অর্পিতা সরকার
নতুন স্কুল, নতুন চাকরি, স্বাভাবিকভাবেই একটু ভয়জনিত উত্তেজনা কাজ করছে মোহরের মধ্যে। অন্য শিক্ষকরা ঠিক কেমন জানা নেই ওর। ক্লাস ফাইভে যখন নতুন স্কুলে ভর্তি হয়েছিল তখন যেমন অনুভূতি হয়েছিল সেরকম নয়, তবে একটু অস্থির অস্থির তো লাগছেই। ফরম্যালিটিস মেইনটেন করে তারপর টিচার্স রুমে বসে আছে মোহর। আজ ওকে কোন কোন ক্লাস নিতে হবে সেটা বুঝিয়ে দেবেন কেকাদি মানে অ্যাসিস্ট্যান্ট টিচার। তিনি এখনও অফিসে ঢোকেননি। তাই অপেক্ষা…
তিনজনের সঙ্গে অলরেডি আলাপ হয়েছে, তার মধ্যে অর্চনাদি বেশ মিশুকে, বাকি দুজন নতুনকে অত প্রায়োরিটি দিতে নারাজ।
ঘরে ঢুকলেন কেকাদি।
এই মহিলাকে বড্ড চেনা লাগছে, কিন্তু কিছুতেই চিনে উঠতে পারছে না মোহর।
অনেকক্ষণ একই দৃষ্টিতে অপরিচিত মানুষের দিকে তাকিয়ে থাকাটা ভীষণ অশোভন তাই দৃষ্টি সরিয়ে নিল মোহর।
কেকাদি সাবলীলভাবে বললেন, আজ তো নতুন… তাই ফাইভ, সিক্সের ক্লাস দিলাম না। বিচ্চুগুলোকে না হয় তিন দিন পর থেকেই হ্যান্ডেল করো। মুখে মৃদু একটা হাসি ঝোলানো আছে মহিলার। বয়স প্রায় চল্লিশ কী তার একটু কমই হবে, ঠিক বোঝা যাচ্ছে না।
অনেক মহিলাই যেমন নিজের বয়স ঢাকতে উগ্র রংকে সঙ্গী করেন, কেকাদি তা নয়। একটা হালকা আকাশি তাঁতের জামদানি পরেছেন, গলায় আর কানে হালকা মুক্তোর একটা সেট। এক হাতে রিস্টওয়াচ অন্যটাতে সরু চুরি একগাছা।
মহিলাকে এক ঝলক দেখেই মোহরের পঁচিশ বছরের চোখে যেটা মনে হল সেটা হল, ওর বয়সে মহিলা অনেকের হার্টথ্রব ছিলেন। হয়তো এককালে ওনাকে দেখে অনেকেই ‘কে তুমি নন্দিনী’ আওড়াতেন। কেকাদি নাম প্রেজেন্টের খাতাটা মোহরের হাতে তুলে দিয়েই ফোর্থক্লাস স্টাফ রমলাকে হাঁক পাড়লেন, নতুন ম্যাডামকে সেভেন এ’তে পৌঁছে দিয়ে এসো।
মোহরের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে বললেন, বেস্ট অফ লাক। মোহরের মাথার মধ্যে তখনও অস্বস্তিটা চলতেই থাকছে, কেন এত পরিচিত মনে হচ্ছে কেকাদিকে! ওর পরিচিত কোনো মুখের সাথে কী সামঞ্জস্য রয়েছে কেকাদির। নিজের পিসি, মাসি, গানের দিদিমণি মোটামুটি ওই বয়সের সকলের মুখই একবার করে ভেবে নিল মোহর। একমাত্র ওর ছোটো মাসির সাথেই একটু-আধটু মেলে, কিন্তু ছোটো মাসির রং কেকাদির মতো আকর্ষণীয় নয়। কেকাদি দুধে আলতা ফর্সা নয় কিন্ত একটা বাদামি জৌলুশ… যেন ওনার ব্যক্তিত্বকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে।
কেকাদির কথা ভাবতে ভাবতেই নতুন ম্যাডাম ঢুকল ক্লাস সেভেনের বাংলার ক্লাসে।
নতুন ম্যাডাম দেখে স্টুডেন্টদের মধ্যে বেশ একটা চাঞ্চল্য লক্ষ্য করা যায়। মোহরদের স্টুডেন্ট লাইফেও এটা ঘটত। প্রথম দিন পড়তে ইচ্ছা করত না। নতুন ম্যাডামের সাথে গল্প করতে ইচ্ছা করত।
এই ক্লাসেরও তাই ইচ্ছে। মোহর কিছুটা গল্প করে, কিছুটা পড়িয়ে কাটাল ওদের সাথে। তারপর গিয়ে ঢুকল ক্লাস নাইনের ইতিহাস ক্লাসে। যাক এতক্ষণে নিজের সাবজেক্ট পেয়ে একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়ল ওর।
বইয়ের পাতায় একটা গ্রিক ভাস্কর্যের ছবি। মোহরের মাথায় কোনো গোপন প্রকোষ্ঠে রাখা আরেকটি মুখ উঁকি দিয়ে গেল। এমনি কাটা কাটা তীক্ষ্ন একটা মুখ, এমনি বলিষ্ঠ শরীর। চোখের চাহনিতে আত্মবিশ্বাস।
ওহ মনে পড়েছে, ওদের জিমনাস্টিক ক্লাসের রজতকাকু। রজতকাকু ঠিক পাশেই দেখেছিল একটা অল্প বয়সি তরুণীকে। তখন মোহর ক্লাস সেভেনের ছাত্রী।
রজতকাকুর সাথে মোহরের বাবার সম্পর্কটা বরাবরই নিজের ভাইয়ের মতোই। তাই মোহরকেও কাকু ভীষণ ভালোবাসত।
ম্যাডাম, আপনার বাড়ি কোথায়? বাড়িতে কে কে আছে? কৌতূহলী স্টুডেন্টদের কৌতূহল মেটানোটাও মোহরের দায়িত্ব।
টিচার্স রুমে ঢুকতেই কেকাদি বললেন, কেমন হল প্রথম দিনের অভিজ্ঞতা?
মোহর হেসে বলল, স্টুডেন্টরা আজ চূড়ান্ত স্মার্ট আমিই একটু নার্ভাস ছিলাম। ওর উত্তর শুনে কেকাদি একটু হাসলেন, দৃষ্টিটা দেখে মনে হল নিজেও বোধহয় নিজের জয়েনিং ডেটের কথা ভাবছিলেন।
গলার বাঁদিকের তিলটা আরও সন্দেহ মুক্ত করল মোহরকে, কিন্তু প্রথম দিনেই অল্প আলাপে কিছু জানতে চাওয়াটা বড় বেমানান।
যদিও মোহর আর পুরোনো পাড়ায় থাকেও না, চলে এসেছে নতুন ফ্ল্যাটে। তাছাড়া হয়েও গেল তো বারো তেরো বছর আগেকার ঘটনা। কী একটু তার বেশিই হবে। রজতকাকু আর মোহররা একই পাড়ায় থাকত, রজতকাকু বাবার থেকে অনেকটাই ছোট ছিল, তবুও কী করে যে বাবার চা খাবার বন্ধু হয়ে গিয়েছিল তা মন্টুদার চায়ের দোকানের লিকার চা-ই জানে। রজতকাকু কবি সুকান্ত ক্লাবে জিমনাস্টিক শেখাত। পাড়ার ছেলেমেয়েরা শিখতে যেত। মেয়েদের ক্লাস ছিল বিকালে আর ছেলেদের সন্ধেবেলা। মোহরকেও ক্লাস সিক্সে বাবা রজতকাকুর ক্লাবে ভর্তি করে দিয়েছিল। কাকু যখন একবারও না থেমে ভোল্ট মারত তখন মোহর অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকত। কাকুর পেশিগুলো পরিশ্রমে ফুলে উঠত। মোহরের কাকু হলেও পাড়ার বেশিরভাগ মেয়ের যে রজতকাকুকে পছন্দ ছিল সেটা বুঝতেও পারত মোহর। ওদের পাড়ার চন্দ্রাদি মোহরের হাত দিয়েই তো কাকুর জন্য চিঠি পাঠিয়েছিল। কাকু মোহরের মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিল, শোন পাগলি তোকে যদি কেউ এসব চিঠি দেয় তুই নিবি না। বলবি, আমাকে কাকু বকবে।
কৌতূহলবশে চিঠিটা ফাঁক করতেই ‘ভালোবাসি’ কথাটা দেখে ফেলেছিল মোহর।
ওর কিশোরী মনে তোলপাড় হয়েছিল, তার মানে চন্দ্রাদি রজতকাকুকে ভালোবাসে?
পাড়ার অনেক দিদিই রজতকাকুর সম্বন্ধে মোহরের কাছে খোঁজ নিত। সকালের দিকে বোধহয় কাকু একটা বেসরকারি ফার্মে চাকরি করত, বিকালের দিকে জিমনাস্টিক ক্লাস।
কাকু যে মজার কথা বলত, সেটা মোহর শুনলেও ক্লাবের কেউই খুব একটা শুনতে পেত না কারণ ক্লাসে কাকু ভীষণ ডিসিপ্লিন মেইনটেইন করত।
তখন মোহর ক্লাস সেভেন কী এইটের ছাত্রী হঠাৎ একদিন রাধামাধবের পুরোনো মন্দিরটার সামনে একটু আলো-আঁধারিতে দেখল, রজতকাকুর সাথে একজন ভীষণ সুন্দরী তরুণী দাঁড়িয়ে আছে। কাকু হয়তো মোহরকে খেয়াল করেনি কিন্তু মোহর মুগ্ধ হয়ে দেখছিল, মেয়েটির হাতের ওপর কাকুর হাত। না ঠিক হাত ধরে আছে এমন নয়, বোধহয় কোনো প্রতিশ্রুতির হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে দুজনে দুজনের দিকে।
মেয়েটির ছলছলে চোখ নজর এড়ায়নি মোহরের।
পরে বহ্নিকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারে মেয়েটির মামার বাড়ি ওদের পাড়াতেই, সান্যাল জেঠু ওর বড়মামা। বোধহয় গরমের ছুটিতে ঘুরতে এসেছে। ওরা ওই সুন্দরী মেয়েটিকে নন্দিনী বলেই সম্বোধন করত, আসল নাম জানার চেষ্টাও কেউ করেনি, অথবা বললেও গুরুত্ব পায়নি। মেয়েটি রোজ ওদের ক্লাসের সময় মাঠের কোণে দাঁড়িয়ে থাকত, অবশ্যই অপলক তাকিয়ে থাকত রজতকাকুর দিকে। রজতকাকুও শেখানোর ফাঁকে ফাঁকে আড় চোখে দেখে নিতে ভুলত না। প্রেম প্রেম গন্ধ পেয়ে মোহরদেরও যথেষ্ট ইন্টারেস্ট জন্মেছিল। চুপচাপ গোয়েন্দাগিরি চালিয়ে যেত ওরা বান্ধবীরা।
কয়েকদিন পরেই পাড়ায় হই হই পড়ে গিয়েছিল, নন্দিনীকে নিয়ে নাকি রজতকাকু কোথায় পালিয়ে গেছে। সান্যাল জেঠু পুলিশ লাগিয়েছিল, কিন্তু খুঁজে পায়নি। তারপর তো মোহরদের ক্লাস বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কবি সুকান্ত ক্লাবে একটা গানের স্কুল খুলেছিল কিন্তু জিমনাস্টিক আর শুরু হয়নি।
মাস খানেক পর রজতকাকুকে আবার রাস্তায় দেখে মনে হয়েছিল, আবার বুঝি কাকুর কাছে ক্লাসে যাবে। কিন্তু ততদিনে পাড়ার লোকেরা রজতকাকুকে বয়কট করেছিল। কারোর মেয়েকেই নাকি আর ভরসা করে ওর কাছে পাঠানো যাবে না। মোহরের বাবা তারপর বালিগঞ্জে ফ্ল্যাট কিনে চলে এলে পুরোনো পাড়ার সাথে সমস্ত সম্পর্কই ছিন্ন হয়ে যায় মোহরের। তবে আসার আগে পর্যন্ত রজতকাকুকে যতবারই দেখেছে ততবারই খেয়াল করেছে একটা বিষণ্ণতার চাদরে মুখটা ঢাকা। সকাল হলেই আর রাস্তায় জগিং করতে দেখতে পায়নি মোহর। শুধু অফিস টাইমে একটা ব্যাগ বগলে রজতকাকুকে অন্যমনস্কভাবে হেঁটে যেতে দেখেছিল।
মা ডাকল ডিনার টেবিল থেকে, অগত্যা হঠাৎ খুঁজে পাওয়া স্মৃতির ঘরে আপাতত তালা ঝুলিয়ে রেখে যেতেই হল ডাইনিং টেবিলে।
বাবা-মা দুজনেই মেয়ের প্রথম দিনের স্কুলের এক্সপিরিয়্যান্স শুনতে উৎসাহী, কিন্তু কেন জানে না মোহরের উৎসাহ নেই। হঠাৎ এলোমেলো কথার ভিড়ে মোহর বাবাকে জিজ্ঞেস করল, বাবা তোমার রজতকাকুকে মনে আছে?
বাবা কিছু বলার আগেই মা বলল, কেন তোর সঙ্গে দেখা হল বুঝি? বেশি কথা বলতে যাস না, কিছু কিছু মানুষের তো আবার বয়স হলেও চরিত্র ঠিক হয় না!
বাবা বিরক্তির সুরে বলল, রজতকে কিন্তু আমি কোনো দিনই খারাপ কিছু করতে দেখিনি।
মা স্বভাব সিদ্ধ ঢঙে বলল, গোটা পাড়া জানত সান্যালদের ভাগ্নীটাকে কোথায় নিয়ে গিয়ে খারাপ কাজ করতে গিয়েছিল, কেন তুমি জানতে না? রজত তো দু-দিন জেলও খেটেছিল!
এবার আশ্চর্য হবার পালা মোহরের, কাকু জেল খেটেছিল!
বাবা বলল, জেল লোক বিনা কারণেও খাটে। মিথ্যে দোষারোপ যে নয় কে বলতে পারে?
মোহর আর বাকবিতণ্ডার মধ্যে না গিয়ে চুপচাপ খেয়ে উঠে গেল।
যতক্ষণ না ঘুম এল ততক্ষণ শুধু রজতকাকুর প্রেমিকা নন্দিনীর মুখটাই মনে পড়ে যাচ্ছিল ওর। সত্যিই কি কাকু রেপ করতে গিয়েছিল? মোহর তো তখন এইটে পড়ে, খারাপ পুরুষের চোখের ভাষা বা ছোঁয়া বোঝার বয়েস তো হয়েছিল ওর, কই রজতকাকুকে তো কোনোদিন অমন মনে হয়নি। বরং যখন মাথায় হাত বুলিয়ে দিত মনে হত বাবার মতোই স্পর্শটা।
পরের দিন স্কুলে গিয়ে থেকে মোহর শুধু একটু ফাঁক খুঁজছিল। বারবার চোখ চলে যাচ্ছে গলার ওই আকর্ষণীয় তিলটার দিকে।
কেকাদি একটা কথা বলব?
মোহরের দিকে মিষ্টি হেসে কেকাদি বললেন, বলো…
বাঁদিকের গজ দাঁতটা দেখতে পেয়ে আরো স্যাঙ্গুইন হল ও।
আপনি রজত অধিকারী বলে কাউকে চিনতেন? জিমনাস্টিক শেখাত…
মোহরকে কথা শেষ করতে না দিয়েই কেকাদি উদ্বিগ্ন গলায় বললেন, কেন রজতের কী হয়েছে? কোনো অ্যাক্সিডেন্ট?
মোহর সামলে নিয়ে বলল, না না সেরকম কিছু নয়। আপনার ফুলবাগানের রায়পাড়া, সান্যাল বাড়ি মনে আছে?
এতক্ষণে ঢোক গিলে কেকাদি বললেন, তুমি কে? আমাকে কী করে চিনলে?
মোহর আশ্বস্ত করার ঢঙে বলল, সেরকম কিছু নয়। আসলে আমি রজত কাকুর কাছে জিমনাস্টিক শিখতাম, তখন আপনি হয়তো কলেজে পড়েন, রায় পাড়ায় আপনাকে দেখেছি বহুবার।
কেকাদি হঠাৎ মোহরের হাত ধরে বললেন, তাহলে তো তুমি ওখানেই থাকো, আমাকে বলতে পারো রজতদা কেমন আছে? বিয়ে করেছে? ওর বউ কেমন দেখতে? কটা বাচ্চা? এখনও জিমনাস্টিক করে? বয়েস হল তো আর বোধহয় পারে না।
এতগুলো প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে বুঝতেই পারেনি মোহর। আসলে ওর নিজের একটা কৌতূহল মেটাতে গিয়ে যে এরকম একটা পরিস্থিতির শিকার হবে কল্পনার বাইরে ছিল ওর। মোহর ভেবেছিল রজতকাকুর মতো একজন রেপিস্টের কথা শুনে হয়তো ঘৃণায় মুখ বাঁকাবে কেকাদি। কিন্তু এখন দেখছে কেকাদির চোখে জল! কোনো চরিত্রহীনের জন্য কোনো মহিলা এত বছর পর কাঁদতে পারে বলে তো মোহর শোনেনি কখনো।
স্কুল ছুটির পর কেকাদি আর মোহর সামনাসামনি বসে আছে একটা কফি শপে।
বলতে শুরু করেছেন কেকাদি, ভিজে গলা চোখও ভিজে… ধুলো ঝাড়াতে বসেছে তেরো বছর আগেকার কোনো এক সন্ধ্যার হঠাৎ পাওয়া মুহূর্তের।
ভালোবাসতাম আমরা দুজন দুজনকে। রজতদা বলেছিল, আমার পড়াশোনা কমপ্লিট হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করবে। আর নিজেও আর একটু ভালো চাকরির চেষ্টা করবে। কথা দিয়েছিলাম, কোনোদিন কোনো পরিস্থিতিতেই হাত ছাড়ব না কেউ কারোর।
সেদিন সন্ধ্যায় আমরা কেউ কোথাও পালাইনি। শুধু বড় মামা দেখে ফেলেছিল আমাদের একসাথে। হ্যাঁ সেদিন আমরা একটু ঘনিষ্ঠভাবেই দাঁড়িয়েছিলাম বাগানের অন্ধকারে। মামা আমাকে টেনে নিয়ে গিয়ে বন্ধ করে দিয়েছিল ঘরের ভিতর। শুনেছিলাম রজতকে পুলিশে দিয়েছে মামা। মামা আর বাবার প্রচুর প্রতিপত্তির সাথে রজত পেরে উঠবে না জানতাম। তাই বাবার কাছে লিখে দিয়েছিলাম, রজতকে জেল থেকে ছাড়িয়ে দিলেই আমি ওকে ভুলে যাব। তারপর তো আর কখনো মামার বাড়ি আসতে দেয়নি বাবা। রজতের ফোনে ফোন করেছিলাম একবার, সেটাও বাবা ধরে ফেলেছিল। আমার জন্য ছেলেটার জীবন নরক হয়ে গিয়েছিল।
মোহরের মনে হচ্ছে চোখের সামনে কোনো সিনেমা দেখছে। সান্যাল জেঠুর মুখটা মনে পড়ে যাচ্ছে ওর। ঠিক হিন্দি সিনেমার ভিলেনের মতো চেঞ্জ হয়ে যাচ্ছে যেন ওর মুখের রেখাগুলো।
কেকাদি বলল, ভাগ্যের কী পরিহাস। এক বছরের মধ্যেই বিয়ে দিয়ে দিল আমার, আর দু-বছরের মধ্যেই বিধবা হলাম। ফিরে এলাম বাবার বাড়ি। আবার পড়াশোনা করতে শুরু করলাম, পরীক্ষা দিয়ে পেয়ে গেলাম এই চাকরিটা।
মোহর বলল, তারপর আর কখনো খোঁজ করেননি রজতকাকুর?
কেকাদি মাথা নাড়ল। না, মামি বলেছিল রজত বিয়ে করেছে, তাই আর…
কেকাদির সাথে মোহরের এই মিষ্টি সম্পর্কটা স্কুলে অনেকেরই একটু ঈর্ষার বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে। ওরা ঠিক কী নিয়ে কথা বলে সেটাই সকলের জানার আগ্রহ।
কখনো কেকাদি বলে, মোহর তোমার মনে আছে আমি মাঠের কোণের দিকে দাঁড়িয়ে থাকতাম আর রজতদা আড়চোখে তাকাত। মোহর হেসে বলে, আমাদের গোয়েন্দাগিরির চোটে তোমাদের প্রেম তখন ধরা পড়ে গেছে। আশ্চর্যভাবে একজন চল্লিশের মহিলা অবলীলায় পৌঁছে যায় সেই উচ্ছ্বল তারুণ্যে।
পুরোনো ডায়রি ঘেঁটে মোহর সেদিন বহ্নিদের ফোন নাম্বারটায় রিং করল। যদিও এখন আর সেই নাম্বার আছে কিনা তাও জানা নেই মোহরের। যা ভেবেছিল তাই, নাম্বারটা বন্ধ হয়ে গেছে। ফেসবুকে বহ্নিশিখা বসু সার্চ করতেই পেয়ে গেল রায়পাড়া বালিকা বিদ্যালয়ের বহ্নিকে। মেসেজ নয় ডিরেক্ট ম্যাসেঞ্জারে কল করল ও। বার চারেক পর বহ্নির গলা।
মোহর শুনে আনন্দে আত্মহারা বহ্নিকে ও প্রথমেই জিজ্ঞেস করল, এই তোর রজতকাকুর কী খবর রে?
বহ্নি বলল, তিনদিন আগেও দেখেছি বাজার করে ফিরছে। তবে বয়সের তুলনায় বুড়িয়েছে বেশি।
আর বিয়ে থা?
বহ্নির গলায় আক্ষেপের সুর! বিয়ে তো করল না রে। বরঞ্চ বছর তিনেক আগে মা হারা হয়ে একাই থাকে এখন।
মোহর শুধু জেনে নিল ওই বাড়িতেই আছে কিনা।
দরজার বাইরে সেই মাধবীলতার ঝোপটা আর নেই। মোহররা তখন কত মাধবীলতার ঝাড় তুলে খেলা করেছে। পড়ন্ত সূর্যের আলোয় বাড়িটাকে দেখেই মনে হচ্ছে বড্ড ক্লান্ত, শীর্ণ। এই বাড়ির মালিক বোধহয় শুধুই দুঃসংবাদ আশা করে, কোনো সুসংবাদ-এর খবর ওর কল্পনার অতীত।
বেলটা দু-বার বাজতে দরজা খুলল রজতকাকু। না, ট্র্যাকসুট আর স্কিনটাইট গেঞ্জি পরে নেই। একটা সাদাটে জামা আর পায়জামা পরে বেরিয়ে এল।
মোহরকে চিনতে পারেনি বোঝাই যাচ্ছে। চেনার কথাও নয়, ক্লাস এইটে ফ্রক পরা মোহরের সাথে আজকের শান্তিনিকেতনি সুতোর শাড়ি পরা মোহরের অনেক পার্থক্য। চোখ কুঁচকে তাকিয়ে আছে কাকু। মোহর ভণিতা না করেই বলল, মন্মথ রায়ের মেয়ে মোহর। এবার চিনতে পেরেছ?
একমুখ হেসে কাকু বলল, ওমা এত বড় কী করে হলি?
মোহরের হাসি পেয়ে গেল কাকুর কথায়। ও বলল, যেমন করে তুমি এত বুড়ো হলে!
হ্যাঁরে, মন্মথদা ভালো আছেন তো? আর বউদি? সবাই ভালো আছে শুনে বলল, বল এতবছর পর কী মনে করে?
মানুষটার দিকে তাকিয়ে মোহরের প্রথমেই যে কথাটা মনে হল, পাড়ার এত লোকের মিথ্যাচারণের বিরুদ্ধে কোনোদিন কেন রুখে দাঁড়ায়নি কাকু? কেকাদির অসম্মানের ভয়ে নয় তো!
কাকু আজ তোমাকে একটা সারপ্রাইজ দেব আমি।
ভ্রু কুঁচকে বলল, কী রে তোর বিয়ের নিমন্ত্রণ করতে এলি নাকি?
মোহর বাড়ির বাইরে চলে যাচ্ছে দেখে কাকু বলল, কী রে না বলেই কোথায় যাচ্ছিস?
কেকাদি তখন বাইরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘামছে। মোহরকে দেখতে পেয়েই বলল, ভালো আছে রজতদা?
মোহর বলল, ভালোই।
কেকাদি কাঁপা গলায় বলল, তাহলে চলো ফিরে যাই, আর দেখা নাই বা করলাম! আশ্চর্য চোখে তাকিয়ে মোহর কেকাদির হাতটা ধরে টেনে নিয়ে চলল, কাকু তখনও বাইরে দাঁড়িয়ে আছে।
কেকাদিকে এক নজরেই বোধহয় চিনতে পেরেছে। নাকি মুখের আদল দেখে অনুমান করেছে সেটা কাকুই বলতে পারবে।
কেকাদি বলল, শরীরের কী হাল করেছো?
কাকুর চোখের পাতা থেকে সিগারেটে পোড়া ঠোঁটটা পর্যন্ত অভিমানে কেঁপে উঠল যেন।
ওরা ঘরে ঢুকে সোফায় বসেছে। ওদের বারণ না শুনেই মোহর বাড়ি ফিরে যাচ্ছে। তেরোটা বছর তো খুব কম সময় নয়!
অনেক অনেক কথা জমে আছে ওদের, অনেক না বলা অনুভূতি, অভিমান, কষ্ট ভাগ করে নেবে আজ ওরা। এই মূল্যবান সময়টুকু মোহর কিছুতেই কেড়ে নিতে পারবে না ওদের কাছ থেকে। কল্পনা করছিল মোহর, হয়তো রজতকাকু বলবে, তোমার গলার তিলটা এখনও তোমাকে হাজারের ভিড়ে আলাদা করে। আর কেকাদি চল্লিশেও লজ্জা পেয়ে চোখ নামিয়ে নেবে। ওদের আজ অফুরন্ত সময় চাই… নিভৃতে…
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন