শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়
মস্ত বড় রাজার ছেলে।
চেহারাও চমৎকার। মাথায় বাবরি চুল, পাকা আমের মত গায়ের রং, বাঁশির মত নাক, ঢলঢলে দুটি চোখ! যেমন তার গড়ন-তেমনি জোয়ান।
তা হলে কী হয়, তার স্বভাব বড় বেয়াড়া।
অত অত ধন-দৌলত, হাতি-ঘোড়া, লোক-লস্কর, দাস-দাসী… তবু সে বলে, ‘আমি চললাম।’
চল্লাম কি রে!— যাবি কোথায়?’
ঘাড় নেড়ে রাজপুত্র বলে, ‘আমি যাবই।’
‘কোথায় যাবি?’
‘যেদিকে দুচোখ যায়। যেদিকে আমার খুশি!’
রানি জিজ্ঞেস করেন, ‘কেন, কী দুঃখে যাবি বাছা?’
ছেলে জবাব দেয় না! চুপ করে থাকে।
.
তারপর, সত্যিই একদিন গেল।
কাউকে কিছু বললে না। গভীর রাত। সবাই তখন ঘুমোচ্ছে। চুপি চুপি উঠে পা টিপে টিপে রাজবাড়ির পিছনের দরজা দিয়ে রাজার ছেলে রাজবাড়ি ছেড়ে উধাও হল।
অন্ধকার রাত। রাজপুত্র চলেছে তো চলেইছে!
বিরাম নাই, বিশ্রাম নাই, রাতে চলল, দিনে চলল—আবার রাত, আবার দিন—এমনি করে বনের ফল খেয়ে পুকুরের জল খেয়ে, পাহাড়-প্রান্তর, নদ-নদী, বন-জঙ্গল পার হয়ে হয়ে রাজার ছেলে হাজির হল এক দৈত্যের দেশে।
সন্ধে হয়ে এসেছে। রাজার ছেলের পা যেন আর চলে না!
পথের মাঝে এক দৈত্যের সঙ্গে দেখা!
বাপরে বাপ। প্রকাণ্ড একটা গাছের মত চেহারা, লম্বা লম্বা হাত, লম্বা লম্বা পা, হাঁড়ির মত মাথা আর কুলোর মত কান। এক পাল ছাগল নিয়ে সে তখন বাড়ি ফিরছে। ছাগল তো নয়—এক একটা যেন বাছুর!
বললে, ‘কে হে তুমি?’
রাজপুত্র বললে, ‘আমি রাজার ছেলে।’
‘রাজার ছেলে তো এখানে কেন?’
‘চাকরি করব।’
‘চাকরি?’ বলে দৈত্যটা একবার হাসলো।
মুখও যেমন তার, দাঁতও তেমনি!—বেঁটে বেঁটে মুলোর মত। প্রকাণ্ড তার বাড়ি। তার একটা ঘর দেখিয়ে দিয়ে বললে, ‘রাত্রে এইখানে ঘুমোও। চাকরির ব্যবস্থা কাল সকালে হবে।
.
সকাল হল।
আবার সেই ছাগলের পাল নিয়ে দৈত্য বেরল তার বাড়ি থেকে। বেরবার আগে রাজপুত্রকে কাছে ডেকে বললো, ‘শোন!’
রাজপুত্র ভয়ে ভয়ে তার কাছে গিয়ে দাঁড়াল।
দৈত্য বললে, ‘দ্যাখ, আমার মত মনিব তুমি আর পাবে না। বুঝেছ?’
রাজপুত্র কী আর জবাব দেবে! চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।
‘বাঃ, চুপ করে রইলে যে?’
রাজপুত্র ঘাড় নেড়ে বললে, ‘আজ্ঞে হ্যাঁ, বুঝেছি।’
‘বেশ, তবে তুমি আজ এই ঘোড়ার আস্তাবলটা পরিষ্কার করে রেখ।
রাজপুত্র বললে, ‘আজ্ঞে হ্যাঁ, রাখব। ‘
এই কথা বলেই দৈত্য চলে যাচ্ছিল। আবার ফিরে দাঁড়াল। বললে, ‘আর একটি কথা তোমায় বলে যাই। যে-ঘরে তোমায় শুতে দিয়েছিলাম—ব্যস্, সেই ঘর ছাড়া আর কোনও ঘরে ঢুকবে না।’
রাজপুত্র বললে, ‘আজ্ঞে না, তা আমি ঢুকব না।’
কিন্তু যেই সে পিছন ফিরেছে, অমনি তার মনে হল—কেন ঢুকব না?
কী এমন জিনিস আছে? তাকে দেখতেই হবে।
রাজপুত্র ভাবলো, আস্তাবল পরিষ্কার করা—ভারি তো কাজ! কতক্ষণই বা লাগে! এখন দেখা যাক একটু ঘুরে-ফিরে কোথায় কী আছে!
এই বলে মনের আনন্দে শিস দিতে দিতে প্রথম ঘরটায় ঢুকে পড়ল।
দেখে, দেওয়ালের গায়ে শিকে ঝোলান প্রকাণ্ড একটা পাত্র। পাত্রের ভেতর বক্ বক্ করে কী যেন ফুটছে। অথচ নীচে তার না আছে আগুন না আছে কিছু! অবাক কাণ্ড!
‘জিনিসটা কী তাই দেখতে হবে।’—রাজপুত্র তার মাথার একগোছা চুল সেই পাত্রের ভেতর ডুবিয়ে দিলে। ডুবিয়ে আবার তুলে নিতেই দেখে, চুলের রং হয়ে গেছে তাঁবাটে!
ব্যস্, সে-ঘরে আর কিছু নেই। আবার আর একটা ঘর।
সে-ঘরেও ঠিক তাই! তেমনি শিকে ঝোলান একটা পাত্র, আগুন নেই, কিছু নেই, অথচ পাত্রের ভেতর কি যেন ফুটছে।
এবার আর একগোছা চুল তাতে ডুবিয়েই দেখে–বাঃ! চুল তার হয়ে গেছে ঠিক রুপোর মত সাদা।
এইবার তার পরের ঘরটা।
সেখানেও সেই একই কাণ্ড!
এবার কিন্তু চুলের গোছাটা হল ঠিক সোনালী রঙের।
রূপো হল, সোনা হল, তাঁরা হল, এবার কী হবে?
রাজপুত্র চার-নম্বর ঘরের দরজায় গিয়ে দাঁড়াল।
এবার কিন্তু দরজা খুলতেই চক্ষুঃস্থির! দেখে—পালঙ্কে হেলান দিয়ে এক পরমা সুন্দরী মেয়ে বসে আছে ঘরের ঠিক একটি পাশে। ঢেউ-খেলানো কালো একপিঠ চুল, গায়ের রং ঠিক যেন দুধে-আলতায় গোলা, টানাটানা দুটি চোখ, মুখখানি চমৎকার! এত চমৎকার যে, রাজপুত্রের মনে হল, এমন মেয়ে সে জীবনে কখনও দেখেনি। বোধহয় সে কোনও রাজার মেয়ে। তারই মত এখানে এসে বন্দিনী হয়েছে।
রাজপুত্রকে দেখেই তো মেয়েটি চমকে উঠল।
সর্বনাশ! আহা, এমন সুন্দর ছেলে! সে বললে, ‘হায় হায়, কে তোমায় এখানে আনলো বল ত? এ যে বড় ভীষণ জায়গা।’
রাজপুত্র বললে, ‘আমি নিজেই এসেছি।’
‘কেন এসেছ মরতে? এখন ভালয় ভালয় ঘরের ছেলে যাতে ঘরে ফিরে যেতে পার, তার চেষ্টা কর।’
রাজপুত্র বললে, ‘কিন্তু মনিব বড় ভাল। সামান্য কাজ দিয়েছে। বলেছে, শুধু আস্তাবলটা পরিষ্কার করে রেখ। ‘
রাজকন্যা হাসলো। বললে, ‘সামান্য কাজ না? আচ্ছা, কেমন করে পরিষ্কার করবে তুমি?’
‘যেমন করে সবাই করে। ঝাঁটা দিয়ে।’
রাজকন্যা ঘাড় নেড়ে বললে, ‘না। সারাদিনেও পারবে না তাহলে। একগুণ জঞ্জাল সরাবে— দশগুণ এসে ঘরে ঢুকবে। এখানকার মজাই তাই!’
রাজপুত্র ভাবনায় পড়ল—তাহলে উপায়?’
উপায় বলে দিই—শোন। ঝাঁটাটা উল্টো করে ধর। জঞ্জাল সব আপনা হতে সাফ হয়ে যাবে।’
রাজপুত্র হেসে তাকে তার ধন্যবাদ জানিয়ে চলে যাচ্ছিল।
রাজকন্যা বলল, ‘শোন!’
রাজপুত্র ফিরে দাঁড়াল।
রাজকন্যা তার মুখের পানে একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকে বললো, ‘বসো, তার ফিরতে এখনও অনেক দেরি। ততক্ষণ দুটো গল্প করি এসো।’
দুজনে পাশাপাশি বসল।
রাজপুত্র আর রাজকন্যা।
দুজনেই চমৎকার! এ বলে, আমায় দ্যাখ, ও বলে আমায় দ্যাখ! ঠিক যেন পটে আঁকা! গল্প তো হল ছাই—দুজনে দুজনের হাতে হাত দিয়ে মুখোমুখি চুপ করে বসে রইল। তারপর দূরে পাহাড়ের গায়ে সূর্য অস্ত গেল। গাছে গাছে পাখির কোলাহল শুরু হল। সন্ধে হতে আর দেরি নেই।
রাজকন্যা বললে, ‘এবার ওঠ তুমি।
যাবার ইচ্ছা ছিল না, তবু তাকে উঠতে হল।
দৈত্য ফিরে এল তার ছাগলের পাল নিয়ে।
ভেবেছিল, যে-কাজ সে রাজপুত্রকে দিয়ে গেছে, তা সে পারবে না করতে কিন্তু দেখলে যখন — আস্তাবলটি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, দেখেও যেন তার বিশ্বাস হল না। গম্ভীর হয়ে সে জিজ্ঞেস করলো, ‘তুমি আমার চাকরানিটার সঙ্গে দেখা করেছ নিশ্চয়!’
নিতান্ত বোকার মত ফ্যাল্ ফ্যাল্ করে তার মুখের পানে তাকিয়ে রাজপুত্র বললো, ‘সে আবার কি? কেমন সে? কোথায় থাকে সে চাকরানিটা? ‘
দৈত্যটা খানিকক্ষণ কি যেন ভাবলো। তারপর বললো, ‘আচ্ছা, কাল তোমার কাজ রইল—ওই যে ছোট পাহাড়টা দেখছ, ওইখানে আমার ঘোড়াটা রোজ চরতে যায়, সন্ধেবেলা তাকে নিয়ে এস তুমি।
ঘাড় নেড়ে রাজপুত্র বললে—‘আনব।’
পরের দিন সকালে দৈত্য যখন তার ছাগলের পাল নিয়ে বেরিয়ে যায়, তখন আর একবার রাজপুত্রকে সাবধান করে দিয়ে গেল—’কিন্তু খবরদার, যেন আমার আর অন্য কোনও ঘরে তুমি ঢুকো না! ঢুকেছ কি তোমায় খুন করেছি!’
.
রাজকন্যা হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করলে, ‘আজকের কাজটা কী শুনি?’
রাজপুত্র বললে, ‘আজকের কাজ খুব সোজা। ঘোড়াটাকে ধরে আনতে হবে পাহাড়ের কাছ থেকে।’
‘সোজা?’ বলে, রাজকন্যা তার সেই রাঙা রাঙা ঠোঁট দুটি টিপে টিপে হাসতে লাগলো। বললে, ‘সোজা মোটেই নয়।’
রাজপুত্র বললো, ‘কত বড় বড় ঘোড়ায় আমি চড়েছি। দুষ্টু ঘোড়াকে কেমন করে জব্দ করতে হয়, তা আমি জানি।’
রাজকন্যা বললো, ‘কিন্তু একে জব্দ করা সহজ নয়। গিয়ে দেখবে, ওর নাক থেকে আগুনের হলকা বেরোচ্ছে। সে যে কি ভীষণ ব্যাপার, তা তুমি ধারণা করতে পারবে না। কাছে তার যেতেই পারবে না, তো চড়বে কেমন করে?’
রাজপুত্র বললে, ‘তাহলে উপায়?’
‘উপায় বলছি শোন।—পাহাড়তলিটা দেখবে সবুজ ঘাসে ঘাসে ছেয়ে আছে। দূর্বা ঘাস চেনো ত?’
রাজপুত্র বললে, ‘চিনি।’
সেইখান থেকে একমুঠো দূর্বা ঘাস ছিঁড়ে নেবে। তারপর সেই ঘাসে তিনটি ফুঁ দিয়ে ছুঁড়ে দেবে ঘোড়াটার মুখে। ব্যস্—দেখবে, তৎক্ষণাৎ আগুনের হলকা বন্ধ হয়ে গেছে! তখন ধীরে ধীরে তুমি তাকে ধরতে গেলে সে ধরা দেবে।’
রাজপুত্র হাসতে লাগল। বললে, ‘ভারি মজা তো!’
রাজকন্যা সেদিনও তাকে তার কাছে এসে বসতে বললো। বললো, ‘চল আমরা পালাই এখান থেকে।’
রাজপুত্র রাজি। ‘চল, এক্ষুনি চলে যাই।’
রাজকন্যা বললে, ‘না। এত তাড়াতাড়ি নয়। জানতে পারলে আর রক্ষে থাকবে না। দুদিন সবুর কর।’
তারপর সারাদিন তারা মুখোমুখি বসে বসে গল্প করতে লাগল।
দিনটা যে কোন্দিক দিয়ে পার হয়ে গেল, তারা তা বুঝতেই পারলো না।
রাজপুত্রকে যে ঘোড়া আনতে হবে, সে কথা তার মনেই ছিল না। শেষে রাজকন্যাই তাকে মনে করিয়ে দিলো। বললে, ঠিক যেমনটি বলেছি, তেমনি কর যেন! একমুঠো দুর্বা ঘাস, তিনটি ফুঁ…ব্যস, আর কিছু না।’
রাজপুত্র ঘোড়া আনতে গেল।
.
এবার আর দৈত্যটা কিছুতেই বিশ্বাস করলো না। বললো, ‘কাল সকাল হোক।’
গুম হয়ে ভাবতে ভাবতে সে তার প্রকাণ্ড হল-ঘরে শুতে গেল। দেখে মনে হল, কাল
সে তাকে মেরে ফেলবে।
রাজপুত্রের চোখে ঘুম নেই। মরবার আগে রাজকন্যার সঙ্গে দেখা যে একবার না করলেই নয়!
কিন্তু এই রাত্রির মধ্যে দেখা করে কেমন করে? দৈত্যটা যদি টের পায়? যদি সে ঘুম ভেঙে জেগে ওঠে?
রাজপুত্র ভাবলো, সে তো মরবেই; কাল সকালে মরলেও মরবে, আজ রাত্রে মরলেও মরবে।
এমনি সব নানা কথা ভাবতে ভারতে সে তার ঘরের মধ্যে পায়চারি করছে, এমন সময় সে মেঘ ডাকার শব্দে হঠাৎ চমকে উঠে বাইরে আকাশের পানে তাকিয়ে দেখে—
দিব্যি ফুটফুটে জ্যোৎস্না! দূরে ছোট ছোট পাহাড় দেখা যাচ্ছে। পাহাড়ের নিচে সবুজ রঙের কচি কচি ঘাস-ঢাকা মাঠ। বহু দূরে সমুদ্রের জলের উপর জ্যোৎস্নার আলো এসে পড়েছে। আকাশে মেঘের কোনও চিহ্নই নাই।
শব্দটা আসছিল পাশের হল ঘর থেকে।
দৈত্যটার নাক-ডাকার শব্দ। মেঘ-ডাকার নয়।
রাজপুত্র দেখলো, এই তো সুযোগ! তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে সে রাজকন্যার দরজায় গিয়ে দাঁড়াল। দেখে, ভেতর থেকে খিল-বন্ধ।
দরজায় ধীরে ধীরে বারকতক টোকা মারতেই রাজকন্যা দরজা খুলে দিলে। ঘুমের ঘোরে চোখ দুটি ঢুলু ঢুলু, পরনের শাড়ি মাটিতে লুটোচ্ছে, পিঠে একপিঠ চুল এলান। চাঁদের আলোকে হার মানিয়ে রাজকন্যার রূপ যেন ঝলমল করছে। বললো, ‘এত রাত্রে যে?’ রাজপুত্রের মুখখানি শুকনো। বললে, ‘দৈত্যটা সন্দেহ করেছে। কাল যদি বেঁচে থাকি,
তো আবার দেখা হবে। নইলে এই আমাদের শেষ দেখা।
রাজকন্যা বললে, ‘দাঁড়াও।’
দাঁড়াও বলে সে চলে গেল। আধো-আলো আধো-অন্ধকার ঘরের দেওয়ালের গায়ে তাকের উপর কড়ির একটা ঝাঁপি খুলে কী যেন সে বার করে আনলো। দরজার কাছে আসতেই জ্যোৎস্নায় দেখা গেল, নীল রঙের খানিকটা সুতো।
বললো, ‘দেখি, তোমার বাঁ-হাতটা দেখি।
রাজপুত্র বাঁ-হাত বাড়িয়ে দিলো।
রাজকন্যা তার বাঁ-হাতের কড়ে আঙুলে সুতোটা বেশ ভাল করে বেঁধে দিয়ে বললে, যাও, এবার ঘুমোও গে।’
‘এ সুতোয় কী হয়?’
রাজকন্যা বললে, ‘বলব না। বললে ওর গুণ চলে যাবে।’
রাজপুত্র আবার তার ঘরের দিকে ফিরে আসছিল, হলঘরের দরজাটা সে ভয়ে ভয়ে যেই পেরোতে যাবে, অমনি তার ঘাড়ের ওপর ক্যাক্ করে কে যেন চেপে ধরতেই, অতি কষ্টে ঘাড় ফিরিয়ে দেখে, সেই দৈত্যটা।
কখন যে সে জেগে উঠেছে, তা সে টেরও পায়নি।
রাজকন্যাকে জানাবার জন্যই বোধ করি সে প্রাণপণে চিৎকার করে উঠল।
কিন্তু বৃথা চিৎকার! দৈত্য তাকে তেমনি হাতে করে তুলে নিয়েই দে ছুট! লম্বা লম্বা পা ফেলে সে পাহাড়ের দিকে এগোতে লাগল।
পশ্চিমদিকে পাহাড়গুলো যেখানে শেষ হয়েছে, সেইখানে ছোট একটা পাহাড়ের ওপর উঠে রাজপুত্রকে সে তুলে ধরলো।
রাজপুত্র বহু অনুনয়-বিনয় করতে লাগলো। বললে, ‘আমায় বাঁচাও।’
দুটো পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে দেখা গেল বহু নিম্নে হু হু শব্দে জলের ধারা ছুটে চলেছে।
নিষ্ঠুর দৈত্য তাকে পাহাড়ের ওপর থেকে ঝুপ্ করে সেইখানে দিলে ফেলে।
ভীষণ একটা আর্তনাদ শোনা গেল। তারপরেই আবার সেই জলের শব্দ।
.
রাজপুত্র মরেনি। মরলে তো এইখানেই আমাদের গল্প শেষ হয়ে যেত।
কেন যে সে মরেনি, তা সে নিজেও জানে না। পাহাড়ের ওপর থেকে গিয়ে পড়ল—জলের ওপর। বরফের মত ঠাণ্ডা জল। হু হু করে তাকে স্রোতের মুখে টেনে নিয়ে চলল। আকাশে জ্যোৎস্না, কিন্তু সে জ্যোৎস্নার আলো মাথার ওপর, পাহাড়ের গায়ে। গাছে, পাতায়, কোথায় যেন আটকে যাচ্ছে! অন্ধকারে জলের খরস্রোত বয়ে চলেছে! আর সেই জলের ওপর রাজপুত্র একাকী।
হঠাৎ কিসে যেন আটকে গিয়ে রাজপুত্রের মনে হল, সে যেন কিনারে এসে লেগেছে। অন্ধকারে হাতড়ে দেখে, কিনারা নয়, মাথার ওপর খাড়া সোজা পর্বত উঠে গেছে। সে-পর্বতের গা বেয়ে ওপরে ওঠা বড় সহজ কথা নয়! বাঁকের মুখে পাহাড়ের খানিকটা ধ্বস্ ছেড়ে পড়েছে। সেইখানে সে আটকে পড়েছিল মাত্র। কিন্তু সেখানেও তার বেশিক্ষণ থাকা নিরাপদ নয়। স্রোতের জল ধ্বসের মুখে আটক খেয়ে ক্রমাগত আবর্ত রচনা করছে। ঘূর্ণাবর্তের মুখে পড়ে নিঃসংশয়ে প্রাণ হারানোর চেয়ে স্রোতের মাঝখান দিয়ে ভেসে যাওয়া ঢের ভাল। রাজপুত্র তাই ইচ্ছা করেই কিনার ছেড়ে দিয়ে সাঁতার কেটে মাঝখানে চলে গেল।
এমনি করে কতক্ষণ সে যে পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে ঘুরে মরেছে, কে জানে? হঠাৎ মনে হল, সে ফাকা জায়গায় এসে পড়েছে। চারিদিকে তাকিয়ে দেখে, সত্যিই তাই। শুধু জল আর জল। মাথার ওপর আকাশ আর জ্যোৎস্না। পশ্চাতে পর্বত-শ্রেণী!
সুমুখে জলের ওপর কিছুদূরে মনে হল যেন জ্যোৎস্নার আলোয় রঙিন পাল তুলে দিয়ে ছোট্ট একটি নৌকো ভেসে চলেছে। সেখানে সে আশ্রয় পাবে ভেবে সেইদিকে সাঁতার কেটে এগোতে লাগল। জলের স্রোত হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেছে। বড় বড় ঢেউয়ের দোলায় দুলতে দুলতে শ্রান্ত অবশ দেহে যেমনি সে নৌকোর কাছে এসেছে, অমনি নৌকো থেকে হাত বাড়িয়ে কে যেন ডাকলো, ‘এসো।’
পরিচিত কণ্ঠস্বর।
চোখ চেয়ে ভাল করে সে তখন দেখতেও পাচ্ছিল না। তবু প্রাণপণে সে একবার দেখবার চেষ্টা করল। দেখলে সে আর কেউ নয়, দৈত্যপুরীর সেই রাজকন্যা নৌকো নিয়ে সমুদ্রের মাঝে তারই জন্যে অপেক্ষা করছে!
রাজপুত্র অবাক! এ কি স্বপ্ন নাকি!—
মুখ দিয়ে তার কথা ফোটে না, চোখে সে ভাল দেখতে পায় না! তার হাত অবশ, সমস্ত দেহ তখন তার মৃত্যুর পূর্ব-মুহূর্তে ঠিক যেমনটি হয়, তেমনি আড়ষ্ট শীতল হয়ে উঠেছে।
রাজকন্যা তাকে নৌকোয় তুলে নিলে। মড়ার মত রাজপুত্র তার কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে পড়ল। শীতে তখন সে ঠক্ ঠক্ করে কাঁপছে।
রাজকন্যা যাদু জানে। দৈত্যটার কাছ থেকে অনেক কিছু সে শিখেছে।
হাতে ফুঁ দিতেই তার হাতের ওপর বিনা আগুনে আগুন জ্বলে উঠল। তারপর সেই গরম হাত রাজপুত্রের গায়ের ওপর ক্রমাগত বুলোতে বুলোতে সে চাঙ্গা হয়ে উঠে বসলো। হাসতে হাসতে বললে, ‘আমি বেঁচে উঠেছি, সেকথা এখনও আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।’
রাজকন্যা বললে, তুমি যে মরবে না, তা আমি জানতাম।’
কেমন করে জানতে?
রাজকন্যা বললে, ‘কই, দেখি তোমার বাঁ-হাতটা! ‘
দেখলে, কড়ি-আঙুলে সেই সুতো এখনও বাঁধা রয়েছে।
বললে, ‘যতক্ষণ এই সুতো কারও হাতে বাঁধা থাকবে, ততক্ষণ সে মরবে না।’ রাজপুত্র ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করলে, ‘আর সেই দৈত্যটা? তার কাছে কি আবার তুমি ফিরে যাবে?’
রাজকন্যা হেসে বললে, ‘দেখতে চাও?’
‘কী?’
‘এইদিকে সরে এসো। বলে আঙুল বাড়িয়ে সুমুখে রাজকন্যা যা দেখালে, তা দেখে তো রাজপুত্র অবাক! রাজপুত্র দেখলে, পর্বত-শ্রেণির ওপারে দৈত্যের সেই প্রকাণ্ড বাড়ির চারিদিকে ধু-ধু করে আগুন জ্বলছে, আর ধোঁয়ার চারিদিক এমনি আচ্ছন্ন হয়ে গেছে যে, জ্যোৎস্নার অমন সুন্দর আলোও সেখানে মনে হচ্ছে যেন ঘোলাটে!’
রাজপুত্র বললে, ‘সে কী! দৈত্যটা কোথায়?
সে পুড়ছে ওই ঘরের মধ্যে।
দৈত্যটাকে ঘরের মধ্যে পুরে আগুন সে কেমন করে লাগিয়েছে, রাজপুত্রের সেকথা জানবার কৌতূহল হল। বললে, ‘এ-ও কি সম্ভব?’
রাজকন্যা বললে, ‘ওরই শেখান বিদ্যে দিয়ে আজ ওরই সর্বনাশ করে এলাম। বিনা-আগুনে আগুন জ্বালাতে, বিনা মেঘে বৃষ্টি নামাতে—ওই আমাকে শিখিয়েছিল। তোমায় খাঁড়ির নীচে ফেলে দিয়ে পরমানন্দে হাসতে হাসতে সে আবার তার ঘরে ফিরে গিয়ে শুলো! উপযুক্ত সুযোগ ভেবে আমিও তখন উঠে দাঁড়ালাম। ওর ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ করে দিয়ে—জ্বালালাম আগুন। তারপর ঘরের চারিদিকে বেশ ভাল করে আগুন ধরিয়ে দিয়ে চলে এলাম এখানে।’
রাজপুত্র জিজ্ঞাসা করলে, ‘ও আগুন সে নেবাতে পারবে না?’
রাজকন্যা বললে, ‘না। যে জ্বালে একমাত্র সে ছাড়া ও-আগুন কেউ আর নিবোতে পারে না। সমস্ত বাড়ি-ঘর-দোর ভস্ম করে ফেলে ও-আগুন আপনিই নিবে যাবে!
রাজপুত্র বললে, তাহলে এখন আমরা কোথায় চলেছি? এ নৌকো কার? এই দিয়ে কি সমুদ্র পেরোনো চলবে?’
রাজকন্যা বললে, ‘এ নৌকো সেই দৈত্যের। মাঝে মাঝে এই নৌকোয় চড়ে আমিই বেড়াতাম। যতই জল হোক, এ ডুববে না। কোথায় চলেছি জিজ্ঞাসা করছ? কিন্তু সেকথা তো আমিই জানি না।’
রাজপুত্র বললে, ‘চল—আমাদের রাজত্বে চল। সেখানে গিয়ে আমরা সুখে থাকব।
‘কোথায় তোমাদের রাজত্ব, তাও ত জানিনে। চল—ওপারে যাওয়া যাক, তারপর যা হয় হবে।’
একদিন যায়—দুদিন যায়—
তিন দিনের দিন ওপারের কিনারে গিয়ে নৌকো দাঁড়াল। ক্ষুধায় তৃষ্ণায় দুজনেই তখন অত্যন্ত কাতর হয়ে পড়েছে। নৌকো থেকে নেমে তারা পথ চলতে লাগল।
সামনে প্রকাণ্ড বন। সেই বনের ভিতর দিয়ে চলে, আর গাছের ফল খেয়ে তাদের দিন কাটে। চলতে-চলতে-চলতে, একদিন তারা দেখলে—বন শেষ হয়ে গেছে। সামনে প্রকাণ্ড প্রান্তর, আর সেই প্রান্তরের ওপারে মস্ত বড় বড় দালানবাড়ি দেখা যায়।
বোধহয় কোনও রাজার বাড়ি। লোকজন নেই যে, তাকে জিজ্ঞাসা করে।
রাজপুত্র বললো, ‘চল, ওই রাজার বাড়িতে আশ্রয় নিই; তারপর দয়া করে তিনিই আমাদের দেশে পাঠিয়ে দেবেন।’
কিন্তু রাজার বাড়িতে রাজকন্যার হেঁটে যাওয়া চলে না।
রাজপুত্র বললে, ‘পারবে তুমি এইখানে অপেক্ষা করতে? আমি তাহলে গ্রাম থেকে একটা পালকি নিয়ে আসি।’
রাজকন্যা হেসে বললে, দৈত্যের পুরীতে একলা ছিলাম, আর এখানে থাকতে পারব না? খুব পারব, তুমি যাও; কিন্তু দেখ, কোনও মেয়েমানুষের মুখের পানে তুমি তাকিও না, তাকালেই আমায় ভুলে যাবে।’
‘পাগল! তাই কি কখনও ভুলতে পারি? দুজনে এত কষ্ট সহ্য করলাম। তুমি আমায় এমন করে বাঁচালে! শেষে তোমাকেই ভুলে যাব?’
.
রাজপুত্র গেল পালকির সন্ধানে। আর রাজকন্যা রইল বনের ধারে।
গ্রামের কাছাকাছি পৌঁছতেই রাজপুত্র দেখলে, তার চোখের সুমুখে হাতি-ঘোড়া, লোক-লস্কর নিয়ে কোথাকার কোন রাজার এক মন্ত্রী চলেছেন!
কোথায় চলেছেন, কী বৃত্তান্ত জানবার জন্যে রাজপুত্র দাঁড়াল পথের ধারে।
কী?–ব্যাপার কী?
কে একজন বললে, ‘অমুক দেশের রাজপুত্রের সঙ্গে অমুক দেশের রাজকন্যের বিয়ের সব ঠিকঠাক। বর আসছে! বর আসছে! কোথায় বর! কোথায় বর—এমন সময় সংবাদ এল কিনা—সাপের কামড়ে বর হঠাৎ মারা পড়েছে। রাজকন্যার বিয়ে আর হয় না! আজকের লগ্ন পেরিয়ে গেলে বিয়ে আর কোনওদিন হবেও না। তাই সেই রাজ্যের মন্ত্রী বেরিয়েছেন—বরের সন্ধানে?’
খবরটা শুনেই আমাদের এই রাজপুত্র চলে যাচ্ছিল – হঠাৎ নজর পড়ল মন্ত্রীর।
‘ছেলেটি কে হে?’ কেউ আর কিছু বলতে পারে না।
মন্ত্রী হুকুম দিলেন—’যে-ই হোক, চল—ওকেই নিয়ে চল!
যেই হুকুম দেওয়া, আর অমনি সব লোক-লস্কর, হাতি-ঘোড়া চারিদিক থেকে রাজপুত্রকে ঘিরে ফেলল।
কোনও কথাই কেউ তার শুনল না, সব অনুনয় তার ব্যর্থ হল।
রাজপুত্রকে ধরাধরি করে নিয়ে গিয়ে সবাই মিলে তাকে বরের পিঁড়িতে বসিয়ে দিলো।
চারিদিক থেকে রব উঠল— সাবাস মন্ত্রী! সাবাস মন্ত্রী! চমৎকার বর! চমৎকার ছেলেটি।’
তাদের সেই কোলাহল ও চিৎকারে রাজপুত্রের কোনও কথাই তারা শুনতে পেল না, শুনতে চাইলও না!
সভাস্থলে রাজকন্যাকে আনা হল – অসামান্য রূপসী রাজকন্যা!
রাজপুত্র যেই তার মুখের পানে তাকিয়েছে—ব্যস্, পূর্বস্মৃতি সব গেল ভুলে। সে যে এমনি আর একজনকে বনের ধারে বসিয়ে রেখে পালকির খোঁজে বেরিয়েছে, সেকথা তার মনেই রইল না।
পুরোহিত মন্ত্রোচ্চারণ করলেন। মহা ধুমধামে রাজকন্যার বিয়ে চুকে গেল।
বিয়ে চুকল, ওদিকে যে আর-এক রাজকন্যা বসে রইল বনের ধারে-রাজপুত্র সেকথা ভুলেই গেল।
.
রাজকন্যা বসেই থাকে। বসে থাকে আর ভাবে—সে এখনও এল না কেন? তবে কি কোনও মেয়েমানুষের মুখ দেখেছে সে?
যাই হোক, এর উপায় একটা-কিছু করতেই হবে। কি আর করে?
মনের দুঃখে রাজকন্যা একাকিনী পথে-প্রান্তরে ঘুরে বেড়াতে লাগল। অবশেষে ঘুরতে ঘুরতে সে এক নদীর তীরে এসে উপস্থিত।
পিপাসায় তখন তার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে! রাজকন্যা নদীর তীর থেকে হাত বাড়িয়ে একটুখানি জল খেতে যাবে, এমনি সময় দেখে—চমৎকার এক যুবা-পুরুষের মৃতদেহ ভাসতে ভাসতে কিনারে এসে লেগেছে।
জল খাওয়া তার হল না। মৃতদেহটিকে জল থেকে টেনে সে ওপরে তুললো। সাজ-পোশাক দেখে মনে হল—কোন রাজার ছেলে। শিরে উষ্ণীষ, সর্বাঙ্গে বহু মূল্যবান পরিচ্ছদ, সম্ভব—জলে বেশিক্ষণ ছিলও না, কারণ দেহের বিকৃতি তখনও পর্যন্ত বিশেষ কিছু ঘটেনি।
চেহারা দেখে মনে হল—অপমৃত্যুতে মরেছে। তৎক্ষণাৎ চারিদিকে আগুনের বেড়া তৈরি করে রাজকন্যা তার চিকিৎসা আরম্ভ করে দিলে।
দৈত্যের কাছে যে-সব মন্ত্র-তন্ত্র সে শিখেছিল, তারই প্রয়োগ শুরু হল।
সারাটা দিন ধরে রাজকন্যার পরিশ্রমের আর অন্ত রইল না। বহু পরিশ্রমের পর শেষে সন্ধ্যার আগে দেখলে, মৃতদেহের শরীরে প্রাণ সঞ্চার হয়েছে, ধীরে-ধীরে নিশ্বাস-প্রশ্বাস বইছে।
রাত্রি যখন দ্বিপ্রহর, মৃতদেহ তখন উঠে বসল।
রাজকন্যার খুশি যেন আর ধরে না!
.
যুবকটি তখনও পর্যন্ত কিছুই বুঝতে পারেনি। চারিদিক ঘিরে অগ্নিশিখা হু হু করে জ্বলছে, আর তার মাঝখানে সে নিজে, সম্মুখে অপরূপ রূপ লাবণ্যবতী যুবতী এক নারী-প্রতিমা!
কোথায় এসেছে সে, কেন এসেছে, কী হচ্ছে এখানে—কিছুই বুঝতে না পেরে রাজকন্যার মুখের পানে যুবক ফ্যাল্ ফ্যাল্ করে তাকিয়ে রইল।
রাজকন্যা বলল, ‘তোমার ভয় নেই। তুমি কে বল দেখি? কার ছেলে? কোথায় বাড়ি?’
যুবকের মুখ দিয়ে কথা যেন সহজে বেরোতে চায় না। অত্যন্ত ধীরে ধীরে বললে — ‘আমি জয়নগরের রাজার ছেলে। আমার নাম—কুমারদেব।’
রাজকন্যা জিজ্ঞাসা করলে, ‘আর কিছু তোমার মনে পড়ে রাজকুমার?’
চোখ বুজে খানিকক্ষণ ভেবে কুমারদেব বললে, ‘আমি বিয়ে করতে যাচ্ছিলাম মিহিরপুরের রাজকন্যাকে। সেখানকার কোটালপুত্র আমায় নিতে এসেছিল। বরযাত্রী আসছিল পিছনে। আমি আর মিহিরপুরের কোটালপুত্র দুজনে একটি হাতির পিঠে চড়ে আগে আগে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ সেই কোটালপুত্র কোত্থেকে একটা প্রকাণ্ড গোখরা সাপ বের করে আমার গায়ে দিলে ছেড়ে। আঁতকে উঠে আমি চিৎকার করতে সাপটা আমায় কামড়ালে। তারপর কি হল আমার কিছু মনে নেই।’
রাজকন্যা বললে, ‘তাহলে এখন তুমি কি করতে চাও?’
কুমারদেব বললে, ‘শাস্তি দিতে চাই ওই রাজাকে আর ওই কোটালপুত্রকে।’
‘কেমন করে দেবে শাস্তি?’
কুমারদেব বললে, ‘আগে বাড়ি যাই। মা-বাবাকে দেখতে বড় ইচ্ছে করছে। তাঁদের সব কথা বলিগে আগে।’
রাজকন্যা বললে, ‘নিশ্চয়! আগে বাড়ি যাও।’
কুমারদেব বললে, ‘কিন্তু আমার একটি প্রার্থনা আছে আপনার কাছে।’
রাজকন্যা জিজ্ঞাসা করলে, ‘কি প্রার্থনা?’
‘আপনাকে যেতে হবে আমার সঙ্গে। আমার মা-বাবা বড় খুশি হবেন।’
রাজকন্যা বললে, ‘যাব।’
একটা কথা কুমারদেব তাকে অনেকক্ষণ থেকে জিজ্ঞাসা করতে পারছিল না। এতক্ষণ পরে জিজ্ঞাসা করলে, ‘আপনি কে, কোত্থেকে এসেছেন—কিছুই তো জানতে পারলাম না। দয়া করে আমায় বলবেন কি?’
রাজকন্যা বললে, ‘আমি কে, কোত্থেকে এসেছি–সেকথা কাউকে বলব না। তবে একটি লোক আমার হারিয়ে গেছে, ফিরে আসব বলে আর ফিরে এল না, আমি তারই খোঁজে ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছি।’
কুমারদেব বললে, ‘সেজন্যে ভাববেন না আপনি! আমি প্রতিজ্ঞা করছি—যেমন করে হোক, যেখান থেকে হোক, আপনার সে-লোকের সন্ধান আমি করে দেবই। ‘
রাজকন্যা খুশি হল।
.
পরদিন সকাল হতে না হতেই রাজকন্যাকে সঙ্গে নিয়ে কুমারদেব রওনা হল জয়নগরের দিকে।
কুমারদেব বললে, ‘পায়ে হাঁটিয়ে আপনাকে নিয়ে যাচ্ছি আমি, কী আর করব বলুন, কিছু মনে করবেন না।
রাজকন্যা মৃদু হেসে বললে, কাজ নেই আমার গাড়ি-পালকিতে। আর একজন এমনি পালকি আনতে গিয়েই উধাও হয়েছে।’
এই বলে কথা কইতে কইতে তারা পথ চলতে লাগল।
একে শুধিয়ে ওকে শুধিয়ে, এ-পথ ভেঙে সে-পথ ধরে কত গ্রাম, কত শহর পার হয়ে হয়ে—শেষে তারা জয়নগরে গিয়ে হাজির হল।
মরা মানুষ বেঁচে ফিরে এসেছে। অবাক কাণ্ড!
মা-বাপ, ভাইবোনের আনন্দ যেন আর ধরে না! কুমারদেবকে নিয়ে কী যে করবে তারা, খুঁজেই পায় না!
রাজবাড়িতে উৎসব শুরু হল। গাড়ি গাড়ি ফুল এল, ফুলের মালা এল। রাজবাড়ি সাজান হল। রাজা খুলে দিলেন—দানছত্র। দীন-দুঃখী রাজ্যের মধ্যে যে যেখানে আছে—ডাক ডাক—সবাইকে ডাক। যার যা খুশি, সে তাই নিয়ে যাক।
রাজ্যের চারিদিকে আনন্দের কোলাহল পড়ে গেল! দলে দলে লোক আসতে লাগল-রাজকন্যাকে দেখবার জন্যে—সে আবার এমন রাজকন্যা যে, মরা মানুষকে বাঁচাতে পারে।
রাজবাড়ির যত মেয়ে—দাস-দাসী রাজকন্যার সেবা-শুশ্রূষা করতে লাগল। রানি-মা তো তাকে চব্বিশ ঘণ্টা বুকে করে রাখেন। কিছুতেই আর ছাড়তে চান না! বলেন, ‘তুমি আমার ছেলে ফিরিয়ে দিয়েছ মা, তোমার জন্যে কী আমি করতে পারি, বল!’
রাজকন্যার সেই এক কথা!— আমার হারানো লোকটিকে আমি ফিরে পেতে চাই মা, আমায় ছেড়ে দাও, আমি তাকে খুঁজব।’ রাজা বলেন, রানী-মা বলেন, ‘পাগলি মেয়ে বলে কি! আমার এত লোক, এত লস্কর, এত হাতি, এত ঘোড়া, কালই আমি দিকে দিকে লোক পাঠাচ্ছি। তারা থাকতে তোমায় আমরা ছেড়ে দেব কেন মা?’
কিন্তু মিহিরপুরের কোটালপুত্র-কুমারদেবের গায়ে সাপ ছেড়ে দিয়ে তাকে যে হত্যা করেছিল, তার শাস্তির বিধান না করলেই নয়।
জয়নগরের রাজা বললেন, ‘চল, আমরা মিহিরপুর আক্রমণ করি। রাজা-রানিকে বন্দী করে রাজ্যকে রাজ্য, চল – ধ্বংস করে দিয়ে আসি!’
রাজকন্যা বললে, ‘না। একের পাপে এত লোক মরবে কেন? শাস্তির ব্যবস্থা আমি করব।’
রাজা বললেন, ‘কেমন করে করবে মা?’
রাজকন্যা একটুখানি ভেবে বললে, ‘কুমারদেবকে আমার সঙ্গে দিন, ইচ্ছে করলে আপনিও সঙ্গে যেতে পারেন। বড় একটা তাঁবু, দু-তিনদিনের মত খাবার, জন-দশ বারো লোক, কয়েকটা বাজনা, কিছু অস্ত্র, ব্যস্, আর কিছু না। এই নিয়ে—চলুন, আমরা মিহিরপুরে যাই।’
রাজা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এতেই হবে?’
রাজকন্যা বললে, ‘হ্যাঁ এতেই হবে।’
.
মিহিরপুরের বাইরে রাজার প্রকাণ্ড তাঁবু খাটানো হল।
রাজকন্যার আদেশ মত, যা যা দরকার সবই তাঁদের সঙ্গে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।
রাজা বললেন, ‘এবারে কি করবে, কর মা! সবই তো প্রস্তুত।’
রাজকন্যা রাজাকে প্রণাম করে তাঁর পায়ের ধুলো মাথায় নিয়ে বললে, ‘যা করব, তা দেখে আপনি ভয় পাবেন না যেন! আপনারা তাঁবুর ভেতরে বসে বসে মজা দেখুন।
বলে রাজকন্যা তাঁবুর বাইরে এসে চুপটি করে আকাশের পানে তাকিয়ে জোড় করে কী যেন বলতেই, রাজকন্যাকে ঘিরে চারিদিক থেকে হু হু করে আগুন জ্বলে উঠল।
সেই আগুনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে রাজকন্যা বললে, ‘বাজাও।’
রাজা হুকুম দিলেন। তাঁবুর ভেতর থেকে বাজনা বাজতে শুরু হল। যুদ্ধের ‘বিউ’ তখন আমাদের দেশে ছিল না। ছিল—রামশিঙে। তার যে কি ভীষণ আওয়াজ, তা তোমরা না শুনলে কল্পনা করতে পারবে না। গ্রাম, প্রান্তর, শহর কাঁপিয়ে দুরদুর করে শিঙে বেজে উঠল।
তাঁবুর ভেতর কাড়া-নাকাড়া বাজতে লাগল। গ্রাম থেকে, শহর থেকে দলে দলে লোক ছুটে এল।
মিহিরপুরের রাজা পাঠালেন দূত। ‘দেখে এসো তো ব্যাপার কি!’
দূত এসে দেখে—অদ্ভুত ব্যাপার! এমনটি কখনও সে দেখেনি, কখনও শোনেনি—কাঠ নেই, কয়লা নেই, মাটি ফুঁড়ে আগুন উঠছে ধু ধু করে, আর তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে… ধ্যানমগ্না অপরূপ সুন্দরী এক দেবীমূর্তি।
‘কে মা তুমি–কে?’
যে-ই আসে, মুখ দিয়ে তার আর কথা ফোটে না, নির্বাক বিস্ময়ে শুধু হাঁ করে চেয়ে থাকে, আর ভূলুণ্ঠিত হয়ে প্রণাম করে।
.
তারপরেই শুরু হল–ঝম্ ঝম্ করে বৃষ্টি।
কিন্তু আশ্চর্য! বৃষ্টি শুধু মিহিরপুরেই! এমন কি, জয়নগরের রাজার তাঁবুতে বৃষ্টি নেই।
বৃষ্টি প্রথম যখন আরম্ভ হল, লোকে ভেবেছিল, এখনই হয়ত বন্ধ হবে; কিন্তু বন্ধ হওয়া দূরে থাক, বৃষ্টি যেন বেড়েই চলল।
এক দণ্ডের জন্য বিরাম নাই—শুধু জল আর জল!
গরীব-দুঃখীর বাড়ি-ঘর ভেসে যাবার উপক্রম হল। দুপদাপ করে প্রাচীর পড়তে লাগল। গরু-বাছুর, ছাগল-ভেড়া—সব রইল ঘরে-ঘরে বাঁধা।
বৃষ্টি আর কিছুতেই বন্ধ হয় না। একদিন — দুদিন — তিনদিন!
তিনটি দিনেই মিহিরপুর ডুবুডুবু।
উনোনে কাঠ জ্বলে না, কয়লা জ্বলে না, উপোস করে মানুষ আর কতদিন থাকে! সবাই বলে, ‘এ ওই রাজকন্যার কাণ্ড! ‘
কেউ বলে, ‘দেবী।’ কেউ বলে, ‘ডাইনি।’
যাইহোক, দেবী হোক আর দানবী হোক, রাজা বলেন, ‘চল, যাই তারই কাছে। দেখি গিয়ে হাতে-পায়ে ধরে—বৃষ্টি যদি বন্ধ হয়।
রাজকন্যার কাছে রাজা গেলেন স্বয়ং।
দেখলেন, আশ্চর্য ব্যাপার! চারিদিকে আগুন জ্বলছে, বৃষ্টি সেখানে একেবারেই নেই!
এমন অসম্ভব ব্যাপার দেখেই তিনি হাতজোড় করে কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। বললেন, ‘আমাদের কি অপরাধ হয়েছে মা? ক্ষমা কর, নইলে গেলাম।
রাজকন্যা বললে, ‘ডাক তোমার কোটালপুত্রকে। তাকে আমার চাই।’
কোটালপুত্র! কিন্তু কোটালপুত্র যে মিহিরপুরে নেই! রাজার জামাইকে নিয়ে সে মৃগয়ায় গেছে।
রাজকন্যা বললে, ‘যেখানেই যাক, তাকে ধরে নিয়ে এসো। সে না এলে বৃষ্টি বন্ধ হবে না।’
কোটালপুত্রের সন্ধানে তৎক্ষণাৎ লোক ছুটল চারিদিকে। বনে-বনে, জঙ্গলে-জঙ্গলে সন্ধান করে করে দুদিন পরে কোটালপুত্রের সন্ধান মিলল।
.
রাজা নিজে কোটালপুত্রকে সঙ্গে করে নিয়ে এলেন রাজকন্যার কাছে।
রাজাকে কাছে ডেকে রাজকন্যা বললে, ‘আপনি একা এলে চলবে না। রানি-মাকে ডাকুন, আর ডাকুন আপনার যে মেয়েটির বিয়ে হবার কথা ছিল জয়নগরের রাজপুত্রের সঙ্গে—তাকে।’
তাই হল।
পালকি চড়ে রানি-মা এলেন। রাজকন্যাও এল।
সকলকে বসতে বলে রাজকন্যা কোটালপুত্রকে প্রশ্ন করলে,- ‘জীবনে কী কী পাপ করেছ তুমি, বল।’
কোটালপুত্র বললে, ‘পাপ কিছু করেছি বলে তো মনে হয় না
‘কোথায় ছিলে এতদিন?’
‘মৃগয়ায় গিয়েছিলাম।’
‘কে কে গিয়েছিলে?’
‘আমি আর মহারাজের নতুন জামাই।’
‘সে জামাই কোথায়?’
কোটালপুত্র এদিক-ওদিক তাকিয়ে বার-কতক ঢোক গিলে বললে, ‘তাঁকে বাঘে খেয়েছে।’
বাঘে খেয়েছে। রাজা ও রানি দুজনেই চমকে চিৎকার করে উঠলেন, ‘সে কি কথা! কই, এতক্ষণ তো বলনি?’ বলে হায় হায় করে তাঁরা মাথায় হাত দিয়ে কাঁদতে লাগলেন।
রাজকন্যা হাত তুলে বলল, ‘চুপ করুন।’ বলেই একমুঠো ধুলো সে কোটালপুত্রের গায়ে ছুঁড়ে দিলে।
যেই ধুলো ছুঁড়ে দেওয়া, আর অমনি কোটালপুত্রের চারিদিকে হু হু করে আগুন জ্বলে উঠল।
সেই আগুনের ভেতর থেকে কোটালপুত্র চিৎকার করে বলতে লাগল, ‘আমায় বাঁচাও! আমায় বাঁচাও। আমি বলছি। আমি বলছি।’
রাজকন্যা বললে, ‘বল।’
কোটালপুত্র বললে, আমার কোনও দোষ নেই। যত দোষ ওই—’ বলে সে আগুনের ভেতর থেকে আঙুল বাড়িয়ে মিহিরপুরের রাজকন্যাকে দেখিয়ে দিয়ে বললে, ‘ওর!’
সে তখন তার মায়ের পাশে বসে থর্ থর্ করে কাঁপছে!
কোটালপুত্র বললে, ‘ওর ইচ্ছে—আমার সঙ্গে ওর বিয়ে হয়। কিন্তু আমি কোটালপুত্ৰ। আমার সঙ্গে বিয়ে মহারাজ দেবেন কেন? তাই জয়নগরের রাজার ছেলের সঙ্গে ওর বিয়ের পাকাপাকি ঠিকঠাক যখন হয়ে গেল, বিয়ের দিন আমিই তখন কৌশল করে বর আনতে গেলাম।
‘আমি সাপ ধরতে জানি। লুকিয়ে নিয়ে গেলাম একটা গোখরো সাপ। আসবার পথে সাপটা দিলাম সেই রাজপুত্রের গায়ের উপর ছেড়ে। সাপের কামড়ে সে মরে গেল।’ বলে কোটালপুত্র একটুখানি থেমে একটা ঢোক গিলে ভয়ে ভয়ে এদিক-ওদিক তাকাতে লাগল।
রাজকন্যা বললে, ‘ভয় নেই তোমার। সে-রাজপুত্র তোমার সাপের কামড়ে মরেনি। __ আমি বাঁচিয়েছি। দেখবে?’ বলে তাবুর ভেতর থেকে কুমারদেবকে সঙ্গে করে এনে বললে, ‘চিনতে পার?’
কোটালপুত্র মাথা হেঁট করে দাঁড়িয়ে রইল।
রাজকন্যা বললে, ‘লজ্জা কী! তারপর বল, তুমি কি করেছ?’
কোটালপুত্র ধীরে ধীরে বললে, ‘ভেবেছিলাম, রাজকন্যার বিয়ে আর হবে না। কিন্তু মন্ত্রীমশাই কোত্থেকে আবার একটি বর ধরে এনে দিলেন বিয়ে। রাজকন্যার সঙ্গে পরামর্শ করে এবার আমি জামাইকে নিয়ে মৃগয়ায় বেরিয়েছিলাম।’
.
কোটালপুত্রের মুখ দিয়ে কথা আর বেরচ্ছিল না।
রাজকন্যা বললে, ‘বলো। তারপর—’
কোটালপুত্র বললে, তাকে আমি শ্যামপুরের জঙ্গলে মস্ত বড় একটা মহুয়া গাছের গায়ে বেঁধে রেখে এসেছি। বাঘে খায়নি।’
মিহিরপুরের রানি বলে উঠলেন, ‘মরেনি তো? ওগো তাহলে – ‘
রাজা তাঁকে আর কথা বলতে দিলেন না। চিৎকার করে বলতে লাগলেন, ‘মেরে ফেল ওই কোটালপুত্রকে, আগুনে পুড়িয়ে মেরে ফেলো মা তুমি! শয়তান!’
রাজকন্যা বললো, ‘না।’
বলে তার চারিদিক থেকে আগুন নিবিয়ে ফেলে কোটালপুত্রকে কাছে ডেকে রাজকন্যা বললে, ‘না, তোমায় আমি মারব না কোটালপুত্র, তোমার ভয় নেই, তুমি আমার লোকজনের সঙ্গে যাও, গিয়ে যাকে গাছে বেঁধে রেখে এসেছ, তাকে নিয়ে এসো!
কোটালপুত্র ঝর্ ঝর্ করে কেঁদে ফেলে রাজকন্যার পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়ল।— আমায় ক্ষমা কর মা!’
.
গাছের বাঁধন খুলে মিহিরপুরের নতুন জামাই যখন এল-রাজকন্যার হাসি যেন আর ধরে না।
কুমারদেব জিজ্ঞাসা করলে, ‘আপনি হাসছেন যে?’
জয়নগরের মহারাজা বললেন, ‘তোমার এত আনন্দ কেন মা?’
রাজকন্যা বললে, ‘আপনাদের আর কষ্ট করতে হল না! এই আমার সেই হারানো রাজকুমার।’
.
কিন্তু মিহিরপুরের রাজা জয়নগরের রাজাকে কিছুতেই ছাড়বেন না। বলেন, ‘এসেছেন যখন দয়া করে তখন আমার রাজবাড়িতে আপনার পায়ের ধুলো একবার দিতেই হবে।’
জয়নগরের রাজা লজ্জিত হলেন। বললেন, ‘যাচ্ছি কিন্তু আপনার কোটালপুত্রকে শাস্তি না দিয়ে আমি এখান থেকে উঠব না।’
মিহিরপুরের রাজার তাতে আপত্তি নেই। বললেন, ‘দিন শাস্তি। সে শয়তানের শাস্তি হওয়াই উচিত। কিন্তু কোথায় গেল সে?’
ডাক তাকে কে আছিস—সেই ব্যাটা কোটালপুত্রকে!’ তৎক্ষণাৎ লোক ছুটল কোটালপুত্রকে ডাকবার জন্যে। তার বাড়ি থেকে লোক ফিরে এল। বললে, ‘বাড়িতে সে নেই হুজুর।’
‘যেখানে আছে সেইখান থেকে ধরে নিয়ে আয়।’ কিন্তু সব লোকই একে একে ফিরে আসতে লাগল। কোথাও তাকে পাওয়া গেল না। কোটালপুত্র পালিয়েছে।
কে একটা লোক যেন বললে, ‘একটি মেয়ে সঙ্গে নিয়ে তাকে আমি যেতে দেখেছি হুজুর!’
মেয়ে! কে সে মেয়ে!
খোঁজ! খোঁজ!
অবশেষে খোঁজ করে জানা গেল—সর্বনাশ!
মিহিরপুরের রাজার লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে যাবার কথা। রাজার অন্তঃপুর থেকে সংবাদ এল—বড় রাজকুমারী পালিয়েছে। এবং পালিয়েছে ওই কোটালপুত্রের সঙ্গে!’
বিছানার নিচে তার পাওয়া গেল একখানা চিঠি! যাক!
রাজা বললেন—’যাক্।’
রানি বললেন—’যাক্’।
সবাই বললে—’অমন মেয়ে যাওয়াই ভাল।’
কোটালপুত্র নাগালের বাইরে।
শাস্তি তাকে আর দেওয়া হল না।
জয়নগরের রাজা গেলেন মিহিরপুরের রাজার বাড়ি—সদলবলে আতিথ্য গ্রহণ করতে। কিন্তু এই আতিথ্য গ্রহণ করতে গিয়েই বাধল গোল। গোল এমন বিশেষ কিছুই নয়।
সেই রাত্রেই মহা ধুমধামের সঙ্গে মিহিরপুরের রাজার দ্বিতীয় কন্যার সঙ্গে কুমারদেবের হয়ে গেল বিয়ে।
পরদিন সন্ধ্যায়।
আমাদের দৈত্যপুরীর রাজকন্যা আমাদের হারান রাজপুত্রকে আড়ালে ডেকে নিয়ে বললে, ‘চল, আর আমাদের এখানে থাকা কেন? আমরা যাই।’
রাজপুত্র বললে, ‘হ্যাঁ চল।’
এমন সময় পিছনে হঠাৎ খিল খিল করে হাসির শব্দ!
‘কে!’ বলে দুজনেই চমকে তারা পিছন ফিরে দেখে—সদ্যবিবাহিতা রাজকুমারী—আমাদের কুমারদেবের স্ত্রী! হাসতে হাসতে বললে, ‘যাবার আগে, মা আপনাদের দুজনকেই একবার ডাকলেন,–আসুন!’
গিয়ে দেখে—ছাদ্না-তলায় তাদেরও বিবাহের আয়োজন সব প্রস্তুত।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন