শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়
কাশীনাথ আর শশীনাথ দুই বন্ধু। কাশীনাথ কালো, শশীনাথ ফরসা। কাশীনাথ গরম, শশানাথ নরম। কাশীনাথ কানা, শশীনাথ কালা। তবু তারা দুই বন্ধু। হাতিবাগান বাজারের কাছে দুজনের দুটি খাবারের দোকান। এদিকে একটি, ওদিকে একটি। প্রায় মুখোমুখি। কাশীনাথের দোকানে খরিদ্দার আসে। শশীনাথের ডাক ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করে। আবার শশীনাথের দোকানে যখন খদ্দেরের ভিড়, —কাশীনাথের তখন কি যে হয় তা সে নিজেই ভাল বুঝতে পারে না; উনোন-খোঁচানো লোহার ডাণ্ডাটার দিকে হাত বাড়ায়, মনে হয়, ওই ডাণ্ডা দিয়ে শশীনাথের মাথাটা ফাটিয়ে দিয়ে আসে।
একদিন রাত্রে কানা কাশীনাথ এমনি একটা স্বপ্ন দেখলো। স্বপ্ন যে এত স্পষ্ট পরিষ্কার হয়, তা তার জানা ছিল না।
দেখলো, শশীনাথের দোকানে সেদিন দু কড়াই বড় বড় রসগোল্লা নেমেছে। কড়াইয়ের রস তখনও গরম। সে গরম রসের ওপর রসগোল্লাগুলো ভাসছে। শশিনাথ লোহার একটা ঝাঁজরা দিয়ে চেপে চেপে রসগোল্লাগুলো ডুবিয়ে দিচ্ছে রসের ভেতর। এমন সময় কাশীনাথ ঢুকল চুপি চুপি পা টিপে টিপে, পেছন দিক থেকে লোহার ডাণ্ডা হাতে নিয়ে। তার পরেই, ব্যস! দিলে বসিয়ে সেই ডাণ্ডা—শশীনাথের মাথায়। চিৎকার করে শশিনাথ মুখ থুবড়ে পড়ল সেই গরম রসের কড়াইয়ের ওপর। মাথাটা ফেটে চৌচির হয়ে গেছে। কাঁচা রক্তে রাঙা হয়ে গেল রস আর রসগোল্লা। কাশীনাথ ছুটতে লাগল প্রাণের ভয়ে। পেছনে বিস্তর লোক তাকে তাড়া করেছে। লোকজন তাকে ধরে ফেললো। কোত্থেকে হৈ-হৈ করে পুলিস এসে গেল।
মুখ দিয়ে কেমন যেন একটা অস্বাভাবিক আওয়াজ বেরুচ্ছে কাশীনাথের। গোঁ-গোঁ করতে করতে তার ঘুম ভাঙল।
গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। এক গ্লাস জল খেয়ে একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললে কাশীনাথ। সবই স্বপ্ন। তাকে তা হলে পুলিসে ধরে নি। বাঁচা গেল।
নাঃ, আর সে ও-রকম বাজে কথা ভাববে না। পরের মন্দ না ভাবাই ভাল। শশীনাথ করুক উন্নতি। যত বড় হতে পারে হোক
সেদিন সন্ধ্যায় কাশীনাথ তার কানা চোখ মিট্ মিট্ করে আবার দেখলে— শশীনাথের দোকানের সামনে অনেকগুলো খদ্দের দাঁড়িয়ে। হাত বাড়িয়ে পয়সা নিচ্ছে আর কাঠের বাক্সে পুরছে। এমন সময় কাশীনাথের দোকানে একজন খরিদ্দার এল। চেনা খরিদ্দার। —দুটো সন্দেশ আর চার পয়সার দই নেবে। শালপাতার ঠোঙা তৈরি করতে করতে কাশীনাথ বললে, খবরের কাগজ পড়েছেন দাদা?
— কি?
কাশীনাথ বললে, গুঁড়ো দুধ খেয়ে মেদিনীপুরে সাতজন লোক মারা গেছে।
খদ্দের বললে, গুঁড়ো দুধের কারবার তো শুনেছি তোমরাই কর।
কাশীনাথ বললে, ভগবানের দিব্যি করে বলছি দাদা, ছেলেপুলে নিয়ে ঘর-সংসার করি, সে রকম দুর্মতি যেন কোনওদিন না হয়। তবে হ্যাঁ, নাম করব না, সামনা-সামনি দোকান করি, বলবে— ব্যাটার হিংসে হচ্ছে, নইলে এখুনি হাঁক মেরে বলে দিতে পারতুম—বাজার থেকে পেটি পেটি গুঁড়ো দুধ আমি কিনি না, কেনে ওই—। না বাবা, কাজ নেই, বলবে- আমার খদ্দের ভাঙাচ্ছে!
উত্তেজনার মুখে কথাটা বেশ জোরেই বলেছিল কাশীনাথ। শশীনাথ কানে খাটো তাই শুনতে পেলে না।
শশিনাথও বলে। তবে চেঁচিয়ে বলে না, গালাগালিও দেয় না। হাত দিয়ে খদ্দের বিদেয় করে, আর মুখ দিয়ে আপন মনেই অনর্গল বলতে থাকে : গুঁড়ো দুধের দই বেচে, পানতুয়া বেচে দোতলা দালান তুলবি তোল, আমি বাবা যেমন তেমনই থাকি।… কালো অলম্ভুস্ মোষের মতন চেহারাও যেমন, মনটাও তেমনি।
—কাকে কি বলছ শশী?
শশীনাথ একটু হেসে বলে, কাউকে বলি নি আজ্ঞে। ওসব বড় নোংরা কথা, আপনাদের শুনে কাজ নেই।
রাত্রি হয়ে গেছে। কাশীনাথ দোকান বন্ধ করবে।
টাকাপয়সাগুলি একটি কাপড়ের থলিতে ঢুকিয়ে কোমরে বাঁধলো প্রথমে। ধূপদানিতে আগুন দেওয়া হয়েছে। ধূপদানিটি নিয়ে গণেশ ঠাকুরকে ধোঁয়া খাইয়ে, কাঠের ক্যাশবাক্সটিতে ধোঁয়া দিলো, তারপর দোকানের চারিদিকে ঘুরিয়ে ধোঁয়া দিয়ে যথাস্থানে ধূপদানিটি নামিয়ে রাখলো। গঙ্গাজল ছিটিয়ে দিলো চারিদিকে। তারপর গণেশ ঠাকুরকে প্রণাম করে বেরিয়ে এল বাইরের ফুটপাথে। শো-কেস, দরজা টেনে টেনে বন্ধ করলে। বড় বড় তিনটি তালা লাগালো। প্রত্যেকটি তালা দু হাত দিয়ে চেপে ধরে প্রাণপণ শক্তিতে টেনে ঝুলে দেখলো বন্ধ হয়েছে কি না, তারপর দলা-পাকানো খবরের কাগজে আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে সুমুখে তাকিয়ে দেখলো, শশীনাথ দোকান বন্ধ করে কাগজ পুড়িয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চাবি বাজাচ্ছে।
কাশীনাথ এল শশিনাথের কাছে।
কাশীনাথ জিজ্ঞাসা করলে, বেচাকেনা কেমন? শশীনাথ বললো, কোন রকম।
দুজনে হাঁটতে আরম্ভ করলো।
শশীনাথ বললো, এবারের পেটিটার ওজন কম ছিল। কাশীনাথ বললো, ও-রকম থাকে।
শশীনাথ বললে, কাল দু’পেটি মাল বেশী চাই।
কেন?
দুজন দোকানদার নেবে বলেছে।
কাশীনাথ বললে, তুমি বুঝি সবাইকে শেখালে এই গুঁড়ো দুধের কাজ?
শশীনাথ বললে, শিখুক না। এতেও তো লাভ আছে। শেষে দুটোই চালাব। দোকানও চালাব, ওটাও চালাব। এরই সূত্র ধরে চলল তাদের ভবিষ্যতের পরিকল্পনা—কত হাসি, কত গল্প!
শ্যামবাজারের মোড় থেকে দুজনকে যেতে হবে দুদিকে। গল্প তখনও তাদের শেষ হয়নি। সুতরাং বসতে হল একটা বাড়ির রকে। শহরের পথ জনবিরল হয়ে এল। সুমুখের ট্যাক্সি-স্ট্যাণ্ড ফাঁকা হয়ে গেল। মল্লিকদের পেটা ঘড়িতে একটা বাজল। চমক ভাঙল কাশীনাথের; ভোরে উঠতে হবে। আজ চলি।
এস। —বলে বিদায় নিলো শশিনাথ।
এমনি প্রত্যহ। দশ বছর আগে এমনি ক’রে গড়ে উঠেছিল তাদের প্রগাঢ় বন্ধুত্ব।
দশ বছর পরে, দেখা গেল, দুটো দোকানই তাদের বড় হয়েছে। দশ-বারোজন কর্মচারী কাজ করছে প্রত্যেকটি দোকানে। দোকানের মাথায় প্রকাণ্ড সাইনবোর্ড। কাচের শো-কেসে নানারকমের মিষ্টি সাজানো। পেছনে বসে খাবার জায়গা। তারও পেছনে দিবারাত্রি সন্দেশ তৈরি হচ্ছে।
কাশীনাথ, শশীনাথ এখন মস্ত লোক। মুর্গিহাটায় তাদের মস্ত কারবার। এখন তারা গুঁড়ো দুধের পাইকারী ব্যবসাদার। অস্ট্রেলিয়া থেকে মাল আসছে। হল্যাণ্ড থেকে জাহাজ আসছে। লক্ষ লক্ষ টাকার লেন-দেন চলছে।
সামনে পুজো। শশীনাথ বললে, হাওড়া স্টেশনের ওপারে কি আছে তা তো জান না। চল বেড়িয়ে আসি।
কাশীনাথ জিজ্ঞাসা করলে, কোথায় যাবে? শশীনাথ বললে, পুরী।
কাশীনাথ রাজি হয়ে গেল। ঠিক হল—দুজনের যা খরচ হবে, হিসেব করে এ দেবে অর্ধেক, ও দেবে অর্ধেক।
শশীনাথ আগে বিড়ি টানত, এখন সিগারেট খায়।
পান খায়, মদ্যপান করে।
কাশীনাথের কিন্তু ও-সব বালাই নেই। মদ্যপান দূরের কথা, সিগারেটও খায় না, পানও খায় না।
শশীনাথ বললে, নিতান্ত বে-রসিক তুমি। এই বলে সে কয়েকটা দামী দামী সিগারেটের টিন কিনে নিলে। জীবনের সাধ মিটিয়ে নেবার জন্যে বেড়াতে বেরিয়েছে, এ সময় কৃপণতা করার কোনও মানেই হয় না।
পুরী গিয়ে পৌঁছলো দুই বন্ধু। ভাল একটা হোটেলে গিয়ে উঠল।
শশীনাথ বললে, মদ খাব। কাশীনাথ বাধা দিলে না। বললে, খাও।
খুব দামী বিলিতী মদ এল। তার সঙ্গে আনুষঙ্গিক সব কিছুই এল। শশীনাথ তার মনের সাধ মিটিয়ে মদ্যপান করলে। কাশীনাথ নিজের হাতে বোতল খুলে কাচের গ্লাসে ঢেলে দিতে লাগল।
পরের দিন ঠিক হল—সমুদ্রস্নান করবে তারা। সমুদ্রে স্নান করে জগন্নাথের মন্দির দর্শন করবে। এত লোক স্নান করছে সমুদ্রে, তারাই-বা করবে না কেন? দুই বন্ধু প্রস্তুত হল কোমরে গামছা বেঁধে। মনে হল যেন দিগ্বিজয় করতে চলেছে। ধীরে ধীরে জলে গিয়ে নামল।
এই ঢেউটা নিতে হবে কিন্তু। —বলতে বলতে প্রকাণ্ড ঢেউ এসে তাদের আছড়ে ফেলে দিয়ে গেল বালির ওপর। মন্দ লাগল না। হাসতে হাসতে আবার এগিয়ে গেল দুই বন্ধু।
কাশীনাথ পূর্ববঙ্গের মানুষ। নদী-নালা-খাল-বিলে ভরা পূর্ববঙ্গ। সমুদ্রের লোনা জলে নাকানিচুবানি খেতে পারে, কিন্তু জলে ডুবে মরবে না সহজে।
আর শশীনাথ? কলকাতা শহরেই চিরকাল। লালদীঘি, গোলদীঘি চোখে দেখেছে মাত্র। স্নান করেছে কলে চৌবাচ্চায়। সেই শশীনাথ নেমেছে সমুদ্রের জলে। বার দুই-তিন ঢেউ নেবার পর তার সাহস গেল বেড়ে। ক্রমাগত এগিয়ে চলল সামনের দিকে। কাশীনাথও যাচ্ছিল তার পাশে পাশে। একটা ঢেউয়ের ধাক্কায় ছিটকে পড়ল অনেকদূরে। ঢেউ স’রে গেল। কাশীনাথ উঠে দাঁড়াল। কিন্তু শশীনাথ কোথায়? অনেক দূরে মনে হল যেন ভেসে যাচ্ছে একটা মানুষ। হাত দুটো একবার উপরের দিকে উঠল, তারপর আর তাকে দেখা গেল না। কাশীনাথ চিৎকার করে উঠল, শশীনাথ! শশী! একে কালা, তায় আবার সমুদ্রের গর্জন। কারও কোনও সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। নুলিয়া ছেলেরা তীরে সাঁতার কাটছিল। কাশীনাথ তাদের ডাকলে হাতের ইশারায়। আবার তেমনি ইশারা করেই দেখিয়ে দিলে তার বন্ধু ডুবছে। নুলিয়া ছেলেরা বকশিসের লোভে ছুটল তীরের মত। তারপর চারজনে ধরাধরি করে অতি কষ্টে যে মানুষটিকে তারা তুলে নিয়ে এল সে শশীনাথ
অনেকখানি লোনা জল খেয়ে পেটটা তখন তার ফুলে ঢাকের মত হয়ে গেছে। মুখ দিয়ে গল গল করে জল বেরুচ্ছে। চোখ দুটো লাল। তাকিয়ে আছে, কিন্তু কথা বলতে পারছে না।
বিস্তর লোক জড়ো হয়ে গেল। কেউ বললে, ডাক্তারখানায় নিয়ে যান। কেউ বললে, চিৎ করে শুইয়ে দিন। কেউ বললে, উপুড় করে দিন। কেউ বললে, মরে গেছে। কেউ বললে মরে নি।
নুলিয়া ছেলেরা কিন্তু কারও কথা শুনলে না, কোনও কথার জবাব দিলে না, মিনিট দশ-পনেরো ধরে কত রকম কি সব করলে, শশীনাথের মুখ দিয়ে হড় হড় করে খুব খানিকটা জল বেরিয়ে গেল; তারপর হঠাৎ এক সময় তাকে তুলে বসিয়ে দিয়ে একটা ছেলে বললে, এবার এঁকে বাড়ি নিয়ে যান বাবু।
শশীনাথের দু’চোখ বেয়ে দর দর করে জল গড়িয়ে এল। কাশীনাথের হাত দুটো জড়িয়ে ধরে সে হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল। কাশীনাথ বললে, কাঁদে না চুপ কর।
শশীনাথ বললে, আজ আমি মরে গিয়েছিলাম। তুমি আমাকে বাঁচালে।
কাশীনাথ বললে, না, আমি বাঁচাই নি। নুলিয়াদের দেখিয়ে দিয়ে বললে, বাঁচিয়েছে এরা।
শশীনাথ বললে, চল, ওদের দশ টাকা বকশিস দেব। নুলিয়া ছেলেগুলো বললে, না বাবু, আমরা কুড়ি টাকা নেব। পাঁচ টাকা করে এক-একজন।
কুড়ি টাকাই তাদের দেওয়া হল।
এই দুর্ঘটনার পর, পুরীতে তারা আর রইল না। ফিরে এল কলকাতায়। এসেই শশিনাথ হিসেবের কাগজ নিয়ে বসল। পুরী যাওয়া-আসা খরচের হিসেব। কাশীনাথ বললে, কত ছোটখাটো খুচরো খরচ হয়েছে আমাদের, সে সব কি তোমার মনে আছে?
হাসতে হাসতে শশীনাথ তার পকেট থেকে ছোট একটি খাতা বের করলে। দেখা গেল, কোথায় দু’ পয়সার পান কিনেছে, তাও সে লিখতে ভোলে নি। কাশীনাথ ভেবেছিল, মদ ও নিজেই খেয়েছে, কাজেই সে খরচের আধাআধি বখরা নিশ্চয়ই তাকে দিতে হবে না। তার ওপর নুলিয়াদের বকশিস কুড়ি টাকা। শশীনাথের জীবন বাঁচিয়েছিল তারা। সে খরচ শশীনাথের একার। কিন্তু আশ্চর্য, সব টাকা একসঙ্গে যোগ করে নিতান্ত নির্লজ্জের মত শশীনাথ তার অর্ধেক চেয়ে বসল কাশীনাথের কাছে। কাশীনাথ তবু একবার জিজ্ঞাসা করলে, এ সবের অর্ধেক দিতে হবে আমাকে? শশীনাথ বললে, যাবার আগে সেই রকম কথাই হয়েছিল। কাশীনাথ আর একটি কথাও বললে না। দিলে। তার আধাআধি ভাগের প্রতিটি পাই পয়সা মিটিয়ে দিয়ে উঠে গেল সেখান থেকে।
ষোল কলা পূর্ণ হল সেই দিন, কাশীনাথ যেদিন শুনলে, যে টিকিটে তারা পুরী গিয়েছিল, রেলের সে টিকিট দুটোও শশীনাথ কেনে নি। পুজোর ছুটিতে রেল-কোম্পানি সে বছর এক মাসের কনসেশন টিকিট বের করেছিল। শশীনাথের দুশালা দু’খানি টিকিট কিনে পুরী গিয়ে সাত দিনের ভেতর ফিরে এসেছে। টিকিটে কোথাও আঁচড় পড়ে নি। টিকিট দুটো তারা ফেলে দিতে যাচ্ছিল, শশীনাথ কুড়িয়ে নিয়ে বলেছিল, টিকিটের মেয়াদ এখনও ফুরোয় নি। দেখি, যদি আর-একবার ব্যবহার করতে পারি।
সেই টিকিটই তারা ব্যবহার করেছে। শশিনাথের জয় হোক!
কাশীনাথ একবার স্বপ্ন দেখেছিল, শশিনাথকে সে মেরে ফেলেছে। সে আজ অনেক দিনের কথা। আজ মনে হল, পুরীর সমুদ্রতীরে দাঁড়িয়ে সেদিন সে নুলিয়াদের বোধ করি না ডাকলেই ভাল করত।
.
আরও কিছুদিন পরে।
অনেক টাকার মাল ধরে রেখেছিল দুই বন্ধু। কাশীনাথ পঞ্চাশ হাজার, শশীনাথ হাজার—এক লক্ষ টাকার গুঁড়ো দুধের পেটি। শশীনাথের ইচ্ছা, দর না উঠলে মাল সে ছাড়বে না। অনেক টাকা লাভ করবে।
কাশীনাথ এসে খবর দিলে, হল্যান্ডের জাহাজ এসে গেছে। বাজারে প্রচুর মাল। দর পড়ে যাচ্ছে। এ সময় মাল ধরে রাখলে অনেক টাকা লোকসান হয়ে যাবে। শশীনাথ বললে, ছাড়তে হয় তুমি ছাড়। আমি আরও এক সপ্তাহ দেখব।
এক সপ্তাহ দেখবার দরকার হল না। দু দিন পরেই দেখা গেল, বাজারের দর অনেক নেমে গেছে। এখন ছেড়ে দিলে তার পনেরো হাজার টাকা লোকসান। আরও দেরী করলে আরও বেশি লোকসানের সম্ভাবনা
পনেরো হাজারের ওপর দিয়েই যাক। —বলে একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে কাশীনাথ উঠে দাঁড়াল। বললে, ও মাল আমি আজই বিক্রি করে ফেলব।
শশীনাথ বললে, বেশ, তবে আমাকেই দাও। টাকার হিসেব করে শশীনাথ চেক-বই বের করলে।
কাশীনাথ বললে, এত মাল তুমি কোন সাহসে ধরছ? ডুববে যে!
শশীনাথ বললে, ডুবেছিলাম একদিন পুরীর সমুদ্রে। সেদিন তুমিই বাঁচিয়েছিলে। আবার যদি ডুবি এই শুকনো ডাঙায়, তুমিই বাঁচাবে। এই বলে সে হো হো করে হেসে উঠল।
মুখে কিছু বললে না কাশীনাথ। কিন্তু মনে মনে বললে, এমনি হো হো করে কাঁদবে যেদিন মাথায় হাত দিয়ে; সেই দিন আমি হাসব।
.
হাসবার সুযোগ কিন্তু পেলে না কাশীনাথ।
দেখা গেল, শশীনাথ হাত মিলিয়েছে মস্ত বড় ধনী এক মাড়োয়ারীর সঙ্গে। হল্যাণ্ডের জাহাজের সংবাদ মিথ্যা, আর গুঁড়ো দুধ বলতে যেখানে যা কিছু ছিল—শশীনাথের কল্যাণে সবই গিয়ে ঢুকল মাড়োয়ারীর গুদামে।
লাভ হল প্রচুর, কিন্তু সে লাভের কতটুকু অংশ পেলে শশীনাথ আর কতটুকু পেলে ধনী মাড়োয়ারী তার হিসেব কেউ রাখলে না। শুধু জ্বলে পুড়ে মরতে লাগল কাশীনাথ তার লোকসানের জ্বালায়।
নিতান্ত ইতরের মত শশীনাথ যে খেলা খেললে তার সঙ্গে, সেটাকে সে কিছুতেই বরদাস্ত করতে পারলে না। কাশীনাথের আহার গেল ছুটে, নিদ্রা গেল টুটে, দিবারাত্রি শুধু সে একটি কথাই ভাবতে লাগল—কেমন করে সে এর প্রতিশোধ নেবে।
বাজারে তখন একটা মালের চাহিদা খুব বেশি। অস্ট্রেলিয়ার তৈরি ‘ফুল ক্রিম মিল্ক পাউডার’। কেউ দিতে পারছে না। অস্ট্রেলিয়া থেকে খবর এসেছে, কোম্পানি কারবার গুটিয়ে দিয়েছে। সে জিনিস আর পাওয়া যাবে না। সামান্য যার কাছে যেটুকু আছে, হাতছাড়া করতে চায় না কেউ। দিনের পর দিন দাম তার বেড়েই চলেছে।
কাশীনাথ একদিন শশীনাথের বাড়ি গিয়ে বললে, অস্ট্রেলিয়ান ফুল-ক্রিম চাই? শশীনাথ চমকে উঠল। মনে হল যেন কাশীনাথ বলছে—আকাশের চাঁদ চাই? শশীনাথ বললে, নিশ্চয়ই চাই। কিন্তু পাবে কোথায়?
সে-সব তোমার জানবার কি দরকার? চাই কি না বল।
শশীনাথ বললে, চাই। কাশীনাথ জিজ্ঞাসা করলে, কত? যত দিতে পার।
কাশীনাথ, বললে, কাল বলব, কত দিতে পারি।
দরদস্তুর সব ঠিক হয়ে গেল। কাশীনাথের নতুন বাড়ির পাশেই যে গুদাম-ঘর, মাল ডেলিভারি নিতে হবে সেইখান থেকে। কাশীনাথ বললে আর যদি বল তো মাল পৌঁছিয়েও দিতে পারি তোমার গুদামে।
না, আমি তোমার গুদোম থেকেই নেব – বললে শশীনাথ।
সেই ভাল। —বলে নিশ্চিন্ত হয়ে কাশীনাথ বাড়ি ফিরে গেল।
শশীনাথ কিন্তু নিশ্চিন্ত হতে পারলে না। তাকে জব্দ করবার এ এক নতুন চাল নয় তো? কিন্তু তাই বা কেমন করে হবে? কাশীনাথ তো অগ্রিম টাকা চাইলে না! শশীনাথের মাথার ভেতরটা কেমন যেন করতে লাগল। এই দুর্লভ বস্তু সে পেলে কোথায়?
পরের দিন সে হেঁটে হেঁটেই চলতে লাগল কাশীনাথের বাড়ির দিকে। চুপিচুপি তার গুদামে গিয়ে দেখবে, মাল সেখানে সত্যই মজুত আছে কি না। অর্ডার দিতে হয় তারপর দেবে।
কাশীনাথের বাড়িতে আলো জ্বলছে। গ্যারেজে নতুন গাড়িখানাও রয়েছে। বাড়িতেই আছে সে।
যাক, শশীনাথ তাকে ডাকলে না। চোরের মত চুপি চুপি এগিয়ে গেল তার গুদামের দিকে। গুদাম মানে বাড়ির পেছনের দিকে টিনের একখানা লম্বা ঘর।
শশীনাথ দেখলে, গুদামের দরজায় তালা নেই। টিনের কপাটে হাত দিয়ে একটু ফাঁক করে অতি সন্তর্পণে শশীনাথ ভেতরে ঢুকে পড়ল। আলো জ্বলছে না। চারিদিক অন্ধকার। ফিস ফিস করে কারা যেন কথা বলছে। দুজন লোক রয়েছে বলে মনে হল। একজন দাঁড়িয়ে, একজন বসে। যে দাঁড়িয়ে, তার হাতে একটা টর্চ।
শশীনাথ তাদের চিনতে পারে নি। ডাকলে, কাশীনাথ
কাশীনাথ চমকে উঠল। বললে, কে?
টর্চের আলোটা এসে পড়ল শশীনাথের মুখের ওপর। হঠাৎ সেখানে বজ্রপাত হলেও বুঝি এতটা বিস্মিত হত না কাশীনাথ! তাড়াতাড়ি শশীনাথের দিকে সে এগিয়ে এল। জিজ্ঞাসা করলে, তুমি এখানে? শশীনাথ বুঝতে পারছিল না, কি জবাব দেবে। ফ্যালফ্যাল করে কাশীনাথের মুখের পানে সে তাকিয়ে রইল। কাশীনাথের বুকের ভেতরটা তখন টিপটিপ করছে। শশীনাথকে এক রকম ঠেলতে ঠেলতে সেখান থেকে বাইরে নিয়ে এল। বললে, চল, বসরে চল।
শশীনাথ বললে, না বসব না। আমার কাজ আছে। আমি বলতে এসেছিলাম—
কথাটা কাশীনাথ শেষ করে দিলে অস্ট্রেলিয়ান মিল্ক-পাউডার তুমি নেবে না। এই তো?
শশিনাথ বললে, দু-চার দিন পরে নেব।
কাশীনাথ বললে, বুঝেছি। ‘বুঝেছি’ বলে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল সেইখানে। ‘এস’ কি ‘যাও’ কোনও কথাই বললে না শশীনাথকে। শশীনাথও কিছু না বলে হেঁটে হেঁটে চলে গেল তার চোখের সুমুখ দিয়ে। রাস্তার বাঁকে অদৃশ্য হয়ে গেল শশীনাথ। কাশীনাথ চিৎকার করে উঠল, শয়তান!
.
পুলিস কিন্তু এল না রাত্রে। পুলিসও এল না, কাশীনাথের চোখে ঘুমও এল না।
এই কথা যদি জানাজানি হয়ে যায়, এ বাজারে আর করে খেতে হবে না কাশীনাথকে। শশীনাথ তার পরম শত্রু। এ সুযোগ সে ছাড়বে না কিছুতেই। তারচেয়ে—
কাশীনাথ উঠে বসল। আলো জ্বালালে। আলমারি খুলে তার নতুন কেনা অটোমেটিক রিভলভার ঠিক করে রাখলে। কাঁচা টাকা-পয়সা সঙ্গে নিয়ে যাওয়া আসা করতে হয় কলকাতার রাস্তায়। কাশীনাথ আর শশীনাথ দুজনেই লাইসেন্সের দরখাস্ত করেছিল দুটি রিভলভারের জন্যে। অনেক তদ্বির-তদারক করে অনেক কষ্টে কাশীনাথ লাইসেন্স পেয়েছে। শশীনাথ পায় নি।
পরের দিন বাজারে গেল কাশীনাথ। শশীনাথের দেখা পেলে না। সে আসে নি।
আসবে কেন? পুলিসে খবর দিয়ে চুপ করে বসে আছে বাড়িতে। আর নয়তো কলকাতা ছেড়ে পালিয়েছে।
কাশীনাথ বাড়ি ফিরে এল। সন্ধ্যা তখনও হয় নি। ভাবলে শশীনাথের সঙ্গে একটা এপয়েন্টমেন্ট করা যাক—পোষ্টকার্ড লিখে। একখানা পোষ্টকার্ড টেনে লিখতেও গেল। কিন্তু না, পোষ্টকার্ডখানা সাক্ষী থেকে যাবে। তার চেয়ে— টেলিফোনে কথা বলা ভাল।
টেলিফোনের রিসিভারটা তুলে নিয়েও নামিয়ে রাখলে কাশীনাথ। ডাকলে, হরিশ!
হরিশ এসে দাঁড়াল বলুন।
কাশীনাথ বললে, চট করে তুমি চলে যাও শশীনাথের বাড়ি। এখন বাজছে সাড়ে পাঁচটা। বল গিয়ে ঠিক সাতটার সময় সে যেন তার বাড়িতে আমার জন্যে অপেক্ষা করে। আমি যাচ্ছি।
হরিশ চলে গেল। এখনও অনেক দেরি। গাড়ি নিয়ে তার বাড়ি পৌঁছতে পনেরো মিনিটের বেশি লাগবে না। সময় যেন কাটতে চায় না কিছুতেই। কাশীনাথ বেরিয়ে এল বাড়ির বাইরে।
ড্রাইভার জিজ্ঞাসা করলে, গাড়ি বের করব?
–কর।
ড্রাইভার গাড়ি বের করছে, কাশীনাথ পায়চারি করছে বাড়ির সামনে। জুতো জোড়াটা নতুন কিনেছে। কিচকিচ আওয়াজ হচ্ছে। তা হোক। চমৎকার জুতো। কিন্তু কালো রঙের জুতো না কিনলেই পারত। তার গায়ের রঙ কালো, তার ওপর কালো রঙের জুতো। ব্রাউন রঙের আর এক জোড়া কিনতে হবে।
রাম রাম!
মুখ তুলে চাইতেই দেখে, দুধের বাজারের দালাল কিষণচাঁদ।
কাশীনাথ জিজ্ঞাসা করলে, কি খবর কিষণচাঁদ?
কিষণচাঁদ বললে, কুছু না বাবুসাব। এই দিক দিয়ে একঠো তাগাদায় যাচ্ছি—
বলেই যে কাশীনাথের একটু কাছ ঘেঁষে এসে দাঁড়াল। চুপিচুপি বললে, হাঁ বাবু; শুনেছি নাকি অস্ট্রেলিয়ান ফুল-ক্রিম এসে গেছে বাজারে?
কাশীনাথ বললে, কোথায় শুনলে? শশীনাথের কাছে?
—না, শশীবাবুর সঙ্গে আমার মুলাকাৎ হয় নাই। আমি শুনেছি মথুরা প্রসাদের গদিতে। আবার শুনছি ঠিক সেই রকমের টিন বানিয়েছে, লেবিল বানিয়েছে, বাহারসে চিনা যায় না, ভিতরে রদ্দি মাল পুরিয়ে দিয়েসে।
গাড়ি এসে দাঁড়াল। কিষণচাঁদ বললে, আপনি যান বাবুসাব, আবার দেখা হবে। রাম রাম!
কিষণচাঁদ চলে গেল।
কাশীনাথ দাঁতে দাঁত চেপে ধরল।— এ ঠিক শশীনাথের কাজ
এখন ছটা বাজছে। আর এক ঘণ্টা। তারপরেই সব শেষ। চিরদিনের জন্যে তার মুখ বন্ধ হয়ে যাবে।
হরিশ ফিরে এল। শশীনাথের সঙ্গে তার দেখা হয়েছে। বাড়িতেই থাকবে সে।
কাশীনাথ আজ কোট গায়ে দিয়েছে। পকেটে হাত দিয়ে দেখলে, ঠিক আছে।
হরিশ জিজ্ঞাসা করলে, আমি যাব সঙ্গে?
কাশীনাথ বললে, না।
ড্রাইভারকে বললে, তুমিও নাম। আমি একাই যাব।
কাশীনাথ গাড়ি চালাতে খুব বেশিদিন শেখে নি। ড্রাইভার বললে, থাকি না আমি আপনার সঙ্গে?
কাশীনাথ ধমক দিয়ে উঠল, না না।
এই বলে সে নিজেই গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেল।
.
শশীনাথ বাড়িতে বসে আছে কাশীনাথ আসবে বলে। সাতটা বাজল, সাড়ে সাতটা বাজল, কাশীনাথ এল না।
শশীনাথ ভাবলে বুঝি সে তার সঙ্গে রসিকতা করেছে। আসবে না। তার বাড়িতে একবার টেলিফোন করে দেখা যাক।
উঠতে যাবে, ঘড়িতে তখন আটটা বাজতে মিনিট পাঁচেক দেরি, এমন সময় হো হো করে হাসতে হাসতে ঘরে ঢুকল কাশীনাথ।
শশীনাথ কেমন যেন অবাক হয়ে মুখ তুলে তাকালে। তাকিয়ে আর চোখ ফিরিয়ে নিতে পারলে না। এ যেন অন্য কাশীনাথ। এত সুন্দর হাসি কাশীনাথের মুখে!
শশীনাথ বললে, এত হাসি কিসের?
কাশীনাথ বললে, অনেকক্ষণ বসিয়ে রেখেছি তোমাকে।
—তাতে কি হয়েছে?
হয়েছে অনেক কিছু।— বলতে বলতে কাশীনাথ বসল। বললে, দেখ, আজ তোমাকে সব কথা খুলে বলি। সারাটা জীবন ধরে কি করলাম আমরা? এমন কোনও খারাপ কাজ নেই যা আমরা করি নি। তুমি কিন্তু আমাকেও ছাড়িয়ে গেলে। বেশ ভেবে চিন্তে আমার পনেরো হাজার টাকা লোকসান করিয়ে দিয়ে তোমার কত লাভ হল জানি না-
শশীনাথ প্রতিবাদ করতে চাইলে। বললে, না না সেটা হচ্ছে গিয়ে—তুমি আমার কথা শোন-
কোনও কথা শুনতে চাই না।— কাশীনাথ বললে, আমাকে বলতে দাও। পনেরো হাজার টাকা নয়, তুমি আমাকে ঠকালে—সেইটা আমি কিছুতেই ভুলতে পারলাম না। কেমন করে তোমাকে ঠকাব, কেমন করে তোমার সর্বনাশ করব— সেই কথাটাই ভাবতে লাগলাম দিনরাত। শেষে অনেক কষ্ট করে অস্ট্রেলিয়ান দুধের টিন তৈরি করলাম, হুবহু নকল লেবেল ছাপলাম। তোমাকে বিক্রি করবার জন্যে নয়। বিক্রির নাম করে তোমার গুদামে মাল পাঠিয়ে দিয়ে তোমাকে পুলিসে ধরিয়ে দেব বলে। কিন্তু সব গেল ভেস্তে। তুমি নিজে গিয়ে হাজির হলে আমার গুদামে। চোরের মত চুপিচুপি গিয়ে সব কিছু দেখে ফেললে।
শশীনাথ বললে, কি দেখে ফেললাম?
—দেখলে না? আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম টর্চ নিয়ে, আর হরিশ লেবেল আঁটছিল।
শশীনাথ বললে, না। সত্যি বলছি আমি কিছুই দেখতে পাই নি।
কাশীনাথ খানিক থেমে কি যেন ভাবলে। তারপর বললে, তা হলে দেখ কি রকম মতিভ্রম! অথচ আমি ভাবলাম, তুমি সব দেখে গেলে। গিয়েই পুলিসে খবর দেবে। বাজারে জানাজানি হয়ে যাবে, লজ্জায় আমি আর কারও কাছে মুখ দেখাতে পারব না। কারবার গুটিয়ে আমাকে সরে পড়তে হবে। তার চেয়ে।—তুমি তো জান আমি রিভলভারের লাইসেন্স পেয়েছি, ভাবলাম সেই রিভলভার দিয়ে তোমাকে একবারে শেষ করে দিই—তোমার মুখ চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়ে যাক।
শশীনাথ নড়ে-চড়ে বসল। ভয়ে এদিক-ওদিক তাকাতে লাগল।
কাশীনাথ বললে, বাজারে গেলাম, দেখলাম তুমি যাও নি। হরিশকে পাঠালাম তোমার কাছে।
শশীনাথ আর বসে থাকতে পারছে না। চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেছে। পেছনের দরজাটা খোলা। ছুটে পালিয়ে যেতে পারবে কি না একবার তাকিয়ে দেখে নিলে।
কাশীনাথ বললে, তোমাকে সাতটার সময় বাড়িতে থাকতে বলেছিলাম।
শশীনাথ বললে, হ্যাঁ, সাতটা।
শশীনাথ আর কথা বলতে পারছে না। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা দিয়েছে। একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে কাশীনাথের হাতের দিকে। হাতটা সরিয়ে কি ছুটে পালাবে?
সেই দিকে তাকিয়েই শশীনাথ অতি কষ্টে উচ্চারণ করলে, তুমি কি রিভলভার নিয়ে এসেছ?
কাশীনাথ আবার হো হো করে হেসে উঠল। বুঝতে পারলে, মৃত্যুর ভয়ে শশীনাথ আধমরা হয়ে গেছে। বললে, না না, তোমার ভয় নেই। সাতটার সময় দেখা যদি হত, তা হলে সত্যি আমি তোমাকে মেরে ফেলতাম। এখন আর মারব না। তুমি শুধু শোন আমার কথাগুলো শেষ পর্যন্ত।
শশীনাথের চোখ দিয়ে জল এসে গেল। বললে, বল।
কাশীনাথ বললে, নিজেই গাড়ি চালিয়ে আসছিলাম তোমার এখানে। ড্রাইভারকে সঙ্গে নিলাম না, হরিশকে নিলাম না। নিলাম শুধু আমার সেই অটোমেটিক রিভলভারটা — সাতটা চেম্বার সাতটা বুলেট দিয়ে ঠাসা।
কিন্তু কে জানত এমন হবে? এখান থেকে বেশি দূরে নয়—তোমার বাড়ির সুমুখে রাস্তার এই যে বাঁকটা—ওইটে পেরিয়েই লালরঙের রকওয়ালা বাড়িটার কাছ-বরাবর এসে গেছি, হঠাৎ দেখি সুমুখে একটা প্রকাণ্ড লরি আসছে। সেই লরিটাকে পাশ কাটাতে গিয়ে হাতটা ঠিক রাখতে পারলাম না, একটা ল্যাম্পপোস্টের গায়ে জোরসে লাগালাম ধাক্কা। মাথাটা গেল ঘুরে—কি যে হল বুঝতে পারলাম না, আবার আর এক ধাক্কা—লাল বাড়িটার রকে। আমাতে তখন আর আমি নেই। সব শেষ। চারিদিক অন্ধকার! কিন্তু সে শুধু কিছুক্ষণের জন্যে। তার পরেই সব পরিষ্কার। তখন এ পৃথিবীর রঙ গেছে বদলে। সব দেখতে পাচ্ছি, সব বুঝতে পারছি, কিন্তু আমার কিছুই করবার নেই। মনে হচ্ছে, তোমরা কে? কারও সঙ্গে আমার কোনও সম্বন্ধ নেই। আমার স্ত্রী পুত্র কন্যা— কেউ আমার নয়। আমি একা, আমি স্বাধীন, আমার কোনও প্রয়োজন নেই, আমার কোনও কষ্ট নেই, দুঃখ নেই, অভাব নেই; কারও ওপর কোনও রাগ নেই, বিদ্বেষ নেই—শুধু আনন্দ। আনন্দ ছাড়া আর কিছু নেই। কিন্তু সে আনন্দ আমি উপভোগ করতে পারছি না ভাই। এতদিন ধরে পৃথিবীর সঙ্গে যে সম্বন্ধ পাতিয়েছি—শুধু স্বার্থের সম্বন্ধ। শুধু আমি আর আমার ছেলে, আমার মেয়ে, আমার ঘর, আমার বাড়ি, আমার টাকা, আমার বন্ধু, আমার শত্রু। এরাই আমাকে টেনে টেনে নামিয়ে আনছে শুধু। জ্বলে পুড়ে মরে যাচ্ছি। আমি তোমার কাছে এসেছি শুধু ক্ষমা চাইতে, মুক্তি চাইতে। তোমাকে আমি মারতে এসেছিলাম। তুমি আমাকে ক্ষমা কর। আমাকে মুক্তি দাও। আমি পালাই এখান থেকে।
শশীনাথ বললে, তোমার কথাগুলো আমি বুঝতে পারছি না কাশীনাথ। পাগলের মত কি বলছ যা-তা।
কাশীনাথ বললে; বুঝতে পারবে না যে! পৃথিবীর সব ভাল কথাই পাগলের কথা বলে মনে হয়। যদি পার তো আমাকে ক্ষমা কর। আমি চললাম।
শশীনাথ বললে, কিন্তু তোমার গাড়িটার কি হল? তোমার তো লাগে নি কোথাও?
কাশীনাথ উঠে দাঁড়াল। বললে, বাড়ি থেকে বেরিয়ে একটুখানি এগিয়ে যাও। রাস্তার এই মোড়টা পেরুলেই সব দেখতে পাবে, সব বুঝতে পারবে।
শশীনাথের জুতোজোড়াটা ছিল চৌকাঠের ওপারে। জুতো পায়ে দিয়ে ঘরে ঢুকে দেখলে, কাশীনাথ নেই।
শশীনাথ রাস্তায় বেরিয়ে এল। ডাকলে, কাশীনাথ! কাশীনাথ!
কাশীনাথকে দেখতেও পেলে না, তার সাড়াও পেলে না।
শশিনাথ মোড় পেরিয়ে গিয়ে দেখে, কাশীনাথ যা বলেছিল ঠিক তাই। লাল বাড়িটার পাশে কাশীনাথের গাড়িটা কাৎ হয়ে পড়ে আছে। গাড়ির সামনের দিকটা ভেঙে একেবারে চুরমার হয়ে গেছে। জায়গাটা লোকে লোকারণ্য। কয়েকজন পুলিস কনস্টেবল ভিড় সরাচ্ছে।
ক্রেন-ফিট করা একটা ট্রাক এসেছে। গাড়িটা টেনে নিয়ে যাবে। ওদিকে পুলিসের গাড়ির কাছে স্ট্রেচারের ওপর একটা মানুষের মৃতদেহ। আপাদমস্তক কাপড় দিয়ে ঢাকা। লোকের ভিড় সেইখানেই বেশি।
লোকজন ধরাধরি করে মৃতদেহটা অ্যাম্বুলেন্সে তুলতে যাচ্ছিল। শশীনাথ তাড়াতাড়ি সেইখানে গিয়ে দাঁড়াল। থানার ও.সি. শশীনাথের চেনা লোক।
শশীনাথ বললে, গাড়িটা তো কাশীনাথের?
ও.সি. বললেন, এই যে, আপনি এসেছেন? আপনার বন্ধু।
শশীনাথ জিজ্ঞাসা করলে, অ্যাকসিডেন্ট কখন হয়েছে?
ও.সি. বললেন, এঁরা তো বলছেন সাতটার সময়। এদিকে উনি যাচ্ছিলেন কোথায়? আপনার বাড়িতেই বোধহয়।
শশীনাথ কোনও কথা বলতে পারলে না। চুপ করে রইল।
ও.সি. বললেন, পকেটে একটা নতুন চকচকে রিভলভার পাওয়া গেল। লোডেড রিভলভার। সাতটা চেম্বারে সাতটা বুলেট।
মৃতদেহ অ্যাম্বুলেন্সে তুলে দেওয়া হল।
ও.সি. বললেন, বন্ধুকে একবার দেখবেন নাকি?
বলেই তিনি এগিয়ে গিয়ে মৃতদেহের মুখের ঢাকা তুলে দিলেন। শশীনাথ দেখলে। মনে হল, কাশীনাথ যেন নিশ্চিন্ত মনে ঘুমুচ্ছে। মুখে কোথাও এতটুকু বিকৃতির চিহ্ন নেই।
ও.সি. বললেন, চোটটা লেগেছে বুকে। সঙ্গে সঙ্গে মারা গেছেন। আসি। নমস্কার।
গাড়ি চলে গেল। শশীনাথ কাঠের মত দাঁড়িয়ে। তার চোখ দুটো তখন জলে ভরে এসেছে। এতক্ষণ পরে কাশীনাথের কথাগুলো সে বুঝতে পারলে।— তোমাকে আমি ক্ষমা করেছি কাশীনাথ। তুমি আমাকে ক্ষমা কর।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন