অর্পিতা সরকার
ক্লাস সেভেনে আমি প্রথম মা হই।
ক্যামেরার ঝলকানি, সামনে রিপোর্টেরর ভিড়।
কয়েকজন তো সীমানার ফিগারটা আরেকবার মেপে নিল। না, কোথাও কোনো বাড়তি মেদ নেই। চামড়ার টানটাও আলো পড়ে ঝলকাচ্ছে। পরনে ক্রিম আর ব্ল্যাক কম্পিনেশনের গাউন, কানে লম্বা ঝোলা দুল, হাতে কপার আর সিলভারের মিক্সড কালারের রিস্টিওয়াচ। পায়ে পেন্সিল হিল। চোখের তারায় আত্মবিশ্বাস।
একজন মহিলা বলল, তাহলে তো সীমানা চৌধুরীর এডুকেশানটা বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে?
সীমানা একটু চুপ করে থেকে বলল, তা হয়েছে… ইচ্ছে ছিল নামি অ্যাডভোকেট হব, কিন্তু কলেজের ফার্স্ট ইয়ারে উঠেই মডেলিং-এর অফারটা পেয়ে যাই।
আপনার ছেলের বয়স এখন কত ম্যাডাম?
সীমানার ঠোঁটের কোণায় রহস্যের হাসি। একটির ১০ আর একটির ৫৮। এবার পার্সোনাল কথা বাদ দিয়ে আমার কামিং মুভির কথায় আসি।
খুব সুন্দরভাবে নিজের ব্যক্তিগত জীবনকে মিডিয়ার কাছ থেকে আড়াল করতে শিখে গেছে সীমানা, মাত্র গত চার বছর এই গ্ল্যামার দুনিয়ায় থেকে।
পরিচালক কঙ্কন রায়ের মুভিতে চান্স পেলেন কী করে? এতদিন তো সহ অভিনেত্রী হিসাবেই মুখ দেখা গিয়েছে আপনার?
বিরক্তিটাকে রেড লিপিস্টিকের আড়ালে রেখেই ঘায়েল করা একটা হাসি হেসে সীমানা বলল, সহ অভিনেত্রী ছাড়াও কিন্তু মুভিগুলো সম্পূর্ণ হত না। সহ অভিনেত্রীর ওই দশ মিনিটের অভিনয়েই কঙ্কন রায়ের মতো জহুরির চোখ হয়তো তার ‘ওগো বিদেশিনী’-র নায়িকা খুঁজে পেয়েছেন।
ম্যাডাম আপনাকে কী ওখানে কোনো বিদেশিনীর চরিত্রে দেখা যাবে?
মিষ্টি করে হেসে সীমানা বলল, ওটুকু সিক্রেট।
মিডিয়াকে কাটিয়ে প্রোডাকশানের গাড়িতে উঠে পড়ল ও।
কয়েকটা সিনেমা হিট করলেই নিজের একটা গাড়ি কিনতে হবে। অন্তত সেকেন্ড হ্যান্ডেড। ইন্ডাস্ট্রিতে নিজস্ব গাড়ি না থাকলে সম্মান থাকে না।
চোখের নীচে যাতে ডার্ক সার্কেল না পড়ে সেদিকে নজর দিয়েই রাত দশটার মধ্যে শুয়ে পড়েছে সীমানা, কিন্তু কাঙ্ক্ষিত ঘুমটাই যে কিছুতেই আসে না।
সীমা… ডাকছে আটান্ন বছরের মানুষটা। এই বয়েসের মানুষটাকে বৃদ্ধ বলাটা বোধহয় সমীচিন নয়, কিন্তু দীর্ঘকালীন হাই প্রেসার, ডায়াবেটিসের চক্করে এই বয়সে দৃষ্টি শক্তি প্রায় হারাতে বসেছেন সোমনাথ চৌধুরী। মাঝে মাঝেই বলেন, বড় আবছা দেখি আজকাল।
সবে মাত্র নিজের উপার্জনের টাকায় বছর পঁচিশ পর একতলা বাড়িটাকে রিপিয়ারিং করে রং করেছে সীমানা। সোমনাথ চৌধুরীর চোখের ট্রিটমেন্ট চলছে। তবে কোনো বড় জায়গায় যাওয়া এই মুহূর্তে সীমানার পক্ষে সম্ভব নয়।
যাই বাবা… ক্লান্ত শরীরটাকে টেনে নিয়ে চলল বাথরুমের দিকে। বাবা আবার ঝাপসা দেখছে। যদি পড়ে যায় তাহলে আবার হাত-পা ভাঙলে সীমানারই বিপদ। তাই সচেতন হয়েই ডাকছে মানুষটা।
সীমানা যেতেই অসহায়ের মতো বললেন, দেখ না আবার সেই অন্ধকার!
হাতটা ধরেই বাচ্চাদের মতো পা ফেলে ফেলে চলতে শুরু করল বাবা।
সীমানার ৫৮ বছরের সন্তান। আরেকজন সীমানার বিছানায় ওর গায়ে পা তুলে দিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে। আলতো করে ওর পা’টা সরিয়ে বিছানা থেকে নেমে এসেছে সীমানা।
ঘর থেকেই ডাক দিল ওর আরেক সন্তান, দিদিভাই… কোথায় গেলি তুই…? বাবাকে ঘরে পৌঁছে দিয়েই নিজের ঘরে ঢুকে বার দুয়েক পিঠে হাত বুলিয়ে দিতেই ঘুমিয়ে পড়ল সৌমিক। শুধু নির্ঘুম চোখে ভাবছে সীমানা… কঙ্কন রায়ের ছবিতে সই করার পর থেকেই ভাবছে। গানের সিকোয়েন্সগুলো তো উনি বিদেশের প্লটে করবেন ঠিক করেছেন, তখন সৌমিক আর বাবাকে কার দায়িত্বে রেখে যাবে ও! যত রাত করেই শুটিং থেকে ফিরুক, দুটো মানুষ ঘুম ঘুম চোখে অপেক্ষা করেছে এতকাল। এই প্রথম বাড়ির বাইরে গিয়ে বেশ কিছুদিন থাকতে হবে। এর আগে একদিনের দীঘা অথবা শান্তিনিকেতনেই কিংবা দার্জিলিংয়ে কাজ সেরেছে সহ অভিনেত্রী হিসেবে।
ভাবনার অতলে তলিয়ে যেতে যেতে খড়কুটোর মতো মনে পড়ল মিনু মাসির কথা।
সেই মিনু মাসি। বেঁটেখাটো, একমাথা চুল আর কপালে একটা বড় টিপ, সিঁথিটা চওড়া হতে হতে বেশ প্রশস্ত রাস্তা হয়ে গেছে। তবু সিঁদুর পরা কমেনি। বরং সিঁথি বাড়ার সাথে সাথে সিঁদুরের পরিমাণ আরও বেড়েছে। ছোটবেলায় মিনু মাসির আঁচল ধরে সীমানা জিজ্ঞেস করত, ও মাসি বলো না মেসো কোথায় থাকে?
মাসি চোখ দুটো মুহূর্তে চারদিকে ঘুরিয়ে তারপর বলত, উত্তর-দক্ষিণ, পূর্ব-পশ্চিমের কোথাও একটা থাকে। আমি তো তাকে সেই শেষ দেখেছিলাম তখন আমার বয়স মাত্র সতেরো। সেই যে ইলিশ মাছ দিয়ে ভাত খেয়ে বাড়ি ছাড়ল, আর তো জানতে পারলুম না সে কোথায় গেল বা কেন গেল?
মাসির চোখ দুটো একটু উদাস হয়ে যেত। সীমানা একবার জিজ্ঞেস করেছিল, তোমার স্বামী যখন থানে না তখন এত সিঁদুর পরো কেন?
মাসি কপালে হাত ছুঁইয়ে বলেছিল, ওরে এই সিঁদুরের জোরেই তো সে দেশে-বিদেশে ঘুরে বেড়াচ্ছে, এই সিঁদুরের জোরেই তো আবার কোনোদিন আমার কাছে ফিরে আসবে।
বিশ্বাসবিহীন প্রত্যাশারও এত শক্তি থাকে সীমানা সেই বয়সে বোঝেনি। আজ অবশ্য বোঝে। সম্পূর্ণ অবিশ্বাস থাকলে সেখানে আশা থাকতে পারে না। কোথাও না কোথাও বিশ্বাসের ছিটেফোঁটাতো নিশ্চয়ই থেকেই যায়।
সৌমিক পাশ ফিরল। ঘুমন্ত সৌমিকের মুখের দিকে তাকিয়ে চোখ দুটো জ্বালা করে উঠল সীমানার।
ক্লাস সেভেনের মেয়ের কোলে যখন রমা জেঠিমা নরম কাপড় জড়ানো রক্তের পুটুলিটাকে দিল, তখন তো সীমানা ওকে ধরতেই পারছিল না। রমা জেঠিমা কাঁদতে কাঁদতেই বলল, তোর মা তোকে এই বয়সেই মা করে দিয়ে গেল রে সীমা।
কিছুক্ষণের মধ্যেই মায়ের ডেড বডি নিয়ে বাড়িতে ঢুকল পাড়া প্রতিবেশী আর সঙ্গে অবশ্যই প্রায় সংজ্ঞাহীন ওর বাবা। সীমানার মা মারা গেছে, পৃথিবীর কোথাও মা নেই এই উপলব্ধিটুকু হতেই ও কাঁদতে শুরু করেছিল, কিন্তু ওর কান্নাকে ঢেকে দিয়ে কোলের রক্তের ঢেলাটা চিল-চিৎকারে বুঝিয়ে দিল পৃথিবীর শক্ত মাটিতে ওর অস্তিত্বের কথা।
নিজের চোখের জল না মুছেই বাচ্চাটাকে ভোলাতে চেষ্টা করছিল ও। মায়ের পেটে এই ভাইটা ঢোকার পর থেকেই মায়ের রক্ত কমতে থাকে, শরীর অসুস্থ হতে শুরু করে। তবু সীমানার মনে আনন্দ ছিল, একটা পুতুল পুতুল ভাই কী বোন হবে। স্কুলের বন্ধুদের আগাম নিমন্ত্রণ ছিল, মা যেদিন চোখ নড়া পুতুলটাকে নিয়ে বাড়ি ঢুকবে সেদিনই ওদের সকলকে চকলেট খাওয়াবে ও।
কোলেরটা অকারণে কেঁদেই চলেছে।
ঠিক সেই সময় মিনু মাসি এসে বাঁচিয়েছিল ওকে। ঘরের মধ্যে নিয়ে গিয়ে নিজের স্তনটা ভাইটার মুখে পুরে দিয়েছিল। অদ্ভুতভাবে ভাইটার কান্না থেমে গিয়েছিল। সীমাকে বলেছিল, যা একটু গরুর দুধ নিয়ে আয়। পাড়ার কাকিমারাই ব্যবস্থা করেছিল দুধের। মিনু মাসি ওদের বলেছিল, মরণ আমার বুক এখন শুকনো, রমেশের বয়স কত হল বল দিকিনি! দুদিন পর ওরই বাচ্চা হবে। শুধু কান্না ভোলাতে মুখে গুঁজে দিয়েছিলাম।
পাড়ার লোকেরা বাবার মাথায় জল দিচ্ছিল। বাবার নাকি বারবার জ্ঞান চলে যাচ্ছিল।
সীমানা কাঁদতে কাঁদতে মিনু মাসিকে বলছিল, মাসি গো তুমি আমাদেরকে ছেড়ে যেও না। মিনু মাসি আসলে মায়ের মাসতুতো বোন কিন্তু মায়ের সাথে বরাবরই বড্ড ভাব ছিল। কে জানে ভাইয়ের চিল চিৎকার আর সীমানার নোনতা জলের কাকুতিমিনতির দিকে তাকিয়েই বোধহয় মাসি থেকে গিয়েছিল ওদের বাড়িতে।
রমেশদাদা আর বউদি এসে একদিন দেখা করে মাসির জামাকাপড় দিয়ে গিয়েছিল।
প্রায় মাস ছয়েক ছিল মিনুমাসি। তারপর বাবা আস্তে আস্তে মানসিকভাবে সুস্থ হয়ে উঠল, ভাইও নরম খাবার খেতে শিখল, শুধু সীমানাই সেবার ক্লাস এইটে উঠল না, সেভেনেই থেকে গেল।
বান্ধবীরা নতুন বইয়ের ঘ্রাণ নিল। শুধু সীমানার জগৎ জুড়ে একটা কচি গায়ের গন্ধ।
মিনু মাসি চলে গেছে, বাড়িটাকে একটু সামলে নিয়ে আবার আসবে কথা দিয়ে।
একদিন রাতে ভাইয়ের কান্না কিছুতেই থামছিল না। খেলনা দেখিয়ে, কাঁধে ফেলে বাবা অনেক ঘুরিয়েও আনল। তবুও ভাই কেঁদেই চলেছে। বাবা অধৈর্য হয়ে সীমানার কোলে এনে বসিয়ে দিল।
মনে পড়ে গেল মিনু মাসির সেই কথাটা, দরজা বন্ধ করে ভাইকে কোলে নিয়ে বসেছিল ও। আস্তে আস্তে নিজের সদ্য প্রস্ফুটিত স্তনে ভাইয়ের ঠোঁট ছোঁয়ালো সীমানা। ভাই তার ঠোঁট আর জিভ দিয়ে আস্বাদন করে যাচ্ছিল দুগ্ধবিহীন মাতৃস্তন। মাতৃত্বের স্বাদ কী সেদিনই পেয়েছিল সীমানা?
অদ্ভুত উপায়ে ভাইয়ের কান্না বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। সেদিনের কথাটা সীমানা কাউকে আর বলেনি।
সকালবেলা সৌমিককে রেডি করে স্কুলে পাঠিয়ে, বাবার খাবার গুছিয়ে, নিজের মেকআপ কিড নিয়ে বসল ও। যদিও স্টুডিও তে ঢোকার পরেই কার্ত্তিকদা ওর মেকআপ করে দেবে, তবুও রাস্তায় বেরোনোর আগে নিজেকে গোছানোটা ভীষণ দরকার। বিশেষ করে টলিউডের এক নম্বর নায়িকাদের টেক্কা দিয়ে ও যখন সিংহানিয়া ব্যানারের, কঙ্কন রায়ের মতো বড় পরিচালকের মুভিতে সুযোগ পেয়েছে তখন নিজেকে প্রেজেন্ট করাটা ওর দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে।
কন্সিলার দিয়ে নিজের কানের পাশে গভীর ক্ষতটা ঢাকতে ঢাকতেই মনে পড়ে গেল, আগের দিন মেকআপ ম্যান কার্ত্তিকদা জিজ্ঞেস করেছিলেন, ম্যাডাম ছোটবেলায় কোথাও থেকে পড়ে গিয়েছিলেন কি?
ছোট্ট করে মাথা নেড়ে ওর কথার সম্মতি দিয়েছিল সীমানা।
কার্ত্তিকদা আর একটু কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন, গাছ থেকে নাকি?
মুখে হালকা হাসিটা ছড়িয়ে ও বলেছিল, পেয়ারা গাছ।
কে জানে ক্ষতটা দেখে হয়তো কার্ত্তিকদার মনে হয়েছিল এটা পড়ে যাওয়ার ক্ষত নয়? বাবা ডাকছে পাশের ঘর থেকে। এই মাত্র বাবাকে সবকিছু গুছিয়ে দিয়ে এসেছিল সীমানা, তবুও যে কেন বাবা এতবার ডাকে! যখন অফিস করত তখন কিন্তু বাবা এতটা অবুঝ ছিল না। অসুস্থতার কারণে রিটায়ারের আগেই ভি আর নিতে হল বাবাকে। আজকাল তো ভাইও ক্রিকেটের নেশা বাদ দিয়ে বাবাকে গল্প পড়ে শোনায়। ঠোঁটের কোণে এক মিষ্টি হাসির রেখা দেখা দিল সীমানার। ভাইটাও বড় হয়ে গেল! ছোটবেলায় সীমানার সালোয়ারের ওড়না ধরে ঘুরে বেড়াত পায়ে পায়ে। দেখ তো একটা চিঠি দিয়ে গেল, ক্যুরিয়ারের লোকটা। আমি সইও করে দিলাম। কী জানি ঠিক জায়গায় করলাম কিনা! বাবার আজকাল আত্মবিশ্বাসটা তলানিতে এসে ঠেকেছে। একটা সই তাও ঠিক জায়গায় করছে কিনা তাই নিয়ে চিন্তিত।
কোনো পরিচালকের চিঠি নয় তো!
ধুর কী সব ভাবছে সীমানা! মুঠোফোন থাকতে ক্যুরিয়ারে আজকাল কেউ চিঠি পাঠায় না। বাবা আগ্রহ ভরে ঝাপসা চোখে তাকিয়ে আছে খামটার দিকে। কৌতূহল বড় বিষম বস্তু। আর সেটা সব বয়সের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।
আগে তো কোর্টের শমন বয়ে আনত এক পেয়াদা। কোর্টের ডেটে ইচ্ছাকৃতভাবে হাজির হত না সীমানা। মিডিয়া হাঁ করেই আছে, মডেল কী সহ অভিনেত্রী বলে ছাড় পেত না তখন। মিডিয়ার চক্করে রাতারাতি ফেমাস হয়ে যেত ও। তারপর ইন্ডাস্ট্রিতে আনম্যারেড বলে চালানোই দায় ছিল। যদিও থিয়েটার পাড়া থেকে কথাটা একটু আধটু ভেসে আসছিল বটে টালিগঞ্জের বাতাসে, কিন্তু সেই আঁশটে বাতাস শুকে সীমানার ব্যাকগ্রাউন্ড খুঁজতে যায়নি কেউ। কারণ তখন সীমানা মাত্র দুটো ফর্সা হওয়ার ক্রিম আর একটা টয়লেট পরিষ্কার করার লিক্যুইডের অ্যাড দিচ্ছিল।
সীমানা মিউচুয়াল ডিভোর্স চেয়েছিল, কিন্তু রাজীব দিতে চায়নি। আসলে ইন্ডাস্ট্রিতে বদনাম করে দিতে পারলে আর কাজ পাবে না। না খেতে পেয়ে মরবে তিনটে প্রাণী। এর থেকে সুবিধা আর রাজীবের কিই বা আছে!
ক্যুরিয়ারের খামটা খুলেই দেখল একটা পার্লার থেকে পাঠিয়েছে। বহুদিন আগে ওই পার্লার থেকে বিউটিশিয়ান কোর্স করেছিল সীমানা।
ওদের নতুন শাখা উদ্বোধন করছে বলে, একটা ইনভিটেশন কার্ড পাঠিয়েছে, সীমানা চৌধুরীকে, মানে নবাগতা প্রতিভাময়ী নায়িকাকে।
পার্লারের নামটা দেখে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই পৌঁছে গিয়েছিল বেশ কয়েক বছর আগের সময়ে। যখন বিনা পয়সায় ও জয়াদির কাছে কাজ শিখতে যেত। নতুন হাতে আইব্রো প্লাক করতে গিয়ে সামান্য ভুলের জন্য একটা কাস্টমার ভীষণ অপমান করেছিল ওকে। এককোণে কাঁদছিল ও।
জয়াদি ওর পিঠে হাত রেখে বলেছিল, জীবনে যত বেশি ভুল করবি, তত বেশি শিখবি আর নরম মনটাও তখন তলোয়ার হয়ে যাবে। তখন আর তোকে কেউ কাটতে পারবে না, তুই সকলকে ক্ষত-বিক্ষত করতে পারবি অক্লেশে। যত বিজি সিডিউলই থাক জয়াদির পার্লারে ফিতে কাটতে ওই দিন যেতেই হবে।
আজ সীমানার মনের ধার যতই বাড়ুক, কিছু মানুষকে ও এখনও অস্বীকার করতে পারে না। জয়াদি তাদের মধ্যে একজন।
বাইরে গাড়ির হর্ণ।
প্রোডাকশানের গাড়ি এসে গেছে।
বাবাকে আরেকবার ওষুধগুলো বুঝিয়ে দিয়ে বেরিয়ে এল সীমানা।
আশপাশের বাড়ির মহিলারা এই সময় তাদের হাতের হাজার একটা কাজ ফেলেও, ব্যালকনি কিংবা জানলার আড়ালে দাঁড়াবেই সীমানাকে দেখবার জন্য।
হয়তো ওর গাড়িটা বেরিয় যাবার পরই ওর চরিত্র নিয়ে অনেক কথা বলবে কিন্তু আপাতত উঁকিঝুঁকি মেরে ওকে দেখার চেষ্টাটাকে সীমানা ভীষণ উপভোগ করে।
যখন বাবা ভি. আর নিল। যখন ভাইটা বড্ড ছোট ছিল, যেবার সীমানা ক্লাস সেভেনে ফেল করল, তখনও এরা দেখত। কিন্তু তখন এদের চোখে ছিল করুণার ছোঁয়া। আজ দৃষ্টিগুলোতে রয়েছে জমানো ঈর্ষা। এত কষ্টের ফসল হিসাবে ওই ঈর্ষাটুকু সীমানার প্রাপ্য।
কঙ্কন রায়ের গাড়িটা স্টুডিওর সামনেই পার্ক করা রয়েছে।
হিরো রোহানও হাজির মনে হচ্ছে।
ভিতরে ঢুকেই দেখল শুটিং চলছে। নায়কের সাথে কয়েকটা রাজনৈতিক দলের নেতাদের মিটিংয়ের একটি দৃশ্য শুট করা চলছে।
ইশারায় কঙ্কনদা ওকে মেকআপ নিয়ে রেডি হতে বলল।
রিপোর্টার চৈতি সেন হিসেবে যখন ফ্লোরে ঢুকল সীমানা তখন পরিচালকের চোখ দেখেই বুঝতে পারল, অন্তত ওর হাঁটা চলায় কোনো জড়তা নেই।
আজকের শুটিংটা হয়ে যাবার পরেই ঠিক হবে কবে বাইরে যেতে হবে ওদের টিমকে।
ব্যাগের মধ্যে মুঠোফোনের কম্পনটা অনুভব করল সীমানা। ঘড়িতে এখন বিকেল পাঁচটা। নিশ্চয়ই সৌমিক ফোন করছে।
হ্যাঁ ভাই বল…
দিদিভাই তুই আসার সময় একটা প্রোজেক্টের খাতা আনবি। আরেকটা ২বি পেন্সিল। আমি খেয়ে নিয়েছি। ম্যাম আসার আগে একটু কার্টুন দেখছি।
ভাই যখন ফোনে কথা বলে ওর মনে হয় একটা ম্যাচিওর ছেলের সাথে কথা বলছে। আর যখন ওর ওড়না ধরে ছেলেটা অকাতরে ঘুমায় তখন মনে হয় সেই ন’দিনের ছেলেটা, যার মা হয়ে মাতৃত্বের স্বাদ পেয়েছিল সীমানা ওর মেয়েবেলায়। লক্ষ্মীর মাকে বলা আছে রাতের রান্নার জোগাড়টা করে রেখে দিতে, কিছু করে বেশি টাকাও অবশ্য ওকে দিতে হচ্ছে। শুটিংয়ের হাড়ভাঙা খাটুনির পর, সঠিক স্টেপে নাচ শিখতেও তো যথেষ্ট পরিশ্রম করতে হচ্ছে সীমানাকে, এরপর বাড়ি ফিরে আর শরীর দিতে চায় না।
নিজের মনেই একটু হেসে নিল ও। আজকাল ওর শরীরটাও বোধহয় বুঝতে পেরেছে ও বড় ব্যানারে কাজ পেয়েছে। যখন থিয়েটার পাড়ায় প্রতিদিন দুশো টাকায় ও কাজটা করত, তখন শো এর পরে ঢুলু ঢুলু চোখে ভাত বসাত উনুনে। খিদের জ্বালায় ভাই কাঁদতে শুরু করত।
সীমানা শোনে ভিসার ব্যবস্থা হয়ে গেছে। সামনের সপ্তাহের প্রথম দিকেই যেতে হবে। দিন সাতেকের জন্য, ব্যাংকক। দুটো গানের সিকোয়েন্স আছে আর কয়েকটা শট, কঙ্কনদা আর সহ পরিচালক বিদ্যুতদা বললেন।
আজকের মতো প্যাকআপ বলেই বেরিয়ে গেলেন তিনি।
স্টুডিও থেকে বেরিয়েই আজ মিনু মাসিদের কেষ্টপুরের বাড়িতে হানা দিতে হবে ভেবেই রেখেছিল সীমানা। ফোনে মিনু মাসিকে এতটা বোঝানো সম্ভব নয়। অগত্যা ওদের বাড়িই যেতে হবে। প্রোডাকশানের গাড়ি শুধু বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দেবে এটাই নির্দেশ আছে। তাই আজ আর গাড়ি না নিয়ে ট্যাক্সি ধরল সীমানা।
হলুদ কালো এই চারচাকাগুলোও ওর কাছে একদিন স্বপ্নই ছিল। যখন থিয়েটার পাড়া থেকে মিনি বসে গুঁতোগুঁতি করে চারটাকা ভাড়া দিয়ে বাড়ি ফিরত।
রাজীবের সাথে পরিচয় হয়েছিল ‘পরিবার’ থিয়েটারের সেটে। রাজীব ছিল ‘পরিবার’-এর হিরো। সুপুরুষ রাজীবের প্রেমে তখন অনেকেই হাবুডুবু খাচ্ছে। সহ অভিনেত্রী সীমানার আর দোষ কী! সেও যথারীতি রাজীবের ওই হিরো হিরো চেহারার প্রেমে পড়ে গেল।
ওদের প্রেমটা থিয়েটার পাড়ার মেকআপ রুম ছাড়িয়ে, থিয়েটারের মঞ্চ অতিক্রম করে, রীতিমতো রাজীবের এক কুঠুরী ঘরে গিয়ে সংসার পাতল।
দিনে বাবা-ভাই আর রাতে রাজীবের সংসার সামলে থিয়েটারের মঞ্চে উঠে বড্ড ক্লান্ত হয়ে পড়ছিল ও। মাস তিনেকের মধ্যেই খবর এল রাজীবের আরও একটা সংসার আছে। সেখানে নাকি একটা বছর তিনেকের মেয়েও আছে।
সেদিন রাতে প্রশ্নটা সরাসরি করেছিল সীমানা। না, অস্বীকার করেনি রাজীব। বরং উঁচু গলায় বলেছিল, জবা কি তোমার কোনো অসুবিধা করেছে? ও আছে ওর মতো আমার মেয়েকে নিয়ে। তুমিও তোমার মতো থাকো।
সীমানা আর সময় নষ্ট করেনি। নিজের টুকিটাকি জিনিস গুছিয়ে রাজীবের সামনে দিয়ে বেরিয়ে এসেছিল।
ট্যাক্সি ড্রাইভারের ডাকে সম্বিত ফিরল সীমানার। মিনু মাসির বাড়ি পৌঁছে গেছে সীমানা। ভাড়া মিটিয়ে নেমে পড়ল ও।
রমেশদা আর বউদি বাড়িতেই আছে।
সিনেমা, টিভির পর্দায় মুখ দেখিয়ে দেখিয়ে আপাতত সীমানা যে বেশ পরিচিত মুখ সেটা বোঝা গেল মিনু মাসির বাড়ির সামনে মুহূর্তে ভিড় জমে যাওয়ায়।
কেষ্টপুরের মধ্যবিত্ত বাড়ির বউ মেয়েদের একটা ছোট জটলায় নিজের নামটা বার পাঁচেক শুনতে পেল সীমানা। রমেশদা আর বউদিও এই ভেবে আপ্লুত যে, হিরোইন আসায় তাদেরও সম্মান বেড়ে যাবে মুহূর্তে। মিনু মাসির বাতের ব্যথাটা একটু বেড়েছে। তবে সীমানা বিপদে পড়েছে শুনে নিজের সমস্যা ভুলে রাজি হয়ে গেল মাসি। এই একটা মানুষ আছে পৃথিবীতে যে সীমানাকে ঠকাবে না, কোনো দাবি ছাড়াই নিঃস্বার্থভাবে সীমানার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে বারেবারে।
সীমানা বলল, কাল এই সময় তোমাকে নিয়ে যাব, রেডি হয়ে থেকো।
ভাইয়ের প্রয়োজনীয় খাতা-পত্তর কিনে বাড়ি ঢুকতে ঢুকতে বেশ রাত্রি হয়ে গেল।
বাবা সিরিয়াল দেখছিল, ওই ঝাপসা ধূসর চোখে কী আদৌ কিছু দেখতে পায় বাবা, নাকি কানে শুনেই আন্দাজ করে পর্দায় কী হচ্ছে।
সীমানা বাড়ি ঢুকতেই বাবা অসন্তাোষের গলায় বলে উঠল, এত রাতে বাড়ি ফিরছ, আবার যেন রাজীবের মতো কারো পাল্লায় পরো না। অদ্ভুত ব্যাপার, বাবা এখন নিজে রোজগার করতে পারে না। কিছু জমানো টাকা পড়ে আছে ব্যাঙ্কে। ওষুধপত্র, খাওয়াদাওয়া সবই বহাল তবিয়তে চলছে সীমানার রোজগারের টাকায়। তবুও ও যে ডিভোর্সি ওটা মনে করিয়ে দিতে ভুলে যায় না বাবা। আর রাজীবকে জীবনসঙ্গী করাটা যে ঠিক কতটা ভুল ছিল সেটাও প্রতি পদে পদে স্মরণ করাতে ভোলে না বাবা। যদিও বাবার কথা খুব একটা গায়ে মাখে না সীমানা। তবুও কেন জানে না আজ মাথাটা শান্ত রাখতে পারল না। দুম করে বলে বসল তোমাদের পেটের খাদ্য জোগাড় করার জন্যই রাত পর্যন্ত বাইরে থাকতে হয়। বাবা কোনো কথা না বলে অসহায় দুটো চোখ মেলে তাকাল সীমানার দিকে। ভাইও ভয়ে ভয়ে তাকাচ্ছিল দিদির দিকে।
বাড়ির পরিবেশটা মুহূর্তে বদলে যাচ্ছিল দেখেই সীমানা বলল, আজ মিনু মাসির ওখানে গিয়েছিলাম।
নিজের চোখের ভুল কিনা বুঝতে পারল না সীমানা, তবে বাবার মুখে একটা আলগা খুশি ছড়িয়ে পড়ল মনে হল। সমবয়স্ক মানুষের সাথে সখ্যতাটা স্বাভাবিক কারণেই গড়ে ওঠে। তার বোধহয় একটাই কারণ, তারা একই সাথে ফেলে আসা দিনগুলোতে ফিরে যেতে পারে। বাবা আর মিনু মাসিও মুহূর্তে গল্পের খাতিরে পৌঁছে যেতে পারে বাবার বিয়ের রাতের বাসর ঘরে বা তারাপীঠ যাবার অভিজ্ঞতায়।
তাইও উৎফুল্ল হয়ে বলছিল, ভালোই হবে দিদিভাই, ওই ঠাম্মিটা বাড়িতে থাকলে আমিও একটু ক্রিকেট খেলতে খেলতে যেতে পারব।
সীমানা ছদ্ম রাগে চোখ পাকিয়ে বলল, তাই বলে আমি যখন বাড়িতে থাকব না তখন কিন্তু টংটং করে ঘুরে বেড়াবি না।
বাবার এতক্ষণে খেয়াল হতে, আলতো করে জিজ্ঞেস করল, তুই কদিনের জন্য যাচ্ছিস?
আপাতত পাঁচ-সাতদিনের কথা হয়েছে। শুট হয়ে গেলেই ফিরে আসব।
সীমানার সারাদিনে ব্যস্ততাটাই বেশি পছন্দের। দ্রুততার সাথে গতিতে হাঁপিয়ে যায় বলে স্মৃতি এসে ভিড় জমাতে সাহস পায় না দিনের বেলায়। কিন্তু রাতের নিস্তব্ধতায় ওদের আগমন ঘটে। তখন সবে সবে মডেলিংয়ে ঢুকেছে সীমানা। যদিও খুবই কাকতালীয়ভাবেই মডেলিংয়ের চান্সটা পেয়েছিল ও। মেট্রো স্টেশনের ভিড়ের মধ্যেই রাতুল প্রামাণিক কানের কাছে এসে বলেছিলেন, ফেসটা ফটোজনিক, মডেলিংয়ের অফার আছে। একটা কাগজে নিজের ফোন নম্বরটা লিখে দিয়ে, ট্রেনের পেটের মধ্যে প্রবেশ করেছিলেন উনি।
মুহূর্তে হারিয়ে যাওয়া কথাগুলো কি সত্যি না স্বপ্ন বোঝার জন্য পরের দিনই কাগজে লেখা নম্বরটায় ডায়াল করেছিল সীমানা।
একেবারে লাস্ট রিংটায় ফোনটা রিসিভ করে বলেছিল, রাতুল প্রামাণিক হিয়ার…
ভয়ে ভয়ে নিজের সব থেকে গর্জিয়াস চুড়িদারটা পরে রাতুলবাবুর অফিসে ঢুকেছিল সীমানা।
অ্যাডভারটাইজিংয়ের কোম্পানি। বিভিন্ন অ্যাড এজেন্সিদের মডেল সাপ্লাই করে রাতুল প্রামাণিকের ‘নিউ লাইট’ কোম্পানি।
ওর দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে রাতুলবাবু বলেছিলেন, গ্রুমিং-এর প্রয়োজন। সেই প্রথম একটা অচেনা শব্দের সাথে পরিচিত হয়েছিল সীমানা। তারপর পরিচয় হয়েছিল, নিজের অপরিচিত চেহারার সাথে। ঘণ্টা তিনেক পার্লারে থাকার পরে আয়নায় নিজেকে দেখে একটু হকচকিয়ে গেছিল ও নিজেই।
সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরতেই বছর সাতেকের ভাই অবাক চোখে খানিকক্ষণ ওই রঙিন চুলের মেয়েটার মধ্যে ওর দিদিভাইকে খুঁজেছিল। তারপর ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে বলেছিল, দিদিভাই তুই বদলে গেলি কেন?
নিজের মনের মধ্যে আসল বদলাটা বোধহয় সীমানাও আটকাতে পারেনি।
রাজীবের সাথে বাড়ি থেকে চলে আসার পর থেকেই পুরুষ মানুষের মধ্যে আর বাবা-ভাইয়ের ছবি দেখতে পেত না ও। সকলের মধ্যেই একটা করে রাজীব লুকিয়ে থাকত যেন।
তবে আজকের বাস্তবে দাঁড়িয়ে একথা অস্বীকার করার জায়গা থাকে না যে, রাতুল প্রামাণিকের সাথে ওই মেট্রোয় দেখা হয়ে যাওয়াটাই ছিল সীমানার জীবনের টার্নিং পয়েন্ট।
ছোট পর্দায় গোটা দুই অ্যাড দেবার পরই ও প্রথম সহ অভিনেত্রীর চরিত্রে ‘সুখের সংসার’ মুভিতে মোট চারবার মুখ দেখাবার সুযোগ পেয়েছিল।
ব্যাংকক যাবার আগেই একটা ফ্রুট ফেসিয়াল করিয়ে নিতে হবে নামী স্পা তে গিয়ে। অভিনয় আর শরীর, মূলধন বলতে এটুকুই তো সম্বল সীমানার।
ভাইটা এখনো বড্ড ছোট, ওকে বড় করতে, লেখাপড়া শেখাতে অনেক টাকা লাগবে সীমানার। তবে দিনরাত এক করে ও কঙ্কন রায়ের ছবিতে খেটে চলেছে তার একটাই কারণ— যদি একবার হিট করে যায় তাহলে ওকে আর পিছন ফিরে তাকাতে হবে না। সুযোগ এসে ধরা দেবে ওর মুঠোয়। পরিচালক কঙ্কন রায় একটা অদ্ভুত নিয়ম নেমে চলেন। অতি পরিচিত, নম্বার ওয়ান হিরোইন ওনার সিনেমায় কাজ পায় না। ওনার বক্তব্য হল, ওনার ছবির নায়িকাকে লোকে সেই চরিত্রেই প্রথম চিনুক। বারবার ব্যবহার হয়ে যাওয়া আসবাবের মতো পুরোনো নয়, নতুন ফার্নিচার ঘরে ঢুকলে আমরা যেমন তাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ি, কোথায় রাখব, রং যেন না নষ্ট হয়ে যায়, তেমনই দর্শকও নতুন নায়িকাকে আবিষ্কার করুক। আকর্ষণটা নাকি ওইখানেই।
কাল রাতে ডিস্কো ঠেকে একটা শুটিং আছে। রিপোর্টার চৈতি সেন একজন স্বনামধন্য ব্যক্তির পিছনে ধাওয়া করে পৌঁছে যাবে ডিস্কে। এই চৈতি সেনের চরিত্রে অভিনয় করার আগে পর্যন্ত সীমানার বেশ ভয় ভয় করছিল। ইংরাজি, হিন্দি উচ্চারণগুলো প্রপার করতে পারবে কিনা! তারপরে ওই গ্যাংটাকে টার্গেট করে ব্যাংককে যাওয়া, সব মিলিয়ে বেশ ভয়েই ছিল সীমানা।
কঙ্কনদা মুখে প্রশংসা না করলেও মুখের অভিব্যক্তিতে সীমানা বুঝতে পারছে তার কাজে পরিচালক খুশি।
সীমানার এই প্রথম বিদেশ যাত্রা। ভাই কোলের কাছে বসে চা খেতে খেতে জিজ্ঞেস করল, দিদিভাই তুই কি প্লেনে চেপে যাবি? দিদিভাই ওখানে কি ইংরাজিতে কথা বলতে হয়?
প্রশ্নগুলো সৌমিক কৌতূহল বশে করে ফেলেছে, তবে সীমানার অবস্থাও সৌমিকের মতোই। সেও ওই ফরেনট্রিপটার ব্যাপারে অজ্ঞ।
দীঘা, দার্জিলিং, পুরীতে গেছে শুটিং করতে কিন্তু একেবারে ব্যাংকক, এটা ভাবতেও অবাক লাগছে সীমানার।
পুরোনো স্মৃতিগুলো যতই নাছোড় হোক, খারাপ স্মৃতি থেকে বেরোলেই নতুন সকাল পাওয়ার একটা আশা থেকেই যায়। রাজীবের বিছানায়, ওর ওই এক কুঠুরি ঘরের অগোছালো সংসারে, ওর দেওয়া আঘাতের কষ্টগুলো মাঝে মাঝে যন্ত্রণা দিলেও আস্তে আস্তে সীমানা পিছনের দিক থেকে দৃষ্টি ফেরাতে শিখেছে।
ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির অনেকেই হয়তো ভাবছে, সীমানা চৌধুরী নিশ্চয় কঙ্কন রায়ের সাথে বেড শেয়ার করে ওনার বিগ বাজেটের ছবিতে চান্স পেয়েছে। তারা আসলে কঙ্কন রায়কে চেনেই না। যে-কোনো আর্টিস্টের অভিনয়ে যদি কঙ্কনদা সন্তুষ্ট না হন তাহলে অর্ধেকটা শুট হয়ে গেলেও সেই অভিনেতা বা অভিনেত্রী বাদ পড়ে যায় তার ছবি থেকে। তাই সিলেকশানের পরেও সবাই আতঙ্কে থাকে, শেষপর্যন্ত থাকতে পারবে তো মুভিটায়।
সীমানা আপ্রাণ চেষ্টা করেছে নিজের বেস্টটা দেবার। প্রতিনিয়ত শিখছে ও।
মিনু মাসি বাড়িতে আসতেই কয়েক সেকেন্ডে বাড়ির পরিবেশটাই পালটে গেল যেন নিমেষে।
মিনু মাসি এসেই ভাইকে জড়িয়ে ধরে বলল, ওরে গোপাল তুই কত বড় হয়ে গেছিস! ভাই কোনোমতে বলল, মাসিমণি আমার নাম গোপাল নয় সৌমিক।
মাসি প্রাণখোলা হাসি হেসে বলল, আমার মোটা জিভে ওসব নাম উচ্চারণ হবে না বাপু। আমি ওই গোপাল বলেই ডাকব।
মিনু মাসিকে রান্না ঘরে সব বুঝিয়ে দিতে মাত্র চল্লিশ মিনিট লাগল সীমানার। নিজের মতো করে সব বুঝে নিল মাসি, এবার সীমানা কিছুটা নিশ্চিত।
মিডিয়া যে কীভাবে খবর পেয়ে যায় তা ভগবানই জানে। এয়ারপোর্টে ঢোকার আগেই কোনো এক ফিল্মি দুনিয়া চ্যানেলের দুজন রিপোর্টার এসে ঘিরে ধরল সীমানাকে।
‘ওগো বিদেশিনী’ মুভিতে সীমানার চরিত্রটাও একজন রিপোর্টারের। তাই রিপোর্টারদের ছুটে আসা, ওদের প্রশ্ন করার স্টাইলগুলো খুব নিখুঁতভাবে লক্ষ্য রেখেছিল ও।
সীমানা আর ওই মুভির নায়ক রোহানের মধ্যে কী ধরনের বন্ধুত্ব আছে সেটা জানাই এদের উদ্দেশ্য। শুধুই বন্ধুত্ব নাকি অন স্ক্রিনের মতো একটু ডিফারেন্ট রিলেশন আছে কিনা এই নিয়েই প্রশ্ন করে গেল রিপোর্টাররা।
রোহান আর সীমানা খুব হালকা চালেই উত্তর দিল, আপাতত শুটিং-এর বাইরে কোনো কিছু নিয়েই ওরা ভাবছে না। গসিপের গন্ধ না পেয়ে মনক্ষুণ্ণ হয়ে ফিরে গেল সাংবাদিকরা।
সত্যিই সীমানা আর ‘ভালোবাসার’ মতো চার অক্ষরের কথায় একেবারেই বিশ্বাসী নয়। ওই কথাটার রন্ধ্রে রন্ধ্রে রয়েছে কিছু অবিশ্বাসী স্মৃতি। রাজীবের মনগড়া কিছু মিথ্যে দিয়ে বানানো সীমানার খেলনা সংসার।
পরিচালক নয়ন ঘোষালের কাছে কাজ চাইতে গিয়ে তার ভালোবাসি বলে লালসার চিহ্নটা এখনও রয়ে গেছে সীমানার মুখাবয়বে। যেটাকে মেকআপম্যান কার্ত্তিকদা গাছ থেকে পড়ে যাওয়ার ক্ষত ভেবেছে, ওটা আসলে নয়ন ঘোষালের কাছে থেকে সম্মান বাঁচিয়ে ফেরার সময় ওর ছুঁড়ে দেওয়া কাচের মদের বোতলের আঘাত চিহ্ন।
তবে এই আঘাতগুলোই সীমানাকে আজকে এই জায়গায় পৌঁছে দিয়েছে মানুষ চেনাতে সাহায্য করেছে। মানুষজনের বলা বিরক্তি সূচক কথাগুলোতেই সীমানা বেশি স্বস্তি বোধ করে। ভালোবাসার কথায় বড্ড ভয় করে ওর।
ফ্লাইটের উইন্ডো দিয়ে আকাশ দেখতে দেখতে সীমানা ভাবছিল, আকাশের কাছাকাছি হয়তো পৌঁছোতে পেরেছে ও কিন্তু আকাশকে ছোঁয়া এখনও ঢের দেরি। অন্তত একবার ভাইকে নিয়ে বিদেশে পাড়ি দিতে চায় সীমানা সৌমিকের প্রশ্নটা কানের মধ্যে ভেসে এল, দিদিভাই বিদেশ কেমন হয় রে? ওই টিভিতে যেমন দেখায়?
ব্যাংককের শুটিং শেষের পরের দিন শপিংয়ে গিয়ে খুব সামান্যই কিছু জিনিস কিনল। ভাই, বাবা আর মিনু মাসির জন্য।
কঙ্কন রায় খুব আশাবাদী মুভিটা নিয়ে। বিশেষ করে সীমানার অভিনয় নিয়ে।
সীমানাও অমানুষিক পরিশ্রম করেছে এই কদিনে। শুটিংয়ের আর খুব অল্প অংশই বাকি রয়েছে। যেটা কলকাতায় হবে।
কলকাতায় ফিরেই চমকে গেল সীমানা। কঙ্কন রায়ের ব্যানারে বিজ্ঞাপনের স্টাইলই অন্যরকম। সীমানার অর্ধেক মুখের ছবি আর অল্প কিছু সংলাপ দিয়ে চারদিকে পোস্টার সাঁটানো হয়েছে। পাবলিকের কৌতূহল তৈরির পদ্ধতিটা কঙ্কনদা ভালোই বোঝেন।
মিনু মাসিকে জোর করে আরও কিছুদিন আটকে রেখেছে সীমানা। ওর ফিল্ম রিলিজের পার্টিতে সকলকে নিয়ে যাবে ঠিক করেই রেখেছে। যদিও বাবা বা মিনু মাসি আদৌ যেতে চাইবে কি না জানে না সীমানা। ভাই তো এখন থেকেই সেই পার্টির একটা কল্পিত চেহারা বানিয়ে বন্ধুদের কাছে গল্প করে বেড়াচ্ছে।
সৌমিক সত্যিই চমকে গেছে। দিদি সিনেমা করলেও এই ধরনের পার্টিতে কোনোদিন সে আগে আসেনি। আর তার ঘরোয়া দিভাইকে তো এই মেকাপের আতিশয্যে সে চিনতেই পারছে না। দিভাইয়ের হাসিটাও যেন কেমন অপরিচিত লাগছে।
সৌমিক এক কোণে চুপটি করে দাঁড়িয়ে আছে। দিভাই সকলের সাথে মিষ্টি করে হেসে হাত মেলাচ্ছে। কখনো কখনো কেউ আবার এসে দিভাইকে হাগ করছে। বাড়ির দিভাইটা যেন হঠাৎ ম্যাজিক করে বদলে গেছে। এই বদলে যাওয়া দিভাই আর সৌমিকের তিন বছর বয়সে দেখা সেই মায়ের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য। সেই মাকে সৌমিক দিদিভাই ডাকত ঠিক কথা কিন্তু সকলের আড়ালে মনে মনে মাই ভাবত।
সীমানা ‘ওগো বিদেশিনী’ মুভির প্রিমিয়ারে এসে আরেকটা বিগ বাজেটের অন্য ব্যানারের ছবিতে সাইন করল। কোলাহলের মধ্যে অনেকক্ষণ ভাইকে খেয়াল করা হয়নি। দেখল, দূরে একটা কর্ণার টেবিলে মুখ নিচু করে বসে আছে সৌমিক।
কাছে যেতেই দেখতে পেল ভাইয়ের চোখে জল।
জন্ম থেকে যে রক্তের পিন্ডটাকে মানুষ করেছে তার মন পড়তে না পারার কোনো কারণ নেই। সৌমিককে দেখেই সীমানা বুঝতে পারল তার পরিচিত দিদিভাইকে চিনতে পারছে না এই পরিবেশে, তাই হয়তো ভাই কাঁদছে।
সীমানার ইচ্ছে হচ্ছিল সব কিছুকে তুচ্ছ করে ছুটে গিয়ে সেই ছোটবেলার মতো ভাইকে বুকে জড়িয়ে ধরতে। গ্ল্যামার ওয়ার্ল্ডে অন স্ক্রিনে যতই ইমোশানের ছড়াছড়ি হোক, রিয়েল দুনিয়ায় ওটারই বড় অভাব। নিজেকে সংযত করল, টলিউডের সম্ভাবনাময়ী উঠতি হিরোইন সীমানা চৌধুরী। ভাইকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে এখনও আবেগ বহির্ভূত অনেকটা পথ চলতে হবে সীমানাকে।
ভাইয়ের পিঠে ছোট্ট করে একবার হাত বুলিয়েই মিশে গেল মেকি ঐতিহ্যের জগতে, আলোর রোশনাইয়ে যেখানে চোখের জলকেও হাসিতে রূপান্তরিত করতে হয় সযত্নে। সীমানা এখন শুধুই অভিনেত্রী।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন