নমস্কার – শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়

শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়

অনেক দিন বেকার বসে থাকবার পর চাকরি পেলাম। কিন্তু চাকরি যেখানে পেলাম – সে এক ভীষণ জায়গা। সহজে সেখানে বড় একটা কেউ যায় না। আমার আগে যারা গেছেন, সকলেই মরেছেন এবং সে এক আশ্চর্য মৃত্যু। রোগ নেই, ব্যাধি নেই, সারাদিন কাজকর্ম করে রাত্রে খাওয়া-দাওয়ার পর বিছানায় শুয়েছেন, সকালে দেখা গেল, তিনি আর উঠছেন না, বিছানাতেই মরে পড়ে আছেন! মুখের চেহারা হয়ে গেছে—কিম্ভূতকিমাকার বিশ্রী। মনে হয়, যেন মরবার সময় তিনি ভয় পেয়েছিলেন। কিন্তু কেন ভয় পেয়েছিলেন, কীসের ভয়—সে সব তখন কে আর বলবে?

আমার কিন্তু ভয় বলে কোন বস্তু ছেলেবেলা থেকেই নেই, তাই একটুখানি ভরসা হল। ভাবলাম—চোর-ডাকাত যদি খুন করে দিয়ে যায়, সে এক কথা আলাদা, তাছাড়া আর কিছুর ভয় আমি করি না।

যাই হোক, মরি মরব; অর্থাভাবে দিনে দিনে তিলে তিলে মরার চেয়ে সে বরং ঢের ভাল।

.

চাকরি নিলাম। জায়গাটা বেশি দূরে নয়। বাংলাদেশের মধ্যেই।

একটা স্টেশনে গাড়ি বদল করে ছোট একটি ব্রাঞ্চলাইনের ট্রেনে চড়লাম। কথা ছিল লাইন যেখানে গিয়ে শেষ হয়েছে, সেইখানেই আমার কাজের জায়গা। সন্ধ্যার একটু পরেই আকাশে চাঁদ উঠেছে। শরৎকালের নীল নির্মল আকাশ। শুভ্র সুন্দর জ্যোৎস্নালোকে উদ্ভাসিত ছোট ছোট গ্রাম, সবুজ ধানের মাঠ আর গাছপালার মাঝখান দিয়ে ছোট লাইনের ছোট্ট ট্রেনখানি আমাদের নিয়ে এগিয়ে চলেছে। দূরে দূরে একটি করে স্টেশন। টিম-টিম করে দু-একটি কেরোসিনের বাতি জ্বলছে। দু-একজন লোক নামছে, দু-একজন উঠছে; লোকজনের কোলাহল নেই, গোলমাল নেই, দু-একটি ছোটখাটো কথা, ইঞ্জিনের সাঁই সাঁই শব্দ আর গার্ড-সাহেবের হুইসল।

জানালায় হাত রেখে বাইরের পানে তাকিয়ে ছিলাম। ট্রেনের যাত্রী নিয়ে গ্রামের পথে কোথাও বা একটি গরুর গাড়ি চলেছে, কোথাও বা আঁকা-বাঁকা ছোট একটি শুকনো নদীর সাদা বালি চাঁদের আলোয় চিক চিক করছে। দুরের অস্পষ্ট গ্রাম ধোঁয়ার মত কুয়াশায় ঢেকে গেছে, লাইনের ধারে ধারে শুভ্র সুন্দর কাশের গুচ্ছ বাতাসে দুলছে, মাঝে মাঝে দূরের গ্রাম থেকে কুকুরের ডাক শুনতে পাচ্ছি।

গাড়ি আমাদের কখনও দাঁড়াচ্ছে, কখনও চলছে।

মাঝে কোন সময় আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘুম যখন ভাঙল, চেয়ে দেখি— আমার কামরা একেবারে ফাঁকা। যাঁরা ছিলেন, কখন যে তাঁরা নেমে গেছেন, কিছু বুঝতেই পারি নি। পেছনে পায়ের শব্দ হতেই ফিরে দেখলাম— আপাদমস্তক সাদা চাদরমুড়ি দিয়ে কালোমত প্রকাণ্ড লম্বা এক ভদ্রলোক আমার দিকে এগিয়ে আসছেন। কেন আসছেন বুঝলাম না। সে রকম লম্বা মানুষ আমি খুব কমই দেখেছি। কাছে আসতেই আমি তাঁর মুখের পানে তাকালাম। কালো কিম্ভূতকিমাকার সে এক অদ্ভুত মুখ। মানুষের মুখ বলে মনে হয় না। ঠিক যেন ছাগলের মত। এক-একটা পাঁঠার যেমন দাড়ি থাকে তেমনি দাড়ি; গোঁফগুলি একটি একটি করে গোনা যায়। আর সেই কালো মুখের ওপর অস্বাভাবিক রকম উজ্জ্বল গোল গোল সাদা দুটো চোখ।

চোখে আমার ঘুমের ঘোর যদি-বা একটুখানি ছিল, লোকটাকে আমার সুমুখের বেঞ্চে বসতে দেখে সেটুকুও উড়ে গেল।

কারও মুখে কোনও কথা নেই। শেষে তিনিই আমায় দয়া করে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কোথায় যাওয়া হবে?’

গলার আওয়াজ তেমনি। মনে হল, যেন হাঁড়ির ভেতর থেকে বেরোচ্ছে।

বললাম, ‘শালবুনি!’

তিনি বললেন, ‘চলুন, আমিও যাব।’

বাধিত হলাম।

চাকরির জায়গায় পৌঁছোতে না পৌঁছোতেই এই!

জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আপনি কি শালবুনিতেই থাকেন?’

ঘাড় নেড়ে জানালেন, ‘না।’

কোথায় থাকা হয়, সেকথা জিজ্ঞাসা করবার সাহস হল না। বললাম, ‘সিমসান কোম্পানির যে লোহার কারখানাটা তৈরি হচ্ছে, স্টেশন থেকে সেটা কত দূরে মশাই?’

‘কাছেই।’

শুনে আশ্বস্ত হলাম।

বললাম, ‘আচ্ছা বলতে পারেন মশাই, শুনছি নাকি তিন-চারজন লোক সেখানে মারা গেছে? কেন মারা গেছে, জানেন আপনি?’

তিনি তখন অন্যদিকে মুখ ফিরিয়েছেন। কোনও জবাব পেলাম না। সর্বনাশ। তবে কি এইখান থেকেই সঙ্গ নিলেন নাকি? শালবুনি স্টেশন আর কত দূরে সেই কথাই ভাবতে লাগলাম।

দেখতে দেখতে ট্রেনের গতি মন্থর হয়ে এল।

ভদ্রলোক এতক্ষণ পরে আমার দিকে মুখ ফেরালেন। বললেন, ‘কারখানায় চাকরি নিয়ে এলেন বুঝি?’

বললাম, ‘কী আর করি মশাই, পেটের দায়ে… দু-তিনটি ছেলেমেয়ে—’

তিনি বললেন, যদি মারা যান?’

সেকথা নিজেও কতবার ভেবেছি, কিন্তু তাঁর মুখ থেকে হঠাৎ এই কথাটা শোনবামাত্র বুকের ভেতরটা কেমন যেন ধ্বক করে উঠল। বললাম, ‘তাহলে না খেতে পেয়ে সবাই মারা যাবে।’

তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘ছেলেমেয়ে কটি?’

বললাম, ‘তিনটি। দুটি ছেলে, একটি মেয়ে।’

‘সংসারে আর কে আছে?’

‘বুড়ো বাবা, মা, পিসি, মাসি, ভাগনে, ভাগনি—পোষ্যের আর অন্ত নেই মশাই!’

‘হুঁ’ বলে তিনি একবার বাইরের দিকে মুখ বাড়িয়ে কী যেন দেখলেন। দেখেই বললেন, বুড়ো মা-বাপকে খেতে দেওয়া ভালো! আজকাল অনেকে দেয় না। আমিও বুড়ো হয়েছিলাম মশাই, কিন্তু এমনি পাজি ছেলে—’

বলেই তিনি উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, ‘স্টেশন এসে গেছে।’

গাড়ি কিন্তু তখনও থামে নি। তাঁর জীবনের গল্পটা শোনবার কৌতূহল হল। বললাম, ‘বসুন না। গাড়ি তো আর এগোবে না।’

এই বলে পকেট থেকে একটা বিড়ি আর দেশলাইটা বের করে বললাম, ‘খান।’ ভাবলাম, তাতেও যদি বসে তাঁর জীবনের গল্পটা বলেন! কিন্তু বিড়ি-দেশলাই তিনি হাত বাড়িয়ে নিলেন মাত্র, দেশলাইও জ্বাললেন না, বিড়িও খেলেন না; গাড়ি আমাদের স্টেশনে পৌঁছে গেল এবং পৌঁছোবামাত্র দরজা খুলে তিনি নেমে পড়লেন। যাবার সময় একটা নমস্কার করে বিদায় নেওয়া দূরে থাক, আমার দেশলাইটাও ফিরিয়ে দেবার সময় তাঁর আর হল না।

তৎক্ষণাৎ আমি তাঁর পিছু পিছু দরজা পর্যন্ত এগিয়ে গেলাম। তিনি ঠিক কোন দিকে যান দেখবার উদ্দেশ্যও যে ছিল না, তা নয়, অবশ্য আমার অন্য প্রয়োজনও ছিল। আমায় সঙ্গে নিয়ে যাবার জন্যে কারখানা থেকে লোক আসবার কথা।

কিন্তু অবাক কাণ্ড! দরজার কাছে এগিয়ে গিয়ে দেখি—গাড়ি তখনও ঠিক প্ল্যাটফর্মে এসে পৌঁছোয়নি, তখনও গাড়িখানা ধীরে ধীরে চলছে।

লোকটি কি তবে টিকিট করে নি? তাই টিকিট দেবার ভয়ে তাড়াতাড়ি নেবে গেল? কিন্তু অত বড় লম্বা চেহারা সহজে তো চোখের আড়াল হবার জো নেই। জ্যোৎস্নার আলোয় চারিদিক ঠিক দিনের মত স্পষ্ট পরিষ্কার, অথচ এদিক-ওদিক তাকিয়ে কোনদিকেই তাঁকে দেখতে পেলাম না। মানুষ বলে মনে মনে যদিই-বা একটুখানি সন্দেহ হয়েছিল, সেটুকুও এবার ঘুচে গেল। মানুষ কখনও এত সহজে চোখের সুমুখ থেকে অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে না।

বুকের ভেতরটা কেমন যেন করতে লাগল। একে আমার সম্পূর্ণ অপরিচিত নূতন জায়গা, তায় আবার পৌঁছোতে না পৌঁছোতেই এই অভিজ্ঞতা! পেটের দায়ে চাকরি করতে এসে কী যে অদৃষ্টে আছে কে জানে?

কারখানা থেকে দুজন গুর্খা চাপরাশি এসেছে, আর একজন বাঙালি ভদ্রলোক। গাড়ি থেকে আমার জিনিসপত্র তারাই নামাল।

প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে একবার চারিদিকে চেয়ে দেখলাম। যতদূর দৃষ্টি যায়—শুধু শালের জঙ্গল। ছোট ছোট কয়েকটি পাহাড়ও দেখলাম।

ট্রেনের লাইন এইখানে এসেই শেষ হয়েছে। গাড়িতে ওঠবার সময় লক্ষ করি নি, এখন দেখলাম—ট্রেনখানার দুদিকে দুটো ইঞ্জিন জুড়ে দেওয়া হয়েছে। একটা সুমুখে, একটা পিছনে। এইবার পিছনের ইঞ্জিনটা পিছু হটতে শুরু করলে। গাড়িটা যেদিক থেকে এসেছিল, হুস হুস করে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে আবার সেইদিকেই চলে গেল।

চারিদিক নির্জন। মাঝখানে ইস্পাতের ঝকঝকে লাইন চাঁদের আলোয় চিকচিক করছে, এপাশে ছোট্ট একটি স্টেশন, আর ওপাশে আমাদের কারখানা। কারখানা হতে তখনও অনেক দেরি। প্রকাণ্ড বড় বড় লোহার যন্ত্রপাতি এসে পৌঁছেছে। অনেকটা জায়গা জুড়ে নানান রকমের লোহালক্কড় ইতস্তত ছড়ানো, আর তারই একপাশে আমাদের থাকবার জন্যে টিনের ছোট ছোট কয়েকটি অস্থায়ী ঘর তৈরি হয়েছে।

শুনলাম নাকি ওই টিনের ঘরেই আমার আগে যারা এসেছেন, তাদের জীবন-লীলার অবসান হয়ে গেছে। তবু সে রাত্রির মত আমাকে সেইখানেই থাকতে হল।

বাঙালি ছোকরাটি জাতিতে ব্রাহ্মণ, আমার জন্যে সে রান্না করে রেখেছিল। ঠিক হল—নিজের হাতে রান্না আমায় কোনোদিনই করতে হবে না, সেই রোজ আমার রান্না করে দেবে। সেদিন রাত্রে তাকে আর আমার কাছ ছেড়ে যেতে দিলাম না। খাওয়া-দাওয়ার পর সে আমারই কাছে ছোট্ট একটি বিছানা বিছিয়ে শুয়ে রইল। কাছাকাছি কোন একটা গ্রামে তার বাড়ি। নাম—যতীন

প্রথমেই সে জিজ্ঞেস করলে, ‘আপনি ব্রাহ্মণ? ‘

বললাম, ‘হ্যাঁ।’

যতীন বললে, ‘ব্যস, তাহলে আর আপনার ভয় নেই।’

জিজ্ঞেস করলাম, ব্যাপার কী বল দেখি যতীন?’

যতীন বললে, ‘যারা মরছে, তাদের ভূতে মেরেছে কিনা। গেছো ভূতে। ভূত কখনও বামুনকে মারে না। ওরা বামুন কেউ ছিল না।’ বললাম বামুনকে মারবে না, তা তুমি কেমন করে জানলে যতীন? যতীন একটুখানি হাসল। হেসে বললে, পৈতে ছুঁয়ে একবার যদি গায়ত্রী জপ করে দেন তো ভূতের বাবার সাধ্য নেই যে, আপনার কাছে এগোয়। তা নইলে ওদের তিন-তিনটেকে মেরে ফেললে, আর আমাকে মারতে পারত না?’

ব্যাপারটা সত্যিই রহস্যজনক। কিছুই বুঝবার উপায় নেই। রাত্রে ভাল ঘুমও হল না। অতি প্রত্যুষে শয্যাত্যাগ করে বাইরে বেরিয়ে এলাম। তখন সবে সূর্যোদয় হচ্ছে। পূর্বদিকে সবুজ বনের মাথার উপর আকাশটা লাল হয়ে উঠেছে। মিষ্টি মিষ্টি হাওয়া বইছে। জায়গাটি বড় চমৎকার!

আমায় বাইরে বেরিয়ে আসতে দেখেই গুর্খা চাপরাশি দুজন সেলাম করে আমার কাছে এসে দাঁড়াল। জিজ্ঞেস করলে, কাজ আরম্ভ হবে কি না এবং তা যদি হয়, তাহলে ওরা আশপাশের গ্রাম থেকে লোক ডাকতে যাবে।

বললাম, ‘যাও, তোমরা লোক নিয়ে এসো। কাজ আরম্ভ হবে।

এখন আমাদের কাজ শুধু জঙ্গলের গাছ কাটা। কোম্পানি তার জন্যে আমার সঙ্গে দিয়েছে একশ টাকা। তাছাড়া, টাকার দরকার হলেই হয় হেড-আপিসে জানাতে হবে, আর না হয় এখানকার জংশন স্টেশনে কোম্পানির যে চুনের কারখানা আছে, সেখানে জানালেই তারা তৎক্ষণাৎ টাকা পাঠিয়ে দেবে। আমার ওপর হুকুম—এক মাসের মধ্যে অন্তত হাজার বিঘে জমি সাফ করে ফেলা চাই।

চাপরাশিদের বলে দিলাম, ‘লোক তোমরা যত বেশি পার নিয়ে এসো।’

তারা লোক আনতে চলে গেল।

ভাবলাম, আমার একমাত্র প্রতিবেশী স্টেশন-মাস্টারের সঙ্গে আলাপ-পরিচয়টা করে আসি। কিন্তু এত সকালে ভদ্রলোক ঘুম থেকে উঠেছেন কি না, কে জানে? একটু পরেই যাওয়া যাবে ভেবে, পায়ে-চলা যে সরু পথটি জঙ্গলের ভেতর গিয়ে ঢুকেছে, সেই পথ ধরে হাঁটতে শুরু করলাম। দুপাশে শাল আর মহুয়ার ছোটবড় নানা রকমের গাছ সোজা উপরের দিকে উঠে গেছে। কিছুদূর এগিয়ে যেতেই দেখি, শাখায়-প্রশাখায়, চিকন কচি লতায়-পল্লবে ক্রমশ তারা এমনিভাবে ঘন সন্নিবদ্ধ যে, বেশিদূর দৃষ্টি চলে না। যেদিকে তাকাই—শুধু গাছ আর পাতা, পাতা আর গাছ। মৃদুমন্দ বাতাসে পাতাগুলি ঝির ঝির করে কাপছে, নানারকমের অসংখ্য পাখি উড়ে উড়ে বেড়াচ্ছে। কোথায় হয়ত কোন বুনো গাছে বুনো ফুল ফুটেছে; তারই মিষ্টি সুগন্ধে বাতাস যেন ভরে আছে। চিত্র-বিচিত্রিত চমৎকার একটি প্রজাপতি উড়তে উড়তে হঠাৎ আমার গায়ে এসে বসল। ইচ্ছে করলেই তাকে আমি ধরতে পারতাম, কিন্তু ধরলাম না। হাতটি আমার চোখের কাছে এনে যেই তাকে আমি ভাল করে দেখতে গেলাম, রঙিন পাখা উড়িয়ে তৎক্ষণাৎ সে আমার হাতের ওপর থেকে উড়ে পালাল। ছায়াশীতল স্নিগ্ধ সেই অরণ্যের মাঝখান দিয়ে মনের আনন্দে অন্যমনস্ক হয়ে অনেক দূরে গিয়ে পড়েছিলাম, পেছনে হঠাৎ একটা ট্রেনের শব্দে যেন আমার চৈতন্য হল। এবার ফিরতে হবে। ফেরার পথে যতই আমি সেই সতেজ সবুজ গাছগুলির পানে তাকাই, ততই আমার মনে হতে থাকে, –আমি যেন ওদের পরম শত্রু। কতকাল ধরে এরা এইখানে এই ধরিত্রীমাতার বুকের ওপর সযত্নপালিত সন্তানের মত ধীরে ধীরে বেড়ে উঠেছে, বিশ্বের বিস্ময় প্রাণবন্ত এই সব বিশাল মহীরুহ, – আমি এসেছি তাদের সমূলে উৎপাটিত করে সবংশে নিধন করে দিতে। নিবিড় ঘন অরণ্যানীর নয়ন-মনোহর এই স্নিগ্ধ শ্যাম রূপ আমায় নিশ্চিহ্ন করে মুছে দিতে হবে, তার পরিবর্তে বসবে এখানে—এক বিরাট কারখানা! —লোহা আর ইস্পাত, ইঞ্জিন আর আগুন।… আমার আগে যাঁরা এলেন, নিজের জীবন দিয়ে এই হত্যাকাণ্ডের প্রায়শ্চিত্ত করে গেলেন কি না, তাই বা কে জানে।

ট্রেন এসেছে, আবার চলেও গেছে। স্টেশন মাস্টার বসে বসে একটা মোটা খাতায় কি যেন লিখছিলেন। মোটা-সোটা, বেঁটেখাটো মানুষটি। পরিচয় হতেই মুখখানি তার আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। খাতা বন্ধ করে তিনি গল্প জুড়ে দিলেন।

বললাম, কাজ করুন।’

তিনি বললেন, ‘ধ্যুৎ তেরি কাজ। মানুষের মুখ দেখতে পাই না মশাই, দুটো কথা বলে যে সুখ হবে, তা এই পাণ্ডব-বর্জিত দেশে তারও উপায় নেই। দিন না মশাই চটপট ওই গাছগুলোকে কেটে উড়িয়ে। তবু একটা কারখানা-টারখানা হবে, শহর বসবে, বাজার বসবে, লোকজন তবু দেখতে পাব।’

বললাম, ‘কিন্তু ওই গাছ কাটতে গিয়েই শুনছি, আমার আগে তিন-তিনজন—’

কথাটাকে তিনি আর শেষ করতে দিলেন না। টেবিল চাপড়ে চিৎকার করে বলে উঠলেন, ‘আরে দূর দূর! আমি ও-সব বিশ্বাস করি না মশাই, ভূত না আরও কিছু। ভূত না হয় মেরেই দিয়ে গেল, কিন্তু টাকাকড়িগুলো গেল কোথায়? সেগুলোও কি ভূতে নিয়ে গেল নাকি?’

কথাটা ভাল বুঝতে পারলাম না, তাই তাঁকে আর একবার ভাল করে জিজ্ঞেস করতেই তিনি বললেন, তাঁর বিশ্বাস, ভূতে তাদের মারেনি, মেরেছে মানুষে। কুলি বিদেয় করবার টাকাকড়ি তাদের কাছেই থাকত, সেই টাকার লোভে কেউ তাদের মেরে ফেলেছে।’

তিনি বললেন, ‘আমার কিন্তু মশাই, ও গুর্খা চাপরাশি দুটোকে বিশ্বাস হয় না। বললে কথা শোনে না, ব্যাটারা যেন নবাব পুত্তুর।’

বললাম, ‘কী জানি মশাই, কী করব, তাই ভাবছি।’

মাস্টারমশাই-এর টেলিগ্রাফ এসেছে। তিনি উঠে দাঁড়ালেন। টেলিগ্রাফের কলটার কাছে গিয়ে টক টক করে কলটা বারকতক বাজিয়ে দিয়ে বললেন, ‘বলছি দাঁড়ান! আপনার আগে যে লোকটা এসেছিল, তাকেও বলেছিলাম; কিন্তু সে হিন্দুস্থানি, বাঙালির কথা শুনলে না, ভাবলে—বুঝি আমি ওর টাকাগুলো বাগাবার মতলবে আছি।’

কাজ শেষ করে তিনি অবার আমার কাছে এসে বসলেন। বললেন, টাকাকড়ি নিজের কাছে রাখবেন না দাদা, আমি ভালো কথা শিখিয়ে দিচ্ছি, শুনুন।’

বলে তিনি স্টেশন ঘরের দেওয়ালের গায়ে-লাগানো একটা আয়রন সেফ দেখিয়ে দিয়ে বললেন, ‘ওইখানে রাখতে পারেন। পরের টাকা ওখানে রাখতে অবশ্য আমি দিতাম না, কিন্তু আপনি একে বাঙালি, তায় ব্রাহ্মণ; তাই বলছি, একবার রেখে দেখুন দেখি—কী হয়। রাত দশটায় আমার শেষ ট্রেনখানা পার করে দিয়ে আমি আমার বাসায় চলে যাই, সেই সময় চাবি আমি সঙ্গে করে নিয়ে চলে যান। আপনি ইচ্ছে করলে রাত্রে এখানে শুয়েও থাকতে পারেন। বেশ করে দরজা-জানালা বন্ধ করে দিয়ে এই টেবিলের ওপর তোফা আরাম করে নাক ডাকাবেন মশাই। টাকা থাকবে ওই আয়রন-চেস্টের মধ্যে, দেখুন তো, দেখি ভূতে কেমন করে মারে?’

পরামর্শ মন্দ নয়।

খাবার জোগাড় করবার জন্যে যতীন আমার কাছে টাকা চাইতে এলে, টাকা দিয়ে বললাম, রাত্রে আমি এইখানে থাকব যতীন।’

যতীন হেসে বললে, ‘বুঝতে পেরেছি, বাবু ভয় পেয়েছেন। তা আপনার ভয় কী বাবু। আপনি বেরাহ্মণ মানুষ—আমি তো তখন আপনাকে বলেই ছিলাম।’

.

গুর্খা চাপরাশি দুজন বেশ কাজের লোক। গাছ কাটার জন্যে প্রায় পঞ্চাশজন কুলি তারা ধরে নিয়ে এল। একশ টাকা আর কতক্ষণ। দিনের শেষে কুলিদের মজুরি দিতে গিয়ে দেখি—অনেকখানি জায়গা তারা পরিষ্কার করে ফেলেছে।

রামলাল গুর্খা বললে, ‘বাবু হেট-আপিসসে বহুট রুপেয়া মাঙ্গায় লেন।’

জিজ্ঞাসা করলাম, কাজ কি তাহলে এতদিন হয়নি রামলাল?’

রামলাল বললে, ‘ঠোড়া ঠোড়া হয়েছে বাবু!’

শিউশরণ বলে রামলালের সঙ্গীটি পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। সে বললে, ‘উ বাবুলোক বহুট রুপেয়া চুরি করিয়েসে বাবু!’

তা হয়ত হবে। কিন্তু সে-টা তাদের কাজে লাগেনি। টাকা তো যমের বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছোয় না।

যাই হোক সেইদিনই হেড-আপিসে তার করে দিলাম—একসঙ্গে মোটা রকমের কিছু টাকা আমায় পাঠিয়ে দেওয়া হোক, নইলে কাজের ভারি অসুবিধা হবে।

কিন্তু টাকা আসতে আসতে অনেক দেরি হয়ে গেল। আমার আগে যাঁরা এসেছিলেন, তাঁরাও হয়ত এমনি করে টাকা নিয়েছেন, কিন্তু কাজ বেশিদূর এগোয়নি; অথচ টাকার হিসেব না দিয়েই তাঁরা মরে গেছেন। এমনি করে কোম্পানির অনেক টাকা ক্ষতি হয়েছে। তাই টাকা না এসে কলকাতার হেড-আপিস থেকে এলেন একজন ইন্সপেক্টর।

কাজ দেখে তিনি খুশি হলেন। অসংখ্য গাছ তখন আমি কাটিয়ে স্তূপাকার করে ফেলেছি। বনের শ্যামল শ্রী একেবারে নির্মমভাবে নষ্ট করে দিয়ে অনেকখানি জায়গা তখন ফাঁকা করে দিয়েছি। কিন্তু কুলিরা বেতন পায়নি প্রায় সপ্তাহখানেকের, তারা আমায় তখন ছিঁড়ে খাচ্ছে। বললাম, ‘টাকা আপনি গিয়েই পাঠিয়ে দেবেন, নইলে কাজ হয়ত আমায় বন্ধ করে দিতে হবে।’

ইন্সপেক্টর বললেন, টাকা আপনার পরশু পৌঁছে যাবে। এখন এক হাজার টাকা পাঠিয়ে দিচ্ছি, ফুরিয়ে যাবার আগেই জানাবেন।’

তাকে আমি ট্রেনে চড়িয়ে দিয়ে এলাম। শিউশরণ আমার সঙ্গে গিয়েছিল। ফেরবার পথে শিউশরণ বললে, ‘আরও বেশি টাকা মাঙ্গায় লেন বাবু, এক হাজার টাকা আর কোতোদিন যাবে।’

বললাম, ফুরোলেই আবার পাঠাবে।’

যতীনকে প্রায়ই বলতাম, ‘কই যতীন, মরলাম না তো? বড় বড় গাছগুলোকে তো প্রায় সবই কেটে ফেললাম।’

যতীন হেসে জবাব দিত, ‘আমি তো বাবু আগেই সে কথা বলে দিয়েছি। বামুনের কোনও ভয় নেই।’

বলতাম, ‘ঠিক বলেছ। কথাটা প্রথমে বিশ্বাস করিনি, এখন দেখছি, সেই কথাই সত্যি।’ যতীন বলত, ‘আজ্ঞে হ্যাঁ, আমার ও-সব অনেক জানা আছে।’

রাত্রে সেদিন খেতে বসে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ভূত তুমি নিজে কোনোদিন দেখেছ যতীন?’ যতীন বললে, ‘তা আজ্ঞে, দেখেছি বই কি!’

এই বলে সে তার ভূত-দেখার গল্প আরম্ভ করলে। এমন গল্প যে, সে আর সহজে থামতে চায় না। এদিকে রাত্রির শেষ-গাড়িটা তখন স্টেশনে এসে দাঁড়িয়েছে। গাড়িটা ছেড়ে গেলেই স্টেশন-মাস্টার বাসায় চলে যাবেন। তার আগেই আমার সেখানে যাওয়া দরকার। কারণ, রাত্রে আমার শোবার বন্দোবস্ত সেইখানেই। কাজেই বাধ্য হয়ে যতীনকে বললাম, ‘বাকিটা কাল শুনব যতীন, আজ থাক।’

কিন্তু এমনি তার গল্প বলবার শখ যে, সে শেষ পর্যন্ত আমার সঙ্গে স্টেশন পর্যন্ত তার গল্পটা বলতে বলতে এল।

গাড়ি চলে গেছে, মাস্টারমশাই তখন বসে আছেন দেখে জিজ্ঞেস করলাম, ‘বসে আছেন যে এখনও?’

বললেন, ‘আসুন, আপনারই জন্য বসে আছি।’

বললাম, ‘এবার আপনি যেতে পারেন।’

তিনি বললেন, ‘যাব কি মশাই, জংশন থেকে তার এল, আপনার একহাজার টাকা নিয়ে লোক আসছে।’

‘কেমন করে আসবে? গাড়ি তো চলে গেল।’

তিনি ঈষৎ হেসে বললেন, ‘একি আর আপনার আমার কাজ মশাই, অত বড় সায়েব-কোম্পানির কাজ, খাতির কত! জংশন থেকে একখানা পাইলট ইঞ্জিন দিয়েছে, তাইতেই লোক আপনার এল বলে।’

যতীন বললে, ‘তাহলে এই অবসরে গল্পটা আমার শেষ করে নিই বাবু, শুনুন।’

বলে সে তার গল্প শেষ করতে বসল।

গল্প শেষ হতে না হতেই হুস হুস করে ইঞ্জিন এসে দাঁড়াল। ইঞ্জিন থেকে নামল এক সাহেব। একহাজার টাকা—অন্য কারও হাতে পাঠাতে হয়ত বিশ্বাস হয়নি, তাই চুনের কারখানার ছোট সাহেব নিজে এসেছেন।

টাকা দিয়ে রসিদ লিখিয়ে নিয়ে, তিনি আবার সেই ইঞ্জিনেই ফিরে গেলেন।

টাকাগুলো লোহার সিন্দুকে বন্ধ করে মাস্টারমশাই বললেন, ‘আসি তবে, নমস্কার।’

বললাম, ‘আসুন।’

যতীন বললেন, ‘আমিও তাহলে আসি বাবু। আপনি শুয়ে পড়ুন।’

বললাম, ‘যাও।’

বলেই দরজা-জানালা বন্ধ করছিলাম, যতীন ফিরে এল। বললে, ‘অত অত টাকা এল, আপনি একা থাকবেন বাবু, গুর্খা দুটোকে পাঠিয়ে দেবো?’

ঘাড় নেড়ে বললাম, ‘না।’

যতীন চলে গেল।

দরজা-জানালাগুলো বন্ধ করে দিয়ে ঘরের মধ্যে শুয়ে থাকলে দম আমার বন্ধ হয়ে আসে। সেদিনও তাই একটা জানালা আমি খুলে রাখলাম। রেল স্টেশনের জানালা, খুলে রাখা মানে শবই খোলা। ইচ্ছে করলে ও-পাশ থেকে টপকে যে-কেউ এসে ঘরে ঢুকতে পারে। আসুক-না। এলেই বা কী করবে? টাকা আছে লোহার সিন্দুকে। সিন্দুক একেবারে দেওয়ালের সঙ্গে আঁটা। আর ভূত যদি আসে, তাদের তো শুনেছি সর্বত্রই অবাধ গতি তাদের কাছে খোলাই বা কি, আর বন্ধই বা কি। তারা অবশ্য টাকা নিতে আসে না। তাছাড়া, এলে এতদিন আসতো। এখনও যখন আসেনি, তখন সম্ভবত আর আসবে না।

এমনি সব নানান কথা ভাবছি, আর সেই খোলা জানালার পানে তাকিয়ে আছি। আকাশে চাঁদ উঠেছে। দিনের মত পরিষ্কার জ্যোৎস্নার ছটা জানালার পথে ঘরে এসে পড়েছে।

ভাবতে ভাবতে কতক্ষণ পরে জানি না, ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ মনে হল, কাপড় দিয়ে কে যেন আমার মুখখানা চেপে ধরেছে। ঘুম ভেঙে গেল, জেগে দেখি, সত্যিই তাই। হাত তুলতে গিয়ে দেখি, হাত দুটো দড়ি দিয়ে বাঁধা, পায়ের অবস্থাও তাই। ঘুমের ঘোরে কখন যে এমন করে আমায় আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে, কিছুই বুঝতে পারিনি। কথা কইবার উপায় নেই। দম যেন বন্ধ হয়ে আসছে। অথচ চোখ দুটো খোলা। জানালার পথে যে জ্যোৎস্নার আলো ঘরে এসে পড়েছে, তাতে শুধু সেই জায়গাটাই দেখা যায়। যে লোকটা আমার মুখে কাপড় চাপা দিয়ে সজোরে বেঁধে ফেলছে, তাকে আবছা আবছা দেখতে পাচ্ছি, কিন্তু চিনবার উপায় নেই। মুখ খুলতে পারছি না, তবু কোনোরকমে অস্পষ্টভাবে গোঁ গোঁ করে বললাম, ‘টাকা নিয়ে যাও, কিন্তু আমায় তোমরা মেরে যেয়ো না বাবা।

ওদিকে আমার মাথার পেছনে দেওয়ালের গায়ে সিন্দুক খোলার শব্দ পেলাম। আর করি কি! মড়ার মত চুপ করে পড়ে আছি। মৃত্যু অনিবার্য। এতক্ষণে বুঝলাম, আমার আগে যারা গেছে তারাও ঠিক এমনি করেই গেছে। সে যে কি ভীষণ অবস্থা, তা আমি লিখে বোঝাতে পারব না। চোখের সুমুখে আমার ছোট ছোট ছেলেমেয়ে তিনটির কচি মুখ ভেসে উঠল, আমার স্ত্রীর কথা মনে হল। হায় হায়, কেন আমি তাদের ছেড়ে এখানে এলাম। চোখ দিয়ে আমার দর দর করে জল গড়িয়ে পড়তে লাগল। –হে ভগবান! এরা যেন আমায় প্রাণে না মারে। বেঁচে যদি থাকি তো কালই আমি এ চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে চলে যাব। টাকাগুলো মাথার কাছে ঝন ঝন করে উঠলো। থলেটা তাহলে ওরা বের করেছে।

এমন সময় মনে হল যেন জানালার পথে আর একটা লোক ঘরের মধ্যে লাফিয়ে পড়ল। চোখের জলে দৃষ্টি তখন আমার ঝাপসা হয়ে এসেছে, তবু যেন মনে হল, আপাদমস্তক সাদা কাপড়ে ঢাকা প্রকাণ্ড লম্বা সেই লোকটা—ষাকে আমি প্রথম দিনে ট্রেনে দেখেছিলাম। গলাটা তখন কে যেন আমার দুহাত দিয়ে চেপে ধরেছে। এইবার মৃত্যু! অনুরোধ করবার শক্তি নেই। মুখের কাপড় তখন তেমনি বাঁধা

কিন্তু অবাক কাণ্ড! মরতে মরতে আমি যেন বেঁচে গেলাম। লোকটা আমার গলা ছেড়ে দিয়ে ঘরের মধ্যে কার সঙ্গে যেন হাতাহাতি শুরু করে দিয়েছে।

তার পরেই ভীষণ শব্দ। তার পরেই চিৎকার। মানুষ মরবার সময় যেভাবে চিৎকার করে, এও যেন ঠিক তেমনি। কণ্ঠস্বর শুনে চিনতে পারলাম, এ আমার গুর্খা চাপরাশি রামলাল।

মারামারি কিন্তু তখনও থামেনি; টাকার থলেটা মনে হল একবার ঝন ঝন করে মেঝেতে পড়ে গেল। তারপর কে যেন জানালা টপকে বাইরে বেরিয়ে গেল। তার পিছু পিছু আর একজন। বাইরেও শব্দ হতে লাগল। নিরুপায় ও অসহায় অবস্থায় আমি শুধু মড়ার মত সেইখানে চুপ করে পড়ে রইলাম।

খানিক পরে সব নিস্তব্ধ হয়ে গেল।

কি যে হল, কিছুই ভাল বুঝতে পারলাম না। তখনও বুকের ভেতরটা আমার কেমন যেন করছে। যে কোন মুহূর্তে মৃত্যু হতে পারে, সে কথাই ভাবছি।

এমন সময় ঝক ঝক শব্দ করতে করতে ঘরের বাইরে একখানা ইঞ্জিন এসে দাঁড়াল। সঙ্গে সঙ্গে অনেকগুলো পায়ের শব্দ। বন্ধ দরজায় ঘা পড়তে লাগল। কিন্তু কে খুলবে? আমার তো ওঠবার উপায় নেই। মুখখানা টেনে বাঁধা। কথাও বলতে পারছি নে।

পায়ের শব্দ ঘুরে এদিকের খোলা জানালার কাছে এসে দাঁড়াল। একজন সাহেব জানালা টপকে ঘরে ঢুকে দরজা খুলে দিলেন। ঘরে আলো জ্বালা হল। জংশন থেকে তাঁরা ইঞ্জিনে চড়ে চারজন এসেছেন। কোয়ার্টার থেকে স্টেশন মাস্টার এলেন।

ঘরের মেঝে রক্তে ভেসে গেছে। গুর্খা চাপরাশি রামলাল মেঝের উপর মরে পড়ে আছে। তারই কোমরের ভোজালি তারই গলায় বসিয়ে দেওয়া হয়েছে।

লোহার সিন্দুক খোলা। কিন্তু টাকার থলে মেঝের উপর পড়ে রয়েছে।

ব্যাপারটা কিছুই ভাল বোঝবার উপায় নেই। কে যে আমায় মেরে ফেলে টাকা নিয়ে উধাও হবে ভেবেছিল, আর কেই-বা আমায় বাঁচিয়ে রামলালকে মেরে গেল, কে জানে!

সাহেবদের জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনারা খবর পেলেন কেমন করে?’

যিনি এখানে টাকা দিয়ে গিয়েছিলেন, তিনি বললেন, ‘জংশনে ইঞ্জিন আমাদের পৌঁছবামাত্র এখান থেকে তার গেল, ডাকাত পড়েছে, জলদি আসুন।’

এখান থেকে তার করবে কে? স্টেশন-মাস্টার টেলিগ্রাফের কাছে উঠে গিয়ে হাত দিয়ে তুলে আমাদের দেখালেন, কানেকশন তিনি কেটে দিয়েই বাসায় গিয়েছিলেন।

অবাক হয়ে আমরা পরস্পরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগলাম।

হঠাৎ আমার মনে হল, ঝগড়াটা বাইরে পর্যন্ত গড়িয়েছিল। বাইরে বেরিয়ে একবার দেখা যাক।

সবাই মিলে বাইরে বেরিয়ে গেলাম। জ্যোৎস্নার আলো তখন ম্লান হয়ে এলেও দেখা গেল, দূরে প্ল্যাটফর্মের একেবারে শেষ সীমানায় সাদামত কি যেন একটা পড়ে রয়েছে। কাছে গিয়ে দেখি, শিউশরণ। আমাদের দেখে সে শুধু কাঁদতে থাকে। মুখে কোনও কথা বলে না।

শেষে অনেক কষ্টে মেরে মেরে তাকে কথা বলানো হল। সাহেবের লাথি খেয়ে সে কাঁদতে কাঁদতে সব কথাই বলে ফেললে। আমায় মেরে ফেলে সে আর রামলাল, দুজনেই এসেছিল টাকা চুরি করতে। এর আগে যে তিনজন মরেছে, তারাও তাদেরই হাতে মরেছে। কিন্তু এবার তার ফল হল বিপরীত। মাঝখান থেকে কে একটা লোক এসে রামলালকে তো মেরেই ফেললে, আর তার হাত থেকে টাকার থলেটা কেড়ে নিয়ে পা-দুটো তার উলটো দিকে মুচড়ে ভেঙে দিয়ে চলে গেল।

বুঝলাম, সেই ভাঙা পা নিয়ে অতি কষ্টে বুকে হেঁটে শিউশরণ পালাবার চেষ্টা করছিল।

জিজ্ঞাসা করলাম, ‘লোকটা দেখতে কি রকম বল দেখি?’

শিউশরণ বললে, ‘সে মানুষ নয় বাবু; তার গায়ে বহুৎ জোর। ইয়া লম্বা তালগাছের মত, আর ছাগলের মত মুখ।

আর কিছু বলবার দরকার ছিল না। মাথাটা তখন আমার কেমন যেন ঘুরছিল বলে সেইখানেই বসে পড়লাম। রামলাল যখন আমার গলাটা চেপে ধরে আমায় মেরে ফেলবার উদ্যোগ করছিল, তাকে তখন আমি জানালা টপকে ঘরে ঢুকতে দেখেছি। এমন সময় টুপ করে আমার পায়ের কাছে কি যেন একটা পড়ল। তুলে দেখি—একটা দেশলাই-এর বাক্স এইটেই সেদিন আমি তাকে ট্রেনের কামরায় দিয়েছিলাম, কিন্তু ফেরত দিতে সে ভুলে গিয়েছিল। এদিক-ওদিক বহুদূর পর্যন্ত তাকিয়ে কাউকেই দেখতে পেলাম না। সমস্ত শরীর তখন আমার রোমাঞ্চিত হয়ে উঠেছে।

কিন্তু কে সে?

যে-ই হও, তুমি আমার প্রাণ রক্ষা করেছ। তোমায় নমস্কার।

সকল অধ্যায়

১. ভয় – শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়
২. প্রেতপুরী – শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়
৩. ভয়ঙ্কর – শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়
৪. ভূতুড়ে বই – শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়
৫. কি? – শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়
৬. নমস্কার – শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়
৭. অসম্ভব – শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়
৮. ন্যাড়া নন্দী – শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়
৯. ভূতের গল্প – শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়
১০. ভীষণ কাণ্ড – শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়
১১. যবনিকা – শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়
১২. আতঙ্ক – শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়
১৩. প্রেতিনী – শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়
১৪. জীবন নদীর তীরে – শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়
১৫. সত্যি নয় – শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়
১৬. ভূতুড়ে খাদ – শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়
১৭. ঘরোয়া ভূত – শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়
১৮. কে তুমি? – শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন