দেখা না দেখায় মেশা – অর্পিতা সরকার

অর্পিতা সরকার

দেখা না দেখায় মেশা

ইজি চেয়ারে বসে আছেন মৃন্ময়। ডুব সূর্যের আলোয় আরেকটা অলস বিকেল দেখছেন চোখের সামনে। নিজের তৈরি বাগানের সবজে হলদে পাতাগুলো তাদের ইহ জীবনের কাজ সাঙ্গ করে মাটির সাথে বন্ধুত্ব করতে বদ্ধপরিকর। গাছের কচি সবুজের চিন্তারও অতীত যে তারাও একদিন বেরঙিন হবে, ফুরফুরে হাওয়ায় দোল খেতে খেতে কবে যে বোঁটা আলগা হয়ে সম্পর্ক ছিন্ন হবে জন্মদাতার সাথে, তার অঙ্ক তাদেরও অজানা।

বছর সাতান্নর সুঠাম দেহের অধিকারী মৃন্ময়ও জানতেন না কবে থেকে তার সাঁতরে নদী পার করতে ভয় করবে। গোলাপের সদ্য বসানো চারাগুলোয় কী রঙের বাহার আসবে না জেনেই নার্সারির সুজয়ের মুখের ভরসাতেই বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন, ওই ডানদিকের কোণের গাছটায় নীল গোলাপ ফুটবে।

মৃন্ময়ের বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে মানুষজন খুব কমই যাতায়াত করে, এটা কোনো গুরুত্বপূর্ণ রাস্তাই নয়। মানুষের হাতে সময় কম থাকলে তবেই তারা শর্টকাট করার জন্য এই দেবদারু ঘেরা রাস্তাটা ধরে।

সামনেই এস ডিও সাহেবের বাংলো, তার ঠিক পাশেই একটা পলস্তারা খসা একতলা। উঁচু পাঁচিলের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় পথ চলতি মানুষের কৌতূহল সৃষ্টি করে ওই বাংলোর না দেখতে পাওয়া অংশ।

অদেখার প্রতি আগ্রহ তো জন্মগত, অপরিচিতির আড়ালেই যত রহস্য জমাট বাঁধে, পরিচয়ের আলোয় প্রকট হলেই নিত্যনৈমিত্তিক জীবনের মতোই তা হয়ে ওঠে অতি সাধারণ।

এই পথে যাওয়া মানুষগুলোর কাছে তাই মৃন্ময়ের তৈরি গোলাপের বাগানটা রমণীয় হলেও, লোভনীয় নয়। বিশাল গ্রিলওলা গেট দিয়ে বাগানের প্রতিটা কুড়ির পাঁপড়ি খোলাও সকলে দেখতে পায়। সে তুলনায় গেটের সামনে পোশাকধারী সিকিউরিটির লাল চোখের চাহনি এড়িয়ে ওই বাংলোর ভিতরটা মানুষকে টানে বেশি।

”কী ব্যাপার মৃন্ময়দা কফি পর্ব মিটল?”

গেটের বাইরে থেকে পলাশ জানতে চাইল। পাশাপাশি অনেকেই জানে মৃন্ময় চা প্রিয় নয়, বিশেষ করে যখন ইজি চেয়ারে বসে নিজের অবসর সময়ের ছবি আঁকছেন নিপুণ হাতে, তখন তো নয়ই। এই সময় তিনি শুধু এক কাপ তেজী কফিই পান করবেন। যার তিতকুটে স্বাদে গলা পর্যন্ত তেতো হয়ে যাবে, কারণ তার এই স্পেশাল কফিটা চিনির মিষ্টতা বর্জিত।

মৃন্ময় রায়চৌধুরী একজন নামী লেখক। যদিও তার লেখা সাধারণ পাঠক মহলে খুব কমই আলোচিত হয়। কারণ তিনি গল্প উপন্যাস কম, প্রবন্ধ লেখেন বেশি। সাহিত্য মহলে একটি বিতর্কিত নাম, আর এই বিতর্কের কারণ তার লেখনী। তার বেশিরভাগ লেখাতেই একটা প্রতিবাদী মন দেখা যায়, তা সে ধর্মের গোঁড়ামির বিরুদ্ধে হোক আর কুসংস্কারমুক্ত মনের ভণ্ডামির বিপক্ষেই হোক।

”হরিপদ দেখিস, গোলাপ কুঁড়িগুলোতে যেন পোকা না লাগে।” খাস লোক হরিপদ এ বাড়িতে আছে প্রায় সাতাশ বছর। মৃন্ময়ের একমাত্র বিশ্বাসের জায়গা হরিপদ। সাহিত্য সম্মেলনে যাবার আগে ধুতি পাঞ্জাবি ঠিক করে দেওয়া থেকে কলেজের নিত্য দিনের পোশাক গুছিয়ে রাখা সবই ওর দায়িত্বে।

”বুঝলি হরিপদ, আর মাত্র তিনটে বছর কোনো মতে ঘঁষে ঘঁষে চালিয়ে দিতে পারলেই কলেজ থেকে রিটায়ার করব, তখন এই বাগান আর ওই কাগজ কলম।” কথাটা যে ঠিক হরিপদকে শোনানোর জন্য বলা তা নয়, হয়তো মৃন্ময়ের স্বগতোক্তিটা হরিপদর কানে ভেসে গেল।

বাংলার প্রফেসর মৃন্ময় রায়চৌধুরী যখন ক্লাসে বক্তৃতা দেবার ঢঙে মধ্যযুগের অন্ধকারময় সময়ের বর্ণনা দেন, তখন ছাত্রছাত্রীরা নিমেষে পৌঁছে যায় সেই মধ্যযুগের দম বন্ধ করা পরিবেশে। যেখানে গিয়ে দীর্ঘ সময়ের জন্য নির্বাক হয়ে গিয়েছিল, সাহিত্য-শিল্প।

”বাপি আমি হায়দ্রাবাদের চার্মিনারের ঠিক সামনে থেকে তোমাকে কল করছি। দু-চার দিনের মধ্যেই কলকাতা যাব। এবারে নিশ্চয়ই তোমার সাথে দেখা হবে। আমরা না হয় জমিয়ে একদিন উইদাউট সুগার কফি খাব।” মুঠোফোনে শতভিষার কথাগুলো মন দিয়ে শুনলেন মৃন্ময়।

শতভিষা রায়চৌধুরী, যার গবেষণার বিষয় স্ট্রিট বেগার্স। মৃন্ময়ের একমাত্র মেয়ে। স্বভাবটা কিছুটা মৃন্ময়ের মতোই হয়েছে। খামখেয়ালি, একটু অহংকারী। নিজের সিদ্ধান্তে স্থির। এক্ষেত্রে অনেকেরই মনে হতে পারে, শতভিষার গবেষণার বিষয় কী করে ফুটপাতের মানুষ হয়? সেক্ষেত্রে একটা কথা বলতেই হয়, শতভিষাকে যারা অহংকারী বলেন তারা সবাই ওদের ক্লাসের। কিন্তু রাস্তার ধারে রুক্ষ চুলের ছোট ছোট ছেলে-মেয়েগুলো, যাদের প্রধান জীবিকা ভিক্ষা, যারা দিনরাত পথচলতি মানুষদের বিরক্তির কারণ, তাদের মতে তিন্নি দিদি মা দুর্গা। তিন্নি শতভিষার ডাক নাম।

তিন্নি নাকি দশ হাতে ওদের জন্য ভিক্ষা করে এনে দেয় ওদের প্রিয় কেক, চকলেট।

দুই

অবশেষে কলটা করেই ফেলল সৌম্য। ওপ্রান্তের যান্ত্রিক আওয়াজটা এক নাগাড়ে হয়ে চলেছে। না, কোনো রোমান্টিক গানের কলি নয়, ওই ধাতব রিংটোনটাই কানে বাজছে সৌম্যর। হৃৎপিণ্ডের দ্রুতগামী হবার চিহ্ন স্বরূপ নিজের শ্বাস-প্রশ্বাসের আওয়াজ নিজের কানেই শুনতে পাচ্ছে ও।

নির্দিষ্ট নাম্বারটা ডায়াল করার সময় পুরুষাঙ্গের উত্থানটা এই মাত্র খেয়াল করল সৌম্য। শুধু ওর মন নয় শরীরও চায় ভীষণভাবে তৃপ্তি পেতে। ছাব্বিশ বছরের একটা ছেলের শারীরিক ক্ষুধাটাকে অকারণে অস্বীকার করতেই বা যাবে কেন? নিজের কাছে যুক্তির পাহাড় সাজালো সৌম্য।

ওপ্রান্তে নারীকণ্ঠ কোনোরকম উত্তেজনা ছাড়া অভ্যস্ত ভঙ্গিমাতে বলে চলেছে… ”আপনাকে স্বাগত জানাই এই ‘সম্পর্ক’ ফ্রেন্ড ক্লাবে। প্রথমে নিজের নাম আমাদের সদস্য পদে নথিভুক্ত করুন। নাম নথিভুক্ত করাতে মাত্র এক হাজার সাত টাকা আমাদের অ্যাকাউন্টে ট্রান্সফার করুন, আমাদের অ্যাকাউন্ট নাম ও নাম্বার হল, রজত চৌধুরী, ৫৬…। আপনি এই অ্যাকাউন্টে টাকাটা ডিপোজিট করে দিন।”

বেশ সেক্সি গলা মেয়েটার। উত্তেজিত সৌম্য জিজ্ঞেস করল, ”আর আপনার নাম? আমি কি একটু সেপারেট ভাবে আপনার সাথে কথা বলতে পারি?” বিকৃতকাম মানুষদের সাথে বাক্যালাপ করতে করতে মোহিনী গত পাঁচ মাসে এতটাই অভ্যস্ত হয়ে গেছে যে, এই পুরুষ মানুষগুলোর কণ্ঠস্বরে বিরক্তি ছাড়া ওর আর কিছুই উৎপন্ন হয় না। মোহিনী খুব ভালো করেই জানে, ভালোবাসার বা বিয়ের প্রতিশ্রুতি পাবার জন্য কেউ ওর সাথে কথা বলতে চায় না। শুধুমাত্র ফোনে কথা বলে, গলার স্বরে ইজ্যাকিউলেশন ঘটাতে চায় কিছু পুরুষ। একই নিরুত্তাপ গলায় মোহিনী বলল, ”কাল ঠিক সকাল এগারোটার পর আপনি আমাদের এই অ্যাকাউন্টে এডভান্স টাকা জমা করুন। তারপর কল করবেন।” ফোনটা কেটে দিল মোহিনী।

সৌম্যর একটা মহিলা কণ্ঠ প্রয়োজন ছিল এই সময়। ওর এই হস্ত মৈথুনের সময়ের গ্লানীগুলো নিমেষে কেটে যেত যদি একটা নারীকণ্ঠের অস্ফুট আওয়াজ ও কানে শুনতে পেত।

”কী রে? ভর সন্ধেবেলা দরজা বন্ধ করে কী করছিস?” দরজার বাইরে মা, হাত দিয়ে দরজায় হালকা ধাক্কা দিয়ে ঠুক ঠুক করে চলেছে। সৌম্যকে বন্ধ দরজা খোলার নির্দেশ। নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলেদের অর্থের সাথে সাথে নিজস্ব সময়েরও বড়ই অভাব। প্রাইভেসি শব্দটা এই পরিবারগুলোতে কোনোদিনই মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না।

ছাব্বিশ বছরের অবিবাহিত ছেলে কোনোভাবেই নিজের ঘরের দরজায় ছিটকানি লাগাতে পারে না, একমাত্র আত্মহত্যার মানসিকতা ছাড়া।

এটাচ বাথ নেই বলে এমনিতেই সৌম্যকে ওর চটচটে আধপুরোনো অন্তর্বাস পরিবর্তন করতে উঠোনের পাশের কলতলাতে যেতেই হত কিন্তু এই ঘন বীর্যপাতের পর ক্লান্ত অর্ধতৃপ্ত শরীরটা আরেকটু আগলে রাখতে চাইছিল বিছানাটাকে। এই সুখানুভূতিটুকুকে জলাঞ্জলি দিয়ে এক ঝটকায় উঠে পড়ল সৌম্য। দরজা খুলতেই এক ঝাঁক প্রশ্নের সম্মুখীন হল ও। অস্বাভাবিক নয়, প্রশ্নগুলো ওর অতি পরিচিত। ওর কাঁধের আড়াল দিয়ে মা ঘরের সিলিং ফ্যানের অবস্থান বা অন্য কিছু দেখার চেষ্টা করছে। মাকে সুযোগটুকু করে দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল সৌম্য। ঠান্ডা জলও কখনো কখনো শুধু শীতলই করে না তৃপ্তিও দেয়। বাথরুমে টিনের দরজাটাকে পটপট আওয়াজ করে বন্ধ করতে শ্যাওলা ধরা বাথরুমটা ওকে কিছুটা গোপনীয়তা দিল। লোহার বালতিতে ধরে রাখা জল শিথিল হয়ে যাওয়া যৌনাঙ্গে ঢালতেই ফ্রেন্ড ক্লাবের মেয়েটির গলাটা কানের মধ্যে ভেসে এল।

কল্পনার ডানাগুলো অধিক সময়েই বেশ প্রশস্ত হয়। সেই ঠাকুরমার ঝুলির সময় পক্ষীরাজের পাখনার মতো কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা।

শীতল জলের ধারায় সিক্ত হতে হতে সৌম্য কল্পনা করতে শুরু করল, ফোনের অন্য প্রান্তের মেয়েটির উদ্ধত স্তনযুগলের ঈষৎ কালচে বৃন্তদুটোকে। নিজের সামনের দুপাটি দাঁত তীব্র টক খাওয়ার মতোই শিরশির করে উঠল।

গত কালই দুজন স্টুডেন্ট মাইনে দিয়েছে, প্যান্টের পকেটে ষোলোশো টাকা রয়েছে সৌম্যর। একটা নতুন পাঁচশো। না কালো না সবুজের মিশ্রণে অদ্ভুত একটা রং, গন্ধটা কিন্তু আভিজাত্যের।

ফোনে কথা বলা মেয়েটিই কি সৌম্যর শয্যাসঙ্গিনী হবে? নাকি অন্য কেউ…

ভাবনার পারদ কল্পনার ছোঁয়ায় বাড়তে বাড়তে ক্রমশ অবশ হয়ে যাচ্ছে তার বিকল মন।

আর তো মাত্র কয়েক ঘণ্টা, তারপরই সৌম্য একেবারে নিজের করে পেয়ে যাবে একটা সম্পূর্ণ নারী শরীর। অন্তত কিছুক্ষণের জন্য সে শুধু সৌম্যর।

এক হাজার সাত টাকার বিনিময়ে ও কিনে নিতে পারবে ওই মহিলার কিছু মুহূর্ত।

তিন

ঝুপ করেই সন্ধ্যা নামল মৃন্ময়ের বাগানে। অবশ্য আলোকে ধীরে ধীরে গ্রাস করে অন্ধকারের হাতছানিতে সাড়া দেবার মুহূর্তেরা খুব আপন মৃন্ময়ের। এই সময় কলম সচল হতে চায়। নেহাত কবিতা লেখায় ওর মন বিদ্রোহ করে, তাই আর হয়ে ওঠে না।

কলকাতায় এই নাতিশিতোষ্ণ আবহাওয়া তো বিরল। কংক্রিটের উত্তাপ এখানে দ্রুততার সাথে গ্রীষ্মকে ডেকে আনে। তাই এই হঠাৎ পাওয়া ফাল্গুনী নরম উষ্ণ হাওয়ায় মৃন্ময়ের ঠিক শীত করেছে না, তবে একটা হাল্কা চাদর হলে আরামপ্রিয় মানুষদের ভালো হয় আর কী।

একমাত্র মৃন্ময়ের মনের না বলা কথা পড়তে পারে হরিপদ, তাই রোজকার ব্যবহার করা সুতির চাদরটা ওর হাতে ধরিয়ে দিল।

নিজের স্টাডিতে ঢুকলেই আজকাল মৃন্ময়ের লিখতে কম, পড়তে বেশি ইচ্ছে করছে।

আজকালকার দিনের অল্পবয়সি ছেলেমেয়েরা বেশ বিতর্কপ্রবণ। নিজের মতামতকে পাঠকের কাছে পৌঁছানোর জন্য তারা উপযুক্ত তথ্য দিচ্ছে। হয়তো সব তথ্য সঠিক নয় কিন্তু এই সাহসী মানসিকতাটাকেই কুর্নিশ জানায় মৃন্ময়। নিজের প্রিয় কলম আর লেখার ডায়েরিটা নিয়ে বসতেই, একটা মুখ চোখের সামনে ভেসে উঠল। এটা কোনো নতুন ঘটনা নয়। ওর একাগ্রতা নষ্ট করার একটা আপ্রাণ চেষ্টা থাকে ওই বিশেষ অবয়বের। বেশ কিছুক্ষণ মৃন্ময়ের দৃষ্টি পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, ওর চিন্তাশক্তিকে দুর্বল করে তবেই তার আনন্দ। যতক্ষণ না মৃন্ময়ের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘামের সঞ্চার হচ্ছে আর তার ঠোঁটের কোণে তৃপ্তির হাসি ফুটছে, ততক্ষণ সে আগলে রাখে মৃন্ময়ের একাগ্রতা। বেশ কিছুক্ষণ ধস্তাধস্তি যুদ্ধের পর অর্ধেক জয়ী মৃন্ময় কলমে আঁচড় টানে নতুন পাতায়। এইভাবে মনের সাথে যুদ্ধ করেই লিখে চলেছে বিগত ষোলো বছর। তারপর যখন সাহিত্য মহলের সমালোচকরা আড়ালে আবডালে মৃন্ময় রায়চৌধুরীর ব্যক্তিগত জীবনের ঢেকে রাখা অংশে আলোকপাত করতে চায় তখনই সংকুচিত হয়ে যায় মৃন্ময়।

চার

না, সুজয়, রবিন, বিকাশের মতো প্রেম করতে পারেনি সৌম্য। আবার অমিতের মতো প্রেমে ব্যর্থ হয়ে কবিতা লিখতেও পারেনি। প্রেমিকা যেহেতু নেই, তাই তার চোখের আড়ালে কোনো কর্লগার্লকে এক রাতের জন্য শয্যাসঙ্গিনীও করে উঠতে পারেনি সৌম্য অন্য বন্ধুদের মতো। অন্ধকার প্রেক্ষাগৃহের নীল ছবির পর্দার নিরাভরণ নারীই ওকে দিয়েছে একটা পূর্ণ মেয়েলি শরীরের বিবরণ। অন্যের সাথে রতিক্রিয়ায় বিভোর নায়িকার যোনিদ্বারে নিজের পুরুষাঙ্গ প্রবেশের কাল্পনিক সুখ পেতে পেতে সৌম্য এখন ক্লান্ত, বিধ্বস্ত।

মাথার ওপরে জলজ্যান্ত এক বোন আর দিদি যেখানে অবিবাহিত হয়ে সমাজ সংসারে লাঞ্ছিত হচ্ছে, সেখানে ছাব্বিশ বছরের বেকার যুবকের বিয়ের কথা ভাবাটা নিম্ন মধ্যবিত্ত কেন উচ্চবিত্ত সংসারেও নেহাত বাতুলতা ছাড়া আর কিছুই নয়।

সামাজিক স্বীকৃতি যুক্ত, সিঁদুর পরিহিতা স্ত্রী যে কোনোভাবেই পাওয়া সম্ভব নয় তা সৌম্য বুঝেছে বেশ কিছুদিন আগেই, যেদিন রাজীব সরকারি চাকরি পাওয়ার তিনমাসের মধ্যে পরমা সুন্দরী শিক্ষিতা একটা মেয়ে ওর বউ হয়ে এল।

একই সাথে মোহনদার চায়ের দোকানে চা খেতে যাওয়া ছেলেগুলোর মধ্যে হঠাৎ করেই রাজীবকে মোহনদা মাটির ভাঁড়ে বা প্লাস্টিকের কাপে চা না দিয়ে চিনে মাটির কাপে চা দিল।

খিস্তি মেরে সুজয় বলেছিল, ”বিয়ে করার জন্য মোটা ইয়ে দরকার হয় না, পকেটে টাকা দরকার হয়।”

সৌম্য অবশ্য এসব তর্কে যায়নি, রাজীবের বিয়েতে কব্জি ডুবিয়ে খেয়ে বাড়ি ফিরেছে, আর জমাট অন্ধকারে রাজীবের সুন্দরী বউকে নিজের কাছে খুঁজেছে বারবার।

পাঁচ

এই সিজন চেঞ্জের সময় প্রতিবারই অল্প স্বল্প ঠান্ডা লেগে যায় মিতালীর। হাজার প্রোটেকশান নিয়েও কোনোদিন আটকাতে পারেনি এই বিরক্তিকর ঘুষঘুষে কাশিটাকে। ঠিক যেন মনের আয়না, অতীত দেখব না বললেও সেই টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করাতে চায় ভুলতে চেষ্টা করা অতীতে।

মিতালীকে দেখে কে বলবে ওর মেয়ের বিয়ের বয়স হয়ে গেছে। না, এক্সসারসাইজের উপকার নেই বললে চলবে কেন! সকালের মর্নিং ওয়াক আর সন্ধের এক্সসারসাইজ মিতালীর অনন্ত যৌবনের কারণ।

যদিও কোনোদিন কোনো লেখকের মানস প্রতিমা হয়ে তার লেখনীতে ঠাঁই পায়নি, শুধু পথ চলতি লোকের মুগ্ধ দৃষ্টিতে নিজের আত্মবিশ্বাস ফিরে পেয়েছে বারংবার।

আত্মবিশ্বাসই বটে! সেটাও যখন ওকে কুড়োতে হয় হাজার মানুষের ভিড়ে, তখন ওর প্রতি সম্পূর্ণ উদাসীন সেই মানুষটার ভাবলেশহীন চাহনিটা একবার হলেও মনে পড়ে বইকি।

সাবিত্রী, তুই বরঞ্চ গিজারটা এবার অন করেই দে। হালকা গরমেই শরীরটা আরাম পাবে। ছোট্ট একটা নির্দেশ, অনুরোধের ঢঙে দিয়েই পোশাক চেঞ্জ করতে গেল মিতালী।

আজকাল আর পূর্ণ দৈর্ঘ্যের ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়াতে ইচ্ছে করে না। আলগা হয়ে যাওয়া, মেদ জমে যাওয়া তলপেট আর প্রকট স্ট্রেচ মার্কগুলো হাতছানি দেয় আগামী বার্ধক্যের। স্তনবৃন্তের বাদামি লালচে আভারা অপসৃত হয়েছে, কবেই কালচে ছোপের আধিপত্য সেখানেও। ঝুলপির সিলভার লাইনগুলো কালার দিয়ে ঢাকা, চোখের নীচের ডার্ক সার্কেলও ফ্যাশানেবল গ্লাসের পর্দার আড়ালে।

মনটাই শুধু মাঝে মাঝে বেপরদা হয়ে যায় নিজের কাছে।

মুঠোফোনে তিন্নির নাম দেখলেই হালকা একটা উষ্ণ বাতাস ছুঁয়ে যায় মিতালীকে।

”মাম্মা আমি কলকাতা ফিরছি, অবশ্যই এবার দেখা হবে তোমার সাথে।”

মিতালী গলার অভিমানটা চেপে রাখার ব্যর্থ চেষ্টা করে বলল, মাম্মাকে মনে থাকলে এসো, গতবার তো বাপির সাথেই দেখা করে ফিরে গিয়েছিলে। মাম্মা তো নামী লেখক নয়, ছাপোষা স্কুল টিচারের অবজ্ঞা সহ্য করার অভ্যেস আছে।

তিন্নি আদুরে গলায় বলল, মাম্মা প্লিস, মিস করছি তোমাকে। কাল এখানে প্যারাডাইসে বিরিয়ানি খেতে গিয়ে অভিককে তো বললাম, মাই মাম্মা ইস এ বেস্ট কুক ইন দি ওয়ার্ল্ড। অভিক তোমার হাতের রান্না খেতে চেয়েছে।

এই অভিকটা ঠিক কে তা তিন্নি এখনো বলেনি। আধুনিক মায়েদের অনেক বেশি ধৈর্যশীল হতে হয়, নিজের গর্ভের সন্তানের প্রাইভেসি নষ্ট হবে এমন কোনো প্রশ্ন করা নিষেধ। কৌতূহল দমন করে অপেক্ষা করতেই হবে মিতালীকে, যবে তিন্নি বলবে।

ছয়

ঘড়িতে এখন সকাল ন-টা। বাবার ডায়াবেটিসের সমস্যাটা ইদানীং একটু বেড়েছে মনে হয়। রাত একটা নাগাদ বাথরুম করার পরও যখন ভোর চারটেতে আবার যেতে হচ্ছে তখন মোহিনী নিশ্চিত, এটা রক্তে সুগার বাড়ার লক্ষণ। ঘুমের ওষুধ খেয়েও যখন চারটের মধ্যে ঘুম ভেঙে যাচ্ছে বাবার, তখন নিশ্চয়ই শারীরিক অস্বস্তিটা ভোগাচ্ছে। মায়ের অবর্তমানে মোহিনীই বাবার দেখাশোনা করে। মাত্র ছদিনের নোটিসে মা তার সংসারের দায়ভার মোহিনীকে দিয়ে নিশ্চিন্তে চোখ বুজলেন। কলেজের শেষ পরীক্ষাটা আর দেওয়া হয়ে উঠল না মোহিনীর। সংসার বলতে বড় কিছু নয়। প্রাণী বলতে ওরা দুজন, বাবা আর মেয়ে। দিদির বিয়ে হয়ে গেছে ধানবাদে। বিবাহিত মেয়েরা একটু একটু করে বাপের বাড়ির সাথে সম্পর্কের সুতোটা কাটতে থাকে, যখনই বুঝতে পারে শ্বশুরবাড়ির অর্থনৈতিক অবস্থা বাপের বাড়ির অপেক্ষা ভালো। হাঁ করা দারিদ্রকে পুজোয় সুতির ছাপা বা রসগোল্লার হাঁড়িতে চাপা দেওয়া যাবে না বুঝেই হয়তো লাটাই এর সুতোটা গোটাতে গোটাতে ওই নিমন্ত্রণ বাড়িতে লৌকিকতা করার মতো দাঁড়ায়। মোহিনীর দিদিও নিজের সংসার নিয়ে এতটাই ব্যস্ত যে মাসান্তে একবার মুঠোফোনে বাবার শরীরের খবর নিয়েই দায়িত্ব শেষ করে।

দায়িত্বর শেষ অক্ষরটা যেমন জোরালো তেমনি বাস্তব জীবনে এর গুরুত্বও অনেক। এই যেমন মোহিনী বাবার দায়িত্ব নিয়ে নিজের পড়াশোনা, অগোছালো বসন্তকে ত্যাগ করে এই ঘৃণ্য চাকরিটা বেছে নিয়েছে। বাবা জানেন, মোহিনী কোন অফিসের রিসেপশনিস্ট। তা রিসেপশনিস্টই বটে। ফোন কানে নিতে প্রথম প্রশ্নটাই আসে, আপনি কত সাইজের ব্রেসিয়ার ব্যবহার করেন? লো কার্ট না হাই? ঘণ্টা হিসাবে চার্জ নেন, নাকি ফুলপেমেন্ট করে তবে এন্ট্রি নিতে হয়?

একটা হ্যালো বলার পর থেকেই উত্তেজিত মানুষজনের এটাই ইচ্ছে, মোহিনীই ওদের এটেন্ড করুক। চেহারা দেখে নয় একটা শুধু মহিলা কণ্ঠ প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে তাদের। আজকাল তাই নতুন কৌশল নিয়েছে মোহিনী, ফ্রেন্ডস ক্লাবের কাস্টমারদের কোনো কথা বলার সুযোগই দেয় না। ওদের রুলসগুলো ফুলস্টপ না দিয়ে বলে চলে।

এতে অন্তত ফোনগুলোর থেকে নিষ্কৃতি মিলেছে। বাঁচতে পেরেছে সেইসব মানুষগুলোর থেকে, যারা বহুদূর থেকেও হাত দিতে চায় মোহিনীর শ্যামলা বক্ষবিভাজনীতে। ফোনে কথা বলার সময় ওড়নাটা ভালো করে জড়িয়ে নেয় মোহিনী, এটুকুতেই যেন নিরাপত্তা। তাদের নিয়েই সমস্যায় পড়ে মোহিনী যাদের বোঝাতে অসমর্থ হয়, ও রিসেপশনিস্ট, কর্লগার্ল নয়।

সাত

”কী রে আজ এত সকাল সকাল উঠে পড়েছিস?” সৌম্যর মা জানতে চাইল ওর কাছে। মায়েদের প্রবলেমটা ঠিক কোথায়? একদিন দেরি করে উঠলে, বেকারত্বের গ্লানি নিয়ে বেলা পর্যন্ত কেন ঘুমোচ্ছে, এই প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয় ওকে।

সস্তার লিকারের রংটা সোনালি না হয়ে ঘোলা কালো হয়। টেলিভিশনের বিজ্ঞাপনের চায়ের রঙের মধ্যে যে আভিজাত্য থাকে সেটা বোধহয় কোনোদিনই মেলা থেকে কেনা দশটাকা জোড়া চায়ের কাপে সম্ভব নয়।

গরম পানীয় গলার মধ্যে উত্তাপের অনুভব দিয়ে ধীরে ধীরে নেমে গেল। সৌম্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে, বাবার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবার। ব্যাঙ্কে যাবার ভাবনাটা ধীরে ধীরে অবশ করে দিচ্ছে সৌম্যর কার্যকরী স্নায়ুগুলোকে।

এই ক্লাবে নাকি বেড পার্টনারের ছবি দেখিয়ে কাস্টমারের পছন্দ অনুযায়ী সঙ্গী গ্রহণের সুযোগ আছে। নিজের মনের গোপন প্রকোষ্ঠে যে নারী মূর্তিটি আঁকা আছে, সৌম্য যাকে রোজ নীলাভ অন্ধকারে কোলবালিশের জমাট তুলোয় বারংবার খুঁজে চলে, তাকে যদি একবার চর্মচক্ষে দেখতে পেত।

নারকেল কাঠির ঝাঁটার খচর খচর আওয়াজে সম্বিত ফেরে সৌম্যর। মা উঠোন ঝাঁট দিতে শুরু করেছে। হয়তো কাজের মাসির আসতে দেরি দেখে।

সৌম্য বাথরুমে ঢুকতে যাবে ঠিক সেই সময় দিদি ভিজে কাপড়ে বাথরুম থেকে বেরিয়ে এল। সৌম্য চোখ সরিয়ে নিল দিদির অপুষ্ট একফালি পিঠের দিক থেকে। দিদির সময় মতো বিয়ে হলে, এতদিনে সৌম্যর ভাগ্না-ভাগ্নি মাধ্যমিক দিত হয়তো।

পাত্রপক্ষ যদি বা বিয়ের পর বাড়ির কাজের লোকের অভাব মিটবে বলে দিদিকে পছন্দ করে তখনই আটকে যায় পণের টাকায়।

বোনটা কলেজে পড়েছে, দেখতে মন্দ নয়। প্রেম করে কাউকে ফাঁসাতে পারলে তবেই বিয়ে হবে, নয়তো দিদির মতোই পড়শীর বিয়েতে গায়ে হলুদের তত্ত্ব সাজাতে হবে।

দিদি আর বোনের কথা মনে পড়লেই গলার কাছে একটা গিলতে না পারা কষ্ট জমাট বাঁধে সৌম্যর। তবে বাড়ির বেকার ছেলেরা আবার অবিবাহিত মেয়েদের থেকেও বেশি বিদ্রুপের পাত্র। পাত্রপক্ষ দেখতে এসে পছন্দ করলেই এক ঝটকায় সেই মেয়েদের কদর বেড়ে যায়, তখন তাকে ভালোমন্দ খাওয়ানো মাখানো চলতে থাকে। বেকার ছেলে সেই অনেকটা জংধরা লোহার মতো। কোনো কাজে লাগে না, অথচ আজ নয় কাল বলে ভাঙাচোরার দলে বিক্রি করাও হয় না।

সৌম্য যখন স্নান করে আয়রণ করা শার্ট-প্যান্ট পর বেরোচ্ছিল, তখন দিদি স্বাভাবিক গলাতেই জিজ্ঞেস করেছিল, ”আজ কি কোনো ইন্টারভিউ আছে ভাই? তাহলে ঠাকুর ঘরে একটা প্রণাম করে যাস।” প্রথম প্রথম ইন্টারভিউ-এ যাওয়ার সময় দিদি সৌম্যর কপালে দইয়ের ফোঁটা দিয়ে দিত। তারপর যখন বুঝেছিল দইটাও ওয়েস্টেজ হচ্ছে, তখন বন্ধ করে দিয়েছিল ওই মঙ্গল ফোঁটা।

”না, আজ অন্য একটা কাজে বেরোচ্ছি।” বলেই মুখ ফিরিয়ে নিল সৌম্য। পবিত্র মানুষের চোখের দিকে তাকালে একটা অস্বস্তি হয়। নিজের অজান্তেই অপরাধবোধে ভুগতে হয়।

আট

বাইরের চিৎকারে শতভিষার ঘুম ভাঙল, কোনো একজন মহিলা কণ্ঠ, ওর নাম ধরে ডেকে চলেছে। ফ্ল্যাটের সিকিউরিটি সম্ভবত আটকে রেখেছে তাই এই অসহিষ্ণু চিৎকার।

তিন্নি ব্যালকনিতে দাঁড়াতেই বাইরের দৃশ্য পরিষ্কার নজরে এল। অবিন্যস্ত পোশাক, ছিঁড়ে যাওয়া শাড়ির অর্ধেক মাটিতে লুটোচ্ছে, রুক্ষ সোনালি চুল, খসখসে শ্রীহীন রোদে জ্বলে যাওয়া তত্ত্বের মেয়েটা সকলের নজর এড়িয়ে পৌঁছতে চাইছিল তিন্নির কাছে। কিন্তু কেন? একে তো তিন্নি কোনোদিন দেখেছে বলে মনে করতে পার না।

ফ্ল্যাটের কোলাপ্সিবেলটা টেনে দিয়ে লিফটের সাহায্য ছাড়াই তিন তলা থেকে নীচের গ্যারেজের সামনে নেমে এল তিন্নি।

মেয়েটি তিন্নিকে সামনে দেখে যেন স্বর্গ পেল, হাঁউমাঁউ করে কিছু বোঝাতে চাইছিল, নিজের শুকনো ঠোঁট দুটো বার বার জিভ দিয়ে ভিজিয়ে নিচ্ছিল।

তিন্নি ওকে শান্ত করে বসাল।

মেয়েটির নাম পূজা, রাস্তার ধারেই ত্রিপল ঘেরা ঝুপড়িতে থাকে। দিন চারেক ধরে ওর এক বছরের বাচ্চাটাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। থানায় গিয়েছিল, ওরা কোনো রিপোর্ট নেয়নি। তাই ও তিন্নির দ্বারস্থ হয়েছে।

অভিককে ফোন করতে করতেই পূজার বাসস্থানটা জেনে নিল তিন্নি। বার দুয়েক রিং হবার পর পরিচিত স্বরে হ্যালো বলল অভিক।

ওর সাথে লোকাল থানার বেশ জানাশোনা আছে। অন্তত তিন্নি যে দু-বার অভিকের সাথে গেছে থানায় সেবার অবজ্ঞা পায়নি, বরঞ্চ ভদ্র ব্যবহারই পেয়েছে।

”বলুন ম্যাডাম আপনার জন্য এই অধম কী করতে পারে? একশো আটটা নীল পদ্ম ছাড়া আর সবই জোগাড় করা সম্ভব”, মজার সুরে বলল অভিক। তিন্নি সংক্ষেপে পূজার সমস্যাটা জানাতে ও থানায় ফোন করেছে জানাল।

অভিকের সাথে তিন্নির এই রাস্তার ধারের বস্তিতেই পরিচয়।

একটা বাচ্চাকে বাইকের মুখ থেকে বাঁচিয়ে অভিক ফেরত দিতে এসেছিল তার মায়ের কাছে। তিন্নির হাতে তখন ওদের জন্যই আনা বিস্কিটের প্যাকেট।

আলাপ থেকে ঘনিষ্ঠতা হতে অবশ্য সময় লেগেছিল বছর খানেক।

আর পাঁচটা গড়পড়তা প্রেমিক-প্রেমিকার মতো বিয়ে, সংসার, পরদা, ফ্রিজের রং নিয়ে ওরা আলোচনা কমই করেছে। এই সুলেমান, কুসুম, রাবেয়া, রহিম আরও নাম না জানা ভিক্ষাপাত্র হাতে নিয়ে ঘোরা মানুষগুলোই ওদের আলোচনার বিষয়।

নয়

মোহনদার চায়ের দোকানে একটা প্যাটিস চিবোতে চিবোতেই হাত ঘড়ি দেখিয়ে দিল কাঁটা দুটো এগারোটার ঘরের দিকে ছুটছে। সৌম্যর অস্থির মনের আগে পৌঁছাতে পারবে বলে মনে হয় না। ব্যাঙ্কের শীততাপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে ঢুকলেই নিজেকে কেমন একটা অর্থবান পুরুষ মনে হয়।

যদিও এখানে যারা লাইন দিয়েছে তারা সবাই যে টাকা সেভিংসের জন্য এসেছে তা নয়। এর মধ্যে অনেকের লোন স্যাংশন আছে, হয়তো নতুন অ্যাকাউন্ট খুলতে চায় অথবা কন্যাশ্রী প্রকল্পের টাকা এসে পড়েছে ওই নীল চুড়িদার স্কুল পড়ুয়া মেয়েটির অ্যাকাউন্টে, তাই তার মুখটায় লেগে আছে উজ্জ্বল হাসি।

‘সম্পর্কের’ অ্যাকাউন্টে টাকাটা ট্রান্সফার করেই ফোন করতে শুরু করল সৌম্য।

কী অদ্ভুত একটা এমাউন্ট… এক হাজার সাত।

দু-বার সম্পূর্ণ রিং হবার পরও ফ্রেন্ড ক্লাবের কেউ রিসিভ করল না। অধৈর্য লাগছে সৌম্যর।

আজই পৌঁছাতে চায় সেই মহিলার কাছে, যার যোনির গন্ধ ওকে তৃপ্তি দেবে।

তৃতীয়বারে ফোনটা ধরল, মহিলা কণ্ঠ। বোধহয় কাল সন্ধের সেই মহিলা।

কম্পিউটার চেক করছে মোহিনী।

সৌম্য রায়। চন্দননগরের কোন ব্রাঞ্চ থেকে টাকাটা ঢুকেছে?

বিরক্ত হয়ে সৌম্য বলল, কী হল টাকা তো পেয়ে গেছেন এবার বলুন কোথায় যেতে হবে?

কোনো ওঠানামা ছাড়াই স্থির গলায় মোহিনী বলল, কিন্তু স্যার একটা সমস্যা হয়েছে। চন্দননগরের যে মহিলা আপনাকে ত্রিশ হাজার দেবে তাকে সেক্সসুয়ালি হ্যাপি করতে পারলে, তার কাছে তো আপনি এখুনি যেতে পারবেন না। রাত আটটার আগে তো ওনার বাড়িতে পাঠানোর পারমিশন নেই। আর আপনি আগামী কালের মধ্যে পঁচিশ হাজারের এমাউন্ট আমাদের ওই অ্যাকাউন্টে ট্রান্সফার করুন। আর স্যার আপনি ওনার কাছ থেকে ত্রিশ হাজার ক্যাশে না চেকে নিতে চান সেটাও কাল সকালের মধ্যেই জানাবেন। আমরা সেভাবেই ব্যবস্থা করে রাখব।

ফোন কেটে গেল। ছক্ষ্মটাকা আশি পয়সা কেটে নিল সৌম্যর ফোন থেকে।

দশ

সাহিত্য মহলে ঠাঁই পাওয়া যে ঠিক কতটা কঠিন তা মৃন্ময় বুঝেছিল ওর প্রবন্ধ ‘পৃথিবী সৃষ্টির প্রাক্কালে’ প্রকাশের সময়। সম্পাদক মণ্ডলীর অবাক চোখের প্রশ্ন ছিল, গল্প উপন্যাস না লিখে হঠাৎ সৃষ্টি হয়ে যাওয়া পৃথিবীকে নিয়ে লিখলেন কেন?

মৃন্ময় যখন প্রবন্ধটির ছাপার অক্ষরে দেখার আশা প্রায় ত্যাগ করেছিল ঠিক তখনই ‘জাতীয় প্রকাশন’ ওর লেখাটা পাবলিশ করতে রাজি হয়।

ওর ওই হতাশার দিনগুলোয় সম্পূর্ণ ভাবে পাশে পেয়েছিল মিতালীকে। বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়, পরিজন সর্বোপরি কোনো প্রকাশকের বিশ্বাস ছিল না মৃন্ময়ের সৃষ্টিতে, শুধু মিতালী মন থেকে বিশ্বাস করত মৃন্ময়ের কালির আঁচড় একদিন পাঠককুলকে ভাবাবেই।

যে লেখাকে সমর্থন করে মিতালী তাদের বিয়ের পরের স্বপ্নীল রাতগুলোকে অক্লেশে বিলিয়ে দিয়েছে মৃন্ময়ের অক্ষরদের, সেই মিতালীই আবার অস্বীকার করেছে ওদের সামাজিক স্বীকৃতি। সেই রাতের ওই পঁচিশ মিনিটের তরল অন্ধকার বার বার তাড়া করে চলেছে মৃন্ময়কে। ক্ষমা নেই জেনেও ক্ষমাপ্রার্থী হয়ে ছুটেছিল মিতালীর কাছে। যদি তিন্নির মুখ চেয়েও একটা সুযোগ পাওয়া যেত…

কী করে কল্পনার জাল বুনে শব্দের পর শব্দ সাজিয়ে গল্প আঁকতে হয় মৃন্ময় জানে না। একটা কেন্দ্রবিন্দুকে প্রদক্ষিণ করতে করতে কবে যে প্রাবন্ধিক মৃন্ময় রায়চৌধুরী হয়ে উঠেছে সেটা আজ আর সচেতন ভাবে মনে করতে পারে না ও নিজেই।

যৌবনোচ্ছ্বল তরুণীর পরিপূর্ণ দেহাবয়েবের প্রতিচ্ছবি ওর লেখায় নেই। নেই কোনো অনুরাগে ভেজা প্রেম কাহিনি।

শুধু ওর জীবনের সাথে জড়িয়ে গেছে একটা কলেজ ছাত্রীর নাম। সুনয়না মৃন্ময়ের কলেজের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী। বাংলাকে সে শুধু পড়ার জন্য পড়ে না। সিলেবাস শেষ করার তাড়ায় নাভিশ্বাস তোলে না। দুটো গভীর চোখের কৌতূহলী চাহনিতে সে জানতে চায়, চর্যাপদের সবর-সবরী উদ্দাম যৌবনদর্শন।

মাঝে মাঝেই মৃন্ময়ের বাড়িতে চড়াও হয় সুনয়না। কখনো তার প্রশ্ন থাকে, ছিন্নপত্রাবলীতেই উপন্যাসের বীজ লুকিয়ে আছে এর সঠিক ব্যাখ্যা কী?

একটু কি বেশি প্রশ্রয় পায় সুনয়না মৃন্ময়ের কাছ থেকে?

বাইরে অঝোরে বৃষ্টি চলছিল সেদিন, লোডশেডিং তো খানিকক্ষণ আগেই হয়েছিল। সুনয়নার আবদারে মৃন্ময়ের স্টাডিতে সেদিন ইনভার্টারের সুইচ অফ, মোমবাতির আলোয় বিদ্যাপতির পদের পর্যালোচনা চলছিল অসমবয়সি দুই সাহিত্যপ্রেমীর মধ্যে।

মিতালী তিন্নিকে নিয়ে গানের স্কুলে গিয়ে বৃষ্টির জন্য আটকে গিয়েছিল।

সুনয়নার গায়ের পারফিউমের গন্ধটা ভেজা মাটির গন্ধ ছাপিয়ে মৃন্ময়ের নাকে ঝাপটা দিচ্ছিল। আজকালকার ভেজাল সুগন্ধিতেও কি মৃগনাভীর মতো দুর্লভ জিনিস দেওয়া থাকে? শ্রীরাধার শরীরের বর্ণনার সাথে সুনয়নার বক্ষবিভঙ্গ মিলে মিশে একাকার হয়ে মাতাল করে দিয়েছিল বিগত যৌবন মৃন্ময়কে। অদ্ভুতভাবে সুনয়নাও কোনো বাধা দেয়নি। যেন আরও তীব্রভাবে আকর্ষণী ক্ষমতা দিয়ে আকৃষ্ট করেছিল এক মধ্যবয়স্ক পুরুষকে।

কপালের বিন্দু বিন্দু ঘামে আর রক্তের দাপাদাপিতে অসহ্য তৃপ্তিতে খাদের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে মৃন্ময় বুঝেছিল, চরম ভুলের মুহূর্তটা পেরিয়ে গেছে।

কোনো কথা না বলে, নিজের সালোয়ারের বোতাম আটকাতে আটকাতেই ছুটে বেরিয়ে গিয়েছিল দশমিনিট আগেই নিজের কৌমার্য হারানো সুনয়না।

দরজার সামনে মিতালী এসে পৌঁছেছিল। হয়তো ওর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় সুনয়নার ভীরু দৃষ্টিকে চিনে ফেলেছিল। আন্দাজ করেছিল ঘটনা প্রবাহের।

এগারো

মিথ্যে কথা বলতে বলতে প্রায় ক্লান্ত মোহিনী, একটা যদি চাকরি জোগাড় করতে পারত তাহলে এই নরক থেকে উদ্ধার পেত।

সকলের কাছে কমলা সূর্যরশ্মি একটা নতুন সকাল বহন করে নিয়ে আসে। ব্যতিক্রমী বোধহয় মোহিনী। রাতের গাঢ় অন্ধকার ফর্সা হয়ে যখন পুব আকাশ একটু একটু করে রেঙে ওঠে, তখনই মোহিনী বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবতে থাকে, আজ তাকে আর কত পাঁক ঘাঁটতে হবে।

পাশের ঘর থেকে বাবার এক নাগাড়ে কাশির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে।

রাত পোশাকে খুব সাধারণ দেখতে মেয়েকেও খুব অসাধারণ লাগে। যদিও মোহিনীর নাইটিটা নেহাতই চৈত্র সেলে কেনা সস্তার। তবুও ঘুম চোখে বিবর্ণ আয়নার সামনে দাঁড়ালে আয়না একটু মুচকি হেসে বলে, মন্দ নয়। সেটা দর্পণের বিচারের ভুল, নাকি মোহিনীর দৃষ্টি ভ্রান্তি তা বুঝতে পারে না মোহিনী।

মোহিনীদের বাড়ির ঠিক সামনেই ছিমছাম একটা দোতলা বাড়ি। বাড়ির বাসিন্দা একজন নামী লেখক। যদিও মোহিনী সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আর বুদ্ধদেব গুহর উপন্যাস ছাড়া তেমন বই পড়েনি। এই মৃন্ময় রায়চৌধুরীর কোনো উপন্যাসও কোনোদিন চোখেও দেখেনি। ভদ্রলোক একাই থাকেন। সঙ্গে একজন বয়স্ক কাজের লোক। ডিভোর্সি বোধহয়। মধ্যবিত্ত ঘরে ছাড়াছাড়ি হলে, লোকের সমালোচনার বিষয় হয়ে যায়, কিন্তু উচ্চবিত্তদের ডিভোর্সটা শীতকালে গাছের শুকনো পাতা ঝরার মতোই অত্যন্ত স্বাভাবিক ঘটনা।

কানাকানির দৌলতে এ চত্বরে মানুষের বেশ আগ্রহের বিষয় ওই লেখক। তবে শুনেছে নাকি মানুষের বিপদের দিনে মৃন্ময়বাবু পাশে থাকেন।

চারপাশের লোকের আলোচনা বা সমালোচনা থেকে একটু জানা যায়, অধ্যাপক এবং লেখক মৃন্ময়বাবুর স্ত্রী নাকি ছাত্রীর সাথে ওনার সম্পর্ক আছে এই সন্দেহে বাড়ি ছেড়েছেন। মাঝে মাঝে একটি মধ্য বয়সি মহিলা বাড়ির গেট দিয়ে বেরিয়ে যান, তিনি মৃন্ময়বাবুর স্ত্রী না ছাত্রী তা মোহিনীর জানা নেই। জানার আগ্রহও অবশ্য নেই।

বড়লোক, নামী মানুষদের নিয়ে মোহিনীর আজকাল কোনো ইন্টারেস্ট নেই। মোহিনীর ধারণায় সকলের দৃষ্টিই মেয়েদের শরীরের দিকে।

বারো

নিজের পুরুষত্ব বেচে রোজকার? শুধু সুখের সন্ধান নয় অর্থের আগমনও হয় তাহলে? সমস্যা হল, সৌম্য কোনো বন্ধু বা পরিচিতের সাথে এই বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করতেই পারছে না। এমনকী আজ সকালে ফোন করলেও এখনও যার উপস্থিতি প্রসকোয়াটারে তেমন বন্ধুকেও জিজ্ঞেস করতে পারছে না কারণ সে চমকে উঠে বলবে, সৌম্য তুই? তুই যাবি ওসব প্রফেশনালদের কাছে?

যেন সৌম্য অন্য গ্রহের পুরুষাঙ্গহীন কোনো জীব।

আরও একটা নিঃসঙ্গ রাতের পরিকল্পনা, যেখানে সৌম্য অজন্তা গুহাচিত্রের নগ্ন নারীকে তৃপ্তি দিচ্ছে, নরম শরীরটি তৃপ্তির শিহরণে শিউরে উঠছে বারংবার।

রতিক্রিয়ার পর সেই মহিলার কাছ থেকে হাত পেতে টাকা নেওয়াটা একটা বর্বর অসভ্যতা হয়ে যায় বোধহয়।

খবরের কাগজের বিজ্ঞাপন পত্র মিতালী দেখে ফোনটা যখন করেছিল সৌম্য, ভেবেছিল হয়তো কোনো একটা নির্দিষ্ট মেয়ের নম্বর, এটা যে-কোনো ফ্রেন্ড ক্লাব সেটা ও বুঝতে পারেনি।

চারদিকে এই ফ্রেন্ড ক্লাবগুলো যখন গজিয়ে উঠছে এবং রমরম করে চলছে তখন কাস্টমার নিশ্চয় সৌম্য একা নয়।

সৌম্যর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে সাকুল্যে আঠেরো হাজার পড়ে আছে, কিন্তু আপাতত ওর দরকার পঁচিশ হাজার। আরও সাত হাজার! বেকার ছেলেদের ধার দেবার বন্ধুও খুব কমই থাকে। মাসের প্রথমে মাইনে পেয়ে শোধ দেবার নির্দিষ্ট কথা থাকে না যে।

ফ্রেন্ড ক্লাবের কথা মতো পঁচিশ ডিপোজিট করলেই ত্রিশ ফেরত পাবে সৌম্য। পাঁচ হাজার ওর লাভ, কিন্তু ওই সাত হাজার দু-দিনের জন্য ধার দেবে কে?

হরি জ্যাঠাকে একবার বললে হয়, বুড়ো দীর্ঘদিন ধরে প্রফেসরের বাড়িতে চাকরি করছে, জমিয়েছেও প্রচুর। বুড়োর তিনকুলে কেউ নেই। সৌম্যর নিজের জ্যাঠা নয়, বাবার খুড়তুতো সম্পর্কের। তবে ছোট থেকেই সৌম্যকে বড় ভালোবাসেন। যখনি দু-একদিনের ছুটিতে সৌম্যদের বাড়ি আসেন তখনি ওর হাতে কিছু টাকা দিয়ে যান।

ঘুম থেকে উঠে যখন হরি জ্যাঠার মুখটা মনে পড়ল তখন একবার ফোন ঘেঁটে জ্যাঠার ফোন নম্বরে একটা ফোন করতে ক্ষতি কী?

তেরো

দাদাবাবু আপনার ঘরে এখনও আলো জ্বলছে, কত রাত হল খেয়াল আছে? হরিপদর সাধারণ গলাতেও কেঁপে উঠল মৃন্ময়। ভাবনার অতলে ঝাঁপ দিয়ে পৌঁছে গিয়েছিল অনেকগুলো বছর আগে। ফিরতে সময় লাগল একটু।

লেখার পাতায় দু-একটা হাবিজাবি লাইন ছাড়া আর কিছুই লিখতে পারেননি সেটা খেয়াল হল এখন। ধীরে ধীরে নিজের বেডরুমের দিকে এগোতে থাকলেন। বিছানায় শুয়েও ঘুমের প্রতীক্ষায় কাটবে আবার একটা নির্ঘুম রাত।

চোদ্দো

ক্ষমা তো কবেই করে দিয়েছে মৃন্ময়কে, কিন্তু সেই স্বাভাবিক সম্পর্কটা আর কোথায়?

মাঝে মাঝে ওর বাড়িতে গিয়ে আত্মীয়দের মতো কয়েকঘণ্টা কাটানো, তাও তো সেটা শুধু তিন্নিকে নিয়ে আলোচনার জন্যই। মিতালী বুঝতে পারে ভিতরে ভিতরে ক্রমাগত ক্ষয় হয়ে চলেছে মৃন্ময়। নিজেও কী কিছু কম ছাড়ল জীবনে।

পনেরো

পূজার সত্যিই সন্তান চুরি গেছে নাকি ওর মনের বিকৃতি সেটা এখনও পরিষ্কার নয় অভিক আর তিন্নির কাছে। আগামীকাল ওদের কলকাতায় ফেরার দিন।

অভিকের সাথে বাবা আর মায়ের পরিচয় করিয়ে দেওয়াটা এবার একটু আবশ্যক হয়ে পড়েছে। ফ্লাইট লেট না করলে ওরা সকাল ন-টার মধ্যেই বাড়ি পৌঁছে যাবে। অভিক যাদবপুরে ওর দাদার বাড়িতে দু-দিন থেকে শ্রীরামপুরে ওদের দেশের বাড়িতে ফিরবে। তিন্নি এখনও নিজের পনেরো দিন ভাগ করেনি। ক-দিন বাবা আর ক-দিন মায়ের কাছে থাকবে তার সিদ্ধান্ত এখনও নেওয়া হয়নি ওর। তবে ও আর অভিক দিন তিনেক কলকাতার রাস্তায় অন্ধকারে ঘুরে বেড়াবে ফুটপাত ধরে। রাতের তিলোত্তমা নগরীর আলোর আড়ালে অন্ধকারটাকে খুব কাছ থেকে দেখবে বলে।

ষোলো

খুব সাবধানে ফোন করল মিতালী। মৃন্ময়ের কাছে ওর এই একাকীত্ব যেন কোনোভাবেই প্রকটিত না হয়ে পড়ে।

মৃন্ময়ের গলাটা শুনলে মিতালীর আজও হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়, এটুকুকে আড়াল করার ব্যর্থ চেষ্টা করে ভীষণ স্বাভাবিকভাবেই বলল, কাল তিন্নি আসছে। আমি চাই এই ক-টা দিন একসাথে থাকতে। আমাদের ভাগাভাগির মধ্যে মেয়েটা কষ্টে না পড়লেই ভালো হয়।

মিতালীর কথাগুলো ভোরে স্নিগ্ধ আলোয় একটা অদ্ভুত মায়ার আকার নিল। এইটুকু ক্ষমাও যে মিতালী মৃন্ময়কে করেছে এতেই সে ধন্য।

আগ্রহের সাথে মৃন্ময় বলল, গাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছি, তুমি তোমার ক-দিনের লাগেজ নিয়ে চলে এসো।

বেশ কিছুক্ষণের নীরবতার পরে বিচ্ছিন্ন হল ফোনের কানেকশন।

সতেরো

রিং বাজছে হরিপদ জ্যাঠার ফোনে, একটা বেশ গম্ভীর গলায় কেউ হ্যালো বলল। এই গলাটা আর যারই হোক হরি জ্যাঠার অন্তত নয়। নম্বরটা ঠিক ডায়াল করেছে কিনা সন্দেহ হওয়ার সাথে সাথেই ওদিকের গলায় বিরক্তি ঝরে পড়ল। দ্বিতীয়বার হ্যালোটা আর প্রথমের মতো মোলায়েম নয়।

হরিপদ জ্যাঠা আছেন?

কোনো দ্বিতীয় কথা ছাড়াই হাঁক পাড়লেন ভদ্রলোক, এই হরিপদ কেউ তোকে ফোন করেছে, ধরে কথা বল।

হরি জ্যাঠা খুব আড়ষ্ঠ গলায় বলল, কে বলছ?

সৌম্যর নাম শুনে খুব অবাক হয়েছে সেটা নিঃশ্বাসের ওঠানামাতেই পরিষ্কার হল।

সেটুকুকে খুব সাবধানে গিলে নিয়ে হরি জ্যাঠা বলল, বল রে কী দরকার সৌম্য তোর?

সৌম্য ভূমিকা না করেই বলল, ”হরি জ্যাঠা মাত্র তিন দিনের জন্য হাজার সাতেক ধার দিতে পারবে?”

হরি জ্যাঠার কাছেও যে কেউ ধার চাইতে পারে তা বোধহয় উনি নিজেও জানতেন না। বাবু একটা অ্যাকাউন্ট খুলে দিয়েছেন ব্যাঙ্কে, সেখানে বাঁকা বাঁকা অক্ষরে সইও করে। কিন্তু ঠিক কতটাকা সেখানে জমেছে তার হিসেব তো কিছুই জানে না সে।

একটু উদ্বিগ্ন স্বরে জানতে চাইলেন, ”হ্যাঁরে বাড়ির সবাই ভালো তো?”

সৌম্য ওকে নিশ্চিন্ত করে বলল, ”টাকাটা আমার দরকার জ্যাঠা।”

কাল সকাল দশটার পরে ওই প্রফেসরের বাড়িতে আসতে বলে ফোন রাখল জ্যাঠা।

ব্যাঙ্কের পাশ বইটা সঙ্গে নিয়ে বেড়িয়ে পড়ল সৌম্য। হরি জ্যাঠার মালিকের বাড়ি হয়ে ব্যাঙ্কে যেতে হবে। মাত্র দু-দিনের মধ্যে নিজের পঁচিশ সহ আরও পাঁচ লাভ হবে। এই পাঁচ হাজার না হয় দিদির হাতে দিয়ে দেবে সৌম্য। আর ব্যাঙ্কে আঠেরো আবার রেখে দেবে নিঃশব্দে।

রাত আটটায় যে মহিলার সাথে আজ ওর দেখা হবে সে ঠিক কী ধরনের পারফিউম ব্যবহার করে সেটা ভাবতে ভাবতেই পৌঁছে গেল বাড়ির বাগান ঘেরা পাঁচিলের সামনে।

হরি জ্যাঠা বাজারের ব্যাগ হাতে গেটের দিকেই আসছিল। সৌম্যকে দেখে ভিতরে আসতে বলল। একটু অস্বস্তি হচ্ছে, সামনা-সামনি হরি জ্যাঠার চোখের দিকে তাকিয়ে মিথ্যে বলে টাকাটা নিতে। বাড়ির ভিতরে অল্পবয়সি ভীষণ স্মার্ট একটা মেয়ে আর একজন ষাট ছুঁই ছুঁই রাশভারী ভদ্রলোক বসে আছেন সামনের সোফাতে। হরি জ্যাঠা পরিচয় করিয়ে দিল নিজের ভাইপো বলে। বাধ্য হয়ে প্রফেসরকে প্রণাম করতে হল সৌম্যকে। অল্পবয়সি মেয়েটি, একটু উচ্ছ্বাসের সাথে জিজ্ঞেস করল, আপনি কলকাতাতেই থাকেন? স্ট্রিট বেগার্স সম্পর্কে আমাকে কিছু তথ্য দিতে পারবেন?

সৌম্য হরি জ্যাঠার কাছ থেকে ধার চাইতে এসেছে বলে কী মেয়েটা ওকে রাস্তার ভিখিরি ভেবেছে নাকি?

প্রফেসর এবার গুরুগম্ভীর গলায় বললেন, তিন্নি তুমি কী মানুষ দেখলেই এই আলোচনা শুরু করবে? কোথায় কী অপরাধ ঘটে চলেছে তার সব তুমি একাই সল্যুশন করবে ভেবেছো? বেগার্সদের বাচ্চা চুরির অপরাধীদের শাস্তি দেবার জন্য দেশে আইনকানুন আছে।

তিন্নি বলে মেয়েটা মাথা নিচু করে, সৌম্যর দিকে তাকিয়ে সরি বলল।

হরিজ্যাঠা একটা সাদা খামে ভরে টাকাটা নিয়ে এসেছে। টাকাটা হাতে নিয়ে সৌম্য বলল, জ্যাঠা তিন দিনের মধ্যে এসে ফেরত দিয়ে দেব।

আবার ওই তিন্নি হেসে বলে উঠল, তাহলে তো তিনদিন পরই আপনি কাজটা করতে পারতেন, তা হলে আর লোকের কাছে হাত পাততে হত না?

কানগুলো অপমানে লাল হয়ে উঠল সৌম্যর। মাথা নিচু করে গোলাপের বাগানের মধ্যে দিয়ে বেরিয়ে এল ও।

বাইরে বেরিয়েই ফ্রেন্ড ক্লাবে ফোনটা করল ও।

এবার আর গলাটা চিনতে অসুবিধা হল না।

গত চারদিন ধরে এই মেয়েটির কথাই শুনে আসছে ও। এমনকী ওর গলা শুনে ওর চেহারাও কল্পনা করে ফেলেছে সৌম্য।

অ্যাকাউন্ট নম্বরটা বার দুয়েক বলল মেয়েটি। যে নম্বরে এখুনি পঁচিশ হাজার টাকা ডিপোজিট করতে হবে ওকে।

রাত আটটায় ওর নম্বরে ফোন করে ওরাই জানিয়ে দেবে, ঠিক কোন অ্যাড্রেসে ওকে যেতে হবে।

আঠারো

এতদিন ধরে এই সেন্টারে কাজ করছে মোহিনী, কোনোদিন ওর মনে হয়নি বেশ কিছু মানুষ তাদের উপার্জিত অর্থের বিনিময়ে প্রবঞ্চিত হচ্ছে। আর পরোক্ষভাবে এই প্রবঞ্চনা করে চলেছে মোহিনী নিজেও। আজ ওই সৌম্য নামের ছেলেটার সাথে কথা হবার পর বারবার মনে হচ্ছে, একে ফোন করে জানানো দরকার, যে সে ওদের পাতা নিখুঁত ফাঁদে পা দিয়েছে। সৌম্যর নাম্বারটা টাইপ করতে গিয়ে ওর মনে পড়ে গেল, ওষুধের দোকানে বেশ কিছু টাকা ধার আছে। কাল মাইনে পেলে তবেই শোধ করে বাবার জন্য নতুন ওষুধ কিনতে হবে। মোহিনী ধীরে ধীরে নিজের ফোনের স্ক্রীন থেকে মুছে দিল কাস্টমারের নাম্বারটা। ওর নিজের ভাগ্যও তো বিট্রে করেছে ওকে। তাহলে আর কার প্রবঞ্চনা আটকাতে যাবে মোহিনী।

উনিশ

পুরো পঁচিশ হাজার রজত চৌধুরির অ্যাকাউন্টে ট্রান্সফার করার সময় ছোটো বোনটার ভাঙা সাইকেল, দিদির সাদা সিঁথি আর বাবার দম দিয়েও না চলা ঘড়িটার কথা বড্ড মনে পড়ছিল সৌম্যর।

তবে ত্রিশ হাজার তো আজ রাতেই পেয়ে যাবে তখন না হয় বাবাকে একটা ঘড়ি কিনে দিলেই চলবে।

সন্ধে সাতটার থেকেই নিজের শরীরের একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করছিল সৌম্য। ব্লু ফিল্ম বা পর্ন বই পড়ার থেকেও অন্যরকম এক অনুভূতি। যদি ওই মহিলাকে সেক্সুয়ালি হ্যাপি করতে না পারে, যদি সে ত্রিশ হাজার না দেয়! এতদিন শারীরিক উত্থান-পতনগুলো ছিল ওর একান্ত নিজস্ব চিন্তা ভাবনার। কল্পনায় নারী শরীরকে উপভোগ করা, আর বাস্তবে একজন সম্পূর্ণ অপরিচিতাকে এতটা কাছ থেকে পাওয়ার মধ্যে তফাতটা সৌম্যকে বেশ ভাবাচ্ছে।

আটটা বেজে গেল, বারবার নেটওয়ার্ক চেক করছে সৌম্য। না কোনো ফোন ঢোকেনি ওর ফোনে ওই নম্বর থেকে।

সাড়ে আটটায় ওদের সেন্টারে ফোনটা বেজেই গেল। কেউ রিসিভ করল না।

আধঘণ্টা অন্তর অন্তর ফোন করেই চলল সৌম্য।

আজ আর অন্ধকার বিছানায় কোনো পেলব মসৃণ শরীরের কল্পনা নেই, শুধু পঁচিশ হাজারের একটা হিমশীতল স্রোত ওর পিঠের ভিতর দিয়ে সিথিল যৌনাঙ্গে অতিক্রম করে বারবার নেমে যাচ্ছে। বাবা, মা, হরিজ্যাঠা এমন কী ওই প্রফেসরের স্মার্ট মেয়েটা পর্যন্ত যেন নিষ্ঠুরভাবে হাসছে ওকে দেখে। কী ভীষণ ভাবে ঠকে গেছে ও।

বিদ্রুপ করছে, বিবাহযোগ্যা দিদির ক্লান্ত হাসি।

ঘামে শপশপে হয়ে ঘুমটা ভেঙে গেল সৌম্যর। মানবাধিকার কমিশনের কাছে যাবে ও, কেস করবে এই সব ফ্রেন্ড সেন্টারের বিরুদ্ধে?

থমকে গেল ওর ভাবনা।

কাগজের প্রথম পাতায় হয়তো উঠে আসবে ওর বিকৃতকাম মানসিকতা। আড়ালে আবডালে ওর বাবাকে দেখে লোকে আলোচনা করবে, এর ছেলে টাকার বিনিময়ে বেচতে গিয়েছিল নিজের পুরুষত্ব।

প্রফেসরের মেয়ের কাছে গেল হয় না, সে নাকি ঠকে যাওয়া, বঞ্চিত হওয়া মানুষদের নিয়ে লড়ছে।

ফোনটা বাজছে ভোর রাতে।

কুড়ি

আজ কনফেস করবে মোহিনী ওই সৌম্য বলে ছেলেটার কাছে। চাকরিটা ছেড়ে দেবে মোহিনী। রান্নার কাজ নেবে লোকের বাড়িতে, অথবা নিচু ক্লাসের টিউশনি।

হ্যালো, আমি ফ্রেন্ডস ক্লাব থেকে মোহিনী বলছি…

একুশ

অভিকের একটা অদ্ভুত মিশুকে ক্ষমতা আছে। অনেকদিন পর মৃন্ময় আর মিতালী একই সাথে হেসে উঠল। তিন্নির মুখেও একঝলক আবিরের ছোঁয়া লক্ষ্য করল মিতালী। মৃন্ময়কে সেদিকে দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য আলতো করে ওর হাতের আঙুলগুলো ছুঁয়ে দিল মিতালী।

হন্তদন্ত হয়ে একজন ছেলে আর একটা মেয়ে গেট খুলে সটান এগিয়ে আসছে ওদের বসার ঘরের দিকে।

ছেলেটি তো গতকালই এসেছিল, হরিপদ জ্যেঠুর ভাইপো নাকি যেন।

মোহিনীর বলে দেওয়া অ্যাড্রেস আর প্রফেসরের বাড়ির ঠিকানাটা একই ছিল। প্রথমে মোহিনী সৌম্যর কেস করার কথায় আপত্তি করেছিল। কিন্তু সৌম্যর নিজের সম্মান বাজি রেখে এই লড়ার মানসিকতাটা ওকে উদ্বুদ্ধ করেছে বোধহয়।

হরিজ্যাঠা চারটে গ্লাসে ঠান্ডা শরবত রেখে গেছে। অভিক আর শতভিষা প্রথম থেকে শেষপর্যন্ত সবটা শুনল সৌম্যর কাছ থেকে। সব থেকে আশ্চর্যের ব্যাপার মোহিনীর দেওয়া অ্যাকাউন্ট নম্বরগুলো সবই প্রায় বেনামে। ওই অ্যাকাউন্টের টাকা যে ঠিক কোথায় যায় তা মোহিনীও জানে না। এমনকী মোহিনী ওই সেন্টারের মাইনের যে পদ্ধতি বলল, সেটাও নাকি মোহিনীর অ্যাকাউন্টে ট্রান্সফার করা হয়। মাঝে মাঝে শুধু একটা অজানা নম্বর থেকে ইনস্ট্রাকশন আসে মোহিনীর কাছে। আদৌ কোনো সেক্সকর্মী সত্যিই সশরীরে আছেন, নাকি ওই নামগুলো কল্পিত তারও সঠিক ধারণা নেই মোহিনীর।

প্রথম দিন যে ভদ্রলোক ওর ইন্টারভিউ নিয়েছিল তাকে আর এই ক-মাসে দেখেনি মোহিনী। অভিক ভ্রূ কুঁচকে বলল, দেখলেও আর চিনতে পারবে না হয়তো। ছদ্মবেশে ছিল নিশ্চয়। মোহিনীর দেওয়া প্রতিটি ফোন নম্বরে তিন্নি ফোন করে চলেছে, রেজাল্ট একই। তাদের কোনো অস্তিত্ব বাস্তবে নেই। হাল ছাড়া গলায় সৌম্য বলল, তাহলে দিনের পর দিন মানুষগুলোকে প্রলোভন দেখিয়ে সর্বশান্ত করবে এরা?

তিন্নি আর অভিক এক সাথে বলে উঠল, তোমাদের সত্য খোঁজার লড়াইয়ে আমরা দুজনও সঙ্গী হলাম আজ থেকে।

বাইশ

অনেকদিন পর মিতালী আজ রান্না ঘরে ঢুকে অপরিচিতের মতো এদিক সেদিক তাকাচ্ছে। ষোলো বছর আগের রেখে যাওয়া ওর একান্ত জায়গাটা একটুও বদলায়নি যেন। শুধু একটা কালবৈশাখীতে একটু এলোমেলো করে দিয়েছিল।

মৃন্ময় খাতার পাতায় আজ আর অযথা আঁকিবুঁকি কাটছে না। লিখতে শুরু করেছে নতুন লেখার প্রথম লাইন।

মোহিনী আর সৌম্য বাগানের হাসনুহানার গন্ধটা ঘ্রাণে মিশিয়ে নিতে নিতে এগিয়ে চলল এক সাথে পা মিলিয়ে। ঈশ্বরের গোপন অভিসন্ধিতে হয়তো সৌম্য আর মোহিনীর আলাপটা একটা সম্পর্কের সূচনা করতে চলেছে।

অধ্যায় ২০ / ২০

সকল অধ্যায়

১. গেম ইজ ওভার – অর্পিতা সরকার
২. টুরিস্ট গাইড – অর্পিতা সরকার
৩. দ্য ড্রিম গার্ল – অর্পিতা সরকার
৪. দীর্ঘ প্রতীক্ষা – অর্পিতা সরকার
৫. পার্কের বেঞ্চটা – অর্পিতা সরকার
৬. স্বপ্নের পাসওয়ার্ড – অর্পিতা সরকার
৭. সেই টেলিফোন – অর্পিতা সরকার
৮. হিসেব না মেলা অঙ্ক – অর্পিতা সরকার
৯. লাইট ক্যামেরা অভিনয় – অর্পিতা সরকার
১০. অহংকার – অর্পিতা সরকার
১১. প্রেমের সাইডএফেক্ট – অর্পিতা সরকার
১২. পিতৃঋণ – অর্পিতা সরকার
১৩. অবয়ব – অর্পিতা সরকার
১৪. মধুচন্দ্রিমা – অর্পিতা সরকার
১৫. ভাড়াবাড়ির আত্মীয়রা – অর্পিতা সরকার
১৬. সময় থমকে গেছে – অর্পিতা সরকার
১৭. তেরোটা বছর – অর্পিতা সরকার
১৮. খেলনা বাড়ির মেয়ে – অর্পিতা সরকার
১৯. প্রসব বেদনা – অর্পিতা সরকার
২০. দেখা না দেখায় মেশা – অর্পিতা সরকার

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন