অর্পিতা সরকার
ফাল্গুনী সকালের নরম আলোর প্রথম রেখাটা এখন জানলার গ্রিলে এসে পড়েছে। কেমন একটা কুয়াশা কুয়াশা ঝাপশা আঁধার ছড়িয়ে আছে এখনও। শীত যেতে না যেতেই একটা উষ্ণ হাওয়ার আবেশ ছড়িয়ে পড়েছে। এই সময়টা সন্ধের দিকে গরম ভাব, আর ভোরের দিকে একটা হালকা ঢাকা পেলে আয়েশি ঘুমের সুবিধা হয় গোছের ব্যাপার হয়েছে। ভোরের দিকেই ঘুমটা ভেঙে গিয়েছিল অনামিকার, পাশেই সুদীপ্ত জড়সড় হয়ে শুয়ে আছে দেখে বেড কভারটা টেনে দিল ওর গায়ে।
ভোরে ওঠা ওর নিত্যদিনের অভ্যাস হয়ে গেছে। সকলের আগে টাইমকলের নীচে একটা বালতি পেতে লাইন দেওয়াটা ছিল নিত্যকাজের একটা। তখন থেকেই এই সময় মাথার ভিতরের এলামটা সতর্ক ভাবে বেজে ওঠে।
এপাশ ওপাশ করে আর লাভ নেই, নির্ঘুম চোখের ওপর জোর করে বন্ধ করে রাখার অত্যাচার আর না চালিয়ে উঠেই পড়ল অনামিকা।
উঠোনের মাঝে বাঁধানো বকুল তলাটার নীচে কেউ একজন গুটিসুটি মেরে বসে আছে। এই বাড়িরই সদস্য নিশ্চয়।
শিবু জ্যেঠু বোধহয়। বয়স্ক মানুষদের নিদ্রাবিহীন রাতগুলো বড় অত্যাচার করে। তাই ভোর না হতেই দম বন্ধ করা ঘর থেকে বেরিয়ে এসে মুক্ত হাওয়ায়, বোঝার চেষ্টা করে সত্যিই সকাল হয়েছে কিনা?
পাশের ঘর থেকে একটা মৃদু কান্নার রেশ কানে এল?
তবে কি আশা কাকিমা চলে গেলেন?
তিনদিন ধরে শ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছিল কাকিমার। অনামিকাকে কাছে ডেকে বলেছিলেন, কি রে মেয়ে তোদের যাবার আগেই বোধহয় আমি এ বাড়ি ছাড়ব। ভিতরটা কঁকিয়ে উঠেছিল অনামিকার, ওদের নতুন ফ্ল্যাটে উঠে যাওয়া আর কাকিমার চলে যাওয়ার মধ্যে যে বিস্তর ফারাক! বয়েস হয়েছিল ঠিকই, তবে মৃত্যুর তো সঠিক বয়েস নেই, তাই মনে হয় আর দুটোদিন কি গ্রেস পিরিয়ড দেওয়া যেত না?
দরজাটা খুলে পাশের ঘরের দিকে যেতেই চোখে পড়ল, আশা কাকিমা একটা সাদা চাদরে শুয়ে আছেন, হয়তো প্রতিটি পল গুনছেন প্রাণবায়ু বেরোনোর অপেক্ষায়।
প্রতিবেশী হলেও একটা ঢেউ ওঠেই। অনামিকারও মনে পড়ল, ওর দোপাটি গাছগুলোতে মাঝে মাঝে আশা কাকিমা জল দিয়ে দিতেন, আবার ফুলের সময় সাদা দোপাটি তুলতেন কৃষ্ণ পুজোর জন্য।
আজ আবার সুদীপ্তর সাথে যেতে হবে নতুন ফ্ল্যাটে। প্রথমদিন তো ঝাঁ চকচকে নতুন ফ্ল্যাটে পা দিয়েই চমকে উঠেছিল অনামিকা। সুদীপ্ত ওকে না জানিয়েই এত বড় ফ্ল্যাট পছন্দ করেছে! ওকে তো শুধু বলেছিল একটা ফ্ল্যাট বুক করেছে। সেটা এত বড়! ইন্টিরিয়ার ডেকোরেশনের লোকও হাজির, শুধু অনামিকার নির্দেশের অপেক্ষা। সুদীপ্ত এখন আইটি সেক্টরের যন্ত্রমানব। তার সব কিছুই নিখুঁত চাই। অনামিকা পরদা, সিলিং, কর্নার ডেকোরেশন সমস্ত কিছুর একটা মোটামুটি স্কেচ করে দিয়েছিল, এবার তো ওদের হাতে। ”টাকার জন্য চিন্তা করবেন না, শুধু মনের মতো করে সাজিয়ে তুলুন।” বলেছিল সুদীপ্ত।
স্যুটের কাপড় থেকে পায়ের স্যু পর্যন্ত এখন অহংকারে পরিপূর্ণ সুদীপ্তর। অবশ্য নিজের স্বামীর এই উন্নতি অনামিকার কাছেও যথেষ্ট গর্বের। তবে মাটির সাথে সম্পর্কবিহীন ওই ছ-তলার ফ্ল্যাটটা যেন হাওয়ায় ভাসমান। শিকড় ছাড়া বাড়ি, যেখানে ধরে রাখার টান নেই। অনামিকার এই ভাবনা সুদীপ্তর বিরক্তির কারণ। আজ বোধহয় কোথায় কী ফার্নিচার থাকবে তার আলোচনা হবে। নিজের এত বড়ো ফ্ল্যাট হচ্ছে জেনেও কেন যে অনামিকার মনে স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দ নেই, সেটার কারণ হয়তো ওর নিজেরও অজানা।
সুদীপ্ত ব্রাশ করছে, অনামিকার দিকে তাকিয়ে বলল, একটু তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নাও, প্রথমে ফার্নিচারের দোকানে যাব তারপর ফ্ল্যাটে। দুপুরে বাইরে কোথাও একটা লাঞ্চ করে নিলেই চলবে।
অনামিকা আশা কাকিমার কথাটা বলতেই সুদীপ্ত বলল, ভদ্রমহিলা যে ভাবে কষ্ট পাচ্ছিলেন তাতে বেঁচে থাকাটাই শাস্তি।
কী সহজ হয় এদের উত্তরগুলো, জন্ম-মৃত্যুর রহস্যগুলোর সমাধানও যেন জলের মতোই সোজা। এদের স্মৃতিতে ইলিশ মাছের মাথা দিয়ে আশা কাকিমার হাতের কচুর শাকের স্বাদ ম্লান হয়ে যায় সহজেই।
শুধু অনামিকার স্মৃতির পাতাগুলোতেই ধুলো জমে না বা লালচে হয়ে জ্বলে যায় না।
মৃত্যুপথযাত্রিনীকে পিছনে ফেলে অনামিকা আর সুদীপ্ত এগিয়ে গেল ওদের নতুন আশ্রয়ের ঠিকানায়।
অন্যমনস্ক অনামিকা বিলাসবহুল ফ্ল্যাটের জন্য, আরামদায়ক, সুবিধাজনক সমস্ত নামী দামি ফার্নিচার পছন্দ করল।
সুদীপ্ত ফ্ল্যাটের দরজার সামনে উত্তেজিত হয়ে বলল, অনু আমাদের নিজেদের গেটের সামনে থাকবে একটা নেমপ্লেট তাতে আমাদের দুজনেরই নাম থাকবে। ক্লান্ত হাসি হেসে সম্মতি জানাল অনামিকা। ভাগের কলতলা, বারোয়ারি উঠোন, সার্বজনীন ডাকবক্স— কোনোটাই আর প্রয়োজন হবে না।
বাড়ি ফিরতে প্রায় ঘণ্টা তিনেক লেগে গেল। গলির মোড়ে ওরা ট্যাক্সি থেকে নেমে পড়ল। এই ব্যানার্জী লেনের বাড়িটার গলিতে গাড়ি ঢোকে না বলে প্রায় প্রতিনিয়তই অসন্তুষ্ট হয় সুদীপ্ত।
বাড়িতে ঢুকেই নিজের নয়নতারার চারাগুলোতে জলসিঞ্চনের কাজে লেগে পড়ল অনামিকা। আহা রে! মাটিটা শুকিয়ে গেছে। সামান্য জলটুকুও যদি না পায় তাহলে ফুল দেবে কী করে।
নিজের মনেই ভাবতে লাগল ও। ফ্ল্যাটের কর্নারে বেশ কিছু ক্যাকটাস আর অর্কিড লাগাবেন বলেছিলেন ইন্টিরিয়র ডেকোরেশনের লোকেরা।
নিশ্চয় তাদের জল লাগে না, তারা নিশ্চয় সুদীপ্তর মতোই পাথুরে। ফুলের ভারে তারা গর্ভবতীর মতো নুয়েও পরবে না।
অনামিকার মন অভিমানে পরিপূর্ণ… একটা কি উঠোনওয়ালা ছোট্ট বাড়ি কিনতে পারল না সুদীপ্ত! যেখানে বৃষ্টি পড়লে সোঁদা মাটির গন্ধ পাওয়া যাবে। ওই আকাশচুম্বি ফ্ল্যাটের কী খুব দরকার ছিল!
বাড়ি থেকে পালিয়ে যখন সুদীপ্তকে বিয়েটা করেছিল, তখন সুদীপ্তর এক মামা এই ভাড়া বাড়িটা দেখে দিয়েছিল ওদের জন্য। সুদীপ্তর বাবা আগেই গত হয়েছিলেন। দুই দাদার সংসারে ওর মা থাকতেন। সেখানে অনামিকাকে দুই জা মোটেই মেনে নেয়নি। তখন থেকেই এই বারোয়ারির কলতলায় ঠেলা ঠেলি করে জল নিয়ে অনামিকার ছোট্ট পুতুল পুতুল অনভিজ্ঞ সংসার চলতে শুরুর করেছিল। তখন সুদীপ্ত ছোট্ট একটা চাকরি করত। তাই এর থেকে আর বেশি সামর্থ ছিল না ওর।
সুদীপ্তকে বিয়ে করে একটা অনিশ্চয়তার পথে পাড়ি জমাতে সেদিন ভয় করেনি অনামিকার। মনে হয়েছিল ওর ভীষণ চেনা মানুষটা তো আছে ওর সাথেই। অনামিকাকে সেদিন অনেক শুভাকাঙ্ক্ষী বন্ধুবান্ধব বলেছিল, ভবিষ্যৎ না ভেবে এত বড় সিদ্ধান্ত নেওয়াটা ওর জীবনের চূড়ান্ত ভুল হতে চলেছে। অনামিকা বিশ্বাস করত, সুদীপ্ত পারবেই নিজেকে প্রমাণ করতে। সেদিন শুধু নিজের স্বচ্ছল জীবনের আকাঙ্ক্ষাটাই মূল্যবান ছিল না ওর কাছে, গুরুত্বপূর্ণ ছিল ওদের ভালোবাসাকে পরিণতি দেওয়া। অনেক যুদ্ধের শেষে রাত্রির ঘন অন্ধকার কেটে গিয়ে প্রকৃতির চিরাচরিত নিয়মের মতোই আবছা হলেও আলো এসেছিল ওদের জীবনে। আর সেই আবছা আলোটুকু তখন বহন করে এনেছিল, এই ভাড়াবাড়ির এককুঠুরী ঘরটাই।
ওদের বিয়ে হয়েছে প্রায় তিন বছর। গতবছর অনামিকা নিজের গর্ভে নতুনের আগমন বার্তাও শুনেছিল কিন্তু সুদীপ্ত তখন বাবা হতে চায়নি। এই নিম্ন মধ্যবিত্তের ভাড়ার বাড়িতে নাকি তার সন্তান আসবে না। তাতে নাকি বাবা হিসাবে সুদীপ্তর অক্ষমতা প্রকাশ পাবে। তারও অবুঝ মন কাঁদছে, মাকে চাক্ষুস না দেখতে পেয়ে। আবার ফিরে আসবার প্রতিশ্রুতি পেয়ে সে বিদায় নিয়েছিল ভ্রূণেতেই।
অনেক টাকা রোজগারের চেষ্টায় কবে যে সুদীপ্ত যন্ত্রমানবে পরিণত হয়ে গেল, অনামিকা বুঝতেও পারল না। হয়তো সুদীপ্ত শুধুমাত্র অনামিকাকেই সাচ্ছন্দ্য দেবার চেষ্টা চালায় প্রতিনিয়ত। অনামিকার আত্মীয়দের কাছে জামাই হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার লড়াইয়ে সুদীপ্ত নিমগ্ন, কিন্তু ওর তো পলেস্তরা খসা, দিনের বেলাতেও লাইট জ্বেলে রাখা ঘরটাকেই নিজের মনে হয়। এখানে নুন, চিনির কৌটোগুলো, সিঁড়ির নীচের রান্না ঘরটাকে ওর বড় আপন মনে হয়। নিজের হাতে বসানো দোপাটি, জবা গাছগুলোকে আত্মীয় মনে হয়। এদের ছেড়ে যেতে হবে ভেবেই মনের ভিতরটা গুমরে ওঠে অনামিকার।
জিনিসপত্র প্যাকিং শুরু হয়ে গেছে অনামিকার। পাশের ঘরে বউদিরা যারা প্রায় আট-দশ বছর ওই ভাড়া বাড়িতেই কাটিয়ে দিল জীবন, তারা অনামিকার ভাগ্যকে হয়তো ঈর্ষা করছে। কিন্তু বিয়ের পর এই ভাঙা উঠোনই যেন ওকে বউ রূপে বরণ করেছিল, নাই বা ছিল আলতা চোবানো পা। তবুও বউ হয়ে প্রথম পদচিহ্ন রেখেছিল এই উঠোনটায়। এই ছোট্ট রান্নাঘরই ওকে দিয়েছিল, ঘরণীর অধিকার। আজ এদেরকে কী এক নিমেষে ভুলে যেতে বসেছে অনামিকা! ভিতরের ঘুণপোকার দংশনের আওয়াজটা যন্ত্রণাদায়ক। কাউকে হয়তো বোঝানোও সম্ভব নয়, পুরোনো বট গাছ কেটে দিলেও কেন তার শিকড়টা সেই মাটির অন্তরেই থেকে যায়।
ওই আল্ট্রামর্ডান ফ্ল্যাট দেখে আসার পরও কেন এই গলির বাড়িটার জন্য অনামিকার মন হু হু করছে!
কাল থেকে ওই বল্টুর মা আর বলবে না, ”অনামিকা তোমার কাছে তেজপাতা আছে গো? দুটো দাও না আমাকে!” অনামিকা কয়েত বেলের আচার মেখে ওই উঠোনের এক কোণে শুকোতে দেবে না যেটা থেকে পাশের ঘরে রঞ্জু চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ে বলবে, ”কাকিমা একটু খেলাম, দারুণ মেখেছ। আমাদের স্কুলের সামনে এত ভালো মাখে না তো!”
হয়তো শিবানী বউদি তিনটে বাড়ির পরের রায়েদের বাড়ির কর্তা গিন্নির ঝগড়া রসিয়ে বলতেও আসবে না আর অনুর কাছে।
কাজের মেয়ে শিউলি, মুখ ঝামটা দিয়ে বলবে না, এই এবড়োখেবড়ো উঠোনে বাসন মাজা যায় না বাপু, আর কোনোদিন ওই শ্যাওলা ধরা কলতলাতেও পড়ে হাত-পা ভাঙবে, কাল থেকে লোক দেখে নিও, আর কাজ করতে পারবুনি।
শিবু জ্যেঠু আর বলবে না, খবরের কাগজের এই ছোট্ট ছোট্ট লেখার পাতাটা একটু পড়ে দেবে, এত ছোট লেখা নজর হয় না।
বৃষ্টির দিনে রাতুল কাগজের নৌকা বানিয়ে জল জমে যাওয়া উঠোনে ভাসানোর জন্য আর বায়নাও তো করবে না।
অনামিকার আজও মনে আছে, এই বাড়ির রেলিংবিহীন খোলা সিঁড়ি দিয়ে ও, শিবানী বউদি আর বল্টুর মা তিনজনে চিলেকোঠার ঘরের জানলায় চোখ রেখেছিল, পাশের বাড়ির নতুন বর-বউয়ের কথা শুনবে বলে। আর যেদিন প্রথম অনামিকা সয়াবিন আলুর ঝোল রান্না করতে গিয়ে পুড়িয়ে ফেলে মন খারাপ করে বসেছিল, সেদিন আশা কাকিমা ওদের ঘর থেকে ফুলকপির তরকারি দিয়ে গেছিস লুকিয়ে লুকিয়ে। সুদীপ্ত জানতেও পারেনি অনামিকা রান্না করতেই পারে না। এদের কাছ থেকেই অনভিজ্ঞ অনামিকা প্রতিদিন একটু একটু করে সংগ্রহ করেছে সব টুকিটাকি।
যখন সুদীপ্ত তিন দিনের জন্য টাটায় চলে গিয়েছিল ট্যুরে, তখন তো ভূতের ভয়ে নতুন বাড়িতে ঘুমুতেই ভয় করত অনামিকার। শিবানী বউদির একটাই শর্ত ছিল রাতে অনামিকার কাছে শুতে পারে, কিন্তু অনেক রাত পর্যন্ত গল্প করতে হবে।
এই চৌকি টাইপের খাটটা যেটা সুদীপ্তর নতুন ফ্ল্যাটে বেমানান বলে বেচে দিচ্ছে সুদীপ্ত… সেটাতেই ওদের পালিয়ে বিয়ের ফুলশয্যা হয়েছিল।
প্রথম সুদীপ্তর স্পর্শে অনামিকা মেয়ে থেকে স্ত্রী হয়ে উঠেছিল।
শুধু ঘরের রংচটা সিলিংটা সব জানে। বাবা-মায়ের জন্য রোজ মনখারাপের নোনতা জলে ভিজে যেতে যেতে এই বালিশটাই ওকে সান্ত্বনা দিত, একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। এই পরম আত্মীয়দের ছেড়ে অনামিকা কি পারবে ওই কংক্রিটের জঙ্গলে আবার নিজের সংসার গোছাতে! পারবে হয়তো! কারণ মেয়েরা তো জলের মতো।
বিয়ের পর এমন একটা ভাড়া বাড়িতে নিম্নমধ্যবিত্তের মতো থাকে বলে, প্রায় কোনো আত্মীয়ই ওর সাথে সহজ ভাবে সম্পর্ক রাখেনি, তা সত্ত্বেও কখনো একা মনে হয়নি ও নিজেকে। গ্রীষ্মের সন্ধেতে দড়ির ক্যাম খাটে ওরা বসত মশলামুড়ি মেখে। কখনো অনু খালি গলায় গাইত, রুমকি নাচতে শুরু করত হাত পা ঘুরিয়ে। হাজার অভাব অভিযোগের মধ্যেও কোথায় একটা আত্মার টান ছিল, সম্পূর্ণ অপরিচিত অন্য জায়গা থেকে আসা মানুষগুলোর মধ্যে। সুদীপ্ত এগুলোর কিছুই জানে না, বরঞ্চ ওদের সাথে বেশি মিশলে ও বিরক্ত হত।
ভোরবেলা উঠে টাইমকলে প্রথম বালতি রাখতে পারার উত্তেজনাটাই ছিল আলাদা, ভুটান বাম্পার লটারিতে প্রাইজ জেতার মতো।
তারপর বাড়িওয়ালার গাছে ঝড়ের দিনে লুকিয়ে আম কুড়োনো তো ছিলই।
এসব ভাবতে ভাবতেই সন্ধ্যা নেমেছে। আজ আর ভাড়াবাড়ির তুলসী তলায় প্রদীপ জ্বলেনি। আশা কাকিমা চলে গেছেন বলে অপেক্ষায় রয়েছে এ বাড়ির সমস্ত অনাত্মীয়েরা।
এই অনাত্মীয়েরাই একদিন অনামিকাকে একাকীত্বের জ্বালা অনুভব করতে দেয়নি।
হয়তো এই অনামিকাই ওই ফ্ল্যাটের গৃহপ্রবেশে সকলকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নিজের ঐশ্বর্য দেখাতে ব্যস্ত থাকবে। তখন নিশ্চয় মনেই থাকবে না বিপদের দিনে আশ্রয় দেওয়া এই ভাড়ার বাড়িটাকে। কারণ সে তো নিজের নয়, সে সমস্তটুকু দিয়ে আপন করে নিলেও কখনো অধিকার ফলাতে পারে না… বলতে পারে না ”এখানেই থেকে যাও, আমাকে ফাঁকা করে যেও না।” সময়ের ব্যবধানে সেও তখন আবার নতুন গলার স্বর শোনার জন্য প্রস্তুত হবে।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন