছিল। পৌষালী তখন সদ্য ব্যাংকে জব পেয়েছে। ছুটি ম্যানেজ করা ছিল মারাত্মক কঠিন। তবুও তিনদিনের ছুটিতে ওরা পৃথিবীর সবটুকু আনন্দকে উজাড় করে নিতে চেয়েছিল।
অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ বলেই বোধহয় দুজনে দুজনকে চেনার আগ্রহ ছিল মারাত্মক।
তাই গল্পের শেষ হত না ওদের। পৌষালী নিজের জীবনের সবটুকু বলেছিল অপূর্বকে। ওদের গল্পের মাঝেই প্রথম মিথ্যেটা ধরা পড়েছিল পৌষালীর কানে। অপূর্ব বিয়ের আগে বলেছিল, ও নাকি মেট্রোরেলের ইঞ্জিনিয়ার। ওর বাবা স্কুল টিচার।
দুটো শরীর যখন বিশ্বাসে ভর করে মিশে যাচ্ছিল তখনই ঠোক্কর খেয়েছিল নির্মমভাবে। অপূর্ব মেট্রোরেলের ইঞ্জিনিয়ার নয় ও ক্লারিক্যাল জব করত। আর ওর বাবাও স্কুলের ক্লার্ক ছিলেন। পৌষালী অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, আমি তোমাদের কোনো কাজকেই ছোট করছি না অপূর্ব কিন্তু তুমি এমন মিথ্যে কেন বললে? একটা সম্পর্কের শুরু কখনো মিথ্যে দিয়ে হয় না।
অপূর্বর ভালোবাসায় কোনো খামতি ছিল না। কিন্তু ওদের বাড়ির সকলে কথায় কথায় মিথ্যে বলত। ওর মা অকারণে মিথ্যে বলতে পছন্দ করত। অপূর্ব কোনোদিন দেরি করে বাড়ি ফিরলে পৌষালী জিজ্ঞেস করলেই নানা অজুহাতে মিথ্যে বলত। পৌষালী অনেক বুঝিয়েছিল অপূর্বকে, প্লিজ সত্যিটা বলো আমার কাছে। আমি ক্লান্ত হয়ে পড়ছি তোমাদের মিথ্যা শুনতে শুনতে, কিন্তু অপূর্বর এই স্বভাবের কোনো পরিবর্তন হয়নি।
বছর না ঘুরতেই ভাঙন দেখা দিয়েছিল ওদের সম্পর্কে। বিশ্বাসের ভীতটা নড়ে গিয়েছিল ভীষণভাবে। অপূর্ব ওকে জড়িয়ে ধরে যখন বলত, আমি তোমায় বড্ড ভালোবাসি পৌষালী, তখনই ওর মনে হত সত্যি বলছে তো? নাকি এটাও ওর বলা আর পাঁচটা মিথ্যের মতোই।
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ জানিয়েছিলেন, এটা নাকি অপূর্বর একধরনের মানসিক রোগ। মিথ্যে বলতে বলতে ও ওগুলোকেই সত্যি বলে বিশ্বাস করতে শুরু করে। পৌষালী অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ছিল।
বাড়িতে মাকে জানিয়েছিল, ওর মা যথারীতি মানিয়ে নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিল। কিন্তু চব্বিশঘণ্টা এদের সকলের কথা ফিল্টার করতে করতে ক্লান্ত লাগত ওর। অপূর্বর ছোঁয়ায় আর ওর শরীর সাড়া দিচ্ছিল না তখন। আদরের আগে অপূর্ব যখন কানে কানে বলত, পৌষালী গোটা পৃথিবী একদিকে আর তুমি আরেকদিকে তখন চমকে উঠতো পৌষালী। একটু আগেই ওর অফিস কলিগ সঞ্জয় ফেসবুকে পোস্ট করেছে ওদের বন্ধুদের ডিনারের ছবি, অথচ অপূর্ব অবলীলায় ডিনার থেকে ফিরে বলল, অফিসে ভীষণ কাজের চাপ বেড়েছে পৌষালী। আজ আর কিছু খাব না, শরীরটা খারাপ লাগছে।
তাই ওর ফিসফিস করে বলা কথাগুলোর মাঝে অনেকটা অবিশ্বাসের বাতাস ঢুকে যেত মুহূর্তে। তখন অপূর্বর ছোঁয়ায় আর কিছুতেই সাড়া দিতে চাইতো না ওর মন।
রেগে যাচ্ছিল অপূর্ব। মারাত্মক আক্রোশে ওর শরীরের নরম অংশে আঁচড়ে কামড়ে দিত।
ধীরে ধীরে নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছিল পৌষালী। বছর দেড়েক পরে বুঝেছিল, অপূর্ব আর ও একেবারেই বেমানান। বিশেষ করে অপূর্ব যখন সকলকে বলতে শুরু করেছিল, পৌষালী নাকি খুব মিথ্যে বলে। চমকে উঠেছিল ও। সিদ্ধান্ত নিয়েছিল আর নয়। ফিরে এসেছিল মা-বাবার কাছে। নিজের বাড়িতেই তখন বেশ অতিথি হয়ে গিয়েছিল ও। মা বারংবার জিজ্ঞেস করেছিল, অপূর্ব কবে আসবে? পৌষালী কবে ফিরে যাবে ওবাড়িতে। দাদা-বউদি দুজনেই ঘুরে ফিরে একই কথা বলছিল, অপূর্বর সঙ্গে কী ঝগড়া হয়ে গেছে? ওরা কী মিটিয়ে দিতে সাহায্য করবে?
বাধ্য হয়ে একটা পিজির খোঁজ করে বেরিয়ে এসেছিল বাড়ি থেকে। অপূর্বর সঙ্গে ডিভোর্স কেসটা চলেছিল প্রায় বছরখানেক ধরে। তারমধ্যে বার দুয়েক এসেছিল দার্জিলিং। একমাত্র কাছের এই শৈল শহরটাই তখন ওকে একান্তে একটু শান্তি দিতে পারত। তাই দার্জিলিং ওর ভীষণ রকমের আপন।
ইদানীং কলকাতায় একটা দু-কামরার ফ্ল্যাট ভাড়া করে থাকে পৌষালী। বাবা-মা বা আর সকলের সঙ্গে নামেমাত্র সম্পর্কটুকু আছে। কারণ ডিভোর্সির তকমা পাওয়ায় ওর কাছ থেকে সেই আগের গুড গার্লের লকেটটা সকলেই কেড়ে নিয়েছে। ও নিজেও অবশ্য আর ওই লকেটটা নিয়ে আগ্রহী নয়। বড্ড ভারী ছিল ওই লকেটের ভারটা।
তাই গুডগার্লের তথাকথিত তকমা ছেড়ে বেরিয়ে প্রথম প্রথম বেশ কষ্টই হচ্ছিল। তারপর পৌষালী সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, ওকে পারতেই হবে। ডিপ্রেশনের জন্য ওষুধ খেতে হচ্ছে ওকে এখনও। প্রায় বছরখানেক হয়ে গেল ও একদম একা। একাকীত্ব কাটাতেই ও মাঝে মাঝেই আশ্রয় খোঁজে পাহাড়ের কোলে। মহাশ্বেতা বলেছিল, দার্জিলিংয়ে যখন তোর কিছুটা খারাপ স্মৃতি আছে, তখন কেন দার্জিলিংয়ে যাস তুই? পৌষালী অন্যমনস্কভাবে বলেছিল, অনেকটা দুঃখের মাঝে সুখ পাওয়ার তৃপ্তির জন্য। খারাপ স্মৃতিগুলোকে ভুলে নয় ওগুলোকে সঙ্গে নিয়ে আনন্দে থাকতে চাই আমি, তাই দার্জিলিংয়ে যাই।
কাঠের বেঞ্চে বসে ভুট্টা খাওয়ার আবদার করেছিল অপূর্বর কাছে। সামনে একটা মেয়ে ভুট্টা নিয়ে ঘুরছিল। আজ আর খেতে ইচ্ছে করল না পৌষালীর। পাশের বেঞ্চে দুজন বয়স্ক স্বামী-স্ত্রী বসে নিজেদের মধ্যে কথা বলছিল। অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল পৌষালী। সম্পর্কের বয়েস বেড়েছে, ভদ্রমহিলার গালে বলিরেখার আধিক্য, তবুও ওদের সম্পর্কে তেমন বলিরেখা দেখতে পেল না ও। বেশ সাবলীল। কিন্তু মাত্র কয়েকদিনেই নড়বড়ে হয়ে গিয়েছিল ওদের সম্পর্কের ভীতটা।
সন্ধে নামছে পাহাড়ের কোলে। সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বলে উঠবে এখুনি। ওর ঠিক কানের কাছে ফিসফিস করে কেউ বলে উঠল, চা খাবেন না ম্যাডাম?
আনমনা পৌষালী চমকে উঠে তাকিয়ে দেখল, মিতাস দাঁড়িয়ে আছে ঠিক ওর পিছনে। একটু সন্দেহ হল ওর। বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করল, তুমি কি আমায় ফলো করছ? মিতাস কানে হাত দিয়ে বলল, রাম রাম। কখনোই নয়। আমি একটু খেয়াল রাখছি আপনার। যেহেতু আপনি আমাকে গাইড করেছেন তাই।
কখনো কখনো আচমকা অন্ধকার অনেকটা একাকীত্বকে সঙ্গে করে নিয়ে আসে। এখনও দার্জিলিংয়ের আকাশের নিস্তব্ধতা যেন গিলে খেতে আসছিল জোর করে কাঠিন্যের আবরণে ঢুকিয়ে রাখা পৌষালীর আহত মনটাকে। সেইসময় মিতাসকে দেখে বিরক্ত হলেও বিরক্তিটা দীর্ঘস্থায়ী হল না পৌষালীর মনে। ধীর গলায় বলল, তুমি চা খাবে? এই নাও টাকা, যাও দুটো চা নিয়ে এসো।
মিতাসের চোখ দুটোতে আন্তরিকতার ছোঁয়া।
মাথার টুপিটা টেনে নিয়ে ও চলল চা আনতে।
চা নিয়ে আসতেই পৌষালী বলল, বসো মিতাস। মিতাস একটু চমকে বলল, আপনার পাশে? আমি দাঁড়াচ্ছি। পৌষালী হেসে বলল, এখানেই বসো, এ যাত্রায় তোমায় ফাঁকি দেব এমন হিম্মত আমার নেই। মিতাস বসে পড়ল একটু দূরত্ব রেখে।
পৌষালী বলল, তোমার বাড়িতে কে কে আছে মিতাস?
মিতাস গরম চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, আমার মা আর আমার মেয়ে আছে। পৌষালী চমকে উঠে বলল, কত বয়েস তোমার? বিয়ে হয়ে গেছে? মেয়েও আছে?
মিতাস মাথা চুলকে বলল, হ্যাঁ ম্যাডাম।
পৌষালী বলল, তোমার বউ নেই? মিতাস বলল, আছে তো। ভালোবেসে কম বয়সেই বিয়ে করেছিলাম। তাই আমার মেয়ের বয়েস দুই। মিতাস কথাটা এড়িয়ে গিয়ে বলল, কাল ভোরে তাহলে আমরা টাইগার হিলে যাই ম্যাডাম? ভোর তিনটেতে ডেকে দেব আপনাকে, ঘুম ভাঙবে তো আপনার? পৌষালী দেখল, ওর চোখে একটুকরো কষ্ট। সেটা ঠিক কিসের বুঝতে পারল না। ছেলেটা খুব দ্রুত যন্ত্রণা লুকাতে শিখে গেছে।
ভোরে উঠে গাড়িতে চেপে রওনা দিয়েছিল টাইগার হিল। এর আগেও বার দুই এসেছে টাইগার হিলের পথে, কিন্তু এবারে যেন যাত্রাটা বেশি যত্নের। পৌষালী ভাবতেই পারছে না, মাত্র কয়েকটা টাকার বিনিময়ে এত যত্ন কেনা যায়। মিতাস একটা বড় ফ্লাক্সে করে চা নিয়ে এসেছে। বান আর চা ধরিয়ে দিয়ে বলল, খেয়ে নিন ম্যাডাম। খিদে পেয়েছে মনে হচ্ছে আপনার মুখ দেখে। পৌষালীর মনে পড়ে গেল, অফিস থেকে ফেরার পরে এক কাপ চাও ওকে নিজেকেই বানিয়ে খেতে হত।
মিতাস পরমযত্নে চায়ের কাপটা এগিয়ে দিল। সূর্যোদয়ের মুহূর্তে মিতাস প্রায় চিৎকার করে বলল, ম্যাডাম, ওই দেখুন।
ছেলেটার সঙ্গ পৌষালীকে একটা অন্যরকম আনন্দ দিচ্ছে। অশিক্ষিত, আনস্মার্ট, কার্টসি জানে না, তবুও ওর সরলতা ভীষণ নজর টানে।
ম্যালের এককোণে বসে দার্জিলিং ভ্রমণ শেষ করবে ভেবেছিল পৌষালী। একাকীত্ব যখন ওকে ক্রমশ গ্রাস করবে তখন ও নতুন করে যুদ্ধ করবে।
নিজের পরিবারই যখন ওর যন্ত্রণাটুকু বুঝল না তখন আর বাইরের মানুষদের কাছ থেকে কি আশা করা যায়! সংসার করতে পারল না মানেই ও বাচাল মেয়ে। অদ্ভুত এই সমাজ। কী সুন্দরভাবে ওর গুণের সব বিচার করে দিল ওর ম্যারিটাল স্ট্যাটাস দেখে! ওপক্ষের কোনো দোষ যেন থাকতেই নেই।
ম্যাডাম, গাড়ি থেকে নেমে আসুন।
চমকে উঠে তাকিয়ে দেখল, পথের একটা বাঁকে দাঁড়িয়ে আছে গাড়িটা। আর মিতাস অফুরন্ত আগ্রহে ওকে ডাকছে। এই ছেলেটা ওর সযত্নে সাজানো একাকীত্বকে মোটেই ধারে কাছে আসতে দিচ্ছে না দেখে নিজের মনেই হেসে ফেলল পৌষালী। মনের হাসির রেখা কী ঠোঁটের কোণে প্রতিফলিত হয়? কে জানে! মিতাস ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি হাসেন না কেন ম্যাডাম, হাসলে আপনাকে ভারী মিষ্টি লাগে। আপনার চোখ দুটোও বড্ড সুন্দর। ঠিক দার্জিলিংয়ের আকাশের মতোই, এই রোদ এই মেঘলা।
বহুবছর পরে কারোর কাছ থেকে এভাবে নিজের রূপের প্রশংসা শুনতে বেশ অস্বস্তি হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল অপূর্বর মতো মিথ্যে বলছে না তো! অপূর্বও বলত, তোমার হাসিটা দেখলে মনে ভালো হয়ে যায়। আবার আত্মীয়দের মুখে শুনেছিল, পৌষালীকে তো অপূর্বর পছন্দই ছিল না। নেহাত বাবা-মা জোর করেছিল বলেই বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছিল। সবকিছু বড্ড ওলটপালট হয়ে যায় পৌষালীর।
ম্যাডাম, এই যে আপনি এখন হারানো পথের পথিক। একমাত্র এই গাইডই আপনাকে আবার পৌঁছে দিতে পারে হোটেলে।
উঁচুনিচু রুক্ষ পথে চলতে চলতে কখন যে একটা অজানা গ্রামে ঢুকে পড়েছে পৌষালী তা খেয়ালই করেনি। সামনেই একটা ছোট্ট পাথরের মন্দির। মন্দিরের গা ঘেঁষে ঝরনার জল অনবরত নিজের উপস্থিতি জানান দিতে স্বশব্দে নীচের দিকে এগিয়ে চলেছে।
জায়গাটা অদ্ভুত রকমের শান্ত। গ্রামের দু-একজন বাসিন্দা রংবেরঙের পতাকা মন্দিরের ধারের গাছে বেঁধে মানত করছে। ইচ্ছেপূরণ করার আবদার জানাচ্ছে ঈশ্বরের কাছে। কোনো কোলাহল নেই।
মিতাস ফিসফিস করে বলল, কী ম্যাডাম, এই গাইড আপনাকে একটা নতুন জায়গায় এনে পথ হারিয়ে দিতে পারল কী?
পৌষালী বলল, বড্ড ভালো জায়গাটা। অশান্ত মনকেও নিজের বশে নিয়ে আসবে। কী নাম এই জায়গাটার?
মিতাস বলল, পূজন। তবে এটা কোনো নামকরা জায়গা নয়। নেহাতই ছোট জনপদ।
মন্দিরের সিঁড়িতে বসে পৌষালী বলল, ওই গাছে নানা রঙের পতাকা কেন বাঁধছে লোকে মিতাস?
মিতাস তুরতুর করে বয়ে যাওয়া ঝরনার দিকে তাকিয়ে বলল, এই গ্রামের বাসিন্দারা বিশ্বাস করে, এখানে মানত করলে নাকি হারিয়ে যাওয়া ভালোবাসা ফেরত পাওয়া যায়।
পৌষালী বলল, সত্যি? এমন হয়?
মিতাস বলল, ম্যাডাম, যে একবার হারিয়ে গেছে স্বেচ্ছায়, তাকে জোর করে বেঁধে রাখা কী উচিত?
এভাবে ভালোবাসা ভিক্ষা করে কী আদৌ কিছু পাওয়া যায়! ভালোবাসা তো দু-তরফ থেকেই হওয়া উচিত। পৌষালী বলল, তার মানে তুমি বিশ্বাস করো না তাই তো?
মিতাস হেসে বলল, ভালোবাসা ভিক্ষা করতে শরমে লাগে, সে ঈশ্বরের কাছে হলেও।
পৌষালী গ্রামের অশিক্ষিত ছেলেটার জীবনদর্শন যত দেখছে ততই আশ্চর্য হচ্ছে।
সারাদিন দুজনে টোটো করে ঘুরে হোটেলে যখন ফিরল তখন হোটেলের ম্যানেজারের কাছ থেকে একটু হলেও বকা খেতে হল মিতাসকে। যতই কম বোর্ডার থাকুক, এতক্ষণ সময় নষ্ট করলে ম্যানেজার তো বকবেই।
মিতাস মাথা চুলকে বলল, বেশ আমার দু-দিনের মাইনে কেটে নেবেন।
মাথাটা অকারণেই চুলকে বিষয়টাকে হালকা করে দিল মিতাস।
পৌষালী ঘরে ঢুকতেই মিতাস এসে হাজির। টিভিতে একটা হিন্দি সিনেমা চালিয়ে দিয়ে বলল, ম্যাডাম এটা দেখুন। ব্যাপক মারপিট করেছে সালমান খান।
আর ম্যাডাম, আপনার যদি কোনো দরকার হয় আমাকে ফোন করবেন আমি চলে আসব।
ছেলেটা যেন পণ করেছে অবসাদকে কিছুতেই ঘেঁষতে দেবে না ওর কাছে। পৌষালীর ভারী মজা লাগছিল ওর এই উপযাচিত যত্নগুলো।
ড্রেস চেঞ্জ করে ও বিছানায় বসল। ব্যাগ থেকে বের করল, You Can Win বইটা। এটা পড়লে নাকি ওর ডিপ্রেশন কেটে যাবে। এমনই বলেছেন একজন কলিগ।
টিভির দিকে চোখ চলে গেল পৌষালীর। টিভিতে অযৌক্তিক গল্পের প্লট, অকারণে মারপিট দেখতে দেখতে হেসে ফেলল পৌষালী। মিতাসের বলা কথাটা শুনে, ম্যাডাম, ভাইজান যা মেরেছে না এই মুভিতে। মানুষ কত অল্পে সন্তুষ্ট হয়ে যায়। ছোট ছোট জিনিসগুলো থেকে কী সুন্দর ভালোলাগা খুঁজে নেয়। সেই গল্পে যুক্তি আছে কিনা দেখে না। সেটা দেখে ওর কী লাভ হবে ভাবে না। বেশি ভাবে না বলেই হয়তো ওদের জীবনগুলো পৌষালীর মতো জটিল হয়ে যায় না।
ভোর ভোর এসে দরজায় টোকা দিচ্ছে মিতাস। দরজা খুলতেই বলল, ঘুম ভালো হয়েছিল? চলুন রেডি হয়ে নিন। আজ আপনাকে আবার হারিয়ে দেব পাহাড়ি রাস্তায়। ঘুম ভেঙে মিতাসের ডাকে জীবনটা যেন হঠাৎ করেই কেমন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেল। নিত্যনৈমিত্তিক অফিস যাওয়া, অফিসের কাজ, কাস্টমার সামলানো, কেজো কথা। বাড়ির সকলকে নিয়ম করে ফোনে বলা, পৌষালী খুব ভালো আছে…বড্ড ক্লান্ত লাগে ইদানীং।
কেউ একজন এতটা মনে রেখেছে ওকে ভেবেই যেন চনমনে হয়ে গেল শীতের সকালটা।
তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়ল পৌষালী।
মিতাস একটু গম্ভীর ভাবে ওর দিকে তাকিয়ে বলল, হু, আজ মনে হচ্ছে দার্জিলিংয়ের আকাশ চনমনে রোদে ভরা। পৌষালী লাজুক গলায় বলল, এভাবে প্রশংসা করাটাও কী গাইডের কাজ?
মিতাস হো হো করে হেসে বলল, কাস্টমারের মন ভালো রাখাটা গাইডের কাজ। তার মনের খবর যদি না রাখতে পারে তাহলে অজানা পাহাড়কে চেনাবে কী করে! সত্যিই পৌষালীর আজ দুর্দান্ত মুড আছে। লাস্ট কবে ও এত কথা বলেছে প্রয়োজনের অতিরিক্ত ও মনে করতে পারছে না। তবে আজ ফুরফুরে লাগছে নিজেকে। বুকের বাঁ দিকে ভারী জমাট কষ্টটা অনেকটা হালকা হয়েছে যেন।
মিতাস বলল, চলুন ম্যাডাম, ওই পাহাড়ের চূড়ায় উঠব আজ। পারবেন? নাকি পায়ে ব্যথা করবে আপনার?
পৌষালী কপট রাগে বলল, তোমার কী আমাকে ন্যাকা ন্যাকা মেয়ে মনে হয়? আমি যথেষ্ট স্ট্রং। চলো….
নাম না জানা ন্যাড়া একটা পাহাড়ের চূড়ায় উঠল ওরা। মিতাস ওর হাত ছাড়েনি একবারও। ওকে হাত ধরে নিয়ে গিয়েছিল ওই পাহাড়ের চূড়ায়। বলল, নীচের দিকে তাকিয়ে দেখুন, গোটা শহর আপনাকে প্রণাম করছে।
সত্যিই পাহাড়টার ওপর থেকে গোটা দার্জিলিংকে যেন ছবির মতো লাগছে। চা-বাগানের পাশ দিয়ে সরু রাস্তা বেয়ে অনেকটা উঠতে হয়েছে ওদের।
ঝরনাগুলোকে সাদা সুতোর মতো লাগছে। এই শীতেও ঘামছে পৌষালী।
ব্যাগ থেকে একটা তোয়ালে বের করে পেতে দিয়ে বলল, ম্যাডাম বসুন এখানে।
পৌষালী বসে পড়ল। এখান থেকে যদি একটা ঝাঁপ দেওয়া যায় তাহলেই সংসার করতে পারলি না, মানিয়ে নিতে পারলি না, ডিভোর্সি এসব তকমাগুলোর থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে যাবে ও। ভুলে যাবে অপূর্বর বলা হাজার হাজার মিথ্যে বঞ্চনাগুলো, মিথ্যে প্রতিশ্রুতিগুলোর ভারটাও কমে যাবে।
মিতাস বলল, ম্যাডাম একটা কথা বলব? আপনি কি কালই ব্যাক করবেন? অন্য ঘরগুলো তো ফাঁকা পড়ে আছে ওই হোটেলের। আপনি খুঁজে খুঁজে ওই ঘরটাই কেন পছন্দ করলেন? ওটা চেঞ্জ করে নিন না প্লিজ।
পৌষালী অদ্ভুত গলায় বলল, কিন্তু কেন? ওই ঘরটা তো যথেষ্ট ভালো। কী সুন্দর নরম আলোয় ঘুম ভাঙে। রাতে শুয়ে শুয়ে পাহাড়ের কোলের প্রদীপ জ্বালা দেখা যায়। অসুবিধা কী আছে?
মিতাস ওর অভ্যস্ত ভঙ্গিমায় মাথাটা চুলকে নিয়ে বলল, ওটা বড্ড বাজে ঘর। আপনি প্লিজ আজকে গিয়ে ঘরটা চেঞ্জ করে নিন। আমার না হলে ঘুম আসছে না।
পৌষালী বলল, বললে না তো কী আছে ওই ঘরে?
মিতাস উদাস সুরে বলল, ওই ঘরে থাকাকালীন একজন সুইসাইড করেছিল ম্যাডাম। গত বছরের ঘটনা। না ওই ঘরে করেনি, পাহাড় থেকে ঝাঁপ দিয়েছিল। তাই আমি চাই না আপনিও ওই ঘরে থাকুন।
পৌষালী চমকে উঠে বলল, তাই নাকি? তুমি চিনতে তাকে? মিতাস বলল, হ্যাঁ ম্যাডাম চিনতাম। আমিই তো তাকে দার্জিলিং চিনিয়েছিলাম। মনীষা দিদিমণি। খুব ভালো মেয়ে। এই আপনার মতোই সব মানুষকে সমান গুরুত্ব দেয়। আগের দিনেও আমি বুঝতে পারিনি দিদিমণির মনের মধ্যে ওই আছে। ভোরে ডাকতে গিয়ে দেখি দিদিমণি ঘরে নেই। বুঝতে পারলাম বেরিয়ে গেছে। আমাদের একসঙ্গে চা-বাগানে ঘোরার কথা ছিল। একটু বেলার দিকে পুলিশ এল হোটেলে। জানতে পারলাম মনীষা দিদিমণি আত্মহত্যা করেছে। পুলিশ আমাকেও অনেক জেরা করল। তারপর জানা গেল দিদিমণির সঙ্গে তার পরিবারের অশান্তির জেরেই এমন ঘটাল। আমি কয়েকদিন ঘুমাতে পারিনি। দিদিমণির পরিবারের সকলেই নাকি দিদিমণিকে তাড়িয়ে দিয়েছিল। দিদিমণির গায়ে শ্বেতীর চিহ্ন হবার জন্য।
আমাকে আগের দিন রাতেই সব টাকা মিটিয়ে দিয়েছিল। আমি বললাম, কালকে তো ঘুরতে যাব তাহলে? দিদিমণি হেসে বলেছিল, মিতাস ঋণ বড় বাজে জিনিস।
তখন যদি বুঝতাম তাহলে কিছুতেই টাকা নিতাম না আগের দিন।
ছলছল করছিল মিতাসের চোখ দুটো।
পৌষালী বলল, আমার কাছে কত টাকা নেবে বলো? তুমি সত্যিই আমায় চ্যালেঞ্জ করে হারিয়েছ। দার্জিলিংয়ে ঘোরার স্পটের বাইরেও এমন সব জায়গা আছে আমি জানতামই না। মিতাস বলল, যাবার দিন নেব।
পৌষালী বলল, আচ্ছা মিতাস আত্মহত্যা মানুষ কেন করে?
মিতাস রাগত স্বরে বলল, যাদের লড়াই করার ক্ষমতা নেই তারা করে। পাহাড়ের অন্য বাঁকে যে তার জন্য ভালো কিছু অপেক্ষা করে আছে সেটা না দেখেই চলে যায়। বোকা লোকজন সব। পৌষালী বলল, তুমি বুঝবে না মিতাস। জীবনে যারা প্রকৃত আঘাত পেয়েছে তারাই বোঝে এর কষ্ট। তাদের জীবনটা বয়ে বেড়াতে সত্যিই খুব কষ্ট হয় মিতাস।
একপক্ষ ঠকিয়ে গেছে দিনের পর দিন ভালোমানুষ সেজে আরেকজন ঠকে গেছে…. এর যন্ত্রণা যে পেয়েছে সেই বোঝে।
মিতাস বলল, ওই দেখুন ম্যাডাম, বকতে বকতে আসল কথাটাই আপনাকে জিজ্ঞেস করতে ভুলে গেছি। আপনার ফেরার টিকিট কবের?
পৌষালী হেসে বলল, কেন তাড়িয়ে দিতে চাইছো? ভাবছি তোমাদের এখানেই একটা বাড়ি কিনে রয়ে যাব। কেমন হবে? তুমি আর আমি সারা দার্জিলিং ঘুরে বেড়াব।
মিতাস লাজুক হেসে বলল, ম্যাডাম আমার খুব শখ বড় একজন টুরিস্ট গাইড হবার। আমি কি পারব ম্যাডাম?
পৌষালী বলল, অবশ্যই পারবে। আমি তো নেক্সট ইয়ারে দার্জিলিং এসেও মিতাস দোলুইকেই খুঁজব আমার গাইড হিসেবে।
মিতাস লজ্জা পেয়ে বলল, চলুন ম্যাডাম এবারে নামতে হবে।
পৌষালীর মন থেকে এত উঁচু থেকে ঝাঁপানোর ইচ্ছেটা কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। মনে মনে ভাবছিল, মিতাসের চোখে নিজেকে হেরো প্রমাণ করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে ওর নেই।
পরের দিন ম্যালে বসে আর রকমারি দোকানে ঘুরে কৈলাশনাথের মন্দিরে পুজো দিয়েই কাটিয়ে দিল পৌষালী। মিতাস বার দুয়েক এসে বকবক করে গেছে ওর সঙ্গে।
পরের দিন সন্ধেতে ট্রেন। পৌষালী দোকান থেকে মিতাসকে লুকিয়ে ওর মেয়ের জন্য দুটো সোয়েটার কিনল। বছর দুয়েকের মেয়ে বলেই মাপ দিলো দোকানে। কালকে ওর গাইডের জন্য ফি ছাড়াও একটু বেশি করেই টাকা দিয়ে দেবে পৌষালী। ওর জন্যই এবারের দার্জিলিং এত রঙিন হল ওর কাছে। বিষণ্ণতা বিরস বদনে পিছু হটল ওর এবারের ট্যুর থেকে। এর মূল্য কী আর টাকায় মেটানো সম্ভব!
ভোর থেকে সকল দশটা বেজে গেল তবুও মিতাস এল না। ম্যানেজারের কাছে খোঁজ করলে সে একটু বিরক্ত মুখে ওর অ্যাড্রেস দিল। বার তিনেক ফোন করেছে পৌষালী, ফোন সুইচড অফ বলছে।
বাধ্য হয়ে মিতাসের খোঁজে বেরুলো ও। প্রায় হাফ কিলোমিটার হেঁটে পৌঁছাল মিতাসের গ্রামে। গ্রামে বললে একটু ভুল হবে। গোটা কয়েক বাড়ি এলোমেলো ছড়িয়ে আছে। কোন বাড়িটা মিতাসের সেটাই তো বোঝা যাচ্ছে না। একজন মহিলাকে দেখতে পেয়ে পৌষালী জিজ্ঞেস করল, মিতাসকে চেনেন? সে হিন্দিতে উত্তর দিল, কে মিতাস?
মোবাইলে তোলা ওর আর মিতাসের ছবি দেখিয়ে পৌষালী বলল, এটা? মহিলা বেশ সন্দেহের চোখে তাকিয়ে বলল, কলকাতায় থাকেন?
পৌষালী হ্যাঁ বলতেই, মহিলা বেশ চিৎকার করে কিছু একটা বলতে শুরু করল।
ঘর থেকে মিতাস বেরিয়ে এসে হকচকিয়ে বলল, এটা নতুন দিদিমণি। খুব ভালো, বাচ্চা চোর নয়। পৌষালী কিছুতেই বুঝতে পারছিল না ওকে কেন বাচ্চা চোর মনে হল ভদ্রমহিলার।
মিতাস ওদের ছোট্ট ঘরে নিয়ে গিয়ে বসাল।
পৌষালী বলল, ফোন অফ কেন তোমার? আর হোটেলে যাওনি কেন আজ?
মিতাস নরম সুরে বলল, ম্যাডাম আমার মেয়ের কাল রাত থেকে জ্বর হয়েছে। তাই সারা রাত জেগে ছিলাম। ভোরে ও আর আমি দুজনেই একটু ঘুমিয়েছি।
ফোনটা অন করতেও ভুলে গেছি। পৌষালী বলল, তোমার স্ত্রী কোথায়? একটা বাচ্চা মেয়ে বিছানায় বসে খেলনা নিয়ে খেলছে। চোখ দুটো হালকা লাল। বোধহয় ঠান্ডা লেগেছে।
মিতাস আমতা আমতা করে বলল, আমার স্ত্রী একটু বাপের বাড়ি গেছে।
পৌষালী অবাক হয়ে বলল, এইটুকু একটা বাচ্চাকে রেখে দিয়ে বাপের বাড়ি গেছে? মিতাস বলল, না ও যেতে চায় না, আমিই জোর করে পাঠিয়েছিলাম দু-দিনের জন্য।
ঠিক সেই সময় মিতাসের মা বকবক করতে করতে ঘরে ঢুকে বলল, কে এসেছে রে? শহরের কেউ? মেয়েটাকে নিতে এসেছে নাকি? কেউ জেনে গেল নাকি রে? মেয়েটা আমাদের ঘরে আছে?
পৌষালীর দিকে চোখ পড়তেই সামলে নিয়ে বলল, এটা কে রে মিতু?
মিতাস মাকে ইশারায় বাইরে যেতে বলল।
তারপর করুণ গলায় বলল, ম্যাডাম আমাকে ক্ষমা করবেন আমি আপনাকে কয়েকটা মিথ্যে বলেছি।
পৌষালী চমকে উঠল। আবার মিথ্যে! চারিপাশে কী শুধু অপূর্বদেরই বাস? এই পাহাড়ের কোলের সরল বাতাসেও এত জটিলতার গন্ধ!
পৌষালী কিছু বলার আগেই মিতাস বলল, মণিদীপা আমার মেয়ে নয়। আমার বিয়ে হয়নি।
ও মনীষা দিদিমণির মেয়ে। এক বছর বয়সের মেয়েটাকে ঘরে রেখেই দিদিমণি আত্মহত্যা করেছিল। হোটেলে কেউ কোনো খবর পাওয়ার আগেই আমি ঘরে ঢুকে দেখেছিলাম, মেয়েটা একলা ঘুম ভেঙে কাঁদছে। আমি মেয়েটাকে তোয়ালেতে জড়িয়ে নিয়ে চলে আসি। তখন রিসেপশনেও কেউ ছিল না। ভোরের আলো সবে ফুটেছে। গেটম্যানও বুঝতে পারেনি আমার কোলে কী আছে।
বেলায় যখন খবর পেলাম দিদিমণি আত্মহত্যা করেছে তখন মেয়েটাকে ফেরত দেব ভেবেই গিয়েছিলাম। কিন্তু দেখলাম, ওনার স্বামী আর বাকিরা ভেবেই নিয়েছিল, মেয়েটাকে নিয়েই মনীষা দিদিমণি মারা গেছেন। ভেবে দেখলাম, দিদিমণি নিশ্চয়ই ওদের কাছে মেয়েটাকে রেখে আসতে চাননি। আবার মেয়েটাকে মেরে ফেলতেও পারেননি। তাই সেদিন থেকে আমিই হয়ে গেলাম ওর বাবা। ওর মা নেই শুনে লোকে করুণার চোখে ওর দিকে তাকাক আমি চাই না। তাই অপরিচিতদের সকলকেই বলি, আমি বিবাহিত।
একমাত্র আমার পাড়ার এই গোটা পাঁচেক ঘরের মানুষ জানে আসল ঘটনাটা। তাই ওরা শহরের কাউকে দেখলেই চেঁচায়।
ওরা সকলে মণিকে নিজেদের মেয়ের মতো ভালোবাসে। সকলে আগলে রাখে। ওকে হয়তো আমি আপনাদের ঘরের মতো করে মানুষ করতে পারছি না, কিন্তু তবুও চেষ্টা করছি ওকে আদরে রাখতে। ম্যাডাম, আমায় ক্ষমা করবেন, আমি মিথ্যে বলেছি আপনাকে।
পৌষালীর চোখে জল। মেয়েটার জন্য আনা সোয়েটারগুলো ওর হাতে ধরিয়ে দেবার সময় বেশ কিছু টাকা মিতাসের হাতে দিয়ে পৌষালী বলল, এটা গাইডের ফিজ নয়। এটা মণিদীপার জন্য ওর মাসিমণির গিফট।
মিতাস, আমি এতদিন জানতাম মিথ্যে বড্ড ঘৃণার বস্তু। সব কেড়ে নেয়। আজ জানলাম, কিছু মিথ্যে ভীষণরকমের মিষ্টি হয়। সত্যির থেকেও বেশি উজ্জ্বল হয়।
নেক্সটবার দার্জিলিংয়ে এসে আমি যেন মিতাস দোলুইকেই গাইড হিসেবে পাই।
মণিদীপার জন্য তার মাসিমণি যদি কিছু পাঠায় তুমি কী রাগ করবে মিতাস?
মিতাস হাত জোড় করে বলল, ম্যাডাম, আমি ওকে নিজের রোজগারে মানুষ করতে চাই।
পৌষালী হেসে বলল, বেশ তাই হবে। মণিদীপার দিকে করুণার দৃষ্টিতে কে তাকাবে মিতাস? আমার তো ওকে হিংসে হচ্ছে, ও এমন বাবা পেয়েছে বলে।
মিতাসের মুখে টাইগার হিলের সূর্যোদয়ের খুশি।
পৌষালী নেমে এল। নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে বসে ওর একটাই কথা মনে হল, ভাগ্যিস ও নিজেকে শেষ করে দেয়নি, তাই তো এমন একজনের সঙ্গে আলাপ হল ওর। জীবনটা বড্ড সুন্দর। শুধু একটু অপেক্ষা করতে হয় ভালোগুলো দেখার জন্য।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন