শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়
আমার নাতিরা বলেছিল তারা নাকি এক বন্ধু পেয়েছে।
‘কোথায় পেয়েছিস?’
তারা বলেছিল, ‘পার্কে।
সেদিন সন্ধ্যাবেলা, দেখি না—আমার দুই নাতি বাচ্চু আর মুকুল টানতে টানতে নিয়ে আসছে এক বুড়ো ভদ্রলোককে।
লোকটির বয়স প্রায় সত্তরের কাছাকাছি। মাথার চুল সব পাকা। মুখে দাঁত বলতে একটিও নেই। হাতে একটা লাঠি। বাঁকা। লোকটি বোধহয় সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে না।
বাইরের ঘরে বসল লোকটি।
আমার বাড়িতে এসেছে যখন, আমার নাতিদের বন্ধু, আমার একবার যাওয়া দরকার। কাছে গিয়ে বললাম, ‘নমস্কার। ‘
লোকটি আমার মুখের দিকে মুখ তুলে তাকাল। বড়ো বড়ো দুটি চোখ। মুখে দাঁত নেই। কিন্তু ফোকলা মুখের হাসিটি চমৎকার। হাসতে হাসতে বললে, ‘নমস্কার।’
জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কী নাম আপনার? ‘
‘নাম? আমার নাম ঝুঁকোবাবু।’
ঝুঁকোবাবু? সে আবার কী রকম নাম?’
‘কোমরটা সোজা করতে পারি না মশাই। ঝুঁকে ঝুঁকে চলি, তাই সবাই আমাকে ঝুঁকোবাবু বলে ডাকে।’
‘ভাল নাম কী?’
ঝুঁকোবাবু বললে, ‘ভাল নাম ভুলে গেছি। আপনার নাতিরা আমার বাপের নাম পর্যন্ত ভুলিয়ে দিয়েছে!’
এই বলে ঝুঁকোবাবু হাসতে হাসতে বাচ্চুর মুখের দিকে তাকালে। বললে, ‘কই রে, চা খাওয়াবি বলেছিলি যে।’
মুকুল বললে, ‘আগে গপ্পো, তারপর চা।’
ঝুঁকোবাবু বললে, ‘না। আগে চা, তারপর গল্প।’
চাকরকে ডেকে ঝুঁকোবাবুকে একপেয়ালা চা দিতে বললাম।
খুশিতে ঝুঁকোবাবুর মুখখানা উজ্জ্বল হয়ে উঠলো।
‘বাস্, এবার আপনি চলে যান এখান থেকে। আমার কারবার এই সব ছেলেমেয়েদের সঙ্গে। বুড়োদের সঙ্গে আমি কথা বলি না।’
লোকটি পাগল কি না ঠিক বুঝতে পারলাম না। আমাকে একরকম তাড়িয়েই দিলে ঘর থেকে। পাশের ঘরে গিয়ে বসলাম। তাদের কথাবার্তা সবই শুনতে পাচ্ছিলাম।
চাকর চা দিয়ে গেল।
বাচ্চু মুকুল—দুজনেই অধীর হয়ে উঠেছিল গল্প শোনবার জন্যে।
‘এই তো চা এসে গেছে। বলুন এবার গপ্পো বলুন।’
তা হ্যাঁ, জানে লোকটা গল্প বলতে।
চা খেয়ে চোখ বুজে আপন মনেই বিড়বিড় করে মন্ত্র বলার মত কী যেন বললে ঝুঁকোবাবু। তারপর হাত দুটি জোড় করে কপালে ঠেকিয়ে কার উদ্দেশে যেন প্রণাম করলে।
‘কাকে প্রণাম করলেন আপনি?’
ঝুঁকোবাবু বললে, ‘গল্পেশ্বরীকে।’
হো-হো করে হেসে উঠলো বাচ্চু আর মুকুল। —’গল্পেশ্বরী ঠাকুর আছে নাকি? ধেৎ!’
‘আছে, আছে। তবে আর বেশিদিন বোধহয় তিনি থাকবেন না আমাদের দেশে।’
‘কেন?’
‘তোমাদের যুগে আর কেউ তাঁকে ডাকবে না। গল্পেশ্বরী তাই পালিয়ে যাচ্ছেন দেশ ছেড়ে।’
বাচ্চু বললে, ‘গেলেন তো বয়েই গেল। আপনার চা খাওয়া হয়ে গেছে, এবার গপ্পো বলুন।’
‘শোনো তবে গল্প শোনো। এক যে ছিল রাজা—’
হাঁ-হাঁ করে উঠলো বাচ্চু মুকুল – দুজনেই।
‘না না রাজার গপ্পো শুনবো না।’
‘তাহলে রানির গপ্পো শোনো। রানি একদিন রাজার সঙ্গে ঝগড়া করে বললে, আমি তোমার বাড়িতে থাকব না। আমি চললাম।’
‘তারপর?’
‘তারপর রানি চলে গেল কোটালপুত্রের কাছে। বললে, তোমার কাছে আমি থাকব।’
বাচ্চু বললে, ‘না। কোটাল-ফোটাল চলবে না। ওসব সেকেলে গপ্পো। আজকালকার গপ্পো বলুন।’
‘বেশ তবে আজকালকার গপ্পোই শোনো।
ঝুঁকোবাবু হাত বাড়িয়ে তাকিয়াটা টেনে নিয়ে ভাল করে চেপে বসল। বললে, ‘আমি একটি মেয়েকে দেখেছিলুম—ভারি সুন্দরী মেয়ে। মেয়েটির নাম ছিল গোপা। গোপার মা একদিন আমাকে ডেকে বললে, ঝুঁকোবাবু, পরশু সন্ধেবেলা আপনার নেমন্তন্ন আমাদের বাড়িতে।’
‘কেন? নেমন্তন্ন কেন?’
গোপার মা বললে, ‘গোপার বিয়ে।’
‘কোথায় বিয়ে দিচ্ছ মা? বর আসবে কোত্থেকে?’
বর্ধমান জেলার দেবগ্রাম থেকে।’
শহরের মেয়ে পাড়াগাঁয়ে থাকতে পারবে তো?’
কী করবো বাবা, মেয়ের কপাল।’
মুকুল বললে, ‘না। পাড়াগাঁয়ের গপ্পো শুনবো না। পাড়াগাঁ আমরা দেখি নি।’
বাচ্চু বললে, ‘পাড়াগাঁ শুনেছি খুব নোংরা। সেখানকার লোকগুলো পুকুরের জল খায়। কেরোসিনের আলো জ্বালে। মাটির ঘরে থাকে। হ্যাক্ থু।’
মুকুল বললে, তার চেয়ে আপনি একটা ভূতের গপ্পো বলুন।’
ঝুঁকোবাবু হো হো করে হেসে উঠল। বললে, ‘ভূতের গপ্পো শুনে ভয় পাবি না তো?’
‘না না, ভয় আমরা পাই না, আপনি বলুন।’
ঝুঁকোবাবু বললে, ‘পাড়াগাঁয়ের ভূতের কথা তো শুনবি না। কলকাতার ভূতের কথাই শোন্। ওই যে দেখছিস এই রাস্তার ওপর ওই লালরঙের বাড়িটা—হঠাৎ শুনলাম ওই বাড়িতে ভূতের দাপাদাপি শুরু হয়েছে। বাড়িতে লোকজন কম। দোতলায় থাকে বাড়ির মালিক আর নীচের তলায় একঘর ভাড়াটে। অত্যাচার চলে বাড়ির মালিকের ওপর। বুড়ো মানুষ, রাত্তির কাল, বেচারা খেতে বসেছে, আর জানলা দিয়ে ঠিক সেই সময় একটা ঢিল এসে পড়লো। ঢিলটা এসে পড়লো একেবারে থালার ওপর। চেঁচিয়ে উঠল অনন্ত বসাক। তার গিন্নি ছুটে এলো। গালাগালি দিতে লাগল পাড়া-পড়শি সবাইকে। ভূত বলে কেউ বিশ্বাসই করতে চায় না। এ ঠিক মানুষের কাজ। কোনও দুষ্টু লোক হয়ত এই কাণ্ডটি করছে।
রোজ রাত্তিরবেলা এই রকম কাণ্ড কারখানা চলতে লাগলো। পাড়া-পড়শি সবাই বিরক্ত হয়ে উঠলো। আলো নিভিয়ে দিয়ে ঘুমোচ্ছে সবাই, এমন সময় অনন্ত বসাকের বাড়িতে গোলমাল। ঝনঝন করে ভেঙে পড়েছে জানলার সার্সি। কোন দিক থেকে ঢিল আসছে কেউ কিছু ঠাহর করতে পারছে না। সবাই বললে, ‘থানায় খবর দিন।’
অনন্ত বসাক গেল থানায়। ডায়েরি লিখিয়ে এল।
দারোগাবাবু এলেন সরেজিমনে তদারক করতে। দেখেশুনে বলে গেলেন, ‘দেখি কী করতে পারি।’
করতে তিনি কিছুই পারলেন না। এলোপাথাড়ি ঢিল সমানে পড়তে লাগল! আগে শুধু রাত্রেই পড়ছিল এখন আবার দিনেও ঢিল পড়তে লাগলো।
তাজ্জব কাণ্ড!
মাঝে মাঝে অনন্ত বসাকের বাড়ির দরজায় পুলিসের জিপগাড়ি এসে দাঁড়ায়। দারোগাবাবু হেসে হেসে বলেন, ‘কেমন? ঢিল ছোঁড়া বন্ধ হয়েছে তো?
অনন্ত বসাক হাতজোড় করে কাঁদো কাঁদো মুখে বলে, ‘না হুজুর, বন্ধ হয় নি এখনও।’
হবে হবে—এইবার বন্ধ হয়ে যাবে দেখবেন।’
এই বলে তিনি তাঁর কর্তব্য শেষ করে দিয়ে চলে যান।
নীচের তলার ভাড়াটে ভদ্রলোক কোন্ এক ইস্কুলের পণ্ডিত। কাশীশ্বর বিদ্যারত্ন। তিন চারটি ছেলেমেয়ে নাতি-নাতনি, পুত্র-পুত্রবধূ নিয়ে দিন কাটান। এতদিন এই ঢিল ছোঁড়ার ব্যাপারটা নিয়ে কোনও কথাই তিনি বলেন নি।’
এই পর্যন্ত বলে ঝুঁকোবাবু থামলো একবার। বললে, ‘দাঁড়া একটা বিড়ি খেয়ে নিই।’
মুকুল বললে, ‘আপনি বিড়ি খান?’
‘হ্যাঁ রে বাবা, খাই। পয়সা থাকলে সিগ্রেট খেতুম।’
বিড়ি ধরিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে ঝুঁকোবাবু বললে, ‘কাশীশ্বর বিদ্যারত্নর সঙ্গে একদিন আমার দেখা হল। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘হ্যাঁ মশাই, আপনাদের বাড়িতে নাকি ঢিল পড়ছে?’
গম্ভীর মুখে বিদ্যারত্ন বললেন, হুঁ, পড়ছে। তবে আমার বাড়িতে নয়। পড়ছে অনন্ত বসাকের দোতলায়।’
বললাম, ‘সেই বাড়িতেই তো আপনি থাকেন?’
‘হ্যাঁ, আমি থাকি নীচের তলায়।’
‘তাহলে তো ওই একই বাড়ি হল। ওপর তলা আর নীচের তলা। এবার যদি আপনার ঘরে পড়ে?’
‘পড়বে না, পড়বে না, আমি জানি।’ বিদ্যারত্ন বললেন, ‘এ তো মানুষে ছুঁড়ছে না। ভূতে ছুঁড়ছে। আমি ব্রাহ্মণ মানুষ। তাছাড়া তন্ত্রমন্ত্র কিছু জানি।’
বললাম, ‘বেশ তো, তন্ত্রমন্ত্র যদি জানেন তো তাড়িয়ে দিন ভূতটাকে।
বিদ্যারত্ন তেড়ে মারতে এলেন আমাকে। বললেন, ‘যা জানেন না তাই নিয়ে কথা বলতে আসছেন কেন? চেনেন আপনি অনন্ত বসাককে?’
বললাম, ‘চিনি বইকি। ‘
উনি বললেন, ‘চেনেন যদি তো বলুন ওঁকে—আমার সঙ্গে ওঁর যা কথা হয়েছিল সেই কথাটা রাখতে। তা যদি রাখেন তো আমি না হয় একবার চেষ্টা করে দেখতে পারি।’
গেলাম অনন্ত বসাকের কাছে। দেখলাম সে সদর দরজার কাছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একজন কাচের মিস্ত্রীর সঙ্গে দরদস্তুর করছে। আমাকে দেখেই বলে উঠল, ‘দেখুন না মশাই, কীরকম বিপদে পড়েছি। আমার বাড়িতে ঢিল ছুঁড়ে ছুঁড়ে জানলার কাচগুলো সব ভেঙে দিচ্ছে। ঢিল ছোঁড়া বন্ধ হচ্ছে না কিছুতেই।’
বললাম, বলেন তো আমি একবার চেষ্টা করে দেখতে পারি।’
অনন্ত বসাক হাসলে। অদ্ভুত সে হাসি। হাসতে হাসতে বললে, ‘আপনি পারবেন না ঝুঁকোবাবু। এ ঢিল তো মানুষে ছুঁড়ছে না। মানুষে ছুঁড়লে পুলিসে ধরে ফেলত।’
তাহলে কে ছুঁড়ছে আপনার মনে হয়?’
‘ভূতে। ভূতে ছুঁড়ছে আমি বুঝতে পেরেছি। কাল আমি গয়া যাচ্ছি, পিণ্ডি দিয়ে আসব, তাহলেই বন্ধ হয়ে যাবে।’
কিছুদিন আগে শুনেছিলাম অনন্ত বসাকের এই বাড়িতেই দারুণ একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে। বাড়িটা তখন সবেমাত্র নতুন তৈরি হয়েছে। অনন্ত বসাককে পাড়ার লোক ভাল করে চিনত না তখন। তবে চিনতে তাকে দেরিও হল না। অনন্ত বসাকের বড়ো ছেলে ছিল পাঁড় মাতাল। দিনের বেলা দিব্যি ভাল মানুষটির মতন বাড়ির রকে চুপচাপ বসে থাকে, আর রাত্তির হলেই শুরু হয় তার দাপাদাপি হট্টগোল। পাড়ার লোক মিটিং করলে, অনেকগুলো সহি দিয়ে থানায় দরখাস্ত পাঠালে। কিন্তু তার মীমাংসা হবার আগেই যাকে নিয়ে এত কাণ্ড অনন্ত বসাকের সেই ছেলে একদিন মারা গেল। কেমন করে মরল কেউ কিছুই জানল না। শুধু শুনলে সে মারা গেছে। মাসখানেক পেরোতে না পেরোতেই আবার আর একটা কাণ্ড। সেই ছেলের বিধবা বউ বাড়ির নীচের তলার একটা ঘরে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করলে।
অনন্ত বসাক গয়ায় গেলো। ছেলে বউয়ের নামে পিণ্ডিও দিয়ে এলো। কিন্তু ঢিল ছোঁড়া বন্ধ হল না।
কাশীশ্বর বিদ্যারত্নমশাই সেদিন বোধহয় তখন ইস্কুল থেকে ফিরছিলেন। আমাকে দেখেই থমকে দাঁড়ালেন।
‘কী হল ঝুঁকোবাবু? ঢিল ছোঁড়া থামল? গয়ায় পিণ্ডিই দিক আর যাই করুক—থামবে না। আপনি সেই কথাটা বলেছিলেন অনন্ত বসাককে?’
বললাম, ‘না মশাই, আপনার কথাটা বলি নি। বলব এইবার।’
‘বলবেন।’
বলেছিলাম, ‘তোমার এ ভূতটা দেখছি বড় সাংঘাতিক ভূত। তোমার নীচের তলার ভাড়াটে ওই যে কাশীশ্বর বিদ্যারত্নমশাই—’
নামটা শুনেই চেঁচিয়ে উঠল অনন্ত বসাক। কথাটা আমাকে শেষ করতেই দিলে না। বললে, ‘বিদ্যারত্ন না শুষ্টির মাথা। ব্যাটা পাজির একশেষ। তিন তিনটি মাস বাড়ির ভাড়া দেয় নি। বলছি তোমাকে কিচ্ছু দিতে হবে না, তুমি উঠে যাও। তাও যাচ্ছে না।’
জিজ্ঞাসা করেছিলাম, তাঁর সঙ্গে আপনার কোনও শর্ত হয়েছিল?’
‘ব্যাটা আপনাকে বলেছে বুঝি?’
‘না। বিশেষ কিছু বলে নি। তবে লোকটা বিদ্বান-মানুষ, পণ্ডিত-মানুষ, তার ওপর তন্ত্রমন্ত্র কিছু জানে।’
‘ছাই জানে। তবে শুনুন।’
এই বলে অনন্ত বসাক সব কথা আমাকে খুলেই বললে। বললে, ‘এই বাড়ির যে ঘরটায় কাশীশ্বর থাকে ওই ঘরে আমার ছেলের বউ গলায় দড়ি দিয়েছিল। বাড়িতে দু-দুটো মানুষ মারা গেল তাই আমরা ভাবলাম নীচের তলাটা ভাড়া দিয়ে আমরা দোতলায় উঠে যাই। কিন্তু ভূতের বাড়ি বলে ভাড়া কেউ নিতে চায় না। শেষে ওই কাশীশ্বর রাজি হল। বললে, ভাড়া যদি দশ টাকা কমিয়ে দাও তাহলে আমি যেতে পারি। দিলাম দশ টাকা কমিয়ে। তার পর বলে কিনা আরও পাঁচ টাকা কমাও। তারপর বলে—আবার। এমনি করে করে পঞ্চাশ টাকা ভাড়ার জায়গায় এখন হয়েছে তিরিশ টাকা। তাও তো তিন মাস একটি পয়সা দেয় নি। ব্যাটা ভেরেছে কী? ভেবেছে বুঝি বিনা ভাড়ায় আমি ওকে থাকতে দেবো? কখনো না। এবার আমি ওর নামে নালিশ করবো।’
ব্যাপারটা বুঝলাম সব।
অনন্ত বসাকের বাড়িতে ঢিল ছোঁড়া বন্ধ হল না। কাশীশ্বর বিদ্যারত্নমশাই-এর কপালে সিঁদুরের ফোঁটাটা জ্বলজ্বল করতে লাগল। গলায় দেখা গেল একটি রুদ্রাক্ষের মালা ঝুলিয়েছেন।
বিদ্যারত্ন উপাধি লাভ করেছেন তিনি। বিদ্বান মানুষ তাতে কোন সন্দেহই নেই। তার ওপর তন্ত্রসাধনায় সিদ্ধিলাভ করেছেন বোধহয়। নইলে অনন্ত বসাকের ব্যাটার বউ ভূত হয়ে তাঁর কাছে বাঁধা পড়লো কেমন করে? শ্বশুর-শাশুড়ির ওপর রাগ তার নিশ্চয়ই ছিল। গলায় দড়ি দিয়ে কেন মরেছে, তার সেই মৃত্যুর রহস্য আমার কাছে একেবারে অজানা কিন্তু কোথাকার কোন্ এক কাশীশ্বর বিদ্যারত্নর ওপর তার এমন কীসের আকর্ষণ যার জন্যে সে তার হয়ে ঢিল ছুঁড়ে ছুঁড়ে বুড়ো শ্বশুরকে একেবারে নাস্তানাবুদ করে তুললে?
ভেবে ভেবে কিছুই যখন ঠিক করতে পারলাম না, তখন নিজেই একদিন উঠে পড়ে লেগে পড়লাম। থানায় গিয়ে দারোগাবাবুর কাছে আড্ডা জমালাম।
আগেকার দারোগাবাবু—যিনি এই অনন্ত বসাকের ব্যাপারটা সবই জানতেন—তিনি তখন বদলি হয়ে গেছেন। তাঁর জায়গায় যিনি এসেছেন, বড় রসিক মানুষ তিনি। নাম গগন গুপ্ত।
বললাম, ‘সেই একটা কবিতায় পড়েছি—গগনে গরজে মেঘ ঘন বরষা। – তেমনি একবার গর্জে উঠতে হবে আপনাকে।’
হাসতে হাসতে গগনবাবু বললেন, ‘কেন বলুন তো?’
বললাম, ‘থানা পুলিসের নাম শুনলে মানুষ ভয় পায় জানি। এবার ভূত-প্রেতগুলো আপনাদের ভয় করে কিনা দেখব।’
‘ভূতপ্রেত পাবেন কোথায় মশাই?’
বললাম, ‘ধরে আনব। একটা ভূতকে একদিন আপনার কাছে ধরে আনব।’
গগনবাবু ভেবেছিলেন আমি হাসি রহস্য করছি। কথাটা বিশ্বাস করলেন না।
কিন্তু বিশ্বাস করলেন সেইদিন যেদিন সত্যিসত্যিই ভূতটাকে ধরলাম। ধরে নিয়ে গেলাম থানায়।’
বাচ্চু মুকুল দুজনেই চেঁচিয়ে উঠলো, ‘ভূত আপনি ধরলেন? কেমন দেখতে? ঠিক মানুষের মতন?’
‘হ্যাঁ, ঠিক মানুষের মতন।
‘তারপর কী হল?’
ঝুঁকোবাবু বললে, ‘ভূত জব্দ হয়ে গেল। গগনের গর্জন আর দু-চারটে রুলের গুঁতো। বাস্, সব ঠান্ডা।’
বাচ্চু বললে, ভূতটাকে আর-একদিন ধরুন। আমরা দেখব।
ঝুঁকোবাবু বললে, ‘সে কি আছে এ-পাড়ায়? ব্যাটা তো পুলিসের ভয়ে বাড়ি ছেড়ে দিয়ে পালিয়েছে।’
মুকুল বললে, ‘ব্যাটা বলছেন কাকে? ভূত তো অনন্ত বসাকের ছেলের বউ।’ ঝুঁকোবাবু বললে, ‘না রে না, ভূত হচ্ছে গিয়ে সেই কাশীশ্বর বিদ্যারত্ন। মরা ভূত নয়, জ্যান্ত। সেই ব্যাটাই ঢিল ছুঁড়ত।’
বাচ্চু বললে, ‘এবার একটা সত্যিকারের ভূতের গপ্পো বলুন।’
ঝুঁকোবাবু বললে, ‘এই তো সত্যিকার ভূত। এই কাশীশ্বর বিদ্যারত্ন। কপালে সিঁদুরের ফোঁটা, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা। বাইরেটা একরকম, ভেতরটা আর-একরকম। কত রকমের ছদ্মবেশে কত ভূত যে ঘুরে বেড়াচ্ছে তার হিসেব নেই।’
হাঁ করে শুনছিল বাচ্চু আর মুকুল।
ঝুঁকোবাবু বললে, ‘এরা কিন্তু পেঁচি ভূত। আবার আর এক রকমের ভূত আছে। তাদের হাঁ-টা এই এ-ত বড়। তারা বলে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের যা-কিছু ভাল সব আমি নেব আমি খাব। তারাই আমাদের সবচেয়ে বড়ো শত্রু।’
মুকুল বললে, ‘তবে যে শুনেছি ভূতগুলো অন্ধকারে ঘুরে বেড়ায়—তাদের সহজে কেউ
দেখতে পায় না।’
‘হ্যাঁ সেইগুলোই মরা ভূত। তারা মানুষের মনের কোণে অন্ধকারে ঘাপটি মেরে বসে থাকে, সুবিধে পেলে সেইখান থেকে বেরিয়ে আসে, আবার সেইখানেই মিলিয়ে যায়। তারা মানুষের কোনও ক্ষতি করে না।’
মুকুল বাচ্চু দুজনেই বললে, ‘সেইরকম ভূতের গপ্পো একটা শুনব।’
ঝুঁকোবাবু বললে, ‘গল্পেশ্বরীকে জিজ্ঞাসা করব। তিনি যদি অনুমতি দেন তো শোনাব।’
‘গল্পেশ্বরীর অনুমতি নিতে হবে কেন?’
ঝুঁকোবাবু বললেন, ‘ডামাডোলের বাজার তো! সব জায়গায় সব গল্প বলতে নেই।’
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন