প্রসব বেদনা – অর্পিতা সরকার

অর্পিতা সরকার

মৃন্ময়ী যেদিন এই বিশাল জমিদার বাড়িতে বউ হয়ে ঢুকেছিল, সেদিন বড় বড় ঘরের ছাদ পর্যন্ত দেখতে দেখতে তার ঘাড়ে যন্ত্রণা করছিল। চোদ্দোর মৃন্ময়ীকে সবাই জমিদার গিন্নি বলে সম্বোধন করছিল। ভিতরে ভিতরে একটু ঘাবড়ে গেলেও সামনে ভয় প্রকাশের মেয়ে মৃন্ময়ী কোনোকালেই ছিল না। দীনবন্ধুবাবুর ছোট মেয়ে মৃন্ময়ী যে কথার পিঠে কথা সাজিয়ে ঘায়েল করতে পারে প্রতিপক্ষকে, তা নিশ্চিন্তপুরের কারোরই অজানা নয়।

দীনবন্ধুবাবুর ওই ছোটমেয়েটির জন্য চণ্ডীমণ্ডপে বিচার সভাও বসেছে বহুবার। গ্রামের গণ্যমান্য ব্যক্তির সামনে ওই একরত্তি মেয়ে কোমরে হাত দিয়ে বলেছে, অন্যায়টা সে কী করেছে? বিষ্ণু জ্যাঠার বাগানে এক বাগান আম পেকে পেকে পচে যাচ্ছে দেখেই সে ওই লক্ষ্মী ঠাকুমাকে খান দশেক পেরে দিয়েছে। ঠাকুমার কিনে খাওয়ার সাধ্য নেই বলে কি খেতে সাধ জাগে না বুঝি?

তার অকাট্য যুক্তির সামনে গ্রামের প্রধান হার মেনেছে। সেই মৃন্ময়ীর যে এমন রাতারাতি গুপ্তিপাড়ার জমিদার বাড়িতে বিয়ে হয়ে যাবে, এ বোধহয় নিশ্চিন্তপুর গ্রামের জনপ্রাণীও ভাবেনি।

জমিদারি প্রথা উঠে গেছে বহু বছর হল। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয়েছে গুপ্তিপাড়াতেও। গ্রাম পঞ্চায়েতও আছে। এই পঞ্চায়েতেও প্রধান আছেন। তবু গুপ্তিপাড়ার রামনারায়ণের এই বিশাল বাগানওয়ালা বাড়িটাকে লোকে জমিদার বাড়ি বলেই সম্মান করে আজও। গ্রামের গরিব, দুঃখী মানুষেরা বিপদে পড়লে আজও এই জমিদার বাড়িতে এসেই সুরাহা চায়। এই বাড়িতে নিত্যদিন প্রায় পঞ্চাশ থেকে সত্তর জনের পাত পড়ত এক সময়। সেসব দিন অতীত হলেও তিন মহলা বাড়িটা আজও জমিদার বাড়ির গর্ব নিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। আজও গুপ্তিপাড়ার মানুষ রামনারায়ণবাবুকে দেখলে দু-হাত তুলে প্রণাম করে।

রামনারায়ণবাবুর দুই ছেলে। বিজয়নারায়ণ আর জয়নারায়ণ।

বিজয়নারায়ণের বিয়ে হয়েছে আজ বছর ছয়-সাত হল। দু দুটো কন্যা সন্তান জন্ম দিয়েই বিজয়ের স্ত্রী জমিদার বাড়ির সকলের আশায় জল ঢেলে দিয়েছে। আপাতত সব আশা ভরসার কেন্দ্রস্থল জয়নারায়ণের স্ত্রী মৃন্ময়ী।

যদিও মৃন্ময়ীকে এ বাড়ির কেউই ঠিক বিশ্বাসযোগ্য মনে করে না। বছর ষোলোর মৃন্ময়ী যেন কেমন এলোমেলো। প্রায় দু-বছর বিয়ে হয়েছে তার, তবুও যেন সংসার সম্পর্কে বড্ড উদাসীন সে, আর পাঁচটা বয়েসি বউ-র মতো তার স্বভাব নয়। রান্নাঘরে নুন-তেলের কৌটোর হিসেব রাখা তার চরিত্রে নেই। আনমোনা হয়ে ছাদের কার্নিশে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে বৃষ্টির জল মাখে, আকাশের সাথে কী সব কথা বলে।

রামনারায়ণের স্ত্রী পান্নাবালা রেগে গিয়ে বলেন, কপাল করে বউ এনে ছিলাম বটে! একটা দুটো মেয়ে দিয়েই ক্ষান্ত হল। আরেকটার তো পোয়াতি হবার কোনো লক্ষণই নেই। সবই তাদের পাপের ফল। নাতির হাতের জল পেয়ে স্বর্গে যাওয়া তাদের কপালে আর নেই।

এদিকে জয়নারায়ণ এখনও পর্যন্ত কাউকে বলে উঠতেই পারেনি যে মৃন্ময়ীর সাথে তার এখনও কোনো শারীরিক সম্পর্কই তৈরি হয়নি।

ফুলশয্যার ঘরেই মৃন্ময়ী কোমরে হাত দিয়ে চোখ পাকিয়ে বলেছিল, যেদিন আমি তোমাকে বন্ধু ভাবব সেদিনই আমার শরীরের অধিকার পাবে। আগে আমার মন জয় করে দেখাও।

দু-বছর ধরে একই ঘরে থেকে, একই বিছানায় শুয়েও পঁচিশের জয়নারায়ণকে সন্ন্যাসীর মতোই জীবন কাটাতে হয়। পাশেই নিশ্চিন্তে ঘুমোয় লাল শাড়িপরা তার ফুটফুটে বউ মৃন্ময়ী।

এখনও শর্ত পূরণ করতে পারেনি জয়নারায়ণ।

মৃন্ময়ীকে এখনও বেশ কিছুটা শেখানোর বাকি আছে ইংরেজি সাহিত্যের। বাংলা সাহিত্য সে বাবার বাড়িতে দাদার কাছেই অনেকটা শিখে এসেছে। বঙ্কিমচন্দ্র, শরৎচন্দ্র, বিভূতিভূষণ পড়ে ফেলেছে সে। রবিঠাকুরের সাথে নাকি তার মন দেওয়া নেওয়ার পালাও চুকেছে।

ইংরাজি জানা স্বামী জয়নারায়ণের কাছে তার একটাই দাবি, তাকে শেক্সপিয়র, শেলী, কীটস, বায়রন পড়াতেই হবে। A B C D আর ওয়ার্ড বুকের ইংরাজি জানা মানুষকে শেক্সপিয়র পড়াতে গিয়ে জয়নারায়ণ নিজেই সব ভুলতে বসেছে। তবুও পড়ার সময়টুকুই যা মৃন্ময়ী নিজের কাছে ঘেঁষতে দেয় ওকে। বাদবাকি সময় হয় জমিদার গিন্নির দায়িত্ব পালন, না হয় বই পড়া। জয়ের খুব ইচ্ছে করে ওই পুতুল পুতুল মেয়ের নরম ঠোঁটটাতে একবার ঠোঁট রাখতে, কিন্তু মৃন্ময়ী বা বেআক্কেলে! হয়তো চেঁচিয়ে লোক জড়ো করে ফেলবে। নয়তো বাবার বৈঠকখানার ঘরে গিয়ে তার ছোট ছেলের অভব্যতা নিয়ে নালিশ ঠুকে আসবে মৃন্ময়ী। কোনোটাই তার কাছে খুব কঠিন নয়। অগত্যা মৃন্ময়ীর শর্তেই রাজি হতে হয়েছে ওকে।

মৃন্ময়ী বলেছে, যেদিন ওর ইংরাজি শেখা শেষ হবে সেদিনই নাকি জয়নারায়ণ মহেন্দ্রের মতো করে আশালতাকে আদর করতে পারবে।

কেন যে ইংরাজি শিখতে গিয়েছিল জয়!

জমিদার জয়নারায়ণের বাবার প্রতিষ্ঠিত স্কুলটি এখন সরকারি স্কুলে পরিণত হয়েছে। সেই স্কুলের ইংরাজির শিক্ষক জয়নারায়ণের মনের দুঃখের হেতু কেউ বোঝে না। সকলেই মনে করে হয়তো সন্তান হচ্ছে না বলেই জয়ের এমন মন খারাপ।

যতই জমিদারি রক্ত ধমনিতে বহাল থাক, মৃন্ময়ীর তেজের কাছে তা কিছুই নয়।

একদিন মৃন্ময়ীকে একটু জোর করেই কাছে টানতে গিয়েছিল জয়।

মৃন্ময়ী আলগোছে বলল, মন বিহীন শরীর আর ছন্দ বিহীন কবিতা পড়ে যারা সুখ পায়, তুমিও কি তাদের দলেই পড়ো জয়নারায়ণ?

নিজের নামটি স্পষ্ট স্বরে স্ত্রীর মুখে শুনেই চমকে উঠেছিল জয়।

স্কুলের গণ্ডী না পেরিয়েও এমন দার্শনিকদের মতো কথা তার ষোল বছরের বউ কোথা থেকে শিখল?

কবি গুরুর ওপর রাগটা ক্রমশ চেপে বসেছিল জয়ের। তবুও মৃন্ময়ী তার বিবাহিত স্ত্রী, এ বাড়ির ছোট বউ, এটা অস্বীকার করার ক্ষমতা নেই জয়নারায়ণের।

বয়স বাড়ছে রামনারায়াণের। আগের মতো পরিশ্রম করার ক্ষমতা কমছে।

হঠাৎই রামনারায়ণের শরীর অসুস্থ হয়ে পড়ল। পান্নাবালা বলতে লাগলেন এত বড় জমিদার বংশ রক্ষা করার মতো কাউকে রেখে যেতে পারলেন না তিনি, এ বড়ই দুর্ভাগ্যজনক। বিজয়ের স্ত্রী শিবানী নিজের দুই মেয়ে নিয়ে অপরাধীর মতোই বিশাল জমিদার বাড়ির আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়ায়। এমনকী বিজয়ের ধারণা তার বউ-র দোষেই তার পুত্র সন্তান হল না। জমিদারের বীর্যের এত তেজ তবুও একটা ছেলে হয় না!

নিজেকে অপরাধী ভাবা বড় জাকে মৃন্ময়ী অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেছে যে, কন্যা সন্তানকে সঠিকভাবে মানুষ করতে হবে। তাদের বাপ ঠাকুরদা তাদের অল্প বয়সে বিয়ে দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু তাদের মেয়েদের লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করতে হবে।

মৃন্ময়ীর মুখে হাত দিয়ে তার কথা বন্ধ করার চেষ্টা করেছে শিবানী।

মৃন্ময়ী বড় জা শিবানীকে ‘শেষের কবিতা’-র বই থেকে শুনিয়েছে লাবণ্য চরিত্রের দৃঢ়তার কাহিনি। তবুও সে নিজেকে অপরাধী ভেবে ঈশ্বরের কাছে পুত্র সন্তান কামনায় কাতর হয়েছে।

ইদানীং জয়নারায়ণ খেয়াল করেছে, তার তেজী স্ত্রী একটু একটু লজ্জা পাচ্ছে। সেদিন যেমন, কবিতায় নারীর শরীর বর্ণনা করার সময় সে লজ্জা পেল।

তার সতেরোর স্ত্রী এখন বেশ ইংরাজি শিখেছে। মনযোগী ছাত্রী মৃন্ময়ী, অধ্যাবসায়ের জোরে সে ইংরাজি সাহিত্যের মতো কঠিন বস্তুও ধাতস্থ করে ফেলেছে।

সাহায্য ছাড়াই পড়তে পারছে বায়রন। কতটা বুঝছে সেটা অবশ্য জয় জানে না।

জয়নারায়ণও আর দেরি না করেই বলল, মৃন্ময়ী তুমি তো এখন সব শিখেছ, তাহলে তোমার শর্ত পূরণ করো, আমাকে স্বামীর অধিকার দাও!

মৃন্ময়ী নির্দ্বিধায় বলেছিল, স্বামীর অধিকার তুমি সেদিনই পেয়েছ, যেদিন আমায় সিঁদুর পরিয়েছিলে। আজ তুমি আমার মনের অধিকারও নাও।

গত তিন বছর তুমি আমায় ভালোবেসে, আমার কথার মর্যাদা দিয়ে আমার মন জয় করেছ, তোমাকে অদেয় কিছুই নেই।

উপন্যাসের ফুলশয্যার মতো মধ্যরাতে জুঁইয়ের গন্ধে বিভোর হয়ে দুটো শরীর-মন একাত্ম হয়েছিল।

জয়নারায়ণ বুঝেছিল তার স্ত্রী রত্নটি আর পাঁচজনের মতো ফেলনা নয়। একে খুব যত্নে ব্যবহার করতে হয়, একটু একটু করে।

মন আর শরীর মিশে গিয়ে পরিপূর্ণ হয়েছিল ওদের দীর্ঘ অপেক্ষার রাত।

রামনারায়ণ বয়স জনিত কারণে অসুস্থ হওয়ায়, এখন জমি জায়গা সম্পত্তির দায়িত্ব নিয়েছে বিজয়নারায়ণ। জয় চিরকালই একটু অগোছালো। নিজের লেখাপড়া আর স্কুল নিয়েই সে ব্যস্ত। আবার বছর পাঁচেক পরে চৌধুরী বাড়িতে একটা খুশির হাওয়া বইছে। এ বাড়ির ছোট বউ সন্তান সম্ভবা। অদ্ভুতভাবে একইসময় বড় বউও সন্তান সম্ভবা।

বিজয় এবার আশাবাদী। দুই মেয়ের পরে এবার নিশ্চয় তার ছেলেই হবে।

জয়নারায়ণ অবশ্য এত ভাবেনি। সে বাবা হতে চলেছে এতেই সে খুশি।

তবুও দুই ভায়ের যখন একই সাথে সন্তান ভূমিষ্ঠ হবে তখন স্বাভাবিকভাবেই গুপ্তিপাড়ায় এটাই এখন আলোচ্য বিষয়কে জমিদার রামনারায়ণ চৌধুরিকে নাতির মুখ দেখাতে পারে?

বড় বউ শিবানী ভারী শরীর নিয়ে দিন রাত পুজো দিয়ে বেড়াচ্ছে।

ছোট বউ মৃন্ময়ী দিনরাত নভেল মুখে নিয়ে বসে আছে।

জয়নারায়ণ মৃন্ময়ীর পেটে হাত বোলাতে বোলাতে বলল, মিনু, আমাদের মনে হয় ছেলেই হবে! একটুও উত্তেজিত না হয়ে মৃন্ময়ী বলল, আমাদের সন্তান হবে। আমি চাই আমাদের একটা সুস্থ সন্তান হোক।

ওর চোখের দিকে তাকিয়ে আর কথা বলার সাহস হয়নি জয়ের।

পান্নাবালা দুই বউকে ছেলে হবার মাদুলি পরিয়ে দিয়েছেন। ছোট বউ দু-দিন পরেই সে মাদুলি হারিয়ে ফেলেছে।

অলক্ষুণে বাচাল মৃন্ময়ীকে এবাড়ির কেউ কোনোদিন পছন্দ করে না।

বড় ছেলের মেয়ে দুটো একটু অবহেলাতেই মানুষ হচ্ছে এবাড়িতে। যদিও কাকা স্কুল শিক্ষক বলে, তারা স্কুল যাচ্ছে, তবু ষোলো হলেই বিয়ে দেবে ঠিক করেই রেখেছে বিজয়নারায়ণ।

শিবানী সেদিন মৃন্ময়ীর ঘরে ঢুকে কাঁদতে কাঁদতে বলেছে, এবার যদি মেয়ে হয়, তাহলে নাকি সে বাড়ির পিছনের পদ্ম পুকুরে গলায় কলসী বেঁধে ডুবে মরবে।

মৃন্ময়ী কোনোদিন দিদিকে বুঝিয়ে কিছু শেখাতে পারেনি। এমনকী বিজয়নারায়ণ তার দুই মেয়ে সবিতা আর রমিতাকে কাকিমার কাছে ঘেঁষতে অবধি দেয় না। যদি মৃন্ময়ী ওদের মাথায় বিষ ঢোকায়, তাই! মৃন্ময়ী যেন বাড়ির মধ্যে থেকেও চৌধুরী বাড়ির নিয়ম কানুনের বাইরে তার নিজস্ব জগৎ তৈরি করে নিয়েছে। ওর গঠিত এই জগতে ওর অনুমতি ব্যতীত কারও প্রবেশ নিষিদ্ধ।

তেমনি রামনারায়ণের বাড়ির আঁতুড় ঘরে কোনো পুরুষ ডাক্তারের প্রবেশ নিষিদ্ধ।

শহর থেকে কোনো এক মহিলা ডাক্তারকে গাড়ি করে তুলে আনা হয়েছে, দুই বউ-এর প্রসবের জন্য।

একই দিনে দুজনেরই প্রসব বেদনা উঠল। বড় বউ অবশ্য দু-দিন ধরেই কাতরাচ্ছিল কিন্তু প্রসব বেদনায় নীল হয়ে গেছে মৃন্ময়ীর ফর্সা মুখ। দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করেছে মৃন্ময়ী। ডাক্তার বলল, মৃন্ময়ীর আর হয়তো বাচ্চা নাও হতে পারে। জয়নারায়ণের কপালের জোরেই নাকি এই সন্তানটি সুস্থভাবে চিৎকার করল, চৌধুরীদের জমিদার বাড়ির আঁতুড় ঘরে।

চৌধুরীদের বাড়িতে সকলে বলাবলি করছিল, শিবানীর ডাক ঠাকুর শুনেছে, তার একটি ফুটফুটে ছেলে হয়েছে।

মৃন্ময়ীর কোলে মেয়ে।

যাক অবশেষে বংশ রক্ষা করতে পেরেছে বিজয়ের স্ত্রী। তাকে আর পদ্ম পুকুরে ডুবেও মরতে হয়নি।

রামনারায়ণ নাতির নাম রেখেছে কৃষ্ণেন্দুনারায়ণ চৌধুরী।

শিবানীর গলায় উঠেছে শ্বশুরের আশীর্বাদ স্বরূপ সোনার বিছে হার। গরবিনী শিবানী এতদিনে চৌধুরী বাড়ির বড় বউ-এর সম্মান পেয়েছে। কোল আলো করা ছেলে নিয়ে সে এখন পান্নাবালাদেবীর বড় আদরের বউ হয়েছে।

মৃন্ময়ীর মেয়েকে কেউ অবহেলা করতে পারেনি। যা একখানা দজ্জাল বউ, তার মেয়ে হলেও তাকে সম্মান দেখাতেই হবে।

জয়নারায়ণ ক-দিন মন খারাপ করে ছিল বলেই, মৃন্ময়ী বলেছিল, মেয়ে নিয়ে সে বাপের বাড়ি চলে যাবে। গুপ্তিপাড়ায় ঘরে ঘরে জেনে যাবে জমিদার বাড়ির বউ ছাড়া হয়েছে।

সকলেই ওই পাগলাটে বউ-এর জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়েই থাকে। কৃষ্ণেন্দুর অন্নপ্রাশনের সাথে জয়শ্রীরও অন্নপ্রাশন করতে হবে বলে বাড়িতে প্রথম অশান্তি বাঁধাল মৃন্ময়ী।

তাকে যতই বোঝানো হোক যে, মেয়েদের জন্মটাই নাকি অভাগীর, তার আবার ঘটা করে মুখে ভাত কী করে হবে?

মৃন্ময়ী শ্বশুর-ভাসুর না মেনেই বলল, তাহলে আমিই আমার গয়না বেচে গ্রামবাসীকে নিমন্ত্রণ করে আসব। জয়নারায়ণ অনেক বুঝিয়েও স্ত্রীকে শান্ত করতে না পেরে, জয়শ্রীরও বেশ ঘটা করে অন্নপ্রাশন করা হল।

দিনরাত মেয়েকে নিয়ে আদিখ্যেতা করে চলেছে মৃন্ময়ী। আড়ালে সকলেই বলে, ছোট বউ-এর মাথায় একটু আধটু গন্ডগোল তো আছেই। তবে প্রাণে দয়া-মায়া আছে। গরিব মানুষদের দান-ধ্যান করতে জানে।

রামনারায়ণ একদিন ছোট বউমাকে ঘরে ডেকে বললেন, তোমার এই মেয়ে নিয়ে আদিখ্যেতা মোটেই পছন্দ করি না। লোকজন হাসাহাসি করে এ নিয়ে। কৃষ্ণেন্দুর সঙ্গে একই ক্ষণে জন্মেছে মানেই তোমার মেয়ে এ বংশের মান বাড়িয়েছে, তা কিন্তু মোটেই নয়।

তুমিও আর একটি পুত্র সন্তানের জন্ম দাও, তাকেও চৌধুরীবংশ মাথায় করে রাখবে!

মৃন্ময়ী নিজের ঘোমটা শ্বশুরের সামনে খুলে, চোখ তুলে উঁচু গলায় বলল, মেয়েটা যখন এই চৌধুরীদের ঔরসেই হয়েছে, তখন এই বংশের সমস্ত সম্পত্তির ওপর জয়শ্রীর সমান অধিকার আছে। দেশে আইন বলেও তো একটা কথা আছে।

রামনারায়ণ বোধহয় স্বপ্নেও কল্পনা করেনি ওই এক রত্তি মেয়ে তার মুখের ওপর এমন কথাও বলতে পারে!

মৃন্ময়ী বলেছিল, আমার মেয়েকে আমি ডাক্তার করব। যেমন ডাক্তার কলকাতা থেকে এসেছিল আমাদের বাড়িতে, তেমন ডাক্তার।

শুনেই হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছিল পান্নাবালার। সত্যিই বউ-এর মাথার ব্যামো আছে। এমন বেআক্কেলে কথা কি কেউ বলে?

ভয়ে হোক আর জমিদার গিন্নির ভক্তিতেই হোক এবাড়িতে কেউ মৃন্ময়ীর মুখের ওপর কথা বলে না।

ও মেয়ে তো বলেই দিয়েছে, তার মেয়ের ভবিষ্যতের সামনে যদি কেউ বাধা হয়ে দাঁড়ায়, আঁশবটির এক কোপে তার গলা নামাবে।

মৃন্ময়ী স্বামী, শ্বশুর, ভাসুর কাউকে মানে না! ছোট বউ-এর মুখের কথা আর কাজের মধ্যে বিস্তর ফারাকও কেউ কোনোদিন দেখেনি চৌধুরী বাড়িতে। অগত্যা সকলেই সমঝে চলে এসেছে ওকে। সেই মৃন্ময়ীর ঝুলপিতে এখন রূপলী চুলের রেখা। রামনারায়ণ চৌধুরী মারা গেছেন। বিজয়নারায়ণই এখন জমি জায়গা দেখাশোনা করছে। জয়নারায়ণ আর বছর দুয়েক পরেই রিটায়ার করবে।

পান্নাবালার বয়স হলেও সংসারের কতৃত্ব এখনও তার হাতে। শিবানী বড় বউ হলেও মৃন্ময়ী আর পান্নাবালার নির্দেশেই নিজেকে ভাসিয়ে দিতে বেশি পছন্দ করে এসেছে আজীবন। আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি। ষোলোর মৃন্ময়ীর সাথে আজকের মৃন্ময়ীর পার্থক্য একটাই, আগে সে সকলকে বোঝাতে চেষ্টা করত, সকলের কাছে অনুমতি চাইত, আর এখন সে তার দৃঢ় সিদ্ধান্ত জানায়।

আজ জমিদার বাড়িতে রান্নার বড় ঘটা। আজ দুই ছেলে মেয়ে ফিরছে। কৃষ্ণেন্দু আর জয়শ্রী। কৃষ্ণেন্দু পেশায় অধ্যাপক, কয়েক বছর বিদেশে থেকে আজ সে ফিরছে। কৃষ্ণেন্দু সত্যিই খুব ভালো ছেলে। কাকিমা মৃন্ময়ীর প্রতি তার আলাদা একটা সম্মান আছে।

মৃন্ময়ীর মেয়েও বিদেশ থেকে ফিরছে। মৃন্ময়ী গলা উঁচু করে বলেছে আমার মেয়ে বিলেত ফেরত ডাক্তার।

এতদিনে মৃন্ময়ীর স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। এই গ্রামের বাধানিষেধের বেড়াজাল থেকে বের করে সে মেয়েকে কলকাতার হোস্টেলে রেখে পড়িয়েছে, বিজয়নারায়ণের সাথে আর পান্নাবালার সাথে সংঘর্ষ করে মেয়ের বিদেশ যাবার টাকা আদায় করতে হয়েছে তাকে। জয়নারায়ণ কোনোদিনই মা আর দাদার মুখের ওপর কিছু বলে উঠতে পারেনি। জয়শ্রী মাকে ফোন করে জানিয়েছে, সে আজ সকাল দশটা নাগাদ ঢুকবে। কৃষ্ণেন্দু ফিরেছে ভোর রাতে।

পেল্লাই বাড়ির বাইরে অনেকেই ভিড় জমিয়েছে, এ বাড়ির ডাক্তার মেয়েকে দেখবে বলে।

একমাত্র, বিজয়নারায়ণই একটু বিরক্ত। তার দুই মেয়ের বিয়ে দিয়েছে সে। তাদের ছেলে পুলে হয়ে গেছে। আর এই বত্রিশের ধিঙ্গি মেয়ে ডাক্তার হয়ে বাড়ির মান-সম্মান নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে। যেমন নির্লজ্জ ছোট বউমা, তেমন তার মেয়ে।

কৃষ্ণেন্দু আবার গর্ব করে বলছে, ভাবতেই ভালো লাগছে আমার বোন এফ আর সি এস পেয়েছে।

বিরক্ত বিজয়নারায়ণ মাকে গিয়ে বলল, মা দয়া করে এবার জয়ের মেয়ের একটা বিয়ে দাও। এই বয়সে জয়ীর জন্য পাত্র পেলে হয়!

জয়শ্রী বাড়িতে ঢুকেই ছুটে এসে তার মাকে জড়িয়ে ধরেছে। মৃন্ময়ীর চোখের জলে ভিজে যাচ্ছে জয়শ্রীর জামা।

মনে পড়ে যাচ্ছে মৃন্ময়ীর, কত বছর এই মেয়ের জন্য লড়াই করেছে সে। সকলে চেয়েছিল,জয়শ্রীর বিয়ে দিয়ে দিতে। ঠিক সেই সময়ই মৃন্ময়ী জেদ করে মেয়েকে কলকাতায় পাঠিয়ে দিয়েছিল। কতদিন জয়নারায়ণ স্ত্রীর সাথে কথা বলেনি ওই অপরাধে। সকলেই বলত, বড্ড অলক্ষুণে বউ মৃন্ময়ী। তার মেয়েও নাকি তার মতোই বাচাল হবে। সব অপমানের উপযুক্ত জবাব দিতে আজ জয়শ্রী ফিরে এসেছে ডাক্তার হয়ে।

হঠাৎ বিজয়নারায়ণ নিজের বুকের বাঁদিকটা হাত দিয়ে চেপে ধরে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।

কৃষ্ণেন্দু কিছু না বুঝেই তাকিয়ে আছে বাবার মুখের দিকে।

জয়শ্রী বলল, দাদাভাই! হারি আপ…

মুখে ব্লো করো, বুকে পাম্প করছি আমি। নিজের ব্যাগ খুলে ইনজেকশন পুশ করল জয়শ্রী।

কৃষ্ণেন্দু শুধু বোনের কথা মতো কাজ করে চলেছে।

বিপদকালীন পরিস্থিতির জন্য বেশ কিছু জিনিস সর্বদাই জয়শ্রীর হাতের কাছে থাকে। এর আগেও ট্রেনে-বাসে বহুবার অনেক মানুষের জীবন রক্ষা করতে পেরেছে জয়শ্রী, এই এমার্জেন্সী ওষুধের সাহায্যে।

ধীরে ধীরে চোখ খুলল বিজয়নারায়ণ। তখনও একটা আঙুলকে ছেদ করে ব্লাড বের করে যাচ্ছে জয়শ্রী।

পান্নাবালা বলছেন, জানতাম ওই অলক্ষুণে মেয়ে বাড়িতে পা দিলেই কিছু অঘটন ঘটবেই। ঘরের মেয়ে বিদেশে অজাত-কুজাতের সঙ্গে মিশে বাড়ি ফিরলে, সে বাড়িতে আর লক্ষ্মী টেকে না। মুখে গজগজ করে কপাল চাপড়াচ্ছেন পান্নাবালা। শিবানীও স্বামীর এমন অবস্থা দেখে বিহ্বল হয়ে বলে বসল, জয়শ্রীর জন্যই কি তবে এমন হল?

শুধু পরীক্ষা দিয়ে চলেছে মৃন্ময়ীর মেয়ে।

বিজয়নারায়ণ চোখ খুলতেই জয়শ্রী বলল, জ্যেঠু তুমি রেগুলার প্রেসার চেক করাও? ওষুধ খাও?

বিজয়নারায়ণ ধীরে ধীরে বলল, প্রায় দিন পাঁচেক প্রেসারের ওষুধটা খাওয়া হয়নি।

মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসে এই প্রথম জয়শ্রীর মাথায় হাত বোলাল বিজয়নারায়ণ চৌধুরী।

গুপ্তিপাড়ায় নিমেষে রটে গেল, জয়নারায়ণের মেয়ে বিখ্যাত ডাক্তার হয়ে ফিরেছে।

রান্নাঘরে বড় জা শিবানী আর মৃন্ময়ী খাবার সাজাচ্ছিল। শিবানী বলল, মিনু একটা কথা বলি…

তোর দাদা যখন জয়শ্রীকে মেনেই নিলেন, তখন সত্যিটা বলতে আর দোষ কোথায়?

মৃন্ময়ী রাগ আর ঘৃণা মিশ্রিত চোখে তাকিয়ে বলল, কেন দিদি? সাত ভরির হার গলায় দুলিয়ে, ছেলে কোলে নিয়ে সৌভাগ্যবতী সাজার সময় তো তোমার সত্যিটা বলতে ইচ্ছা করেনি? কখনো তো কাউকে বলোনি যে, কৃষ্ণেন্দু আমার ছেলে, সেদিন রাতে তোমার আবার মেয়েই হয়েছিল! আমি যখন ডাক্তারকে বলেছিলাম, ছেলেটাকে দিদির পাশে দিন আর মেয়েটাকে আমার পাশে, আমি তোমাকে পদ্ম পুকুরে ডুবে মরা থেকে বাঁচিয়ে ছিলাম, বুঝেছিলাম অল্প হলেও তোমারও জ্ঞান ছিল তখন। কই তুমি তো সেদিন প্রতিবাদ করোনি দিদি?

আজ যখন আমার বুকের রক্ত দিয়ে আমি আমার মেয়েকে মানুষ করেছি, সে দাদার জীবন ফিরিয়ে দিয়েছে, তখন তুমি তোমার মেয়ের পরিচয় দিতে চাইছো? নিজের ছেলেকে তোমার কোলে বড় হতে দেখে বুকটা ফেটে যেত আমার, কই তখন তো তুমি আমার ছেলেকে কোলে দিয়ে বলোনি, সত্যিটা বলে দে ছোট। আজ বত্রিশ বছর পর তুমি সত্যি খুঁজতে চেও না দিদি। সেদিনও বলেছিলাম, বঁটির এক কোপে শেষ করব তাকে যে আমার মেয়ের দিকে তাকাবে। আজও ওই একই কথা বললাম দিদি।

রান্না ঘরের বাইরে থেকে সবটা শুনে জয়শ্রী কিছু না শোনার ভান করে ভিতরে এসে বলল, জানো মা, আমাকে সকলে বলে, তোমার মা নিশ্চয় কোনো মহিয়সী মহিলা, তাই তোমার এত সাহস!

আমি সকলকে গর্ব করে বলি, আমার মায়ের নাম মৃন্ময়ী চৌধুরী।

মৃন্ময়ী সেই ছোটবেলার মতো মেয়ের গালে গাল ঘষে বলল, তুই আমার মেয়ে জয়ী। তুই আমার মেয়ে। আমর গর্ভেই তোর জন্ম। তোর জন্যই সারারাত আমি প্রসব বেদনা সহ্য করেছিলাম। তুই শুধুই মৃন্ময়ী চৌধুরীর মেয়ে জয়শ্রী চৌধুরী।

সকল অধ্যায়

১. গেম ইজ ওভার – অর্পিতা সরকার
২. টুরিস্ট গাইড – অর্পিতা সরকার
৩. দ্য ড্রিম গার্ল – অর্পিতা সরকার
৪. দীর্ঘ প্রতীক্ষা – অর্পিতা সরকার
৫. পার্কের বেঞ্চটা – অর্পিতা সরকার
৬. স্বপ্নের পাসওয়ার্ড – অর্পিতা সরকার
৭. সেই টেলিফোন – অর্পিতা সরকার
৮. হিসেব না মেলা অঙ্ক – অর্পিতা সরকার
৯. লাইট ক্যামেরা অভিনয় – অর্পিতা সরকার
১০. অহংকার – অর্পিতা সরকার
১১. প্রেমের সাইডএফেক্ট – অর্পিতা সরকার
১২. পিতৃঋণ – অর্পিতা সরকার
১৩. অবয়ব – অর্পিতা সরকার
১৪. মধুচন্দ্রিমা – অর্পিতা সরকার
১৫. ভাড়াবাড়ির আত্মীয়রা – অর্পিতা সরকার
১৬. সময় থমকে গেছে – অর্পিতা সরকার
১৭. তেরোটা বছর – অর্পিতা সরকার
১৮. খেলনা বাড়ির মেয়ে – অর্পিতা সরকার
১৯. প্রসব বেদনা – অর্পিতা সরকার
২০. দেখা না দেখায় মেশা – অর্পিতা সরকার

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন