গেম ইজ ওভার – অর্পিতা সরকার

অর্পিতা সরকার

একটু হন্তদন্ত হয়েই ঢুকলেন সর্বাণীদেবী, চোখে আগুন দৃষ্টি। চেম্বারের বাইরে বহু পেশেন্ট এখনও বসে আছে। তাদের সামনে নিজের সম্মানটুকু বাঁচবে কিনা সেই নিয়ে বেশ চিন্তিত হয়ে পড়লেন ডক্টর শুভাশিস তরফদার। শুভাশিস তরফদার এ তল্লাটে নাম করা অর্থপেডিক সার্জেন। তাই সপ্তাহের তিনদিন নির্দিষ্ট সময়ে চেম্বারের বাইরেও লাইন থাকে। বিকেল চারটে থেকে সন্ধে সাতটা পর্যন্ত টাইম, যদিও রাত নটার সময়েও ডাক্তারবাবুকে রোগী দেখতে দেখা যায়। কী করবেন, বাইরে অপেক্ষারত রোগীকে তো আর বলতে পারেন না, আজ আর দেখব না! যন্ত্রণাকাতর মুখগুলো দেখে বাধ্য হন নেক্সট বলে হাঁক পাড়তে।

এ নিয়ে বিয়ের পর থেকে সর্বাণীর সঙ্গে খণ্ডযুদ্ধ বেঁধেছে। যদিও তখন শুভাশিসের এতটা পসার ছিল না, তবুও ঘড়ির কাঁটা রাত দশটা ক্রস করলেই সর্বাণীর নির্দেশমতো বাড়ির সদর বন্ধ করে দিত সিকিউরিটি। সর্বাণী হল লেট ডিএসপি প্রতাপ বসুর মেয়ে। তাই মেজাজটাও বাবার মতোই পেয়েছে। শুভাশিস অবশ্য যখন মায়ের সঙ্গে মেয়ে দেখতে গিয়েছিল, তখন সর্বাণীর মুখ দেখে বুঝতেই পারেনি ও পুলিশ কমিশনারের আরেকধাপ ওপরে বসবাস করে। নরমসরম মুখের সর্বাণীকে এক দেখাতেই পছন্দ হয়েছিল সদ্য পাশ করা ডাক্তারের। বিয়ের পর বছরখানেক পর্যন্ত সর্বাণী খুব ধীরে ধীরেই কথা বলত, আদরে আদরে ভরিয়ে রেখেছিল শুভাশিসকে। তারপর যত শুভাশিসের পসার বেড়েছে, সময় কমেছে, তত সর্বাণীর মেজাজ বেড়েছে। রিয়ান হবার পর থেকেই সর্বাণীর মেজাজ সপ্তমে বাঁধা থাকে। আর মুডের খবর তো আলিপুর আবহাওয়া দপ্তরের রিখটার স্কেলেও মাপা সম্ভব নয়। এত দোষের মধ্যে একখানি গুণের জন্যই শুভাশিস সবটুকু মাথা পেতে নিয়েছিল, সেটা হল সর্বাণীর অকপট সত্য কথা আর মায়া-দয়া। শুভাশিস যদি একবার বলত, সর্বাণী আমি জানি আমি তোমায় কম সময় দিই বলে তুমি রেগে থাকো, কিন্তু একটিবার ভেবে দেখো নার্সিং হোমের বেডে কিংবা চেম্বারে বসে থাকা রোগীগুলোর যন্ত্রণাকাতর মুখগুলো, তাহলে নিশ্চয়ই তুমি আমায় দোষারোপ করবে না। সর্বাণীর মেজাজ শিথিল হত আর ওর রাগের এই শিথিলতার সুযোগ নিয়েই এতদিন চেম্বার থেকে বাড়ির দরজা খুলে ঢুকতে পেরেছে শুভাশিস। সিকিউরিটি মাধবও হয়েছে সর্বাণীর কেনা গোলাম, ও যতক্ষণ না বলবে ততক্ষণ কিছুতেই গেট খুলবে না মাধব। ও ব্যাটাও বুঝে গেছে তরফদার বাড়ির আসল মালিক কে! তাই সর্বাণীর কথা মতোই সবাই চলে। এই বুড়ো বয়েসে এসেও সর্বাণীর মেজাজটা কমেনি বরং বেড়েছে। আগের মায়া মমতাও ইদানীং বিদায় নিয়েছে ওর শরীর থেকে। এখন অবশিষ্ট হিসাবে পড়ে আছে একরাশ রাগের অভিব্যক্তি।

রিয়ান চাকরি পাওয়ার পর থেকেই সর্বাণী যেন ধরাকে সরা জ্ঞান করছে। রিয়ান যেন সর্বাণীর একার ছেলে। শুভাশিসের কেউ নয়! ছেলেকে মেডিকেল পড়তে দেয়নি সর্বাণী। বলেছে, হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি এক ডাক্তারের পাল্লায় পড়ে, আর নয়। ছেলে আমার ইঞ্জিনিয়ার হবে। মায়ের বাধ্য সন্তান রিয়ান ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে বেশ ভালো কোম্পানিতেই জয়েন করেছে। ছেলেকে নিয়ে সর্বাণীর গর্বের শেষ নেই। কারণ রিয়ানকে দেখতে একেবারে সর্বাণীর মতো। মায়ের মতো সুন্দর দেখতে হয়েছে রিয়ান। বাবার মতো সো সো দেখতে নয়, রীতিমতো মেয়েদের রাতের ঘুম কেড়ে নেওয়া চেহারা। সেই জন্য অবশ্য মায়েরও রাতের ঘুম নেই। তার দিনরাতই মনে হয়, এই বুঝি ছেলে কারোর পাল্লায় পড়ল। রিয়ান রীতিমতো অস্থির হয়ে পড়েছে মায়ের এই অতি সচেতনতায়। স্কুল লাইফ থেকে কোনো মেয়েবন্ধুকে ওর ধারে কাছেও ঘেঁষতে দেয়নি সর্বাণী। বেচারা জীবনে একটা প্রেম অবধি করে উঠতে পারেনি মায়ের অত্যাচারে। এখন সর্বাণী একের পর এক মেয়ে দেখছে আর বাতিল করছে। কোনো মেয়েই নাকি তার ছেলের উপযুক্ত নয়। শুভাশিস দু-চারটে কথা বলতে গিয়েছিল, কিন্তু এমনভাবে ওকে থামিয়ে দেওয়া হয়েছে যেন বিয়ে নামক জিনিসটা ওর করাই উচিত হয়নি, তাই সেই ব্যাপারে সামান্য কথা বলার ক্ষমতাটুকুও ওর নেই। বাধ্য হয়ে থেমে গিয়েছিল শুভাশিস। রিয়ান অসহায় চোখে তাকিয়ে বলেছিল, মা আমার মনে হয়, আমার বিয়ে দেওয়ার দরকার নেই, এমনিতেই আমি আর বাবা ছাড়া কেউ এ বাড়িতে টিকবে না। তাই ডিভোর্সি তকমা নিয়েই আমায় ঘুরতে হবে, তার থেকে বরং ব্যাচেলর মাচ বেটার। মা একটু অবাক হওয়ার ভান করে বলছে, কথাটা তুই নেহাত মন্দ বলিসনি, এমন শ্বশুর দেখলে কে আর বিয়ে করতে চাইবে বল? দিনরাত গা থেকে ওষুধ ওষুধ গন্ধ বেরোচ্ছে, বাড়িটা যেন নার্সিং হোম। আমি বলেই আছি এই বাড়িতে। তবে তুই চিন্তা করিসনা রিয়ান, তোর বিয়ে আমি এমন দেব, যে পাড়া প্রতিবেশী তাকিয়ে দেখবে। রিয়ান অবাক হয়ে তাকিয়েছিল মায়ের দিকে। মা কি দুর্দান্ত ভাবে যেকোনো দোষ বাবার দিকে ঠেলে দিতে পারে, এমন গুন চট করে খুঁজে পাওয়া ভার। রিয়ান জানে, মা ওর মেয়ে বন্ধুদের টিকতে দেয়নি, বিয়েও হতে দেবে না। ওকে চিরকুমার সভায় নাম লেখাতে হবে।

বাড়ির অবস্থা এই মুহূর্তে গলিত ম্যাগমা, সেটা শুভাশিস জানে। কারণ সর্বাণীর একমাত্র আদরের দুলাল বন্ধুদের সঙ্গে ভাইজ্যাক গিয়েছিল। তারপর সমুদ্রের ঢেউয়ে বিচে আছড়ে পড়েছে। সেই থেকে তার কোমরে বেশ ব্যথা। ওষুধপত্র দিয়েও তেমন কাজ হয়নি। তাই সর্বাণী উঠতে বসতে বলে চলেছে, জালি অর্থপেডিক, আমার রিয়ানকে সুস্থ করতে পারল না। ছেলেটা আমার মাসখানেক ধরে ব্যথায় কষ্ট পাচ্ছে, ওই নিয়েই অফিস করছে, লজ্জা হওয়া উচিত এমন ডক্টরের। শুভাশিসও যে ছেলের ব্যথা নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন সেটা বোঝাতেও পারেনি সর্বাণীকে। কারণ সর্বাণীর ধারণা রিয়ান ওর একার সন্তান। সর্বাণী সেদিন বেশ অপমানের সুরেই বলেছিল, কে জানে ভগবান তোমার মনটা কী দিয়ে তৈরি করেছিল? ছেলের প্রতিও সহানুভূতি নেই। রিয়ানের চোখে ওকে ছোট করে কী যে আনন্দ পায় সর্বাণী কে জানে!

তাই এমন গলন্ত ম্যাগমাকে বেশ ভয়ে ভয়েই হ্যান্ডেল করছেন ডক্টর শুভাশিস তরফদার। সেই উত্তপ্ত মহিলা ঠিক কী কারণে এই অবেলায় ওর চেম্বারে ঢুকেছে সেটা নিয়ে বেশ চিন্তিত হয়েই শুভাশিস বলল, আরে তুমি? এই পথ দিয়েই যাচ্ছিলে নাকি? তাই একবার ঘুরতে এলে? যাক, আমার জন্য তাহলে তোমার এখনও মন খারাপ করে?

সর্বাণী আগুন চোখে তাকিয়ে দাঁত চেপে চেপে বলল, বলি তোমার আন্ডারে কোনো পুরুষ ফিজিওথেরাপিস্ট নেই? অথবা বয়স্ক মহিলা ফিজিওথেরাপিস্ট নেই? খুঁজে খুঁজে ওই আগুনের গোলাকেই পাঠাতে হল বাড়িতে, ছেলের ম্যাসাজের জন্য? মাথাটা কি খারাপ হয়ে গেছে নাকি তোমার?

শুভাশিস এক মুখ হেসে বলল, আসলে অরুণিমা বড্ড ভালো মেয়ে। রিয়ানের বয়েসিই হবে হয়তো। তাই মনের ম্যাচ হবে বলেই আমি অরুণিমাকে পাঠালাম বাড়িতে রিয়ানের দেখাশোনার জন্য। ও খুব ভালো ফিজিওথেরাপিস্ট। ভীষণ ভালো হাত ওর, তাছাড়া খুব যত্ন করে ওর ট্রিটমেন্ট করবে। দেখো সর্বাণী, রিয়ানের এখন ফিজিওথেরাপি ট্রিটমেন্ট দরকার, তাই আমি বেস্ট ফিজিওথেরাপিস্টকেই পাঠালাম। যাতে রিয়ান তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে ওঠে। তো তোমার সমস্যাটা ঠিক কী?

সর্বাণী চোখ পাকিয়ে বলল, আগুন আর ঘি এক ঘরে বসে আছে সর্বক্ষণ। দিনে দুবার করে ওই মেয়ে রিয়ানের ম্যাসেজ করছে, এটা কি ঠিক হচ্ছে? শুভাশিস বোকার মতো বলল, কিন্তু ওষুধে তো রিয়ানের কাজ হচ্ছে না। তাই তো আমি ….ওকে কথা শেষ না করতে দিয়েই সর্বাণী বলল, উফ, তোমায় কে ডক্টর করেছিল কে জানে! হ্যাঁ গো, তুমি কি টুকে পাশ করেছিলে? মাথায় কি গোবর ঠাসা? বলছি, কোনো পুরুষ ফিজিওথেরাপিস্ট নেই? এখন যদি রিয়ান ওই সুন্দরী মেয়েকে সামনে দেখে উল্টোপাল্টা কিছু করে বসে, তখন আমি কী করব?

শুভাশিস হেসে বলল, না না, কিছু করবে না। ওর কোমরে বেশ ব্যথা, এখন ইচ্ছে হলেও কিছু করতে পারবে না!

সর্বাণী বেশ চিৎকার করেই বলতে যাচ্ছিল, তারপর গলা নামিয়ে বলল, মরণ, বুড়ো বয়েসে ছেলের সম্পর্কে কী ভাষা ব্যবহার করছে একবার দেখো! তাছাড়া যদি মন দেওয়া-নেওয়াও করে, তখনই বা আমি কী করে অন্যত্র বিয়ে দেব রিয়ানের? যতই হোক, দিনে দুবার করে অতক্ষণ ধরে….কী জানি বাবা। শুভাশিস বলল, তা মন দেওয়া-নেওয়া হলে সমস্যাটা কোথায়? অরুণিমা বড় ভালো মেয়ে। মিষ্টি স্বভাবের মেয়ে। বউমা হিসাবে মন্দ হবে না।

সর্বাণী বিরক্ত হয়ে বলল, না আমি কোনো ডাক্তারি পেশায় নিযুক্ত কাউকে আর ওই বাড়ির মেম্বার করব না। তাছাড়া আমার ছেলে প্রেম করে বিয়ে করবে? এটা আমি হতে দেব, ভাবলে কী করে? আমি নিজে ওর জন্য যোগ্য মেয়ে খুঁজছি। শুভাশিস জানে তর্করা হেরে যেতে বাধ্য সর্বাণীর সামনে। তাই বাধ্য হয়েই বলল, বেশ, অরুণিমা কদিন ট্রিটমেন্টটা করুক, তারপর আমি দেখছি যদি বিকাশকে পাঠাতে পারি বাড়িতে। তবে দিন সাতেক বিকাশ নেই কলকাতায়। দেশের বাড়ি বিক্রি সংক্রান্ত ব্যাপারে বহরমপুর গেছে। ও ফিরলে না হয় অরুণিমাকে নার্সিং হোমে ডেকে নেব।

সর্বাণী গজগজ করতে করতে বেরিয়ে গেল। শুভাশিস নেক্সট বলার আগে ঢকঢক করে খানিকটা জল খেয়ে নিল। যাক, আজ অল্পের ওপর দিয়ে গেল। কিন্তু এভাবে ভয়ে ভয়ে কি ওকে বুড়ো বয়েসটাও কাটাতে হবে!! মাঝে মাঝে ক্লান্ত লাগে শুভাশিসের। এমন অবুঝ কেন সর্বাণী? একটু তো বুঝতে পারত!

সর্বাণী বাড়ি ঢুকেই দেখল রিয়ানের ঘরের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ। তার মানে ওই মেয়ে ফিজিওথেরাপি করছে। ম্যাসাজ বললে আবার বাপ, ছেলে দুজনেই রাগ করে।

দরজায় কান লাগিয়ে শুনতে চেষ্টা করছে সর্বাণী।

রিয়ান বলল, গানের সঙ্গে নাকি ফিজিওথেরাপির একটা রিলেশন আছে শুনেছি। মানে সুন্দর গান শুনলে মন ভালো হয়ে যায়, মনে জোর পাওয়া যায় সঙ্গে পেশিতেও? অরুণিমা ঝরণার মতো হেসে বলল, আপনি কী করে জানলেন, আমি গান জানি?

রিয়ান আলগোছে বলল, যারা গান ভালোবাসে তারা আনমনেই গুনগুন করে, আপনিও করছিলেন, তাই বুঝলাম। অধম রোগীকে কি দুকলি গেয়ে শোনাবেন নাকি? রিয়ান যে এমন করে কথা বলতে পারে সেটাই তো অজানা ছিল সর্বাণীর। এতদিন তো মনে হত, ছেলেকে ভাজামাছ দিলে উল্টে খেতে পারবে না। ঠিক বাপের ধাতে গেছে। মিটমিটে বদমাশ একটা। সুন্দরী অল্প বয়সি মেয়ে দেখেছে অমনি ওনার সংগীত প্রীতি জেগে উঠেছে।

অরুণিমা গুনগুন করে গাইছে…. এই সুন্দর স্বর্ণালী সন্ধ্যায়, একি বন্ধনে জড়ালে গো বন্ধু.

সর্বাণী প্রমাদ গুনল। এ মেয়েকে তাড়াতেই হবে এ বাড়ি থেকে। কিছুতেই ছেলের কাছে একে থাকতে দিলে হবে না। তিনদিনের মধ্যে একেবারে বশ করে ফেলেছে ছেলেকে। কী ট্রিটমেন্ট করে সেটাও তো দেখা যায় না। শুভাশিস বলেছে, ফিজিওথেরাপির সময় নাকি দরজা বন্ধ রাখতে হয়! সর্বাণী তো রিয়ানের মা, ওর না থাকার কী আছে! একদিন সর্বাণী গ্যাট হয়ে বসেছিল রিয়ানের ঘরে, অরুণিমা ঢুকেছে দেখেও ওঠেনি। অরুণিমা ওর মেশিনারিজ সেট করছিল, তবুও বসেই ছিল। হঠাৎ নিজের পেটের শত্রু বলে উঠল, মা তুমি একটু বাইরে যাও। সর্বাণী বাধ্য হয়েছিল বেরিয়ে আসতে।

গান শেষ হতেই রিয়ান বলল, ব্রিলিয়ান্ট। তোমার কিন্তু অনেক গুন অরুণিমা। এমা, সরি সরি, আপনাকে আমি তুমি বলে ফেললাম। অরুণিমা নরম গলায় আদুরে ভঙ্গিমায় বলল, আমি বোধহয় আপনার থেকে একটু ছোটই হব। তাই তুমিই বেস্ট।

রিয়ান হেসে বলল, এগ্রি করলাম, কিন্তু আমিও কোনো বাতের রোগী দাদু নই, তাই আমিও তুমিটাই ডিজার্ভ করি।

সর্বাণী মনে মনে বলল, এখানে ফিজিওথেরাপি হচ্ছে, না রাসলীলা চলছে?

অরুণিমা বলল বেশ, তাহলে তুমিই লক করলাম। এখন বলতো, ইউ আর ফিলিং বেটার?

রিয়ান বলল, আগে বলো আমার কথা তুমি বিশ্বাস করবে? তোমার হাতে জাদু আছে। তুমি জানো আমার পেইনটা এখন অনেক কমে গেছে! আগে সিঁড়িতে পা দিলেই কঁকিয়ে উঠছিলাম। এখন অনেক বেটার ফিল করছি। অরুণিমা হালকা হেসে বলল, ডক্টর তরফদার বলেন, অরুণিমা শুধু টেকনিকের দ্বারা ট্রিটমেন্ট করো না, মন থেকে করবে, তাহলে যে-কোনো রোগ খুব তাড়াতাড়ি সেরে যায়।

রিয়ান বলল, কিন্তু অরুণিমা আমার বেশ ভয় করছে, আমি আদৌ আর কোনোদিন আগের মতো ছুটতে পারব তো? নাকি এই পেইন নিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলতে হবে।

বুকের মধ্যে কষ্টটা মুচড়ে উঠল সর্বাণীর। আহা রে, ছেলেটার যে কী হল!

অরুণিমা বলল, ডোন্ট ওরি, খুব তাড়াতাড়ি তুমি সুস্থ হয়ে উঠবে। এখন উঠে বসো, আমি যে এক্সসারসাইজগুলো দেখাচ্ছি এগুলো দুবার করে অভ্যেস করবে। রিয়ান বলল, তুমি সত্যি বলছ আমি সুস্থ হয়ে উঠব? অরুণিমা বলল, হতেই হবে। তুমি জানো, তোমার মা দিনরাত তোমার জন্য প্রার্থনা করে চলেছে। মায়েদের ডাক কখনো মিথ্যে হয় না। তোমার মায়ের জন্যই তোমায় দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠতে হবে। সর্বাণীর মনটা কেঁদে উঠল রিয়ানের জন্য।

অরুণিমা বলল, আজ আমি আসছি রিয়ান। অরুণিমার কথাটা শুনেই সর্বাণী সরে গেল দরজা থেকে। অরুণিমা বেরোতেই সর্বাণী বলল, হাতটা ভালো করে ধুয়ে নিয়ে টেবিলে গিয়ে বসো, আজ বাড়িতে কেক বানানো হয়েছে, খেয়ে যাবে। অরুণিমা নরম গলায় বলল, আমি পেশেন্ট দেখতে এসেছি ম্যাডাম, তাই ডিউটি চলাকালীন তো কিছু খেতে পারব না, এটা আমার রুলস। সর্বাণী বিরক্ত হয়ে বলল, রোগী দেখতে এসে গান শোনাতে পারছ, আর খেয়ে যেতে পারছ না? ধন্যি রুলস বটে। ডক্টর তরফদারের আন্ডারে বেশিদিন কাজ করলে দেখছি মানুষের মাথার গন্ডগোল হয়ে যায়।

অরুণিমা আর কথা না বাড়িয়ে টেবিলে বসল। কেক আর মিষ্টি নিয়ে এগিয়ে এল তরফদার বাড়ির সবসময়ের মেড মিনুদি। অরুণিমা কেকটা মুখে ঢোকাতেই সর্বাণী প্রশ্ন করল, তা তোমার বাড়িতে কে কে আছেন? অরুণিমা বলল, মা, বাবা আর আমি। মা গানের শিক্ষিকা, বাবা ব্যাংকে জব করেন। সর্বাণী হেসে বলল, বেশ বেশ। তা তোমায় তো দেখতে শুনতে ভালো, পেশায় ডাক্তার, বিয়ে থা করবে না?

অরুণিমা কেকটা একটু সামলে নিয়ে বলল, করব তো, পাত্র খুঁজছি।

সর্বাণী ঢোক গিলে বলল, খুঁজছ মানে? তুমি খুঁজছ? তোমার বাবা-মা নয়?

অরুণিমা হেসে বলল, আপনি হাসালেন ম্যাডাম। বিয়ে করব আমি, তার সঙ্গে দিনরাত সংসার করব আমি, যুদ্ধ বলুন, ভালোবাসা বলুন সবই হবে আমার সঙ্গে আর তাকে পছন্দ করবে আমার বাবা-মা? না, এতে আমি বিশ্বাসী নই। আমি একটু বাজিয়ে দেখে তবে বিয়েটা করব। সারাজীবন বাড়িতে কাক-চিল বসতে পারবে না এমন পরিস্থিতি তৈরি হবার জন্য তো বিয়ে করব না!

তারপর ধরুন, আমি একজন ডক্টর। আমার যখন তখন ডিউটি থাকতেই পারে। তাই সেটাও যাতে আমার হাজবেন্ড মেনে নেয় সেটাও তো দেখতে হবে। এত কিছু যদি অ্যাডজাস্ট হয় তবেই বিয়ে। তাই আপাতত পাত্র খুঁজছি ম্যাডাম।

সর্বাণী কী বলবে বুঝতে না পেরেই বলল, আমিও আমার ছেলের জন্য পাত্রী খুঁজছি। তবে আমার একটাই শর্ত, পাত্রী যেন ডক্টর না হয়।

অরুণিমা একটু হেসে বলল, আমারও একটাই শর্ত, আমার শাশুড়ি যেন লিবারেল হয়, চূড়ান্ত ব্যাকডেটেড নয়। ম্যাডাম, থ্যাংক ইউ ফর কেক অ্যান্ড সুইটস। আজ আসি।

কিছুক্ষণ স্তম্ভিত হয়ে বসে থাকলো সর্বাণী। অরুণিমা মেয়েটা দায়িত্ব নিয়ে ওকে অপমান করে গেল। না, এই মেয়ে কিছুতেই রিয়ানের ট্রিটমেন্ট করবে না, অন্য কাউকে ব্যবস্থা করতে হবে।

শুভাশিস বাড়ি ফিরতেই আবার শুরু করল সর্বাণী। অন্য কোনো ফিজিওথেরাপিস্ট চাই রিয়ানের জন্য। আচমকা রিয়ান বলে বসল, কেন মা? অরুণিমা তো যথেষ্ট ভালোভাবে ট্রিটমেন্ট করছে, তোমার সমস্যাটা কোথায়? আমি তো আস্তে আস্তে ভালো হয়ে উঠছি। তাছাড়া অরুণিমা সব জায়গায় অ্যাসিস্টেন্ট নিয়েই আসে, নিজে শুধু ইন্সট্রাকশন দেয়। এক্ষেত্রে যেহেতু বাবার নার্সিং হোমের সঙ্গে ও যুক্ত তাই আমারটা নিজে করছে। তোমার কী সবেতেই আপত্তি মা?

সর্বাণী বলল, আমিও চাই তুই ভালো হয়ে যা। কিন্তু কেন জানি না মনে হচ্ছে এই মেয়ে তোকে ঠিক করতে পারবে না। শুভাশিস বলল, তোমায় তো বললাম, বিকাশ ফিরুক, এ সাতদিন অরুণিমাই করুক।

পরের দিন অরুণিমা বাড়িতে ঢুকেই বলল, রিয়ান চলো আজ ছাদে নিয়ে যাবো তোমায়। সিঁড়িতে স্টেপ ফেলবে।

সর্বাণী বলতে যাচ্ছিল, সিঁড়িতে ওর কষ্ট হচ্ছে। তার আগেই রিয়ান এগিয়ে এসে বলল, হাতটা কিন্তু ধরতে হবে।

অরুণিমা হাত বাড়িয়ে বলল, চল।

রিয়ান অরুণিমার হাত ধরে বলল, আমার হাত ধরে তুমি নিয়ে চলো সখা আমি যে পথ চিনি না…..

সর্বাণীর চোখ দিয়ে আগুন ঠিকরে পড়ছে। এমন নির্লজ্জতা সহ্য করাটাও মুশকিল। সর্বাণী এতদিন জানত, রিয়ান তার বাধ্য ছেলে। শুভাশিসও তার বাধ্য। তরফদার বাড়ির সবটুকু নিজের হাতের মুঠোয় রেখেছিল ও। এই একটা মেয়ে এসে ছেলেটাকে রীতিমতো কেড়ে নিচ্ছে ওর কাছ থেকে। সর্বাণী এতদিন সকলের কাছে গর্ব করে বলেছে, রিয়ান কোনোদিন প্রেম করে বিয়ে করবে না। মায়ের কথা ছাড়া ও এগোয় না। আমাকেই খুঁজে আনতে হবে বউমা। এখন তো সবাই হাসবে সর্বাণীর ওপরে। সর্বাণী স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে, অরুণিমা এ বাড়ির বউ হয়ে এসেছে আর ও নিরুপায় হয়ে বরণ করছে।

ভিতরে ভিতরে অসহিষু� হয়ে উঠল সর্বাণী। ওদের পিছন পিছন ছাদে গিয়ে সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে শুনছিল ওদের কথোপকথন।

অরুণিমা বলল, আকাশের রংটা দেখো, ঠিক যেন লাজুক নতুন বউ। ঘোমটার আড়াল দিয়ে প্রিয়তমকে দেখতে চাইছে আড়চোখে। একেই বোধহয় গোধূলি রং বলে তাই না? নাকি কনে দেখা আলো? কোনটা বলে, তুমি জানো?

রিয়ান বলল, কিন্তু কেন তুমি বিশ্বাস করো না, প্রথম দর্শনে প্রেম হয়? অরুণিমা বলল, ধুর, এত তাড়াতাড়ি যেটা হয় সেটা ঠিক প্রেম নয়, ওই ভালোলাগা গোছের কিছু একটা।

রিয়ান বলল, মানতে পারলাম না তোমার লজিক। দেখো, কাকে তুমি প্রেম বলবে সেটা তোমাকেই ঠিক করতে হবে। আমি বরং তোমায় আমার অনুভূতিগুলো বলি…

এই ধর তুমি আর মাত্র আধঘণ্টা থাকবে আমার সঙ্গে। যেমনি চলে যাবে তখন থেকেই আমার মুহূর্তগোনা শুরু হবে। আবার কখন দেখব তোমায়? এটা কী শুধুই ভালোলাগা? যতক্ষণ তুমি থাকো আমার সঙ্গে ততক্ষণ নিজের সব ব্যথা যন্ত্রণা ভুলে যাই আমি, এই অনুভূতিগুলোকে কী নাম দেবে তুমি অরুণিমা? শুধুই ভালো লাগার আবেশ বললে আমার এই অচেনা অনুভূতিগুলোর ওপরে কিন্তু একটু বেশিই অন্যায় করা হবে। একে আরেকটু গভীর নাম অন্তত দাও। অরুণিমা হেসে বলল, বেশ তবে আদি কবির কথায় বলি, পূর্বরাগ। ভালোবাসা মোটেই নয়। রিয়ান বলল, আচ্ছা অরুণিমা তুমি তো বলছ, আমি এখন পুরো সুস্থ। কয়েকটা এক্সসারসাইজ রেগুলার করলেই সপ্তাহ খানেকের মধ্যে একেবারে ফিট হয়ে যাব। তার মানে তো তুমি আসবে না আর আমাদের বাড়িতে? এখন কি তোমার ওই অ্যাসিস্ট্যান্ট দিন তিনেক আসবে?

অরুণিমা বলল হ্যাঁ, আমি পার্থকে বলব ও এসে তোমাকে রোজ এক্সসারসাইজগুলো করাবে। দিন পাঁচেক পর তুমি এমনিই ছুটবে, বুঝলে? আসলে তোমার মাসলে লেগেছিল। তাই ব্যথাটা এতদিন ছিল। মাসল পেইনে ওষুধের থেকে ফিজিওথেরাপি বেশি কাজ দেয়।

চলো, রিয়ান নীচে চলো, এবার আমি ফিরব।

রিয়ান অরুণিমার হাতটা ধরে বলল, যদি যেতে না দিই, যদি বলি এবাড়িতেই থেকে যাও পার্মানেন্টলি, কী করবে?

অরুণিমা লাজুক হেসে বলল, ধ্যাৎ।

সর্বাণী ধুপধাপ করে নেমে এল সিঁড়ি দিয়ে। অরুণিমা চলে যাবার পরেই রিয়ানের ঘরে ঢুকেছে সর্বাণী। একটু হেসে ছেলের পাশটিতে বসে মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলল, হ্যাঁ রে, তোর কাউকে পছন্দ হয়? তোর অফিসের কোনো কলিগকে? বা এ পাড়ার কাউকে? তোরা এখনকার ছেলে, তোদের পছন্দটাই গুরুত্বপূর্ণ। বল না, রিয়ান তোর কাউকে পছন্দ হয়? যদি হয় তাহলে আমায় অ্যাড্রেস দে, আমি নিজে গিয়ে তার সঙ্গে তোর বিয়ে ফাইনাল করে আসব।

রিয়ান বলল, আমার যাকে পছন্দ তার সঙ্গেই আমার বিয়ে দেবে?

সর্বাণী ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, অরুণিমা বাদ দিয়ে যে-কোনো মেয়ের সঙ্গে দেব।

রিয়ান মুচকি হেসে বলল, তাহলে তুমি আমাদের অফিসের রিমিতার সঙ্গে আমার সম্বন্ধ করো মা। ওই মেয়েটাকে আমার বেশ ভালো লাগে!

সর্বাণী হেসে বলল, ছবি আছে নাকি ফেসবুকে?

রিয়ান মোবাইল খুলে ছবিটা দেখাল। সর্বাণী চোখ বড় করে বলল, এমন সব ছোটখাটো পোশাক পরে নাকি রে? বিয়ের পরেও পরবে?

রিয়ান বলল, হয়তো পরবে। তার থেকে কিন্তু অরুণিমা ভালো মা।

সর্বাণী বলল, তুই রিমিতার ফোন নম্বর দে, আমি কথা বলব। মনে মনে বলল, অরুণিমা কখনো নয়, কোনোদিন নয়। চোখের সামনে দিয়ে ওর ছেলেকে ওর কাছ থেকে কেড়ে নিতে চাইছে মেয়েটা, ওই মেয়ে কিছুতেই এবাড়িতে আসবে না।

মাস খানেকের মধ্যেই বেশ ধুমধাম করেই বিয়ে হচ্ছে রিয়ানের। বাড়িতে নহবতখানা বসেছে। শুভাশিসের চেম্বার বন্ধ দিন সাতেকের জন্য।

সর্বাণী নিজে দাঁড়িয়ে থেকে ছেলের বিয়ের তত্ত্ব সাজিয়েছে। বউমার জন্য মনের মতো করে শপিং করেছে।

মনে মনে হাসছে সর্বাণী, জয়ের হাসি। রিয়ানের প্রেম করে বিয়ের মতলবটা অন্তত ভেঙে দিতে পেরেছে সর্বাণী। অরুণিমাকে ভালোবেসে বিয়ে করবে রিয়ান, এটা হতে পারে না। বরং রিমিতা মেয়েটা এমনিতে বেশ ভালো, তবে বড্ড আধুনিক পোশাক পরে। কী আর করা যাবে! অরুণিমার থেকে সরাতেই এত তাড়াতাড়ি বিয়েটা দিতে বাধ্য হল। সত্যি বলতে কী রিমিতার বাবা-মাও বুঝতে পারেনি এত দ্রুত ডেট ধরবে সর্বাণী। তবে ভালো ছেলে পেয়ে ওরা আর হাতছাড়া করতে চায়নি। তাছাড়া একই অফিস, রিমিতাও ভালো করেই চেনে রিয়ানকে। তাই আপত্তি করেনি রিমিতাও।

বিয়েটা ভালোয় ভালোয় হয়ে গেছে। আজ বউ নিয়ে আসবে রিয়ান। সুন্দর করে লাল পেড়ে বেনারসি পরে সেজেছে সর্বাণী। বধূবরণ করতে হবে।

রিমিতার সঙ্গে একই গাড়ি থেকে নামল অরুণিমা। সুন্দর করে সেজেছে। চুলের আড়ালে এক ফোঁটা সিঁদুরও যেন উঁকি দিচ্ছে।

সর্বাণী সব ভুলে অপলক তাকিয়ে থাকল অরুণিমার দিকে। অরুণিমা হেসে বলল, ম্যাডাম, স্যার কিন্তু টুকে পাশ করেননি। স্যার হলেন অর্থপেডিক সার্জেন। রীতিমতো ব্রিলিয়ান্ট, তাই শেষ দানটা স্যারই দিলেন। গেম ইজ ওভার।

সর্বাণী কিছুই বুঝতে পারছে না, বলতে কী চাইছে মেয়েটা?

অরুণিমা ফিসফিস করে বলল, পুরো গেমটা মিস্টার শুভাশিস তরফদারের সাজানো। রিমিতা আর রিয়ান বছর দুয়েক ধরে প্রেম করছে। কিন্তু আপনি থাকতে ওদের বিয়ে হতে দেবেন না। তাই রিয়ান প্রায় কাঁদো কাঁদো হয়ে বাবাকেই ধরেছিল। অগত্যা স্যারই হাল ধরলেন।

রিয়ানের কোমরের ব্যথা হয়তো সেরে যেত স্যারের ওষুধেই। কিন্তু বিয়েটা তাহলে রিমিতার সঙ্গে হত না। তাতে রিয়ান আর রিমিতা দুজনেই কষ্ট পেত। আপনাকে তো এভাবে জিততে দেওয়া যায় না মিসেস তরফদার। বারবার এক তরফা জিতে জিতে আপনার হয়তো অভ্যেস দাঁড়িয়ে গিয়েছিল, তাই একবার, মাত্র একবার স্যার আপনাকে হারালেন। আপনি সেদিন জিজ্ঞেস করেছিলেন না, আমি বিয়ে করব কিনা? উত্তরে বলি, আমি বিবাহিত। আমার হাজবেন্ড বা শাশুড়ি গর্বিত আমি পেশায় ডাক্তার বলে।

আপনি তো মানুষকে মিনিমাম প্রাইভেসিটুকুও দেন না দেখলাম। তাই দরজার বাইরে কান পাতা থেকে শুরু করে ছাদের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে থাকার মতো অন্যায় কাজও করেছেন। শুনুন মিসেস তরফদার, আপনার স্বামী, ছেলে সকলে আপনাকে ভালোবাসে। তাই আপনার এ হেন ব্যবহার সহ্য করে নেয়। নিজেকে বদলান, না হলে হাতের মুঠো খুলে দেখবেন শূন্য হয়ে গেছে।

সর্বাণীর মুখটা থমথম করছে। শেষপর্যন্ত একটা হাঁটুর বয়েসি মেয়ের চালে হেরে গেলেন?

অরুণিমা বলল, নিন সময় নষ্ট করবেন না। ওদের বরণ করুন। স্যার আমাকে দায়িত্ব দিয়েছে, এ বাড়িতে যেন রিমিতার কোনো অসুবিধা না হয় সেটা দেখতে।

সর্বাণী বুঝতে পারছিল ও হেরে গেছে।

বরণটা সেরে এসেই শুভাশিসকে বলল, তুমি আমার সঙ্গে এটা করতে পারলে?

শুভাশিস হালকা হেসে বলল, পারলাম। রিয়ান যাতে জীবনটা ভালোভাবে কাটায় তাই করতে হল। ওর জীবনটা যেন আমার মতো দুর্বিষহ না হয়ে ওঠে, তাই করতে হল। পরাজয়ের গ্লানি নিয়েই ঠান্ডা গলায় সর্বাণী বলল, কিন্তু তোমরা আমায় ঠকালে?

শুভাশিস ধীরে ধীরে বলল, মেনে নিতে শেখো সর্বাণী। তোমার তো মায়া-দয়া ছিল, কবে এত কঠিন হয়ে উঠলে?

নিজের ছেলের সঙ্গে কিসের লড়াই তোমার?

রিয়ানকে এত ভালোবাসো যখন তখন রিমিতাকে মেনে নিতে কিসের সমস্যা?

সর্বাণী ব্যঙ্গাত্মক গলায় বলল, তুমি যদি ভেবে থাকো অরুণিমাকে ঢাল করে তুমি লড়াইটা জিতে গেছো তাহলে জানবে ভুল জানো। আমিও ভবিষ্যতে দেখব, রিমিতা তোমায় বেশি ভালোবাসে, না আমায়!

রিমিতা বেনারসি খুলে একটা হাউজকোট পরে বসে আছে ঘরে। গরমে হাঁপিয়ে গেছে বেচারা। গয়না, ভারী শাড়িতে নাজেহাল।

রিয়ানের বাড়ির আত্মীয়রা ফিসফিস করে আলোচনা করছে, নতুন বউ, শাড়ি পরেনি কেন? নতুন শ্বশুরবাড়ি বলে কথা!

সর্বাণী ঘরে ঢুকে বলল, রিমিতার এটা শ্বশুরবাড়ি নয়, এটা ওর বাড়ি। আমি ওর মা। হ্যাঁ, শ্বশুর আছে এবাড়িতে, কিন্তু শাশুড়ি নেই। মা আছে।

রিমিতা রিয়ানের কাছ থেকে শুনেছিল, ওর মা নাকি মারাত্মক রাগী, দজ্জাল টাইপ। তাই এবাড়িতে পা দিয়ে অবধি একটু ভয়ে ভয়েই আছে ও। অরুণিমাদিও বলে রেখেছে, রিয়ানের মাকে একেবারে সুযোগ দিবি না। ভদ্রমহিলা বড্ড বেশি সন্দেহবাতিক, দজ্জাল টাইপ।

ওর কাছ থেকে ভালোবাসা পাবি না জেনেই রাখ। অরুণিমাদি খুব হেল্প করেছিল বলেই আজ ওদের বিয়েটা হল। তাই রিয়ানের মাকে দেখেই ভয়ে ভয়ে রিমিতা বলল, আমি এখুনি শাড়ি পরব। আসলে গরম করছিল বলে…

ওকে কথাটা শেষ না করতে দিয়েই সর্বাণী বলল, বললাম না, এটা তোর বাড়ি। তুই বাড়িতে যেভাবে থাকিস সেভাবে থাকবি। আর মায়ের কাছে যেমন ভাবে আব্দার করিস তেমন ভাবেই করবি।

রিমিতা এসে সর্বাণীকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল। বলল, তবে যে শুনেছিলাম তুমি খুব রাগী।

সর্বাণী অরুণিমা আর শুভাশিসের দিকে তাকিয়ে বলল, সে নিন্দুকেরা অনেক কিছুই বলে। মা মেয়ের সম্পর্কের মধ্যে নিন্দুকদের ঢুকতে না দেওয়াই বোধহয় বাঞ্চনীয়।

অরুণিমা মুচকি হেসে বলল, স্যার ইউ আর ব্রিলিয়ান্ট।

শুভাশিস রিয়ানের দিকে তাকিয়ে বলল, কি রে মা হ্যাংলা ছেলে, যা এই সুযোগে তুইও রিমিতার সঙ্গে মাকে আদর করে নে। মানুষটা মন্দ নয়, তবে বড্ড মেজাজি, ভীষণ মুডি, আর একটু বাতিকগ্রস্ত।

অরুণিমা বলল, স্যার আপনি কিন্তু ম্যাডামকে এখনও বেশ ভালোবাসেন, তাই এতকিছুর পরেও ওনার গুন খুঁজে পাচ্ছেন।

কী আর করব অরুণিমা, সত্যিই ওকে সময়টা আমি একটু কমই দিয়েছি জীবনে, তাই দোষ তো আমার আছেই।

সর্বাণী অরুণিমার দিকে তাকিয়ে বলল, হাঁটুর বয়েসি মেয়ে নাকি আমায় হারিয়ে দেবে? এবারে শুধু দেখো, রিমিতা কাকে বেশি ভালোবাসে?

অরুণিমা ফিসফিস করে বলল, স্যার আপনি শিওর ম্যাডামের মাথার সব প্রকোষ্ঠগুলো সঠিক জায়গায় আছে?

শুভাশিস হেসে বলল, অরুণিমা, অমন গোলমেলে মাথার মানুষটাকে নিয়েই তো এতগুলো বছর কাটিয়ে দিলাম হে, বাকিগুলোও কাটবে।

সর্বাণী জোরে জোরেই বলল, শত্রুরাও এ বাড়ি থেকে না খেয়ে যায় না। মনে রেখো অরুণিমা। দীপনকে নিয়ে খাওয়াদাওয়া করে যেও।

অরুণিমা হেসে বলল, স্যার হয়তো নিশ্চিত নয়, কিন্তু আমি একশো পার্সেন্ট নিশ্চিত, সর্বাণী তরফদারের মাথার কোনো একটা প্রকোষ্ঠ মিসিং জন্মমুহূর্ত থেকেই।

রিয়ান ফিসফিস করে বলল, আমার হাত ধরে তুমি নিয়ে চল অরুণিমাদি, আমি তো এই নতুন মাকে চিনি না।

সানাইয়ে বিসমিল্লাহ বাজছে, রিমিতার দিকে তাকিয়ে রিয়ান বলল, বলেছিলাম, বিয়ে আমি তোমাকেই করব। মায়ের সব বাধাকে উপেক্ষা করেই করব। রিমিতা বলল, রিয়ান তোমার লজ্জা করে না এমন দেবীর মতো মায়ের নামে তুমি আমায় অত অত মিথ্যে বলেছিলে। এটা কিন্তু তুমি অন্যায় করেছিলে, আমি এটা আশা করিনি তোমার কাছে। যাইহোক, আমি তোমায় ভালোবাসি তাই ক্ষমা করে দিলাম। আর কখনো মায়ের নামে কিছু বলবে না। মা বড্ড ভালো।

রিয়ান হেসে বলল, অন্যায় মার্জনা হোক। আপাতত কি আমি আমার বউয়ের কাছে একটু আসতে পারি?

দাঁড়াও, দরজার বাইরেটা একটু দেখে আসি।

বাইরে বেরিয়ে দেখল, মা দূরে কাউকে বেশ জোরে জোরে বলছে, রিয়ানের বাবার কাজের জন্য তো আমরা হানিমুনে যেতেই পারিনি। তাই আমি রিয়ান আর রিমিতার জন্য হানিমুনের টিকিট কেটেছি। আজ বউভাতের সময় ওদের ওটা গিফট করব।

রিয়ান ছুটে গিয়ে মায়ের গলাটা জড়িয়ে ধরে বলল, লাভ ইউ মা।

অধ্যায় ১ / ২০

সকল অধ্যায়

১. গেম ইজ ওভার – অর্পিতা সরকার
২. টুরিস্ট গাইড – অর্পিতা সরকার
৩. দ্য ড্রিম গার্ল – অর্পিতা সরকার
৪. দীর্ঘ প্রতীক্ষা – অর্পিতা সরকার
৫. পার্কের বেঞ্চটা – অর্পিতা সরকার
৬. স্বপ্নের পাসওয়ার্ড – অর্পিতা সরকার
৭. সেই টেলিফোন – অর্পিতা সরকার
৮. হিসেব না মেলা অঙ্ক – অর্পিতা সরকার
৯. লাইট ক্যামেরা অভিনয় – অর্পিতা সরকার
১০. অহংকার – অর্পিতা সরকার
১১. প্রেমের সাইডএফেক্ট – অর্পিতা সরকার
১২. পিতৃঋণ – অর্পিতা সরকার
১৩. অবয়ব – অর্পিতা সরকার
১৪. মধুচন্দ্রিমা – অর্পিতা সরকার
১৫. ভাড়াবাড়ির আত্মীয়রা – অর্পিতা সরকার
১৬. সময় থমকে গেছে – অর্পিতা সরকার
১৭. তেরোটা বছর – অর্পিতা সরকার
১৮. খেলনা বাড়ির মেয়ে – অর্পিতা সরকার
১৯. প্রসব বেদনা – অর্পিতা সরকার
২০. দেখা না দেখায় মেশা – অর্পিতা সরকার

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন