মধুচন্দ্রিমা – অর্পিতা সরকার

অর্পিতা সরকার

তোমার শোয়ার অভ্যাসটা বড্ড খারাপ। ফুটবলের মতো গোটা বিছানায় ঘুরপাক খাচ্ছিলে কেন?

বাসর ঘর থেকে বেরিয়েই কুণাল বিরক্ত মুখে তাকাল গিনির মুখের দিকে। গিনিও ঝাঁজি গলায় বলল, নীচেও তো অন্য বন্ধুবান্ধবরা শুয়েছিল তুমি ওদের কাছে গিয়ে ঘুমোলেই পারতে! আমি তো তোমাকে আহ্লাদ করে বলিনি, ওগো আমার জীবনসঙ্গী, তুমি আমার পাশেই এসে শোবে!

একে তো সারারাত গিনির লাথি ঘুষি খেয়ে ঘুমের বারোটা বেজে গেছে, তারপর কোথায় গিনি দুঃখ প্রকাশ করবে তা নয়, নতুন বউয়ের কী মুখের ভাষা!

অথচ মা বলেছিল, ও মেয়ে নাকি সাক্ষাৎ লক্ষ্মী!

এ তো রীতিমতো বাড়িতে ডেকে এনে অপমান।

গিনি বলছে, দেখো ওটা আমার ঘর, আমার ডিভান, আমি উদার মানুষ তাই তোমাকে এক্সকিউজ করে জায়গা দিয়েছিলাম। আজ অবধি আমার ডিভানে কাউকে এলাউ করিনি।

এবার কুণালের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেছে, ভেবেছে কী মেয়েটা! ওর নিজের কোনো ঘর নেই, নাকি পার্সোনাল ডিভান নেই!

গিনি হাই তুলে বলল, শোনো তোমার ডিওর ব্রান্ডটা চেঞ্জ করে নিও। এই তীব্র গন্ধটা আমার মোটেই ভালো লাগে না।

কুণালের ইচ্ছে করছে টেনে একটা থাপ্পড় লাগাতে। তবে এ যা মেয়ে একটা থাপ্পড়ের বদলে হয়তো চারটে মারবে।

ছোটপিসি বলেছিল, ছোট্ট থেকে নাকি ও গিনিকে চেনে, এমন ভালো মনের মেয়ে আর দুটো পাওয়া যাবে না। বাড়িশুদ্ধু লোক যদি কুণালের ভালো মানুষির সুযোগ নেয় তাহলে আর ওর একার পক্ষে কী করা সম্ভব!

শেষপর্যন্ত একটা অহংকারী মুখরা মেয়ের সাথে ওর বিয়ে দিল, হ্যাঁ গিনির মাথায় এখনও কাল রাতের কুণালের দেওয়া সিঁদুর টকটক করছে।

গিনির আপাতত পরনে রয়েছে, একটা থ্রি কোয়াটার প্যান্ট, আর একটা টিশার্ট। আদুরী আদুরী মুখ করে বলল, তুমি আগে ওয়াশ রুমে ঢুকবে না আমি?

কুণাল বিরক্ত মুখে বলল, আমি আগে।

গিনি নাকটা সিটকে বলল, জানতাম! তুমি বুর্জুয়া শ্রেণিতেই পড়ো। যাও যাও…

বন্ধুদের কাছে শোনা নতুন বউয়ের লজ্জা অবনত মুখটার সাথে গিনির তুলনা করতে গিয়েই মাইগ্রেনের যন্ত্রণাটা জানান দিয়ে বলল, এই তো সবে শুরু বন্ধু… আগে আগে দেখো হোতা হ্যায় কেয়া!

কুণাল মনের আনন্দে সবে একটু গায়ে জল ঢালতে লেগেছে ওমনি গিনি এসে বাথরুমের দরজায় ধাক্কা দিয়ে বলল, আরে তুমি কি সারা সকালটা একাই বাথরুমে কাটাবে?

কুনাল উত্তর দেবার প্রয়োজন মনে করল না কিন্তু ও মেয়ে চুপ করার নয়। আমার বাথরুমে এতক্ষণ ধরে তুমি কী করছ? পরের পেয়ে নিশ্চয় আমার দামি শ্যাম্পু আর বডিওয়াশের বারোটা বাজাচ্ছ।

কুনাল রেগে গিয়ে টাওয়েল পরেই বাইরে বেরিয়ে এসেছে, কী ভেবেছো টা কী তুমি গিনি? তোমার ওই লেডিস শ্যাম্পু ব্যবহারের লোভে আমি এতক্ষণ বাথরুমে ছিলাম?

গিনি মুখটা ভেংচি কেটে বাথরুমে ঢোকার সময়ে বলে গেল, বিয়ে বাড়ির সব লোক জেগে গেছে এখন। সবাই নতুন বরকে টাওয়েল পরে দেখবে, কী মজা।

যা, কুণালের সব পোশাক তো বাথরুমে! গিনি বাথরুমের দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। এখন ওকে নরম নরম গলায় অনুরোধ করা ছাড়া কুণালের আর কোনো উপায় নেই।

কুণাল আস্তে আস্তে বলল, গিনি এখন তো আমি তোমার স্বামী, মানে হাবি তাই তুমি নিশ্চয় চাও না তোমার হাবির সম্মানহানি হোক।

গিনি মনে মনে একচোট হেসে নিয়ে বলল, নিশ্চয় না।

বাথরুমের দরজাটা আধফাঁক করে কুণালের পায়জামা আর পাঞ্জাবি বের করে দেবার সময় গিনি বলল, এই সফট সুরে কথা বলে, এটাই আমার পছন্দের।

কুণাল ঘড়ি দেখল, বিদায় পর্ব মিটিয়ে নিজের বাড়িতে ফিরতে মাত্র দু’ঘণ্টা লাগবে, তারপর এই গিনি চৌধুরীর তেজ যদি না কমাতে পেরেছি তো আমার নামও কুণাল সেন নয়।

গিনিকে আবার গয়না আর বেনারসিতে সাজানো হয়েছে।

মুখটা কেমন একটু দুঃখী দুঃখী লাগছে। সকালের সেই প্রাণচঞ্চল মেয়েটাই নয় যেন।

গিনির বাবা রঞ্জনবাবু সামনে আসতেই গিনি অঝোরে কেঁদে ফেলল। নিজের ঠোঁট কামড়ে কান্না চাপার ব্যর্থ চেষ্টা করে চলেছে ও কিন্তু নোনতা জলের ধারারা আজ অবাধ্য হয়ে ঝড়ে পড়ছে ওর গোলাপি গাল বেয়ে।

কুণাল অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে গিনির দিকে। কাল রাত থেকে দেখা মেয়েটার মধ্যে যেন একটা অদ্ভুত পরিবর্তন। ওর চোখের জল হয়তো আস্তে আস্তে কুণালকে দুর্বল করে দিচ্ছে।

অবশেষে রুমাল দিয়ে চোখের জল মুছতে মুছতেই গিনি গাড়িতে উঠল। শ্বশুরবাড়ি যাত্রার উদ্দেশে। এত নিয়মের বেড়াজাল থেকে রেহাই পেয়ে কুণাল যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। গাড়ির এসিটা চালিয়ে চোখটা বন্ধ করে বসল। পাশের জন তখনও চোখ মুখে আর নাক টেনে চলেছে বলে একটু অস্বস্তি হচ্ছে।

কুণাল মাথাটা তুলে বলল, এভাবে কাঁদার কী আছে, একঘণ্টার রাস্তা যেকোনো সময় চলে এসো তোমার বাড়িতে।

তখনও চোখে জল টলটল করছে, সেই নিয়েই ঝেঁজে উঠল গিনি। তুমি আর কী বুঝবে! নিজের ঘর, নিজের বাবা, মা, এদের ছেড়ে থাকতে কত কষ্ট হয়। আমার টেডিগুলোকেও তো মিস করছি।

কুণাল আস্তে করে বলল, আর তোমার ওই মহামূল্যবান ডিভানটাকেও।

কুণালের চোখের দিকে গভীরভাবে তাকিয়ে বোধহয় বুঝে নিতে চাইল গিনি, আদৌ কথাটা ব্যাঙ্গাত্মক কি না। কুণাল যতটা সম্ভব মুখটাকে নিষ্পাপ রাখার চেষ্টা করেছিল বলেই এ যাত্রা বেঁচে গেল।

গোটা গাড়ি জার্নিটা ঠোঁট ফুলিয়ে ফুলিয়েই কাটিয়ে দিল গিনি। কুণাল মাঝে মাঝে আড় চোখে তাকাচ্ছিল।

বাড়ির গেটের সামনে যখন বউ নিয়ে পৌঁছাল তখন সকাল এগারোটা। বিয়ে বাড়ির সাথে একটা জিনিসের তুলনা চলে সেটা হল মাছের বাজার। এখানেও সবাই বলছে কিন্তু কেউ শুনছে না।

কুণালের মা এসে নতুন বউকে বরণ করতে শুরু করলেন। গিনির কোমরে একটা জল ভরা ঘড়া আর হাতে জ্যান্ত মাছ। গিনি নাজেহাল হয়ে যাচ্ছে, সিল্কের শাড়ি থেকে ঘড়া আরেকটু হলেই হড়কে যাচ্ছিল, কুণাল সাপোর্ট দিল তাই ওটা পড়ল না। গিনির ঘর্মাক্ত মুখটা দেখে সকালের রাগটা আসতে আসতে কমছে কুণালের।

অনেক নিয়ম কানুন মিটিয়ে অবশেষে কুণাল আর গিনি বেডরুমে ঢুকল।

গয়নাগাটি খুলতে খুলতেই গিনি বলল, নট ব্যাড।

ভ্রু কুঁচকে নিজের পছন্দের কুশনটা কোলে নিয়ে সোফায় হেলান দিয়ে কুণাল বলল, কোনটা নট ব্যাড?

গিনি বলল, এই তোমার বেড রুমটা। আমার মতো না হলেও আমি চালিয়ে নেব।

ব্যাস, যেমনি সকলের চোখের আড়াল হয়েছে তেমনি গিনি সেই সকালের রূপ ধরেছে।

কুণালের ওয়ার্ডরবটা খুলে ফেলে ওর শার্টপ্যান্ট সরিয়ে নিজের পোশাক রাখতে ব্যস্ত। ওকে জিজ্ঞাসা করার প্রয়োজনও মনে করল না।

প্রথম দিন বলে ভদ্রতার খাতিরে সহ্য করে চলেছে গিনির এই অত্যাচার।

কোনো ভূমিকা ছাড়াই গিনি বলল, একটা পরিষ্কার কথা বলে দিই, আমার উপর বউয়ের অধিকার ফলাতে আসবে না।

ধৈর্যের শেষ সীমায় পৌঁছে কুণাল বলল, আমি পিসিমণির কথায় বিশ্বাস করে তোমাকে বিয়ে করেছিলাম, কিন্তু একদিনেই সে মোহ কেটে গেছে। তাই নিশ্চিন্তে আমার ঘরে তুমি থাকতে পারো। এরপরও গিনি নাকটা কুঁচকে বলল, তোমাকে ভদ্রলোক ভেবে কথাটাতে আস্থা রাখলাম।

উত্তর না দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল কুণাল।

না, লোকটা খুব একটা খারাপ নয়। কুণালের পিসিমণি মানে দোলন পিসি। ছোট থেকেই ওদের বাড়িতে যাতায়াত আন্টির। যদিও গিনি ওকে আন্টি বলেই ডাকে। গিনিকে কুণালের সম্পর্কে বলা হয়েছিল, উদারমনস্ক ছেলে। কাল থেকে তো উদারতার বিন্দু বিসর্গও চোখে পড়ল না ওর। সবসময় কেমন একটা নাক উঁচু, নাক উঁচু ভাব। যাকগে ওর স্বাধীনতার হস্তক্ষেপ না করলেই হবে।

তবে কুণালের বাবা মাকে ওর বেশ পছন্দ হয়েছে। ওর বাবা তো গিনির কানে কানে বলল, যদি কুণাল কোনো গন্ডগোল করে ওনার কাছে শুধু একটা নালিশ ঠুকে দিলেই চলবে। বাবাকে দেখে প্রথমেই গিনির অভিনেতা ছবি বিশ্বাসের কথা মনে পড়ছিল। শুধু ঠোঁটের ডগায় চুরুটের অভাব ছিল একটা। কিন্তু পরে বুঝল, ওই ব্যক্তির ভিতরে একটা শিশুর মতোই সরল মানুষের উপস্থিতি। কুণালের মা তো নেহাতই সাদাসিধে। ছেলে আর স্বামীর কথায় চলতি পুতুল বিশেষ। ছেলে আর স্বামী দুজনকে সমর্থন করতে করতে বেচারির অবস্থা অনেকটা স্যান্ডুইচের মতো।

ফুলশয্যার দিন গিনিকে ছোঁয়া যাবে না সেটা কুণাল আগেই বুঝতে পেরেছিল। পরের দিন বন্ধুদের কাছে নিজের পাঞ্জাবিতে বাংলা সিরিয়ালের কাহিনির মতোই লিপস্টিক বা সিঁদুর লাগিয়ে প্রমাণ করতে হবে ফুলশয্যার রোমান্স জমে উঠেছিল। পার্সোনাল বিষয়ে মানুষের এই অতিরিক্ত কৌতূহল। বিরক্তি লাগলেও, নতুন বরকে অনেক কিছু সহ্য করতে হয়। সহ্য যে করতে হয় সেটা তো এই দু-দিনে গিনির ব্যবহারেই বুঝতে পেরেছে। আশ্চর্য মেয়ে একখানা, বাবা-মা, বাড়ি শুদ্ধু আত্মীয়ের সাথে দারুণ ব্যবহার আর কুণালের সাথে কথা বলতে হলেই মনে হচ্ছে মুখে কেউ নিমপাতা ভরে দিয়েছে। কুণালকে যদি এতই অপছন্দ ছিল তাহলে বিয়েটা করতে গেল কেন?

আবহাওয়ার মতো মুড পরিবর্তন হয় এই মেয়ের। ফুলশয্যার সাজানো বিছানায় শুয়ে বলল, তুমিও আমার পাশেই শুতে পারো। আমি ভদ্রলোকজনদের সাথে কখনো খারাপ ব্যবহার করি না। বিষাক্ত মন নিয়ে কুণাল গিনির পাশেই শুয়ে পড়ল।

বেশ কিছুক্ষণ পর পেটের কাছে একটা সজোরে লাথি খেয়ে চমকে উঠল ও। যা ভেবেছে ঠিক তাই, গিনি ঘুমের ঘোরে সম্পূর্ণ উলটে গেছে।

ঘুমন্ত গিনির মুখের দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বালিশটা নিয়ে সোফায় শুয়ে পড়ল ও।

সকালে ঘুম ভাঙতেই দেখল একটু লজ্জিত মুখে গিনি হাতে চায়ের কাপ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

আমি বোধহয় ঘুমের মধ্যে শট মেরে ছিলাম, তাই না? কুণাল বলল, তুমি ঘুমের ঘোরেও আমার ওপর রিভেঞ্জ নিতে চাইছো?

সরি, বলে ছুটে বেরিয়ে গেল ও।

অফিস যাবার আগে দেখল গিনি আর বাবা খুব হাসছে, কিছু একটা প্ল্যান করছে মনে হয়। বাবা গম্ভীর গলায় বলল, তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরো, অফিস ফিরত আগের মতো আর ক্লাবে ঢুঁ মারতে যেও না।

এ বাড়িতে কুণালের মিনিমাম সম্মানটুকু যেন গিনি এসে কেড়ে নিল। গিনির সামনেই বাবা এমন ভাবে কথা বলছে, যেন প্রাইমারির বাচ্চাকে কেউ বলছে, স্কুলে পটি পেলে ঠিক করে প্যান্টটা খুলো। একটা বিয়ে করে যে মানুষের জীবনে এত পরিবর্তন আসে তা কুণাল কল্পনাই করতে পারেনি।

মাত্র দু-দিন ওদের বাড়িতে ঢুকে পুরো বাড়িটাকে নিজের বৈঠকখানা বানিয়ে নিয়েছে গিনি। বাবা-মাও এখন গিনি বলতে ঢোক গিলছে। অসহ্য হয়ে উঠেছে ওর কাছে।

অফিসে গিয়েও বারবার অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছিল, মুখার্জীদা রসিকতা করে বললেন, কী হে, নতুন বউয়ের শ্রীমুখ সর্বদা চোখের সামনে ভাসছে বুঝি?

এই প্রশ্নের উত্তরে নিশ্চুপ থেকে দন্তবিকশিত করা ছাড়া আর উপায়ই বা কী।

বাড়িতে ঢুকেই বুঝল সবাই ওর ফেরার অপেক্ষায় ছিল, ওর না ওর গাড়িটার সেটা প্রশ্ন সাপেক্ষ। গিনি বলল, চটপট হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও। টেবিল বুক করা আছে, আজ বাইরে ডিনার।

বলছে কী মেয়েটা! বাবা যাবে বাইরে ডিনার করতে? চাকরিতে জয়েন করার পর কুণাল বাবা-মাকে নিয়ে রেস্টুরেন্টে যেতে চেয়েছিল সেলিব্রেট করতে। বাবার বলা কথাটা আজও কুণালের মনে গেঁথে আছে। কষ্ট করে পড়াশোনা শিখিয়েছি, জব পাবে এটাই তো স্বাভাবিক, এতে অকারণে লাফানোর কী আছে। নিমেষে ইচ্ছেটা চুপসে গিয়েছিল। আজ সেই বাবা যাচ্ছে বাইরে ডিনার করতে। মাও তো বেশ সেজেগুজে রেডি। মার নাকি হাবিজাবি খেলেই অ্যাসিডিটি হয়, আজ বোধহয় সেসব ভুলেছে।

যাইহোক মেজরিটি অলওয়েজ গ্রান্টেড মেয়ে নিয়েই কুণাল গাড়িতে উঠল। গিনি সারা রাস্তা বাবা-মায়ের সাথে বকবক করতে করতে চলেছে। যাক এটা কুণালের সৌভাগ্য যে বাবার অট্টহাসির আওয়াজটা এই একত্রিশে এসে অন্তত শুনতে পেল।

টেবিলে বসে কুণাল প্রথমেই বলল, সবাই আজ চাইনিজ খেলে কেমন হয়?

গিনির চটজলদি উত্তর, যে যার নিজের পছন্দমতো খাবার পছন্দ করুক।

মা বলল, কুণাল বা ওর বাবা যা নেবে সেটাই আমি খাব।

গিনি প্রতিবাদ করে বলল, কেন মা… আপনার নিজের পছন্দ বলে কিছু নেই! ছেলে আর স্বামীর পছন্দকে কেন সবসময় নিজের পছন্দ করে নিয়েছেন?

মা বোধহয় তেত্রিশ বছরের বিবাহিত জীবনে এমন অদ্ভুত কথা এই প্রথম শুনলেন, তাই অস্বস্তি ভরা মুখে তাকিয়ে রইলেন বাবার দিকে। বাবাও সমস্যায় পড়েছে, এতদিন পর্যন্ত তো মানসী ওর কথা মতোই চলেছে, ফলে নিজস্ব মতামত দেবার ক্ষমতাটাও বোধহয় হারিয়ে ফেলেছে। আজ গিনির সামনে সেটা স্বীকার করার ক্ষমতা আর বাবার নেই।

মা হঠাৎ একমুখ হেসে বলে উঠল, আচ্ছা এখানে ডাব চিংড়ি পাওয়া যায়?

এই প্রথম মা নিজের ইচ্ছে জানাল সকলের সমানে। কুণাল ছেলে হয়েও জানতে পারেনি ডাব চিংড়ি মায়ের পছন্দের কোনো খাবার। আসলে মায়েরও যে আলাদা কোনো পছন্দ থাকতে পারে সেটাই তো কুণাল বুঝতে পারেনি কোনোদিন।

খাওয়াদাওয়া যখন প্রায় কমপ্লিট তখন গিনি বলল, একটা পার্সেল হবে।

বাকি তিনজনের কৌতূহলকে বেশিক্ষণ স্টে করতে না দিয়েই বলল, রীতা মাসির জন্য।

রীতা মাসি হল কুণালদের বাড়ির সবসময়ের কাজের লোক।

গিনি বলল, আসলে রীতা মাসিকেও আমি আনতে চেয়েছিলাম, কিন্তু এত লাজুক যে কিছুতেই আসতে চাইল না। আমাদের জন্য না ঘুমিয়ে অপেক্ষা করবে দরজা খোলার জন্য।

গিনি এমনভাবে নিজের সিদ্ধান্ত জানায় যে ওর ওপরে আর কারুর কথা চলে না।

আজ অনেকদিন পর কুণাল নিজের বাবা কৈলাস সেনের এত হাসি হাসি মুখ দেখল।

সাধারণত এত ভোরে ঘুম ভাঙে না কুণালের। ঘুম ভাঙতেই দেখল, গিনি কারোর সাথে খুব ফিসফিস করে কথা বলে চলেছে। কিছু একটা টাকা, গয়না নিয়ে। কুণালকে চোখ মেলতে দেখেই চুপ করে গেল।

এতদিন কুণাল মনে করেছিল, বড়লোকের আদুরি মেয়ের মনমর্জি, তাই কুণালকে এখনও ধারে কাছে যেতে দেয়নি, কিন্তু আজ পরিষ্কার বুঝতে পারল গিনি অন্য কাউকে ভালোবাসে।

ভোরের সোনালি সূর্যের দিকে তাকিয়ে কুণালের মনটা হুহু করে উঠল।

আদৌ কী এই কদিনে ও গিনিকে একটুও চিনতে পেরেছে! গিনির হাতে কুণালের চায়ের কাপ। গরম চা থেকে ধোঁয়া উঠছে।

গিনির মুখটা নরম আলোয় বড় পবিত্র লাগছে। কুণাল অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে গিনির দিকে। এমন একটা নিষ্পাপ মুখের আড়ালে একজন প্রবঞ্চককে খুঁজে বেড়াতে ইচ্ছে করছে না কুণালের।

গিনি হালকা সবুজ চুড়িদারের ওড়না সামলে বেরিয়ে গেল।

খোলা জানলার দিকে তাকিয়ে কুণাল ভাবছিল, আর মাত্র তিনদিন পর ওদের হানিমুনের টিকিট।

মধুচন্দ্রিমা! গ্যাংটকের টিকিট দুটো টেবিলের ওপর থেকে বিদ্রুপের হাসি হাসছে।

গিনির মতো প্রতিবাদী মেয়ে হঠাৎ নিজের মনের বিরুদ্ধে কেন কুণালকে বিয়ে করল সেটা তো বোঝা যাচ্ছে না।

একটা সময়ের পর ভাবনারাও ক্লান্ত হয়ে যায়, মাথার মধ্যে শিরা-উপশিরাগুলো বুঝিয়ে দেয় তারা অবসন্ন বোধ করছে।

ট্রলি ব্যাগের পেটটা ফুলে উঠেছে। গিনি তারপরেও ঠুসে ঠুসে আরও পোশাক ঢুকিয়ে যাচ্ছে দেখে কুণাল বলল, গ্যাংটকে থাকা মাত্র চারদিন। এত জামাকাপড় কী হবে?

গিনি মুখ ভেংচে বলল, দু-বেলা দুটো করে পরলেও তো আটটা লাগবে। কুণালের সত্যিই পাগল পাগল অবস্থা। কখনও গিনি ভীষণ সরল সাদামাটা একটা মেয়ে আবার কখনো যেন ধূসর আবরণে ঢাকা রহস্যময়ী! একজন মানুষের মধ্যে সমানভাবে দুটো রূপই বর্তমান। অষ্টমঙ্গলায় নিজের বাড়ি গিয়ে গিনি সকলের কাছে কুণালের বাবা-মায়ের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। যদিও কুণালের প্রসঙ্গ উঠলেই খুব আলতো করে সেটা স্বেচ্ছায় এড়িয়ে গেছে। শুধু একদিন বিকালের দিকে গিনিকে সারা বাড়ি, ছাদ কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। শেষে গিনির মা বললেন, মনে হয় বন্ধুর বাড়িতে গেছে। গিনির এই বিশেষ বন্ধুটি যে কে সেটা কুণাল জানতে পারেনি। সত্যি বলতে কী আর বোধহয় জানার কৌতূহলও নেই।

গ্যাংটক স্টেশনে নামার পর থেকেই গিনির পরিবর্তনটা চোখ এড়ালো না কুণালের। অন্যমনস্ক গিনি বারবার নিজের মোবাইলের কল লিস্ট চেক করছে। হয়তো সম্ভাব্য কলটা আসতে দেরি হচ্ছে বলেই।

গাড়িতে উঠে ফোনের কোনো একটা মেসেজ দেখার পর থেকেই আবার ঠোঁটের কোণায় হাসি উপচে পড়েছে।

কুণাল বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। নিউজলপাইগুড়ি ছেড়ে বেরোতেই রাস্তার দু-ধারে লম্বা লম্বা গাছের সারি আর একটা আলো-আঁধারির লুকোচুরি খেলা চলছে।

মাটিতে পাহাড়ি গন্ধটা পেতে শুরু করেছে গিনি। কুণালকে তো বলেনি যে ও পাহাড় পছন্দ করে। পাহাড়ের প্রতিটা বাঁকের পিছনে যে অপার রহস্য লুকিয়ে থাকে থাকে সেটাই বারবার ডাক দেয় গিনিকে।

কুণালের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে গিনি। না দোলন আন্টি ভুল বলেনি। কুণাল সত্যি খুব ভালো ছেলে। এখনও পর্যন্ত গিনি যা যা অত্যাচার করেছে সেগুলো সব হাসি মুখে না হোক মেনে নিয়েছে। গিনির না বলা কথাগুলো বোঝার চেষ্টাও করে চলেছে। ঘুমিয়ে পড়েছে কুণাল। গাড়ির ঝাঁকুনিতে মাথাটা বারবার এদিক ওদিক হচ্ছে দেখে গিনি আস্তে করে নিজের কাঁধে সাপোর্ট দিল।

কুণালের ট্রিম করা দাড়ি গিনির গালে ঘষে যাচ্ছে। ওর আফটার সেভের গন্ধটা গিনির নাকে এসে ঝাপটা দিচ্ছে। এই ক-দিন এক বিছানায় পাশাপাশি শুয়ে থেকেছে গিনি আর কুণাল, মাঝে পাশবালিশের একটা পলকা ব্যবধান ছিল। কুণাল কোনোদিন সেটা টপকাতে চেষ্টাও করেনি। যেহেতু গিনি প্রথম দিনেই বলে দিয়েছিল, ”আমাকে ছোঁবে না”। ওর প্রতি কুণালের এই নিস্পৃহতা আর ভালো লাগছে না গিনির কিন্তু নিজের বলা কথা আর ও ফিরিয়েও নিতে পারছে না। ওর ঈষৎ সোনালি চুলগুলো থেকে একটা মিষ্টি গন্ধ গিনিকে অবশ করে দিচ্ছে। বারবার মনে হচ্ছে এই গাড়ির পথটা আরও লম্বা হোক, আরও কিছুক্ষণ কুণাল এভাবেই ঘুমুক।

গিনির কাঁধ থেকে চট করে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে গিনির দিকে লজ্জিত ভাবে তাকিয়ে কুণাল বলল, সরি।

এতক্ষণের সব ভালোলাগাটুকু নিমেষে চলে গেল গিনির। এতটা পর ভাবে কুণাল ওকে! হয়তো সেটা ওর ব্যবহারের জন্যই।

হোটেলে ঢুকেই গিনি বলল, বিকেলের আগে কোথাও বেরুবো না। কুণালের তো কোনোমতে ওই চারটেদিন কেটে গেলেই হল। মধুচন্দ্রিমার জন্য একটা ভালো গল্প বানাতে হবে যেটা কলিগদের কাছে বেশ রংচড়িয়ে বলে প্রমাণ করতে হবে ওদের হানিমুন কত মধুর কেটেছে। একটা হালকা গোলাপি টপ আর ব্ল্যাক লং স্কার্ট পরে গিনি যখন ভিজে চুলে বাথরুম থেকে বেরুল তখন ইচ্ছে করেই কুণাল নিজের দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে হোটেলের মেনুকার্ডে মনোনিবেশ করল।

সন্ধেবেলা সব ভুলে গিনি আর কুণাল ম্যালের রাস্তায় আর পাঁচটা হানিমুন কাপলের মতোই হাঁটল। ঠান্ডায় জমে যেতে যেতে আইসক্রিম খেল। একটা স্বপ্নের সন্ধ্যা কাটানোর পরেই ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে গিনির সেই ফিসফিস কথা শুনব না ভেবেও শুনতে হল। খুব উদ্বিগ্ন গলায় গিনি কাউকে বলছে, ভালোবাসলে সব অসুখ সেরে যায়।

পাহাড়ের ধাপে ধাপে সন্ধ্যেপ্রদীপ জ্বলে উঠেছে। দূরে বাড়ির আলোগুলো যেন জোনাকির মতো মিটমিট করছে। পাশে শুয়ে গিনি অকাতরে ঘুমোচ্ছে। একটা নিষ্পাপ মুখ, চোখের ওপর এসে পড়ছে ওর অবাধ্য চুলের গোছা।

কুণাল সামনের কাচের জানলা দিয়ে অন্ধকারের আলোক বিন্দুর দিকে তাকিয়ে আছে নির্নিমেষ দৃষ্টিতে।

রাত তখন বারোটা। গিনির ফোনটা আবার ভাইব্রেট করছে…

আজ বিকেলে ম্যালের ধারে বেশ কিছু বাচ্চার হাতে চকলেট দিচ্ছিল গিনি। বাচ্চাগুলো ভিক্ষা ভুলে শৈশবে মেতেছিল মুহূর্তের জন্য। গিনির চোখের কোণে তখন নোনতা জলের একটা রেখা দেখেছিল কুণাল।

আলগোছে গিনি বলেছিল, কুণাল তুমি রাগ করলে?

প্রথমে বুঝতে পারেনি কুণাল। ঠিক কী কারণে রাগ করবে! পরে বুঝেছিল, গিনির ধারণা ওই ভিক্ষে করা বাচ্চাগুলোর সাথে সময় কাটাচ্ছিল বলে কুণালের রাগ হয়েছে কিনা জানতে চাইছিল গিনি।

ওকে এতটা খারাপ মনের মানুষ মনে করে গিনি এটা ভেবেই কষ্ট হয়েছিল কুনালের। নীরবে মাথা নেড়ে বুঝিয়ে দিয়েছিল, ও রাগ করেনি।

একবার কেটে যাওয়ার পরও আবার ভাইব্রেট করেছে ফোনটা। গিনি ঘুমোচ্ছে।

বারবার উঠছে রাহুল কলিং…

কুণাল ফোনটা রিসিভ করতেই ওপ্রান্তের ছেলেটি কিছু না শুনেই বলতে শুরু করল, গিনি পারলাম না রে, মিঠিকে বাঁচাতে। বাচ্চাটা চলে গেল আমাদের ছেড়ে। তোর দেওয়া গয়না বেচা টাকায় অপারেশনটাও হয়ে গিয়েছিল কিন্তু কাল দুপুরের দিকে আবার ডিটোরিয়েট করল। ঘণ্টা খানেক আগেই, ছেলেটি কিছুই বলতে পারছে না আর, কান্নায় অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে ওর কথা।

কুণাল ফোনটা কেটে দিল।

সারারাত ছটফট করেছে কুণাল বিছানায় শুয়ে। কে ওই রাহুল? কার বাচ্চা মিঠি? গিনি কেন তার অপারেশনের জন্য গয়না বিক্রি করল?

এত প্রশ্নের ঘনঘটা নিয়ে ঘুমানো সম্ভব নয়। রাহুলের সাথে গিনির কী এমন সম্পর্ক? মিঠি কি রাহুল আর গিনির…

মাথাটা যন্ত্রণায় ফেটে যাচ্ছে কুণালের। আর ভাবতে পারছে না ও। গিনি যা স্মার্ট তাতে বিয়ের আগে কারোর সাথে লিভ ইন করাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়!

তাহলে হঠাৎ কুণালকে কেন এই প্রবঞ্চনা!

গুডমর্নিং বলে আড়মোড়া ভাঙল গিনি। চোখটা মেলে প্রথমেই হাত বাড়াল মোবাইলের দিকে।

কললিস্ট ব্ল্যাঙ্ক। গতকাল রাতে আসা কলটা ডিলিট করে দিয়েছে কুণাল।

তবে বাড়ি ফিরেই গিনির সাথে সামনা-সামনি কথা বলতে হবে। এত লুকোচুরি কুণালের কোনোদিনই পছন্দ নয়। ও বরাবরই জলের মতো স্বচ্ছ। তাই কলেজে স্বাতীর সাথে দু-মাসের প্রেমের ঘটনাটাও গিনিকে বলে দিয়েছিল বিয়ের আগেই। গিনি যদি মনে করে কুণালের কাছে নিজের জীবনের অন্ধকার দিকটা লুকিয়ে রেখে মুখোশ পরে সংসার করে যাবে, সেটা কোনো ভাবেই সম্ভব নয়।

বাথরুমে ঢোকার আগে গুনগুন করে গান গাইছিল গিনি। অন্যদিন হলে গিনির মুড এত ভালো আছে দেখে কুণাল খুশি হত কিন্তু কাল রাতের পর থেকে কোনো ভাবেই গিনির সামনে স্বাভাবিক হতে পারছে না কুণাল।

আবার গিনির ফোনটা বাজছে, রাহুলের ফোন…

ধৈর্যের শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে কুণাল।

গিনি বাথরুম থেকে তাড়াহুড়ো করে বেরিয়েই ফোনটা ধরল।

কুণাল অপলক তাকিয়ে আছে গিনির দিকে। গিনি বোধহয় এই মুহূর্তে চাইছে কুণাল ব্যালকনিতে বেড়িয়ে যাক, একটু আড়াল চাইছে গিনি। কুণাল নির্বিকার, আজ সামনে বসেই দেখবে ওই মাঝরাতে ফোন করা রাহুলের সাথে গিনির ঠিক কী সম্পর্ক!

গিনি কোনো কথা বলছে না, শুধু ও গোলাপি ঠোঁট দুটো তিরতির করে কাঁপছে আর দীঘল চোখ দুটো দিয়ে নোনতা জলের ধারা ওর গাল বেয়ে নেমে আসছে। চোখের জল মোছার কোনো তাগিদ অনুভব করছে না গিনি, সামনে যে কুণাল আছে সেটাও আর গ্রাহ্য করছে না। ফোনের ওপর প্রান্তে কী বলছে একটু হলেও আঁচ করতে পারছে কুণাল, কিন্তু গিনি কেন এত নিশ্চুপ সেটাই বোঝার চেষ্টা করছে। মিঠি বলে যদি কেউ একজন মারাও যায় সেটা যে গিনির কোনো কাছের আত্মীয় নয় সেটুকু ও নিশ্চিত। কারণ দু-দিন আগেই কুণাল গিনিকে জিজ্ঞেস করেছিল, ওর কোনো নিকট আত্মীয় বিপদে আছে কিনা! গিনি পরিষ্কার জানিয়েছিল, হঠাৎ এমন প্রশ্ন কেন কুণাল করছে, ওর কোনো আত্মীয় অসুস্থ নয়। গিনির ওই বিশেষ ফোনটা এলে ওর বাইরে বেরিয়ে যাওয়াটাই কুণালের মনের প্রশ্নের উৎস।

গিনি বিছানার চাদরটা খামচে ধরে কেঁদে চলেছে।

হঠাৎ কুণালের বুকে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল গিনি। এমনিতেই গিনি ঘটনা প্রবাহের জাল বিস্তার করে কুণালের ভাবনা চিন্তাকে অবশ করে দিয়েছে, তারপর এই আকস্মিক পরিবর্তনে ও সত্যিই হকচকিয়ে গেছে।

গিনি বিড়বিড় করে বলছে, পারলাম না কুণাল আমরা মিঠিকে বাঁচাতে পারলাম না। মাত্র সাত বছরের একটা মিষ্টি মেয়ে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেল।

‘মিঠি কে?’ এই প্রশ্নটা আপাতত কণ্ঠনালীর মধ্যেই জোর করে আটকে রাখল ও।

কান্নার দমকে গিনির পিঠটা ফুলে ফুলে উঠছে। চোখের জলে কুণালের টি শার্ট-র অংশ ভিজে যাচ্ছে।

কুণাল আস্তে আস্তে বলল, আমাকে বলো গিনি। আমি যদি কোনো হেল্প করতে পারি।

যদি সত্যিই গিনি বাড়ির চাপে কুণালকে বিয়ে করে থাকে, যদি সত্যিই রাহুলের সাথে থাকতে চায় তাহলে না হয় কুণালই পৌঁছে দেবে গিনিকে রাহুলের কাছে।

গিনি চলে যাবে ভাবতেই একটা অচেনা অনুভূতি চিনচিন করে উঠল হৃদয়ের কোনো গোপন স্থানে।

চোখ মুখে গিনি উঠে বসেছে।

কুণালের একটা হাত ধরে আছে এখনও।

কুণাল ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করেনি।

পাহাড়ে রোদবৃষ্টির খেলা চলছে। রোদেলা আকাশে গুড়িগুড়ি বৃষ্টির ফোঁটারা পাথুরে মাটি ছুঁতে চাইছে।

দু-দিকে রঙিন রিবন বেঁধে পাহাড়ি মেয়েগুলো পিঠে ব্যাগ নিয়ে সাত সকালেই স্কুলের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়েছে। চড়াই রাস্তা ধরে সাবলীলভাবে হেঁটে চলেছে, নিজস্ব ভাষায় কথা বলতে বলতে।

নিষ্পাপ মুখগুলোর অনাবিল হাসির দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে গিনি। ঘরের একদিকের দেওয়াল জুড়ে লাগানো কাচ দিয়ে বাইরের দৃশ্য পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে।

গিনির দৃষ্টি আকর্ষণ করে কুণালও তাকিয়ে আছে অনামী পাহাড়ের রাস্তার দিকে। রাস্তার ধারে ধারে রঙিন পতাকা হাওয়ায় দুলছে ভারবিহীন ভাবে।

গিনি বলতে শুরু করল, গলার স্বরটা যেন কোন সুদূর থেকে ভেসে আসছে।

আমি যখন কলেজে পড়ি তখন থেকেই ‘সানরাইজ’-এর সাথে যুক্ত। বাবা জানে না, কিন্তু মা জানত।

সানরাইজ একটা এনজিও সংস্থা।

না, কোনো বড়সড় এনজিও নয়, সরকারি অনুদান পাবার মতো বৃহৎ কাজ সেখানে হয় না। কলেজের বেশ কিছু বন্ধুবান্ধবের নিজেদের পকেট মানি বাঁচিয়ে শুরু হয়েছিল সানরাইজ। বাকিটা চলছিল চাঁদা তুলে। থ্যালাসেমিয়ার বাচ্চাদের জন্য ব্লাড ডোনেশন ক্যাম্প করাটাই আমাদের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল। কিন্তু কাজ করতে করতে দেখা গেল, থ্যালাসেমিয়ার মতো মহামারী রোগ আরও আছে। মিঠির যেমন ব্রেন টিউমার ছিল। আবার মুখে হাত চাপা দিয়ে কান্না চাপল গিনি। গলার আবেগ সামলে নিয়ে আবার বলতে শুরু করল ও।

সানরাইজ সবসময় চেষ্টা করেছে দুঃস্থ বাচ্চাদের পাশে দাঁড়াতে। বছর খানেক ধরে মিঠির জন্য আমরা টাকা জোগাড় করেছি, শেষপর্যন্ত আমার আর অন্যন্যার, দুজনের একটা করে সোনার গয়না পর্যন্ত বিক্রি করা হয়েছিল ওর ট্রিটমেন্টের জন্য। বেস্ট সার্জেন ওকে অপারেট করেছিল তবুও…

কুণাল অবাক হয়ে শুনছে, একটা বদমেজাজি, মুডি মেয়ের জীবনের কথা। দোলন পিসির একটা কথা মনে পড়ে গেল কুণালের, শুধু নামে নয়, গিনি আসলে খাঁটি সোনা।

গিনি বলে চলেছে, রাহুল, বিকাশ, রতনদা, মোনালিসাদি সকলে বলেছিল, আমি হানিমুন থেকে ফিরে গিয়েই মিঠিকে সুস্থ দেখব।

গিনিকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরেছে কুণাল। ওর প্রতিটা নিঃশ্বাস মিশিয়ে নিচ্ছে নিজের রক্তে। কোনো এক অচেনা মিঠির জন্য কষ্ট হচ্ছে কুণালের।

ধীরে ধীরে বলল, আমার কাছে কেন লুকিয়ে ছিলে গিনি? আমাকে কি খুব নিষ্ঠুর বলে মনে হয়েছে?

মাথাটা দু-দিকে নেড়ে গিনি বলল, মা বলেছিল বিয়ের পর আর এসব করলে শ্বশুরবাড়ির সকলে রাগ করবে।

ভাগ্যিস কুণালের মনটা গিনি দেখতে পায়নি। তাই কিছুক্ষণ আগেই ওকে নিয়ে ভাবা কদর্য রূপটা আড়াল করে গেছে অন্তত।

কুণাল বলল, যদিও আমি অপদার্থ, তবুও তোমাদের সানরাইজের নতুন সদস্যপদে আমার নাম বিবেচনা করা যায় কি?

টলটলে জল ভরা চোখে গিনি কুণালের দিকে তাকাল।

অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে আছে দেখে কুণাল বলল, স্বামী হিসাবে তো পাশ করতে পারিনি, তোমার কাজের সঙ্গী হিসাবেও কি গ্রহণীয় নয়?

গিনি কোনো কথা না বলে কুণালকে জড়িয়ে ধরেছে, এমন একজন জীবনসঙ্গীই সে চেয়েছিল মনপ্রাণ থেকে।

দূরের কোনো পাহাড়ি গ্রামের দেহাতি গানের সুরের আবছা শব্দ ভেসে আসছে ওদের ঘরে। বৃষ্টি ভেজা বুনো গাছের গন্ধে মাতাল হয়ে উঠছে মধুচন্দ্রিমার বাতাস।

সকল অধ্যায়

১. গেম ইজ ওভার – অর্পিতা সরকার
২. টুরিস্ট গাইড – অর্পিতা সরকার
৩. দ্য ড্রিম গার্ল – অর্পিতা সরকার
৪. দীর্ঘ প্রতীক্ষা – অর্পিতা সরকার
৫. পার্কের বেঞ্চটা – অর্পিতা সরকার
৬. স্বপ্নের পাসওয়ার্ড – অর্পিতা সরকার
৭. সেই টেলিফোন – অর্পিতা সরকার
৮. হিসেব না মেলা অঙ্ক – অর্পিতা সরকার
৯. লাইট ক্যামেরা অভিনয় – অর্পিতা সরকার
১০. অহংকার – অর্পিতা সরকার
১১. প্রেমের সাইডএফেক্ট – অর্পিতা সরকার
১২. পিতৃঋণ – অর্পিতা সরকার
১৩. অবয়ব – অর্পিতা সরকার
১৪. মধুচন্দ্রিমা – অর্পিতা সরকার
১৫. ভাড়াবাড়ির আত্মীয়রা – অর্পিতা সরকার
১৬. সময় থমকে গেছে – অর্পিতা সরকার
১৭. তেরোটা বছর – অর্পিতা সরকার
১৮. খেলনা বাড়ির মেয়ে – অর্পিতা সরকার
১৯. প্রসব বেদনা – অর্পিতা সরকার
২০. দেখা না দেখায় মেশা – অর্পিতা সরকার

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন