শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়
আজ যে গল্পটি তোমাদের বলতে বসেছি, সেরকম ঘটনা পৃথিবীতে বড় একটা ঘটে না। ঘটেছিল মাত্র আমারই জীবনে।
তোমাদের মনে হয়ত নাও থাকতে পারে, কারণ তোমরা ছিলে তখন নিতান্ত ছোট। তেরশ’ তিরিশ সালের কথা। তেরশ’ তিরিশ সালের শ্রাবণ মাসের তেরো তারিখে কলকাতার বাংলা, ইংরাজি, সমস্ত খবরের কাগজেই বড়-বড় অক্ষরে এই রোমাঞ্চকর সংবাদটি ছাপা হয়েছিল, এবং এই সংবাদটি নিয়ে ভারতবর্ষের এমন কোনও জায়গা নেই, যেখানে না আলোচনা চলেছে।
কলকাতা, বোম্বাই, লাহোর আর মাদ্রাজ—এই চারটি শহরে চারিটি গুপ্ত-সমিতি আছে। সে সমিতির খবর তোমরা কেউ জানো না। শুধু তোমরা কেন, অনেকেই জানে না। এই সমিতিগুলির কাজ কী জানো? এই সব সমিতির যাঁরা সভ্য, তাঁরা অন্ধকার রাতে নির্জন কক্ষে বসে নানারকমের যন্ত্রপাতি নিয়ে ভূত নামান। মানুষের মৃত্যুর পর সেই মরা মানুষটিকে তোমরা স্বচক্ষে যদি কেউ দেখতে চাও তো, এই সমিতির মধ্যে ঢুকতে হবে। সেখানে ঢোকা অবশ্য বড় শক্ত, কারণ বাইরের কোনও লোক ইচ্ছে করলেই অমনি চট করে এসব সমিতির সভ্যশ্রেণীভুক্ত হতে পারেন না। সে সব অনেক হাঙ্গামা। যাকগে, সেখানে তোমাদের ঢুকেও কাজ নেই। যে-সব কাজ তাঁরা করেন, সে-সব দেখলে তোমরা ভয়ে আঁতকে উঠবে।
এই যে জীবন্ত মানুষের জগৎ, —যেখানে আমরা চলে ফিরে বেড়াচ্ছি, এ জগতের সঙ্গে তাঁদের কারবার একরকম নেই বললেই হয়, – তাদের কারবার শুধু মরা মানুষের সঙ্গে। যে-সব মানুষ মরে গেছে, আমরা তাদের দেখতে পাইনে; কিন্তু তাঁরা দেখতে পান। শুধু দেখা নয়, তাদের সঙ্গে রীতিমত কথাবার্তা চলে, তাদের দিয়ে কত কাজ করিয়ে নেওয়া হয়।
আমার জীবনের সেই অদ্ভুত ঘটনাটি ঘটবার আগে পর্যন্ত এইসব গুপ্ত-সমিতির কথা আমি মোটেই জানতাম না। কেমন করেই বা জানব? কিন্তু খবরের কাগজে বেরিয়ে যাবার দিনকয়েক পরেই কলকাতার একটি সমিতি থেকে একখানি চিঠি পেলাম। দেখলাম, চিঠিখানি এসেছে…নং…স্ট্রিট থেকে। লিখেছেন—আপনি যদি দয়া করে আগামী বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় (৬টার পরে ৭টার মধ্যে) আমাদের সমিতি-গৃহে একবার আসতে পারেন তো বড় ভাল হয়।
.
বৃহস্পতিবার দিন সন্ধ্যায় বাড়ির নম্বর খুঁজে খুঁজে তো গেলাম সেখানে। প্রকাণ্ড একখানা বাড়ি—বহুদিনের পুরানো। চুন-সুরকি খসে গিয়ে ইটগুলো যেন দাঁত বের করে আছে। বাড়িতে যে মানুষ বাস করে, দেখে তা মনে হল না। দরজার কড়া নাড়তে গিয়ে দেখি—দরজা আছে, কিন্তু কড়ার বালাই নেই। সেইখান থেকেই ডাকতে আরম্ভ করলাম, ‘কে আছেন বাড়িতে? একবার বেরিয়ে আসতে পারেন দয়া করে?’
কিন্তু অত যে ডাকলাম কারো কোনো সাড়াশব্দ পেলাম না।
ধীরে-ধীরে একটু-একটু করে এগিয়ে গিয়ে ভেতরের উঠোনে গিয়ে দাঁড়ালাম। সন্ধে হয়ে গেছে। নীচেটা অন্ধকার। ঘরগুলো সব বন্ধ। মনে হল, নীচে হয়ত কেউ বাস করে না। ওপরের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, তেতলায় একটা জানালার ফাঁকে মনে হল যেন আলো জ্বলছে। চিঠিতে লেখা আছে সমিতি-গৃহ। সুতরাং মেয়েছেলে এখানে বাস নিশ্চয়ই কেউ করে না। ওপরে উঠে যেতেও দোষ নেই। কিন্তু যে-রকম ভূতুড়ে বাড়ি বলে মনে হচ্ছে, একা একা উঠে যেতেও ভয় করে। যাই হোক, সাহসে ভর করে ভাবলাম—যা থাকে কপালে, যা হবার তা তো হয়েই গেছে—উঠেই যাই। কিন্তু ও মা! যাব যে, তা সিঁড়ি কোথায়?
আবার একবার ডাকলাম, ‘কে আছেন বাড়িতে?’
কোথাও কোন সাড়াশব্দ নেই। চারিদিক নীরব-নিস্তব্ধ। আমার নিজের গলার আওয়াজটাই যেন প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে এল।
আবার ডাকলাম।
টিক টিক করে কোথায় যেন একা টিকটিকি ডেকে উঠল।
এবার কেমন যেন আমার একটুখানি ভয় হল। ভাবলাম, ভুল নম্বর দেখিনি তো! তৎক্ষণাৎ বাইরে বেরিয়ে এলাম। রাস্তায় তখন আলো জ্বলেছে। পকেট থেকে চিঠির কাগজখানা বের করে বাড়ির নম্বরটা আর একবার ভাল করে মিলিয়ে নিলাম। দেখলাম, না—ভুল হয়নি। ঠিকই এসেছি। রাস্তার এপারে সামনা-সামনি যে বাড়িখানা—তাতে দেখলাম To let ঝুলছে। তার পাশেরটাও তাই। এ বাড়িটায় লোকজন কেউ বাস করে কি না, কাকেই বা জিজ্ঞাসা করি? খান দুই-তিন পরে যে বাড়িখানা, তার দরজায় একটি ছেলে কোলে নিয়ে এক বুড়ো বসেছিল। এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, – ‘বলতে পারেন মশাই, ও-বাড়িতে লোকজন কেউ বাস করে কি না?’ লোকটি মুখ তুলে একবার আমার মুখের পানে তাকালে। বললে, ‘কী জানি মশাই, জানি নে।’
আচ্ছা বিপদ তো!
এদিকে সাতটা বাজতে তখন আর দেরি নেই। আবার সেই বাড়িতে গিয়ে ঢুকলাম। ডাকলাম, ‘কে আছেন বাড়িতে?’
আমার ডাকের সঙ্গে সঙ্গেই ওপরে কোথায় যেন একটা ভীষণ শব্দ হল। অনেকগুলো বাসন হাত থেকে ঝন্ ঝন্ করে পড়ে গেলে যেরকম শব্দ হয়, ঠিক সেই রকম শব্দ। শব্দটার জন্যে প্রস্তুত ছিলাম না, আচমকা একটুখানি চমকে উঠলাম। লোক এ বাড়িতে নিশ্চয়ই আছে, নইলে এ শব্দ হয় কোত্থেকে?
এবার একটুখানি সাহস হল। পকেট থেকে দেশলাই বের করে জ্বাললাম। এদিক-ওদিক সন্ধান করে দেখলাম, নীচে উঠোনের একপাশে জলের চৌবাচ্চার পাশে অন্ধকার একটা কুঠুরির ভেতর সিঁড়ির মত কী যেন একটা দেখা যাচ্ছে। সাহস করে সেইখানেই ঢুকে পড়লাম।
ভ্যাপসা কেমন যেন একটা গন্ধ আমার নাকে এল। চারিদিকে ঘুরঘুট্টি অন্ধকার। দেশলাই-এর কাঠিটা নিবে গিয়েছিল, তাই সিঁড়ির ওপর পা দিয়েই আবার দেশলাই জ্বাললাম। কিন্তু আশ্চর্য, স্পষ্ট আমার মনে হল, ফুঁ দিয়ে দেশলাইটা কে যেন নিবিয়ে দিলে। লোক দেখতে পেলাম না, অথচ ফুঁ-এর শব্দ পেলাম। অন্ধকারে দাঁড়িয়েই জিজ্ঞেস করলাম, ‘কে?’
আমার কাছেই কোথায় মনে হল কারা যেন ফিস ফিস করে কথা কইছে। কথার এক বর্ণও বুঝতে পারলাম না। আবার জিজ্ঞেস করলাম, ‘কে?’
ফিস ফিস কথা হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল। একটা চাপা হাসির শব্দ পেলাম। দু তিনজন লোক একসঙ্গে কেমন যেন একটা অদ্ভুত কণ্ঠে হি হি করে হেসে উঠল। কী এক অজ্ঞাত আতঙ্কে আমার শরীরের সমস্ত লোমগুলো তখন খাড়া হয়ে উঠেছে। দেশলাইটা আমার হাতেই ছিল। জ্বালতে গিয়ে দেখি, আমি থর থর করে কাঁপছি। কাঠিটা বাক্সের ওপর ঘষে জ্বালাবার ক্ষমতাটুকুও আমার তখন বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
পালাব কি না ভাবছি, কিন্তু সে অবস্থায় আমার পক্ষে পালানোও বিশেষ সোজা নয়। পা-দুটো মনে হল, কে যেন শেকল দিয়ে বেঁধে রেখেছে।
হঠাৎ আমার সুমুখে একটা টর্চের আলো পড়ল। আলোয় দেখতে পেলাম, প্রকাণ্ড একটা সিঁড়ি আমার সুমুখে সোজা ওপরে উঠে গেছে। যাক, বাঁচা গেল। আলোটা কে যে, কোত্থেকে ফেলেছে, কিছুই বুঝলাম না, তবু যা হোক একটা পথ দেখতে পেয়েছি ভেবে সিঁড়ি ধরে সোজা ওপরে উঠতে আরম্ভ করলাম।
টর্চের আলো দেখতে পাই অথচ লোক দেখতে পাই না কেন? মনে মনে যতই সন্দেহ হতে থাকে, ততই আমি এদিক-ওদিক তাকাই।
সিঁড়ি বেয়ে তখন আমি অনেকখানি উঠে এসেছি। হঠাৎ আমার চারিদিক অন্ধকার করে দিয়ে চোখের সুমুখে টর্চের আলো দপ করে নিবে গেল।
সর্বনাশ। যেই নিবে যাওয়া আর তৎক্ষণাৎ কে যেন পিছন থেকে আমার মুখখানা চেপে ধরল। হাত দিয়ে দেখি, কঙ্কালের মত একখানা শক্ত হাত, বরফের মত ঠাণ্ডা!
ছাড়িয়ে নেবার জন্যে ধস্তাধস্তি, মারামারি আরম্ভ করলাম, কিন্তু কার সাধ্য ছাড়ায়। সঙ্গে সঙ্গে মনে হল যেন আরও অনেকগুলো লোক এসে আমায় জাপটে ধরেছে। ভয়ে তখন আমার হয়ে গেছে। শেষ পর্যন্ত মূর্ছিত হয়ে পড়েছিলাম কি না তাই বা কে জানে? তারপর কি হল কিছুই আমার মনে নেই।
চৈতন্য ফিরে পাবার সঙ্গে সঙ্গে দেখলাম, প্রকাণ্ড একটা ঘরের মধ্যে একটি ইজিচেয়ারের ওপর আমি শুয়ে আছি, আর আমার দুপাশে দুটি চেয়ারে দুজন ভদ্রলোক বসে আছেন। লোক দুটির মুখের পানে তাকিয়ে দেখি অদ্ভুত মুখ। তেমন মুখ আমি জীবনে কখনও দেখেছি বলে মনে হয় না। একজনের মুখখানি যেমন গোলাকার, আর একজনের মুখখানি তেমনি লম্বা। দুজনেরই মুখে লম্বা দাড়ি, একজনের চোখে একটা চশমা, আর একজনের চোখ-দুটো এত লাল আর এত তীক্ষ্ণ উজ্জ্বল যে, সেদিক পানে তাকানো যায় না।
একজনের নাম জগন্নাথ, আর একজনের নাম চমনলাল।
জগন্নাথ জিজ্ঞাসা করলেন, ‘বলুন এবার। একটি কথাও বাদ দেবেন না, এখানে আপনি এলেন কেমন করে বলুন আগে।’
আমি আমার পকেটে হাত দিয়ে চিঠিখানি বের করে তাঁর হাতে দিয়ে বললাম, ‘পড়ুন।’ জগন্নাথ তাঁর চশমাটি কপালের ওপর তুলে দিয়ে চিঠিখানি একবার পড়লেন, খুব মনোযোগ সহকারে চিঠিখানি আর একবার উল্টে-পাল্টে দেখে সেটি চমনলালের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘তাজ্জব ব্যাপার! ‘
চমনলালও পড়লেন। পড়ে আমার মুখের পানে তাকিয়ে বললেন, ‘এ চিঠি আমাদের সমিতির কোনও সভ্য আপনাকে লেখেনি!’
আমি বললাম, ‘তাহলে কোনও দুষ্টু লোক হয়ত আপনাদের ছাপা চিঠির কাগজ চুরি করে—’
চমনলাল পরিষ্কার বাংলায় জিজ্ঞেস করলেন, ‘চিঠিখানি কে আপনার হাতে দিয়ে এन? ডাকের ছাপ দেখছিনে, নিশ্চয়ই কেউ হাতে দিয়ে এসেছে।’
বললাম, ‘আজ্ঞে হ্যাঁ, কিন্তু কে যে আমার বাড়িতে দিয়ে গেছে, জানি না। কেউ তাকে দেখে নি। রাত্রে ফিরে সেদিন দেখলাম, আমার বিছানার ওপর খামের একখানি চিঠি পড়ে রয়েছে। বাস্, এই পর্যন্ত।’
চমনলাল এইবার জগন্নাথের মুখের পানে তাকিয়ে বললেন, ‘বুঝতে পেরেছ কার কাজ?’
জগন্নাথ ঘাড় নেড়ে বললেন, ‘না ঠিক বুঝতে পারলাম না।’
চমনলাল হাসতে লাগলেন। বললেন, ‘গোপীনাথের কাজ।’
গোপীনাথ। নামটা শুনে চমকে উঠলাম। কারণ, এই গোপীনাথ নামটির সঙ্গে কিছুদিন পূর্বে আমার বিশেষ পরিচয় ঘটেছে। কেমন করে ঘটেছে পরে বলছি।
চমনলাল বললেন, ‘গোপীনাথ ছাড়া আর কেউ নয়।’ বলেই তিনি আমার মুখের পানে তাকিয়ে বলতে লাগলেন, ‘এই গোপীনাথের জ্বালায় মশাই আমরা অস্থির হয়ে উঠলাম। লোকটা মরেছে অনেকদিন আগে, কিন্তু এখন পর্যন্ত পৃথিবীর কোনো মায়াই সে ত্যাগ করতে পারছে না। কিছুদিন ধরে আমাদের এমন মুশকিল হয়েছে যে, আর-কারো ভূতকে আমাদের ডাকবার উপায় নেই। যেই ডেকেছি, আর অমনি গোপীনাথের Spirit এসে হাজির। বলছে, ‘যা বলতে হয় আমায় বলো।’ বলি, ‘তুমি কি মুরদের মানুষ হে!’ গোপীনাথ রেগে ওঠে। বলে, ‘বটে। আমি করিনি কী! সমস্ত ভারতবর্ষকে চমকে দিয়েছি।’ কিন্তু গোপীনাথের কথা আমরা বিশ্বাস করি না। লোকটা এত উপদ্রব করে। কিছুদিন আগে খবরের কাগজে একটা ভারি অদ্ভুত খবর বেরিয়েছিল—মজিদবাড়ি স্ট্রিটের একটা ভূতুড়ে বাড়ির কাণ্ড। গোপীনাথ বললে, ‘আমি করেছি।’ আমরা বিশ্বাস করলাম না। কিন্তু গোপীনাথের দেখলাম, মসজিদবাড়ি স্ট্রিটের সে ভদ্রলোকের ওপর ভারি রাগ! বলে—’ওকে একদিন আমি মেরেই ফেলব।’
আমার মাথার ভেতরটা তখন ঝিম্ ঝিম্ করছে। মুখ দিয়ে আর কথা বেরোচ্ছে না। আগাগোড়া সব ব্যাপারই তখন আমি বুঝতে পেরেছি। হাতের ইশারা করে চমনলালকে বললাম, চুপ করুন। সবই আমি বুঝতে পেরেছি। আমিই সেই মসজিদবাড়ি স্ট্রিটের—’
কথাটা আমায় শেষ করতে হল না। চমনলাল এবং জগন্নাথ—দুজনেই হাত বাড়িয়ে দুদিক থেকে আমার হাত-দুটো চেপে ধরে সবিস্ময়ে বলে উঠলেন, ‘আপনি! আপনিই সেই লোক?’
ঘাড় নেড়ে বললাম, ‘আজ্ঞে হ্যাঁ, আমিই সেই।’
চমনলাল বললেন, ‘বলুন, তবে আপনার মুখ থেকেই শুনি কী কী হয়েছিল। তারপর গোপীনাথকে একবার দেখাচ্ছি মজা।’—
জিজ্ঞাসা করলাম, ‘ভূতদের জব্দ করতে পারেন আপনারা?’
জগন্নাথ এতক্ষণ গম্ভীর হয়ে বসে বসে শুনছিলেন। এইবার মুখে তাঁর হাসি ফুটল। ঘাড় নেড়ে বললেন, ‘পারি। সম্প্রতি একটা যন্ত্র আমরা তৈরি করেছি। তৈরি এখনও শেষ হয়নি। হলে দেখবেন—মানুষের কত উপকার আমরা করব। মানুষের মৃত্যু রোধ করতে অবশ্য পারব না, – মানুষ মরবেই। কিন্তু মানুষ মরবার পরে আত্মীয়স্বজন যাতে সেই যন্ত্রের সাহায্যে অতি সহজেই তাদের সঙ্গে কথাবার্তা কইতে পারে, তার ব্যবস্থা করে দেবো। হিসাব করে দেখেছি, সে যন্ত্র আমরা মাত্র পাঁচ টাকা দামে বিক্রি করতে পারব। কী বলেন? মানুষের এতে উপকার করা হবে না?’
বললাম, নিশ্চয়ই হবে।
চমনলাল কিন্তু তখন আমার জীবনের সেই অদ্ভুত কাহিনিটি শোনবার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। বললেন, ‘থামো জগন্নাথ, আগে ওঁর সেই গল্পটা শুনি। তারপর আজ রাত্রেই আমরা গোপীনাথকে ডাকব। নিন্–বলুন!’
গল্পটা আবার আমায় আগাগোড়া সবই বলতে হল—
আগে আমার বাসা ছিল শ্যামপুকুর স্ট্রিটে। একতলা স্যাঁৎসেঁতে বাড়ি। আমার বেরি-বেরি হল। ডাক্তার বললেন, ‘বাড়ি বদল করুন।’ খুঁজতে খুঁজতে মজিদবাড়ি স্ট্রিটের ওই বাড়িখানা পেলাম। চমৎকার বাড়ি। দক্ষিণ খোলা। সুমুখে ফুলের বাগান। দোতলায় চারখানি ঘর। তার মধ্যে বাগানের সুমুখেই যে ঘরখানি, সেরকম ঘর কলকাতা শহরে খুব কমই পাওয়া যায়। মার্বেল পাথরের মেঝে, দেওয়ালে রঙিন টালি-দেওয়া, বড় বড় জানালা, দেওয়ালের গায়ে কাচের আলমারি। ইলেকট্রিকের আলো। বাকি ঘর ক’খানিও মন্দ নয়। অথচ ভাড়া মোটে কুড়ি টাকা। যাক্, সস্তায় এমন সুন্দর বাড়ি পেয়ে ভারি আনন্দ হল। বাড়িখানি নিয়ে সেখানেই বাস করতে লাগলাম। আমি থাকতাম মার্বেল-দেওয়া সেই ভাল ঘরখানিতে।
দিনকতক বাস করার পরেই ভারি সব মজার ঘটনা ঘটতে লাগল।
ওপরেই রান্নাঘর। স্ত্রী রান্না করছেন। বেশি রাত নয়, – সেই সবে সন্ধে। আমি আপিস থেকে ফিরেছি। স্ত্রী হঠাৎ রান্নাঘরের ভেতর থেকে চিৎকার শুরু করলেন,— ‘ওগো খোল— দরজা খোল। আঃ, কি জ্বালাতন!
আমার ঘরে জানালার কাছটিতে বসে-বসে আমি একটা নভেল পড়ছিলাম। বাইরে বেরিয়ে রান্নাঘরের দরজার বাইরে থেকে কে শেকল টেনে বন্ধ করে দিয়েছে আর স্ত্রী চেঁচাচ্ছেন ঘরের ভেতর থেকে। শেকল খুলে ঘরে ঢুকে বললাম, ‘শেকল কে দিল?’
স্ত্রী হেসে বললেন, ‘থাক, বুড়ো বয়সে আর রসিকতা করো না। নিজে বন্ধ করে শেষে—’
আমি তো অবাক। সত্যিই আমি বন্ধ করিনি। ছেলেমেয়েরা কেউ মনের ভুলে বন্ধ করেনি তো? প্রত্যেককে জিজ্ঞাসা করলাম। সবাই বললে, ‘না।’
ভাবলাম, হয়ত চোর-টোর এসে থাকবে। কিন্তু চোর নয়, ভৌতিক কাণ্ডের ওই প্রথম।
তারপর হেঁসেল থেকে মাছ চুরি যেতে লাগল।
মাছ রান্না করে রেখেছে, কিন্তু খাবার সময় পরিবেশন করতে গিয়ে দেখে, পাত্রটা ফাঁকা—মাছ নেই। এমন এক-আধদিন নয়, –রোজ। প্রথম প্রথম ভাবতাম বুঝি বেড়ালে খায়, কিন্তু অত্যন্ত সাবধানে রাখার পরেও যখন মাছ চুরি যেতে লাগল, তখন আমাদের সন্দেহ হল। মাছ খাওয়া আমরা ছেড়েই দিলাম।
আমার ছোট ভাই অরুণ শ্রীরামপুরে চাকরি করত। কলকাতা থেকে রোজ শ্রীরামপুরে যাওয়া-আসা করা তার সুবিধা হবে না বলে শ্রীরামপুরেই সে বাসা নিয়েছিল। কিন্তু প্রত্যেক শনিবারে কলকাতা তার আসা চাই-ই। শনিবার সন্ধেয় আসত, রবিবার থাকত, আবার সোমবার গিয়ে আপিস করতো। অরুণের ছিল ভারি মাছ-মাংস খাবার শখ। সেদিন শনিবার এসেই সে হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করলে, ‘মাছ কি তোমাদের এখনও ভূতে খাচ্ছে বৌদি?’ তার বৌদিদি বললেন, ‘হ্যাঁ ভাই, ভারি বিপদে পড়েছি।’ অরুণ বললে, ‘আচ্ছা দাঁড়াও বৌদি, কাল রবিবার, কাল আমি মাংস কিনে এনে নিজেই রান্না করব, তারপর কে খায়, তাই একবার দেখব পরীক্ষা করে।’
রবিবার সন্ধেবেলা অরুণ মাংস এনে বললে, ‘দাও বৌদি, স্টোভটা জ্বেলে দাও, আমি নিজেই রান্না করব।’
বলে সে সত্যি-সত্যি নিজেই মাংস রান্না করতে বসল।
রান্না শেষ হলে আমাদের সকলকে কাছে ডেকে চোখের সুমুখে বসিয়ে বললে, ‘খাও।’
আমাদের খাওয়া শেষ হয়ে গেলে অরুণ হাসতে লাগল; বললে, ভূত রয়েছে? ভূত-টুত নেই, ওসব আমি বিশ্বাস করি না।
বললাম, ‘এইবার তুই নিজে খা, আর দেরি করিসনে।’
‘খাই।’ বলে সে তার বৌদিকে সেখানেই ভাত আনতে বলে প্যান্ থেকে মাংস ভাগ করতে লাগল।
খেতে সেদিন তার মোটেই দেরি হল না। তাড়াতাড়ি আঁচিয়ে এসে সে আমার ঘরে ঢুকে বললে, ‘দাদা, শোন!’
জানালার কাছে উঠে গেলাম। অরুশ চুপি চুপি বললে, ‘দাদা, এ বাড়ি তুমি কালই ছেড়ে দাও।’
‘কেন রে? কী হল?’
অরুশ বললে, ‘ভূত এ বাড়িতে সত্যিই আছে।’
হাঁ করে অবাক হয়ে আমি তার মুখের পানে চেয়ে রইলাম। অরুণ বলতে লাগল, ‘বৌদিকে ভাত আনতে বলে আমি মাংস ভাগ করছি, হঠাৎ মনে হল স্টোভের ওপর থেকে মাংসের প্যান্টা আলগোছে কে যেন তুলে নিয়ে যাচ্ছে! টপ্ করে প্যানের হ্যান্ডেলটা তক্ষুনি আমি ধরে ফেললাম। তারপরেই শুরু হল টানাটানি। পরিষ্কার ইলেকট্রিকের আলো, হাত দেখতে পাই না, মানুষ দেখতে পাই না, তবু আমায় প্রাণপণ জোরে প্যান্টা টানতে হচ্ছে। শেষে অনেক কষ্টে হ্যাঁচকা একটান মেরে প্যান্টা তো নিলাম কেড়ে। কিন্তু অবাক্ কাণ্ড, যেই আমি প্যান্টা মাটিতে নামিয়েছি, অমনি মনে হল যেন আমার চোখের সামনে লম্বা একটা কঙ্কালের মত হাত এগিয়ে আসছে। হাতটাকে সরাবার চেষ্টা করলাম, কিন্তু কিছুতেই পারলাম না। নিমেষের মধ্যে সে হাতটা এগিয়ে এসে প্যান্ থেকে মাংসটা যে কেমন করে তুলে নিয়ে গেল; বুঝলাম না। পড়ে রইল মাত্র কয়েকখানা হাড় আর ঝোলটুকু! বৌদি তো মাংস খান না, আমিও খেলাম না। তাই এত তাড়াতাড়ি আমার খাওয়া শেষ হয়ে গেল দাদা, আমার বুকটা একবার হাত দিয়ে দ্যাখো তুমি।’
দেখলাম, বুকের ভেতরটা তার ধড়াস্ ধড়াস্ করে কাঁপছে।
মুখে খুব সাহস দিয়ে বললাম, ‘ভয় নেই। ও অম্নি মাছ-মাংসই খেয়ে যায়, অনিষ্ট কিছু করে না।’
‘বৌদিকে তুমি এ-সব কথা কিছু বলো না দাদা। ভয়ে তাহলে ও মরে যাবে।’
বললাম, ‘না, বলব না!’
অরুশ বললে, ‘কিন্তু দ্যাখো দাদা, ভূত আমি এর আগে কোন দিনই বিশ্বাস করতাম না, আজ করলাম। তবে ওকে যদি একবার আমি ধরতে পারি, তো ওর মাংস খাওয়া আমি বের করব।’
বুঝলাম, নিজে খেতে না পেয়ে অরুণের ভারি রাগ হয়েছে।
যাই হোক্, তার পরের দিন সোমবার অরুণ যেমন শ্রীরামপুরে ফিরে যায়, সেদিনও তেমনি গেল। যাবার সময় বলে গেল—বাড়ি বদল করবার চেষ্টার ত্রুটি যেন না হয়।
শ্রীরামপুর থেকে অরুণ কলকাতায় আসত শনিবার সন্ধের ট্রেনে, আবার ফিরে যেত সোমবার সকালে। গত তিন-চার বছর ধরে তার কোনও ব্যতিক্রম হয়নি। কিন্তু তারপরের সপ্তাহে অরুণ এল শুক্রবার সন্ধের ট্রেনে। শুক্রবার দিন আমি আপিস থেকে ফিরে এসেই দেখি—অরুণ এসেছে। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কিরে, শুক্রবারে এলি যে?’
অরুণের মুখখানা গম্ভীর। বললে, ‘হ্যাঁ, শরীরটা তেমন ভাল নেই।’
শুক্রবার রাত্রিটা অরুণ আমার শোবার ঘরেই গুলো। পরদিন সকালে উঠেই বললে, ‘কই, বাড়ি তো বদল করলে না দাদা। ভালো বাড়ি পাওনি বুঝি?’
বললাম, ‘কই আর পাচ্ছি।’
অরুশ বললে, ‘আজও আমার আবার মাংস খেতে ইচ্ছে করছে। আজ রাত্রে আবার আমি মাংস রান্না করে খাব।’
বললাম, ‘সে কি রে! না অরুণ, কাজ নেই। কেন মিছেমিছি
অরুণ হেসে বললে, ‘পাগল হয়েছ দাদা, ভূত-টুত কি আর এক জায়গায় থাকে কখনও? দেখি না আজ কী করে!’
অরুণ চিরদিনই ভারি একজিদে। যা ধরবে, তা সে করবেই। তাকে বাধা দেওয়া বৃথা। সকালে সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ করে দুপুরে ফিরে এসেই, শুনলাম, সে খেয়ে-দেয়ে আবার বেরিয়ে গেছে।
শনিবার দিন আপিস থেকে সকাল-সকাল বাসায় ফিরে দেখলাম, অরুণ তখনও আসেনি। সন্ধ্যায় হৈ হৈ করে বাড়ি ঢুকল একেবারে এক বোঝা কাঁচা মাংস হাতে নিয়ে।
সেই মাংস রান্না করলে সে নিজেই। বাড়ির প্রত্যেককে বসে বসে খাওয়ালে, নিজেও খুব খেলে। খেয়ে উঠে এসে আমায় চুপি চুপি বললে, ‘দেখলে দাদা, কই আজ তো আর মাংস কাড়াকাড়ি করতে কেউ এল না! ভূতকে আর ভয়-ডর আমি করিনে দাদা। কিন্তু বাড়িটা তুমি ছেড়ে দাও, কি জানি, রাগের মাথায় কখন কী করে বসে… ওদের বিশ্বাস তো নেই! ‘
পরদিন রবিবার। সকালে উঠেই অরুণ বললে, ‘আজই আমি শ্রীরামপুর যাব। ওদিকে যেমন একদিন আগে এসেছি, ফেরবার সময়ও তেমনি একদিন আগেই ফিরব।’
অনেক করে বললাম, কিন্তু সে কিছুতেই রইল না।
রবিবার। আমারও আপিস নেই। ট্রামে চড়ে তার সঙ্গে হ্যারিসন রোডের মোড় পর্যন্ত গেলাম। তারপর অরুণকে হাওড়ার ট্রামে চড়িয়ে দিয়ে আমিও এদিককার একটা ট্রামে চড়ে বাসায় ফিরলাম।
বাইরের ফটকটা পেরিয়ে যেই আমি বাগানে ঢুকেছি, পিছনে শুনলাম, ক্রিং ক্রিং করে কে যেন সাইকেলের ঘণ্টা বাজাচ্ছে! পিছন ফিরতেই দেখি, লাল রঙের বাইক নিয়ে একজন টেলিগ্রাফ-পিওন দাঁড়িয়ে আছে। কাছে এগিয়ে যেতেই টেলিগ্রামের একখানা খাম আমার হাতে নিয়ে বললে, ‘কিরণকুমার সেন—আপনারই নাম?’
কিন্তু টেলিগ্রাম আমায় কে করবে? তাড়াতাড়ি একটা সই করে দিয়ে পিনকে বিদায় করলাম। তারপর-
তারপর টেলিগ্রামের খামখানা খুলে সেটা পড়তেই মাথাটা কেমন যেন আমার ঘুরে গেল! স্পষ্ট দিনের আলোয়—একি! ভুল পড়লাম না তো? খামের ওপরের ঠিকানাটা আর একবার দেখলাম। না—ভুল নয়। আমারই নাম, আমারই ঠিকানা। –শ্রীরামপুর থেকে অবনী বলে কে একজন আমায় টেলিগ্রাম করেছেন— ‘গত শুক্রবার সকালে আপনার ভাই অরুশ হঠাৎ মারা গেছে।’—
ভাবলাম, অরুণের কোনও বন্ধু হয়ত দুষ্টুমি করে এই ‘তার’ করে দিয়েছে। মনে-মনে একটুখানি হাসলাম, কিন্তু তবু বুকের ভেতরটা কেমন যেন করতে লাগল। কাউকে কিছু না বলে আমার ওপরের ঘর থেকে কয়েকটি টাকা সঙ্গে নিয়ে নীচে নেমে এলাম। স্ত্রীকে বললাম, ‘ফিরতে একটু দেরি হবে।’ অরুণের সঙ্গেই সকালবেলা খেয়ে নিয়েছিলাম, কাজেই খাবার প্রশ্ন আর উঠল না।
শ্রীরামপুরের ট্রেন এখনও হয়ত আসেনি। অরুণের সঙ্গে হাওড়া স্টেশনেও দেখা হতে পারে। ট্যাক্সি চড়ে হাওড়ায় গিয়ে দেখি, মিনিট পাঁচেক আগে ট্রেনখানা বেরিয়ে গেছে। পনেরো মিনিট পরেই আবার একখানা ট্রেন। শ্রীরামপুরের টিকিট করে ট্রেনে চড়লাম।
অরুশ তার কয়েকজন বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে থাকত একটা মেসে। স্টেশন থেকে ছুটতে-ছুটতে সেই মেসের দরজায় গিয়ে দাঁড়ালাম। রবিবার দুপুর। খাওয়া-দাওয়া তখনও হয়নি। ভেতরে গোলমাল চলছে। ধীরে ধীরে ভেতরে ঢুকেই দেখি, বাঁ-হাতি ওপরে ওঠবার সিঁড়ি। সিঁড়ি ধরে ওপরে উঠে গেলাম। অরুণ যে-ঘরে থাকত, সেই ঘরের দরজায় গিয়ে ডাকলাম— ‘অরুণ!’দরজাটা ভেজানো ছিল। ডাক শুনে দুজন ছোকরা একসঙ্গে বেরিয়ে এল। বললে, ‘কে? কে আপনি?’
আমার মুখ থেকে তখন আর কথা বেরোচ্ছে না। বললাম, ‘আমি অরুণের দাদা।’
একজন ছোকরা চট্ করে আমার হাত ধরে ঘরের ভেতরে নিয়ে গেল। মেঝের ওপর একটা মাদুর দেখিয়ে দিয়ে বললে, ‘বসুন।’
বসবার তখন আর আমার প্রবৃত্তি নেই। ঘরের মধ্যে এদিক-ওদিক তাকাতে তাকাতে বললাম, ‘অরুণ…’
ছোকরাটি বললে, ‘টেলিগ্রাম পাননি?’ ঘাড় নেড়ে জানালাম, পেয়েছি।
সে বললে, ‘শুক্রবারেই একখানা টেলিগ্রাম আমি লিখে আপনার কাছে পাঠাবার জন্যে চাকরটাকে দিয়েছিলাম। খবর আপনি শুক্রবারেই পেতেন, কিন্তু বদমাস চাকর, ব্যাটা পয়সাটা মেরে দিয়ে টেলিগ্রাম আপনাকে করেনি। তাই আজ সকালে আবার—’
আমার চোখ দিয়ে তখনও জল পড়ছে না। ভাবতে পারছি না যে, ওরা আমায় উপহাস করছে, না সত্যি বলছে।
দেখতে দেখতে অনেকগুলি ছোকরাই ঘরে ঢুকল। দেখলাম, একজন বৃদ্ধ ভদ্রলোকও রয়েছেন তাদের মধ্যে। উপহাস আর যেই করুক, তিনি নিশ্চয়ই করবেন না ভেবে আমি তাঁরই মুখের পানে তাকালাম। তিনি বললেন, ‘একেবারে হঠাৎ—মশাই, এমন মৃত্যু কখনও আমি দেখিনি। কলকাতা থেকে ফিরে এসেই জ্বর হল। সামান্য জ্বর। বৃহস্পতিবার দিন সে আর কাজে যেতে পারেনি, তারপর শুক্রবার সকালে মশাই, আমরা তখন ঘরে বসে। কী জন্যে যে অরুণ তার ঘর থেকে বেরিয়েছিল, কে জানে? সিঁড়ির মাথা থেকে একেবারে সোজা নীচে পড়ে গেছে। ভয়ানক একটা চিৎকার আর শব্দ হল। শুনে আমরা সবাই মিলে গিয়ে দেখি—সিঁড়ির নীচে অরুণ তখন সটান লম্বা হয়ে পড়ে আছে। মাথাটা ফেটে গলগল করে রক্ত বেরোচ্ছে। জীবন তখন আর নেই। পড়বার সঙ্গে-সঙ্গেই—তৎক্ষণাৎ… বুঝলেন কি না! আপিসের বড়বাবু ইত্যাদি সকলেই এসেছিলেন। আমরাই দাহ করে এলাম।’
অরুণ তাহলে সত্যিই নেই। কিন্তু শুক্রবার দিন যে গিয়েছিল, যাকে এই ঘণ্টাখানেক আগে পাঠিয়েছি,–সে কে?
বৃদ্ধ ভদ্রলোক বললেন, ‘টেলিগ্রাম আপনি ঠিক সময়েই পেতেন, আমাদের ওই ব্যাটা চাকর যদি না গোলমাল করত।’
কে একজন বলে উঠল, তার শাস্তিও ঠিক হয়েছে। ব্যাটাকে অবনীবাবু আজ মেরে একেবারে আধ-মরা করে দিয়েছে।’
ধীরে-ধীরে উঠে দাঁড়ালাম। ঘরের কোণে কালো একটা কম্বলে জড়ানো কয়েকটা বই আর একটা বাক্স দেখিয়ে একটি ছোকরা বললে, ‘অরুণের ওই জিনিসগুলি আপনি নিয়ে যান।’
সেই অরুণই যখন নেই, তার আর জিনিস নিয়ে কী হবে? বললাম, ‘থাক্।’
***
বাড়ি আমি বদল করেছি। কিন্তু আমার ভাইটিকে সেখানে হারিয়ে এলাম। তার চেয়ে আমি নিজে গেলেই ভাল হত।
অরুণের ব্যাপারটা যাকে বলি, সেই অবাক হয়ে যায়। সহজে কেউ আর বিশ্বাস করতে চায় না। কিন্তু আমি তো পাগল নই। সম্পূর্ণ সত্য ঘটনা—আমার জীবনেই ঘটেছিল।
খবরের কাগজওয়ালারা এই নিয়ে দিনকতক খুব হৈ চৈ শুরু করে দিলে। কিন্তু তাতে আমার কীই-বা এসে যায়? যে গেছে, সে আর বোধ হয় ফিরবে না।
হঠাৎ একদিন আমার এক উকিল-বন্ধুর সঙ্গে দেখা। আমাকে দেখেই সে জিজ্ঞেস করলে, ‘হ্যাঁ হে, শুনলাম নাকি মজিদবাড়ি স্ট্রিটের সেই ভূতুড়ে বাড়িটা তুমি ভাড়া নিয়েছিলে?
জিজ্ঞেস করলাম, ‘ভুতুড়ে বাড়ি—তুমি জান?
‘জানি না আবার। খুব জানি। আমি যে ওদের একটা মামলা চালিয়েছি হে।’
‘কীসের মামলা?’
বলতেই আমার বন্ধুটি আমায় যা বললে, তার সারমর্মটি এই—
ওরা ছিল দুভাই—গোপীনাথ আর শশীনাথ। গোপীনাথ বড়, শশিনাথ ছোট। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার, দুভাই-এর মধ্যে গোপীনাথ ছিল যেমন শৌখিন, শশীনাথ তেমনি কৃপণ। বিয়ে করলে পাছে ছেলেপুলে হয়, ঘরসংসারের খরচ বাড়ে, তাই শশীনাথ বিয়ে পর্যন্ত করলে না। বাপ মরে যাবার পর দেখা গেল, গোপীনাথ আর শশীনাথের জন্যে অনেক টাকা তিনি রেখে গেছেন, আর রেখে গেছেন মজিদবাড়ি স্ট্রিটের ওই বাড়িখানি।
টাকাকড়ি দুভাগ হয়ে গেল, বাড়িও দুভাগ হল। সামনের দিকটা পেল গোপীনাথ আর পেছনের দিকটা শশীনাথ। মাঝখানে দেওয়াল তুলে দিয়ে বাড়িখানা তারা দুভাগ করে নিলে। এতদিন বাপ্ বেঁচে থাকতে গোপীনাথ স্বাধীনভাবে কিছু করতে পারেনি, এখন সে স্বাধীন—তাই বাপের মৃত্যুর পর গোপীনাথ বসবার ঘরখানি মার্বেল পাথর দিয়ে দামি দামি টালি দিয়ে বাঁধিয়ে নিলে, বাড়ির সমুখে বাগান তৈরি করলে, আরও সব দামি দামি আসবাব-পত্র দিয়ে বাড়িখানি সাজিয়ে ভাবলে, এইবার একটুখানি সুখে বাস করতে হবে।
কিন্তু অদৃষ্ট যার মন্দ, তার আর সুখে বাস করা চলে না। রাত্রে একদিন খাওয়া-দাওয়ার পর গোপীনাথের সমস্ত শরীরটা কেমন যেন করতে লাগল! তারপর শুয়ে পড়ে অসহ্য যন্ত্রণায় ছট্ফট্ করতে করতে রাত্রি প্রায় দু’টোর সময় সে মরে গেল। অকস্মাৎ কী এমন তার হয়েছিল, যার জন্য সে মরে গেল, তাই ভেবে লোকে অবাক হল। অনেকে অনেক কথাই বলতে লাগল। গোপীনাথের সন্তানাদি কিছু ছিল না। সে নিজে আর তার স্ত্রী। এর মধ্যে নাকি শশীনাথের ষড়যন্ত্র আছে।
কথাটা কানাকানি হতে হতে পুলিশের কানে গিয়ে উঠল। গোপীনাথের মৃতদেহ চালান গেল ময়না ঘরে। বাস্, সেখানে প্রমাণ হয়ে গেল যে, বিয খেয়ে মৃত্যু। কিন্তু কে খাইয়েছে, তার প্রমাণ কিছু হল না। তাছাড়া শশিনাথ নাকি এর জন্যে অনেক টাকা খরচ করে ফেললে।—
আমার বন্ধুটি বললে, শশিনাথের তরফ থেকে এরই মামলা সে চালিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত কারও কিছু হল না। গোপীনাথের বৌ রইল শশিনাথের কাছে। মাঝখান থেকে মামলা গেল চুকে। সেইদিন থেকে গোপীনাথের প্রেতাত্মা নাকি ওই বাড়ির মধ্যে ঘুরে বেড়ায়। বাড়িতে সহজে কেউ আর বাস করতে পারে না।
বন্ধুটি আমায় আরও বললে, শশিনাথের বাড়িতেও উপদ্রব কম হয় না। বিধবা হয়েও গোপীনাথের স্ত্রী নাকি লুকিয়ে লুকিয়ে সাবান মাখত, সাজ-পোশাক পরতো, মাছ খেত, মাংস খেত। কিন্তু গোপীনাথের তা সহ্য হবে কেন? তেল, সাবান, সেন্ট—যা কিছু শৌখিন জিনিস, তা সে যত সংগোপনেই রাখুক—বাড়ি থেকে ক্রমাগত চুরি যেতে থাকে, মাছ-মাংস হেঁসেলে কোনদিন তারা দেখতে পায় না! এই রান্না করে রেখেছে, আর এই নেই!’
অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সবই শুনলাম। বললাম, ‘আচ্ছা, স্ত্রীকে সে মেরে ফেলতেও তো পারে।’
বন্ধুটি হেসে বললে, ‘না হে, সে তার স্ত্রীকে বড় ভালবাসত যে! সেই জন্যেই বোধ হয় বিশেষ কিছু অনিষ্ট সে তার করেনি।’
* * *
চমনলাল বললেন, ‘এবার বুঝতে পেরেছেন তো এ-সব কার কাজ?’
ঘাড় নেড়ে বললাম, ‘হ্যাঁ।’
জগন্নাথ বললেন, ‘চল, এবার গোপীনাথকে ডাকা যাক্। দেখি ও নিজে কী বলে।’
এমন সময় প্রচণ্ড একটা শব্দে আমরা সকলেই চমকে উঠলাম। দেখলাম, দেওয়ালে টাঙানো প্রকাণ্ড আরশিখানা ঝন্ঝন্ করে মেঝেয় পড়ে ভেঙে একেবারে টুকরো টুকরো হয়ে গেল।
চমনলাল বললেন, ‘ব্যাটা এই ঘরেই আছে।’
কিন্তু ঘরের চারিদিকে তাকিয়ে আমি কোথাও কিছু দেখতে পেলাম না। মনে হল, কোথায় একটা ভ্রমর যেন অনেকক্ষণ ধরে দেওয়ালের গায়ে মাথা ঠুকে ঠুকে ধুঁ ধুঁ করে ঘুরে বেড়াচ্ছে, আর ঘরের কোণে টেবিলের ওপর জ্বলন্ত মোমবাতিটা ক্ষয়ে ক্ষয়ে এতটুকু হয়ে গেছে।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন