ভীষণ কাণ্ড – শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়

শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়

আমাদের মানিকতলার আড্ডায় আনন্দকে কেউ কোনও দিন অনুপস্থিত দেখে নাই।

ঝড় হোক, জল হোক, ভূমিকম্প হোক, পৃথিবী উল্টে যাক, আনন্দ আড্ডায় আসবেই। একদিন সে কাঁপতে কাঁপতে আমাদের রবিবারের মজলিশে যোগ দিতে এসেছিল।

তাকে কাঁপতে দেখে বলাই জিজ্ঞাসা করলে, ‘কী রে, অমন ভল্লুকের মত কাঁপছিস্ কেন, বাপ্! এই গরমে আমরা ঘেমে জল হয়ে যাচ্ছি আর তুই উজবুকের মতন শীতে কাঁপছিস?’

আনন্দ মুখে কিছু না বলে হাতটা বলাইয়ের দিকে বাড়িয়ে দিলে। নাড়িটা দেখে বলাই চমকে উঠল— ‘আরে বাপরে, জ্বরে যে তোর গা ভেজে যাচ্ছে, – হতভাগা, এই জ্বর নিয়ে আড্ডায় যোগ দিতে এসেছিস্?’

আনন্দ বললে— ‘কিছু না, ম্যালেরিয়া— ১০৪ ডিগ্রির উপর জ্বর, —তা হোক—সন্ধ্যার সময় বাড়িতে কি আর চুপচাপ থাকা যায়?’

সেই আনন্দ আজ তিন দিন অনুপস্থিত। এই ব্যাপারে দস্তুরমত অবাক হয়ে গেছি।

অসুখ করলে নিশ্চয়ই জানতে পারতাম, –কলকাতা ছেড়ে অন্য কোথাও গেলে নিশ্চয়ই সে খবর দিয়ে যেত, –কাজেই, নিশ্চয়ই কোনও অভাবনীয় ঘটনা ঘটেছে।

সন্ধ্যার সময় সেই আলোচনাই চলছিল, এমন সময় আনন্দ এসে হাজির।

সারা মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি উঠেছে, চোখের কোণে কালি; মাথার চুল উস্কো-খুস্কো।

একি ব্যাপার? আমাদের আর কৌতূহলের শেষ নাই। প্রশ্নের উপর প্রশ্ন। আনন্দ বললে, ‘দাঁড়াও, সব বলছি—আগে এক কাপ চা খাওয়াও, গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে।’

চা খেয়ে এক টিপ্ নস্য নাকে দিয়ে আনন্দ খাটের উপর গ্যাঁট হয়ে বসে বলতে আরম্ভ করল।

— শুক্রবার দিন সন্ধ্যার সময় এখানে আসবার জন্যে তৈরি হচ্ছি, হঠাৎ টেলিফোনটা ঝন্ ঝন্ করে বেজে উঠল।

‘হ্যালো, –কে?’

মাসির ভীষণ অসুখ, একবার তোমাকে দেখতে চান।’

মাসি থাকেন কাশীপুরের এক ভাড়াটে বাড়িতে। আমাকে খুবই ভালবাসতেন, আজ প্রায় দিন পনেরো তাঁর আর কোনো খবর নিতে পারিনি।

মাসির অসুখ, এখনই সেখানে যাওয়া উচিত। ভাবলাম, তাড়াতাড়ি মাসিকে দেখে আড্ডায় এসে যোগ দেবো।

সন্ধ্যা উৎরে গেছে, শ্যামবাজারের মোড়ে এসে আলমবাজারের বাসে চড়লাম।

সন্ধ্যার আগেই এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে, —রাস্তা-ঘাট কাদায় ভর্তি।

মাসির বাড়ির কাছে এসে বাস থেকে নামলাম, রাস্তায় বেজায় কাদা, পথ এত পিছল যে, প্রতি পদেই উল্টে পড়ার সম্ভাবনা।

তার উপর আবার আর এক ফ্যাসাদ, মাসির বাড়ির গলির মুখে যে গ্যাসের আলোটা ছিল তাও বিগড়ে গেছে, গলির মুখটা ঘুটঘুটে অন্ধকার।

বাড়িটা ভাল করেই চিনতাম। মাসির অবস্থা তেমন ভাল নয়, দেখবার-শুনবারও বিশেষ কেউ নেই। মেসো অনেকদিন হল মারা গেছেন, মেসোর এক ভাইপোর সামান্য উপার্জনে কোনও রকমে দিন গুজরান হয়।

বড় রাস্তার উপরে একটা পেট্রোলের দোকান আছে, আমাদের কাছে কিছু জানাবার দরকার হলে মেসোর ভাই-পো বন্ধু সেখান থেকে টেলিফোনে আমাদের বাড়িতে খবর দেয়।

আজও মাসির খবর এই ভাবেই আমাকে দিয়েছে।

যাক্, অনেক কষ্টে পা টিপে টিপে অন্ধকার পিছল গলির মধ্যে দিয়ে এসে মাসির দরজার কাছে দাঁড়িয়ে কড়া নাড়লাম।

খট্ করে দরজা খুলে গেল, ভিতর থেকে কে যেন ক্যানক্যানে গলায় বললে- ‘যান, উপরে যান।

গলাটা সম্পূর্ণ অচেনা। ভাবলাম, মাসির হয়ত অন্য কোন আত্মীয় এসে থাকবে।  

দরজার সামনে দিয়েই সিঁড়ি সোজা দোতালায় উঠে গেছে। ইলেকট্রিকের আলো নেই, সিঁড়ি অন্ধকার।

ডাকলাম, ‘বন্ধু।’

আবার সেই অচেনা গলা বললে, ‘যান্, উপরে যান।’

উপরে গেলাম। মাসির দরজা বন্ধ ছিল। একটু ঠেলতেই দরজা খুলে গেল। মাসি খাটের উপর চাদরে আপাদমস্তক ঢেকে শুয়ে আছেন, —কাছে মিট্‌মিট্ করে একটি প্রদীপ জ্বলছে।

মাসি ঘুমোচ্ছেন। পাছে জুতোর শব্দে ঘুম ভেঙে যায়, তাই পা টিপে টিপে মাসির মাথার কাছে গিয়ে আলগোছে তাঁর মুখের চাদরটা সরিয়ে ফেললাম।

আমার সমস্ত শরীরের রক্ত জল হয়ে গেল। মাথার চুলগুলি বুরুশের মত খাড়া হয়ে উঠল। খুন! খুন!!

সম্পূর্ণ এক অপরিচিতা স্ত্রীলোক গলাকাটা অবস্থায় পড়ে আছে, তার মাথাটা ধড় থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন।

আর এক মুহূর্তও দেরি করা নয়। শেষে কি খুনের দায়ে পড়তে হবে! মাসির বাড়ির বদলে কি ভুল করে অন্য কোন বাড়িতে ঢুকে পড়েছি!

একছুটে দরজার কাছে এসে দরজাটা খুলতে গেলাম। সর্বনাশ! সর্বনাশ!! বাইরে থেকে কে শিকল এঁটে দিয়েছে!

আমার তখনকার মনের অবস্থাটা বেশ বুঝতে পারছ। চোখের সামনে ভেসে উঠল হাতকড়া—ফাঁসির দড়ি।

এই পর্যন্ত বলে আনন্দ বললে, ‘আর এক কাপ চায়ের ব্যবস্থা কর, গলাটা বড় শুকিয়ে যাচ্ছে।’…

আমাদের আড্ডায় চায়ের কখনও অভাব হয় না। উনুনে জল প্রায় সব সময়েই চড়ানো থাকে।

সঙ্গে সঙ্গে চা এসে হাজির।

চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিয়ে আনন্দ আবার বলতে আরম্ভ করলে—

ব্যাপারটা কিছুই বুঝতে পারলাম না। নিশ্চয় বাড়ি ভুল করিনি। এ বাড়িতে আমি অনেকবার এসেছি। এই ঘরই তো মাসির, তবে জিনিস-পত্রের কিছু অদলবদল হয়েছে মাত্র মিট্‌মিটে তেলের আলোতে ঘরটার ঝাপসা অন্ধকার ভাব বিন্দুমাত্র কাটে নি, বরং আরও বিভীষিকার সৃষ্টি করেছে।

আমি দিশেহারা হয়ে পাগলের মত বদ্ধ দরজায় আঘাতের পর আঘাত করতে লাগলাম। কঠিন কাঠের দরজা; ভীষণ রকম দুড়ুম-দাড়াম শব্দে সমস্ত বাড়িটা যেন কাঁপতে লাগল। কিন্তু দরজা যেমনি ছিল, তেমনি বন্ধই রইল।

হায়, হায়, নিরুপায়!! দুই-একবার প্রাণপণে চিৎকার করলাম— ‘কে আছ, দোর খুলে দাও, – মাসি, মাসি, বঙ্কু, বঙ্কু—’

আমার গলার স্বর সেই ঘরখানার মধ্যে গুমরে গুমরে ফিরতে লাগল। আমার স্বরের প্রতিধ্বনিতে আমিই চমকে চমকে উঠতে লাগলাম।

কোথায় মাসি, কোথায় বন্ধু!! মাসিকে দেখতে এসে খুনের দায়ে পড়ে গেলাম।

ঘরের একদিকে মাত্র দরজা, অন্য এক কোণে ছোট্ট একটি জানালা ছিল! ভাবলাম, জানালা খুলে পথের লোক ডাকি।

পরক্ষণেই মনে হল, লোক ডেকেই বা হবে কি! তারা আমাকে এ অবস্থায় দেখলে খুনি বলেই সন্দেহ করবে, – আর এক্ষুনি পুলিশের হাতে চালান দিয়ে দেবে!

আমার মাথা গরম হয়ে উঠল। কোনও রকমে পালাতে পারলে বাঁচা যায়, তবে পালাবার কোনও পথ নেই।

যত ভাবি ততই মাথায় গোল বেধে যায়। যে আসল খুনি সে নিশ্চয়ই এতক্ষণ পুলিশ ডাকতে গেছে, আমাকে হাতে হাতে ধরিয়ে দিতে পারলে তার উপর আর কোনও সন্দেহ হবে না!

রাত তখন অনেক। প্রবল উত্তেজনায় ও দারুণ দুশ্চিন্তায় আমি ঘরের মধ্যে পায়চারি করছি, এমন সময় ঝনাৎ করে শিকল খোলার শব্দে চমকে উঠলাম।

তাকিয়ে দেখি, আমার সামনে একদল পুলিশ। একজন বেঁটে মোটা লোক আঙুল দিয়ে আমাকে দেখিয়ে বললে- ‘ঐ যে পাকড়াও।’ —সেই ক্যানক্যানে স্বর। …

আমার বলবার আর কিছুই নেই, আর বললেই বা কে বিশ্বাস করবে?

হাতে হাতকড়া, কোমরে দড়ি; পুলিশ আমাকে টেনে নিয়ে চলল-হিড়্‌ হিড়্‌ হিড়্‌। আমি খুনি আসামী, –আমি গয়নার লোভে রাসমণি নামে একটি স্ত্রীলোককে খুন করেছি। ওঃ, কি দারুণ অভিযোগ!!

আমার চোখ ঝাপসা হয়ে এলো, গলা দিয়ে কোনও কথা বেরুলো না— কে যেন দুটো অদৃশ্য হাত দিয়ে আমার টুটি চেপে ধরেছে।

হায় রে, আমি আজ খুনি আসামী! আমার এমন কোনও প্রমাণ নেই, যাতে আমি নিজেকে নির্দোষ বলে জোর করতে পারি।

খুন করিনি, এ সম্বন্ধে কোনও কিছুই জানিনে, তবু হাতে হাতে ধরা পড়েছি, কে আমাকে রক্ষা করে!

বাড়িতে খবর দিয়ে কোনো লাভ নাই, বাড়ির লোক তা জানবে কী করে? তা ছাড়া বাড়ির লোকের মধ্যে কেবল ছোট কাকাই আছেন, আর সবাই গেছে পুরী বেড়াতে।

***

দুই দিন পুলিশের হাজতে কাটল। তৃতীয় দিন সন্ধ্যার সময় ঘরে ঢুকল এক পুলিশ কর্মচারী। আমি দুই হাঁটুর মধ্যে মাথা রেখে আমার দুর্দশার কথা ভাবছিলাম, এমন সময় আমার পিঠে প্রচণ্ড এক ধাক্কা দিয়ে পুলিশ কর্মচারীটি বললেন— ‘আনন্দ, যা–বাড়ি যা, –আসলে খুনি ধরা পড়েছে, তুই মুক্ত।’

তাকিয়ে দেখলাম, পুলিশ কর্মচারীর বেশে সামনে দাঁড়িয়ে আছে আমার ছেলেবেলার বন্ধু মুকুন্দ।

জানতাম, মুকুন্দ পুলিশের কাজ নিয়েছে, কিন্তু সে যে কলকাতাতেই আছে, এ-খবর জানা ছিল না।

মুকুন্দ হাসিমুখে বললে, ‘তোর তদারকের ভার পড়েছিল ভাগ্যক্রমে আমারই উপর। আসামীর বেশে তোকে দেখে আমি তো প্রথমে বিশ্বাস করতে পারিনি যে, আমাদের সেই গোবেচারা আনন্দ খুনের দায়ে ধরা পড়েছে। ভাবলাম এর ভিতর নিশ্চয় কোনও গুরুতর রহস্য আছে, আনন্দ কিছুতেই খুন করতে পারে না।

আমি এ বিষয়ে কারুকে কিছু না বলে গোপনে তদন্ত করতে লাগলাম। আমি যে এখানেই আছি, তোকেও একথা জানতে দিইনি! ইচ্ছা ছিল একেবারে নিজে এসে খালাস দিয়ে তোকে তাক্‌ লাগিয়ে দেব।

এই দুই দিন অনেক চেষ্টার পর আজ আসামী ধরা পড়েছে।’

এই বলে মুকুন্দ একজন পুলিশকে কী জানি ইসারা করল, সে হাতকড়া-দেওয়া একটি লোককে আমার কাছে এনে দাঁড় করাল। আমি দেখলাম, সেই বেঁটে লোকটা, যে আমাকে ধরিয়ে দিয়েছিল।

মুকুন্দ বললে, ‘আয় আনন্দ আমার ঘরে, এ দুদিন তোকে অনেক কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে। একটু বিশ্রাম করে তারপর বাড়ি যাস্—ততক্ষণ এই খুনের রহস্যটা তোকে বলি।—’

মুকুন্দ বলতে আরম্ভ করলে— ‘খোঁজ নিয়ে জানলাম, যে বাড়িতে এ ঘটনা ঘটে, সেই বাড়িতে কিছুদিন আগে একটি বিধবা মহিলা আর বন্ধু বলে একজন ছেলে থাকত।’

মুকুন্দর কথা শুনে আমি চমকে উঠলাম— ‘আরে, ঐ বিধবাটিই তো আমার মাসি, আর তার অসুখের খবর পেয়েই তো তাকে দেখতে এসে খুনের দায়ে পড়ে গেলাম। তারপর? —তারপর?’

মুকুন্দ বললে— তাঁরা বাড়ি ছেড়ে চলে যাবার পর—রাসমণি বলে একটি ধনী স্ত্রীলোক এসে ওই বাড়ি ভাড়া নেয়। স্ত্রীলোকটি ধনী হলেও ছিল ভারি কৃপণ। কোথায় বড় বাড়ি ভাড়া করে সুখে থাক, তো নয় এসে ভাড়া নিলে এই অন্ধকার এঁদো গলির মধ্যে ১৫ টাকার জিরজিরে বাড়িখানা।

এই বেঁটে লোকটা ছিল ওর চাকর। অনেকদিন থেকেই ওর ইচ্ছা ছিল বুড়িটাকে খতম্ করে তার টাকা-পয়সা, গয়না-গাঁটি নিয়ে সঙ্কাবে।

এতদিন সুবিধা করে উঠতে পারে নি। যেদিন বুড়িটাকে ও খুন করল, বরাত দোষে সেদিন তুইও মাসির খোঁজে সেখানে উপস্থিত।

লোকটা ভাবল, তোকে ধরিয়ে দিতে পারলে আর অন্য কারুকে খুনি বলে পুলিশ সন্দেহ করবে না। তাই এই চাল চেলেছিল।

আমি কিন্তু লোকটাকে আগাগোড়াই সন্দেহ করে এসেছি।

মুকুন্দর কথা শুনে আমি বললাম, ‘ওকে ধরলে কী করে?’

মুকুন্দ রুমাল দিয়ে কপালের ঘাম মুছে বললে, ‘বেগ আমাকে কম পেতে হয়নি। লোকটা এক নম্বরের ঘুঘু। এই দুই দিনই এক রকম প্রায় আহার-নিদ্রা ত্যাগ করে গোয়েন্দাগিরি করেছি।’

এই বলে মুকুন্দ সংক্ষেপে তার কাহিনি বলতে আরম্ভ করলে—

লোকটার নাম হিদ্দারাম, বাড়ি পশ্চিমে। লোকটাকে প্রথম দিন দেখেই আমার কেমন যেন সন্দেহ হল, তার উপর, সে যখন তোকে খুনি আসামী করে দাঁড় করিয়েছে—তখন ভাবলাম ব্যাপার অতি গুরুতর।

সে তোকে পুলিশে ধরিয়ে দিয়েই ভেবেছিল নিজে সরে পড়বে। কিন্তু আমি তাকে ছাড়ি নি। সাক্ষাৎ কিছু প্রমাণ না পেলে তাকেও ধরতে পারিনে, তোকেও ছাড়া যায় না।

ভয় দেখিয়ে, ভাল কথা বলে, কিছুতেই তার পেটের কথা বের করা গেল না। আমাদের আফিস থেকে তাকে ছেড়ে দেওয়া হল, আমি গোপনে তার অনুসরণ করলাম।

লোকটা বাসে চড়ে এসে হাজির হল বড়বাজার গলির মুখে

আমি চুপে চুপে তার পিছনে পিছনে চললাম।

গলিটা কিছুদূরে গিয়েই বাঁ দিকে ঘুরে গেছে, সেই বাঁকের মুখেই প্রকাণ্ড পোড়ো বাড়ি। দেখে মনে হল বাড়িটা প্রায় একশো বছরের পুরানো হবে।

দরজা বন্ধ ছিল! হিদ্দা কয়েকবার কড়া নাড়তেই ভিতর থেকে দরজা খুলে গেল!

হিদ্দা ভিতরে ঢুকতেই—কে যেন ফিফিস্ করে কী জিজ্ঞাসা করল! হিদ্দা বললে, ‘কাজ হাসিল।’

ভিতর থেকে দরজা সশব্দে বন্ধ হয়ে গেল। বুঝলাম, এটা একটা বদমাইসের আড্ডা।

সে দিন ফিরে এলাম। পরের দিন জায়গাটার আশেপাশে খোঁজখবর নিয়ে জানলাম বাড়িটাকে সবাই ভূতের বাড়ি বলে জানে। রাত দুপুরে বাড়িটা থেকে নানারকম জানোয়ারের আওয়াজ পাওয়া যায়।

আমি মনে মনে সবই বুঝলাম। লোককে ভূতের বাড়ি বলে প্রতিপন্ন করবার জন্যে গুণ্ডার দল এই রকম জানোয়ারের আওয়াজ করে।

বাস্তবিক এই বাড়িতে কোনও মানুষ থাকতে পারে বলে কেউ ধারণা করতে পারে না। কিন্তু আমি নিজের চোখে যা দেখেছি—তা তো আর অবিশ্বাস করা যায় না।

কাল শেষ রাত্রে একদল পুলিশ নিয়ে আমি সেই পোড়ো বাড়ি ঘেরাও করলাম!

আমাদের সাড়া পেয়ে, সেই বাড়ি থেকে যেন হাজারে হাজারে বাঘ, সিংহ, শেয়াল, কুকুর একসঙ্গে চিৎকার করে উঠল 1

পুলিশের দল ঘাবড়ে গেল— আমি বললাম, সব বদমাইসদের কীর্তি, দরজা ভেঙে আমাদের ভিতরে ঢুকতে হবে। ভয় করলে চলবে না।’

সবাই মিলে ধাক্কা মেরে দরজা ভেঙে ফেললাম। সেই ভাঙা দরজা নিয়ে দুই-একজন পালাবার চেষ্টা করল, আমরা বন্দুকের ভয় দেখিয়ে তাদের গতি রোধ করলাম।

উপরের নড়বড়ে কাঠের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে দেখি একটা ঘরে গ্যাসের আলো জ্বলছে, সেখানে বসে আছে এক লম্বা দাড়িওয়ালা বেঁটে লোক, –তার সামনে দামি দামি সব সোনা-রূপার গয়না ছড়ানো।

আমাদের দেখে লোকটা তাড়াতাড়ি পালাতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল। একজন পুলিশ গিয়ে এক হ্যাঁচকা টান মেরে তাকে তুলে ফেললে, লোকটার দাড়ি খসে গেল। তাকিয়ে দেখি—হিদ্দারাম!

হিদ্দারাম আহত সিংহের মত রাগে ফুলতে লাগল, কিন্তু করবে কী, সামনে দাঁড়িয়ে আছি বন্দুকের নল বাগিয়ে। হিদ্দারাম নিজে কিছু স্বীকার করে নি বটে, কিন্তু তার দলের আরও যে সব লোক আমরা ধরেছি, তারা সব কথা ফাঁস করে দিয়েছে। হিদ্দা তাদের দলপতি, এই খুন সে-ই করেছে।

এই পর্যন্ত বলে মুকুন্দ আমার পিঠ চাপড়ে বললে, ‘ভাই, মনে কিছু করিস না, যেটুকু দুর্ভোগ কপালে লেখা থাকে সেটুকু ভোগ করতেই হবে—তার জন্য কেউ দায়ী নয়। তাড়াতাড়ি বাড়ি যা, বাড়ির লোকেরা হয়ত ভেবে অস্থির হয়ে পড়েছেন।’

***

আনন্দের গল্পে আড্ডাটা বেশ জমে উঠেছে। ঘড়িতে ঢং ঢং করে দশটা বাজল।

গল্প থামিয়ে আনন্দ বললে, ‘ভাই এখনও বাড়ি যাই নি। পুলিশের হাত থেকে ছাড়া পেয়ে, সোজা গেলাম সেই গলির মোড়ের পেট্রোলের দোকানে, যদি তারা বন্ধুদের কোনও খবর জানে, এই আশায়— বন্ধু প্রায়ই ওখানে বসে আড্ডা দেয় কিনা।

পেট্রোলের দোকানে গিয়ে দেখি, বন্ধু দিব্বি বসে গল্প করছে। আমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত রাগে জ্বলে উঠল, বেশ ঝাঁঝাল সুরে বললাম, ‘বেশ লোক তোমরা, বাড়ি বদলেছ, অথবা খবর দাও নি, টেলিফোনে মাসির অসুখের খবর জানালে, অথচ বাড়ির ঠিকানাটা দিলে না।’

আমার কথা শুনে বন্ধু একটু ঘাবড়ে গিয়ে বললে, ‘হ্যাঁ, আমরা বাড়ি বদলেছি বটে, কিন্তু তোমার মাসির তো কোনো অসুখ করে নি। তিনি তো এখানে নেই, হুগলিতে তাঁর এক ননদের বাড়ি গেছেন—আমিও আজকাল কাছেই একটা মেসে বাস করছি!’

বন্ধুর কথা শুনে আমি দস্তুরমত বোকা বনে গেলাম। —তাকে আর কিছু বললাম না। সেখান থেকে সোজা আসছি তোমাদের আড্ডায়।

কে আমাকে টেলিফোনে মাসির অসুখের খবর দিল ভেবেই কূল-কিনারা পাচ্ছি না, মনে হচ্ছে—আগাগোড়া সমস্ত ব্যাপারটা একটা রহস্যে পরিপূর্ণ।’

সকল অধ্যায়

১. ভয় – শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়
২. প্রেতপুরী – শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়
৩. ভয়ঙ্কর – শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়
৪. ভূতুড়ে বই – শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়
৫. কি? – শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়
৬. নমস্কার – শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়
৭. অসম্ভব – শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়
৮. ন্যাড়া নন্দী – শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়
৯. ভূতের গল্প – শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়
১০. ভীষণ কাণ্ড – শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়
১১. যবনিকা – শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়
১২. আতঙ্ক – শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়
১৩. প্রেতিনী – শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়
১৪. জীবন নদীর তীরে – শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়
১৫. সত্যি নয় – শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়
১৬. ভূতুড়ে খাদ – শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়
১৭. ঘরোয়া ভূত – শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়
১৮. কে তুমি? – শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন