প্রেতপুরী – শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়

শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়

এক

(কয়লার গুঁড়া বিছানো কয়লাকুঠির পথ। পথের উপর দিয়া মোটাসোটা বেঁটেগোছের এক ভদ্রলোক বাইক হাতে লইয়া পায়ে হাঁটিয়া চলিতেছিলেন, আর এক ভদ্রলোক তাহার কাছে আসিয়া নমস্কার করিলেন। সন্ধ্যা হইয়া আসিয়াছে। দূরে সাঁওতালী কুলি-ধাওড়া হইতে মাদল ও বাঁশির আওয়াজ শোনা যাইতেছিল।)

—নমস্কার। ম্যানেজার বাবুর বাসা কি এইটে?

—নমস্কার। আজ্ঞা না। এডা আমাদের কর্মচারীদের মেছ। আপনি বুঝি এহানে— এই কলিয়ারিতে নতুন ডাক্তার হইয়া আলেন, না?

—আজে হ্যাঁ। কাল এসেছি।

—কিসের লাগ্যা এলেন মশাই? ভূতে যেদিন দেবে ঘাড়ড়া মটকাইয়া সেদিন বুঝবেন ঠ্যালা।

—আজ্ঞে না, ভূত টুত আমি মানি না।

—ভালো। আইছেন ত আইছেন কিন্তু সাবধানে থাকবেন দাদা। ভূতের ভয়ে রাত্তিরে এহানে থাকতে পারি না মশাই। সাইকেল কইরা সেই সক্কালে আইছি আর এই চললাম। অন্ধকার হয়া এলো দ্যাহেন না! –এইডা ম্যানেজারের বাংলা। কড়া নাড়েন। অমি চললাম। নমস্কার।

(বাইকের ঘণ্টার শব্দ, কড়া নাড়ার শব্দ)

(বাড়ির ভিতর হইতে) – কে?

—দরজা খুলুন।

—ডাক্তারবাবু। আসুন, আসুন, রাত্তিরে এলেন যে? বসুন।

—না আর বসবো না ম্যানেজারবাবু। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একটা কথা জিজ্ঞাসা করে যাই। আচ্ছা, ম্যানেজারবাবু শুনছি এখানে সবাই বলছে—ভূতের ভয়ে টিকতে পারবেন না। ব্যাপারটা কি বলুন ত মশাই?

ম্যানেজার—(হাসিয়া) ভূত! হুঁ, সেকথা বলে বটে! বসুন তাহলে বলি।

ডাক্তার-বলুন। বসেছি।

ম্যানেজার—শুনুন। সে আজ থেকে অনেক দিনের কথা। বছর চার পাঁচ আগে। ভীষণ বর্ষা মশাই। চার পাঁচদিন ধরে সমানে বৃষ্টি। সিঙ্গারন নদীতে বান এল। হড়পা বান! ভাবলাম এমন কী আর হবে। আর ও তো প্রতি বছরই আসে। আমার আবার কাছেই সিঙ্গারন কিনা! দুনম্বর পিট-মাউথের পাশেই। সকালে একবার খাদের দিকে গেলেই দেখতে পাবেন।

ডাক্তার—দেখেছি। আপনি বলুন।

ম্যানেজার—দেখেছেন? বেশ, বেশ। ওই সিঙ্গারনই আমার সর্বনাশ করেছিল। দুপুরে খেয়ে দেয়ে চাপাচাপি দিয়ে একটুখানি শুয়েছিলুম। একটা লোক ছুটতে ছুটতে এসে খবর দিলে—নদীর বাঁধ গেছে ভেঙে। সর্বনাশ। বাঁধ ভাঙলে আর রক্ষা আছে। তৎক্ষণাৎ ছুটতে ছুটতে খাদের মুখে গিয়ে দাঁড়ালাম। উঃ! নদীর সে কি মূর্তি মশাই। সিঙ্গারনের সেরকম ভয়ঙ্কর মূর্তি আমি ত কখনও দেখিনি। দেখলুম—হুড় হুড় হুড় হুড় করে খাদের মুখে জল ঢুকছে। সমস্ত নদীটা যেন খাদের ভেতর ঢুকে পড়তে চায়। বললাম, – চালাও পাম্প! কিন্তু একটা পাম্পের আর কতটুকু ক্ষমতা। এদিকে খাদের নীচে তখন জন-ত্রিশেক লোক দুনম্বরের মুখ দিয়ে লোকগুলো যদি তাড়াতাড়ি উঠে আসতে পারে তবে মঙ্গল। লিফট-কেজ নীচে নামিয়ে রাখলাম। কিন্তু না, আধঘণ্টা পার হয়ে গেল, একটা ঘণ্টা গেল, দু ঘণ্টা গেল, কেউ আর উঠল না।

ঢালু ‘সিমে’ কাজ হচ্ছিল। জল গিয়ে সেখানেই জমেছে। বুঝলাম— কেউ আর বেঁচে নেই। প্রাণপণ চেষ্টায় নদীর বাঁধ বেঁধে পাম্প করে জল মারতে দুদিন লাগল। নীচে গিয়ে দেখলাম—সব শেষ। স্বামী স্ত্রীতে জড়াজড়ি করে উঠে আসছিল, তেমনি জড়াজড়ি করেই ডুবে মরেছে। বাপ ধরেছে ছেলেকে জড়িয়ে, মা ধরেছে মেয়েকে। ব্যস, সেই থেকে লোকের বিশ্বাস এতগুলো লোক যেখানে মরেছে সেখানে ভূত নিশ্চয়ই আছে। বুঝলেন? এই জন্যেই লোকে ভূতের কথা বলে, আর কিছু না।

ডাক্তার—(হাসিয়া) ও, এই।

ম্যানেজার – (হাসিয়া) আজ্ঞে হ্যাঁ, এই।

ডাক্তার—যাক, এইটুকুই জানতে চেয়েছিলুম। চলি। কাল দেখা হবে।

ম্যানেজার—লণ্ঠন নিয়ে যান। বাইরে অন্ধকার যে!

ডাক্তার–না, আর লণ্ঠনের দরকার নেই। এই তো আম বাগানটা পেরিয়েই বাসায় গিয়ে পৌঁছোব। আসি। নমস্কার। ভূতের ভয় আমার নেই। তবু একবার জেনে গেলাম। জেনে রাখা ভাল। (হাসি) কি বলেন?

ম্যানেজার- (হাসি)

(দরজা বন্ধের শব্দ। মচ মচ করিয়া জুতার শব্দ। দূরে মাদল ও বাঁশি বাজিতেছিল। কোথায় যেন একটা কুকুর ডাকিয়া উঠিল। দূরের মাঠে শেয়াল ডাকিতেছে। বাগানের পথে শুকনো ঝরা পাতার উপর ডাক্তারবাবুর জুতার শব্দ। বাগানের ভিতর একটানা রোহিণী পোকার ডাক। )

ডাক্তার—(হঠাৎ ভয় পাইয়া) কে?

—ডাক্তারবাবু। তুই একবার আয় আমার সঙ্গে।

ডাক্তার—কেন? কে তুই?

—আমি যেই হই না কেনে, তুর কি? তুই আয় আমার সঙ্গে।

ডাক্তার—কেন? কি দরকার?

—আয় বাবু, তুই না এলে আমার ছেলেটা মরে যাবেক।

ডাক্তার—কি, হয়েছে কি তোর ছেলের?

—তা জানি না বাবু। তুই দেখবি চল।

ডাক্তার—চল।

(আবার শুকনো পাতার উপর দিয়া পায়ে চলার শব্দ। ঝিঝি পোকার ডাক শোনা যাইতেছে।) ডাক্তার—তোর নাম কিরে?

—টুইলা মাঝি।

ডাক্তার—কত দূর যেতে হবে?

—হোই ত। ওইখানে।

ডাক্তার—খাদে বুঝি তুই কয়লা কাটিস?

—হঁ বাবু। উ-সব জেনে তুর কি হবেক, চল।

ডাক্তার—ক’টি ছেলে তোর?

—ওই একটি। আরও ছিল, তারা কেউ নাই।

ডাক্তার—ছেলেটি কত বড়?

—তা অনেক বড় বটে!

ডাক্তার—তবু ক’ বছরের?

—কে জানে ত! অত-সব জানি না।

ডাক্তার—এ কিরে টুইলা? কাছে বলছিলি যে? পথ যে আর ফুরোতেই চায় না।

-–হঁ বাবু, কাছে লয় ত কি! চল বাবু, অমনি আমাকেও একটো ওষুধ দিবি।

ডাক্তার—তোর আবার কি হয়েছে?

—তাই যদি বলতে পারব তাহলে ত আমিও তুর মতন ডাক্তার হ’থম।

ডাক্তার—তাহলেও বল না কি হয়েছে? জ্বর?

—না বাবু না। জ্বর-টর কিছু লয়। খাদে বান ঢুকেছিল সেই থেকে—

ডাক্তার—বান ঢুকেছিল? কখন রে? সে ত চার পাঁচ বছর আগে। অনেকদিনের কথা

-–হঁ বাবু হঁ, এনেক দিন এগুতে।

ডাক্তার—তারপর?

—তারপর আমরা তেখন এনেক মালকাটা ছিলম খাদের নামুতে। হোই দিককার হোই নামু সুদটোতে কয়লা কাটছিলাম। হুড়মুড় করে শালা বানের জল একবারে—। লম্ফ গলা হাতে নিয়ে ভাবলম ছুটে পালাই। পিথমেই লম্ফ গলা গেল নিমেই। ঘুটঘুটে আঁধার হয়ে গেল। লে—ইবারে কুনদিকে যাবি—যা। পিথমে জল উঠল এক কুমোর, তাবাদে এক-বুক, তাবাদে বাস—

ডাক্তার—সেখান থেকে কেউ ত বাঁচেনি শুনলাম। তুই বাঁচলি কেমন করে? …চুপ করে রইলি যে? হ্যাঁরে, এখানে নাকি খুব ভূতের ভয়?

—কে জানে ত!

ডাক্তার—আচ্ছা তুই সেই বান থেকে বাঁচলি কেমন করে কই বললি না ত?

ডাক্তার—হুঁ, বাঁচলম আবার কুথা। আমি ত মরেই গেইছি।

ডাক্তার—সে কি রে! তু—তু—তুই টুইলা! টু—ইলা! কোথায় তুই? বারে, কোথায় গেলি?

(জুতা পায়ে দিয়া প্রাণপণে ছুটিয়া পালাইবার শব্দ পাওয়া গেল। দূরে একটা কুকুর ডাকিয়া উঠিল।)

দুই

ডাক্তারবাবুর স্ত্রী—হ্যাঁগো, কাল রাত্তিরে ত ছুটতে ছুটতে হাঁপাতে হাঁপাতে বাড়ি ফিরে এলে, আজ আবার এই রাত একটা বাজল, এখনও পর্যন্ত চোখে তোমার ঘুম নেই, শুয়ে শুয়ে ছটফট করছো, কি, ভাবছো কি বল দেখি?

ডাক্তারবাবু—ভাবিনি কিছু। হেড আপিসে একটা দরখাস্ত করে দিলাম। এখান থেকে বদলি হয়ে যাব।

ডাক্তারবাবুর স্ত্রী—কেন, ভূতের ভয়ে?

ডাক্তার-না না ভূত কোথায়। ভূত কিসের? ভূত টুত নেই, তোমরা আবার যেন ভয় পেয়ো না। ও-সব কিছু না। বুঝলে?

(দরজার বাহিরে কড়া নাড়ার শব্দ)

—ডাক্তারবাবু! ডাক্তারবাবু!

ডাক্তারবাবু—এত রাত্তিরে কে ডাকে রে বাবা। বলে দাও আমি ঘুমিয়েছি। এ সময় কোথাও আমি যেতে পারব না। দরজা খুলো না, এইখান থেকে বলে দাও।

—ডাক্তারবাবু!

—আরে ম্যানেজারবাবু। এত রাত্তিরে আপনি আবার কি জন্যে এলেন? (দরজা খোলার শব্দ)

ম্যানেজার—আরে মশাই আর বলেন কেন? বিপদের ওপর বিপদ। খাদের নীচে খুন হয়েছে।

ডাক্তার—খুন! সে কি? রাত্রে খাদ বন্ধ থাকে। খুন কেমন করে হলো?

ম্যানেজার—সে সব অনেক কথা। জরুরি একটা অর্ডার পেয়েছিলাম, তাই ডবল হাজিরার লোভ দেখিয়ে মদ খাইয়ে নামিয়েছিলাম জনকতক লোক। শুনছি নাকি এক ব্যাটা খতম! চলুন, আর দেরি করে লাভ নেই। থানা থেকে ইন্সপেক্টর এসেছেন। চলুন।

ডাক্তার—চলুন।

(অনেকগুলো পায়ের শব্দ)

(বয়লারের সোঁ সোঁ শব্দ। দূরে কুকুর ডাকিতেছে, মনে হইল, একটি মেয়ে যেন কাঁদিতে কাঁদিতে আগাইয়া আসিতেছে।)

—বাবু গো! খাদে আমার সব গেইছে বাবু! (কান্না )

ম্যানেজার—(চলিতে চলিতে) চুপ চুপ, গাংটুর মা, চুপ কর। কি আর করবি বল।

গাংটুর মা—আমি একবার ছেলেটাকে দেখব বাবু, আমাকে নিয়ে চ।

ম্যানেজার—আমরা নিয়ে আসছি তাকে, তুই থাক এইখানে।

গাংটুর মা—গাংটু যে আমার জ্বর গায়ে খাটতে নেমেছিল বাবু—। আমি, তাকে বারণ করেছিলাম।

—আরে এই ব্যাকসম্যান, ঘণ্টি মারো। এ–ইঞ্জিনখালাসি চালাও। চালাও। মারো ঘণ্টি।

(তিনবার ঘণ্টা বাজিল। নীচে হইতে অনসেটার ঘণ্টায় জবাব দিল। লিফটকেজ ঝড়াং করিয়া উপরে আসিয়া থামিল। লোহার চেন আটকানোর শব্দ হইল। গাংটুর মা তখনও কাঁদিতেছিল। সর সর করিয়া কেজ নীচের দিকে নামিতে লাগিল। সোঁ সোঁ শব্দ করিতে করিতে লিফট-কেজ নীচে গিয়া থামিল। চানকের মুখে ঝর ঝর করিয়া জল পড়িতেছে। ঝড়াং করিয়া চেন খুলিবার শব্দ।)

ম্যানেজার—এইদিকে আসুন ইন্সপেক্টরবাবু, চলরে মুনিয়া, তুই আগে আগে চল। ইন্সপেক্টরবাবু, আপনার হাতের টর্চটা জ্বালুন।

(জল-সপসপে পথের উপর ট্রাম লাইনে হোঁচট খাইয়া খাইয়া সকলে আগাইতে লাগিল। ঝিঁঝি পোকার চিরিক চিরিক শব্দ। কোথায় যেন একটা কোলা ব্যাং ডাকিতেছে।…)

ডাক্তার—ওরে বাবারে! (লাফাইয়া উঠিল)

ম্যানেজার–কি কি, কি হলো ডাক্তারবাবু?

ডাক্তার—এই দেখুন না মশাই, পায়ের উপর দিয়ে-

ম্যানেজার-(হাসিয়া) সর্বনাশ। একটা ইঁদুর দেখে ভয় পেয়ে গেলেন? আসুন। আপনি আমাদের মাঝখানে আসুন।

ইন্সপেক্টর—সেই ভালো। আসুন মাঝখানে আসুন।

ডাক্তার-আজ্ঞে হ্যাঁ, সেই ভালো। (পায়ের শব্দ)

ইন্সপেক্টর—লোকটা কখন মরেছে?

ম্যানেজার—বিকেলবেলা। কাজ শেষ করে ওঠবার সময়। ব্যাটা চুরি করে Hanging Coal এ চোট মেরে ছিল আর কি!

—বয়েস কত?

ম্যানেজার—বেশি বয়েস নয়। Young man.

ইন্সপেক্টর—সাঁওতাল?

ম্যানেজার-আজ্ঞে হ্যাঁ। সাঁওতাল।

ইন্সপেক্টর—মা ত দেখলাম ওপরে কাঁদছে। বাপ নেই?

ম্যানেজার–না, বাপটা সেই ত্রিশ সালের বান যখন ঢুকেছিল খাদে তখন মরেছে।

ডাক্তার–বাপের নাম কি ছিল বলতে পারেন?

ম্যানেজার—বাপের নামটা… আমার ঠিক… হাঁরে মুনিয়া, তুই জানিস?

মুনিয়া—কার? গাংটুর বাপের নাম? টুইলা মাঝি।

ডাক্তার—কি বললি? টুইলা মাঝি? আঃ, আরসুলাগুলো কিরকম জ্বালাতন করছে দেখেছেন? ও মশাই, আপনি আবার আমাকে পেছনে ফেলে দিলেন কেন? আমি মাঝখানে যাব। আমার ভয় করছে।

—ভয়? (সকলে হো হো করিয়া হাসিয়া উঠিল)

মুনিয়া—বাবু লাশ ত এখানে ছিল। কই নাই ত’?

ম্যানেজার—সে কি রে? নেই কি রকম? লাশ যাবে কোথায়? দ্যাখ ভাল করে।

মুনিয়া—না বাবু, এই ত এই কাঁথির কাছে দেখে গেলাম, এই ত রক্তের দাগ। আচ্ছা, দাঁড়ান বাবু! আমি একবার ওই দিকটা দেখে আসি।

ডাক্তার-ব্যাটার সাহস ত খুব!

ম্যানেজার-কেন, আপনার কি ভয় করছে নাকি?

ডাক্তার—না মশাই, ভয়-ডর আমার ছিল না, কিন্তু কাল থেকে—

(হঠাৎ একটা বিকট চিৎকার!)

মুনিয়া— বাবু, বাবু, বাবু, বাবু—বা-বা-বা পেয়েছি…

সকলে—(ছুটিয়া তাহার কাছে গিয়া) এই ত লাশ।

মুনিয়া—লাশটার পেটেই পা দিয়ে ফেলেছিলাম বাবু। মড়াটা চেঁচিয়ে উঠল। আপনারা শুনতে পেলেন না?

ম্যানেজার—দূর ব্যাটা! মড়া আবার চেঁচায় নাকি? তুই নিজেই চেঁচিয়েছিস ভয়ে।

মুনিয়া—কিন্তু এ কি বাবু, আলোটা যে নিবে গেল!

ম্যানেজার—জ্বালা! জ্বালা! এই নে দেশলাই। ইন্সপেক্টরবাবু আপনার টর্চটা…

ইন্সপেক্টর—আমি ঠিক আছি।

(দেশলাই জ্বালানোর শব্দ। দুটো, তিনটে, চারটে)

মুনিয়া—না বাবু! এ আলো জ্বলবে না।

ইন্সপেক্টর—সে কিরে? বাঃ, এ কি রকম? আমার টর্চটাও যে নিবে গেল।

ডাক্তার—ব্যস। নে এইবার মর এইখানে। তাহলে কি হবে? চলুন হাতড়ে হাতড়ে কোনোরকমে খাদের মুখে ফিরে যাই। আমার মশাই ভয় করছে।

মুনিয়া—আসুন বাবু, তাহলে আমার পিছু পিছু আসুন।

— যাবি কুথা? আমার ছেলেকে বাঁচা এগুতে, তাবাদে যাবি।

ম্যানেজার–কে তুই?

ডাক্তার—সর্বনাশ! এ যে সেই টুইলার গলার আওয়াজ।

ম্যানেজার—আপনার কাছে রিভলভার ছিল না ইন্সপেক্টরবাবু?

ইন্সপেক্টর—হ্যাঁ—(রিভলভারের আওয়াজ)—

—বটে! আমাকে গুলি করবি? (হো হো করিয়া হাসির শব্দ)—

ইন্সপেক্টর—বাবরে! গেলাম, গেলাম! ছেড়ে দে বাবা, ছেড়ে দে! আর আমি গুলি ছুঁড়বো না, ছেড়ে দে আমি পালাচ্ছি।

(মনে হইল তাহাকে যেন দূরে কেহ টানিয়া লইয়া যাইতেছে।)

—গুলি চালাবি আর? চালা। দেখি কেমন মরদ।

ইন্সপেক্টর—না বাবা! আর না—আর না-

—থাক তুই এইখানে। আমাকে মেরেছিস বানে ডুবোঁই—জলের ভিতর ইঁদুর মারা করে। বড় ছেলেটো সেই সঙ্গে গেইছে, তাবাদে এই ছুটু ছেলেটো ছিল তাখেও দিলি মেরে। কই তুদের ম্যানেজার কই?

ম্যানেজার—এই যে বাবা! আমি বাবু দোহাই বাবা-

—আচ্ছা, তুখেও নাহয় ছেড়ে দিলম। কই, সেই ডাক্তারটো কই?

ডাক্তার—আঁঃ! এই যে বাবা আমি।

—আয় দ্যাখ যদি তুই বাঁচাতে পারিস। কাল ছেলেটোর জ্বর হয়েছিল—সেই যে তুখে বললাম আম-বাগানে। জ্বরে জ্বরেই পয়সার লোভে এসেছিল কয়লা কাটতে। আয় দেখবি আয়।

ডাক্তার—ও আর কি দেখব টুইলা? মরা মানুষ বাঁচাতে ত আমরা পারি না!

—ও! আচ্ছা, যা তবে তুরা পালা ইখান থেকে। আমি একাই রইলাম এইখানে গাংটুকে আগুলে।

ডাক্তার—কিন্তু ওর মা যে ওকে একবার দেখতে চাচ্ছে রে! তাদের ওপরে দেখে এলাম কাঁদছে।

—কাঁদছে! হঁ তা কাঁদবেক আমি জানি। দ্যাখ—হেই ম্যানেজার, আমাদের সবাইকেই ত সাবাড় করেছিস তুই। এবার ওই বুড়িকে যদি না মারিস ত তুখে দিব্যি রইলো। বুঝলি? (গলার আওয়াজ তাহার ভারী হইয়া আসিল) কই, কথার যে আমার জবাব দিছিস নাই। বল কি বলছিস। গাংটু! গাংটু।

(কান্নাকাতর কণ্ঠ তাহার দূরে মিলাইয়া গেল)

সকল অধ্যায়

১. ভয় – শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়
২. প্রেতপুরী – শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়
৩. ভয়ঙ্কর – শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়
৪. ভূতুড়ে বই – শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়
৫. কি? – শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়
৬. নমস্কার – শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়
৭. অসম্ভব – শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়
৮. ন্যাড়া নন্দী – শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়
৯. ভূতের গল্প – শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়
১০. ভীষণ কাণ্ড – শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়
১১. যবনিকা – শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়
১২. আতঙ্ক – শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়
১৩. প্রেতিনী – শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়
১৪. জীবন নদীর তীরে – শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়
১৫. সত্যি নয় – শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়
১৬. ভূতুড়ে খাদ – শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়
১৭. ঘরোয়া ভূত – শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়
১৮. কে তুমি? – শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন