শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়
কলিকাতা শহরে মনের মত বাড়ি আর মিলিতেছিল না—বাড়ি খুজিয়া খুজিয়া হয়রান হইয়া গেলাম। শেষে একদিন সন্ধ্যাবেলা রাস্তায় তখন গ্যাস জ্বলিয়াছে, একটা গলির মোড়ে দাঁড়াইয়া বাড়িগুলির দিকে তাকাইয়া To let-এর সন্ধান করিতেছি, এমন সময় এক ভদ্রলোক আসিয়া আমার পাশে দাঁড়াইলেন। ভাবিলাম, হয়ত কিছু চাহিবেন, কাজেই সেদিক হইতে ইচ্ছা করিয়াই মুখ ফিরাইলাম।
কিন্তু কিছুই তিনি চাহিলেন না। বলিলেন, বাড়ি খুঁজছেন? কি রকম বাড়ি?
এতক্ষণ পরে তাঁহার মুখের পানে ভাল করিয়া তাকাইলাম। আলোর ছায়াটা তাঁহার মুখের উপর পড়িয়াছিল, মুখখানা ভাল করিয়া দেখিতে পাইলাম না। না পাইলেও বুঝিলাম লোকটির বয়স নেহাৎ কম নয়। বলিলাম, একতলা হোক, দোতলা হোক, ফাঁকা বাড়ি চাই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন।
তিনি বলিলেন, বাড়ির সুমুখে যদি ফুলের একটি বাগান থাকে?
খুব ভাল। আছে নাকি সে-রকম বাড়ি আপনার সন্ধানে?
আছে। দোতলা বাড়ি, ইলেকট্রিক আলো, পাখা, বাগান—ভারি চমৎকার বাড়ি, ভাড়া কিন্তু একটু বেশি।
জিজ্ঞাসা করিলাম ভাড়া কত?
পঞ্চাশ টাকা! তবে সত্যিই নেন যদি ত আরও কিছু কমিয়ে দিতে পারি।
আপনারই বাড়ি? বেশ ত, চলুন, দেখে আসি।
লোকটি বলিলেন, আজ্ঞে হ্যাঁ, আমারই বাড়ি। আসুন, দেখবেন আসুন।
তিনি চলিলেন আমার আগে-আগে, আমি চলিলাম তাঁহার পিছু পিছু।
বেশিদূর যাইতে হইল না। দু-তিনটা গলি পার হইয়াই দেখিলাম, ফটকওয়ালা বাড়িখানি সত্যিই চমৎকার। শহরের মাঝখানে এ-রকম বাড়ি যে একখানি ছিল তাহা জানিতাম না। To let টাঙ্গাইয়া দেওয়া হয় নাই বলিয়া সেদিকে কোনওদিনই আমার নজর পড়ে নাই।
লোকটি তাহার কোটের পকেট হইতে চাবির গোছা বাহির করিয়া ফটক খুলিলেন। বাড়ির প্রত্যেকটি ঘর খুলিলেন এবং সব আলোগুলো একসঙ্গে জ্বালাইয়া দিয়া নিজে একটুখানি দূরে দাঁড়াইয়া থাকিয়া বলিলেন, দেখুন পছন্দ হয় কি না!
এইরকম বাড়িই চাহিতেছিলাম। বলিলাম, কাল থেকেই আমি আসতে চাই।
ভাড়া কিন্তু এক মাসের অগ্রিম দিতে হবে।
এক্ষুনি দিতে পারি।—বলিয়া পকেট হইতে চেক-বই বাহির করিলাম।
লোকটি কোনও উচ্চবাচ্য করিলেন না, জিজ্ঞাসা করিলাম, আপনার নাম?
তিনি বলিলেন, হরলাল মিত্র।
কত টাকা লিখব?
লিখুন—পঁয়তাল্লিশ টাকা। পাঁচ টাকা কমিয়ে দিলাম।
ক্রশ চেক্ দেব না বেয়ারার?
বেয়ারার দিন। ব্যাঙ্কে আমার এ্যাকাউন্ট নেই।
চেকখানি তাঁহার হাতে দিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, আপনার ঠিকানাটা বলুন লিখে রাখি—যদি কোনওদিন দরকার হয়। আর তাছাড়া মাসে মাসে ভাড়াটা তাহলে আমি পাঠিয়ে দিতে পারি।
তিনি বলিলেন, পাঠাতে হবে না। আমি নিজে এসে নিয়ে যাব। কিন্তু চেক টেক আর দেবেন না মশাই, নগদ টাকা দেবেন!
এই বলিয়া লোকটি আর অপেক্ষা করিতে চাহিলেন না। চলুন—বলিয়া নিজেই আলো নিবাইয়া দরজার তালা বন্ধ করিয়া বাহিরে আসিয়া দাঁড়াইলেন। আমার হাতে চাবির গোছাটা দিয়া বলিলেন, কাল আসবেন তা হলে।
আজ্ঞে হ্যাঁ, আসব। নমস্কার।
নমস্কার।
হন হন করিয়া আমার আগে আগেই তিনি চলিয়া গেলেন। ভাবিলাম, হয় তো কোথাও বিশেষ কোনও প্রয়োজন আছে।
গলির পর গলি পার হইয়া বড় রাস্তায় আসিয়া দাঁড়াইলাম। কিন্তু কোনদিক দিয়া কেমন করিয়া তিনি যে কোথায় অদৃশ্য হইয়া গেলেন কিছুই বুঝিতে পারিলাম না।
.
পরদিন বেলা এগারোটার মধ্যে খাওয়া-দাওয়া চুকাইয়া গাড়ি ডাকিয়া জিনিসপত্র বোঝাই করিয়া সপরিবারে আমার নূতন বাড়িতে আসিয়া পৌঁছিলাম। ঘরগুলো ঝাড়িয়া মুছিয়া গোছগাছ করিতেই বেলা চারটা বাজিয়া গেল।
বাড়িখানি আমাদের সকলের বেশ ভাল লাগিয়াছে।
বাড়ির সুমুখে দোতলার বারান্দাটি বড় চমৎকার। চেয়ার পাতিয়া বারান্দায় বসিলে সুমুখে বাগান দেখা যায়। বারান্দায় রোদ ছিল না! ভজাকে বলিলাম, চা তৈরি কর, এইখানে বসে খাওয়া যাক।
পাশাপাশি দুইখানা বেতের চেয়ারে বসিয়া আমি ও আমার স্ত্রী গায়ত্রী চা খাইতেছিলাম, এমন সময় ভজা আসিয়া একখানা চেক আমার হাতে দিয়া বলিল, নীচের ঘরে টেবিলের ওপর এই চেকখানা পড়েছিল বাবু।
হরলাল মিত্রের নামে পঁয়তাল্লিশ টাকার চেকখানি কাল রাত্রে লিখিয়াছিলাম, দেখিলাম সেইটিই সে আনিয়া দিয়াছে। ভদ্রলোক মনের ভুলে চেকখানি লইয়া যাইতে ভুলিয়াছেন নিশ্চয়ই। এই জন্যই কাল আমি তাঁহার ঠিকানা চাহিয়া ছিলাম। ঠিকানা জানিলে পাঠাইয়া দিতে পারিতাম। কিন্তু কি রকম অদ্ভুত লোক কে জানে। বাড়ির মালিক, অথচ নিজের ঠিকানা আমাকে জানাইলেন না। হয়ত বা এমন জায়গায় বাস করেন, সেখানকার ঠিকানা জানাইতে তাঁহার লজ্জা হইয়াছে। যাইহোক চেকখানির জন্য আজ হোক কাল হোক আবার তাঁহাকে আসিতেই হইবে।
.
তিন দিন পার হইয়া গেল, কিন্তু তিনি আসিলেন না।
অথচ বেয়ারার চেক, কোথায় পড়িয়া রহিল, কেহ ভাঙ্গাইয়া লইল কি না জানিবার আগ্রহ তাঁহার হওয়া স্বাভাবিক। মানুষটিকে ভাল করিয়া যদিও সেদিন দেখিতে পাই নাই, তাহা হইলেও রাত্রির আলোয় যতটুকু দেখিয়াছি, উন্মাদ বলিয়া মনে হয় নাই। মানুষের নানা রকমের আকস্মিক দুর্ঘটনা ঘটিতে পারে। হয়ত বা কোনও অনিবার্য কারণে আসিতে পারেন নাই কিংবা হয়ত এখান হইতে গিয়াই তিনি অসুস্থ হইয়া পড়িয়াছেন।
সেদিন তখন রাত্রি বোধকরি দুইটা বাজিয়া গিয়াছে। ঘুমাইয়া পড়িয়াছিলাম। গায়ত্রী আমার গায়ে হাত দিয়া ঘুম ভাঙ্গাইল। জিজ্ঞাসা করিলাম, কি?
চুপি চুপি বলিল, ওই শোন, পাশের ঘরে কিসের যেন শব্দ হচ্ছে।
বলিলাম, ঘুমোও। ও কিছু নয়।
না গো তুমি শোন।
ঘুমের নেশাটা কাটিয়া গেল। বাধ্য হইয়া কান পাতিয়া রহিলাম।
গায়ত্রী মিথ্যা বলে নাই। স্পষ্ট শুনিলাম, পাশের ঘরে কাহারা যেন হাতাহাতি মারামারি শুরু করিয়াছে। কাহার কোনও কথা শুনিতে পাইলাম না বটে, কিন্তু মারামারি যে করিতেছে তাহাতে কোনও ভুল নাই।
এই গভীর রাত্রে এমন করিয়া হাতাহাতি মারামারি করিবার মত লোক আমার বাড়িতে কে আছে? দোতলায় মাত্র চারিখানা ঘর। আমরা স্বামী-স্ত্রী এ-ঘরে শুইয়া আছি। বাকি তিনখানা মধ্যে একখানায় আছে আমার ভাই অবিনাশ, কলেজের ছাত্র, আর একখানায় আছে অন্নদা-ঝি, আর আমার ছোট বোন সাবিত্রী। একখানা মাত্র ঘর খালি পড়িয়া আছে। নীচের একটা ঘরে ভজা-চাকর শুইয়া আছে। উড়ে যে ঠাকুরটি আমাদের রান্না করিয়া দেয় সে এখানে রাত্রিবাস করে না, রান্না শেষ করিয়াই সে তাহার বাসায় চলিয়া যায়।
সুতরাং মারামারি করিবে কে?
বিছানার উপর উঠিয়া বসিলাম। গায়ত্রী তাড়াতাড়ি সুইচটা টিপিয়া আলোটা জ্বালিয়া ফেলিল।
খাট হইতে নামিয়া জুতা পায়ে দিতেছি, গায়ত্রী কাছে আসিয়া দাঁড়াইল। চুপি চুপি বলিল, যাবে?
বলিলাম, যাব না?
গায়ত্রী বলিল, না বাপু, আমার ভয় করছে।
এই বলিয়া সে আমার হাতখানা চাপিয়া ধরিল।
বলিলাম, তুমিও এসো আমার সঙ্গে। ব্যাপারটা দেখাই যাক।
গায়ত্রী ঘরের এদিক-ওদিক তাকাইতে লাগিল।
বলিলাম, কি দেখছ?
হাতে একটা কিছু নিয়ে যাওয়া উচিত।
লইয়া যাইবার মত ছিল না কিছুই। বলিলাম, থাক।
বলিয়াই তাড়াতাড়ি ধড়াম করিয়া সশব্দে দরজাটা খুলিয়া ফেলিলাম।
সুমুখে-নীচে নামিবার সিঁড়ির আলোটা নিবাইয়া দেওয়া হইয়াছে। মনে হইল অন্ধকার সিঁড়ির উপর দিয়া দুড় দুড় করিয়া কাহারা যেন নামিয়া যাইতেছে। জিজ্ঞাসা করিলাম, কে?
কোনও সাড়া পাইলাম না।
তাহাদের পায়ের শব্দ তখনও সিঁড়ির শেষ ধাপে গিয়া পৌঁছে নাই, এমন সময় আলো জ্বালিয়া দিলাম। কিন্তু আলো জ্বালিবার সঙ্গে সঙ্গে পায়ের শব্দও যেন থামিয়া গেল, কোথাও কাহাকেও দেখিতে পাইলাম না।
ভজা! ভজা! বলিয়া ডাকিতে ডাকিতে নীচে নামিয়া গেলাম। গায়ত্রী বোধকরি একা দাঁড়াইয়া থাকিতে পারিল না, তাই সেও আমার পিছু পিছু নামিয়া আসিল। ওদিকে আমার গলার আওয়াজ পাইয়া দরজা খুলিয়া অবিনাশ বাহির হইয়া আসিল, সাবিত্রী আসিল, অন্নদা আসিল।
নীচের সমস্ত আলো জ্বালিয়া ফেলিলাম। ভজা ধড়মড় করিয়া উঠিয়া বলিল, কি বাবু? কি হল?
বলিলাম, কিছু হয়নি। ওঠ।
অবিনাশকে সব কথা খুলিয়া বলিলাম। অবিনাশ হাসিতে লাগিল। বলিল, বেড়াল-টেড়াল হবে বোধহয়।
বলিয়াই সে একাকী নীচের সব ঘরগুলি ঘুরিয়া আসিল। বলিল, পাগল হয়েছ দাদা? প্রত্যেকটি দরজায় খিল আমি নিজে বন্ধ করে শুয়েছি, এখনও তেমনি সব বন্ধ রয়েছে।
মানুষ যদি হয় ত খিল খুলিয়া তাহাদের যাইতেই হইবে। জলের চৌবাচ্চার ভিতরটা পর্যন্ত খুঁজিয়া দেখা হইল, কেহ কোথাও লুকাইয়াও নাই।
স্পষ্ট মানুষের পায়ের শব্দ সিঁড়ির উপর আমরা স্বকর্ণে শুনিয়াছি—গায়ত্রী ও আমি। দুজনে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করিতে লাগিলাম। অবিনাশ শোনে নাই, কাজেই সে হাসিয়া উড়াইয়া দিতে পারিল। বলিল, ঘুমোও গে যাও! আমি এবার জেগে রইলাম।
ভজার ঘরে বাঁশের একটা লাঠি ছিল। গায়ত্রী সেটা হাতে লইতেই অবিনাশ হাসিতে হাসিতে জিজ্ঞাসা করিল, ও নিয়ে তুমি কি করবে বৌদি? লড়াই করবে নাকি?
গায়ত্রী বলিল, না ভাই, ঘরে একটা কিছু থাকা দরকার।
সাবিত্রী বলিল, না দাদা এ বাড়ি ছেড়ে দাও, এ ভূতের বাড়ি।
আমারও কেমন যেন সন্দেহ হইয়াছিল। ভয়ও যে না পাইয়াছিলাম তাহা নয়। তবু মুখে তাহাদের সাহস দিলাম। বলিলাম, না না, ও কিছু নয়।
আবার আমরা যে যার ঘরে শুইয়া পড়িলাম।
শুইয়া পড়িলাম বটে, কিন্তু চোখে আমাদের ঘুম যেন কিছুতেই আসিতে চাহিল না। ব্যাপারটা ভৌতিক বলিয়াই মনে হইতে লাগিল। গায়ত্রী বলিল, নইলে এত সস্তায় এমন বাড়ি কখনও পাওয়া যায়?
আমি চুপ করিয়া ছিলাম। গায়ত্রী বলিল, দ্যাখো, কাল একটা টর্চ কিনে এনো বেশ ভাল দেখে। বন্দুকের লাইসেন্স পাওয়া যায় না? এসময়ে তোমার একটা বন্দুক থাকলে বড় ভাল হত। কাল আমি ভজাকে দিয়ে গোটাকতক লাঠি তৈরি করিয়ে রাখব।
খানিকটা ঘুমাইয়া খানিকটা জাগিয়া রাত্রিটা কোন রকমে কাটিয়া গেল।
কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার, তাহার পর তিন চার দিন কোনও প্রকারের কোনও শব্দ আমরা শুনিলাম না। কয়েকটা রাত্রি বেশ নিরুপদ্রবেই কাটিয়া গেল।
অবিনাশ কলেজের ছাত্র, অবিবাহিত যুবক, নিয়মিত ব্যায়াম করিয়া শরীরে শক্তি সঞ্চয় করিয়াছে যথেষ্ট। ভূত-প্রেতের অস্তিত্ব সে কিছুতেই বিশ্বাস করিতে চায় না। বলে, রাত্রে সেদিন দাদা আর বৌদি নিশ্চয় স্বপ্ন দেখেছিল।
সাবিত্রী স্কুলে পড়ে। বিশ্বাস সে করে কি না জানি না। অবিনাশের কথায় সায়ও দেয়, আবার রাত্রির অন্ধকারে ঘর হইতে একা বাহির হইতেও চায় না।
আমি শুধু সেই হরলালবাবুর অপেক্ষায় বসিয়া আছি। বাড়ির ভাড়া আদায় করিতে একবার আসিলে হয়।
এমন দিনে হঠাৎ আবার আর একটা ঘটনা ঘটিয়া গেল।
সেদিন তখন প্রায় আটটা। সাবিত্রী তাহার নিজের ঘরে বসিয়া কি যেন লিখিতেছিল। সুমুখে দেওয়ালের গায়ে বড় একটা আর্শী টাঙানো। লিখিতে লিখিতে যেমন সে মুখ তুলিয়া আর্শীর দিকে তাকাইয়াছে, দেখিল পরমা সুন্দরী একটি মেয়ের ছায়া পড়িয়াছে আর্শীর গায়ে। কে? বলিয়া যেমন সে পিছন ফিরিয়াছে, দেখে—কেহ কোথাও নাই।
নিজের মনের ভুল ভাবিয়া আবার সে লিখিতে আরম্ভ করিল। কিন্তু লেখার মন তাহার কিছুতেই বসিল না। ক্রমাগত মনে হইতে লাগিল যাহাকে সে এইমাত্র আর্শীর ভিতর দিয়া দেখিল সে যেন এখনও তাহার কাছে রহিয়াছে। ভাবিতে ভাবিতে যেই সে মাথা তুলিয়াছে, আবার দেখিল—হুবহু সেই মূর্তি! এবার যেন আরও স্পষ্ট! এবার মনে হইল যেন সে হাসিতেছে।
পশ্চাতে তাহার কেহ নাই তাহা সে জানে। আতঙ্কে তাহার আপাদমস্তক ঝিম্ ঝিম্ করিতে লাগিল। চেয়ার ছাড়িয়া উঠিতেও সাহস হইল না, চিৎকার করিয়া কাহাকেও ডাকিতে পারিল না, কেমন যেন আড়ষ্টের মত চোখ বুজিয়া যেমন বসিয়া ছিল তেমনই বসিয়া রহিল।
অন্নদা-ঝি আসিয়া ডাকিল, দিদিমণি খাবে চল।
অন্নদার কণ্ঠস্বর শুনিয়া সহসা চমকিয়া উঠিয়া সাবিত্রী চোখ চাহিল। জিজ্ঞাসা করিল, মেজ-দা কোথায়?
অন্নদা বলিল, কে? মেজবাবু?
হ্যাঁ গো, হ্যাঁ, মেজবাবু, অবিনাশবাবু। নিজের ঘরে রয়েছে।
বলিয়াই সে চলিয়া যাইতেছিল, সাবিত্রী ধড়পড় করিয়া চেয়ার ছাড়িয়া উঠিয়া দাঁড়াইল। বলিল, অন্নদা শোন!
অন্নদা বলিল, কি বলবে বল দিদিমণি, ওদিকে আবার বৌ-ঠাকুরাণ একা থাকতে পারছে না।
তাহারও সমস্যা সেই একই। সাবিত্রী বলিল, দাঁড়াও।
অর্থাৎ অন্নদা দাঁড়াইয়া থাকিতে থাকিতে সে তাহার মেজ দাদার ঘরে গিয়া ঢুকিবে।
সাবিত্রীর মুখে সব কথা শুনিয়া অবিনাশ হো হো করিয়া হাসিয়া উঠিল। বলিল, তোমার চশমার পাওয়ার দেখছি আবার বাড়াতে হবে। একই বাড়িতে আমার কাছে তো ভূত-টুত আসে না। যত সব ভীতু—
কথাটা তখনও তাহার শেষ হয় নাই। এমন সময়ে ঘরের ইলেকট্রিকের আলোটা দপ্ করিয়া নিভিয়া গেল! আশ্চর্য ব্যাপার!
ঘরের ভিতর তাহারা দুই ভাই-বোন এদিকের জানলার কাছে দাঁড়াইয়া, আর ওদিকের দেওয়ালের গায়ে আলোর সুইচ-বোর্ড। ঘরের মধ্যে অলক্ষ্যে কেহ প্রবেশ করিয়া আলোটা নিশ্চয়ই নিবাইয়া দেয় নাই। সুইচ্ বোর্ডটি ছিল অবিনাশের চোখের সম্মুখে। মাত্র সে খুট করিয়া একটি আওয়াজ শুনিয়াছে, ব্যস, আর কিছু না। ঘর একেবারে অন্ধকার।
একে তো সাবিত্রী ভয় পাইয়াই ছিল, তাহার উপর চোখের উপরে একেবারে অকস্মাৎ এই ভৌতিক ব্যাপারটা ঘটিয়া যাইতেই তাহার মাথাটা কেমন যেন ঘুরিতে লাগিল, সর্বশরীর রোমাঞ্চিত হইয়া উঠিল এবং ইহাই তাহার স্পষ্ট মনে হইল যে, মেয়েটির অপরূপ ছায়ামূর্তি এইমাত্র পাশের ঘরের আর্শীর উপর প্রতিবিম্বিত দেখিয়া আসিল। সে যেন তাহারই নিতান্ত সন্নিকটে লোকচক্ষুর অন্তরালে তাহার অদৃশ্য অস্তিত্ব লইয়া চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া রহিয়াছে।
বিস্ময়াভিভূত অবিনাশ প্রথমটা খানিকক্ষণ চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া কি যেন ভাবিল, তাহার পর অন্ধকারেই দেওয়ালের কাছে কাছে আগাইয়া গিয়া হাত বাড়াইয়া সুইচ টিপিয়া আলোটা জ্বালাইবার চেষ্টা করিল।
কিন্তু এবারেও সেই পূর্বের মতই আবার একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটিয়া গেল।
সুইচটা তখনও তাহার হাতে ঠেকে নাই, এমন সময় আবার যেন খট করিয়া একটু শব্দ হইল এবং শব্দ হইবার সঙ্গে সঙ্গে দপ্ করিয়া আলোটা জ্বলিয়া উঠিল।
এবার আর অবিনাশের কোনও সন্দেহ রহিল না। তৎক্ষণাৎ সে সাবিত্রীর কাছে আসিয়া বলিল, না, গোলমাল হয়ে গেল সাবিত্রী। ভূত কি সত্যিই আছে?
সাবিত্রী বলিল, কথাটা আমিও আগে বিশ্বাস করিনি মেজদা, কিন্তু এখন আর বিশ্বাস না করে উপায় নাই।
এই বলিয়া দুইজন দুইজনের মুখের পানে তাকাইয়া কিয়ৎক্ষণ দাঁড়াইয়া রহিল, তাহার পর অবিনাশই প্রথমে কথা কহিল। বলিল, আমি কিন্তু সহজে ছাড়ব না সাবিত্রী, এর ভেতরের রহস্য আমায় জানতেই হবে।
কিন্তু রহস্য জানিবে কে, তাহার সমস্ত শরীরের রক্ত তখন জল হইয়া গেছে। ঘরের বাহিরে গিরা যে দাদা ও বৌদিদিকে অদ্ভুত এই ভৌতিক ঘটনার কথাটা বলিবে তাহারও উপায় নেই। সাবিত্রী ও অবিনাশ দুজনেরই মনে হইতে লাগিল যেন কোনও অদৃশ্য ব্যক্তি দরজার কাছে চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া আছে, সেদিক দিয়া পার হইতে গেলেই গায়ে গায়ে ঠেকাঠেকি হইয়া যাইবে। ঘরের মধ্যে ভয়ে ভাবনায় মুহ্যমান হইয়া এমনি করিয়া কতক্ষণ যে তাহারা দাঁড়াইয়া থাকিত বলা যায় না—বাঁচাইয়া দিল অন্নদা-ঝি।
বুড়ি থুপ থুপ করিয়া দরজায় আসিয়া দাঁড়াইল। বলিল, এসো তোমরা, খাবে এসো।
অন্নদা সত্যিই অদ্ভুত। বাড়িতে এত যে অলৌকিক ঘটনা ঘটিতেছে, তাহার সেদিকে ভ্রূক্ষেপ নাই। ভয়ে ভাবনায় বাড়ির সকলেই যখন সন্ত্রস্ত, অন্ধকার দেখিলেই সকলেরই যখন গা ছম ছম করিতেছে, অন্নদা তখন অবলীলাক্রমে অন্ধকারের ভিতর দিয়া একাই যাইতেছে, একাই আসিতেছে, আপনমনেই কাজ করিতেছে আর সুযোগ পাইলেই বলিতেছে, ছোঁড়ার কথা শুনলে গা জ্বালা করে। কখন থেকে খোসামোদ করে বলছি, ভজু ভাই, চট করে এক পয়সার তেঁতুল এনে দাও তো! বুড়ো মিসে বলে কিনা বাইরে বেরোতে আমার ভয় করছে, যেতে আমি এখন পারব না, যা বলবে দিনের বেলায় বল।
এ বাড়িতে যেসব ঘটনা ঘটিয়াছে অন্নদা যে সে-সব শোনে নাই তাহা নয়, শুনিয়াছে সবই। ভূত-প্রেতের অস্তিত্ব অস্বীকার করিবার মত শিক্ষাদীক্ষা তাহার নাই, সংস্কারাবদ্ধ মন তাহার সবই বিশ্বাস করে, অথচ ভয়ের কথা উঠিলেই বলে ভয় কিসের বাছা! আমরাও মানুষ, ওরাও মানুষ। আমরা না হয় বেঁচে আছি ওরা গেছে মরে।
ইহার উপর আর কথা চলে না। সাবিত্রী হাসিতে হাসিতে বলে, মরবি একদিন যেদিন দেবে টুটিটি টিপে মেরে।
অন্নদা বলে, মরতে তো একদিন হবেই বাছা! হয় আজ, না হয় কাল।
সাবিত্রী বলে, তোমার বুঝি বিশ্বাস হচ্ছে না অন্নদা? সত্যি বলছি ভূত আমি নিজে দেখেছি।
কথাটার জবাব না দিয়া অন্নদা চুপ করিয়া থাকে।
সাবিত্রী আবার বলে, বিশ্বাস হল না তো?
অন্নদা বলে, তা এত বড় ধাড়ি মেয়ে হয়েছ, বিয়ে এখনও হল না, ভূত এক-একদিন দেখবে বই কি! আমাদের ওই বয়সে ভূত পেরেত আমরাও দেখেছি।
পরদিন বৈকালে দেখা গেল, অবিনাশ কোথা হইতে একগাদা মোটা মোটা বই কাধে লইয়া ঘরে ঢুকিতেছে। সিঁড়ির কাছে বৌদির সঙ্গে দেখা। জিজ্ঞাসা করিল, এ যে বিদ্যের বোঝা নিয়ে বাড়ি ঢুকছ ঠাকুরপো। সরস্বতীর দরবারে মুটের কাজ করবে নাকি?
অবিনাশ বলিল, এসব কিসের বই জান বৌদি? এসো, দেখবে এসো।
বইগুলা অবিনাশ তাহার বিছানার উপর দুম করিয়া ফেলিল। খান-পাঁচছয় মোটা মোটা বই। চারখানা ইংরেজিতে লেখা, আর দুখানা বাংলা। বাংলা বই দুখানি গায়ত্রী উল্টাইয়া পাল্টাইয়া দেখিল, একখানি পরলোকের কথা আর একখানা অলৌকিক রহস্য।
গায়ত্রী একখানা পড়িতে বসিল আর সাবিত্রী একখানা
বাড়িতে রীতিমত ভৌতিক ব্যাপারের আলোচনা চলিতে লাগিল।
আমিও বাদ পড়িলাম না। আমিও একখানা ইংরেজি বই লইয়া বসিলাম।
উপদ্রব কিন্তু থামিল না। নীচের একটা দরজা জানালা বন্ধ করিয়া ভজা শুইয়া থাকে। সেদিন সে বলিল, উপরে উঠিবার সিঁড়ির নীচে অন্ধকার যে কুঠুরিটা রহিয়াছে, ভূত যদি থাকে তো ওখানেই আছে। কারণ সে ওই ছোট ঘরটার ভিতরে প্রায় নানারকমের শব্দ শুনিতে পায়, কাল সে স্বকর্ণে একটা মেয়ের হাসি শুনিয়াছে।
তবে এইটুকুই ভাল যে, ভূতেরা কোনওদিন কাহারও আনষ্ট করে নাই।
বই পড়িয়া অবিনাশ ঠিক করিল, একদিন গভীর রাত্রে সে ‘চক্রে’ বসিবে।
জিজ্ঞাসা করিলাম, সে আবার কি রকম? ‘চক্র’ কি রে? চক্রের ব্যাপারটা অবিনাশ বাবুকে বুঝাইয়া দিল। বলিল, তবে আর বই পড়লে কি দাদা? আচ্ছা আচ্ছা আমি এক্সপেরিমেন্ট করব তুমি দেখো!
এক্সপেরিমেন্ট করিবার সমস্ত আয়োজন চলিতে লাগিল। সিঁড়ির নীচের সেই অন্ধকার কুঠুরিটার মধ্যেই ‘চক্র’ আহ্বান করা হইবে। ভজাকে দিয়া অবিনাশ ঘরখানা বেশ ভাল করিয়া পরিষ্কার করাইল। কাঠের একটা টেবিল ঘরের মাঝখানে রাখা হইল। টেবিলের চারিপাশে রহিল চারিখানি চেয়ার। একখানায় বসিবে গায়ত্রী, একখানায় আমি, একখানায় সাবিত্রী আর একখানায় অবিনাশ, মিডিয়াম হইবে সাবিত্রী।
সাবিত্রী বলিল, না মেজদা আমার ভয় করছে। ভয় কিরে? অবিনাশ তাহাকে নানারকমের কথা বলিয়া সান্ত্বনা দিতে লাগিল। বলিল, কিচ্ছু ভয় নেই, এ বড় মজার জিনিস।
রাত্রে সকাল সকাল সকলেরই সেদিন খাওয়া হইয়া গেল! পেট ভরিয়া খাইতে কেহই পারিল না। কারণ—অবিনাশের আদেশ, ‘চক্রে’ বসিতে হইলে নাকি পেট ভরিয়া খাইতে নাই। ঠাকুর চলিয়া গেল। ভজা তালার নিচের ঘরে খিল বন্ধ করিয়া শুইয়া পড়িল। আমরা সকলেই উপরে উঠিয়া আসিলাম। ঘড়িতে ঢং ঢং করিয়া এগারোটা বাজিল। রাত্রি দেড়টার সময় ‘চক্রে’ বসিতে হইবে।
অবিনাশ বলিল, তোমরা ততক্ষণ একটু ঘুমিয়ে নিতে পার।
সকলেই আমরা ঘুমাইবার চেষ্টা করিতে লাগিলাম। কিন্তু ঘুম কিছুতেই আসিতে চাহিল না। ঘন ঘন ঘড়ির পানে তাকাইয়া তাকাইয়া গায়ত্রীর সঙ্গে গল্প করিতে লাগিলাম।
রাত্রি বারোটা তখনও বাজে নাই। এমন সময় অন্নদা ছুটিতে ছুটিতে আমার ঘরের ভিতর ঢুকিয়াই হাঁপাইতে হাঁপাইতে বলিল, দিদিমণিকে দেখবে এস বাবু!
কেন, তার আবার কি হল?
অন্নদা বলিল, বিছানার উপরে শুয়ে শুয়ে এতক্ষণ কেমন যেন গোঁ গোঁ করে ছটপট করছিল বাবু, সেটা যদি বা বন্ধ হল তো বিড়বিড় করে যা-তা বলছে, এসো, শুনবে এসো।
গায়ত্রী ও আমি দুজনেই ছুটিয়া তাহার ঘরে গিয়া ঢুকিলাম। দেখিলাম, অবিনাশ তাহার আগেই আসিয়াছে।
আমাকে ঘরে ঢুকিতে দেখিয়াই সাবিত্রী তাহার মাথায় কাপড়টা টানিয়া দিয়া জিভ কাটিয়া জড়সড় হইয়া খাটের এককোণে আসিয়া বসিল।
আমি তো অবাক!
ডাকিলাম, সাবিত্রী!
সাবিত্রী ঘোমটা টানিয়া সেই চুপ করিয়া বসিয়া রহিল, একটি কথাও বলিল না!
গায়ত্রী তাহার কাছে গিয়া হাসিতে হাসিতে কাপড়টা খুলিয়া দিতে গেল, কিন্তু সাবিত্রী কিছুতেই তাহা খুলিতে দিল না। গায়ত্রী তাহার কানের কাছে মুখ লইয়া গিয়া চুপিচুপি জিজ্ঞাসা করিল, এ তোমার কি হচ্ছে সাবিত্রী? পাগল হলে নাকি?
সাবিত্রীও তেমনি চুপিচুপি জবাব দিল; বলিল, ওঁদের সরে যেতে বলুন।
গায়ত্রী আমাদের দিকে তাকাইয়া বলিল, যাও তোমরা এখান থেকে সরে যাও। ঠাকুরপো তুমিও যাও!
ঘর হইতে আমরা বাহিরে আসিলাম বটে, কিন্তু জানালার কাছে দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া সবই দেখিতে লাগিলাম।
সাবিত্রী বলিল, এ বাড়িতে কি আপনাদের খুব কষ্ট হচ্ছে দিদি?
গায়ত্রী বলিল, তা আবার হচ্ছে না? রাত্রি হলে গা ছম্ হম্ করে, ভূতের ভয়ে কেউ বেরোতে পারে না, ঘুমোতে পারে না—
সাবিত্রী তাহার কথাটাকে শেষ করিতে দিল না। বলিল, কিন্তু তারা ত আপনাদের কিছু অনিষ্ট করে না দিদি!
গায়ত্রী বলিল, এখনও করেনি, কিন্তু করিতেই বা কতক্ষণ!
সাবিত্রী হাসিল। বলিল, না না অনিষ্ট কোনওদিন করবে না। আপনারা থাকুন এইখানে।
গায়ত্রী জিজ্ঞাসা করিল, তুমি কে ভাই?
সাবিত্রী বলিল, আমি এ বাড়ির বৌ। আমার নাম পুষ্প।
গায়ত্রী জিজ্ঞাসা করিল কেন আছ ভাই তোমরা এ বাড়িতে? অন্য কোথাও চলে গেলেই তো পারো!
সাবিত্রী মাথা হেঁট করিয়া খানিকক্ষণ চুপ করিয়া রহিল, তাহার পর মুখ তুলিয়া ঈষৎ হাসিয়া বলিল, সবই বুঝি শুনতে চান?
এই বলিয়া সে ফিক্ ফিক্ করিয়া হাসিতে লাগিল।
গায়ত্রী বলিল, হাসছো যে?
সাবিত্রীর হাসি কিন্তু থামিল না। আপন মনেই সে হাসিতে হাসিতে হঠাৎ একসময় দরজার দিকে তাকাইয়া থামিয়া গেল। তাহার চাহনি দেখিয়া মনে হইল দরজার কাছে কে যেন আসিয়া দাঁড়াইয়াছে। সাবিত্রী সেইদিকে তাকাইয়া তাকাইয়া বলিতে লাগিল, তুমি আবার এখানে কি জন্যে এলে বল তো? বেরিয়ে যাও বলছি, বেরিয়ে যাও!
এক্সপেরিমেন্ট করিবার সমস্ত আয়োজন চলিতে লাগিল। সিঁড়ির নীচের সেই অন্ধকার কুঠুরিটার মধ্যেই ‘চক্র’ আহ্বান করা হইবে। ভজাকে দিয়া অবিনাশ ঘরখানা বেশ ভাল করিয়া পরিষ্কার করাইল। কাঠের একটা টেবিল ঘরের মাঝখানে রাখা হইল। টেবিলের চারিপাশে রহিল চারিখানি চেয়ার। একখানায় বসিবে গায়ত্রী, একখানায় আমি, একখানায় সাবিত্রী আর একখানায় অবিনাশ, মিডিয়াম হইবে সাবিত্রী।
সাবিত্রী বলিল, না মেজদা আমার ভয় করছে। ভয় কিরে? অবিনাশ তাহাকে নানারকমের কথা বলিয়া সান্ত্বনা দিতে লাগিল। বলিল, কিচ্ছু ভয় নেই, এ বড় মজার জিনিস।
রাত্রে সকাল সকাল সকলেরই সেদিন খাওয়া হইয়া গেল! পেট ভরিয়া খাইতে কেহই পারিল না। কারণ—অবিনাশের আদেশ, ‘চক্রে’ বসিতে হইলে নাকি পেট ভরিয়া খাইতে নাই। ঠাকুর চলিয়া গেল। ভজা তালার নিচের ঘরে খিল বন্ধ করিয়া শুইয়া পড়িল। আমরা সকলেই উপরে উঠিয়া আসিলাম। ঘড়িতে ঢং ঢং করিয়া এগারোটা বাজিল। রাত্রি দেড়টার সময় ‘চক্রে’ বসিতে হইবে।
অবিনাশ বলিল, তোমরা ততক্ষণ একটু ঘুমিয়ে নিতে পার।
সকলেই আমরা ঘুমাইবার চেষ্টা করিতে লাগিলাম। কিন্তু ঘুম কিছুতেই আসিতে চাহিল না। ঘন ঘন ঘড়ির পানে তাকাইয়া তাকাইয়া গায়ত্রীর সঙ্গে গল্প করিতে লাগিলাম।
রাত্রি বারোটা তখনও বাজে নাই। এমন সময় অন্নদা ছুটিতে ছুটিতে আমার ঘরের ভিতর ঢুকিয়াই হাঁপাইতে হাঁপাইতে বলিল, দিদিমণিকে দেখবে এস বাবু!
কেন, তার আবার কি হল?
অন্নদা বলিল, বিছানার উপরে শুয়ে শুয়ে এতক্ষণ কেমন যেন গোঁ গোঁ করে ছটপট করছিল বাবু, সেটা যদি বা বন্ধ হল তো বিড়বিড় করে যা-তা বলছে, এসো, শুনবে এসো।
গায়ত্রী ও আমি দুজনেই ছুটিয়া তাহার ঘরে গিয়া ঢুকিলাম। দেখিলাম, অবিনাশ তাহার আগেই আসিয়াছে।
আমাকে ঘরে ঢুকিতে দেখিয়াই সাবিত্রী তাহার মাথায় কাপড়টা টানিয়া দিয়া জিভ কাটিয়া জড়সড় হইয়া খাটের এককোণে আসিয়া বসিল।
আমি তো অবাক!
ডাকিলাম, সাবিত্রী!
সাবিত্রী ঘোমটা টানিয়া সেই চুপ করিয়া বসিয়া রহিল, একটি কথাও বলিল না!
গায়ত্রী তাহার কাছে গিয়া হাসিতে হাসিতে কাপড়টা খুলিয়া দিতে গেল, কিন্তু সাবিত্রী কিছুতেই তাহা খুলিতে দিল না। গায়ত্রী তাহার কানের কাছে মুখ লইয়া গিয়া চুপিচুপি জিজ্ঞাসা করিল, এ তোমার কি হচ্ছে সাবিত্রী? পাগল হলে নাকি?
সাবিত্রীও তেমনি চুপিচুপি জবাব দিল; বলিল, ওঁদের সরে যেতে বলুন।
গায়ত্রী আমাদের দিকে তাকাইয়া বলিল, যাও তোমরা এখান থেকে সরে যাও। ঠাকুরপো তুমিও যাও!
ঘর হইতে আমরা বাহিরে আসিলাম বটে, কিন্তু জানালার কাছে দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া সবই দেখিতে লাগিলাম।
সাবিত্রী বলিল, এ বাড়িতে কি আপনাদের খুব কষ্ট হচ্ছে দিদি?
গায়ত্রী বলিল, তা আবার হচ্ছে না? রাত্রি হলে গা ছম্ ছম্ করে, ভূতের ভয়ে কেউ বেরোতে পারে না, ঘুমোতে পারে না-
সাবিত্রী তাহার কথাটাকে শেষ করিতে দিল না। বলিল, কিন্তু তারা ত আপনাদের কিছু অনিষ্ট করে না দিদি!
গায়ত্রী বলিল, এখনও করেনি, কিন্তু করিতেই বা কতক্ষণ!
সাবিত্রী হাসিল। বলিল, না না অনিষ্ট কোনওদিন করবে না। আপনারা থাকুন এইখানে।
গায়ত্রী জিজ্ঞাসা করিল, তুমি কে ভাই?
সাবিত্রী বলিল, আমি এ বাড়ির বৌ। আমার নাম পুষ্প।
গায়ত্রী জিজ্ঞাসা করিল কেন আছ ভাই তোমরা এ বাড়িতে? অন্য কোথাও চলে গেলেই তো পারো!
সাবিত্রী মাথা হেঁট করিয়া খানিকক্ষণ চুপ করিয়া রহিল, তাহার পর মুখ তুলিয়া ঈষৎ হাসিয়া বলিল, সবই বুঝি শুনতে চান?
এই বলিয়া সে ফিক্ ফিক্ করিয়া হাসিতে লাগিল।
গায়ত্রী বলিল, হাসছো যে?
সাবিত্রীর হাসি কিন্তু থামিল না। আপন মনেই সে হাসিতে হাসিতে হঠাৎ একসময় দরজার দিকে তাকাইয়া থামিয়া গেল। তাহার চাহনি দেখিয়া মনে হইল দরজার কাছে কে যেন আসিয়া দাঁড়াইয়াছে। সাবিত্রী সেইদিকে তাকাইয়া তাকাইয়া বলিতে লাগিল, তুমি আবার এখানে কি জন্যে এলে বল তো? বেরিয়ে যাও বলছি, বেরিয়ে যাও!
কিছুক্ষণ পরে সাবিত্রীর চাহনি ও মুখের হাসি দেখিয়া মনে হইল, যে আসিয়াছিল সে চলিয়া গিয়াছে।
গায়ত্রী জিজ্ঞাসা করিল, ও কে সাবিত্রী?
সাবিত্রী হাসিয়া বলিল, আমার নাম সাবিত্রী নাকি?
ও হ্যাঁ। বলিয়া গায়ত্রী তাহার ভ্রম সংশোধন করিয়া লইল।
সাবিত্রী বলিল, ওই লোকটাই তো যত নষ্টের মূল। আমায় স্বামীর সঙ্গে সুবিধে পেলেই ঝগড়া করে। সেদিন আপনাদের ওই সিঁড়ির পাশের ঘরটায় দুজনের সে কি মারামারি! বেঁচে থাকলে ঠিক একজন খুন হয়ে যেত।
এই পর্যন্ত বলিয়া সাবিত্রী কেমন যেন অন্যমনস্ক হইয়া গেল। বিড় বিড় করিয়া আপন মনেই কি যে সব বলিতে লাগিল তাহার এক বর্ণও বুঝিবার জো নাই।
শেষে অনেক পীড়াপীড়ির পর গায়ত্রীকে সে তাহাদের রহস্যময় প্রেত-জীবনের অপূর্ব কাহিনিটি বলিয়া যখন শেষ করিল, রাত্রি তখন বারোটা বাজিয়া গিয়াছে।
সাবিত্রী ঠিক যেমন করিয়া যাহা যাহা বলিয়াছিল সেরকম করিয়া হয়ত বলিতে পারিব না।
তবে মোটামুটি গল্পটা এইরকম—
পুষ্প গরীবের মেয়ে। বাল্যকালে মা মরিল, বাবা মরিল, বাড়িঘর বিষয়সম্পত্তি যাহা কিছু ছিল বাবার মৃত্যুর পর নীলামে বিক্রি হইয়া গেল। পুষ্পের বয়স তখন পনের পার হইয়াছে। গ্রামেই তাহার এক পিসিমা ছিল, পুষ্প তাহারই কাছে গিয়া আশ্রয় গ্রহণ করিল।
পুষ্পের বয়স তখন ষোল হইলে কি হয়, উদ্ভিন্নযৌবনা কিশোরী অসামান্যা সুন্দরী! একবার নজর পড়িলে সেদিক হইতে চোখ যেন ফিরান যায় না।
পিসিমা প্রায়ই বলেন, মা খেয়ে বাপ খেয়ে—এলি তো আমার কাছে, এখন এই আগুনের খাপ্পা নিয়ে আমি কি করি বল দেখি।
পিসিমারও অবস্থা ভাল নয় যে, ভাল একটি পাত্র দেখিয়া কিছু খরচ করিয়া পুষ্পের বিবাহ দিতে পারেন। কাজেই দয়া করিয়া একটি পয়সা না লইয়া পুষ্পকে বিবাহ করিতে পারে এমন কোনও সহৃদয় ব্যক্তির সন্ধান তিনি করিতে লাগিলেন।
সন্ধান মিলিল।
হরিশ বলিয়া এক ছোকরা পুষ্পদের গ্রামে মাঝে মাঝে কাপড় বিক্রি করিতে আসিল ___ গ্রামে কাপড় বিক্রি করাই ছিল তাহার কাজ। তিন চার মাস অন্তর ভাল ভাল শাড়ি লইয়া হঠাৎ একদিন সে তাহাদের গ্রামে আসিয়া হাজির হইত, প্রত্যেক বাড়িতেই ছিল তাহার অবাধ গতি, কখনও দশদিন কখনও বারোদিন, কখনও বা মাসাবধিকাল তাহাদেরই গ্রামের সরকারি ডাক্তারখানার ছোট্ট একটা বড় ঘরে সে তার আস্তানা গাড়িত। গ্রামে গ্রামে বাড়িতে বাড়িতে ঘুরিয়া ঘুরিয়া কাপড়গুলো বিক্রি করিয়া টাকা আদায় করিয়া হঠাৎ একদিন সে চলিয়া যাইত। ফিরিয়া আসিত আবার হয় তো চারমাস পরে।
সে বৎসর পূজার আগে পুষ্পর পিসিমা হরিশের কাছে পুষ্পর জন্য একখানি শাড়ি কিনিলেন। এইখানে এই শাড়ি বেচিবার সময় পুষ্পকে হরিশ প্রথম দেখিল এবং তাহার পর হইতে হরিশ আর সহজে তাহাদের গ্রাম পরিত্যাগ করিয়া কোথাও যাইতে চাহিল না।
হরিশ একদিন পুষ্পর পিসিমার কাছে গিয়া বলিল, পুজোটা এবছর আপনাদের গ্রামেই দেখি, না কি বলেন পিসিমা?
পিসিমা তখনও কাপড়ের দাম দিতে পারেন নাই। কাজেই হরিশ তাঁহাদের গ্রামে যতদিন থাকে ততই ভাল।
পিসিমা বলিলেন, বেশ ত বাবা! থাকো।
সুযোগ বুঝিয়া হরিশ বলিয়া বসিল, থাকলাম তো পিসিমা, কিন্তু হ্যাঁ! একটা কথা আপনাকে বলতে এসেছি।
কি কথা বল।
হরিশ তাহার পকেট হইতে দশটি টাকা বাহির করিয়া পুষ্পর পিসিমার হাতে দিয়া বলিল, এই দশটা টাকা আপনি রাখুন পিসিমা! কায়েতের ছেলে, কায়েতের বাড়িতে খাওয়াই ভাল; আপনার বাড়িতেই আমি দিনকতক খাব।
একে এই লোকটার কাছে কাপড়ের দরুন তিনটি টাকা ঋণ তিনি পরিশোধ করিতে পারিতেছিলেন না এবং তাহার জন্য ইহাকে দেখিলেই তাঁহার আতঙ্ক উপস্থিত হইতেছিল, সেই হরিশের কাছ হইতে উল্টা নগদ দশটি টাকা পাইয়া পিসিমা যেন স্বর্গ হাতে পাইলেন।
সেইদিন হইতে দিবসরাত্রির প্রায় অধিকাংশ সময় হরিশ সেইখানেই কাটাইতে লাগিল। কাপড় বোঁচকাটা পিসিমার বাড়িতেই আনিয়া রাখিল।
পুষ্প আর কতক্ষণ লুকাইয়া লুকাইয়া থাকে। পিসিমাই তাহাকে কাছে আসিতে বলিলেন। প্রয়োজনের সময় চায়ের বাটি, জলের গ্লাস—সবই সে হরিশের হাতের কাছে আগাইয়া দিতে লাগিল এবং কখন যে পিসিমার সঙ্গে হরিশের কথাবার্তা হইয়া গেছে পুষ্প কিছুই জানিতে পারে নাই, দিন-চার পরে হঠাৎ একদিন সে পিসিমার মুখেই শুনিল, হরিশ নাকি পুষ্পকে বিবাহ করিবে। হরিশের অভাব কিছুই নাই, লেখাপড়া ভাল না শিখিলেও প্রতি মাসে সে কাপড়ের কারবার করিয়া তিন-চারশ টাকা রোজগার করে। পুষ্পকে সে সুখে রাখিতে পরিবে।
পাত্রী বড় হইয়াছে। একরকম অরক্ষণীয়া বলিলেই হয়। কাজেই এই মাসেই বিবাহটা তাহা হইলে চুকিয়া যাক্—বলিয়া পিসিমা তাঁহার আদেশ জারি করিলেন।
হরিশ একদিন রাত্রে নগদ একশ টাকা পিসিমার হাতে দিয়া প্রস্তাব করিল, বিবাহ এখানে হইবে না। এখান হইতে পুষ্পকে কলিকাতায় লইয়া যাইবে, সেখানে তাহার আত্মীয়স্বজন আছে, বিবাহ সেইখানে হওয়াই ভাল।
পিসিমা একটুখানি ভাবনায় পড়িলেন। পুষ্পর বিবাহ কলিকাতায় হোক তাহাতে কোনও ক্ষতি নাই, কিন্তু এসময় মাঠে তাঁহার ধান পাকিয়াছে, ধান কাটিয়া ঘরে আনিতে হইবে, সুতরাং গ্রাম ছাড়িয়া কোথাও যাওয়া এখন তাঁহার পক্ষে এক-রকম অসম্ভব। হরিশ বলিল, আপনাকে কোথাও যেতে হবে না পিসিমা, আপনি এইখানেই থাকুন, আমি পুষ্পকে সঙ্গে নিয়ে কলকাতায় যাব, তারপর বিয়ে-থা চুকে গেলে আবার এইখানেই নিয়ে আসব।
পিসিমা বলিলেন, তাহলে বিয়ের খরচের জন্যে যে একশ টাকা তুমি আমায় দিলে ও টাকাটা—
কথাটা তাঁহাকে শেষ করিতে না দিয়াই হরিশ ঘন ঘন মাথা নাড়িয়া বলিয়া উঠিল, ও টাকা আমি আপনাকে দিলাম পিসিমা, ও আপনি রাখুন।
পিসিমা অবাক!
ইহার উপর হরিশ সম্বন্ধে আর কোনও প্রশ্নই চলে না।
হরিশ বলিল, আজ রাত্রেই যাওয়া যাক, তাহলে পিসিমা?
পিসিমা বলিলেন, শোনো।
বলিয়া হরিশকে একটুখানি আড়ালে ডাকিয়া লইয়া গিয়া চুপি চুপি বলিলেন, কিন্তু বাছা, পাড়ার লোকজন কেউ যেন না জানতে পারে। অতবড় ওই সোমত্ত আইবুড়ো মেয়ে-
চুপি চুপি লইয়া যাইতে হরিশও চাহিতেছিল। রাত্রি প্রথম প্রহরের পরেই পল্লীগ্রাম যখন নিস্তব্ধ হইয়া আসিল ইহাই উপযুক্ত অবসর ভাবিয়া হরিশ বলিল, পুষ্পকে তাহলে খাইতে দিন পিসিমা, আমরা বেরিয়ে পড়ি।
পুষ্পর কয়েকখানা জামা কাপড় হরিশের প্রকাণ্ড চামড়ার সুটকেশটার মধ্যে পিসিমা আগেই ঢুকাইয়া দিয়াছিলেন, এইবার পুষ্পকে কাছে ডাকিয়া বলিলেন, আর মা, তাড়াতাড়ি চারটি খেয়ে নিবি আয়।
পুষ্প বলিল, তুমিও তাহলে এইসঙ্গে চারটি খেয়ে নাও পিসিমা।
আমি আর এত তাড়াতাড়ি কি জন্যে খাব বাছা? তোমাদের আগে রওনা করে দিই, তারপর যখন হোক চারটি খেলেই হবে।
সে কি! পুষ্পর ধারণা, পিসিমাও তাহার সঙ্গে যাইবেন। কিন্তু এতক্ষণে বুঝিল তাহাকে একাই যাইতে হইবে।
পুষ্প কাঁদিয়া আপত্তি জানাইল। পিসিমা তাহাকে অনেক বুঝাইলেন। অবশেষে তিরস্কার করিয়া বলিলেন, যাবি না তো কি তোর মত আইবুড়ো ধিঙ্গি মেয়েকে চিরকাল আমি গলায় ঝুলিয়ে রাখব?
এইরকম সব নানা কথা বলিবার পর পুষ্পকে বাধ্য হইয়া রাজি হইতে হইল। এই বলিয়া সে তাহার মনকে বুঝাইল যে, হরিশের সঙ্গে বিবাহ যখন তাহার স্থির হইয়া গিয়াছে তখন আর তাহার সঙ্গে যাইতে দোষ কি!
যাইহোক, সেই রাত্রেই নিতান্ত সঙ্গোপনে পুষ্পকে লইয়া হরিশ চলিয়া গেল কলিকাতায় কোথায় গেল, কেন গেল, গ্রামের লোক কেহ কিছু জানিল না।
পুষ্প কলিকাতা কখনও দেখে নাই। পল্লীগ্রামের মেয়ে, শহর দেখিয়া প্রথমটা তাহার মন্দ লাগিল না। কিন্তু পুষ্পকে লইয়া হরিশ যেখানে গিয়া উঠিল, সে জায়গাটা তাহার কেমন কেমন যেন মনে হইতে লাগিল। টিনের চাল দেওয়া সারি সারি ঘর, বাঁশের ব্যাকারির ওপর মাটি লেপা দেওয়াল, পশ্চিমবঙ্গের পল্লীগ্রামে পুষ্পর দিন কাটিয়াছে, এমন বাড়ি সে কখনও দেখে নাই। বাহিরের দরজার তালা খুলিয়া হরিশ ভিতরে ঢুকিল, পুষ্পকে বলিল, এস।
ভিতরে মাত্র একটুখানি উঠান, দুখানি পাশাপাশি ঘর, পাশেই একটুখানি রান্নার জায়গা—এই তো বাড়ি। লোকজন কেহ কোথাও নাই। ভিতরে ঢুকিয়াই সদরের দরজাটা হরিশ বন্ধ করিয়া দিয়াছিল। পুষ্প অবাক হইয়া এদিক ওদিক তাকাইতে লাগিল।
ঘর দুইটা হরিশ খুলিয়া দিয়াছিল। একটা ঘরে আসবাব-পত্র কিছু রহিয়াছে বটে, কিন্তু কোনও নারী এখানে কোনওদিন বাস করিয়াছে বলিয়া মনে হইল না।
হরিশ বলিল, কেমন? এইবার আমরা দুজন। তুমি আর আমি।
কথাটা শুনিয়া আনন্দ হইবে কি, পুষ্পর বুকের ভিতরটা দুর দুর করিতে লাগিল।
হরিশের কিন্তু আর দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া হাসিলে চলিবে না, বাহিরের কল হইতে জল ধরিবার ব্যবস্থা করিতে হইবে; তারপর বাজার, তাহার পর রান্না।
হরিশ তাহার জামা-জুতা ঘরে ঢুকিয়াই খুলিয়া ফেলিয়াছিল। ‘আসি’ বলিয়া চট করিয়া বাহির হইয়া গেল এবং তৎক্ষণাৎ দুজন ছোকরাকে ডাকিয়া আনিল। পয়সা লইয়া একজন গেল বাজার, আর একজন জল ধরিতে লাগিল।
বাধ্য হইয়া পুষ্পকে সবই করিতে হইল। রান্নাঘরের পাশে টিনের বেড়া দেওয়া একটুখানি স্নানের জায়গা। সেইখানেই এক বালতি জলে গা ধুইয়া কাপড় কাচিয়া পুষ্প রান্না করিতে বসিল।
রান্না শেষ হইলে প্রথমে হরিশকে খাওয়াইয়া পুষ্প যেমন পারিল নিজেও চারিটি খাইয়া লইল। তাহার পর এঁটো বাসনগুলো পরিষ্কার করিয়া ফেলিয়া কাপড় ছাড়িয়া পুষ্প কিসের জন্য না জানি ঘরে ঢুকিয়াই দেখিল, খাটের উপর হরিশ শুইয়া আছে।
পুষ্পর মুখের পানে তাকাইয়া হরিশ হাসিতে হাসিতে উঠিয়া বসিল। বলিল, এ রকম স্ত্রী না হলে কি হয়। তুমি ত বেশ রাঁধতে পার পুষ্প! এস, দাঁড়িয়ে রইলে কেন?
স্ত্রী। বিবাহ না হইতে স্ত্রী? পুষ্পর বুকের ভিতর কথাটা যেন ধ্বক করিয়া গিয়া বাজিল। দরজার কাছে তেমনি হেঁটমুখে কিয়ৎক্ষণ দাঁড়াইয়া থাকিয়া হঠাৎ মুখ তুলিয়া জিজ্ঞাসা করিল, কোথায় আপনার সব লোকজন আত্মীয়স্বজন –কলকাতায় সব আছে বলেছিলেন না?
হরিশ খাট হইতে নামিয়া হাসিতে হাসিতে পুষ্পর কাছে আসিয়া দরজার খিলটা বন্ধ করিয়া দিয়া বলিল, এস বলছি।
পুষ্প ধীরে ধীরে খাটের কাছে গিয়া দাঁড়াইল। হরিশ বলিল, আত্মীয়স্বজন লোকজন কি হবে? এই ত বেশ। মন্তর পড়ে বিয়ে আমাদের নাই বা হল পুষ্প।
পুষ্প হেঁটমুখে চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া রহিল।
হরিশ বলিল, চুপ করে রইলে যে?
তবু সে কথা কহিল না। নিজের অবস্থাটা একবার কল্পনা করিয়া মনে মনেই বোধ করি সে শিহরিয়া উঠিল।
রাত্রিটা যে কেমন করিয়া কাটিল তাহা একমাত্র পুষ্পই জানে।
পরদিন সকালে বাহিরের চালায় একটি খুঁটিতে ঠেস দিয়া পুষ্প চুপ করিয়া বসিয়াছিল। মাথার চুলগুলো এলোমেলো, কতক আসিয়া পড়িয়াছে মুখে, কতক কানের ওপর, সর্বশরীরে কেমন যেন একটা বিশৃঙ্খলা আলুথালু ভাব। ডাগর ডাগর এমন সুন্দর দুইটি চোখ মনে হয় যেন রাত্রি জাগরণের ক্লান্তিতে ঢুল্ ঢুল্ করিতেছে, অবসাদগ্রস্ত মুখখানি ম্লান দেখাইতেছে বটে, কিন্তু তাহাতে তাহার সেই অপরূপ সৌন্দর্যের এতটুকু হানি হয় নাই।
ঘুম ভাঙ্গিতেই হরিশ ধড়মড় করিয়া উঠিয়া বসিল। তাহার পর তাড়াতাড়ি বাহিরে আসিয়া পুষ্পর দিকে একবার তাকাইয়া একটুখানি হাসিল। হাসিয়া হাতমুখ ধুইয়া সে পুষ্পর কাছে আসিয়া দাঁড়াইল। বলিল, উনোনটায় আগুন দিয়ে একটু চা তৈরি করলে না কেন?
পুষ্প বলিল, না আমাকে আমার পিসিমার কাছে দিয়ে আসুন।
হরিশ তাহার মুখের পানে তাকাইয়া হো হো করিয়া হাসিতে লাগিল।
পুষ্প বলিল, এমন জানলে আপনার সঙ্গে আমি কখনও আসতাম না।
বলিতে বলিতে চোখ দুইটা জলে ভরিয়া আসিল।
হরিশ তাহাকে আর একটি কথাও বলিল না, তৎক্ষণাৎ দুই হাত দিয়া সে এক অদ্ভুত কৌশলে পুষ্পকে আড়কোলা করিয়া তুলিয়া ধরিয়া তাড়াতাড়ি ঘরে ঢুকিয়া খাটের উপর তাহাকে ধুপ করিয়া ফেলিয়া দিয়া হাসিতে হাসিতে বলিল, রাগ করছ?
এমনি করিয়া তিন দিন কাটিল।
কেমন করে কাটিল সে কথা আর বলিয়া কাজ নাই।
তিনদিন পরে, হোটেল হইতে ভাত আনিয়া হরিশ খাইল, পুষ্পকে খাওয়াইল। খাওয়া-দাওয়ার পরে পুষ্প বলিল, চলুন, আমাকে পিসিমার কাছে দিয়ে আসুন। আজ আর আমি কিছুতেই থাকব না।
গত কয়েকদিন পুষ্প রান্নাও করে নাই, ঘরের কোন কাজকর্মও করে নাই, চুপ করিয়া বসিয়া বসিয়া শুধু কাঁদিতেছে আর পিসিমার কাছে ফিরিয়ে লইয়া যাইবার জন্য হরিশকে অনুরোধ করিয়াছে। জবাবে হরিশ কখনও শুধু হাসিয়াছে, কখনও বলিয়াছে, আচ্ছা তাই হবে।
হরিশের কাছ হইতে কোন জবাব না পাইয়া পুষ্প বলিল, আজ যদি আমায় না নিয়ে যান তো আমি নিজেই চলে যাব।
হরিশ হাসিল। বলিল, পারবে?
কেন পারব না?
তোমার ওই রূপ নিয়ে এই যৌবন নিয়ে–
পুষ্প বলিল, সে ভয় আমি করি না।
হরিশ বলিল, তাহলে এখানে থাকতেই বা তোমার—
মাথা নাড়িয়া পুষ্প বলিল, না, আমি আপনার কাছে কিছুতেই থাকব না।
কেন, আমি এমন কি অপরাধ করলাম?
পুষ্প বলিল, বলতে লজ্জা করে না?
হরিশ হাসিতে হাসিতে বলিল, আর কি তোমার বিয়ে হবে ভেবেছ? আমি তো তোমার স্বামী।
পুষ্প চুপ করিয়া রহিল।
হরিশ আবার কি যেন বলিতে যাইতেছিল, এমন সময় সদর দরজাটা ঠেলিয়া রোগামত একটা লোক বাড়ির মধ্যে ঢুকিয়াই ডাকিল, হরিশ।
পুষ্প তাড়াতাড়ি উঠিয়া দাঁড়াইয়া ঘরের ভিতর চলিয়া গেল।
হরিশ হাসিয়া লোকটাকে অভ্যর্থনা করিল! বলিল, আসুন পরেশবাবু, আসুন!
পরেশবাবু বলিল, হুঁ। কিন্তু বেশ লোক তো হে তুমি? একটা খবর নেই, কিছু নেই, পাঁচ মাসের হিসেব তোমার কাছে পড়ে রয়েছে, দাও, কিছু টাকা দাও। শীত আসছে, এবার শীতের কাপড়-চোপড় চাই তো?
হরিশ বলিল, আজকালের মধ্যেই যাব ভাবছিলাম। এবার কিছু বেশি বেশি করে কাপড় দেবেন, বুঝলেন, টাকা দেব বৈ-কি, টাকা এবার কিছু দেব আপনাকে।
পরেশবাবু বলিল, দেব নয়, দেব নয়, আজই কিছু টাকা—তা অন্তত শ দুয়েক আমাকে দিতে হবে—ওটি কে? এই বলিয়া পরেশবাবু চোখের ইসারায় ঘরের ভিতরটা দেখাইয়া দিল।
হরিশ বলিল, আমার স্ত্রী।
পরেশবাবু বাহিরের দাওয়ায় বসিয়াছিল, এইবার উঠিয়া দাঁড়াইল। হরিশ ভাবিল বুঝি সে চলিয়া যাইবে, কিন্তু চলিয়া না গিয়া দেখা গেল সে ঘরের ভিতর ঢুকিতেছে। হরিশ তাহার পিছু পিছু ঘরে ঢুকিয়া দেখিল, পুষ্প খাটের উপর শুইয়া আছে। তাহাদের দুজনকে ঘরে ঢুকিতে দেখিয়া সে ধড়মড় করিয়া খাট হইতে নামিয়া দেওয়ালের দিকে মুখ ফিরাইয়া দাঁড়াইল।
পরেশ বলিল, আরে, এ যে একেবারে আগুনের মত মেয়ে হে! বাঃ বেড়ে বৌটি পেয়েছ ত?—তা কই দেখি মুখখানি, দেখি একবার!
হরিশ পুষ্পর কাছে গিয়া বলিল, এইদিকে ফেরো পুষ্প, লজ্জা কর না, ছি! উনি আমার মহাজন। ওঁর কাছ থেকেই কাপড়চোপড় আমি নিয়ে যাই—এই পর্যন্ত বলিয়াই সে তাহার কানের কাছে মুখ লইয়া গিয়া চুপিচুপি বলিল, মস্ত বড়লোক।
বলিয়াই সে একরকম জোর করিয়া হাত দিয়া মুখখানা তাহার ফিরাইয়া দিল।
বৌ দেখিয়া পরেশ ত অবাক!
হরিশ বলিল, দেখলেন তো? চলুন এবার।
পরেশ হো হো করিয়া হাসিয়া উঠিল। বলিল, তাড়াতে চাও হরিশ? কিন্তু এত সহজে হঠবার
পাত্তর আমি নাই। বুঝেছ? বলি পুলিশ কেস-টেস হবে না ত? কার মেয়ে ধরে নিয়ে এলে?
হরিশ বলিয়া উঠিল, কেন, কেন, ওকথা বলছেন কেন?
পরেশ বলিল, হেঁ হেঁ বাবা, চোরাই মালের ব্যবসা করে খাই, আর এটুকু বুঝতে পারব না? পরেশ দাসের চোখে ধুলো দেবে তুমি? হিদুর মেয়ে, সিঁথিতে সিঁদুর নেই, আর ফট্ করে বলে বসলে তোমার বিয়ে করা বৌ! তা বেশ করেছ, তার জন্যে দোষ দিচ্ছিনি, খাসা মেয়ে। কিন্তু একা ভোগ কর না বাবা, আমি তোমার মহাজন বুঝলে? মেয়েটির নাম কি?
হরিশ বলিল, পুষ্প।
বলি ও পুষ্প! পুষ্প, হ্যাঁ, পুষ্পই বটে! বাঃ তোমার চোখ আছে, বাহাদুরি আছে হরিশ! পুষ্প। শোন শোন, এইখানে এস, আমি সব বুঝতে পেরেছি—হরিশ বাইরের দরজাটা খোলা আছে, বন্ধ করে দিয়ে এস। ফট্ করে কেউ হয়ত ঢুকে পড়বে।
এই বলিয়া সে পুষ্পর দিকে হাত বাড়াইয়া চট্ করিয়া একখানা হাত ধরিয়া ফেলিল।
হাত ছাড়াইয়া লইয়া পুষ্প সরিয়া গেল।
হরিশ বলিল, ছি! ও কি করছেন আপনি?
কথাটা শুনিয়া মনে হইল হরিশ রাগিয়াছে।
পরেশ তাহার মুখের পানে তাকাইল। বলিল, এতে রাগ অভিমানের তো কিছু নেই হরিশ, এ-সব জিনিস একা একা ভোগ করতে নেই। কই, এস পুষ্প, এস দেখি তোমাকে।
বলিয়া আবার সে পুষ্পর দিকে হাত বাড়াইল।
এবার বোধকরি হরিশের আর সহ্য হইল না, ধাঁ করিয়া পরেশের চোয়ালে এক ঘুষি মারিয়া দিয়া থর্ থর্ করিয়া কাঁপিতে কাঁপিতে বলিল, বেরও তুমি এখান থেকে, বেরিয়ে যাও বলছি!
পরেশের মুখ দিয়া কথা বাহির হইল না। কস বাহিয়া তখন তাহার রক্ত গড়াইতেছে। হাত দিয়া রক্তটা মুছিয়া বলিল, ভাল, এইবার দ্যাখো তাহলে আমি কি করতে পারি।
এই বলিয়া হন হন করিয়া সে ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল।
হরিশ বলিল, যা করতে পারো কর। টাকা তোমার আমি ধারি না—যাও!
পরেশ চলিয়া যাইবামাত্র হরিশ পুষ্পর কাছে গিয়া দাঁড়াইল।
বলিল, চল, এখান থেকে পালাই চল। ব্যাটা হয়ত পুলিশ ডেকে আনতে পারে।
পুষ্প ঘাড় নাড়িয়া বলিল, না আমি যাব না।
বা-রে, এতক্ষণ যাবার জন্যে ছট্ফট্ করছিলে যে তাহলে?
পুষ্প বলিল, আমার পিসিমার কাছে নিয়ে যাবেন তো চলুন। অন্য কোথাও যাব না।
এই লইয়া দুজনের কথা কাটাকাটি চলিতে লাগিল। পুষ্প ভাবিল, আসুক পুলিশ, পুলিশের কাছে হরিশের অত্যাচারের কথা বলিলে তাহারাই হয়ত তাহাকে তাহার পিসিমার কাছে পাঠাইয়া দিবার ব্যবস্থা করিয়া দিবে।
এদিকে হরিশ তখন পুলিশের ভয়ে অস্থির। একে তো ওই পরেশেরই আনিয়া দেওয়া চোরাই মাল বিক্রি করাই তাহার একমাত্র উপজীবিকা, তাহার উপর পুষ্প বাঁকিয়া বসিয়াছে। এখান হইতে চলিয়া যাইবার জন্য হরিশ তাহাকে অনুনয়-বিনয় করিতে লাগিল।
অনেক অনুনয়-বিনয় এবং প্রতিজ্ঞার পর পুষ্প রাজি হইল, হরিশও রাজি হইল। বলিল—চল, আজ তোমাকে তোমার পিসিমার কাছে দিয়ে আসি চল।
জিনিসপত্র গোছগাছ করিয়া পুষ্প ও হরিশ যখন একটা রিক্সা গাড়িতে গিয়া বসিল, রাত্রি তখন প্রায় আটটা।
রিক্সাওয়ালাকে তাড়াতাড়ি চলিতে বলিয়া হরিশ এদিক-ওদিক তাকাইতে লাগিল।
গলির রাস্তা পার হইয়া যেমনি তাহারা বড় রাস্তায় গিয়া পৌঁছিল, হরিশ দেখিল, দূরে পরেশ আসিতেছে, সঙ্গে জনকতক কনস্টেবল। পরেশকে দেখিবামাত্র হরিশ চীৎকার করিয়া উঠিল, জোরসে চালাও, এই রিক্সাওয়ালা!
সুমুখে গাড়ি-ঘোড়া, রিক্সাওয়ালা ভ্যাবাচ্যাকা খাইয়া কোন দিকে যাইবে ঠিক করিতে পারিল না, ঠিক অমনি সময়ে নূতন একখানা মোটর আসিয়া লাগাইল ধাক্কা। রিক্সাখানা ভাঙ্গিয়া চুরমার হইয়া গেল, কে যে কোনদিকে ছিটকাইয়া পড়িল কেহ কিছু বুঝিতে পারিল না। হরিশ ছুটিয়া পলাইতেছিল, পুলিশ সঙ্গে লইয়া পরেশ তাহার পিছু ধরিল। আর এদিকে পুষ্পকে মোটরে তুলিয়া লইয়া মোটরচালক এক বাঙ্গালি ভদ্ৰলাক বোধকরি তাঁহার বাড়ির দিকেই রওনা হইলেন।
গাড়ি হইতে ছিটকাইয়া পড়িয়া পুষ্প অজ্ঞান হইয়া পড়িয়াছিল, যখন তাহার জ্ঞান হইল, দেখিল—প্রকাণ্ড এক অট্টালিকার দোতলার একটি ঘরে সাদা ধপধপে বিছানার উপর সে শুইয়া আছে। শিয়রের কাছে বসিয়া আছে এক বিধবা যুবতী।
গল্প বলিতেছিল সাবিত্রী, শুনিতেছিল তাহার বৌদিদি গায়ত্রী।
সাবিত্রী হাসিয়া বলিল, কোন বাড়ি জানেন দিদি? –এই বাড়ি। কোন্ ঘরটা জানেন? যে ঘরে আপনারা দুই স্বামী-স্ত্রী বাস করেন ওই ঘরটায় শুয়েছিলুম। যিনি আমায় নিয়ে এলেন তিনিই ছিলেন এবাড়ির মালিক— হরলাল মিত্র। যিনি আমার সেবা করছিলেন, তিনি তাঁর বিধবা বোন—রোহিণী।
.
হরলাল মিত্র নামটা শুনিয়া আমি চমকিয়া উঠিলাম। মনে পড়িল ঠিক এই নামেই আমি সেদিন অগ্রিম বাড়ি ভাড়ার জন্য চেক লিখিয়াছিলাম।
গল্পটা অবশ্যই এইখানেই শেষ হয় নাই। পুষ্পরূপী সাবিত্রী আরও অনেক বলিয়াছিল।
বলিয়াছিল—
হরলাল মিত্র লোক খুব ভাল। হরিশের মত পাজি নয়। কিছুদিন পরে পুষ্পকে তিনি বিবাহ করিয়াছিলেন। দুই বৎসর ধরিয়া পুষ্প ও হরলাল পরমানন্দে এই বাড়িতে স্বামী-স্ত্রীর মত বাস করিতেছিল। তাহার পর হঠাৎ একদিন দেখা গেল, কেমন করিয়া না জানি কোথা হইতে সংবাদ পাইয়া হরলালের বাড়িতে হরিশ আসিয়া হাজির।
হরলাল বাড়ি ছিল না। পুষ্পর অন্তরঙ্গ আত্মীয় বলিয়া পরিচয় দিয়া হরিশ একেবারে পুষ্পর কাছে গিয়া ডাকিল, পুষ্প!
পুষ্প চমকিয়া উঠিল। আপনি! আপনি এখানে?
সে ক্রূর হাসি হাসিয়া বলিল, হ্যাঁ আমি।
আপনি এখানে কি জন্যে এলেন? আপনি চলে যান।
হরিশ ঘাড় নাড়িয়া বলিল, না। আমার জেল হয়েছিল। জেল থেকে ফিরে এসে আজ দু’মাস ধরে তোমার খোঁজ করছি। খোঁজ যখন পেয়েছি তখন আর তোমায় ছাড়ব না। যেতে হলে তোমায় আমি সঙ্গে নিয়ে যাব।
পুষ্প বলিল, না। আপনার সঙ্গে আমি যাব না।
হরিশ হো হো করিয়া হাসিয়া উঠিল—কেন যাবে না পুষ্প, হরলালবাবুকে বিয়ে করেছ বলে?
পুষ্প জোর করিয়া বলিল, হ্যাঁ তাই যদি ভাবেন তো তাই। সেই জন্যেই যাব না।
হরিশ বলিল, আমি কিন্তু শুধু সেই জন্যেই নিয়ে যাব। তুমি আমার স্ত্রী, হরলালের স্ত্রী নও।
এই বলিয়া আগাইয়া আসিয়া জোর করিয়া পুষ্পকে জড়াইয়া ধরিল।
পুষ্প প্রাণপণে নিজেকে মুক্ত করিয়া লইবার চেষ্টা করিতেছিল, হঠাৎ কোথা হইতে সশব্দে একটা বন্দুকের গুলি আসিয়া লাগিল পুষ্পর বুকে।
হরিশ তাহাকে ছাড়িয়া দিয়া পিছন ফিরিয়া তাকাইতেই দেখে পিস্তল হাতে হরলাল ঘরে ঢুকিতেছে। কখন সে যে ফিরিয়া আসিয়া তাহাদের কথাবার্তা শুনিয়াছে কেহ জানিতেও পারে নাই। কিন্তু পুষ্পকে মারিতে সে চায় নাই। চাহিয়াছিল হরিশকে মারিতে। অথচ গুলি গিয়া লাগিয়াছে পুষ্পর বুকে। পুষ্প তখন সেখানেই শুইয়া পড়িয়াছে। হরিশ পলাইয়া যাইতেছিল, হরলাল তাহাকে আক্রমণ করিল এবং গুলির পর গুলির আঘাতে হরিশকে একেবারে জর্জরিত করিয়া দিয়া তাহাকে যখন সে মারিয়া ফেলিল, দেখা গেল তখন সে সিঁড়ির উপর দিয়া গড়াইতে গড়াইতে নিচে পড়িতেছে।
ছুটিয়া হরলাল উপরে আসিয়া দেখিল, পুষ্প তখন মরিয়া গিয়াছে।
হরলাল কাঁদিতে লাগিল।
তাহার পর এই বাড়ির সিঁড়ির নিচে অন্ধকার ছোট যে ঘরখানা আছে, উহারই মেঝের উপর প্রকাণ্ড এক গর্ত খুঁড়িয়া রাত্রির অন্ধকারে হরিশ ও পুষ্পর দুইটা মৃতদেহ পুঁতিয়া ফেলা হইল।
গায়ত্রী বলিয়া উঠিল, সে কি! এই বাড়িতে?
সাবিত্রী হাসিয়া বলিল, হ্যাঁ, এই বাড়িতে। তাতে কি দিদি, ভয় পেয়ো না, সে-সব এতদিন মাটির সঙ্গে মিশে গেছে।
গায়ত্রী জিজ্ঞাসা করিল, তারপর?
সাবিত্রী বলিল, তারপর আর কি। উনিও তাঁর বুকে গুলি করে আত্মহত্যা করলেন। রইল শুধু আমার ননদ। ননদ এখনও বেঁচে আছে। তীর্থে তীর্থে ঘুরে বেড়ায়। এ বাড়িতে আসতে তার আর ভরসা হয় না।
গায়ত্রী আবার জিজ্ঞাসা করিল, তোমরা তিনজনেই তাহলে একসঙ্গে আছ?
সাবিত্রী বলিল, হ্যাঁ ভাই! আমাদের মুক্তি হয়নি। আমি আছি আর আমার বর আছে। হরিশকে উনি মেরে মেরে তাড়িয়েছেন। তা সে কিছুতেই ছাড়বে না, মাঝে মাঝে হঠাৎ এক একদিন এসে বলে, তোমাকে আমি নিয়ে যাব। আমার স্বামীর তা সহ্য হবে কেন? দুজনে একসঙ্গে দেখা হলেই মারামারি শুরু হয়। তাই আপনারা মাঝে মাঝে গোলমাল শুনতে পান।
খানিক থামিয়া সে আবার বলিল, আর শুধু সেইজন্যেই লোকজন ভূতের ভয়ে কেউ এখানে থাকতে চায় না। আমি কিন্তু লোকজন বড় ভালবাসি। আমার স্বামী তাই রাস্তা থেকে আপনাদের ডেকে এনেছেন।
এতক্ষণে সব রহস্যই আমার কাছে পরিষ্কার হইয়া গেল।
অশরীরী প্রেতাত্মাদের লইয়া দিন আমাদের মন্দ কাটিতেছিল না। কিন্তু কিছুদিন পরে কর্পোরেশন বাড়ির ট্যাক্স লইয়া বড়ই জ্বালাতন করিতে লাগিল। গায়ত্রী বলিল, ভাড়া তো কাউকে দিতে হয় না, ট্যাক্সটা দিয়ে দাও।
একবার ভাবিলাম, সেই ভাল। আবার ভাবলাম, হরলাল মিত্রের বিধবা ভগিনী রোহিণী এখনও বাঁচিয়া আছে, হরলালের ওয়ারিশ থাকাও কিছু বিচিত্র নয়, হঠাৎ কে কোনদিন আসিয়া গোলমাল বাধাইবে, তাহার চেয়ে কাজ নাই, ভাবিলাম, আর একটা বাড়ি দেখিয়া উঠিয়া যাই।
কিন্তু যাওয়া আমাদের হইল না। সেদিন বাড়ি ফিরিয়াই শুনিলাম সাবিত্রী আবার কেমন যেন করিতেছে। কাছে গিয়া দেখিলাম গায়ত্রী তাহার কাছে বসিয়া আছে আর সাবিত্রী বলিতেছে, কই যাও দেখি! গেলেই কিন্তু উপদ্রব করব। তার চেয়ে রোহিণীর নামে ট্যাক্সের টাকাটা কাল জমা দিয়ে আসতে বল।
তাহাই করিয়াছি। রোহিণীর নামে ট্যাক্সের টাকা জমা দিয়া বিনা ভাড়ায় আমরা পরমানন্দে বাস করিতেছি।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন