কি? – শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়

শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়

গিয়েছিলাম কোরেজের কাছে ওষুধ আনতে। আমাদের গ্রাম থেকে ক্রোশখানেক দূরের একটা গ্রামে।

কোবরেজ-মশাই-এর কাছে ওষুধ আনতে যাওয়া এক ঝকমারি কাণ্ড। কোবরেজ-মশাই নিতান্ত নোংরা আলকাতরার পিপের মতন একটা মোটা তাকিয়া হেলান দিয়ে শুয়ে ছিলেন। আমায় দেখবামাত্র বললেন, ‘বোসো বাবাজি, বোসো।’

ঘরের এক কোণের দিকে একটা বেঞ্চি পাতা ছিল, তাতেই বসলাম। বললাম, ‘ওষুধ আমায় একটু তাড়াতাড়ি দিন কোবরেজ-মশাই রাত্তির হয়ে গেল, তার ওপর আজ আবার অমাবস্যা।’

কোবরেজ-মশাই হাসতে হাসতে গড়গড়ার নলটা সরিয়ে রাখলেন। হ্যাঃ, এইটুকু তো পথ। হাঁকলে সাড়া পাওয়া যায়, তার আবার রাত্তির, তার আবার অমাবস্যা।’

এই বলে তিনি ওষুধ দিতে বসলেন। কিন্তু তাঁর ওষুধ দেওয়া আর শেষই হয় না। হবে কেমন করে? গল্প করবেন, না ওষুধ দেবেন!

ঘরের মধ্যে তক্তাপোশের ওপর একটা লণ্ঠন জ্বলছিল। আমি ঘন-ঘন বাইরের দিকে তাকাচ্ছিলাম। রাত্রির অন্ধকার ক্রমশ গাঢ় হয়ে আসছে। দূরের মাঠ থেকে শেয়ালের ডাক শোনা যাচ্ছে। গ্রামের প্রান্তে কোথায় যেন কয়েকটা কুকুর চিৎকার করছে বলে মনে হল।

শীত কমে গিয়ে তখন মিষ্টি মিষ্টি বাতাস বইতে শুরু করেছে। সময়টা ভাল, কিন্তু অন্ধকার রাত্রে শুকনো ধানক্ষেতের আলি-রাস্তার ওপর দিয়ে আমি বাড়ি পৌঁছাব কেমন করে সেই কথাই ভাবছি। তার ওপর আমাদের গ্রামের কাছাকাছি গিয়ে ছোট্ট একটি শুকনো নদীর তীরে শ্মশান। আর সেই শ্মশানের ওপর দিয়ে আমায় যেতে হবে। ছি। ছি! কোবরেজ-মশাই এত দেরি করবেন জানলে দিনের বেলায় আসতাম।

কোবরেজ-মশাই তখনও ওষুধের পুঁটলি বাঁধছেন আর এক নাগাড়ে গল্প বলে চলেছেন। তাঁর বলবার বিষয় হচ্ছে—’কোরেজি জিনিসটে বড় শক্ত ব্যাপার বাবা, যে-সে আয়ত্ত করতে পারে না। বাজারে আজকাল নানা রকমের ওষুধ বেরিয়েছে বটে, কিন্তু সব ব্যাটা ফাঁকিবাজ, সব ব্যাটা জোচ্চোর!’

অর্থাৎ খাঁটি জিনিস কেউ যদি পেতে চায় তো সে যেন আমাদের এই মহাপুরুষের কাছে আসে।

সে যাই হোক, ওষুধ পেয়েও রক্ষা নেই। ব্যবহারের নিয়মাবলি শুনে বুঝলুম, –অনুপান জোগাড় করতে তিন গাঁয়ে ছুঁড়তে হবে। সবগুলি জোগাড় করতে গেলে ডোবা পুকুর, বন-বাদাড় ও শ্মশান-মশান সব জায়গায়ই যেতে হবে। শুনে তাঁর ঔষধালয় থেকে যখন বেরিয়ে এলাম, পল্লীগ্রামের পথে-ঘাটে তখন অমাবস্যা রাত্রির গভীর অন্ধকার নেমেছে। সে-যে কত গভীর, তা যে স্বচক্ষে না দেখেছে, সে বুঝবে না। কোলের মানুষ চেনা যায় না—এত গাঢ়!

অন্ধকারের ভেতর দিয়ে চোখের দৃষ্টি যথাসম্ভব তীক্ষ্ণ করে করে এগিয়ে চললাম। গ্রাম তখন পার হই-নি, পথের ধারে এক জায়গায় দেখা গেল, প্রকাণ্ড একটা তেঁতুল গাছের তলায় সরকারি চণ্ডীমণ্ডপের ওপর কয়েকজন লোক বসে বসে সুর করে রামায়ণ পড়ছে, আর টিম টিম করে ভাঙা একটি কাগজের পট্টি-দেওয়া কালিপড়া লণ্ঠন জ্বলছে।

আমায় পেরিয়ে যেতে দেখেই তাদের মধ্যে কে-একজন চিৎকার করে বলে উঠলো – কে?

থমকে দাঁড়ালাম, বললাম, ‘আমি।’

গোপালপুরে আমায় চেনে না এমন লোক খুব কম।

‘এসো এসো মুখুজ্যে, তামাক খেয়ে যাও। আঁধার হয়ে গেল, কোথায় গিয়েছিলে?’

ভাবলাম, ভালই হল এদের কাছে একটা লণ্ঠন চেয়ে নেবো। বললাম, ‘এসেছিলাম লোচন কোরেজের কাছে ওষুধ নিতে।’

বলতে বলতে তাদের কাছে এগিয়ে গিয়ে বসলাম। বললাম, ‘রাত্রি হয়ে গেল, তার ওপর অমাবস্যা। এই ঘুটঘুটে অন্ধকারে মাঠের ওপর দিয়ে পথ চিনে বাড়ি যাব কেমন করে তাই ভাবছি।’

নানান কারণে লোকে আমায় সাহসী বলেই জানে। কেমন করে জানল, সে-সব অনেক কথা। তাদের ভেতর থেকে একজন বলে উঠল, – ‘হ্যাঁঃ আপনার আবার অন্ধকার। আপনিই কত লোককে পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতে পারেন।’

যে আমায় ডেকে বসিয়েছিল, সে তো হো হো করে হেসে উঠলো। বললে, – মুখুজ্যের কথা শোনো।’

হায় হায়, লণ্ঠন চাইব ভাবছিলাম, তাও আর হল না।

কলকেটা বার কতক টেনেই উঠে পড়লাম। অন্ধকারেই হোঁচট খেতে খেতে চলেছি। গ্রামের শেষে ছোট্ট একটি আমবাগানের পাশে দেখলাম জনকতক চাষা প্যাকাটি পুড়িয়ে আগুন জ্বালছে আর বসে বসে গল্প করছে।

আমায় দেখে একজন গড় করে প্রণাম করে বললে, ‘পেন্নাম ঠাকুরমশাই।’

বললাম, ‘কল্যাণ হোক। –তোদের ওই প্যাকাটি এক বোঝা আমায় দে দেখি বাবা। ওই প্যাকাটি জ্বেলে জ্বেলে পথ দেখে দেখে চলে যাই।’

তারা হাসতে হাসতে এক বোঝা প্যাকাটি হাতে তুলে দিলে।

বাঁচা গেল!

কয়েকটি করে প্যাকাটি একসঙ্গে দপ দপ করে জ্বলতে থাকে, আগুনের ফিনকি খোলা মাঠের ওপর দিয়ে অন্ধকারের মধ্যে জ্বলন্ত তারার মত উড়ে উড়ে বহু দূর পর্যন্ত চলে যায়, আর সেই আলোয় পথ দেখতে দেখতে এগিয়ে চলি।

এমনি করে ভেবেছিলাম, বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে যাব, কিন্তু হায়, অদৃষ্ট মন্দ, আলো আর শেষ পর্যন্ত জ্বলে না।

হঠাৎ একসময় পথের মাঝখানেই প্যাকাটির আলো গেল নিবে। গ্রাম থেকে তখন বহু দূরে চলে এসেছি। অন্ধকার মাঠের মাঝখানে থমকে দাঁড়িয়ে ফুঁ দিয়ে দিয়ে হয়রান হয়ে গেলাম, প্যাকাটি তবু আর জ্বললো না। খানিকটা ধোঁয়া শুধু নাক দিয়ে পেটে গিয়ে ঢুকল, আর চোখে লেগে চোখ দুটো জ্বালা করতে লাগল।

দূর ছাই! বলে বিরক্ত হয়ে প্যাকাটির বোঝা দিলাম সেই মাঠের উপর ছড়িয়ে। আগুনে ফিনকি অসংখ্য তারার মত বায়ুবেগে ঊর্ধ্বে উঠতে উঠতে একে একে নিবে গেল। চোখদুটো রগড়ে দিতেই চোখের কোণ বেয়ে দর দর করে জল গড়িয়ে এল। জল মুছে ভাল করে তাকাতে গিয়ে দেখি—সর্বনাশ! আলোয় তখন চোখে যেন ধাঁধা লেগে গেছে, অন্ধকারটা মনে হল যেন হাত দিয়ে অনুভব করা যায়।

এখানে এমনভাবে দাঁড়িয়ে থাকাও চলে না। চেনা পথ—তাই কোনোরকমে আন্দাজে এগিয়ে চললাম। ঝিঁঝি পোকার একটানা ঝিম ঝিম শব্দ ছাড়া আর কোথাও কিছু শব্দ নেই। সেই শব্দে মাথার ভেতরটাও কেমন যেন ঝিম ঝিম করতে লাগল। মাঠের একটা প্রকাণ্ড ফাটলে হোঁচট খেয়ে পথের পাশে ছোট একটা বোয়ান গাছের ঝোপের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়লাম। উঠেই মনে হল—এইবার একটুখানি জোরে জোরে চলতে হবে।

.

সুমুখে আমাদের গ্রাম-প্রান্তের সেই শ্মশান। আশপাশের অনেকগুলো গ্রাম থেকে মড়া নিয়ে এসে এইখানেই পোড়ায়। কাজেই কত মানুষ যে ওখানে পুড়েছে, তার আর অন্ত নেই।

নিজের আত্মীয়স্বজন যারা মরেছে, তাদের তো নিজে দাঁড়িয়ে থেকে ওইখানে পুড়িয়েছি। এই সেদিনও তো নিকুঞ্জ ভট্টচার্যের বৌটাকে পুড়িয়ে গেলাম। মরবার সময় তার মুখের চেহারাটা অত্যন্ত বীভৎস হয়ে উঠেছিল, চোখ-দুটো হয়েছিল বড় বড়, নাকটা গিয়েছিল বেঁকে, দাঁতগুলো বেরিয়ে পড়েছিল। সর্বনাশ! হঠাৎ সেই ভয়াবহ চেহারাটা অন্ধকারে আমার চোখের সুমুখে যেন ভেসে উঠল! পা থেকে মাথা পর্যন্ত একবার শির শির করে এল। ভাবলাম—ভয় কীসের? মৃতদেহটা তো তার পুড়িয়ে ছাই করে দিয়ে গেছি।

কিন্তু আমাদের নিস্তারিণী! তাকে তো পোড়ানো হয়-নি! গলায় দড়ি দিয়ে মেয়েটা আত্মহত্যা করেছিল। ইস্! সে-মুখ, সে-চেহারা ভাবতেও রোমাঞ্চ হয়! শ্রীহরি! শ্রীহরি! নিস্তারিণীকে গ্রামের চৌকিদারেরা গ্রাম থেকে টানতে টানতে নিয়ে এসে ওই শ্মশানের কোথায় না-জানি পুঁতে দিয়ে গেছে। শেয়াল-কুকুরে এত দিন তাকে টেনে তুলে এখন আর কিছুই বোধ করি অবশিষ্ট রাখেনি। তা হোক। তবু কেমন যেন ভয় ভয় করতে লাগল।

আপন মনেই এইসব ভাবতে ভাবতে এগিয়ে চলেছি। হঠাৎ দেখি—নদীর শুকনো বালির ওপর আমার পা পড়েছে। তাহলে এই তো শ্মশান! হ্যাঁ— শ্মশানই বটে! ওদিকে ওই প্রকাণ্ড বটের গাছটা নাবাল নামিয়ে অন্ধকারের মাঝে দাঁড়িয়ে রয়েছে…আর ওই তো সেই আমের বাগান!

শ্মশান থেকে উঠেই আমায় ওই বাগানের মাঝখান দিয়ে চলতে হবে। পায়ে-চলা সরু পথের উপর শুকনো আয়ের পাতা পড়েছে। তার ওপর পা পড়তেই মচ মচ করে শব্দ উঠলো। নিজের পায়ের শব্দে নিজেই একবার চমকে উঠলাম। আমের গাছে মুকুল ধরেছে। বাতাসে তারই গন্ধ পাচ্ছি। কেমন যেন তীব্র মধুর একটি অতি পরিচিত গন্ধ!

এই বাগানের মাঝখানে শ্মশান-কালীর মন্দির। মন্দির বলতে এখন আর কিছুই নেই। ভাঙা চারপাট মাটির দেওয়াল কোনোরকমে খাড়া দাঁড়িয়ে আছে মাত্র। আমাদের বীরভূমের শক্ত মাটি, তাই রক্ষে, বর্ষার জল খেয়েও ও দেওয়ালের চারপাট আর পড়ে না। বছরের মধ্যে একদিন মাত্র শ্যামা-পুজোর রাত্রে ওই দেওয়ালের ওপর কখনও তালের বাগড়ো, কখনও খড় চাপিয়ে ছাদন করে গ্রামের লোক শ্মশান-কালীর পুজো আর বলিদান সেরে দিয়ে চলে যায়।

শ্মশান-কালীর ওই মন্দিরের পাশ দিয়ে আমায় যেতে হবে। এগিয়ে চলেছি। হঠাৎ কেমন যেন একটা অদ্ভুত শব্দ শুনে চমকে দাঁড়ালাম। মনে হল, নিকটেই কোথায় যেন ঝুম ঝুম ঝুম ঝুম করে ঘুঙুরের শব্দ হচ্ছে। যেদিক থেকে শব্দটা আসছিল, সেই দিকে কান পেতে অন্ধকারে চোখের দৃষ্টি যথাসম্ভব প্রসারিত করে তাকিয়ে দেখি— শ্মশান কালীর সেই দেওয়াল-চারটের সুমুখে বলিদানের জন্য যেখানে হাড়ি-কাঠ পোঁতা আছে, সেই জায়গাটায় কে যেন অন্ধকারে ভূতের মতন ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে—কালো একটা লম্বা মানুষের মত গাটা একবার ছম্ ছম্ করে উঠলো। কিন্তু এ সময় ভয় পেলে চলবে না। শুনেছি—এইরকম ক্ষেত্রে ভয় পেয়ে ছুটে পালাতে গিয়ে অনেকে মরে গেছে। কিন্তু পা-দুটো ঠক্ ঠক্ করে কাপতে লাগল। প্রাণপণে তাদের কাঁপুনি থামিয়ে ইষ্টমন্ত্র জপ করতে করতে এগিয়ে গেলাম। দেখতে হবে ব্যাপারটা কি? যা থাকে কপালে! মরি মরব।

কাছে যেতেই খানিকটা বুঝতে পারলাম। আমাদের গ্রামের পশ্চিমদিকে ছোট্ট যে গ্রামখানি আছে, শুনেছি সেই গ্রামের জটি-পাগলি এমন করে শ্মশানে শ্মশানে ঘুরে বেড়ায়, আর বিড় বিড় করে আপন মনেই কী যেন বকে। ভাবলাম, সে ছাড়া এ আর কেউ নয়।

জটি-পাগলিকে আমরা কতবার দেখেছি। কালো ভূতের মত লম্বা চেহারা, মাথার চুলে বড় বড় জটা বেঁধেছে, নোংরা কাপড়ের ওপর কাপড় চড়িয়ে গায়ের আবরণটা কাথার মত পুরু হয়েছে। গ্রামে তার ছোট্ট একখানি মাটির ঘর আছে, ঘরে ছেলে আছে, ছেলের বৌ আছে, কিন্তু কেউ তাকে বাড়ির মধ্যে ধরে রাখতে পারেনি। নিজের যখন ইচ্ছা হয়, তখন বাড়িতে গিয়ে থাকে, আবার হঠাৎ একসময় বাড়ি থেকে পালায়। দিনের বেলা শ্মশানের ওপর দিয়ে হি হি করে হাসতে হাসতে ঘুরে বেড়াতে তাকে আমি কতবার দেখেছি।

সেদিনও সেই জটি-বুড়িকে ভেবেই আমি তার দিকে সাহসে ভর করে এগিয়ে গেলাম।

কাছে গিয়ে বললাম, ‘কে। জটি-বুড়ি?’

আমার নিজের কথাটাই নিস্তব্ধ সেই শ্মশানের অন্ধকারে ছোট্ট সেই নদীর ওপর আমবাগানের মাঝখানে কেমন যেন কাঁপতে কাঁপতে থেমে গেল। ওদিক থেকে কোনও সেই শব্দে মাথার ভেতরটাও কেমন যেন ঝিম ঝিম করতে লাগল। মাঠের একটা প্রকাণ্ড ফাটলে হোঁচট খেয়ে পথের পাশে ছোট একটা বোয়ান গাছের ঝোপের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়লাম। উঠেই মনে হল—এইবার একটুখানি জোরে জোরে চলতে হবে।

.

সুমুখে আমাদের গ্রাম-প্রান্তের সেই শ্মশান। আশপাশের অনেকগুলো গ্রাম থেকে মড়া নিয়ে এসে এইখানেই পোড়ায়। কাজেই কত মানুষ যে ওখানে পুড়েছে, তার আর অন্ত নেই।

নিজের আত্মীয়স্বজন যারা মরেছে, তাদের তো নিজে দাঁড়িয়ে থেকে ওইখানে পুড়িয়েছি। এই সেদিনও তো নিকুঞ্জ ভট্টচার্যের বৌটাকে পুড়িয়ে গেলাম। মরবার সময় তার মুখের চেহারাটা অত্যন্ত বীভৎস হয়ে উঠেছিল, চোখ-দুটো হয়েছিল বড় বড়, নাকটা গিয়েছিল বেঁকে, দাঁতগুলো বেরিয়ে পড়েছিল। সর্বনাশ! হঠাৎ সেই ভয়াবহ চেহারাটা অন্ধকারে আমার চোখের সুমুখে যেন ভেসে উঠল! পা থেকে মাথা পর্যন্ত একবার শির শির করে এল! ভাবলাম—ভয় কীসের? মৃতদেহটা তো তার পুড়িয়ে ছাই করে দিয়ে গেছি।

কিন্তু আমাদের নিস্তারিণী! তাকে তো পোড়ানো হয়-নি। গলায় দড়ি দিয়ে মেয়েটা আত্মহত্যা করেছিল। ইস্। সে-মুখ, সে-চেহারা ভাবতেও রোমাঞ্চ হয়! শ্রীহরি! শ্রীহরি! নিস্তারিণীকে গ্রামের চৌকিদারেরা গ্রাম থেকে টানতে টানতে নিয়ে এসে ওই শ্মশানের কোথায় না-জানি পুঁতে দিয়ে গেছে। শেয়াল-কুকুরে এত দিন তাকে টেনে তুলে এখন আর কিছুই বোধ করি অবশিষ্ট রাখেনি। তা হোক। তবু কেমন যেন ভয় ভয় করতে লাগল।

আপন মনেই এইসব ভাবতে ভাবতে এগিয়ে চলেছি। হঠাৎ দেখি—নদীর শুকনো বালির ওপর আমার পা পড়েছে। তাহলে এই তো শ্মশান। হ্যাঁ— শ্মশানই বটে। ওদিকে ওই প্রকাণ্ড বটের গাছটা নাবাল নামিয়ে অন্ধকারের মাঝে দাঁড়িয়ে রয়েছে…আর ওই তো সেই আমের বাগান!

শ্মশান থেকে উঠেই আমায় ওই বাগানের মাঝখান দিয়ে চলতে হবে। পায়ে-চলা সরু পথের উপর শুকনো আমের পাতা পড়েছে। তার ওপর পা পড়তেই মচ মচ করে শব্দ উঠলো। নিজের পায়ের শব্দে নিজেই একবার চমকে উঠলাম। আমের গাছে মুকুল ধরেছে। বাতাসে তারই গন্ধ পাচ্ছি। কেমন যেন তীব্র মধুর একটি অতি পরিচিত গন্ধ!

এই বাগানের মাঝখানে শ্মশান-কালীর মন্দির। মন্দির বলতে এখন আর কিছুই নেই। ভাঙা চারপাট মাটির দেওয়াল কোনোরকমে খাড়া দাঁড়িয়ে আছে মাত্র। আমাদের বীরভূমের শক্ত মাটি, তাই রক্ষে, বর্ষার জল খেয়েও ও দেওয়ালের চারপাট আর পড়ে না। বছরের মধ্যে একদিন মাত্র শ্যামা-পুজোর রাত্রে ওই দেওয়ালের ওপর কখনও তালের বাগড়ো, কখনও খড় চাপিয়ে ছাদন করে গ্রামের লোক শ্মশান-কালীর পুজো আর বলিদান সেরে দিয়ে চলে যায়।

শ্মশান-কালীর ওই মন্দিরের পাশ দিয়ে আমায় যেতে হবে। এগিয়ে চলেছি। হঠাৎ কেমন যেন একটা অদ্ভুত শব্দ শুনে চমকে দাঁড়ালাম। মনে হল, নিকটেই কোথায় যেন ঝুম ঝুম ঝুম ঝুম করে ঘুঙুরের শব্দ হচ্ছে। যেদিক থেকে শব্দটা আসছিল, সেই দিকে কান পেতে অন্ধকারে চোখের দৃষ্টি যথাসম্ভব প্রসারিত করে তাকিয়ে দেখি — শ্মশান কালীর সেই দেওয়াল-চারটের সুমুখে বলিদানের জন্য যেখানে হাড়ি-কাঠ পোঁতা আছে, সেই জায়গাটায় কে যেন অন্ধকারে ভূতের মতন ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে—কালো একটা লম্বা মানুষের মত। গাটা একবার ছম্ ছম্ করে উঠলো। কিন্তু এ সময় ভয় পেলে চলবে না। শুনেছি—এইরকম ক্ষেত্রে ভয় পেয়ে ছুটে পালাতে গিয়ে অনেকে মরে গেছে। কিন্তু পা-দুটো ঠক্ ঠক্ করে কাঁপতে লাগল। প্রাণপণে তাদের কাঁপুনি থামিয়ে ইষ্টমন্ত্র জপ করতে করতে এগিয়ে গেলাম। দেখতে হবে ব্যাপারটা কি? যা থাকে কপালে। মরি মরব।

কাছে যেতেই খানিকটা বুঝতে পারলাম। আমাদের গ্রামের পশ্চিমদিকে ছোট্ট যে গ্রামখানি আছে, শুনেছি সেই গ্রামের জটি-পাগলি এমন করে শ্মশানে শ্মশানে ঘুরে বেড়ায়, আর বিড় বিড় করে আপন মনেই কী যেন বকে। ভাবলাম, সে ছাড়া এ আর কেউ নয়।

জটি-পাগলিকে আমরা কতবার দেখেছি। কালো ভূতের মত লম্বা চেহারা, মাথার চুলে বড় বড় জটা বেঁধেছে, নোংরা কাপড়ের ওপর কাপড় চড়িয়ে গায়ের আবরণটা কাঁথার মত পুরু হয়েছে। গ্রামে তার ছোট্ট একখানি মাটির ঘর আছে, ঘরে ছেলে আছে, ছেলের বৌ আছে, কিন্তু কেউ তাকে বাড়ির মধ্যে ধরে রাখতে পারেনি। নিজের যখন ইচ্ছা হয়, তখন বাড়িতে গিয়ে থাকে, আবার হঠাৎ একসময় বাড়ি থেকে পালায়। দিনের বেলা শ্মশানের ওপর দিয়ে হি হি করে হাসতে হাসতে ঘুরে বেড়াতে তাকে আমি কতবার দেখেছি।

সেদিনও সেই জটি-বুড়িকে ভেবেই আমি তার দিকে সাহসে ভর করে এগিয়ে গেলাম।

কাছে গিয়ে বললাম, ‘কে। জটি-বুড়ি?’

আমার নিজের কথাটাই নিস্তব্ধ সেই শ্মশানের অন্ধকারে ছোট্ট সেই নদীর ওপর আমবাগানের মাঝখানে কেমন যেন কাঁপতে কাঁপতে থেমে গেল। ওদিক থেকে কোনও জবাব নেই। কিন্তু মনে হল যেন সে থেমেছে। ঝুম ঝুম করে ঘুঙুর আর বাজছে না।

সাহসে ভর করে আরও একটুখানি এগিয়ে গেলাম। কালো সেই মানুষের মূর্তিটাও একটুখানি দূরে সরে গেল। অত্যন্ত দুঃসাহসী হলে মানুষ যেমন মরিয়া হয়ে ওঠে, আমিও তখন ঠিক সেই রকম হয়ে গেছি।

তাড়াতাড়ি এগিয়ে অন্ধকারে হাত বাড়িয়েই তাকে ধরে ফেললাম। মনে হল, ভিজে একটা কাপড় জাপটে ধরেছি। তাই ধরেই টানতে টানতে বললাম, ‘এখানে কেন? চল—বাড়ি চল।’

অন্ধকারে সে খিল খিল করে হেসে উঠল।

জটি-পাগলি এমনি করেই হাসে।

আবার বললাম, ‘চল।’

আবার সেই হাসি। এ হাসি কিন্তু জটি-পাগলির মত মনে হল না। আশ্চর্য, অদ্ভুত! মনে হল, এ যেন কোনও যুবতীর হাসি। তা হোক! আমার ভয় তখন অনেকটা চলে গেছে। টানতে টানতে তাকে আমাদের গ্রামের দিকেই নিয়ে চললাম। কিন্তু পথে যেতে যেতে এত কথা যে বললাম, তার মুখ থেকে ঘন ঘন খিল খিল করে হাসি ছাড়া কিছুই আর শুনতে পেলাম না।

তবু তাকে টেনে নিয়ে চললাম।

জটি-পাগলিদের গ্রামে যেতে হলে আমাদের গ্রামের কাছাকাছি এসে ডানদিকে মেঠো রাস্তা ভাঙতে হয়।

আমি তখন গ্রামে এসে পড়েছি। আর ভয় নেই ভেবে তাদের গ্রামের সেই রাস্তাটার কাছে এসে—দিলাম তাকে ছেড়ে। বললাম, ‘এখান থেকে বাড়ি যেতে পারবি তো পাগলি? ও-ই তোদের গ্রামের আলো দেখা যাচ্ছে। –এই পুকুরের পাড় ধরে সোজা চলে যা।’

.

পাগলি অন্ধকারে এগিয়ে গেল।

তৎক্ষণাৎ পিছন ফিরে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘গেছিস তো পাগলি?’

জবাব এল—’হ্যাঁ তুমি যাও।’

সর্বনাশ। কণ্ঠস্বর শুনে চমকে উঠলাম। যে স্ত্রী আমার এই সেদিন মারা গেছে, এ যেন ঠিক তারই কণ্ঠস্বর।

আর এতদূরে সে এরই মধ্যে চোখের পলক ফেলতে না ফেলতে গেল কেমন করে? এই তো—এইমাত্র তাকে ছেড়ে দিলাম, এরই মধ্যে দেখা গেল, সে প্রায় সামনের গ্রামের কাছাকাছি গিয়ে পৌঁছেছে। দৌড়ে গেলেও এতদূর যাওয়া অসম্ভব।

বাড়ি গিয়ে সে রাত্রে আমার আর ঘুম হল না। ভোর হতে না হতেই বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লাম। জটি-বুড়িদের গ্রামে গিয়ে তাকে একবার কাল রাত্রের কথাটা জিজ্ঞাসা করে আসি।

তাদের গ্রামে যখন পৌঁছোলাম, ঘুম থেকে উঠে লোকজন তখন সবেমাত্র দোর খুলছে। পথে প্রসন্ন স্যাকরার সঙ্গে দেখা। —ওই মুখুজ্যে-মশাই যে। এত সকালে আমাদের গ্রামে?’

হ্যাঁ ভাই, জটি-বুড়িকে একবার দেখতে এলাম।’

প্রসন্ন বললে, ‘জটি-বুড়ি? মাগী এইবার মরবে।’

মরবে কী হে? – কেন?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ। মাগী আজ মাসখানেক ধরে বড্ডো ভুগছে।’

জটি-বুড়ির বাড়ির ভিতর গিয়ে দেখি, সত্যিই তাই। দেখলাম, বুড়ি আজ মাসাবধিকাল রোগে ভুগে ভুগে একেবারে জীর্ণ কঙ্কালসার হয়ে বিছানায় মিশে গেছে। বিছানা ছেড়ে ওঠা দূরে থাক, কথা কইবার সঙ্গতিটুকু পর্যন্ত নেই।

গত রাত্রির রহস্যটা আমার কাছে রহস্যই রয়ে গেল। তখনও বুঝতে পারিনি আজও বুঝতে পারছি না।

সকল অধ্যায়

১. ভয় – শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়
২. প্রেতপুরী – শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়
৩. ভয়ঙ্কর – শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়
৪. ভূতুড়ে বই – শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়
৫. কি? – শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়
৬. নমস্কার – শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়
৭. অসম্ভব – শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়
৮. ন্যাড়া নন্দী – শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়
৯. ভূতের গল্প – শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়
১০. ভীষণ কাণ্ড – শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়
১১. যবনিকা – শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়
১২. আতঙ্ক – শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়
১৩. প্রেতিনী – শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়
১৪. জীবন নদীর তীরে – শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়
১৫. সত্যি নয় – শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়
১৬. ভূতুড়ে খাদ – শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়
১৭. ঘরোয়া ভূত – শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়
১৮. কে তুমি? – শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন