শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়
যে-গল্পটি আজ আমি আপনাদের বলিব, তাহা সুন্দর সিং-এর নয়, –সে গল্প দীননাথ জেলের। কিন্তু বুড়া সুন্দর সিং-এর সঙ্গে ইহার সম্বন্ধ অত্যন্ত নিকট, কাজেই সে বৃদ্ধের জীবনের ইতিহাস আপনাদের একটু ধৈর্য ধরিয়া শুনিতে হইবে।
বুড়া সুন্দর সিং আজ আর ইহলোকে নাই। বুড়া মরিয়াছে।
আহা, বেচারা!
বুড়ার গায়ের রং ছিল ঠিক পাকা আমের মত, গলায় শুভ্র যজ্ঞোপবীত, মাথার চুলগুলি ছোট করিয়া ছাঁটা, পাৎলা ছিপছিপে মানুষটি, কিন্তু এমন ভালমানুষ—আশপাশের গাঁয়ের লোকে বলে তাহারা নাকি জীবনে কখনও দেখে নাই।
মাধবপুর ষ্টেশন হইতে মাইল-খানেক দূরে পাকা একটা লাল কাঁকরের সড়ক রেল-লাইনের উপর দিয়া পার হইয়া গেছে। কিংবা লাইনটা পার হইয়াছে সড়কের উপর দিয়া, –একই কথা
লাইনের উপর ট্রেন চলে, রাস্তার উপর চলে গরুর গাড়ি, হাওয়া-গাড়ি, ঘোড়ার গাড়ি, লোকজন; —চলাচলের বিরাম একরকম নাই বলিলেই হয়। অথচ, ট্রেন চলিবার নির্দিষ্ট একটা সময় থাকিলেও গাড়ি-ঘোড়া লোকজন চলাচলের ধরা বাঁধা সময় কিছু নাই, কাজেই রেল কোম্পানিকে বাধ্য হইয়া এই দুই রাস্তার কাটাকাটির মাথায় লোহার একটি প্রকাণ্ড ফটক তৈরি করিতে হইয়াছে। না করিলে বিপদের সম্ভাবনা। এবং শুধু ফটক তৈরি করিলে চলে না, ফটক আগলাইবার লোক চাই, লোকের জন্য একখানি ঘর চাই।
ঘরও তৈরি হইয়াছে।
সড়কের দুপাশে বড় বড় বাঁশের ঝোপ, চারিদিকে পলাশ, ঘেঁটু, বন-তুলসী, শ্যাওড়া আর সিঁয়া-ফুলের জঙ্গল, আর তাহারই মাঝখানে রেল-লাইনের ধারেই—টালির একখানি ছোট ঘর।
ফটক-ওয়ালা সুন্দর সিং।
থাকে ওই ঘরে। ওইখানেই খায়, ওইখানেই শোয়, ট্রেনের সময় ফটক বন্ধ করে, আবার ট্রেন চলিয়া গেলে খুলিয়া রাখে। সারা দিবারাত্রির মধ্যে শুধু ওই তাহার কাজ। পরিশ্রম বিশেষ কিছু নয়, তবে দায়িত্ব বড় বেশি। এক দণ্ডের জন্যেও তাহার এই ফটক ছাড়িয়া কোথাও যাইবার উপায় নাই।
তা সে যায়ও না।
প্রথম যখন সে এখানে এই ফটক-রক্ষীর কাজ লইয়া আসে, তখন তাহার যৌবন। আসিয়াছিল তিরিশ বছর আগে; এবং এই তিরিশ বছরের মধ্যে কেহ তাহাকে কোথাও যাইতে দেখে নাই।
আত্মীয়-স্বজন কেহ কোথাও তাহার ছিল কি না, কে জানে! ছিল নিশ্চয়। না থাকা সম্ভব নয়। মানুষ কখনও আকাশ হইতে পড়ে না। রক্তের ধারা নর-নারীর দেহে দেহে সঞ্চারিত হইয়া হয়ত বহু দূর-দূরান্তে বিচ্ছিন্ন হইয়া গেছে। সুন্দর হয়ত তাহাদের সন্ধান রাখে না, কিংবা রাখিলেও কাহারও কাছে প্রকাশ করে না! লোকটা বড় চাপা।
তবে এই পর্যন্ত লোকে জানিয়েছে যে, সুদুর পশ্চিমের এলাহাবাদ জেলায় তাহার বাড়ি। মাসের শেষে নিজের খাওয়া-পরার খরচ বাদে, বাকি দশটি করিয়া টাকা সে মনি-অর্ডার করিয়া দেশে পাঠায়।
পাঠায় রুক্মিণী দেবীর নামে।
কিন্তু ওই পর্যন্ত।
রুক্মিণী দেবীটি যে কে, সুন্দর সিং-এর সঙ্গে কি তাহার সম্বন্ধ, সে কথা ওই এক দীননাথ ছাড়া আর কেহ জানে না।
মাধবপুরের ফটকে কাজ লইয়া সুন্দর সিং তখন নূতন আসিয়াছে।
বৈকালে সেদিন সে তাহার ফটকের কাছে চুপ করিয়া বসিয়া কি যেন ভাবিতেছিল। প্যাসেঞ্জার ট্রেন পার হইবার সময়। সিগন্যাল পড়িয়াছে। ফটকে তালা বন্ধ। হঠাৎ শুনিল, পশ্চাতে কে যেন বলিতেছে, ‘কখন খুলবে সিংজি?’ পিছন ফিরিয়া সুন্দর সিং দেখিল, কালো রঙের পাৎলা ছিপছিপে নিতান্ত রোগা এক ছোকরা খালি পায়ে খালি গায়ে ফটক ধরিয়া দাঁড়াইয়া আছে।
সিংজি বলিল, ‘গাড়িটা পেরোলেই খুলব। একটু দাঁড়াও ভাই।’
ছোকরাটি একটু ইতস্তত করিতেছিল, অবশেষে মরীয়া হইয়া সে তাহার বামহস্তের তালুর উপর দক্ষিণ হস্তের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ ঘসিতে ঘসিতে ইঙ্গিতে ব্যাপারটা বুঝাইয়া জিজ্ঞাসা করিল, ‘আছে?’ বলিয়া একটা ঢোক গিলিয়া নিতান্ত করুণ কণ্ঠে কহিল, ‘আমার আজ ফুরিয়ে গেছে সিংজি।
তাহার মুখ দেখিয়া সুন্দর সিং-এর দয়া হইল। বলিল, ‘আছে।’
আর কিছু বলিবার অবসর তাহার হইল না, হুস হুস করিয়া ট্রেন আসিয়া পৌঁছাইল। সবুজ রঙের ঝাণ্ডা হাতে লইয়া সুন্দর সিং উঠিয়া দাঁড়াইল।
গাড়ি স্টেশনে গিয়া থামিলে ফটকের তালা খুলিয়া ছোকরাটিকে ডাকিয়া সুন্দর সিং তাহার
সেই ছোট্ট ঘরখানির ভিতর লইয়া গেল, কাঠের একটি পিঁড়ি টানিয়া দিয়া বলিল, ‘বোসো।’
ছোকরাটি বলিল, ‘না আমি এই মেঝেয় বসি। আমি কৈবর্ত—জেলে।’
এই দীননাথ।
গাঁজা খাইতে খাইতে সেই তাহাদের প্রথম পরিচয়।
পরিচয় ক্রমশ ঘনিষ্ঠ হইতে লাগিল।
দীননাথ জেলে। মাধবপুর গ্রামে তাহার মাত্র একখানি কুঁড়েঘর ছাড়া আর কিছুই নাই। আঁকা-বাঁকা প্রায় মাইল-খানেক মেঠো রাস্তা ভাঙ্গিয়া তাহাকে এখানে আসিতে হয়। তবু সে রোজ দুবেলাই আসে।
বাড়িতে তাহার স্ত্রী এবং একটিমাত্র কন্যা। স্ত্রী তাহার রাত্রি প্রভাত হইতে না হইতে তিন-কোনা কাঠের জালি কাঁধে লইয়া বাহির হয়। পুকুরে পুকুরে ঘুরিয়া ঘুরিয়া চুনোপুঁটি যাহা পায়, দুপুরবেলা ঘরে ঘরে তাহাই বিক্রী করিয়া চাল-ডাল কিনিয়া আনে।
দীননাথ তাহার চোখ দুইটি রাঙা করিয়া ঠিক সময়েই ফিরিয়া আসিয়া খাইতে বসে। স্ত্রী তাহার গালাগালি দেয়। দীননাথ সে সব শুনিতে পায় না। দিব্য নির্বিকার চিত্তে আহারাদি সমাপ্ত করিয়া হাত ধুইয়া আসিয়া বলে, ‘মর মাগী, চেঁচাস কেন?’
টগর বলে, ‘চেঁচাই সাধে? একবেলা, যেতে যেতে এখন ত দুবেলাই ধরলে। তোমার সিংজি যদি আজ চলে যায়, কাল কি করবে?’
‘যদি চলে যায়’… বলিয়া দীননাথ তাহার স্ত্রীর কাছে সরিয়া গিয়া চুপি চুপি বলিল, ‘রায়ের পুকুরে এই এত বড় বড় মাছ। অন্ধকার রাত্রে একদিন জাল নিয়ে গিয়ে…
টগর হাসিতে হাসিতে দীননাথের মুখের কাছে হাত লইয়া গিয়া বলে, ‘থামো, তুমি ধরবে মাছ। তার ওপর অন্ধকার রাতে। তবেই হয়েছে। ওলো ও বগলা, শোন।’
বগলা তাহার মেয়ের নাম। কালো মেয়ে। দিব্যি টানা-টানা চোখ, নিটোল স্বাস্থ্য, গড়ন বড় চমৎকার। দেখিতে অনেকটা ঠিক মায়ের মত। এই সবে সেদিন শ্বশুরবাড়ি হইতে আসিয়াছে। জিজ্ঞাসা করিল, ‘কি বলছিলি মা?’
টগর বড় চালাক মেয়ে। বগলার কাছে বলিলে পাছে স্বামীর লজ্জা হয় ভাবিয়া বলিল, ‘না, কিছু বলিনি। তোকে আসতে হবে না। যা।’
বলিয়া দীননাথের মুখের পানে তাকাইয়া সে আবার হাসিতে লাগিল। – আচ্ছা, অন্ধকারকে তোমার এত ভয় কেন বল ত? আমি ত রাত-দুপুরে শ্মশানে যেতে পারি।’
দীননাথ সে কথা বিশ্বাস করে না। বলিল, ‘তাহলে তুই সব পারিস। তোকে নিয়ে ঘর করা আর হল না দেখছি।’
টগর জিজ্ঞাসা করিল, ‘কাকে নিয়ে করবে? কে তোমায় বসিয়ে বসিয়ে খেতে দেবে দুবেলা, শুনি?’
দীননাথ ভাবনায় পড়িল। তাও বটে। হাসিতে হাসিতে বলিল, ‘বগলার মা না করে তোকেই বগলার বাপ করা উচিত ছিল, বুঝলি টগর। ভগবানের ভুল হয়ে গেছে।’
দুজনেই হাসিতে লাগিল।
টগর বলিল, আচ্ছা, তোমার ঐ সিংজিকে বলেকয়ে দিনের বেলা রেলে কোথাও কাজ হয় না?’
দীননাথ ঘাড় নাড়িয়া বলিল, ‘হবে। আর কিছুদিন সবুর কর।’
কিছুদিন দূরের কথা, টগর সবুর করিল পাঁচ বৎসর।
এই পাঁচ বৎসরের মধ্যে দীননাথ রোজগার করিয়াছে মাত্র এক টাকা দশ আনা।
বারোদুয়ারীর বাবুদের বাড়ি মেয়ের ছিল বিয়ে। প্রচুর মাছের প্রয়োজন। প্রকাণ্ড একটা সায়রে মাছ ধরিতে হইবে। দশ-বারোখানা গ্রামে যেখানে যত জেলে ছিল, সকলেরই ডাক পড়িল। মাধবপুরের জেলেদের সঙ্গে দীননাথও গিয়েছিল। জলে নামিয়া মাছ সে ধরিতে পারিয়াছিল কি না কে জানে, তবে মজুরি পাইয়াছিল এক টাকা, আর চুরি করা মাছ বিক্রীর ভাগ—দশ আনা। খাওয়া-দাওয়াও নাকি হইয়াছিল বেশ, কিন্তু দীননাথ গ্রামে ফিরিয়া প্রতিজ্ঞা করিয়াছিল যে, সে আর তাহাদের গ্রামের লোকের সঙ্গে কোথাও যাইবে না।
না যাওয়াই উচিত।
কারণ, নিষ্ঠুরতার একটা সীমা আছে।
অন্ধকার রাত্রি। ময়নাদীঘির শ্মশানের পাশ দিয়া তাহারা গ্রামে ফিরিতেছিল। আশে-পাশে আগাছায় ভর্তি ঝোপ-জঙ্গলের মাঝখান দিয়া সরু একফালি পায়ে-চলা পথ। জায়গাটা দিনের বেলা খাঁ-খাঁ করে, রাত্রে তো সেখানে মানুষের ভয় পাওয়া স্বাভাবিক। ক্ষণে ক্ষণে দীননাথের সমস্ত শরীর রোমাঞ্চিত হইয়া উঠিতেছিল। কিন্তু এমনি নিষ্ঠুর এই ভগা আর চণ্ডে যে, যত বার সে লোকজনের মাঝখানে একটু নিরাপদ স্থানে গিয়া ঢুকিতেছিল, ততবার তাহারা হাত ধরিয়া টানিয়া তাহাকে একেবারে সকলের পিছনে ঠেলিয়া দিয়া নিজেরা আগাইয়া গিয়া মজা দেখিতেছিল। সমস্ত রাস্তা দীননাথের লাঞ্ছনার তাহারা আর কিছু বাকি রাখে নাই। আর একটু হইলেই সেদিন সে ওই পথের মাঝখানেই মারা পড়িত। কোন রকমে চোখ বুজিয়া মরি-বাঁচি করিয়া রাম-রাম বলিতে বলিতে গ্রামে আসিয়া পৌঁছিয়াছিল। তাই রক্ষা।
ব্যাপার শুনিয়া সুন্দর সিং হাসিতে লাগিল।
কারণ—তাহার পরিচয় সে ইহার পূর্বেই পাইয়াছে।
গাঁজা খাইয়া নেশার ঝোঁকে গল্প করিতে করিতে একদিন তাহাদের সন্ধ্যা হইয়া গিয়াছিল। অন্যদিন সন্ধ্যার পূর্বেই দীননাথ উঠিত। সেদিন কখন সন্ধ্যা হইয়াছে, বুঝিতে পারে নাই। হঠাৎ শেয়ালের ডাকে চমক ভাঙ্গিতে দীননাথ বাহিরে তাকাইয়া দেখে, অন্ধকার। আকাশে তারা উঠিয়াছে। তৎক্ষণাৎ তাহার কথার ধারা বদলাইয়া গেল। কাশিয়া গলাটা একটু পরিষ্কার করিয়া লইয়া কহিল, ‘ন-টার গাড়ি আসবার দেরি আছে, না?’
সিংজি গল্প বলিতেছিল কাশীধামের। সেইখানেই তাহার বাল্যকাল এবং কৈশোর কাটিয়াছে। প্রচুর পরিমাণে দুধ-ঘি খাইয়া, গঙ্গার উপর নৌকায় চড়িয়া কি আনন্দে দিন কাটাইয়াছে, তাহারই গল্প। দুই হাতে দাঁড় টানার ভঙ্গী করিয়া বলিতেছিল, মণিকর্ণিকার ঘাট থেকে কেদারজির ঘাট পর্যন্ত পাল্লা লাগিয়ে আমরা দাঁড় টানতাম। আমার মত দাঁড় টানতে কেউ পারত না।’
শ্রোতার মুখে হঠাৎ ন-টার গাড়ির কথা শুনিয়া সুন্দর সিং-এর দাঁড় টানা বন্ধ হইয়া গেল।
‘হাঁ, দেরি আছে।’ বলিয়া সে আবার আরম্ভ করিল, তারপর গড়েন ঘাটে নৌকো বেঁধে আমরা কেদারনাথজির মন্দির প্রণাম করতে যেতাম। এইখানে প্রণাম করতে গিয়েই একদিন রুক্মিণীর সঙ্গে দেখা।’
দীননাথের তখন অসহ্য হইয়া উঠিয়াছে। এই সবে রুক্মিণীর সঙ্গে দেখা। ইহার পর পরিচয়, ঘনিষ্ঠতা, ভালবাসা, বিবাহ তাহার পরে সন্দেহ, ঝগড়া, ছুরি-মারামারি, বিচ্ছেদ…! রাত্রি তখন যে কত হইবে তাহার আর ইয়ত্তা নাই।
দীননাথ বলিল, কাল শুনব সিংজি, আজ উঠি।
রুক্মিণীর কথা সহজে সে কাহাকেও বলিতে চায় না, আজ যখন বলিতে আরম্ভ করিয়াছিল, দীননাথ শুনিতে চাহিল না দেখিয়া মনে মনে ক্ষুণ্ণ হইয়াই সুন্দর সিং বলিল, ‘আচ্ছা।’
বলিয়া সে একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বাহিরে তাহার লোহার তোলা উনানটা ধরিয়াছে কি না, দেখিবার জন্য নিজেও উঠিল।
বাহিরে আসিয়া দীননাথ একবার ফটকের কাছে দাঁড়াইয়া এদিক ওদিক তাকাইল। পথের দুপাশে বাঁশের ঝোপে ঝোপে অন্ধকার যেন জমাট বাঁধিয়াছে। জনপ্রাণীর সাড়াশব্দ নাই।
দীননাথ জিজ্ঞাসা করিল, দুধ কি তোমার দিয়ে গেছে সিংজি?’
সুন্দর বলিল, ‘বা, দেখলে না, তোমার সামনেই দিয়ে গেল যে।’
‘ও।’ বলিয়া দীননাথ এক-পা এক-পা করিয়া আবার সুন্দর সিং-এর কাছে আসিয়া দাঁড়াইল।
সুন্দর জিজ্ঞাসা করিল, ‘গেলে না যে?’
‘যাই।’
বলিয়া সেইখানেই দাঁড়াইয়া সে ইতস্তত করিতে লাগিল।
‘আমার সঙ্গে তুমি যদি আসতে পার সিংজি, তো তোমায় আজ আমি ক্ষীর খাওয়াতে পারি।’
গাঁজা-খোর মানুষ, সিংজি যে ক্ষীরের পক্ষপাতী, দীননাথ তাহা জানিত। ক্ষীরের নাম শুনিয়া সুন্দর বলিয়া উঠিল, ‘ক্ষীর! কোথায়?’
দীননাথ বলিল, ‘আমার সঙ্গে আসতে হবে তাহলে। সারদা গয়লার বাড়িতে আজকাল চার-পাঁচটা ইয়া বড় বড় গাই। দশ-বারো সের দুধ হয়। ব্যাটা আজকাল ক্ষীর বেচছে। এসো, মাইরি বলছি।’
ন’টার গাড়ির তখনও অনেক দেরী। সুন্দর বলিল, ‘লোটাটা নি তাহলে?’
দীননাথ বলিল, ‘লোটা। আচ্ছা, নেবে তো নাও। তার চেয়ে বরং আঁধার রাত…লণ্ঠনটা… লোটা এবং লণ্ঠন হাতে লইয়া ফটক দুইটা টানিয়া বন্ধ করিয়া সুন্দর সিংহ দীননাথের সঙ্গে ক্ষীর আনিতে চলিল।
সারাটা পথ দীননাথের মুখে কথা যেন আর ফুরাইতে চায় না।
কি যে বলে, মাথা নাই মুণ্ডু নাই, খালি খালি চেঁচাইতে চেঁচাইতে চলে। সুন্দর সিং আগাইয়া যায় তো তৎক্ষণাৎ তাহাকে ঠেলিয়া দিয়া তাহার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। পথের পাশে গাছে-পাতার কোথাও একটু খুডুক করিয়া শব্দ হইলেই অমনি চমকিয়া উঠিয়া দীননাথ জিজ্ঞাসা করে, কিসের শব্দ?
সুন্দর বলে, ‘কিছু না।’
এমনি করিয়া যখন তাহারা গ্রামে গিয়া পৌঁছিল—পল্লীগ্রাম তখন নিস্তব্ধ বলিলেই হয়।
বেচু ময়রার বাড়ির কাছাকাছি আসিতেই গ্রামের কয়েকটা হ্যাংলা কুকুর তাহাদের দেখিয়া চিৎকার করিয়া উঠিল। বেচুর দোকানের চালায় বসিয়া তখনও জনকতক লোক গল্প করিতেছিল। বেচু জিজ্ঞাসা করিল, ‘কে?’
জবাবের অপেক্ষা করিতে হইল না। সুন্দর সিং তাহার হাতের লণ্ঠনটা তুলিয়া ধরিতেই সকলে তাহাদের চিনিতে পারিল।
জিতু বলিল, সিংজি এমন অসময়ে যে?’
বেচু হাসিল। বলিল, ‘বুঝতে পারছ না? দীননাথ সঙ্গে। আঁধার রাত। একা আসতে পারে? দাঁড়িয়ে দিতে এসেছে।’
দীননাথ যে অত্যন্ত ভীতু, সে কথা গ্রামের কাহারও জানিতে বাকি নাই।
দীননাথ বলিয়া উঠিল, ‘মাইরি আর কি! তোমাদের যেমন কুথা। ও এসেছে সারদার বাড়ি ক্ষীর নিতে।’
কিন্তু হায়, যেখানে বাঘের ভয়, সেইখানেই সন্ধ্যা হয়।
রতু স্যাকরা সেই সময়ে বেচুর দোকানে আসিল এক পয়সার পান কিনিতে। সারদার বাড়ি আর রতুর বাড়ি একেবারে গায়ে গায়ে। বেচু বলিল, ‘পান তুই ভাই এসে নিস। তুই একবার চট করে সারদাকে ডেকে তোর সঙ্গে নিয়ে আয়। বল—জরুরী দরকার।’
দীননাথ বলিল, ‘চলে এসো সিংজি, ওদের কথা তুমি শুনছ কেন?
কিন্তু বেচু, জিতু, নগেন ইত্যাদি সকলে মিলিয়া হাসিতে হাসিতে পথ আগলাইয়া দাঁড়াইল। বলিল, ‘না, তুমি যেতে পাবে না, দাঁড়াও।’
সারদা আসিতেই বেচু জিজ্ঞাসা করিল, ‘ক্ষীর আছে তোমার বাড়িতে সারদা?’
সারদা বুড়া মানুষ। জাতিতে গোয়ালা। দুধ, ঘি সে বিক্রী করে বটে, ক্ষীরও মাঝে মাঝে তৈরি যে সে করে না এমন নয়। সারদা বলিল, ‘হা আমার কপাল! আজ একমাস হল, আমার ঘরে এক ফোঁটা দুধ নেই। গরুর বাছুরটি মরে গেছে যে! কেন, তুমি জান না বেচু? এই যে আমাদের দীনুও তো জানে।’ বলিয়া সারদা দীননাথের মুখের পানে তাকাইল।
দীননাথের মুখ তখন শুকাইয়া এতটুকু হইয়া গেছে। একটা ঢোক গিলিয়া বলিল, ‘আমায় আবার কখন বললে?’
সারদা বলিল, ‘সেই যে, দিন পাঁচ-ছয় আগে—সরকারী ইন্দারা-তলায় রাসু ভটচাজ যেদিন দুধের রোজ চাইতে এলেন, –তুমি বললে, বাছুর মরে গেছে? আহা, তাই না কি। তা তো জানতাম না সারদা…’
দীননাথ কিছুতেই স্বীকার করিবে না, অথচ সারদা বলিয়াছে ইহা সত্য কথা।
দুজনে বচসা হইবার উপক্রম।
সুন্দর সিং বলিল, ‘থাক, তুমি চল দীননাথ, তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসি। আমার আবার গাড়ির সময়…
বেচু বলিল, ‘না না, ওকে আবার পৌঁছে দেবে কেন? তোমায় ক্ষীর খাওয়ালে, এবার ও একা যাক, এই তো বাড়ি।’
সুন্দর সিং হাসিয়া একটুখানি আগাইয়া গেল। দীননাথ তখন তাহারও আগে গিয়া দাঁড়াইয়াছে।
কিয়দ্দূর গিয়া, রাস্তায় যখন আর লোকজন কেহ নাই, সুন্দর জিজ্ঞাসা করিল, ‘আচ্ছা, তোমার এত ভয় কেন লাগে বল তো দীননাথ?
দীননাথ বলিল, ‘বেটাদের ষড়যন্ত্র, বুঝলে না?’
কিন্তু সেটুকু বুঝিবার ক্ষমতা সুন্দর সিং-এর আছে। বলিল, ‘ভয় তাহলে তোমার পায় না, বলছ?’
দীননাথ আমতা আমতা করিয়া বলিল, ‘ভয় আবার কার পায় না সিংজি। ও-ব্যাটারা কি একেবারে ইয়ে হয়ে গেছে না কী! ওদের ভয় পায় না?’
সুন্দর সিং আর একটি কথাও তাহাকে জিজ্ঞাসা করিল না।
দীননাথের ভয়ের পরিচয় সেইদিন সে প্রথম পাইল।
এবং সেইদিন হইতে সন্ধ্যার পূর্বেই সুন্দর সিং বলিত, ‘এবার ওঠো দীননাথ।’
কিন্তু তাহাতে দীননাথ বিশেষ খুশি হইত না। আত্মসম্মানে তাহার আঘাত লাগিত। বলিত, উঠছি। কিন্তু দ্যাখ সিংজি, তোমরা আমাকে যতটা ভাবো, অতটা নয়।’
সিংজি হাসিয়া বলিত, ‘তা বলছি না দীননাথ, তবে কিনা অন্ধকার পথ, অতটা যেতে হয়, সাপ-খোপ তো আছে!’
দীননাথ বলিত, ‘হ্যাঁ ঠিক বলেছ সিংজি, এইবার তুমি ঠিক বলেছ। ওই সাপ জিনিসটাকে আমি বড় ভয় করি। অন্ধকারে ফোঁস করে যদি ওঠে একবার ত বাস…। সেদিন আমাদের গাঁয়ের সেই সুধন মুচি যাচ্ছিল তার মেয়ের শ্বশুর বাড়ি…
বলিয়া সুধন মুচিকে একবার তাহার মেয়ের শ্বশুরবাড়ি যাইবার পথে কেমন করিয়া একটা গোখরো সাপে আগলাইয়াছিল, দীননাথ তাহারই গল্প আরম্ভ করিত।
তাহার পর অনেক দিন পার হইয়াছে।
.
বৃদ্ধ সুন্দর সিং—চোখে ভাল দেখিতে পায় না, লাঠি ধরিয়া চলিতে হয়।
তবে ফটক আজকাল শুধু এই ট্রেন চলিবার সময়টুকু ছাড়া অধিকাংশ সময় খোলাই থাকে। গাড়ি-ঘোড়ার সংখ্যা আগের চেয়ে এখন বাড়িয়াছে। আর ‘মহালক্ষ্মী বাস সার্ভিসে’র যাত্রী বোঝাই বড় বড় মোটর গাড়িগুলোর যাতায়াতের বিরাম নেই। বারোখানা গাড়ি তাহাদের প্রভাতের পূর্ব হইতে রাত্রি এগারোটা-বারোটা পর্যন্ত এই রাস্তার উপর দিয়া ক্রমাগত যাওয়া-আসা করে।
দীননাথের বয়সও পঞ্চাশের উপরে উঠিয়াছে। তবু, তাহার যাওয়া-আসা এখনও ঠিক তেমনি। হাট রামপুরের বাজারে আজ যাত্রা গান হইবে, মহালক্ষ্মীর সব বাসগুলো বোঝাই হইয়া আজ শুধু সাজের বাক্স গেল। পানিহাটির হাটে নাকি আজ গঙ্গার টাটকা ইলিশের দাম –বারো আনা জোড়া। ‘মহালক্ষ্মী’ ছাড়াও নাকি আর একটা নতুন কোম্পানীর ‘বাস’ কাল হইতে এই লাইনে চলিবে। তাহাদের বাসগুলো নাকি মহালক্ষ্মীর চেয়েও ভালো, — দেখিতে ঠিক রূপার মত ঝক ঝক করে।
ইহা ছাড়া কলিকাতা শহরটা আগে ছিল অত্যন্ত দূর। এখন এই ‘বাসের’ কল্যাণে সেখানকার খবরও রোজ দুবেলা পাওয়া যায় সেখানে নাকি বিদেশী কাপড় কেনা-বেচা একদম বন্ধ হইয়া গেছে। মেয়েরাও নাকি দলে দলে জেলে যাইতেছে। স্বরাজ পাইতে আর দেরি নাই। ইত্যাদি ইত্যাদি।
সুন্দর সিং হাসিয়া বলে, ‘স্বরাজ যখন হবে, তখন আমরা মরে যাব। কি বল দীননাথ! ছেলেমেয়েও একটা যদি থাকতো তো দেখতে পেতো।’
বলিয়া একটা দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিয়া ‘ডিসস্ট্যান্ট সিগন্যালটা’র পানে তাকাইয়া বোধ করি সে ছেলে-মেয়ের কথাই ভাবিতে লাগিল।
দীননাথও বলিল, ‘তোমারও যা, আমারও তাই। একটা মেয়ে। তারও একটা ছেলে হল না! মেয়ে একটা হয়েছে বছর তিনেকের, তাও সেটা মরে কি বাঁচে, ঠিক নেই।’
স্বরাজ দেখিবার জন্য তাহার মেয়ের মেয়ে বাঁচুক আর মরুক তাহাতে কিছু আসে যায় না, যাহার জন্য আসে যায়, তাহারই হইল একদিন জ্বর।
বর্ষাকাল। পুকুর ডোবা সব কানায় কানায় ভর্তি। এখন আর জাল টানিয়া মাছ ধরিবার উপায় নাই। ধানের ক্ষেতে, নালার মুখে, ছোট ছোট ভাঙ্গনের আড়ায় ‘আড়ি’ পাতিয়া টগর মাছ ধরিতেছিল প্রচুর। গ্রাম ছাড়িয়া ভিন্ন গ্রামেও মাছ বেচিয়া পয়সা আনিতেছিল। পয়সার লোভে দিনে দু-তিনবার করিয়া বৃষ্টির জলে ভিজিতেও সে কসুর করিত না।
দীননাথ বলিত, ‘অত ভিজিস নে টগর, অসুখে পড়বি।’ টগর হাসিয়া বলিত, ‘তুই চুপ কর মিনষে, কেয়টের মেয়ে, জলে ভিজলে কিছু হয় না আমাদের।’
কিন্তু শেষে দীননাথের কথাই সত্য হইল। কেয়টের মেয়ে বলিয়া সে রক্ষা পাইল না। দিন কতক পরেই জ্বরে পড়িল।
জ্বরে, তাহার না হইল চিকিৎসা, না হইল সেবা যত্ন। সঞ্চিত যে কয়টি টাকা তাহার ছিল, তাহাই ভাঙ্গিয়া দীননাথ চাল-ডাল আনিয়া নিজেই দুবেলা রাঁধিয়া খাইতে লাগিল। অবশেষে দিন চার-পাঁচ পরে হঠাৎ একদিন সন্ধ্যায় টগরের বাকরুদ্ধ হইয়া গেল, মুখ দিয়া কথা সরিল না, শুধু সেই স্তিমিত প্রদীপের আলোয় জরাজীর্ণ তাহার সেই ক্ষুদ্র কুটীরের মধ্যে আয়ত দুইটি সজল চক্ষের সকরুণ দৃষ্টি মেলিয়া দীননাথের মুখের পানে তাকাইয়া বারে বারে কি যেন সে বলিবার চেষ্টা করিল কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছুই বলিতে না পারিয়া বার কতক জোরে জোরে নিশ্বাস টানিল, বারকতক খাপচি খাইল; তাহার পর ধীরে ধীরে সব ঠাণ্ডা হইয়া আসিতে লাগিল।
রাত্রি তখন কত হইবে, কে জানে। বাহিরে ঘোলাটে জ্যোৎস্নায় ঝিম ঝিম করিয়া বাদল নামিয়াছে। চোখের জলে দীননাথ ভাল করিয়া কিছুই দেখিতে পাইল না, দেখিবার চেষ্টাও করিল না, ভয় পাইয়া সে বাড়ি হইতে পলাইয়া গেল না, টগরের মৃতদেহের উপর উপুড় হইয়া পড়িয়া সে এমন ভাবে কাঁদিতে শুরু করিল যে, চোখ চাহিয়া উঠিয়া বসিল যখন—দেখিল, রাত্রি প্রভাত হইয়াছে, গাছে গাছে পাখি ডাকিতেছে।
বাড়িতে না আছে কাঠ, না আছে কয়লা, মৃতদেহ সৎকারের কি ব্যবস্থা যে করিবে, কাহার দ্বারস্থ হইবে ভাবিতে ভাবিতে দীননাথ বাহিরে আসিয়া দাঁড়াইল। দেখিল, ছাতাটি বগলে চাপিয়া লাঠি লইয়া সুন্দর সিং আসিতেছে।
দুদিন সে তাহার কাছে যাইতে পারে নাই। আসিতেছে বোধ করি তাহারই সন্ধান লইতে।
কিন্তু এমন বিপদে যেন শত্রুও না পড়ে।
টগর যে এমন করিয়া মরিয়া তাহাকে একেবারে পথে বসাইয়া যাইবে, দীননাথ তাহা একটি দিনের জন্যও ভাবিতে পারে না। স্ত্রী মরিল, একটি মাত্র মেয়ে তাহার, তাহাকেও সে মরিবার সময় একটিবার চোখের দেখা দেখিতে পাইল না। স্টেশনের একটা খালাসীকে দিয়া সুন্দর সিং মেয়ের কাছে সংবাদ পাঠাইল। দীননাথের বলিতে বুক ফাটিয়া যাইতেছিল, তবু সে খালাসীটাকে ডাকিয়া বলিয়া দিল, খবর পেয়ে বগলা যেন এখানে আর না আসে। বলিয়া সে হো হো করিয়া কাঁদিতে লাগিল। – ‘এসে কি করবি মা। ‘
তাহার নিজেই এখানে না আছে আহারের সংস্থান, না সংগ্রহের সঙ্গতি।
দীননাথের জ্ঞাতি-কুটুম্ব, গ্রামের লোক এই বিপদের দিনে কেহ তাহার কিছু করিল না। সকলেই বলিতে লাগিল—’গাঁজাখোর হতভাগার ঠিক হয়েছে।’
গাঁজাখোর বলিয়াই তাহাদের কর্তব্য চুকাইল, কিন্তু আশ্রয় দিল তাহাকে আর এক গাঁজাখোর। —বিদেশী হিন্দুস্থানী—সামান্য এক রেলওয়ে স্টেশনের ফটক-রক্ষী, ব্রাহ্মণ সুন্দর সিং।
.
গ্রামের সঙ্গে সম্পর্ক দীননাথের একরকম উঠিয়া গেল। সুন্দর সিং-এর কাছেই থাকে, তাহারই কাজকর্ম করিয়া দেয়, সেইখানেই খায়, সেইখানেই শোয়, সুখ-দুঃখের গল্প করে।
গ্রামে তাহার সামান্য যে কুঁড়েখানি ছিল, সেখানি এখন রাজ্যের যত কুকুরের আড্ডা।
দীননাথ বলে, ‘হোক। ও বাড়িতে আমি আর ঢুকতে পারব না সিংজি। আমার এবার মরণ হলেই বাঁচি।’
কিন্তু মৃত্যু যে চায়, তাহার মৃত্যু বোধ করি সহজে হয় না।
সেই বৎসরেরই শেষে একদিন সংবাদ পাইল—বগলা মরিয়াছে।
ভালই হইয়াছে। দীননাথের চোখ দিয়া এক ফোঁটা জলও পড়িল না।
বলিল, ‘দ্যাখ মজা! আমি রইলাম বেঁচে।’
সুন্দর সিং-এর শরীরটাও কিছুদিন হইতে ভাল চলিতেছিল না, ‘আমিও আর বেশিদিন বাঁচব না ভাই, আমারও কেমন যেন মনে হচ্ছে।’
কথাটা দীননাথের বুকে গিয়া ধ্বক করিয়া বাজিল।
বলিল, ‘হ্যাঁ, তুমিও চলে যাও, আমি একাই বেঁচে থাকি।’
সেদিন রাত্রে দীননাথের কি মনে হইল, হঠাৎ সুন্দরের কাছে রুক্মিণীর কথাটা নিজে হইতেই পাড়িয়া বসিল। বলিল, ‘আহা, আসুক একবার। শেষ বয়সটা কাছে থেকে সেবা শুশ্রূষা করুক। নিয়ে এসো। আনতে হবে না। চিঠি লিখলেই হয়ত চলে আসবে।’
সুন্দর হাসিল। সে বড় করুণ হাসি। মুখে কিছুই বলিতে বোধ হয় পারিল না।
দীননাথ আবার বলিল, ‘আনবে না সিংজি? কি ভাবছ?’
সুন্দর ঘাড় নাড়িয়া বলিল, ‘না।’
ইহার উত্তরে দীননাথ কি যে বলিবে খুঁজিয়া পাইল না। রাত্রি তখন অনেক হইয়াছে। সাড়ে-বারোটার পর আর ট্রেন নাই। ‘বাস’ চলাচলও থামিয়াছে। আবার সেই শেষ রাত্রে সাড়ে তিনটেয় ট্রেন। এই সময়টুকু তাহাদের ঘুমাইবার সময়।
দীননাথ ঘুমাইয়াছিল কিন্তু সুন্দরের চোখে সেদিন আর ঘুম আসিল না। রাস্তার ধারে গাছগুলোর উপর জ্যোৎস্নার আলো আসিয়া পড়িয়াছে। সুন্দর তাহার সেই ছোট্ট ঘরখানির একপাশে বিছানায় শুইয়া শুইয়া জানালার পথে সুদূর আকাশের সেই শুভ্র জ্যোৎস্নার পানে একদৃষ্টে তাকাইয়া বোধ করি তাহার রুক্মিণীর কথাই ভাবিতেছিল।
সাড়ে-তিনটা বাজিতে আর দেরি নাই। স্টেশনে টিকিটের ঘণ্টা পড়িল। ডিসটেন্ট সিগনাল ফেলিবার তারের শব্দ ঝন ঝন করিয়া কাঁপিতে কাঁপিতে তাহারই জানালার পাশ দিয়া পার হইয়া গেল। সুন্দরের আর শুইয়া থাকিবার উপায় নাই। উঠিয়া বসিয়া সে তাহার সবুজ বাতি জ্বালিল।
ট্রেন পার করিয়া ফিরিয়া আসিতেই দেখিল, গাড়ির শব্দে দীননাথের ঘুম ভাঙ্গিয়াছে।
সুন্দর জিজ্ঞাসা করিল, ‘জাগলে নাকি?’
দীননাথ বলিল, ‘হুঁ।’
সাড়ে-তিনটার গাড়ির শব্দে জাগা তাহার অভ্যাস হইয়া গেছে। এই সময়ে জাগিয়া আর তাহারা ঘুমায় না।
বাতিটি নিবাইয়া দিয়া সুন্দর তাহার বিছানায় গিয়া বসিতেই দীননাথ জিজ্ঞাসা করিল, তাই তাকে না আনাই ঠিক করলে সিংজি, না?’
সুন্দর একটি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বলিল, ‘ভোলোনি এখনও?’
দীননাথ জবাব দিল না।
সুন্দর বলিল, ‘বৌ-এর ভালবাসা পেয়েছ দীননাথ, আমার দুঃখ তুমি বুঝবে না। ধর, তোমার স্ত্রীকে তুমি খুব ভালবাসতে; এত ভালবাসতে যে, একদণ্ড চোখের আড়াল হলে মরে যেতে। তারপর হঠাৎ একদিন দেখলে তোমরা সেই স্ত্রী আর একজনকে ভালবাসে। স্বচক্ষে দেখলে। ভুলতে পার সে কথা?’
বলিয়া কিয়ৎক্ষণ সে চুপ করিয়া থাকিয়া কহিল, তাকে ভালবেসেই যদি সে সুখে থাকে তা থাকুক ভেবে তার কাছ থেকে আমি পালিয়ে গেলাম। দূরে গেলে ভেবেছিলাম তাকে ভুলে যাব, কিন্তু ভুলতে তাকে আজও পারিনি। আজও তাকে আমি তেমনি ভালবাসি। শুনেছিলাম তার কষ্ট হয়েছে, তাই টাকা পাঠাই। সে টাকা সে নেয়, কিন্তু চিঠিপত্রও লেখে না আসতেও চায় না। যাক, সে সব অনেক কথা দীননাথ, বলতে গেলে সারাটা জীবনেও ফুরোবে না। আর কটা দিনই বা বাঁচব। স্ত্রীর সেবা ভালবাসা না পেয়ে এতদিন যখন কাটিয়েছি, তখন আর বাকি কটা দিন কোন কষ্টই হবে না। তার কথা আমার কাছে মুখে আর বোলো না ভাই।
বলিয়া সুন্দর সিং তাহার বুকের বোঝা অনেকখানি হালকা করিয়া দিয়া আবার জ্যোৎস্নালোকিত ধরিত্রীর পানে একাগ্র মুগ্ধদৃষ্টিতে কিয়ৎক্ষণ তাকাইয়া থাকিতে থাকিতে রাত্রি জাগরণের ক্লান্তিবশতই বোধ করি হঠাৎ এক সময় চোখ বুজিয়া ঘুমাইয়া পড়িল।
সুন্দর সিং বলিয়াছিল, কটা দিনই বা বাঁচব।’
সত্যই যে বাঁচিবে না, দীননাথ তখন বিশ্বাস করে নাই।
কিন্তু তাহার পরের মাসেই তিনটি দিন মাত্র জ্বরে ভুগিয়া ‘রাম’ নাম করিতে করিতে দিব্য সজ্ঞানে দীননাথকে কাছে ডাকিয়া কোমর হইতে তাহার সঞ্চিত দু’শ দশ টাকার তোড়াটি তাহার হাতে তুলিয়া দিয়া ঠোটের ফাঁকে ম্লান একটু হাসি হাসিয়া সুন্দর সিং বলিল, ‘চললাম। রুক্মিণীকে একটা খবর দিও। আর ওই টাকা—’ বলিয়া হাতড়াইয়া দীননাথের একখানা হাত চাপিয়া ধরিয়া কাঁপিতে কাঁপিতে সে কি চমৎকার মৃত্যু!
এমনটি বোধ করি কেহ কখনও দেখে নাই।
কিন্তু টাকা সে কাহাকে দিয়া গেল? সুন্দর। সুন্দর! হায়, হায়, কে জবাব দিবে? সুন্দরের মৃতদেহ নিঃসাড়, নিস্পন্দ, নির্বাক।
দু’শ দশ টাকা নগদ।
এত টাকা একসঙ্গে দীননাথ তাহার জীবনে এই প্রথম পাইল। পাওয়া দূরের কথা, দেখিল এই প্রথম।
সে যাই হোক, এ-টাকা সুন্দর হয়ত রাখিয়াছিল তাহার রুক্মিণীর জন্য। সে যদি তাহার কাছে না থাকিত, হয়ত এ-টাকা সে মরিবার আগে তাহাকেই পাঠইয়া দিত। সুন্দর হয়ত ভাবিয়াছে— সে মরিয়া গেলে এ থাকিবে কোথায়, করিবে কি, খাইবেই বা কেমন করিয়া, তাই সে তাহার সারাজীবনের যাহা কিছু সঞ্চয় মৃত্যুর মুহূর্তে দয়া করিয়া তাহারই হাতে তুলিয়া দিয়া গেল। সত্যই কি সে তাহাকে দিয়া গেল? না, রুক্মিণীকে?
আসলে কিন্তু এ দু’শ টাকা রুক্মিণীরই পাওয়া উচিত। স্বামীর টাকার ভরসা স্ত্রী করিবে না ত করিবে কে?
আহা, বেচারী হয়ত কত কষ্টেই না দিন যাপন করিতেছে। মাসের শেষে হয়ত সে সুন্দর সিং-এর মনি অর্ডারের জন্য ব্যাকুল হইয়া ওঠে। পাঠাইতে দুদিন দেরি হইলে হয়ত তাহাকে উপবাস করিতে হয়।
দীননাথ ভাবিল, জীবনে তাহার যত কষ্টই হোক, সুন্দর সিং-এর টাকার সদ্ব্যবহার সে করিবে। তাহার মৃত্যুর এই নিদারুণ সংবাদটুকু শুধু নয়, সেই সঙ্গে এই টাকার তোড়াটিও সে নিজে গিয়া রুক্মিণীর কাছে পৌঁছাইয়া দিয়া আসিবে।
নিজে তার জায়গায় চার-ছ পয়সা গাঁজার খরচ, সে খরচ না হয় আনা-তিনেক— এই সামান্য চার পাঁচ আনা পয়সা ট্রেনে ট্রেনে ভিক্ষা করিয়া অনায়াসে সংগ্রহ করিতে পারিবে। না পারে উপবাস দিয়া পড়িয়া থাকিবে সেও ভালো, তবু এ টাকা সে নিজে লইতে পারিবে না।
স্টেশনের দালানে লোহার যে ওজন করিবার যন্ত্রটা পড়িয়াছিল দীননাথ সারাদিন সেইখানে পড়িয়া পড়িয়া ভাবিতে লাগিল। কিছু খাইল না। কোথাও গেল না, কি যে করিবে কিছুই ঠিক করিয়া উঠিতে পারিল না।
সঙ্গে যে গাঁজাটুকু ছিল, তাহাই খাইবার জন্য বৈকালে দীননাথ সেখান হইতে উঠিয়া টলিতে টলিতে ফটকের দিকে চলিতে লাগিল।
ফটকের কাজ বন্ধ থাকিলে চলে না। স্টেশনের একজন খালাসী সেখানে কাজ করিতেছিল।
তাহাদের সে ঘরখানি সেদিন খাঁ-খাঁ করিতেছে।
সুন্দর নাই। সুন্দর নাই। তাহারই সেই বন্ধু সুন্দর। তাহারই সেই সুখ-দুঃখের সহচর সুন্দর। … গত ত্রিশ বছর ধরিয়া যে এই ঘরখানি দখল করিয়া ছিল, একটি দিনের জন্যও যাহার সঙ্গছাড়া হয় নাই, একদিন যাহাকে না দেখিলে তাহার চলিত না, আজ তাহারই মৃতদেহ তাহারা শ্মশানে পুড়াইয়া দিয়া আসিয়াছে। মৃত্যুর পরপারে আজ সে কোথায়! কোথায় সে সুন্দর! কোথায় সে সুন্দর!
দীননাথের বুকের ভিতরটা হু-হু করিয়া উঠিল। গাঁজার কলিকা আনিতে গিয়া ঘরের ভিতর ঢুকিয়া সে আর নিজেকে কোনো প্রকারে সামলাইতে পারিল না, টস টস করিয়া চোখ দিয়া জল গড়াইয়া পড়িল এবং উচ্ছ্বসিত ক্রন্দনের বেগ আর রোধ করিতে না পারিয়া দুই হাতে মুখ ঢাকিয়া ছেলেমানুষের মত হো হো করিয়া কাঁদিতে কাঁদিতে মেঝের উপর শুইয়া পড়িল।
তাহার কান্না শুনিয়া বিশু খালাসী কাছে আসিয়া দাঁড়াইল। বলিল, ‘কেঁদো না দিনু, চুপ কর।’
বলিয়া সে তাহার গায়ে হাত দিয়া উঠাইবার চেষ্টা করিল।
কিয়ৎক্ষণ পরে কান্নার বেগ একটু কমিয়া আসিলে দীননাথ নিজেই উঠিল, উঠিয়া ঘরের এককোণে সুন্দর সিং-এর কাঠের বাক্স হইতে রুক্মিণীর একখানি বেয়ারিং চিঠি আনিয়া চোখ মুছিয়া বলিল, ‘বিশু, তুমি হিন্দী লেখা পড়তে জানো, না? ঠিকানাটি পড় দেখি?’
চিঠিখানি খুলিয়া বিশু অতিকষ্টে বানান করিয়া করিয়া রুক্মিণীর ঠিকানা পড়িল। দোবারি গাঁও, ডাকঘর সাসারাম।
বিশু মাধবপুরের বাহিরে কোনোদিন কোথাও যায় নাই। জিজ্ঞাসা করিল, ‘মোগলসরাই-এর কাছে সাসারাম ইস্টিশন আছে, দোবারি ওইখানেই কাছাকাছি কোথাও হবে। কেন দীননাথ, তুমি যাবে নাকি সেখানে?’
দীননাথ সে কথার কোনও জবাব না দিয়া অন্যমনস্ক হইয়া গাঁজা টিপিতে আরম্ভ করিল। হঠাৎ একসময় মুখ তুলিয়া বলিল, ‘দোবারি গাঁও। ইস্টিশনের নাম কি বললে?’
‘সাসারাম।’
দীননাথ দিয়াশলাই জ্বালিয়া টিকে ধরাইতে ধরাইতে ‘সাসারাম’ কথাটা বোধকরি মনে-মনে মুখস্থ করিবার চেষ্টা করিতে লাগিল।
.
সাসারাম স্টেশনে নামিয়া দীননাথ অতি কষ্টে ইহাকে উহাকে জিজ্ঞাসা করিয়া করিয়া সেই অপরিচিত বিদেশে বারে বারে পথ ভুলিয়া ভুলিয়া দোবারি গ্রামে যখন আসিয়া পৌঁছিল, তখন বেলা প্রায় বারোটা। মাথার উপর রৌদ্র ঝাঁঝাঁ করিতেছে। পিপাসায় ওষ্ঠাগত প্রাণ। পুরা দুটি দিন এক রকম অনাহারে বলিলেই হয়।
পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হিন্দুস্থানী গ্রাম। মাঝখানে সাদা ধুলার পথ। দুপাশে খোলার খাপরার বস্তি।
পথে যাহাকে দেখিতে পায়, দীননাথ তাহাকেই জিজ্ঞাসা করে। কেহ বা তাহার কথা বুঝিতে পারে না, কেহ বলে, রুক্মিণী বলিয়া কোনও মেয়ের সন্ধান তাহারা জানে না। সে হয়ত এ-গ্রামে
নয়, হয়ত অন্য কোথাও।
কিন্তু গ্রামখানি ছোট। দেখিতে দেখিতে অদ্ভুত এই বিদেশী বাঙ্গালীকে দেখিবার জন্য দীননাথের আশেপাশে লোক জড়ো হইয়া গেল। পথের ধারে একজায়গায় কয়েকটি মেয়ে একটা ইন্দারা হইতে জল তুলিতেছিল। দীননাথ হাত পাতিয়া তাহাদের কাছে গিয়া দাঁড়াইতেই দয়া করিয়া একটি মেয়ে তাহাকে জল খাওয়াইল।
জল খাইয়া একটু শান্ত প্রকৃতিস্থ হইয়া দীননাথ তাহাদেরই মধ্যে এক বৃদ্ধাকে কাছে ডাকিয়া এখানে তাহার আসিবার কারণ জানাইল। জানাইল সে আসিয়াছে—সুন্দর সিং-এর স্ত্রী রুক্মিণী দেবীর সহিত দেখা করিতে। দেখা তাহার না করিলেই নয়।
সুন্দর সিং-এর নাম করিতেই বৃদ্ধা চিনিল। হিন্দুস্থানী ভাষায় বলিল, ‘এসো’।
‘এসো!’ বলিয়া তাহার আগে আগে গ্রামের প্রান্তে ছোট একটি ঘরে গিয়া ঢুকিল। বলিল, ‘তুমি হিয়াই ঠারো।’ এবং আরও বলিল, যে, সে নিজেও এককালে বাংলা মুলুকে ছিল এবং সেইজন্যই বাঙ্গালা ভাষা সে বুঝিতে পারে, বাঙ্গালীদের বড় ভালবাসে।
বুড়ি ঘরে ঢুকিয়া আর বাহির হয় না।
দীননাথ দাঁড়াইয়া থাকিতে পারিতেছিল না, দেওয়ালের গায়ে যে ছায়াটুকু পড়িয়াছিল, সেইখানেই সে বসিয়া পড়িল।
অনেকক্ষণ পরে লাল রঙের ছাপা একখানা শাড়ি পরিয়া হিন্দুস্থানী স্বাস্থ্যবতী পরমাসুন্দরী এক যুবতী হাসিতে হাসিতে বাহির হইয়া আসিল। পশ্চাতে সেই বৃদ্ধা!
দীননাথ দেখিল—এই রুক্মিণী! চমৎকার!
ইহাকেই সুন্দর সিং যদি কষ্ট দিয়া থাকে তো অত্যন্ত অন্যায় করিয়াছে। সুন্দরের মৃত্যু-সংবাদটা যে ইহার কাছে সে কেমন করিয়া বলিবে, কে জানে। হাঁ করিয়া অবাক হইয়া তাহার মুখের পানে তাকাইয়া দীননাথ জিজ্ঞাসা করিল, ‘তুমিই রুক্মিণী?’
মেয়েটি মুচকি মুচকি হাসিতে লাগিল।
বুড়ি বলিল, ‘নেহি।’
এ রুক্মিণী নয়, রুক্মিণীর মেয়ে।
দীননাথ অবাক! মেয়ে কি রকম? সুন্দরের ছেলেমেয়ে তো কিছু হয় নাই!
তাহা হইলে সে ভুল করিয়াছে। এ-রুক্মিণী নয়। এ হয়ত অন্য কেউ।
এমন সময় তিন-চারটি ছোট ছোট ছেলেমেয়ে সঙ্গে লইয়া লোলচর্ম এক বৃদ্ধা বাহির হইয়া আসিল। আসিয়াই জিজ্ঞাসা করিল, ‘মাধবপুর হইতে কে আসিয়াছে?’
বৃদ্ধার মুখের মাধবপুরের নাম শুনিয়া দীননাথ একটুখানি আশ্বস্ত হইল। বলিল, ‘আমি এসেছি।’
যে বৃদ্ধা তাহাকে সঙ্গে করিয়া আনিয়াছিল, সে বলিল, ‘রুক্মিণী এরই নাম।’
কিন্তু হায় হায়, তাহার মনের মধ্যে যে সুন্দরী রুক্মিণী ছিল, সত্যকারের রুক্মিণীকে দেখিয়া সে ধারণা তাহার নিমেষে টুটিয়া গেল।
রুক্মিণী চোখে ভাল দেখিতে পায় না। দীননাথের মুখের কাছে মুখ লইয়া গিয়া প্রথমেই সে রীতিমত কটুকণ্ঠে নানা প্রশ্ন করিল, ‘মিনযে টাকা পাঠায় নাই কেন? সেই গাঁজাখোর, লক্ষ্মীছাড়া?
দীননাথ স্তব্ধ, নির্বাক।
তাহাকে চুপ করিয়া থাকিতে দেখিয়া রুক্মিণী দেবী ক্রমশ ভীষণ মূর্তি ধারণ করিলেন। সুন্দর সিং-এর চতুর্দশ পুরুষ উদ্ধার করিয়া দিয়া সেই মৃত ব্রাহ্মণের উদ্দেশে যে সব ভাবা প্রয়োগ করিতে লাগিলেন, তাহা হিন্দুস্থানী না হইলেও দীননাথ বুঝিতে পারিল।
ছি! ছি! ইহারই জন্য সুন্দর এত কষ্ট করিয়াছে! ইহারই জন্য সে নিজে অনাহারে অনিদ্রায় এই বিদেশে-বিভুঁয়ে আসিয়া এত নির্যাতন সহ্য করিল!
দীননাথ হাতের ইসারা করিয়া বলিল, ‘থাক, আর না।’
‘কেয়া?’ বলিয়া রুক্মিণী হাততালি দিয়া রুখিয়া তাহাকে যেন মারিতে উঠিল। এবং তাহার নিজের ভাষায় যাহা বলিল তাহার ভাবার্থ এই যে স্ত্রী তাহার ভালভাবে আছে কি না, গোপনে তাহাই দেখিবার জন্য লোক পাঠানো হইয়াছে! লোকের মুখে মারি সাত ঝাঁটা। তার মুখে মারিই! আহা, কি আমার গুণের সোয়ামী গো! তাকে বলিস গিয়ে সে নাতির নাতনী লইয়া সে বেশ সুখেই ঘরকন্না করিতেছে, গাঁজাখোর নচ্ছার সে পাজি বদমায়েসের তোয়াক্কা সে করে না। তাহাতে টাকা যদি সে না পাঠায় তোনা পাঠাইবে, তাহার টাকার আমি—ইত্যাদি ইত্যাদি।
আর এক বৃদ্ধা এই বৃদ্ধার কাছে আগাইয়া আসিয়া কানে কানে কি যেন বলিল, এবং বলিবামাত্র যাদুমন্ত্রের মত রুক্মিণী একবার এদিক-ওদিক তাকাইয়া তৎক্ষণাৎ চুপ করিল।
রুক্মিণী চুপ করিয়া সরিয়া দাঁড়াইল। বুড়ি দীননাথের কাছে আসিয়া মুখের কাছে হতা নাড়িয়া ধরিয়া ধরিয়া একটি একটি করিয়া বুঝাইয়া বলিল যে, তুমি আসিয়াছ ভালই হইয়াছে, রুক্মিণী তোমার যাওয়া আসার গাড়ি ভাড়া দিবে, কিন্তু বাবা একটি কাজ তোমার না করিলেই নয়। ও বুড়ি হইয়াছে কিন্তু এখনও উহার বুদ্ধি হয় নাই। উহার ছেলেমেয়ে নাতি নাতনীর কথা কিছুই তুমি সুন্দরকে বলিতে পাইবে না। বলিবে, সে একলাই আছে, বড় দুঃখে আছে, এবং মাসে মাসে যেমন পাঠাইতেছে তেমনি করিয়া টাকা যেন সে পাঠায়।
কথাটা তাহার তখনও শেষ হয় নাই। রুক্মিণী অনেক চিৎকার করিয়া মাটিতে বসিয়া ছোট একটি ঢিল লইয়া ধুলার উপর আঁচড় কাটিতেছিল। ঘাড় নাড়িয়া বলিয়া উঠিল, ‘নেহি। দশো রোপিয়ামে হোগা নেহি, পন্দরো রোপিয়া ভেজনে বোলো।’
কথাটা শুনিয়া দীননাথের সর্বাঙ্গ রী রী করিয়া উঠিল। কাজ নাই আর সুন্দরের প্রণয়িনীকে দেখিয়া।
টাকা?
টাকার কথা মনে হইতেই দীননাথ হাসিল। ইহাকে টাকা দিয়া সুন্দর সিং-এর অপমান করিতে সে পারিবে না। টাকা সে যেখান হইতে আনিয়াছে, সেইখানেই ফিরাইয়া লইয়া যাইবে।
সুন্দরের মৃত্যু-সংবাদটি পর্যন্ত ইহাদের কাছে বলিতে তাহার ঘৃণাবোধ হইল।
না, সে মরে নাই।
এই সব অনাত্মীয় শত্রুর কাছে তাহার না মরাই ভালো। থাক, সে বাঁচিয়াই থাক।
স্টেশনে যাইবার জন্য দীননাথ উঠিল। কিন্তু বুড়ি মাগী তাহার সঙ্গ ছাড়িল না। তাহাদের বিশ্বাস, সুন্দর সিং এতদিন পরে ইহাকে এখানে গোয়েন্দাগিরি করিতে পাঠাইয়াছে। তাই সে গ্রামের বাহির পর্যন্ত দীননাথকে শুধু এই কথাই বলিতে বলিতে গেল যে, সে যেন সুন্দর সিংকে রুক্মিণীর ছেলেমেয়ে নাতি-নাতনীর সম্বন্ধে কিছু না বলে, এবং গিয়াই যেন টাকা পাঠাইয়া দেয়
দীননাথ আবার মাধবপুর ফিরিয়া আসিল।
কিন্তু সুন্দর সিংকে যে তাহার একান্ত প্রয়োজন।
তাহার দেওয়া টাকাগুলি যে কি করিবে, কোথায় রাখিবে, কাহাকে দিবে—সুন্দর আজ যদি তাহাকে না বলিয়া দেয়, সে নিরুপায়।
ওই টাকাই হইল তাহার কাল। ওই টাকাই হইল তাহার বোঝা।
দীননাথ আবার সেই স্টেশনের ওজন-যন্ত্রটার উপর শুইয়াছিল, স্টেশনমাস্টার দয়া করিয়া বলিলেন, ‘ফিরে এসেছ দীননাথ, সারাদিন কিছু খাওনি বুঝি?’
দীননাথ বলিল, ‘আজ্ঞে না।’
‘কি করবে ভাবছ?’
আজ্ঞে, ও ফটকের কাজটি আমায় দিন।
কিন্তু ফটকে তখন লোক বহাল হইয়াছে। মাস্টারমশাই বলিলেন, ‘তা তো হয় না দীননাথ, লোক যে আমি রেখেছি। আচ্ছা, থাকো তুমি এইখানে; তারপর দেখা যাবে।’
বলিয়া তিনি তাহার হাতে একখানি চিঠি দিয়া তাঁহার বাসায় যাইতে বলিলেন।
চিঠিখানি মাস্টারমশাই-এর স্ত্রীর হাতে দিতেই তিনি অত্যন্ত যত্ন করিয়া দীননাথকে খাওয়াইতে বসাইলেন।
ভাত সে আজ চারদিন খায় নাই, চিঁড়া-মুড়ি খাইয়া দিন কাটাইয়াছে। ভাবিয়াছিল, ভাল করিয়া খাইবে। কিন্তু খাইতে বসাইয়া মাস্টারমশাইয়ের স্ত্রী জিজ্ঞাসা করিলেন, তুমি কি করছ দীননাথ? ‘
‘কিছুই করছি না, মা।’
‘কি করে খাবে, ভেবেছ?’
‘ফটকের চাকরিটি তো চাইলাম বাবুর কাছে। যদি পাই তো, ভালই, নইলে ট্রেনে-ট্রেনে ভিক্ষে করব মা। একটা পেট—তাতেই চলে যাবে।’
কিয়ৎক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া তিনি হঠাৎ জিজ্ঞাসা করিয়া বসিলেন, ‘শুনলাম, তুমি সুন্দর সিং-এর বাড়ি গিয়েছিলে দীননাথ?’
‘হ্যাঁ মা, গিয়েছিলাম।’
‘বৌ আছে শুনলাম। ছেলেমেয়ে কটি?’
দীননাথ ভাতের গ্রাসটা গিলিয়া একটু থামিয়া বলিল, ‘তা ঠিক জানি না মা, গেলাম আর চলে এলাম।’
‘খবরটা শুনে বৌ খুব কাঁদছিল, না? কাঁদবেই তো। কাঁদবে না।—ও কি দীননাথ! খাওয়া তোমার হয়ে গেল এরই মধ্যে? কিছুই যে খেলে না।’
দীননাথের খাওয়া সত্যই হইল না। তাড়াতাড়ি উঠিয়া জায়গাটা গোবর দিয়া পরিষ্কার করিল। সেখান হইতে পলাইতে পারিলে সে যেন বাঁচে।
দীননাথের বিশ্বাস—মানুষ মরিলে ভূত হয় এবং ভূত হইয়া যেখানে-সেখানে ঘুরিয়া বেড়ায়। এই ভূতের ভয়ে অন্ধকার দেখিলেই সে আঁৎকিয়া ওঠে। সেদিন সে ফটকের কাছে গাঁজা খাইতে গিয়া নূতন ফটকওয়ালা রামধনীর সঙ্গে গল্প করিতেছিল।
গল্প করিতে করিতে সন্ধ্যা হইয়া আসিল।
রামধনী বলিল, ‘একটু বসো ভাই দীনু, আমি চট করে আসি স্টেশন থেকে।’ আগে সে এক প্রস্তাবে রাজি কিছুতেই হইত না, কিন্তু সেদিন তাহার কি মনে হইল, কে জানে। বলিল, ‘এসো!’
কিন্তু রামধনী আর আসে না।
অন্ধকার ক্রমশ গাঢ় হইতে থাকে। মোটর বাসগুলা হইবার পর এ-পথে পায়ে-চলা লোকের সংখ্যা একরকম নাই বলিলেই হয়। সশব্দে একটা ‘বাস’ পার হইবার পরেই চারিদিক আবার নিস্তব্ধ হইয়া ওঠে। আগাছার জঙ্গলে ভরা রাস্তার দুপাশে বাঁশের ঝাড়। শব্দের মধ্যে শুধু একবার জোরে বাতাস বহিলে লম্বা বাঁশগুলা দুলিয়া দুলিয়া কট কট করিতে থাকে। কদাচিৎ দু-একটা শেয়াল হয় তো শুকনো বাঁশপাতার উপর দিয়া হাঁটিয়া যায়।
দীননাথ একাকী সেই ফটকের পাশে অন্ধকারে চুপ করিয়া বসিয়া বসিয়া সুন্দরের আগমন প্রতীক্ষা করে।
সুন্দর আসিবে।… তাহার সেই বহুকালের বন্ধু সুন্দর!
অনেক কথা তাহাকে বলিবার আছে। তাহার রুক্মিণীর কাছে সে গিয়াছিল। স্বচক্ষে তাহাকে সে দেখিয়া আসিয়াছে। টাকা সে তাহাকে দেয় নাই। না দিয়া ফিরাইয়া আনিয়াছে। ভাল করিয়াছে কি মন্দ করিয়াছে তাহাও জিজ্ঞাসা করিবে। এখন সে সুন্দরের টাকা সুন্দরের হাতেই ফিরাইয়া দিতে চায়…
দীননাথ গাঁজা বাহির করিয়া হাতের তালুতে রাখিয়া তৈরি করিতে লাগিল। কতদিন একসঙ্গে বসিয়া গাঁজা তাহারা খায় নাই! ঠিক এই জায়গাটিতে বসিয়া সুন্দর কবে তাহার সহিত কি রকম ভাবে কি কথা বলিতে বলিতে শেষ গাঁজা টানিয়াছে দীননাথের তাহা মনে পড়িল।
বাতাসে একটা শব্দ হইতেই দীননাথ অন্ধকারে সেইদিকে তাকাইয়া ডাকিল, ‘সুন্দর!’
কোনো জবাব নেই।
নিজের কথাটাই তাহার নিজের কাছে কেমন যেন অপরিচিত বলিয়া মনে হইল।
ভাল করিয়া একদৃষ্টে তাকাইয়া দেখিল, সুন্দর নয়, ছোট একটা চামচিকে বাতাসে ডানা ঝাপটা মারিয়া উড়িয়া উড়িয়া মশা ধরিতেছে।
বহুক্ষণ পরে রামধনী ফিরিয়া আসিল। সুন্দর আসিল না।
.
দীননাথ আজকাল যেন একটু পাগলের মত হইয়া গেছে। মাথার চুল উস্কো-খুস্কো, অযথা বাড়িয়া চলিয়াছে। পাকা পাকা চারটিখানি দাড়ি গজাইয়াছে। চব্বিশ ঘণ্টা বিড় বিড় করিয়া আপন-মনে কাহার সঙ্গে কি কথা কয়, কে জানে। ডাকিলে জবাব দেয় না, অনেক কষ্টে যদি-বা সাড়া পাওয়া যায় তো এক কথা বলিলে আর এক কথা বলিয়া বসে।
প্ল্যাটফর্মে ট্রেন আসিয়া দাঁড়াইলে দীননাথও জানালার কাছে গিয়া দাঁড়ায়। জানালায় জানালায় হাত পাতিয়া যা পায়, তাহাতেই তাহার দিন চলে। –
রান্না সে কোনোদিনই করে না। দয়া করিয়া কেহ যদি কদাচিৎ তাহাকে ডাকিয়া চারটি রাঁধা ভাত খাইতে দেয় তো খায়, তাহা না পাইলে অধিকাংশ দিন তাহার মুড়ি খাইয়াই কাটে।
রাত্রে সে প্রায়ই রামধনী ফটক-ওয়ালার কাছে পড়িয়া থাকে।
এক…একদিন বলে, ‘রামধনী, তুমি ঘুমোও।’
বলিয়া তাহাকে ঘুম পাড়াইয়া লাইনের ধারে বসিয়া ক্রমাগত গাঁজা টানে আর রাত্রি জাগে।
ট্রেন আসিবার সময় সুন্দর যেমন করিয়া ঠিক যে জায়গাটিতে গিয়া দাঁড়াইত, সেও ঠিক তেমনি করিয়া এক হাতে ঝাণ্ডা এক হাতে বাতি লইয়া গিয়া দাঁড়ায়।
সব চেয়ে মজার ব্যাপার এই যে, যে দীননাথ অন্ধকার হইলে বাড়ির বাহির হইত না, সেই দীননাথের ভয় যেন আর একেবারেই নাই।
মানুষের ভয় যেখানে সব চেয়ে বেশি হইবার কথা, দীননাথ তাহার গাঁজার কলিকাটিতে আগুন চড়াইয়া সেইখানে গিয়া চুপ করিয়া বসে। অন্ধকারে কোথাও খুড়ুক করিয়া শব্দ হইলে অমনি সেইখানে ছুটিয়া যায়। চুপিচুপি ডাকে, ‘সুন্দর!’
তাহার পর বৃথাই প্রতীক্ষা করিয়া করিয়া দেখা যখন মিলে না, তখন চোখ দিয়া দর্ দর্ করিয়া জল গড়াইয়া পড়ে। কাঁদিতে কাঁদিতে বলে, ‘হয় তুমি এসো সুন্দর, নয় তোমার কাছে আমায় নিয়ে যাও।’
আজকাল অমাবস্যার গভীর রাত্রে সে শ্মশানে যাইতে আরম্ভ করিয়াছে।
সেইখানেই বসিয়া সে গাঁজা খায় আর সুন্দরের প্রতীক্ষা করে।
তাহার বিশ্বাস, সুন্দর আসিবেই!
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন