অর্পিতা সরকার
নাচের কল শোগুলোর দিন সত্যিই বড় পরিশ্রম হয় তানিয়ার। নিজের নাচের ট্রুপকে রেডি করা তারপর আবার একক নৃত্য থাকে তানিয়ার।
বিশাল ড্রয়িং রুমের শোফায় ক্লান্ত শরীরটাকে নিশ্চিন্তে ছেড়ে দিল তানিয়া চ্যাটার্জী।
বিখ্যাত ওডিসি শিল্পী তানিয়া এখন নিজের ঘরানা ছেড়ে একটু আধটু ফিউশান ডান্সে মন দিয়েছে। এই নিজের মস্তিষ্ক প্রসূত ক্ল্যাসিক্যাল ডান্সের সাথে বাজার চলতি আধুনিক গানের মেলবন্ধনটা ভীষণভাবে প্রশংসিত হয়েছে দর্শক মহলে।
আজ যে কল শোটা ছিল সেটা কলকাতার বাইরে। মোটা টাকার অফার ছিল বলেই এক কথায় রাজি হয়েছিল তানিয়া। মাঝে মাঝেই নাচের ফুল কস্টিউম পরে আয়নার সামনে দাঁড়ায় বছর ছত্রিশের তানিয়া। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে নিজেকে। শরীরের কোন অংশে বয়স চুপি চুপি বাসা বাঁধছে না তো?
যদিও ওকে স্টেজে দেখলে বছর ছাব্বিশের বেশি মনে হয় না। দশ বছর কমিয়ে রাখতে পেরেছে নিজের চেষ্টায়। তানিয়ার ছেলে যে এখন ক্লাস সিক্সে পড়ছে, ওকে দেখে কে বলবে? যেহেতু ছেলে হোস্টেলে থাকে তাই অনেকেই জানে না তানিয়ার কোনো সন্তান আছে। তানিয়ার বর দীপাঞ্জন নিউরোলজিস্ট। ব্যস্ত ডাক্তার। সত্যি বলতে কী ওই পুজোর ছুটিতেই যা তিনজনে একসাথে হয়।
বেশিরভাগ সময়ই ফরেনট্রিপ করে ওরা। গত বছর ইতালি গিয়েছিল এবছর কোথায় যাবে এখনও ঠিক করেনি তানিয়া। দীপাঞ্জনের কোনো নিজস্ব ইচ্ছা নেই। ওষুধ কোম্পানিগুলো যেখানে পাঠাবে সেখানেই রাজি হয়ে যায় ও। তানিয়া তাও দু-একবার চেঞ্জ করিয়েছে বেড়ানোর স্পট। ওদের এই নাগেরবাজারের বিশাল বাড়িটায় যে কেউ একবার তাকালেই বুঝতে পারবে কী প্রচণ্ড পরিমাণে ঐশ্বর্যের ছড়াছড়ি। প্রাচুর্যের সম্ভারে অহংকার পরিস্ফুট।
বাইরে গাড়ির আওয়াজ। তার মানে দীপাঞ্জন এল।
তানিয়া জোরে হাঁক পাড়ল, কণক পিসি, দীপ এসেছে, ডিনার টেবিল রেডি করো।
দীপের সাথে তানিয়ার বিয়েটা একেবারেই কাকতালীয়ভাবে হয়েছিল। তানিয়ার পিসতুতো দিদি রিয়ার সাথে দীপের বিয়ের সব ঠিকঠাক হয়ে গিয়েছিল। অ্যারেঞ্জ ম্যারেজে যা হয়, দুই বাড়ি কথা বলে, একবার ছেলে আর মেয়ে সামনাসামনি দেখা করে বিয়ের ডেট ফাইনাল। যদিও দীপ তখন বিখ্যাত নিউরোলজিস্ট দীপাঞ্জন চ্যাটার্জী হয়ে ওঠেনি। সবে সবে চেম্বারে বসতে শুরু করেছে ও।
তানিয়ার বড় পিসেমশাই তখনকার দিনে পাশ করা হোমিওপ্যাথি ডাক্তার। দীপের বাবা পিসেমশাইয়ের ওষুধকে ধন্বন্তরী বলতেন। সেই থেকে আলাপ। পিসেমশাইকে দীপের পরিবার খুবই সম্মান করতেন। সেই সূত্রেই বড় পিসির মেয়ে রিয়াদির সাথে দীপের বিয়ের কথাবার্তা ফাইনাল হয়েছিল। রিয়াদি তখন মাস্টার্সের ফাইনাল দেবে। বরাবরই তানিয়াদের ভাইবোনেরা রাসভারী বড় পিসেমশাইকে একটু ভয়ই পেত। এমনকী তানিয়ার মা পর্যন্ত নন্দাইয়ের সাথে হাসি মশকরা করে কথাও বলেনি কোনোদিন। তানিয়ার বাবার একটা মুদিখানার দোকান ছিল। দুই কাকা-কাকিমা, খুড়তুতো ভাইবোনেদের নিয়ে তানিয়াদের যৌথ পরিবারে আলাদা করে আদরযত্ন কিছুই পায়নি তানিয়া। মধ্যবিত্ত বাড়ির আর পাঁচটা বাচ্চা যেভাবে মানুষ হয় সেভাবেই মানুষ হয়েছে ও। পাড়ার রেবতীদির কাছে নিজের ইচ্ছেয় নাচ শিখেছিল তানিয়া। স্কুলের ফাংশানে ওর নাচ দেখে অনেকেই বলেছিল, একদিন নৃত্যশিল্পী হবে।
মা বলেছিল, নাচুনে মেয়েদের বিয়ে দেওয়া ভার। তবুও টিভি চ্যানেল দেখে নাচ তুলত তানিয়া। রেবতীদি ছিলেন ওডিসি শিল্পী। তাই গুণী ছাত্রী পেয়ে তানিয়াকে সবটুকু ঢেলে দিয়েছিলেন।
দীপ ফিরেই ওয়াশরুমে ঢুকেছে। তানিয়া হাঁক পাড়ল ডিনার রেডি…।
দীপের বিয়েটা যদি সেদিন রিয়াদির সাথে হয়ে যেত তাহলে হয়তো তানিয়া আজ প্রখ্যাত নৃত্যশিল্পী তানিয়া চ্যাটার্জী হতেই পারত না।
দীপের ব্যাঙ্ক ম্যানেজার বাবা আর বড় পিসেমশাই দুজনে মিলে ফাল্গুনের এক সন্ধ্যায় রিয়া আর দীপাঞ্জনের বিয়ের দিন নির্ধারণ করেন। তানিয়া তখন ফিলোজফি অনার্সের ফাইনাল ইয়ারের ছাত্রী। পড়াশোনাতে কোনোকালেই খুব ভালো ছিল না তানিয়া। তবে খুব খারাপও নয়। ওর ধ্যানজ্ঞান ছিল নাচ। ঘুঙুরের আওয়াজে ওর পা দুটো আপনা আপনিই তাল দিতে শুরু করত।
কলেজে ওঠার পরেই তানিয়া দুটো টিউশানি পড়াতে শুরু করেছিল। ওই টিউশানির টাকায় কত্থক শিখতে শুরু করেছিল ও। নাচের বিভিন্ন ঘরানা বরাবরই ওকে আকর্ষণ করত।
রিয়ার বিয়ের দিন সকাল থেকেই তানিয়া সেজেগুজে পিসির বাড়িতে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। বিবাহযোগ্যা মেয়ে থাকলে বাবা-মায়ের চিন্তার শেষ থাকে না। মা হয়তো দু-চারজনকে তানিয়ার জন্য পাত্র দেখতে বলেছিল কথায় কথায়।
দীপ ফ্রেশ হয়ে এসে খেতে বসেছে। তানিয়াকে জিজ্ঞেস করল আজকের প্রোগ্রাম কেমন হল?
অন্যমনস্ক তানিয়া বলল, জানো দীপ আজ সন্ধের থেকেই আমাদের বিয়ের দিনের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। খাওয়া থামিয়ে তানিয়ার চোখের দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল দীপ।
তানিয়া বলল, আজ তো আমার জায়গায় রিয়াদির থাকার কথা ছিল তাই না?
দীপ ধীরে ধীরে বলল, না নৃত্যশিল্পী তানিয়া ভট্টাচার্যর জায়গায় রিয়া কখনোই বসত না। রিয়া হয়তো মিসেস দীপাঞ্জন চ্যাটার্জী হতে পারত কিন্তু তানিয়া চ্যাটার্জী নয়। তানিয়ার বিয়ে আগে সারনেম ছিল ভট্টাচার্য।
দীপের বেশ অহংকার আছে নিজের স্ত্রীর এই পপুলারিটি নিয়ে। বেশ কয়েকবার ওর সাথে পার্টিতে গিয়ে তানিয়া দেখেছে; দীপ বেশ মজার ছলেই বন্ধুদের বলে, ডাক্তারদের কাছে তো লোকে দায়ে পড়ে আসে, কিন্তু হৃদয়ের টানে তো তানিয়ার নাচ দেখতে যায় হাজার হাজার টাকার টিকিট কেটে। সুন্দরী গুণী স্ত্রীকে নিয়ে নিউরোলজিস্ট দীপাঞ্জন চ্যাটার্জীর বেশ গর্বই হয়। বিয়ের পরে দীপের আগ্রহেই তানিয়া আবার নাচ শুরু করেছিল। দীপের চেম্বার, নার্সিং হোম এসবের জন্যই ওরা কোন্নগরের শ্বশুরবাড়ি থেকে নাগেরবাজারের এই বাড়িতে শিফট করে। নাগেরবাজারের এই বাড়িটা আসলে ছিল এক রিটায়ার্ড প্রফেসরের। প্রফেসরের ছেলে ব্যাঙ্গালোরে চলে যাওয়ায় বাবাকে ও সঙ্গে করে নিয়ে যায়, আর তখনি দীপ এই বাড়িটা কিনে নেয়।
দীপের বিয়ের দিন রাতে রিয়া পালিয়ে গিয়েছিল পাড়ার অরূপদার সাথে। রিয়া নাকি অরূপদাকে ভালোবাসত। সেটা জেনেও পিসেমশাই ডাক্তার জামাইয়ের লোভে কিছুটা জোর করেই রিয়ার বিয়ে দিচ্ছিলেন দীপের সাথে।
বর তখন বিবাহ আসরে উপস্থিত এদিকে পাত্রী পালিয়েছে। দীপের বাবা অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে বললেন, আমি এই আসরেই ছেলের বিয়ে দেব, পাত্রী খোঁজ।
তানিয়ার ছোট পিসি সকালেই শুনেছিলেন তানিয়ার মা ওর বিয়ের জন্য পাত্র খুঁজছেন, তাই কাল বিলম্ব না করে তানিয়াকে টানতে টানতে নিয়ে এসেছিল, দীপের বাবার সামনে।
তানিয়া কিছু বোঝার আগেই দীপের সিঁদুর উঠেছিল ওর মাথায়।
রিয়ার জন্য কেনা বেনারসি পরেই শ্বশুরবাড়িতে পা রেখেছিল তানিয়া।
বাসর রাতে কানে কানে দীপ বলেছিল, আমি বোধহয় জিতলাম।
ততক্ষণে তানিয়া ভালো করে তাকিয়ে দেখেছিল ওর ভবিষ্যতের জীবন সঙ্গীর দিকে।
বেশ হ্যান্ডসাম আর বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা দীপাঞ্জনের। কাকুতির গলায় তানিয়া বলেছিল, সামনেই আমার গ্রাজুয়েশানের পরীক্ষা, নাচের ক্লাস! এখন কী হবে?
দীপ ভরসার গলায় বলেছিল, সব হবে, আরও ভালো করে হবে।
সত্যি সব হয়েছিল। আর হয়েছিল বলেই আজ পপুলারিটির এই প্রান্তে পৌঁছতে পেরেছে।
দীপ শান্ত গলায় বলল, তানি, এত পরিশ্রম করছ, মাঝে মাঝে একটু রেস্ট করো। নাহলে কিন্তু শরীর ভাঙবে।
তানিয়া আদুরে চোখে বলল, ডাক্তারবাবুর আদর কবে কাজে আসবে?
কাল পুরো ছুটি নিয়েছি। শুধু সন্ধের দিকে একবার বাবাইয়ের হোস্টেলে যাওয়ার চেষ্টা করব। রবিবার ছাড়া তো আবার নরেন্দ্রপুর মিশনে ছেলের সাথে দেখাও করতে পায় না। তাও আবার সব রবিবার নয়। নির্দিষ্ট দুটো রবিবার।
ছেলের কথায় মুখে হাসি ফুটল দীপের। কখন যাবে তুমি? তাহলে না হয় আমিও চেষ্টা করব চেম্বার থেকে আর বিকেলের দিকে নার্সিং হোমে না গিয়ে একবার বাবাইকে দেখে আসার?
রবিবার ছুটির সকালে একটু বেশিই আলস্য এসে ঘিরে ধরেছে তানিয়াকে। দীপ নার্সিং হোমে বেরিয়ে গেলেও ওর বিছানা ছাড়তে ইচ্ছে করছে না। ছেলেটা চিকেন দো পিঁয়াজা খেতে চেয়েছিল। আজ একটু বানিয়ে নিয়ে যেতে হবে। কনক পিসিকে বলে রাখতে হবে সব অ্যারেঞ্জ করে রাখতে।
বার দুয়েক বেলের আওয়াজে সচকিত হল তানিয়া।
নিউজপেপার তো দিয়ে চলে গেছে, দুধওয়ালা নয়। তাহলে কি দীপের কোনো পেশেন্ট নাকি রে বাবা। কেউ কেউ তো এতটাই নাছোড় হয় যে বাড়ি পর্যন্ত খুঁজে চলে আসে! নাকি কোনো উঠতি নৃত্যশিল্পী! হয়তো স্টেজ শো করার জন্য সুযোগ করে দিতে অনুরোধ করতে এসেছে।
সকাল সাড়ে ন’টা বেজে গেছে। রাত পোশাকটা পরিবর্তন করে সালোয়াড় পরে নিল তানিয়া।
লক্ষ্মণ এসে খবর দিল ম্যাডাম একজন দেখা করতে এসেছে।
ভ্রূ কুঁচকে তানিয়া বলল, কোনো প্রোগ্রাম অর্গানাইজার?
লক্ষ্মণ বলল, না ম্যাডাম, একজন মহিলা। বলল, আপনার ছোটবেলার বান্ধবী।
নিজের মনেই হেসে নিল তানিয়া। তা বটে, টাকা আর সম্মান হলে ছোটবেলার বান্ধবীরা সংখ্যায় বেড়ে যায়।
পরিচিত কেউ নয়। পরিচিত কেউ হলে নিশ্চয়ই কল করেই আসত। নিশ্চয়ই কোনো সুবিধাবাদী।
একটু বিরক্ত হয়ে চুলে দু-বার চিরুনিটা বুলিয়ে নিয়ে বসার ঘরের দিকে পা বাড়াল তানিয়া।
সোফায় বসে যে মহিলা ওর বাড়ির ইন্টেরিয়ার ডেকরেশনের কাজ ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছিল সে আর যাই হোক তানিয়ার ফ্রেন্ডসার্কেলের কেউ নয়। এত সাধারণ সিন্থেটিক শাড়ি পরে ওর কোনো বান্ধবী রাস্তায় বেরোয় না অন্তত।
নিশ্চয়ই সাহায্যপ্রার্থী। হয়তো গেটের সিকিউরিটি আটকাবে ভেবেই বন্ধুত্বের আবরণে ঢেকেছে নিজের দারিদ্র।
অত্যন্ত সাধারণ একটা সস্তার শাড়ি, গাল ভেঙে গেছে, চুলের পিছনে গার্ডার করা রুক্ষ চুলের খোঁপা।
তানিয়ার স্লিপারের আওয়াজ পেয়েই মহিলা এদিকে দৃষ্টিপাত করল।
আরেব্বাস তুই তো এখনও একই আছিস রে তানিয়া।
সর্বনাশ! তানিয়া চ্যাটার্জীকে ডিরেক্ট তুই তো ওর ক্লাবের বান্ধবীরাও বলে না।
মহিলাটি একমুখ হেসে বলল, চিনতে পারিসনি তাই না?
বীণাপাণি বালিকা বিদ্যালয়, যুবসঙ্ঘ ক্লাব।
বেশ খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে মেমরি বক্স হাতড়ে খুঁজে বার করে নিয়ে এল তানিয়া। তুই নমিতা না?
একমুখ হেসে সোফার কুশানে গা এলিয়ে দিয়ে বলল, রেখা ম্যাডামের কাছে ফুল মার্কস পাবার আনন্দ পেলাম রে।
তানিয়াদের স্কুলের ইংরাজির ম্যাডাম রেখা রায়ের কাছে ফুল মার্কস পাওয়া ছিল স্বপ্নের মতো। উনি এতটাই নিখুঁত ছিলেন যে, কোনোভাবেই এক নম্বর ভুল করে দিয়ে ফেলতেন না।
তানিয়া বলল, কিন্তু নমিতা তোর চেহারা এমন হয়েছে কী করে রে? সেই গোলগোল ফোলা ফোলা গালগুলোই বা কোথায় গেল?
নমিতা বলল, রোগে রোগে জেরবার। কী নেই বল! ডায়াবেটিস, ইউরিক অ্যাসিড সব ধরেছে রে। তুই বয়সটাকে কলেজের তানিয়াতেই ধরে রেখেছিস।
কী সুন্দর তোর বাড়িটা।
তানিয়ার অভ্যস্ত কানে এই প্রশংসা বাক্যগুলো আর নতুন কোনো আবেদন নিয়ে ধরা দেয় না, বরং না শুনলেই অবাক হয় ও।
নমিতার সঙ্গে লাস্ট দেখা হয়েছিল উচ্চমাধ্যমিকের শেষ পরীক্ষার দিন। তারপরই হঠাৎ করে ওর বিয়ে হয়ে যায়।
তানিয়া বলল, তুই এখন কোথায় থাকিস রে? তোর স্বামী কী করেন?
একটা দীর্ঘশ্বাস সাবধানে ভিতরে চেপে নিয়ে নমিতা বলল, আসলে অনেকদিন ধরেই তোর কাছে আসব ভাবছিলাম। আজকাল তো প্রায়ই টিভিতে তোর মুখ দেখি। আমি তো আমার স্বামীকে আর মেয়েকে দেখাই, জানো তানিয়া আমার ছোটবেলার বান্ধবী। ওরা বিশ্বাস করতেই চায় না। আমি ওই কেষ্টপুরের ওদিকটাতে থাকি রে। পলাশের সাথে যখন বিয়ে হয়েছিল তখন ও একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করত। সে কোম্পানি উঠে গেল।
এতক্ষণে তানিয়া বুঝতে পেরেছে ঠিকানা খুঁজে পুরোনো বান্ধবীর সাথে দেখা করতে আসার উদ্দেশ্য।
হ্যাঁরে, তোর হাজবেন্ট তো ডাক্তার না রে?
তানিয়া চায় ওকে সকলে দীপের কথা জিজ্ঞেস করুক। হয়তো কোনও সাক্ষাৎকারে তানিয়ার সম্পর্কে সব পড়েছে নমিতা। দীপের কথা কাউকে বলতে গেলে অটোমেটিক্যালি তানিয়ার চোখে মুখে একটা প্রচ্ছন্ন অহংকার এসে ভিড় করে। আজও তার ব্যতিক্রম হল না।
নমিতার সাথে এতক্ষণ কথা বলছে দেখেই কনক পিসি বুঝে গেছে নিশ্চয়ই বেশ পরিচিত কেউ। তাই লুচি তরকারি সাজিয়ে নিয়ে এসেছে এখানেই।
নমিতা বলল, এসব কেন রে।
তানিয়া বলল, এটুকু খেয়ে নে। তোর মেয়ে কীসে পড়ে?
বিগলিত কণ্ঠে নমিতা উত্তর দিল, এই ক্লাস এইটে রে। আমার মেয়ে বলে বলছি না, ওই ব্যাপারে ভগবান আমাকে কৃপা করেছে রে। মেয়ে আমার পড়াশুনাতে খুবই ভালো রে।
নমিতা খেতে শুরু করেছে। খেতে খেতে বলছে, হ্যাঁরে তোর কোনো ছেলেমেয়ে নেই।
তানিয়ার ছেলে সিক্সে পড়ে শুনে বলল, তোকে দেখে কে বলবে এত বড় ছেলের মা! এটাও ভীষণ চেনা প্রশংসা তানিয়ার কাছে।
রবিবারের সকালটা নমিতার সঙ্গে বকে বকেই শেষ হবে মনে হচ্ছে। এত কথা না বলে যদি নমিতা ডিরেক্ট বলত, তানিয়া আমার বড় অভাব কিছু টাকা সাহায্য কর। তাহলে বোধহয় চেকটা লিখে দিয়ে বিদেয় করতে পারত তানিয়া। তবে বারবার সাহায্য করতে পারবে না তানিয়া। একবারে কুড়ি হাজার মতো দিতেই পারে কিন্তু নমিতা যদি ভেবে থাকে বড়লোক বান্ধবী পেয়ে প্রায়ই হাত পাততে চলে আসবে তাহলে তো চলে না।
নমিতা বলল, আমার স্বামীর চাকরিটা চলে যাওয়ার পর থেকেই আমরা একটু অসুবিধায় পড়েছি রে।
তানিয়া ভাবল, যাক বাবা এতক্ষণে আসল কথায় এসেছে। অ্যামাউন্টটা শোনার অপেক্ষায়…
ছোটবেলার বন্ধু বলে না হয় একটু বেশি দেবে। এমনিতেই পরিচিত দরিদ্রদের অর্থ সাহায্য করে তানিয়া মনে মনে তৃপ্তি পায়।
নমিতা বলল, ওই গয়নাগাটি বেচে আর ওর জমানো টাকা দিয়ে এই মাস দুয়েক আগেই একটা দোকান দিয়েছি। ওই পাড়ার মধ্যে মুদিখানা দোকান রে। আরে তানিয়া তোর বাবার যেমন ছিল ওই ব্যানার্জী পাড়ায়, ওরকমই।
চমকে উঠল তানিয়া। সাধারণত ওর এখনকার সোসাইটিতে কেউ জানেই না যে তানিয়ার বাবার মুদিখানার দোকান ছিল! কোনোভাবেই পিছন দিকে তাকাতে চায় না ও। আপাতত বাবাকে একটা ফার্নিচারের শোরুম করে দিয়েছে তানিয়া। দীপ প্রচুর হেল্প করেছে।
নমিতা হেসে বলল, তোর বরের তো প্রচুর টাকা। তোর বাড়ি দেখেই বুঝেছি। তারপর তোদের গ্যারেজে দেখলাম দুটো গাড়ি।
তানিয়া বলল, ওই আর কী। আসলে আমাদের প্রেজেন্ট স্টেটাস মেনটেন করতে গেলে এগুলো লাগে রে!
নমিতা কেমন অকারণে হেসে চলেছে। আশ্চর্য! ওই আর্থিক অবস্থায় থেকেও যে কী করে মানুষের এত হাসি আসে কে জানে?
নমিতা বলল, অনেক বক বক করলাম। এবার আসলে যে কারণে এলাম তোর কাছে সেটাই তো বলা হল না রে।
তানিয়া ভাবল যাক! এতক্ষণে তাহলে পুরোনো বান্ধবীর মুখোশটা খুলবে। অ্যামাউন্টটা শোনার অপেক্ষায় তাকিয়ে আছে তানিয়া।
নমিতা বলল, জানি তোকে একটু বিপদেই ফেলব হয়তো, তবুও পুরোনো বান্ধবীর কথাটা না হয় একটু রাখলি।
তানিয়া একটু বিরক্ত হয়েই বলল, আহা ভণিতা না করে নিজের মতো ভেবেই বলে ফেল…
আবার বোকার মতো হেসে নমিতা বলল, তোর তো অনেক জায়গায় নাচের স্কুল আছে রে… যদি আমার মেয়েটাকে একটু নাচ শেখাস! ও খুব ভালোই নাচে, কিন্তু শেখানোর লোকের অভাব।
অবাক চোখে তাকিয়ে আছে তানিয়া।
সেটা দেখেই বোধহয় নমিতা বলল, আমি জানি তোর পাঁচ থেকে সাতশো টাকা ফিজ। আমি ওটা দিয়েই শেখাবো রে। একটাই তো মেয়ে আমার, খেয়ে না খেয়েও ওকে মানুষ করতে চাই।
তানিয়া চমকে নিজেকে সামলে বলে উঠল, আরে না না… তোর মেয়েকে আমি বিনা পয়সায় শেখাব রে।
নমিতা একটু গম্ভীর মুখ বলল, তুই একদিন আমাদের সপরিবারে নিমন্ত্রণ করে বন্ধু বলে খাওয়াস, সেটাতে আপত্তি নেই, কিন্তু বিনা পয়সায় নাচ শেখাতে আপত্তি। নমিতা সরে এসে তানিয়ার হাত দুটো জড়িয়ে ধরে বলছে, তুই তোর সঠিক ফিজ নিয়েই আমার মেয়েটাকে ভর্তি করে নে প্লিজ।
তানিয়া তখনও মনে মনে ভাবছে, এটা কি দারিদ্রের অহংকার নাকি সততার!
ওর এত প্রাচুর্য দেখেও এতটুকু হিংসার চিহ্ন নেই নমিতার চোখে। সে তারটুকু নিয়েই সন্তুষ্ট। নমিতার চোখের ওই স্বাভাবিক দৃষ্টিই যেন তানিয়ার আত্মঅহংকারকে মুহূর্তে ধূলিসাৎ করে দিল।
নমিতার প্রস্তাবে রাজি হয়ে সামনের মাস থেকে ওর নাচের স্কুলে পাঠিয়ে দিতে বলল, ওর মেয়েকে।
নমিতা কাঁধের কাপড়ের ব্যাগটা ঠিক করে উঠে দাঁড়িয়েছে।
আলতো করে বলল, জানি তুই সেলিব্রিটি, তবুও যদি কখনো ওদিকে যাস তো আমার বাড়ি যাস কিন্তু।
নিজের ফোন নম্বর সমেত ভিজিটিং কার্ডটা নমিতার দিকে এগিয়ে দিয়ে তানিয়া বলল, বিপদে পড়লে যোগাযোগ করিস।
নমিতা একই ভাবে হেসে বলল, বিপদে না পড়লেও তোর খোঁজ নেব রে। আরেকটা ছক্কা হানল তানিয়ার প্রাচুর্যের অহংকারে।
বাইরে বেরিয়ে যেতে গিয়েও ঘুরে দাঁড়িয়েছে নমিতা। যেন কিছু মনে পড়ে গেছে। নিজের কাপড়ের ব্যাগ হাতড়াচ্ছে ও।
তানিয়াও উঠে পড়েছিল। দেরি হয়ে যাচ্ছে চিকেন দো পেয়াঁজা রেডি করতে হবে।
নমিতা ছাতা, জলের বোতল আর একটা হাতে ধরে একটা ছোট্ট প্লাসটিকের নতুন কৌটো বের করল ব্যাগ থেকে।
তানিয়ার হাতে দিয়ে বলল, বোঝ, আমার ভুলো মনের মরণ। তোর জন্য বানালাম আর বকতে বকতে এটাই দিতে ভুলে যাচ্ছিলাম।
তানিয়া বিস্ফারিত দৃষ্টিতে কৌটোর দিকে চেয়ে বলল, এগুলো কী রে ভিতরে?
নমিতা বলল, খেয়ে দেখিস কিছু মনে পড়ে কিনা।
বেরিয়ে গেল নমিতা।
কৌতূহল সামলাতে না পেরে তখনি কৌটো খুলে একটা মুখে ঢোকাল তানিয়া।
স্বাদটা ভীষণ চেনা। স্মৃতির পাতায় ফুঁ দিতেই বেরিয়ে এল বীণাপাণি বিদ্যালয়ের ক্লাস এইটের টিফিন টাইম।
তানিয়া, সুজাতা, নমিতা আর রঞ্জনা চারজনে মিলে টানছে নমিতার টিফিন কৌটো।
নমিতার টিফিন বক্সের বিশেষ আকর্ষণ ছিল, ওর মায়ের করে দেওয়া তিলের নাড়ু। নারকেল নাড়ু তো সবার বাড়িতেই হত। কিন্তু ওই তিলের নাড়ুর স্বাদ ছিল অসম্ভব সুন্দর। কতবার ওদের কাড়াকাড়িতে শেষে বেচারা নমিতার কপালেই জোটেনি।
মুখের মধ্যে সেই স্কুলবেলার স্বাদ। ধীর পায়ে তানিয়াদের বিশাল লনটা পেরোচ্ছে নমিতা। ড্রয়িং রুমের কাচের জানলা দিয়ে এখনও দেখা যাচ্ছে ওকে।
তানিয়ার ভীষণ ইচ্ছে করছিল ছুট্টে গিয়ে সব অহংকার ভুলে সেই মেয়েবেলার মতোই ওকে জড়িয়ে ধরে।
গেট খুলে বেরিয়ে গেল নমিতা। তানিয়া দাঁড়িয়ে রইল নমিতার দেওয়া তিলের নাড়ুর কৌটোটা হাতে নিয়ে।
টিফিনের ঘণ্টাটা ঢং ঢং করেই বাজল প্রখ্যাত নৃত্য শিল্পী তানিয়া চ্যাটার্জীর কানের মধ্যে। সচকিত হয়ে তানিয়া ফিরে চলল, ওর দ্রুত এগিয়ে চলা দৈনন্দিন জীবনে…
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন