শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়
এক কলিয়ারি থেকে আর এক কলিয়ারিতে বদলি হয়ে এসেছি।
কয়লা-কুঠির ডাক্তার। ভারি ঝকমারি কাজ। খাদের কুলি-কামিন থেকে আরম্ভ করে ম্যানেজার সাহেব পর্যন্ত—যে যেখানে আছে, সকলেরই জীবন মরণ যেন আমারই হাতে। আমি যেন তাদের বিধাতা। কারও পায়ে একটুখানি আঁচড় লেগেছে—ডাক ডাক্তারকে! কোথাও কোনও কুলি-ধাওড়ায় হয়ত রুগী মরছে—ডাক ডাক্তারকে! খাদের নীচে কুলি মরেছে—সকলের আগে আমাকেই সেখানে ছুটতে হবে। সে যাই হোক, চাকরি করতে এসে সে দুঃখু করে লাভ নেই।
বাসাটি মন্দ নয়। টালি দেওয়া খান চারেক ঘর, সুমুখে দাওয়া উঁচু ছোট একটুখানি রক, রকের নীচেই উঠোন, উঠোনে রান্নার জায়গা।
চারিদিক ফাঁকা। ভাবলাম, ভালই হল। আগে যে কলিয়ারিতে ছিলাম—প্রকাণ্ড কলিয়ারি, ছোটখাট একটা শহর বললেই হয়, চারিদিকে ধোঁয়া আর বস্তি, দম যেন আটকে আসত। এখানে তাহলেও একটুখানি নিশ্বাস নিয়ে বাঁচব।
ম্যানেজারবাবু বাঙালি। বড় অমায়িক ভদ্রলোক। প্রথম এসেছি, তাঁর সঙ্গে আলাপ পরিচয়টা ভাল করে জমিয়ে রাখা ভাল। বিকেলে বেড়াতে বেড়াতে সেদিন তাঁর বাংলোর দিকেই যাচ্ছিলাম। কালো রঙের ভুঁড়িওয়ালা বেঁটে এক ভদ্রলোক আমায় দেখে নমস্কার করে পথের মাঝে থমকে দাঁড়ালেন। গোঁফগুলি নিচের দিকে বেঁকে তাঁর মুখে এসে ঢুকেছে, চোখে সাদা রঙের নিকেলের চশমা, আমার মুখের পানে একদৃষ্টে তাকিয়ে ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনিই নতুন ডাক্তার না? আমি হেড ক্লার্ক।
কি আর বলব, ঘাড় নেড়ে একটুখানি হেসে নমস্কার করে এগিয়ে যাচ্ছি, তিনি আমার পিছু নিলেন। বললেন, চলুন তবে ওই দিক দিয়েই যাই, আপনার সঙ্গে গল্পও করা হবে।
বলেই তিনি নিজের পরিচয় দিতে শুরু করলেন। এখানে চাকরি করছেন প্রায় দশ বছর, অথচ একটি দিনের জন্যেও কামাই তিনি করেননি। বাড়ি তাঁর বেশি দূরে নয়। এখান থেকে মাইল খানেকের মধ্যেই একটা গ্রামে। সন্ধের আগেই রোজ তাঁকে বাড়ি পৌঁছতে হয়।
কোনও কথাই তাকে আমি জিজ্ঞেস করিনি, তবু তিনি আমায় সাবধান করে দিলেন। বললেন, ‘দেখুন, এখানকার নিয়মই হচ্ছে তাই। সন্ধের পর আপনিও যেন আর বাসা থেকে বেরোবেন না। নতুন মানুষ—জানেন না তো, তাই সাবধান করে দিলাম।’
বললাম, ‘কেন?’
বলতেই তাঁর সেই কালো গোঁফের জঙ্গল ভেদ করে পানে-রাঙা লাল-লাল কয়েকটি দাঁত বেরিয়ে পড়ল। বুঝলাম তিনি একটুখানি হাসলেন।
বললেন, ‘জিজ্ঞেস করবার কিছু নেই। বড় ভীষণ জায়গা মশাই! আপনি ভূত বিশ্বেস করেন?’
বললাম, ‘না।’
‘এই মরেছেন। চারিদিকে ভূত মশাই, কলিয়ারিটা ভূতে ভূতে একেবারে ছেয়ে গেছে। সন্ধে হলে এ তল্লাটে আর জন মনিষ্যি দেখতে পাবেন না। খাদের নিচে দিনের বেলাতেই লোকজন নামতে ভয় করে, রাত্রের কাজ তো একরকম উঠেই গেছে। অন্ধকার রাত্রে এক-একদিন দেখবেন কি ভীষণ ব্যাপার। ঘরে বসেই হয়ত শুনতে পাবেন, ইঞ্জিনের শব্দ হচ্ছে, খাদ চলছে, ঘণ্টা বাজছে, ট্রাম লাইনের উপর ঘড় ঘড় ঘড় ঘড় করে কয়লার গাড়ি ঠেলার শব্দ পাচ্ছেন, কিন্তু কাছে গিয়ে দেখুন—সব চুপ! কোথাও কিছু নেই। সন্ধেয় হয়ত দেখলেন, ডিপোয় কয়লার একটা গুঁড়ো পর্যন্ত নেই, সকালে গিয়ে দেখুন—চার পাঁচ ওয়াগন কয়লা গাদা হয়ে গেছে।’
বললাম, ‘তাহলে তো ভালই বলতে হবে। ভূতগুলো খুব উপকারী বলুন!’
ভদ্রলোক আবার তেমনি দাঁত বের করে একবার হাসলেন। বললেন, ‘তা বললে হবে কি, খুন জখম যে লেগেই আছে। এমন মাস গেল না যে, খাদের নিচে দু চারটে খুন না হচ্ছে। আগে মশাই যা কিছু হত—ওই খাদের নীচেই হত, গত ছ’বছর ধরে ভূতগুলো দেখছি ওপরে ও উঠে এসেছে। এই ধরুন, আমার আপিসের খাতাপত্র! আজ ঠিক যেমনটি রেখে চাবি বন্ধ করে দিয়ে এলাম, কাল এসে দেখব—সব ওলট-পালট হয়ে গেছে—এখানকার জিনিস ওখানে, ওখানকার জিনিস এখানে,—একেবারে তছনছ কাণ্ডকারখানা। তবে নষ্ট কিছু করে না—এই যা!
আজকাল আমাদের সব গা সওয়া হয়ে গেছে।
হেসে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তাই বুঝি বেলা থাকতে থাকতে আপনাকে বাড়ি পৌঁছতে হয়?’
ঘাড় নেড়ে ভদ্রলোক জানালেন, ‘নিশ্চয়। একদিন যে-কাণ্ড ঘটেছিল মশাই, শুনলে আপনার গা-হাত-পা শিউরে উঠবে। থাক, আজ আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে—আর একদিন বলব। এখন চলি। নমস্কার।’ বলেই তিনি তাঁর হাত দুটি তুলে আমায় আর একটি নমস্কার করে ডানদিকে রাস্তা ভাঙলেন।
ম্যানেজারবাবুর সঙ্গে সেদিন আমার অনেক কথাই হল। বললাম—’ভূতের কথা কি সব শুনছি আপনার কলিয়ারিতে—এ কি সত্যি?’
ম্যানেজারবাবু হাসলেন। বললেন, ‘শুনেছেন এরই মধ্যে?’
বললাম, ‘শুনেছি, কিন্তু ভূত আবার কী? আমার তো বিশ্বাস হয় না কোনওদিন।’
ঘাড় নেড়ে ম্যানেজারবাবু বললেন, ‘কিছু নয়। তবে খাদের অবস্থা বড় খারাপ। চালগুলো অত্যন্ত নরম। খুব সাবধানে কাজ করতে হয়, নইলে কয়লা কাটতে গিয়ে চাল থেকে পাথর খসে পড়ে; লোকজন প্রায়ই মারা যায়। ‘
বলেই তিনি একটুখানি কী যেন ভাবলেন। ভেবে বললেন, ‘কিছুদিন আগে—না কিছুদিন আগে কেন, অনেকদিন আগে, আমি তখন এখানে ছিলাম না। সিঙ্গারণ নদীতে সে বছর ভয়ানক বান হয়। বানের জল এত বেশি বেড়ে ওঠে যে, হঠাৎ একদিন দেখতে না দেখতে বান এসে পড়ে—খাদের মুখে। চানকের পথে হুড় হুড় করে জল ঢুকতে থাকে। তাকে আর রুখবে কে? দিনের বেলা। খাদের নিচে তখন কাজ চলছে। লোকগুলোকে বাঁচাবার অনেক চেষ্টাই করা হয়েছিল, কিন্তু দুদিন ধরে ক্রমাগত জল ঢুকেছে, তিন দিনের দিন বান যখন কমল, খাদ তখন ভর্তি হয়ে গেছে। পাম্প দিয়ে জল তুলে তুলে অনেক কষ্টে নিচে নেমে গিয়ে দেখা গেল—প্ৰায় পঞ্চাশ জন লোক খাদের যেখানে সেখানে মরে পড়ে রয়েছে। ব্যস্, সেই থেকে লোকের ধারণা হল যে, অতগুলো লোক একসঙ্গে যেখানে মারা যেতে পারে, ভূত সেখানে আছেই।’ এই বলে তিনি খুব জোরে জোরে হো হো করে হেসে উঠলেন।
আমিও হাসলাম বটে, কিন্তু কেবলই আমার মনে হতে লাগল—আহা, অতগুলো মানুষ, কোনও দিক থেকে কোনও সাহায্য না পেয়ে নিতান্ত অসহায়ের মত হাহাকার করে জলে ডুবে মারা গেল—কারও হয়ত বুড়ো বাপ-মা আছে খাদের ওপরে কুলি-ধাওড়ায়, কারও ছেলে, কারও মেয়ে, কারও স্ত্রী, কারও স্বামী-পুত্র—আহা! চুপ করে ভাবতে গিয়ে মুখের হাসি আমার মুখেই মিলিয়ে গেল—সে করুণ দৃশ্য যেন আমি আমার চোখের সুমুখে দেখতে পেলাম।
গল্প করতে করতে সন্ধ্যা হল। ম্যানেজারবাবুর চাকর আমাদের কাছে লণ্ঠন দিয়ে গেল। উঠতে যাচ্ছিলাম। তিনি বললেন, ‘একটু চা খেয়ে যান।’
চা খেয়ে তাঁর কাছ থেকে যখন বিদায় নিলাম, রাত্রি তখন আটটা।
ম্যানেজারবাবু বললেন, ‘আলো নিয়ে চাকরটা আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসুক।’
ভাবলাম, তিনি ভেবেছেন হয়ত ভূতের ভয়ে রাস্তায় যদি আমার আবার কিছু বিপদ আপদ হয়। হেসে বললাম, ‘না, কিছু দরকার নেই। ভূতের ভয় আমি করি না।
তিনিও হেসে আমায় নমস্কার করে দরজাটি বন্ধ করে দিলেন।
ফটক পেরিয়ে বাইরে যখন পথে এসে দাঁড়ালাম, দেখি অন্ধকারে তখন চারিদিক থম্ থম্ করছে, কোথাও জনমানবের সাড়াশব্দ নাই। মাথার উপর আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, আকাশটা যেন তারায় তারায় ঠাসা। তারই একটুখানি ঝাপসা আলোয় পথের উপর দিয়ে এগিয়ে চললাম।
বাসাটা আমার নেহাৎ কাছে নয়। পথের পাশে দু-তিনটে কুলি-ধাওড়া পেরিয়ে গিয়ে আম-কাঠালের একটি বাগান, তারপরেও খানিকটা কালো কয়লার গুঁড়ো দিয়ে তৈরি ছোট একটি পথ, তারই কিছুদূর এগিয়ে গিয়ে বাঁ হাতি একটা পোড়ো বাড়ির মত ভাঙা বাড়ি, সেইখান থেকে ডানদিকে একটা নিমগাছের তলা দিয়ে মিনিট-দুই হাঁটলেই আমার বাসার দরজায় গিয়ে পৌঁছোব।
কী যেন ভাবতে ভাবতে আমি সেই বাগানের ভিতর সরু একফালি পায়ে চলা পথের উপর দিয়ে চলেছি। মানুষের পায়ের শব্দ পেয়ে আমার পিছনের কুলি-ধাওড়ায় সেই যে একটা কুকুর চেঁচাতে আরম্ভ করেছে, তার চিৎকার তখনও থামেনি, হঠাৎ দেখি, কয়েকটা গাছের তলা দিয়ে শুকনো পাতার ওপর খড়মড় শব্দ করতে করতে মস্ত লম্বা কালোরঙের একটা লোক আমার সুমুখে এসে দাঁড়াল। আচমকা অন্ধকারে সত্যিই আমি একটুখানি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম! জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছি, তার আগেই লোকটা আমার আরও একটুখানি কাছে সরে এসে বললে, ডাক্তারবাবু, তুই একবার আয় আমার সঙ্গে।’
লোকটা বোধহয় সাঁওতাল। বললাম। ‘কেন?’
সে বললে, ‘ছেলেটাকে আমার বাঁচাতে হবেক্ ডাক্তার। তুই যদি না যাবি ত ছেলেটো মরে যাবেক্—তুই আয়।’
‘কী হয়েছে তোর ছেলের?’
বললে, ‘তা জানি না বাবু, তুই দেখবি চল্, আবার তুকে আমি ঘরের কাছে দাঁড়াই দিয়ে যাব।’ গলার আওয়াজ শুনে মনে হল লোকটা এক্ষুনি হয়ত কেঁদে ফেলবে। আমি আর ‘না’ বলতে পারলাম না। বললাম, ‘চল্।’
বাগান পেরিয়ে আমরা আর একটা রাস্তা ধরলাম। সে আমার আগে আগে চলতে লাগল। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘তোর নাম কি?’
বললে, ‘আমার নাম টুইলা মাঝি!’
বললাম, ‘কতদূর যেতে হবে?’
হাত বাড়িয়ে কাছেই কয়েকটা খড়ো ঘর দেখিয়ে দিয়ে বললে, ‘ওইখানে।’
চুপ করে পথ আর কত চলি, তার সঙ্গে কথা কইতে আরম্ভ করলাম। ‘খাদে বুঝি তুই কয়লা কাটিস্?’
‘হুঁ বাবু।’
‘কটি ছেলে তোর?’
‘ওই একটি।’
‘ছেলেটি কত বড়?’
‘তা এনেক্ বড় বেটে।’
‘তবু—ক বছরের?’
‘কে জানে ত! অতসব জানি না।’
এমনি সব নানান কথা কইতে কইতে পথ আমরা চলেছি তো চলেইছি। সামনে হাত বাড়িয়ে যে ঘরগুলো সে আমায় দেখিয়েছিল, যতই এগিয়ে যাই, মনে হয় সেগুলো আরও দূরে। বললাম—’এ কিরে টুইলা, কাছে বলেছিলি যে!’
টুইলা বললে, ‘ই বাবু, কাছে লয় তো কী!’ কিন্তু পথ যেন আর ফুরোয় না।
সময় কাটাবার জন্যে আবার কথা শুরু করলাম। ‘ছেলেটার তোর কী হয়েছিল প্রথমে?’
টুইলা চুপ করে রইল।
‘প্রথমে হয়েছিল কী? হ্যাঁরে?’
টুইলা যেন বিরক্ত হয়ে জবাব দিলে। বললে, ‘খাদে বান্ ঢুকেছিল।’
বান্! হঠাৎ আমার ম্যানেজারবাবুর সেই বানের কথাটা মনে পড়ল। বললাম, ‘কখন রে? সে তো অনেকদিন —
টুইলা বললে, ‘হঁ–এনেক দিন।’
বললাম, ‘তারপর?’
‘তারপর—আমরা তেখন এনেক লোক ছিলাম খাদের ভিতরে—কয়লা কাট্ছিলম্।’
বললাম, ‘সেখান থেকে কেউ তো বাঁচেনি শুনলাম, তুই বাঁচলি কেমন করে?’ টুইলা আর জবাব দেয় না।
এবার আমার কেমন যেন মনে হল। বললাম, হাঁরে টুইলা, শুনছি নাকি এখানে খুব ভূতের ভয়। সত্যি নাকি?’
হঠাৎ দেখি, টুইলা নেই। অন্ধকারে, ভাবলাম, কালো মানুষ, হয়ত খানিকটা এগিয়ে গেছে তাই দেখতে পাচ্ছি না। ডাকলাম, ‘টুইলা!’
কোথায় টুইলা।
এদিক ওদিক আগে পিছে তাকিয়ে দেখি, টুইলা কোথাও নেই। চারিদিকে দিকচিহ্নহীন অন্ধকার। আর ঝিঝিপোকার ডাক! মাথার ভেতরটা চম্ করে ঘুরে উঠল। সমস্ত শরীরের রক্ত তখন আমার জল হয়ে গেছে!
কোন দিক দিয়ে কেমন করে কতক্ষণ যে চলেছি কিছুই আমার মনে নেই। রাত্রির অন্ধকার কেটে গিয়ে চারিদিক যখন ফর্সা হচ্ছে, দেখি তখনও আমি পথ চলছি। শরীরে তখন আমার শক্তি নেই, পায়ে জোর নেই, নিতান্ত কেমন যেন মরিনি বলেই বেঁচে আছি–এমনিই আমার মনে হতে লাগল। দূরে কতকগুলো লোক আসছে দেখে সেইখানে সেই পথের ধারেই আমি বসে পড়লাম। কিন্তু কাউকে যে আর বিশ্বাস হয় না। এরাও ভূত নয় তো?
প্রভাতের আলোয় দেখলাম, কয়েকজন কুলি তাদের ঝোড়া গাঁইতি কাঁধে নিয়ে কুঠিতে বোধহয় কাজ করতে চলেছে। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘হ্যাঁরে, ডোমরণা কোন দিকে?’
একজন বললে, ‘সে হেথা কোথা বাবু? উ-ই যে চিনি দেখছিস্, হোইখানে।’
সর্বনাশ! উঠে দাঁড়ালাম। প্রায় তিন মাইল হেঁটে একেবারে ক্লান্ত পরিশ্রান্ত আধ-মরা হয়ে বাসায় যখন ফিরলাম, দেখি, বাড়িতে তখন কান্নাকাটি পড়ে গেছে। মেয়ে, ছেলে এমন কি চাকরটা পর্যন্ত সারারাত্রি ঘুমোয়নি। অপরিচিত জায়গা, কাকেই বা কী বলবে, ভগবানের উপর নির্ভর করে সবাই তখন হাঁ করে পথের পানে চেয়ে আছে।
পাছে ওরা ভয় পায় ভেবে কাউকেই কিছু বলিনি। বললাম, ‘মরণাপন্ন একটি রুগীর কাছে সারারাত আমায় জাগতে হয়েছে।’ বলেই সেখান থেকে আমায় বদলি করবার জন্যে কোম্পানির হেড অফিসে একটি দরখাস্ত করে জবাবের আশায় বসে আছি, এমন দিনে আবার আর এক দুর্ঘটনা।
রাত্রি তখন প্রায় একটা। ম্যানেজারের কাছ থেকে ডাক এল— খাদের নীচে লোক মরেছে, আমায় যেতে হবে।
বলে পাঠালাম, যাওয়া আমার পক্ষে অসম্ভব। ম্যানেজারবাবুকে দয়া করে এখানে একবার আসতে বল। আলো হাতে দুজন চাপরাশী সঙ্গে নিয়ে ম্যানেজারবাবু নিজেই এলেন। হাসতে হাসতে বললেন, ‘ভূতের ভয় বুঝি?’ সে দিনের সেই টুইলার কথাটা আমি তাঁকে বলিনি। লজ্জায় বলতে পারিনি।
বললাম, ‘না, তা নয়। খাদের নীচে রাত্রে তো এখানে কাজ কেউ করে না, তবে মরল কেমন করে?’
ম্যানেজার বললেন, ‘কিছু কয়লার দরকার ছিল তাই ডবল হাজরি নিয়ে মদ খাইয়ে নামিয়েছিলাম। পুলিশে খবর পাঠিয়েছি, তার আগে চলুন একবার দেখে আসতে হবে।’
অনেকগুলো লোকজন সঙ্গে নিয়ে তো ভয়ে ভয়ে খাদে গিয়ে নামলাম। কিন্তু অবাক কাণ্ড! কয়লা কাটা হচ্ছিল—সাত নম্বর কাঁথির মুখে। সেইখানেই কয়লার চাবড়া মাথায় পড়ে লোকটা মরেছে। মরবার পর মৃতদেহ তারা সেইখানেই ফেলে রেখে লোকজন ওপরে উঠে এসেছিল। ফিরে এসে দেখা গেল মৃতদেহ সেখানে নেই। মালকাটার সর্দারকে সঙ্গে নিয়ে প্রচুর আলো এবং লোকজনের সঙ্গে সঙ্গে আমরা মৃতদেহের সন্ধান করতে লাগলাম। প্রায় ঘণ্টাখানেক খোঁজাখুঁজির পর দেখা গেল, তার সেই রক্তাক্ত মৃতদেহ পড়ে আছে প্রকাণ্ড ‘গোঁফে’র মাঝখানে— যেখানে যাবার কোনও সম্ভাবনাই তার নেই। মৃতদেহটাকে সেখান থেকে টেনে এনে আবার সেই সাত নম্বর কাঁথির কাছেই রেখে দিয়ে আমরা তো উপরে উঠে এলাম। পুলিশ না আসা পর্যন্ত মৃতদেহ উপরে তোলবার উপায় নেই। অথচ প্রচুর পুরস্কারের লোভেও কেউ সেখানে মড়া আগলে থাকতে রাজি হল না।
ম্যানেজারবাবু নিজে আমায় বাসায় পৌঁছে দিয়ে গেলেন। পুলিশ এলে আবার আমাদের খাদে নামতে হবে।
রাত্রি তখন কত ঠিক মনে নেই। পুলিশ এসেছে। আবার আমরা খাদের নীচে নেমে গেলাম। এবার আমাদের সঙ্গে আর বেশি লোক গেল না। যেতে চাইলেও না। ম্যানেজারবাবু হেসে বললেন, ‘পুলিশ যাচ্ছে আমাদের সঙ্গে, আর ভাবনা কি? ভূতেরও তো পুলিশের ভয় আছে।’
ম্লান হাসি হেসে নেমে তো গেলাম! যা থাকে কপালে! একে রাত্রির অন্ধকার, তায় আবার কালো কয়লার সেই পাতালপুরী! চারিদিক কালো। তবে আমাদের সঙ্গে আলোও ছিল প্রচুর। প্রত্যেকের হাতেই একটি করে অ্যাসিটিলিন গ্যাসের বাতি। পুলিশের ইন্সপেক্টরের হাতে টর্চ।
আগে-আগে যাচ্ছে মাল-কাটার সর্দার। কিন্তু গিয়ে দেখি অবাক কাণ্ড! মৃতদেহ সেখানে নেই। খালি খানিকটা রক্তের দাগ কালো কয়লার ওপর জমাট বেঁধে রয়েছে দেখলাম। এ-ওর মুখ চাওয়া চাওয়ি করে, দাঁড়িয়ে আছি। কারও মুখে কোনও কথা নেই। চারিদিকে নিস্তব্ধ। খাদের চাল থেকে কোথাও বা খুট খুট করে ছোট ছোট কয়লার টুকরো খসে খসে পড়ছে, কোথাও-বা টুপ টুপ করে জল পড়ার শব্দ পাচ্ছি। কী করা যায়?
ইন্সপেক্টরবাবু বললেন, ‘আসুন, এদিক-ওদিক খোঁজ করে দেখি, আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।’
বিশ্বাস তাঁর না হবার কথাই। কিন্তু আমরা আর না বিশ্বাস করে যাই কোথায়। এর আগের বারেও তো এমনি হয়েছিল।
খোঁজাখুঁজি আরম্ভ করলাম। ইন্সপেক্টরবাবু বেশ সাহসী লোক। টর্চের আলো ফেলতে ফেলতে তিনিই সবার আগে আগে চললেন। সবার পেছনে যেতে আমার ভয় করছিল। কোন রকমে পাশ কাটিয়ে কৌশল করে কাউকে জানতে না দিয়ে ফস করে আমি এক সময় মাঝে গিয়ে ঢুকলাম।
খোঁজার আর অন্ত রইল না। কিন্তু লাশ আর পাওয়া যায় না।
খুব ছোট একটা সুড়ঙ্গের ভিতর দিয়ে চলেছি, হঠাৎ একটা বিকট চিৎকার। ভয়ানক একটা কিছু অপঘাত ঘটলে মরবার আগে মানুষ যেমন করে চেঁচিয়ে ওঠে, –এও যেন ঠিক তেমনি একটা গোঙানির শব্দ। একেবারে ইন্সপেক্টরবাবুর পায়ের কাছে। আমরা তো সব চমকে উঠে শিউরে খানিকটা পিছু হাঁটতে গিয়ে এ-ওর গায়ে গায়ে লাগালাম ধাক্কা! ভয়ে তো আমি ম্যানেজারবাবুকে তখন জড়িয়ে ধরেছি। সর্বাঙ্গ শির শির করে গায়ের লোমগুলো খাড়া হয়ে উঠেছে। গেলাম আর কি! বাঁচবার আর কোনও আশা নেই।
ইন্সপেক্টরবাবু তো অত সাহসী লোক! টর্চের আলো ফেলে যেমনি নীচের দিকে তাকিয়েছেন—দেখেন, মৃতদেহের বুকের উপর পা দিয়ে তিনি দাঁড়িয়ে!
‘বাপ!’ বলে তিনি লাফিয়ে একেবারে উল্টে এসে পড়লেন আমার ঘাড়ে। আমি পড়লাম ম্যানেজারের গায়ে, ম্যানেজার দিলেন একটা কনস্টেরলের পা মাড়িয়ে। এমনি করে সবাই মিলে আমরা হুটোপাটি করছি, এমন সময়-অবাক কাণ্ড! ইন্সপেক্টরের হাতের টর্চ গেল নিবে, অনেক টেপাটেপি করে কিছুতেই আর জ্বালানো গেল না। তার পরেই একে একে আমাদের প্রত্যেকের হাতের আলোগুলো নিবতে আরম্ভ করল।
প্রাণের আশা তখন একেবারেই ছেড়ে দিলাম।
কাঠ হয়ে আমরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পরামর্শ করলাম- যেমন করে হোক দেশলাই জ্বেলে জ্বেলে সুড়ঙ্গের দেওয়াল ধরে ধরে চলুন আমরা ফিরে যাই। এমন করে এখানে প্রাণ দেওয়ার চেয়ে পালিয়ে যাওয়া ভাল।
সর্দার বললে, ‘চল আমি পথ চিনি। দে, একটো জ্বালা কাঠির বাসকো দে আমার হাতে।’
আমার পকেটে দেশলাই ছিল, কাঁপতে কাঁপতে সেটা বের করে সর্দারের হাতে দিলাম।
কিন্তু ফস করে সর্দার যেই একটা কাঠি জ্বেলেছে, তারই সেই সামান্য আলোতে দেখতে পেলাম, কিম্ভূতকিমাকার প্রকাণ্ড একটা দৈত্যের মত কালো কুচকুচে এক সাঁওতাল ___ দাঁড়িয়েছে আমাদের সুমুখে। লম্বা লম্বা হাত দুটো বাড়িয়ে সে আমাদের সুড়ঙ্গের পথ আগলে বলে উঠল—’যাবি কুথা? ছেলেকে আমার বাঁচা এগুতে, তা বাদে যাবি।’
ইন্সপেক্টরের পকেটে ছিল রিভলভার, চট করে সেটা বের করে তিনি ধাঁ করে চালালেন এক গুলি! ভীষণ আওয়াজে কানে আমাদের তালা লেগে গেল।
কিন্তু তৎক্ষণাৎ শুনতে পেলাম, অন্ধকার সুড়ঙ্গের মধ্যে ইন্সপেক্টর চিৎকার করে উঠলেন— ‘গেলাম! গেলাম! ওরে বাবারে! ছেড়ে দে বাবা ছেড়ে দে!’
ভূতে মানুষে মারামারি! ইন্সপেক্টরের গোঙানির আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি। মনে হচ্ছে যেন তাঁকে সে আমাদের কাছ থেকে খানিক দূরে নিয়ে গিয়ে ফেলেছে। ঝটপট ঝটপট করতে করতে সব থেমে গেল। শুনলাম, সাঁওতালটা বলছে, গুলি চালাবি আর? চালা— দেখি কেমন মরদ!
আমরা তখন পরস্পর পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে ঠক্ ঠক্ করে কাঁপছি।
‘আমাকে মেরেছিস বানে ডুবোঁই, জলের ভিতর ঠিক ইঁদুর-মারা করে। ছেলেটো ছিল, আবার তাখেও মেরে দিলি।’ বলতে বলতে সাঁওতালটা এগিয়ে এল আমাদের দিকে। – কই তুদের ম্যানেজার কই?’
ম্যানেজারবাবু কেঁদে ফেললেন, ‘দোহাই বাবা, আমায় ছেড়ে দে বাবা, আমার কোনও দোষ নেই।’
‘আচ্ছা তুখে না হয় ছেড়ে দিলম্, কই ডাক্তারটো কই?’ বলেই হাত বাড়িয়ে টপ্ করে আমার ঘাড় ধরে বললে, ‘আয়, দ্যাখ যদি তুই বাঁচতে পারিস।’
আমার তখন দম আটকে এসেছে। মুখ দিয়ে কথা বেরোচ্ছে না। গোঁ গোঁ করছি।
***
তারপর কেমন করে যে ওপরে উঠে এসেছি, কেমন করে যে বাড়ি এসে পৌঁছেছি কিছুই জানিনে।
চাকরি ছেড়ে দেবো বলে দরখাস্ত তো আগেই করেছি, জবাব এল কি না জানবার জন্যে বেলাবেলি তো গেলাম সেদিন ম্যানেজারের সঙ্গে দেখা করতে।
গিয়ে শুনি, অদ্ভুত ব্যাপার! কাল রাত্রি থেকে ম্যানেজারকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। খাদের নীচেও না, খাদের ওপরেও না।
সর্বনাশ! সর্বাঙ্গ আমার শিউরে উঠল।
তাহলে তিনি গেলেন কোথায়?
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন