শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়
অনেকদিন আগেকার কথা বলছি। সে দিনগুলো আর নেই। তখনকার দিনের মানুষগুলোকেও আর দেখা যায় না।
আমাদের গ্রামের পাশের গ্রামটার নাম ছিল সাতা। সেই সান্তা গ্রামটা এখনও আছে, কিন্তু সাতার নন্দীবাড়ি আর নেই।
নন্দীবাড়ি মানে নন্দীদের বাড়ি। নন্দীবাড়ির নাম তখন সবাই জানতো। জানতো মাত্র একটি মানুষের জন্যে। সে মানুষটির নাম ছিল ন্যাড়া নন্দী। ন্যাড়া নাম, অথচ মাথায় ছিল তার ঝাকড়া-ঝাঁকড়া চুল, মুখে ছিল একমুখ দাড়ি আর গোঁফ। থ্যাবড়ামত একটা নাক আর গোল গোল বড় বড় দুটো চোখ ছাড়া আর কিছু দেখা যেতো না। তার ওপর গায়ের রংটা ছিল কালো, হাতে পায়ে বুকে পেটে আর পিঠে ছিল বড় বড় লোম। বেঁটেখাটো মোটাসোটা মানুষটা যখন রাস্তা দিয়ে আসতো তখন মনে হতো যেন একটা ভল্লুক আসছে।
ভয়ে আমরা কেউ তার পাশ ঘেঁষতাম না। ভয় শুধু তার চেহারার জন্যেই নয়। শুনেছিলাম নাকি ন্যাড়া নন্দী ভূত নামায়। ভূতের সঙ্গে কথা বলে। এই জন্যেই নন্দীবাড়ির নাকি এত নামডাক। সবাই বলে, নন্দীবাড়ি মানেই ভূতের বাড়ি।
তারপর বয়স যখন হলো তখন সবই বুঝলাম।
ভূত নামানো—সে যে কী ভয়াবহ কাণ্ড, যারা চোখে না দেখেছে তারা বিশ্বাস করবে না।
চোখে দেখার সৌভাগ্য অবশ্য সকলের হয় না। যে-সব মেয়ের ছেলে হয় না, যাদের ছেলে হয় আর মরে মরে যায়, যারা কোনও দুরারোগ্য ব্যাধিতে ভুগছে—সেই সব মেয়েরাই শুধু দেখতে পায়। কোনও পুরুষ-ব্যাটাছেলের সেখানে যাবার উপায় নেই।
ন্যাড়া নন্দী আমার দাদাকে বলেছিল, ‘হ্যাঁ বাবা, এই আমার ছেলের হুকুম।’
ন্যাড়া নন্দীর বড় ছেলে বিশু মরেছিল গলায় দড়ি দিয়ে। অমাবস্যার গভীর রাত্রে সেই ছেলে আসে ভূত হয়ে।
আমার এক মাসতুতো বোন নিরুর বিয়ে হয়েছে অনেকদিন। ছেলেপুলে হয়নি বলে মাসী তাকে পাঠিয়েছিল সাতায় ন্যাড়া নন্দীর বাড়িতে। ভূতের দেওয়া একটা গাছের শিকড় তামার মাদুলিতে পুরে বাঁহাতে বেঁধে রেখেছিল নিরু। বছর ঘুরতে না ঘুরতে তার ছেলে হলো। সেই ছেলেকে কোলে নিয়ে হাসতে হাসতে নিরু এলো ন্যাড়া নন্দীকে তার কৃতজ্ঞতা জানাতে। ন্যাড়ার জন্যে পঁচিশটি টাকা আর তার দুই ছেলে শশী আর কাশীর জন্যে দু’জোড়া নতুন ধুতি।
আমার দাদা ন্যাড়ার ওপর হাড়ে চটা। হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করলে, ‘আর ভূতের জন্যে কী এনেছিস নিরু?’
‘তোমার সবেতেই অবিশ্বাস দাদা। ওরকম করে বোলো না। পাপ হবে।’
‘হয় হবে আমার হবে, ব্যাটা বুজরুক।’
‘বুজরুক তো এই এত এত মেয়ে যাচ্ছে ওর কাছে, যাকে যা বলছে তাই হচ্ছে, এই যে আমার খোকা হলো, এর কি কোনও মানে নেই?’
দাদা বললে, মানে শুধু যাদের লেগে যায় তাদের কাছে। যাদের লাগে না তারা আর ও-পথ মাড়ায় না। চুপচাপ থেকে যায়।’
নিরু বললে, ‘আমি ভাল বলছি দাদা, বৌদিকে তুমি একবার পাঠিয়ে দাও নন্দীবাড়িতে।’
দাদা বললে, ‘কেন?’
‘বৌদি, যে ভুগছে এতদিন ধরে—যা খাচ্ছে বমি হয়ে যাচ্ছে, পেটের যন্ত্রণায় ছট্ফট করছে। ওর অম্বলশূলের ব্যারাম হয়েছে দাদা। এখনও বলছি তুমি বৌদিকে পাঠিয়ে দাও নন্দীবাড়িতে। ভাল হয়ে যাবে।’
‘না না, ওর অম্বলশুল নয়।’ –দাদা হেসেই উড়িয়ে দিলে কথাটা। —’কোরেজি ওষুধে ওর যদি ভাল না হয় তো তোর ওই ভূতের ওষুধে ভাল হবে না।’
.
ন্যাড়া নন্দীর এতদিনের ভূত নামানো কারবার—তাও একদিন বন্ধ হয়ে গেল। ন্যাড়া একদিন সত্যিই ন্যাড়া হলো। চুল দাড়ি কামিয়ে নাড়ু গোপালটি হয়ে ঘুরে বেড়াতে লাগলো।
‘বেশ তো চলছিল নেড়ু, রোজগার তো মন্দ হচ্ছিল না, তা কারবারটি বন্ধ করে দিলে কেন?’
নেডু বলে, ‘আমার তিনটে ছেলের মধ্যে বড়টা মরে ভূত হয়েছে, এইবার বাকি দুটো মরুক, একসঙ্গে তিনটে ভূত নাচাবো।’
সবাই ভাবলে ‘লোকটা বুঝি পাগল হয়ে গেছে। আমি কিন্তু জানি পাগল সে হয়নি।
.
ন্যাড়া নন্দীর অসুখ করেছিল। ভেবেছিল – অমাবস্যার আগে সেরে যাবে। কিন্তু সারলো না। অমাবস্যা এসে পড়লো। অনেক দূরের দূরের গ্রাম থেকে মেয়েরা সব এসে গেছে। ভূত নামাতেই হবে।
ন্যাড়া তার দুই ছেলে শশী কাশীকে ডেকে বললে, ‘আমাকে ধরে ধরে নিয়ে চল—ঘরে নিয়ে গিয়ে বসিয়ে দে। কাজ আমি ঠিক চালিয়ে দেবো।’
শশী ধরলে একহাতে, কাশী ধরলে একহাতে। ধরাধরি করে বাপকে নিয়ে গিয়ে বসিয়ে দিলে ভূত নামাবার জায়গায়।
বড় একটা টিনের ঘর। টিম টিম করে একটা প্রদীপ জ্বলছে। প্রদীপটাকে আড়াল করে একটা কাপড় টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছে। এদিকে একটা ঘটের ওপর আমের শাখা। চারিদিকে ফুল বেলপাতা ছড়ানো। দুটো বড় বড় ধুনুচিতে ধূপের ধোঁয়া উঠছে।
বাপের কাছাকাছি ঘরের মেঝের ওপর একা চট বিছিয়ে আপাদমস্তক কাপড় মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লো ছোট ছেলে কাশী। আর এক ছেলে শশী লণ্ঠনটা নিবিয়ে দিয়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।
একে অমাবস্যার গভীর রাত্রি, তার ওপর আলোটা দিলে নিবিয়ে। চারিদিক গভীর অন্ধকার।
কাছেই নদীর তীরে শ্মশান। সেখানে শেয়াল ডাকছে।
ন্যাড়ার শরীর অসুস্থ, তবু তার হুঙ্কারের বিরাম নেই। ঘরের একদিকে মেয়েরা শিউরে শিউরে উঠছে।
ন্যাড়া বলছে ‘আয় বাবা বিশু, তাড়াতাড়ি আয়। মেয়েরা সব বসে আছে তোর জন্যে। ওই দ্যাখ তোর ছোট ভাই কাশী শুয়ে আছে। ওর ভেতরে এসে ঢোক। দেরি করিসনে, আমার শরীর ভাল নয়।’
চড় চড় কড় কড় করে মেঘ ডাকা আওয়াজের মত মাথার ওপর ঘরের টিনে আওয়াজ হলো।
ন্যাড়া বললে, ‘ওই এসেছে।’
টিনের আওয়াজ যেই থামলো, অমনি এক বীভৎস বিকট চীৎকার। শুয়ে শুয়ে কাশী চেঁচাচ্ছে। মেয়েরা তখন ভয়ে একেবারে কাঠ হয়ে গেছে।
একে একে মেয়েদের ডাক পড়লো। ভয়ে ভয়ে এগিয়ে এলো একে একে।
‘কী চাই?’
মনে হলো যেন আগাগোড়া কাপড় মুড়ি দিয়ে শুয়ে শুয়ে কাশী বলছে। কিন্তু এ কি মানুষের গলার আওয়াজ?
ন্যাড়া বলে দিলে, ‘বল মা তোমার কি চাই?’ আমার বিশু জিজ্ঞাসা করছে। কাশীর শরীরের ভেতর বিশু এসে ঢুকেছে। লজ্জা করো না, বল।’
মেয়েটি বললে, ‘ছেলে।’
‘টাঁকা দাঁও।’
‘এই যে বাবা পাঁচটি টাকা দিচ্ছি।’
‘পাঁচ টাঁকায় ছেঁলে পাঁওয়া যাঁয় নাঁ, দঁশ টাঁকা রাখো।
ভয়ে ভয়ে আরও পাঁচটি টাকা রাখলে মেয়েটি।
‘কাঁপড় কঁই?—কাঁপড়?’
কাপড় তো আনিনি বাবা।’
এঁনে দিঁও। কাঁপড় দিঁতে হঁয়।’
‘দেবো বাবা।’
টুপ করে একটি শেকড় পড়লো তার হাতের কাছে।
‘তাঁমার মাঁদুলিতে পুঁরে এঁইটি ধাঁরণ কঁরবে বাঁ হাঁতে।— যাঁও।’
এমনি করে একের পর এক। অনেকগুলো টাকা জমলো ন্যাড়া নন্দীর হাতের কাছে। অনেকগুলো ধুতি আর পাটের জোড়।
অসুস্থ দেহ নিয়ে ন্যাড়া নন্দী ভাল করে কথা বলতে পারছিল না। কথাগুলো তার জড়িয়ে জড়িয়ে যাচ্ছিল।
হঠাৎ সে শুয়ে পড়লো সেইখানে। মুখ দিয়ে আর কথা বেরুলো না। তখনও কয়েকজন মেয়ের কাজ বাকি। ঘরের মধ্যে কেমন যেন একটা থমথমে ভাব। এমন সময় ধুপ করে একটা আওয়াজ হলো ঘরের বাইরে। তারপর একটা লণ্ঠন হাতে নিয়ে ঘরে ঢুকলো ন্যাড়ার মেজ ছেলে শশী। প্রথমেই সে মেয়েগুলোকে তাড়িয়ে দিলে ঘর থেকে।
—’যাও তোমরা। আজ আর কিছু হবে না। আর একদিন এসো।’
কাশী তখন উঠে বসেছে।
শশী বললে, ‘খবরদার তুই টাকায় হাত দিবি না কেশে। টাকা আমি ভাগ করবো।’
কাশী বললে, ‘তুই নেমে এলি কেন বল। কাজ তো এখনও শেষ হয়নি।’
শশী বললে, ‘এদিককার কাজ তো শেষ হয়ে গেছে। ওই দ্যাখ বাবা মরে গেছে।’
কাশী তাকিয়ে দেখলে বাপের দিকে।
ন্যাড়া তখন হাতও তুলতে পারছে না, চেঁচাতেও পারছে না। ক্ষীণকণ্ঠে বলছে, ‘ওরে আমি মরিনি। তোরা থাম।’
শশী তাকে ধমক দিলে, ‘তুমি থামো। তুমি মরছো মর, আমরা একটা ফয়সালা করে নিই।’
.
আপনারা হয়ত বলবেন—পুরুষছেলের তো সেখানে যাবার উপায় নেই, আপনি ও-সব জানলেন কেমন করে।
কেমন করে জানলাম সেই কথাই বলি।
পুজোর সময় থিয়েটার করবো। রাত জেগে আমরা রিহার্সাল দিচ্ছিলাম। করুণা কোত্থেকে খবর নিয়ে এলো—সামৃতার ন্যাড়া নন্দী হঠাৎ মারা গেছে। চল দেখে আসি।’
বললাম, ‘আজ তো অমাবস্যা। আজ ওর ভূত নামাবার দিন। ‘
‘তা হোক চল। মজাটা দেখি।’
গেলাম মজা দেখতে। অন্ধকারে মরি বাঁচি করে ছুটলাম সামতায়। নন্দীবাড়িতে গিয়ে দেখি—শশী কাশীর ঝগড়া তখনও থামেনি। শশীর হাতে একটা ডাণ্ডা। কাশীর বগলে নতুন কাপড়ের বোঝা।
কাশী বলছে, ‘বাবার টাকাকড়ি যা কিছু আছে সব তিন ভাগ হবে। এক ভাগ দাদার, এক ভাগ তোর, এক ভাগ আমার।
শশী বলছে, ‘দাদা তো মরে গেছে।’
কাশী বলছে, ‘সেই দাদার ভূত তো আমি। দাদার ভাগ আমি নেবো।’
‘তুই দুভাগ নিবি?’
‘নিশ্চয় নেবো। কষ্ট তো আমিই করি। তুই কী করিস? দুবার টিনের আওয়াজ করিস শুধু। একবার ভূত আসবার সময়, একবার যাবার সময়।’
ন্যাড়া নন্দী তখনও মরেনি। শুয়ে আছে তখনও। উঠতে পারছে না। শুয়ে শুয়েই বলছে, ‘ওরে তোরা থাম। লোকে শুনতে পাবে যে।’
শশী চেঁচিয়ে উঠলো, শুনুক। তাই বলে কেশে দুভাগ নেবে?
‘ভাগাভাগি পরে করিস, আমি তো এখনও মরিনি।’
শশী বললে, ‘আজ না মরো, কাল তো মরবে।’
ন্যাড়া বললে, ‘তার চেয়ে তোরা দুইজন মর। তিনটে ভূতের জন্ম দিয়েছিলাম আমি। সেই তিনটে ভূতকেই নাচাবো।
শশী তার হাতের ডাণ্ডাটা তুলে ধরলে তার বাপের মাথার ওপর। বললে, ‘দ্যাখো না কে কাকে নাচায়! দেখবে?’
.
‘ওরা দেখুক। চলো আমরা পালাই।’
করুণাকে নিয়ে পালিয়ে আসছিলাম। দেখি না অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে একটি মেয়ে। বললাম, ‘কে?’
‘আমি।’
গলার আওয়াজ শুনেই চিনলাম—আমার বৌদিদি।
‘তুমি এখানে? ‘
বৌদি বললে, ‘অম্বলশূলের ওষুধ নিতে পাঠিয়েছিল তোমার দাদা।’
দাদা যে এ-সবে বিশ্বাস করে না। বলে- ন্যাড়া বুজরুক।
বৌদি বললে, ‘তোমার দাদাই তো চুপিচুপি আমাকে পৌঁছে দিয়ে গেল। বললে, ঠিক সময়ে এসে তোমাকে নিয়ে যাব। দ্যাখো না কেমন আক্কেল। এদিকে শশে ছোঁড়াটা দিলে আমাদের তাড়িয়ে।’
বৌদির কাছেই সব শুনলাম।
জিজ্ঞাসা করলাম, ‘ওষুধ দিয়েছে নাকি?’
বৌদি বললে, ‘হ্যাঁ। পাঁচটা টাকা নিয়ে এই দ্যাখো একটা শেকড় দিয়েছে। বেটে খেতে হবে।
বললাম, ‘না, আর খেতে হবে না। শেকড়টা ফেলে দাও।’
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন