শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়
শহরের একটি বড় রাস্তার পাশে ছোট একখানি ঘর ভাড়া করিয়া তখন আমি সবেমাত্র জ্যোতিষী হইয়া বসিয়াছি। দশ টাকা খরচ করিয়া প্রকাণ্ড একটা সাইনবোর্ড টাঙানো হইয়াছে, ঘরের মধ্যে আসবাবপত্রেরও অভাব নাই, মোটা মোটা কেতাবের পিছনে সোনার জলে নাম লিখাইয়া ছোট একখানি কাঁচের আলমারি প্রায় ভর্তি করিয়া ফেলিয়াছি, কাপড়ের উপর বড় বড় পাঁচটা আঙুলওয়ালা হাতের তালু, মানুষের মুণ্ডু ইত্যাদি আঁকাইয়া দেওয়ালে ঝুলানো হইয়াছে, টেবিল চেয়ার, ঘড়ি, তসবির—সবই আছে। নাই শুধু মক্কেল। প্রায় মাস-তিনেক হইতে চলিল, অন্তত হাত দেখাইবার জন্য একটা লোকও আসে না। দিন দশেক আগে কোথাকার একটা ফাজিল ছোকরা আসিয়াছিল বটে। আসিয়াই জানিতে চাহিল আমি কোষ্ঠী তৈরি করিবার জন্য কত পারিশ্রমিক লইয়া থাকি। বলিলাম, ‘দশ টাকা।’
‘হুঁ।’ বলিয়া খানিকক্ষণ কি যেন ভাবিয়া বলিল, ‘আমার ভাগনের একটা দরকার। আচ্ছা দাঁড়ান আমি বলব তাকে।’
তাহার পর হাত দেখিবার চার্জ, প্রশ্ন গণনা করিবার ফি, বিবাহের ফলাফল, ব্যবসার উন্নতি-অবনতি ইত্যাদি। হেন-তেন সাত-সতেরো অনেক কিছু জানিতে চাহিয়া আমাকে বকাইয়া বকাইয়া মারিয়া শেষে হঠাৎ এক সময় বলিয়া বসিল, ‘আপনি কবচ-টবচ দেন তো?’
বলিলাম—’হ্যাঁ দিই।’
‘সব রকমের কবচ?’
জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘সব রকম মানে?’
‘এই ধরুন—ধনদা জ্ঞানদা… আহা হা নামগুলো সব মনেও পড়ে না যে ছাই! ধরুন—বশীকরণ—’
কবচ যদিও তখনও পর্যন্ত কাহাকেও দিই নাই, তবু বলিলাম, ‘দিই।’
ছোকরাটি আবার খানিকক্ষণ কি যেন ভাবিল। তাহার পর জিজ্ঞাসা করিল, ‘আচ্ছা ওই যে বললেন বশীকরণ কবচের কথা, আচ্ছা ধরুন—কেউ যদি নেয় ত তার ফল ঠিক হবেই, কি বলেন?’
বলিলাম, ‘হবে বই-কি। নিশ্চয়ই হবে।’
আচ্ছা ধরুন, এই যে বিজ্ঞাপনে লেখা থাকে, অসৎ ‘পারপাশে’ নেওয়া উচিত নয়—তা ধরুন—অসৎ উদ্দেশ্যেও ত অনেকে নিয়ে থাকে, তাদের কি আর কার্য্যসিদ্ধি হয় না বলতে চান? হ্যাঁ, অসৎ ‘পারপাশ’ না ঘেঁচু। কাজ হয়ে যায়, আলবাৎ হয়। কি বলেন?’
এই বলিয়া সে আমার মুখের পানে তাকাইয়া রহিল।
বলিলাম, ‘চাই আপনার?’
‘কত দাম?’
‘পাঁচসিকে।’
‘পাঁচসিকে?’ বলিয়া একবার এ-পকেট, ও-পকেট হাতড়াইয়া সে উঠিয়া দাঁড়াইল। বলিল, আজ তো অত পয়সা নেই আমার কাছে। আচ্ছা কাল নিয়ে যাব। আসি। নমস্কার।’
এই বলিয়া সেই যে সে চলিয়া গিয়াছে, আর আসে নাই।
সেদিন অমনি একাকী বসিয়া বসিয়া ভাবিতেছি, ছোঁড়াটাকে ছাড়িয়া দেওয়া বোধ হয় আমার উচিত হয় নাই। পকেটে তাহার দু-চার আনা যাহা ছিল তাহাই লইয়া ছাই-ভস্ম একটা পুঁটুলি বাঁধিয়া কবচ তৈরি করিয়া দিলেই পারিতাম। এবার যদি কেহ আসে ত তাহাকে আর এমন করিয়া হাত ছাড়া করিলে চলিবে না। শস্যঞ্চ গৃহমাগতম্! কিছুই না পাওয়ার চেয়ে যাহা পাই তাহাই লাভ।
এমন সময় পায়ের শব্দে সুমুখে তাকাইয়া দেখি, মোটা-সোটা এক ভদ্রলোক ঘরে ঢুকিতেছেন। নমস্কার করিয়া পাশের একটা চেয়ার দেখাইয়া দিয়া বলিলাম, ‘বসুন!’
কিন্তু তিনি বসিলেন না। সরাসরি আমার টেবিলের কাছে আগাইয়া আসিয়া টেবিলের উপর দুইটি হাত রাখিয়া আমার মুখের পানে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকাইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘আপনি জ্যোতিষী?’
সবিনয়ে ঘাড় নাড়িয়া জবাব দিলাম, ‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’
‘বেশ।’ বলিয়া কেমন যেন একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলিয়া তিনি চেয়ারে উপবেশন করিলেন। দেখিলাম, গায়ে একখানি কালো রঙের অত্যন্ত ময়লা কোট, কাপড়__ ততোধিক অপরিষ্কার, পায়ে একজোড়া ছেঁড়া স্যান্ডেল, মাথার চুল উস্কোখুস্কো, দেখিলে মনে হয়—লোকটা মাসাধিককাল স্নান করে নাই। চেয়ারে বসিয়াই তিনি আবার আর একবার আমার মুখের পানে তাকাইয়া বলিলেন, ‘জল আছে মশাই আপনার এখানে? দিন তো এক গ্লাস খাই।’
ঘরের কোণে কুঁজোভর্তি জল ছিল, উঠিয়া তাঁহাকে দিতে হাঁ হাঁ করিয়া নিষেধ করিলেন। বলিলেন, ‘থাক্ আমি নিজেই নিচ্ছি। কাউকে বিশ্বাস নেই মশাই, কাউকে আমি বিশ্বাস করি না।’
সর্বনাশ! আবার আর এক উন্মাদের পাল্লায় পড়িলাম হয়ত! অদৃষ্ট যখন মন্দ হয় তখন এমনিই হয়।
জল খাইয়া গ্লাসটি তিনি টেবিলের উপর নামাইয়া রাখিলেন। বলিলেন, ‘ভয় নেই মশাই ধুয়ে দেব, আমি বামুনের ছেলে! এই দেখুন পৈতে।’
এই বলিয়া তৎক্ষণাৎ গলার নিচে দুটি আঙুল চালাইয়া অত্যন্ত মলিন পৈতেগাছটি বাহির করিয়া তিনি আমায় দেখাইলেন। বলিলেন, ‘ভাগ্যিস এইটে এখনও রেখেছি গলায়। নইলে বামুনের ছেলে যদি না হতাম মশাই, তাহলে দিত এদ্দিন সাবাড় করে। শালী আজও আমার পিছন নিয়েছে।’
বলিয়াই একবার তিনি তাঁহার পিছনের দিকে একবার পাশের দিকে তাকাইয়া বলিলেন, ‘এখানে আসতে পারবে না, কি বলেন? আপনারা তো জ্যোতিষী, মন্তর তন্তর ঝাড়-ফুঁক জানা আছে নিশ্চয়ই। এ্যাঁ?’
পাগলকে বিশ্বাস নাই। এখনই হয়ত একটা বিভ্ৰাট কাণ্ড বাধাইয়া বসিবে ভাবিয়া তাহাকে তাড়াইয়া দিব কিনা চিন্তা করিতেছি, এমন সময় তিনি আমার টেবিলের কাছে উঠিয়া আসিলেন। আবার তেমনি ঝুঁকিয়া পড়িয়া নিতান্ত কাতরকণ্ঠে চুপিচুপি বলিলেন, ‘গাটা আমার একবার বেঁধে দেবেন মশাই?’
কথাটার অর্থ ঠিক বুঝিতে পারিলাম না। বলিলাম, ‘কি বলছেন ঠিক বুঝতে পারলাম না।’
তিনি বুঝাইয়া বলিলেন। বলিলেন, ‘মন্তর পড়ে’ আমার শরীরটা আপনি বেঁধে দিন। এবারে বুঝলেন তো? মাগী আমার পিছনে ধাওয়া করেছে আজ চার বছর—হ্যাঁ, ঠিক চার বছর। তা করুক। তা—সে করবেই। কিন্তু আমার অনিষ্ট যেন কিছু না করতে পারে। ব্যস্, আর কিছু চাই না। এ উপকারটুকু আপনি আমার করুন দাদা, বামুনের ছেলে আমি, আপনার হাতে ধরছি।’
হাত দুইটা ধরিবার জন্য তিনি হাত বাড়াইলেন। বলিলাম, ‘বসুন, দিচ্ছি।’
লোকটা উন্মাদ হইলেও অভদ্র নয়। ঠকাইবার মতলব মাথায় আসিতেছিল। —যা পাই—দু’আনা চার আনা লইয়া মন্ত্রের মত বিড়-বিড় করিয়া যা মুখে আসে তাই বলিয়া দিই উহার গা বাঁধিয়া। কিন্তু মুখখানি তাহার এমনি করুণ যে, উহাকে ঠকাইয়া পয়সা লইতে আমার মত পাষণ্ডেরও আর প্রবৃত্তি হইল না।
যাইহোক, ব্যাপারটা কি—জানিবার কৌতূহল হইতেই একটা কাগজ-কলম লইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘আপনার নাম?’
নাম বলিতে তিনি একটুখানি ইতস্তত করিতেছেন দেখিলাম। বলিলাম, ‘বলুন!’
তিনি আবার একবার তেমনি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমার মুখের পানে তাকাইলেন। বলিলেন, ‘আসল নামটাই বলি। না বললে হয়ত মন্তরটা ঠিক খাটবে না। হ্যাঁ, তাতে আর কি হয়েছে? আপনি তো আর পুলিশের লোক ন’ন মশাই, আপনি গণৎকার। নিন লিখুন—আমার নাম শ্রীশ্রীপতি বন্দ্যোপাধ্যায়। পিতার নাম চাই? পিতার নাম?’
ঘাড় নাড়িয়া বলিলাম, ‘না।’
‘কিন্তু দাদা, আগেই বলে রাখি, আজ আমি আপনাকে দিতে কিছুই পারব না। তবে একটা চাকরির জোগাড়ে আছি, হয়ে যদি যায় তো তখন দেখবেন—পাওনা আপনার কড়ায়-গণ্ডায় শোধ করে দিয়ে যাব। আমি সেরকম লোক নই মশাই আমি ভদ্দর লোকের ছেলে।’
এই বলিয়া আবার তিনি একবার তাঁহার পিছনের দিকে ঘাড় ফিরাইয়া কি যেন তাকাইয়া দেখিলেন। তাহার পর আবার বলিতে লাগিলেন, ‘পয়সা-কড়ি একসময় আমার অনেক ছিল দাদা, কিন্তু সেই মাগীই আমায় একেবারে মূলে হা-ভাত করে দিয়ে গেছে। বুঝলেন? আজকে আমার এই দশা, ছেঁড়া কাপড়, এই ময়লা জামা, এই জুতো—দুবেলা পেট ভ’রে খেতে পাই না মশাই, দুঃখের কথা আর কি বলব আপনাকে, এই দেখুন।’
বলিয়া তিনি তাঁহার কোটের পকেটে হাত ডুবাইয়া তলার কাপড়টা পর্যন্ত টানিয়া তুলিয়া আনিলেন। দেখা গেল, পকেটে মাত্র একটি দিয়াশলাই ও একটুকরা পোড়া বিড়ি ছাড়া আর কিছুই নাই। কিন্তু দেখিলাম, চোখ দুইটা তখন তাঁহার ছল্ ছল্ করিতেছে। ভদ্রলোক কাঁদিয়া ফেলিয়াছেন।
টেবিলের ড্রয়ার টানিয়া একটি বিড়ি বাহির করিয়া তাঁহার হাতে দিলাম। বলিলাম, ‘খান্।’
.
কোঁচার খুঁটে তাড়াতাড়ি চোখ মুছিয়া বিড়িটি তাঁহার হাত পাতিয়া লইবার। সে কি আগ্রহ! মুখে কিছুই বলিতে পারিলেন না বটে, কিন্তু চোখ দেখিয়া বুঝিলাম তিনি মনে মনে আমায় অজস্র ধন্যবাদ দিতেছেন। বিড়িটি ধরাইয়া টানিতে টানিতে বলিলেন, ‘যাক্ ভগবান এদ্দিন পরে জুটিয়ে দিলেন দাদা, আমি বাঁচলাম। নইলে এমন ক’রে মানুষ আর কতদিন বাঁচে! দিন নেই রাত নেই—চব্বিশ ঘণ্টা আমার পিছনে লেগে আছে। কেন রে বাপু, যা হয়েছে, চুকে-বুকে গেছে, তার জন্যে আবার মরে ভূত হয়েও তুই আমার পিছনে লেগে কি করবি বল তো? মেরে ফেলবি, এই ত মতলব? তো আমি বুঝতে পেরেছি। তা—মার বাবা মার, মেরেই ফ্যাল। মরেই তো আছি, এর চেয়ে বেশি আর কি করবি বল।’
বলিতে বলিতে হঠাৎ তাঁহার গা বাঁধিবার কথাটা মনে পরিয়া গেল! বলিলেন, ‘কই দিন দাদা, গাটা আগে আমার বেঁধেই দিন না!’
বিধাতার রাজ্যে মানুষের জীবনকে অবলম্বন করিয়া কত রকমের কত বিচিত্র কাহিনিই না গড়িয়ে ওঠে! শ্রীপতি বলিয়া এই যে অর্ধ উন্মাদ জীবটি আজ আমার কাছে আসিয়া জুটিয়াছেন তাঁহার কথাবার্তা শুনিয়া মনে হইল, তাঁহারও জীবনে এমনি একটি রহস্যময় কাহিনি হয়ত গড়িয়া উঠিয়াছে। জানিবার কৌতূহল বহুক্ষণ হইতেই হইতেছিল, এইবার সরাসরি বলিয়া বসিলাম, ‘কিন্তু কি হয়েছে আগাগোড়া সব খুলে আমায় বলতে হবে শ্রীপতিবাবু। তা যদি না বলেন ত আমার মন্ত্রে হয়ত কোনও কাজ করবে না।’
শ্রীপতি কিয়ৎক্ষণ মাথা হেঁট করিয়া বসিয়া রহিলেন, তাহার পর ধীরে ধীরে চোখ তুলিয়া বলিলেন, আগাগোড়া সব বলতে হবে? তা—তা আমি পারি বলতে, কিন্তু কই আমার পৈতে ছুঁয়ে দিব্যি করে বলুন দেখি, কাউকে আপনি বলবেন না।’
আমিও ব্রাহ্মণ। পৈতা আমারও ছিল। অতখানি কষ্ট স্বীকার করিয়া উঠিয়া গিয়া তাঁহার সেই মসীবর্ণ যজ্ঞোপবীত স্পর্শ করিয়া শপথ করিতে হইল না। নিজেরটাই বাহির করিয়া বলিলাম, ‘এই দেখুন, পৈতে ছুঁয়েই আমি শপথ করছি—কাউকে কিছু বলব না।’
তখন তিনি তাঁহার চেয়ারটাকে টানিয়া টানিয়া একেবারে আমার গা ঘেঁষিয়া আসিয়া বসিলেন এবং চুপি চুপি বলিলেন, ‘তবে শুনুন! আপনার লোকজন কেউ এসে পড়বে না তো?’
কে-ই বা আসিবে? ঘাড় নাড়িয়া বলিলাম, ‘না, আপনি নির্ভয়ে বলতে পারেন।’
নির্ভয়ে কি সভয়ে ঠিক বুঝিলাম না, তিনি তাঁহার জীবনের গল্প আমায় বলিলেন। আদ্যোপান্ত মন দিয়া শুনিবার পর সত্যই তাঁহার জন্য বেদনা বোধ করিলাম। মন্ত্রের মত বিড় বিড় করিয়া যা খুশি তাই আওড়াইয়া গিয়া তাঁহার গা বাঁধিয়া দিলাম। সান্ত্বনা দিয়া বলিলাম, ‘ব্যস। আর ভয় নাই, আপনার কোনও অমঙ্গল অনিষ্ট করা দূরে থাক, সে প্রেতাত্মা ভয়ে আর আপনার ছায়াও মাড়াবে না।
শ্রীপতি অত্যন্ত সন্তুষ্ট হইয়া আমায় ধন্যবাদ দিয়া নমস্কার করিয়া এদিক-ওদিক ঘন ঘন তাকাইতে তাকাইতে ধীরে ধীরে বাহির হইয়া যাইতেছিলেন, কি ভাবিয়া হঠাৎ বলিয়া বসিলাম, ‘আবার আসবেন তো দয়া করে? কেমন থাকেন আমায় জানিয়ে যাবেন যেন।
ঘাড় নাড়িয়া শ্রীপতি বলিলেন, ‘আসব।’
তাহার পর সেই যে সে অদ্ভুত ব্যক্তিটি আমার চোখের সুমুখ হইতে অন্তর্হিত হইয়া গেলেন, কেমন আছেন বলিবার জন্য কোনদিনই তিনি আর ফিরিয়া আসেন নাই। কিন্তু আমার হৃদয়ের পটে তাঁহার সেই বিষণ্ণ করুণ মূর্তিটি এমনভাবে অঙ্কিত হইয়া গেছে যে, আজ সুদীর্ঘ দশ বৎসর পরেও একাকী বসিয়া বসিয়া সেই তাহারই কথা ভাবিতেছি। ভাবিতেছি, মিথ্যা চাতুরি অবলম্বন করিয়া মন্ত্রের নামে যা তা’ বলিয়া তাঁহার গা বাঁধিয়া দেওয়া আমার উচিত হইয়াছিল কি না। উচিত না হোক্, গর্হিত কিছু হয় নাই। যে-নারীকে আমরা দেবীর আসনে বসাইয়া চিরকাল পূজা করিয়া আসিতেছি তাহাদেরই জাতের একজনের অমানুষিক নৃশংসতায় জীবন যাহার জ্বলিয়া পুড়িয়া খাক্ হইয়া গেছে, তাঁহাকে যদি ক্ষণিকের সান্ত্বনা দিবার জন্য আমি একটুখানি মিথ্যাচার অবলম্বন করিয়াই থাকি তো বিধাতা হয় তো আমার সে অপরাধ মার্জনা করিবেন। আজ সেই দুর্ভাগ্যদগ্ধ নিতান্ত অসহায় নিরবলম্ব বিকৃতমস্তিষ্ক সে অর্ধ উন্মাদ শ্রীপতির কোনও সংবাদই আমি জানি না। তাহার সে দুর্বহ জীবনভার এখনও সে ঠিক তেমনি করিয়াই বহন করিতেছে কি না কে জানে। কিম্বা হয়ত সুদীর্ঘ চারি বৎসর ধরিয়া যে প্রেতিনী তাহার পশ্চাদ্ধাবন করিতেছিল শেষ পর্যন্ত তাহারই করুণায় আত্মসমর্পণ করিল—তাই বা কে বলিতে পারে!
যাহাই করুক, আজ আমি তাহারই সেই বৈচিত্র্যপূর্ণ রহস্যময় প্রবঞ্চিত জীবনের সকরুণ কাহিনি লিপিবদ্ধ করিতে বসিয়াছি। জানি না শ্রীপতির উপর কোনও অবিচার করিতেছি কি না। যদি করিয়াই থাকি, যেখানেই থাকুন, আশা করি তিনি আমায় ক্ষমা করিবেন।
শ্রীপতিকে যখন আমরা দেখিলাম তখন তাহার জরাজীর্ণ শেষ অবস্থা। কিন্তু যে-সময়ের কথা বলিতেছি তখন শ্রীপতিবাবু—যৌবনমদগর্বিত জনৈক ধনীসত্তান, কলিকাতা শহরের উপর নিজের বাড়ি, ব্যাঙ্কে প্রচুর অর্থ, অথচ খাওয়াইয়া পরাইয়া খরচ যোগাইবার মত আত্মীয়-পোষ্য কেহ কোথাও নাই, নিজে আর তাঁহার পরমাসুন্দরী যুবতী স্ত্রী—বাসন্তী। স্ত্রীকে ভালবাসিয়া স্ত্রীর ভালবাসা পাইয়া পরমানন্দে তখন তাঁহার দিন কাটিতেছে।
একদা এক প্রভাতবেলার কোনও এক বন্ধুর অনুরোধে বন্দুক লইয়া তিনি দূরের একটা গ্রামে শিকার করিতে বাহির হইলেন। কথা রহিল সন্ধ্যায় আবার কলিকাতায় ফিরিয়া আসিবেন।
বাসন্তী বলিল, ‘দেখ, আসতে ভুলো না যেন। আমি একা থাকব।’
শ্রীপতি তাহাকে কাছে টানিয়া আদর করিয়া শপথ করিলেন, তিনি নিশচয়ই ফিরিবে।
গ্রামের চারিদিকে ঘুরিয়া ঘুরিয়া গোটাকয়েক পাখি শিকার করিয়া গ্রামে যখন তাঁহারা ফিরিলেন তখন সূর্যাস্ত হইয়াছে।
শ্রীপতি বলিলেন, ‘আমার বাড়ি ফিরতে হবে।’
বন্ধু জেদ ধরিয়া বসিল, তা হয় না। যে পাখিগুলা তাহারা মারিয়াছে এইখানেই সেগুলা রান্না করিয়া খাইয়া যাইতে হইবে।
শেষ পর্যন্ত তাহাই স্থির হইল। কলিকাতা যাইবার ট্রেনের অভাব নাই। রাত্রি এগারোটা পর্যন্ত ট্রেন। যখন খুশি সে যাইতে পারে।
পাখিগুলা বাড়ির ভিতর মেয়েদের কাছে পাঠাইয়া দেওয়া হইল। রান্না করিতে আর কতক্ষণই বা লাগে! ট্রেনের এখনও অনেক দেরি। উঠাউঠি একটার পর একটা অনেকগুলা ট্রেন।
কিন্তু ততক্ষণ সময়ই বা তাহাদের কাটে কেমন করিয়া!
গ্রামেও কয়েকজন সঙ্গী জুটিয়া গেল। ‘আসুন, ততক্ষণ তাস খেলা যাক।
ছোট্ট একটি খড়ো বৈঠকখানা ঘরের মধ্যে তাসখেলা চলিতে লাগিল। দেখিতে দেখিতে সন্ধ্যা হইল, আলো জ্বলিল, ঘরের বাহিরে পল্লীগ্রামের নিস্তব্ধ অন্ধকার থম্থম্ করিতে লাগিল।
ঘরের দক্ষিণদিকের একটা জানালা ছিল বন্ধ। শ্রীপতি সেটা হাত দিয়া যেমনি খুলিতে যাইবে, ঘরের অন্যান্য কয়েকজন হাঁ হাঁ করিয়া নিষেধ করিয়া উঠিল—’খুলবেন না মশাই, ও জানালা খুলবেন না।
শ্রীপতি জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘কেন?’
‘কেন? তার অনেক ব্যাপার!—এই যে জানালার সুমুখে বড় দোতলা বাড়িটা দেখছেন, ওটা ভূতুড়ে বাড়ি। বছরের পর বছর ধরে অমনি পড়েই আছে। মালিক যিনি তিনি কলকাতায় বাস করছেন।’
‘তাতে কি?’
‘তাতে কী, একবার খুলেই দেখুন না! দিনে-দুপুরে চব্বিশ ঘণ্টা মশাই ওই বাড়িতে ভূত ঘুরে বেড়ায়, আমাদের নিজের চোখে দেখা। এই জানালাটা খুললে বাড়ির ভেতর পর্যন্ত দেখা যায় কিনা, তাই এই জানালাটার ওপর ভূতগুলোর ভারি রাগ। ওই তো খুলেছেন, ব্যস! বসুন ওই জানালার ধারে, দেখুন মজা।’
শ্রীপতি জোর করিয়াই জানালার ধারে বসিয়া রহিলেন।
কিয়ৎক্ষণ পরেই জানালার ওপর ঝড়াং করিয়া এক শব্দ! প্রকাণ্ড একটা ভাঙ্গা ইট জানালার গায়ে আসিয়া লাগিল এবং লাগিবামাত্র ইটটা ভাঙ্গিয়া গুঁড়া হইয়া চারিদিকে ছড়াইয়া পড়িল।
‘দেখলেন তো? এবার দিন বন্ধ করে।’
জানলাটা শ্রীপতি বন্ধ করিয়া দিয়াই সেখান হইতে উঠিয়া দাঁড়াইলেন।
‘উঠলেন যে?’
ঘরের কোণে ঠেস দেওয়া তাঁহার দো-নলা বন্দুকটা তুলিয়া লইয়া শ্রীপতি বলিলেন, ‘আপনারা বসুন এইখানে, অপেক্ষা করুন। বন্দুকের গুলির আওয়াজ যদি শুনতে পান তাহলে আপনারা সকলে মিলে একসঙ্গে ওই বাড়িতে গিয়ে ঢুকবেন, আর যদি কোনও আওয়াজ না হয়, যাবেন না। জানবেন আমি ফিরে আসছি।’
এই বলিয়া এক হাতে টর্চ ও এক হাতে বন্দুক লইয়া সাহেবী পোশাক পরা শ্রীপতি তৎক্ষণাৎ বাড়ি হইতে বাহির হইয়া গেলেন! সমবেত দু-একজন শ্রীপতিকে নিষেধ করিল, কিন্তু শ্রীপতি তাহাদের কোনও কথাই শুনিলেন না।
প্রকাণ্ড বাড়ি। ফটক পার হইয়া শ্রীপতি সেই বাড়ির মধ্যে ঢুকিলেন। চারিদিকে ঘোর অন্ধকার। কোথায় সিঁড়ি, কোথায় পথ, কিছুই ঠাহর করিবার উপায় নাই। হাতের টর্চ জ্বালিয়া শ্রীপতি আগাইয়া গেলেন। সিঁড়ি ধরিয়া উপরে উঠিলেন। দেওয়ালের চুণ খসিয়া পড়িযাছে। পুরাতন বাড়ি, ঘরগুলি ধুলায় বালিতে বোঝাই, চারিদিক অপরিচ্ছন্ন। কোথাও কিছু নাই। ভূত বলিয়া কোনও বস্তু পৃথিবীতে থাকিতে পারে না ইহাই শ্রীপতির দৃঢ় বিশ্বাস। প্রত্যেকটি ঘর তন্ন তন্ন করিয়া খুঁজিয়া শ্রীপতি আবার নীচে নামিয়া আসিতেছিলেন, পাশেই একটা ঘরের দরজায় হঠাৎ খুট করিয়া একটা আওয়াজ হইল। তাড়াতাড়ি বন্দুকটাকে ঠিক করিয়া ধরিয়া তিনি সেইদিকে অগ্রসর হইলেন। দেখিলেন, কে একটা লোক যেন সিঁড়ির উপর লাফাইয়া পড়িয়া ঊর্ধ্বশাসে পলায়ন করিল। ভূত নয়,—মানুষ। শ্রীপতি তাহাকে গুলি করিতে পারিতেন কিন্তু মানুষ দেখিয়া গুলি ছুঁড়িতে গিয়া হাত তাঁহার কাঁপিয়া গেল। গুলি আর ছুঁড়িলেন না। তেমনি দৃঢ় মুষ্টিতে বন্দুকটাকে বগলে চাপিয়া এক হাতে টর্চ জ্বালিয়া তিনি সেই ঘরের মধ্যে ঢুকিলেন। কিন্তু ঘরে ঢুকিয়াই টর্চের আলোয় তাঁহার চোখের সুমুখে যাহা দেখিলেন, তাহা যে দেখিবেন সে আশা অবশ্য তিনি করেন নাই। দেখিলেন, একটি নারীমূর্তি ভয়ে একেবারে কাঠ হইয়া গিয়া দেয়াল ঘেঁষিয়া চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া আছে। বন্দুক দেখাইয়া শ্রীপতি তাহার কাছে আগাইয়া গিয়া বলিলেন, ‘পালাবার চেষ্টা কোরো না, মরে যাবে।’
মেয়েটি পালাইবার চেষ্টা করিল না বটে, কিন্তু ভয়চকিত চক্ষে টর্চের আলোয় মুখ তুলিয়া সে একবার শ্রীপতির মুখের পানে তাকাইল। সর্বনাশ! এত রূপ! মেয়েটির চোখ মুখ স্বাস্থ্য যৌবন এবং অবয়ব দেখিয়া শ্রীপতির চোখ দুইটা যেন ঝলসিয়া গেল। এত সুন্দরী নারী জীবনে বোধহয় তিনি এই প্রথম দেখিলেন। মেয়েটি কিন্তু চুপ করিয়া রহিল না। হাত দুইটি বাড়াইয়া শ্রীপতির একখানি হাত চাপিয়া ধরিয়া বলিল, ‘আমায় বাঁচান। আমি—আমি- আর কিছু সে বলিতে পারিল না, থর থর করিয়া ঠোঁট দুইটি তাহার কাঁপিতে লাগিল।
শ্রীপতি জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘যে চলে গেল ও কে?’
মেয়েটি নীরবে তাহার মাথা নত করিল। সিঁথিতে সিঁদুর নাই। বোধ করি বিধবা।
শ্রীপতি বলিবার মত কোনও কথা খুঁজিয়া পাইতেছিলেন না। বলিলেন, ‘লোকটাকে তুমি ভালোবাসো, আর ও তোমায় এমনি একলা বিপদের মাঝে ফেলে দিয়ে পালাল?’
মেয়েটি অনুচ্চকণ্ঠে কহিল, ‘অনেক বললাম, কিছুতেই শুনলে না!’
‘তোমার বাড়ি কোথায়?’
মেয়েটি আঙুল বাড়াইয়া দেখাইয়া দিয়া বলিল, ‘ওই পাশের বাড়ি।’
‘বাড়িতে কে কে আছে?’
‘দাদা আর বৌদিদি, আর কেউ নেই।’
‘এরপর তুমি কি করবে? আমি যদি সব গোলমাল করে দিই।’
‘মরব। মরা ছাড়া আমার আর কি উপায় আছে বলুন!’
‘মরবে কেন? যাকে তুমি ভালোবাসো, তাকে নিয়ে কোনও দূর দেশে চলে গেলেও তো পার।’
তাই তো চাই! কিন্তু ও যেতে কিছুতেই চায় না। এখানে আমার কিছু ভাল লাগে না।’
শ্রীপতির মাথার ভিতরটা হঠাৎ কেমন যেন গোলমাল হইয়া গেল। জিজ্ঞাসা করিলেন, তুমি যাবে? আমি যদি তোমায় এক্ষুনি নিয়ে যেতে চাই, তুমি যাবে আমার সঙ্গে?
মেয়েটি ঠোটের ফাঁকে স্নান একটুখানি হাসিল। বলিল, ‘এক্ষুনি চলুন। কিন্তু কেউ যদি জানতে পারে?’
‘কেউ জানবে না, চল। আমি তোমায় কলকাতা নিয়ে যাব।’ বলিয়াই শ্রীপতি তাহার একখানি হাত চাপিয়া ধরিয়া বলিল, ‘এসো।’
মেয়েটি বিনা বাক্যব্যয়ে তাঁহার সঙ্গে চলিল।
সিঁড়ির কাছে আসিয়া শ্রীপতি জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘তোমার নাম? কি বলে ডাকব?’
‘আমার ডাক নাম টুনু। ভাল নাম—কিশোরী।’
তাহার পর অতি সন্তর্পণে দুজনে সিঁড়ি দিয়া নীচে নামিয়া টর্চ নিবাইয়া অন্ধকার পথে গিয়া দাঁড়াইল। টুনু বলিল, ‘স্টেশনে যাবেন তো?’
শ্রীপতি বলিল, ‘হ্যাঁ, এক্ষুনি একটা ট্রেন আসবে।’
টুনু বলিল, ‘তাহলে এই পথে আসুন। ও পথে গেলে লোকজন দেখতে পাবে।’
দুজনে একটা নুড়ি পথ দিয়া যথাসম্ভব দ্রুতগতিতে গ্রামের বাহিরে চলিয়া গেল। ধানের মাঠের আলি রাস্তা দিয়া বাঁকা পথ ছাড়িয়া সোজা পথ ধরিয়া তাহাদের স্টেশনে পৌঁছিতে দেরি হইল না। ছোট স্টেশন টিম্ টিম্ করিয়া গোটাকতক কেরোসিনের আলো জ্বলিতেছে। লোকজন একরকম নাই বলিলেই হয়। প্ল্যাটফর্মের একপাশে অন্ধকারে জড়সড় হইয়া টুনু বসিয়া রহিল। শ্রীপতির আসা-যাওয়ার টিকিট ছিল। টুনুর জন্য একখানি টিকিট তিনি কাটিয়া আনিলেন।
দেখিতে দেখিতে ট্রেন আসিয়া দাঁড়াইল। টুনুর হাত ধরিয়া শ্রীপতি ট্রেনে চড়িলেন। কামরায় দুজনমাত্র লোক বসিয়া আছে।
বেঞ্চির একপাশে শ্রীপতির কাছ হইতে টুনু একটুখানি দূরে বসিতেছিল, শ্ৰীপতি তাঁহার হাতের বন্দুক ও টর্চটি নামাইয়া রাখিয়া বলিলেন, ‘সরে এস।’
সলজ্জ সঙ্কোচে তেমনি জড়োসড়ো হইয়া টুনু একেবারে তাঁহার গা ঘেঁষিয়া আসিয়া বসিল। শ্রীপতি বলিলেন, ‘তোমার কি ভয় করছে নাকি?’
ঘাড় নাড়িয়া টুনু ঈষৎ হাসিয়া বলিল, ‘না।’
শ্রীপতিও হাসিয়া চুপি চুপি বলিলেন, ‘তোমার যদি কলকাতার মত শহরে নিয়ে গিয়ে আমি পথে বসিয়ে দিই?’
টুনু তাঁহার হাতখানি হাতের মধ্যে লইয়া আঙুলগুলি নাড়াচাড়া করিতে করিতে বলিল, ‘বেশ তো, আমার যা অদৃষ্টে আছে তাই হবে।’
শ্রীপতি জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘আচ্ছা, তোমার দাদা পুলিশে যদি খবর দেয়? আমি আর তুমি একসঙ্গে একই দিনে দুজনে গ্রাম ছেড়ে চলে এলাম। পুলিশের ধরতে বিশেষ কষ্ট হবে না।’
টুনু ঠোট উল্টাইয়া মুখে একপ্রকার শব্দ করিয়া বলিল, ‘দাদার বয়ে গেছে পুলিশে খবর দিতে! কিচ্ছু করবে না দেখবেন। আর যদি ধরাই পড়ি তো বলব আমি আপনার সঙ্গে ইচ্ছে করে এসেছি।’
শ্রীপতি তাহার মুখের পানে একদৃষ্টে তাকাইয়া ছিলেন। টুনু জিজ্ঞাসা করিল, ‘কি দেখছেন অমন করে?’
‘দেখছি তুমি সত্যি ভারি সুন্দরী। আমার খুব আনন্দ হচ্ছে।’
টুনু মুখ নামাইয়া কিয়ৎক্ষণ চুপ করিয়া রহিল। তাহার পর হঠাৎ একসময় মুখ তুলিয়া জিজ্ঞাসা করিল, ‘আপনি বুঝি অনিল দাদাদের বাড়ি এসেছিলেন?’
‘হ্যাঁ, অনিল এসেছিল শিকার করতে।’
টুনু আবার হাসিল। বলিল, ‘শিকার তো করে নিয়ে চললেন, কিন্তু এ শিকার আপনি রাখবেন কোথায় শুনি?’
শ্রীপতি বলিলেন, ‘তাই ভাবছি। আজ রাত্রের মত কোনও একটা হোটেলে কাটিয়ে কাল তোমার জন্যে আলাদা একটা বাড়ি ভাড়া করে তোমার থাকবার ব্যবস্থা করে দেব।’
বাড়িতে আপনার স্ত্রী আছেন তো? ছেলেমেয়ে?’
স্ত্রী আছেন, কিন্তু ছেলেমেয়ে নেই।’
টুনু আবার তাঁহার হাতখানি চাপিয়া ধরিয়া বলিল, ‘আমার জন্যে কেন আপনি এত কষ্ট করছেন বলুন ত? ভূত ধরতে এসেছিলেন, ফিরে গিয়ে বললেই হত—ভূতের দেখা পেলাম না।’
শ্রীপতি হাসিলেন। বলিলেন, যুগে যুগে মানুষ যার জন্যে বহু কষ্ট স্বীকার করে এসেছে আমিও করলাম শুধু তারই জন্যে কিশোরী! তবে তোমার মত সুন্দরীকে পেতে হলে যে কষ্ট মানুষের সত্যিই পাওয়া উচিত, আমি তো তার কিছুই পেলাম না, সেজন্যে নিজেকে তো আমি সৌভাগ্যবান ভাবছি।’
কিশোরী আবার একটুখানি হাসিল।
.
কিশোরীকে লইয়া আসার জন্য যতখানা গোলমাল হইবে ভাবিয়াছিলেন, শ্রীপতি দেখিলেন তাহার কিছুই হইল না। একটা হোটেলে গিয়া স্বামী-স্ত্রী বলিয়া পরিচয় দিয়া সে-রাত্রি তাঁহারা দু’জনে এক সঙ্গেই কাটাইলেন। কিশোরী বড় চমৎকার মেয়ে। শ্রীপতি ভাবিলেন, বিবাহ—যদি না করিতেন তো কি সুখেরই না হইত! দুজনে স্বামী-স্ত্রীর মত একসঙ্গে নিজের বাড়িতে থাকিয়াই চিরজীবন কাটাইয়া দিতে পারিতেন।
যাইহোক, পরদিন প্রাতে কিশোরীকে হোটেলে রাখিয়াই তিনি বাড়ি গেলেন। তাহার পর, বেশ পরিবর্তন করিয়া কিশোরীর একটা ব্যবস্থা করিবার জন্য তিনি আবার বাড়ি হইতে তৎক্ষণাৎ বাহির হইয়া পড়িলেন। প্রথমেই ডাকঘরে গিয়া বন্ধু অনিলকে একখানি টেলিগ্রাম করিলেন—শীঘ্র আসিয়া তুমি আমার সঙ্গে দেখা কর। যে বিস্ময়কর ঘটনা কাল রাত্রিতে ঘটিয়াছে সেরূপ ঘটনা জীবনে কখনও ঘটিবে বলিয়া আমি কোনওদিনই ভাবিতে পারি নাই।’
হাতে টাকা থাকিলে সবই সম্ভব। সেইদিনই একখানি আলাদা বাড়ি ভাড়া লইয়া যাবতীয় আসবাবপত্র কিনিয়া বাড়ি সাজাইয়া কিশোরীকে তিনি হোটেল হইতে সেইখানে লইয়া গেলেন।
বৈকালে বাড়ি ফিরিয়া শুনিলেন, অনিলবাবু একবার দেখা করিতে আসিয়া ফিরিয়া গিয়াছেন, আবার আসিবেন। কিয়ৎক্ষণ অপেক্ষা করিতেই বন্ধু আসিলেন। আসিয়াই বলিলেন, কি ব্যাপার বল ত? আমরা ত সারারাত ভেবেই অস্থির।’
কি বলিবেন শ্রীপতি আগেই ঠিক করিয়া রাখিয়াছিলেন। বলিলেন, ‘কাল হয় তো মরেই যেতাম ভাই! কোনরকমে যে বেঁচে গেছি এই যথেষ্ট। তোমাদের সব বলেকয়ে তো গেলাম সেখানে। টর্চের আলোয় পথ দেখে দোতালায় উঠলাম। হঠাৎ শুনি—দোতালার একটা ঘরের মধ্যে কেমন যেন একটা শব্দ হচ্ছে। দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকতেই মনে হল যেন একসঙ্গে অনেক লোক হো হো করে হেসে উঠল। তোমরা সে হাসি শুনতে পেয়েছিলে কি না জানি না। বিকটাকার দৈত্যের মত একটা মানুষ — মানুষ কি অন্য কিছু ঠাওর করতে পারলাম না—আমার দিকে এগিয়ে এল। বন্দুক আমার হাতেই ছিল, যেমনি গুলি ছুঁড়তে যাব, ব্যস, চারদিক থেকে কারা যেন একসঙ্গে আমায় জড়িয়ে ধরলো। তারপর কি যে হয়েছে কিছু আমার মনে নেই। হয়ত অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলাম। জ্ঞান যখন হল তখন দেখি আমি একটা ট্রেনের কামরায় শুয়ে আছি। ট্রেনখানা চলছে। উঠে বসলাম। দেখি, বন্দুক আর টর্চ দুইটি আমার পাশে নামানো। গাড়ির এককোণে এক ভদ্রলোক মুড়িসুড়ি দিয়ে বসেছিলেন। তাঁকে কিছু জিজ্ঞাসা করতে আমার ভয় করছিল। অনেকক্ষণ পরে জিজ্ঞেস করলাম, ট্রেনখানা কোথায় যাচ্ছে মশাই? তিনি বলিলেন, শিয়ালদা। ব্যস্, শিয়ালদায় নেমে ট্যাক্সি করে বাড়ি এলাম। সকালেই তোমায় টেলিগ্রাম করেছি। তারপর এই তো দেখছ স্বয়ং বসে আছি।’
অনিলবাবু অবাক হইয়া কিয়ৎক্ষণ বসিয়া রহিলেন। তাহার পর মুখ তুলিয়া বলিলেন, ‘কিন্তু আর একটা ভারি মজার ব্যাপার ঘটে গেছে ওখানে। ওই বাড়িটার পাশেই এক ভদ্রলোকের বাড়ি। কিশোরী বলে তার এক বিধবা বোন ছিল। ভারি সুন্দরী মেয়ে। তাকেও কাল রাত্রি থেকে পাওয়া যাচ্ছে না।’
শ্রীপতি যেন আকাশ হইতে পড়িলেন! বলিলেন, ‘সর্বনাশ! পাওয়াই যাচ্ছে না? দ্যাখো আবার ভূতে তাকে মেরেটেরে ফেললো নাকি!’
অনিলবাবু বলিলেন, ‘ভূতের কাণ্ড হয়ত নাও হতে পারে। মেয়েটার স্বভাব চরিত্র তেমন ভাল ছিল না। পালিয়েও যেতে পারে।’
‘ও।’ বলিয়া নিতান্ত উদাসীনের মত কথাটা শ্রীপতি তাচ্ছিল্যভরে উড়াইয়া দিয়া অন্য কথা পাড়িলেন।
তাহার পর সচরাচর যাহা ঘটিয়া থাকে তাহাই ঘটিল। কিশোরীর প্রেমে মশগুল হইয়া শ্রীপতি তাঁহার স্ত্রীকে অবহেলা করিতে শুরু করিলেন।
কিশোরীর রূপ একেবারে বদলাইয়া গেল। একে সুন্দরী তার আবার হীরায়-জহরতে, সোনায়-দানায় তাহার সর্বাঙ্গ ভরিয়া উঠিল। তাহার মনের মত নিত্য নূতন নূতন সাজপোশাক আসিতে লাগিল! কিশোরীর বাড়িতে স্ফূর্তির আনন্দের হাট বসিয়া গেল। কিশোরীকে একটু একটু মদ্যপান করাইতে শিখাইলেন। এবং তাহার ফল হইল এই যে, একটি বৎসর ঘুরিতে না ঘুরিতেই দেখা গেল, শ্রীপতির সঞ্চিত অর্থ সবই প্রায় শেষ হইয়া গিয়াছে। এইবার তাঁহার বাড়িখানি বিক্রি করিবার জন্য খরিদ্দার খুঁজিয়া বেড়াইতেছেন।
স্ত্রী বাসন্তীর সঙ্গে ঝগড়াঝাঁটি শ্রীপতির অনেকদিন হইতেই হইতেছিল, এইবার তাহা বড় ভীষণ রূপ ধারণ করিল। বাসন্তী নিতান্ত নিরীহ মেয়ে। স্বামীকে কোনওদিনই সহজে কিছু বলিতে চায় না, কিন্তু কিছুদিন হইতে অত্যাচার তাহার উপর এত বেশি হইতেছিল যে, তাহারও এবার মুখ ফুটিয়াছে। মাসের মধ্যে প্রায় পনর কুড়ি দিন স্বামী তাহার বাড়িতে রাত্রিবাস করে না। রাত্রিবাস যেদিন করে সেদিন ট্যাক্সি চড়িয়া মত্ত অবস্থায় বাড়ি যখন আসে, তখন প্রায় দুইটা বাজিয়া যায়। সেই অত রাত্রি পর্যন্ত বেচারা বাসন্তী নিজে না খাইয়া স্বামীর জন্য খাবার চাপা দিয়া অধীর আগ্রহে আধা জাগ্ৰত আধা-ঘুমন্ত অবস্থায় জানালার কাছটিতে চুপ করিয়া বসিয়া থাকে। বাড়িতে ঠিকা-ঝি একজন কাজ করিয়া দিয়া চলিয়া যায়। চাকর একটা ছিল, তাহাকে ছাড়াইয়া দেওয়া হইয়াছে। দরজার কড়া নাড়িলেই বাসন্তীকে নিজে গিয়া দরজা খুলিয়া দিতে হইবে, কাজেই তাহার জাগিয়া থাকা ছাড়া উপায় কি!
বাসন্তী প্রায়ই আজকাল অসুখে ভোগে। শরীর তাহার অত্যন্ত শীর্ণ হইয়া গিয়াছে। মনের অবস্থাও ভাল নয়। কাজেই শ্রীপতিকে যেদিন সে মনের দুঃখে কোন কথা বলতে চায় সেদিন হয়ত তাহা একটুখানি অতিরিক্ত রকমের রূঢ়ই হইয়া পড়ে; কিম্বা হয়ত নিজেই কাঁদিয়া ভাসায়। ইহার জন্য তাহাকে দোষ দেওয়া বৃথা। কিন্তু শ্রীপতি বলেন, ‘তুমি ছোটলোক। স্বামীকে ভক্তি করাই হিন্দু নারীর একমাত্র কর্তব্য, তা সে যে অবস্থাতেই হোক না। কিন্তু তোমার মধ্যে সে ভক্তিটুকুও নেই।’
বাসন্তী হয়ত রাগের মাথায় জবাব দিয়া বসে, তা না থাক। তোমার ওপর ভক্তি আমার কম ছিল না। সেটুকু আজকাল তুমি নিজেই খুইয়েছ।’
শ্রীপতি বলেন, ‘তাহলে আজকাল তুমি আমায় ঘৃণা কর?’
বাসন্তী বলে, ‘তা করি বৈ-কি!’
শ্রীপতির মাথায় রক্ত তৎক্ষণাৎ গরম হইয়া ওঠে। বলেন, ‘তবে এই আবার আমি চললাম বাড়ি থেকে বেরিয়ে। তুমি মর এইখানে পড়ে পড়ে।’
বাসন্তী নিরুপায়। ভয়ে তাহার বুকের ভিতরটা দুর দুর করিতে থাকে। স্বামীকে বিশ্বাস নাই। আবার হয়ত চলিয়া যাইতেও পারেন। মান অভিমান সমস্তই বিসর্জন দিয়া ছুটিয়া সে পথরোধ করিয়া দাঁড়ায়। বলে, ‘যেয়ো না, তোমার পায়ে পড়ি।’
শ্রীপতি মদ্যপান করিয়াছিলেন। বলিলেন, ‘তাই দেব ভাবছি।’
বাসন্তী বলিল, ‘দিতে আর বাকি রাখলে কোথায়? আমার মা নেই বাবা নেই, আত্মীয়স্বজন কেউ কোথাও নেই, কোথায় যে দাঁড়াব তার ঠাই নেই, আর তুমি কি না ফূর্তি করবার জন্যে বাড়িখানিও দিলে বিক্রি করে?’
শ্রীপতি বলিলেন, ‘ও, আমি মরবার পর তুমি কি করবে সেই কথাই বোধ হয় তুমি ভাব দিনরাত? কেমন?’
‘তা আমায় ভাবতে হয় বইকি!’
‘এই বুঝি তোমার ভালবাসা?’
বাসন্তী রাগিয়া বলিল, ‘তা যদি বোঝ তো তাই। ভাল আমি তোমায় বাসি না। হলো তো?’
এমনি করিয়া কথায় কথায় সেদিন আবার তাহাদের বেশ খানিকটা ঝগড়া হইয়া গেল। শ্রীপতি রাগ করিয়া বাড়ি হইতে বাহির হইয়া গেলেন।
যাইবেন আর কোথায়? গেলেন কিশোরীর বাড়ি।
কিশোরী বলিল, ‘আর পারি না বাপু! তার চেয়ে এক কাজ কর না, হয় ওকে নয় আমাকে, দুজনের মধ্যে একজনকে তুমি মেরে ফ্যালো, জ্বালাজঞ্জাল চুকে যাক।’
শ্রীপতি বলিলেন, ‘তোমায় কেন মারব কিশোরী, মারতে হয় ওকেই মারব। কিন্তু কি করে মারি বল তো?’
কিশোরী হাসিল। বলিল, ‘কেমন করে মারবে? কেন, মেয়েদের মারতে দেরি হয় নাকি? ধর না আমার গলাটা টিপে। দ্যাখো না, এক্ষুনি মরে যাব।’
শ্রীপতি বলিয়া উঠিলেন, ‘গলা টিপে মেরে ফেলব? যদি না মরে?’
‘বেশ তো। গঙ্গায় নিয়ে যাও, দুজনে সন্ধেবেলা নৌকোয় চড়ে হাওয়া খেতে খেতে ধীরে ধীরে একটিবার শুধু—’
বলিয়া শ্রীপতিকে দুহাত দিয়া ঠেলিয়া দিয়া হো হো করিয়া কিশোরী হাসিতে লাগিল। শ্রীপতি সে-হাসিতে যোগ দিলেন না। মনে মনে ইহাই তিনি স্থির সঙ্কল্প করিলেন। উহার হাত হইতে নিষ্কৃতি পাইতে হইলে ইহাই সহজ উপায়। কিশোরী বুদ্ধিমতী। সে ঠিক কথাই বলিয়াছে।
.
বাসন্তীর সঙ্গে শ্রীপতি আর ঝগড়াঝাটি করেন না। বাসন্তী যদি-বা মাঝে মাঝে দু একটা কটু কথা বলে ত শ্রীপতি তাহা নীরবে সহ্য করেন।
বাসন্তীর স্বাস্থ্য সম্বন্ধে শ্রীপতি আজকাল বড়ই উদ্বিগ্ন হইয়া পড়িয়াছেন। দু’দিন দু শিশি ঔষধ কিনিয়া আনিয়া তাহাকে তিনি খাইতে দিলেন।
বাসন্তী অবাক!
বলে, ‘কেন গো, তোমার সেই তিনি কি মরেছেন নাকি? আমার আজকাল এত যত্ন যে?’
শ্রীপতি বলেন, ‘না, ভেবে দেখলাম, তোমার ওপর সত্যিই আমি অবিচার করেছি, আর করব না।’
বাসন্তীর আনন্দের আর সীমা নাই। স্বামীর মতি পরিবর্তন হইয়াছে। আর তাহার কিছুই চাই না। বলে, ‘ওষুধ না খেলেও শরীর আমার এবার দেখ এমনিতেই সেরে যাবে।’
শ্রীপতি কিন্তু তাহা চান না। পরের দিন একটা ডাক্তার ডাকিয়া আনেন।
ডাক্তার নাকি বলিয়াছেন, গঙ্গার হাওয়ায় বাসন্তীর শরীর ভাল হইবে। সুতরাং বাসন্তীকে রোজ একটু করিয়া গঙ্গার হাওয়া খাওয়ানো প্রয়োজন।
বাসন্তী বলে, ‘তা আর কেমন করে হবে? কে আমায় গঙ্গায় হাওয়া খাইয়ে আনবে? তোমার সময় কোথায়?’
শ্রীপতি বলেন, ‘তা সময় একটু করে নিতে হবে বই কি!’
বাসন্তী বলে, ‘তাহলে তো সময় আমার ফিরেছে বলতে হবে।’
.
তাহার পর একদিন দেখা গেল, বাসন্তীকে সঙ্গে লইয়া শ্রীপতি সত্যই বাহির হইয়াছেন। পায়ে হাঁটিয়া হাঁটিয়া দুজনে তাঁহারা গঙ্গার তীরে গিয়া দাঁড়াইলেন। সূর্যাস্তের পর চারিদিকে তখন ধীরে ধীরে অন্ধকার নামিতেছে। গঙ্গার ওপারে কি আছে কিছুই ভাল দেখা যায় না। কিন্তু ঘাটে একটিও খেয়া নৌকা নাই, কোথায় গেলে নৌকা পাওয়া যায়, কি বলিয়াই বা তাহাদের ডাকিতে হয় কিছুই তিনি জানেন না। এই চিন্তার সূত্র ধরিয়া পথ চলিতে চলিতে সহসা তাহার চোখের সুমুখে একটা ভয়াবহ কাল্পনিক দৃশ্য ভাসিয়া উঠিল। নীল নিস্তরঙ্গ অতল স্পর্শ গঙ্গার জল, তাহার উপর দিয়া একখানি মাত্র নৌকা ভাসিয়া চলিয়াছে। হঠাৎ ঝপ্ করিয়া একটা শব্দ, ভীষণ একটা আর্তনাদ এবং সঙ্গে সঙ্গে সব শেষ! শ্রীপতি শিহরিয়া উঠিলেন। তা হোক, কতক্ষণই বা লাগে। তাঁহাকে শক্ত হইতে হইবে। তাহা না হইলে এই দোটানা জীবন তাহার পক্ষে অসহ্য। আচ্ছা, আজ থাক, আর একদিন আসিলেই চলিবে। রাস্তার উপর এক বৃদ্ধকে দেখিয়া শ্রীপতি থমকিয়া দাঁড়াইয়া প্রশ্ন করিলেন, ‘নৌকো কোথায় পাওয়া যায় বলতে পারেন মশাই?’
বৃদ্ধ আঙুল বাড়াইয়া দূরের একটা ঘাট দেখাইয়া দিয়া বলিলেন, ‘ওই যে ওখানে যান, গেলেই দেখবেন বিস্তর নৌকা।’
কাল কিম্বা পরশু আসিলেই চলিবে। আজ তাঁহার মনের অবস্থা ভাল নয়। শ্রীপতি বলিলেন, ‘চল আজ বাড়ি ফেরা যাক। কিন্তু নৌকোয় না চড়লে গঙ্গার হাওয়া ঠিক পাওয়া যায় না।’
বাসন্তী বলিল, ‘নৌকোয় চড়তে আমার কিন্তু ভয় করে।’
অন্যমনস্কের মত শ্রীপতি কহিলেন, ‘তা করুক।’
.
আবার আর একদিন।
শ্রীপতি ডাকিলেন, ‘কিশোরী শোনো।’
কিশোরী কাছে আসিয়া দাঁড়াইল।
সন্ধে হতে আর দেরি নেই। এই ঠিক সময় আমি চললাম।’
কিশোরী সাবধান করিয়া দিল, কিন্তু দেখো যেন কেউ জানতে না পারে।’
জানবে আবার কে? নৌকো যখন গঙ্গার মাঝখানে গিয়ে পৌঁছবে, তখন ঝপ করে একসময় দেব ঠেলে। বাস, চুকে যাবে। তারপর হৈ-হৈ করে চেঁচিয়ে উঠব। বলব—পড়ে গেল।
কিশোরী বলিল, মাঝিরা কেউ যেন দেখতে না পায়।’
শ্রীপতি বলিলেন, ‘কেউ দেখবে না। আর দেখলেও ওরা গরীব মানুষ, দু-চার টাকা পেলেই সব চুপ হয়ে যাবে।’
কিশোরী বলিল, ‘পুলিশে যদি টের পায় তো টানাটানি করতে ছাড়বে না! বেফাস কারও মুখ দিয়ে কোনও কথা বেরিয়ে পড়লেই সর্বনাশ, আমাকেও তখন বাদ দেবে না।’
শ্রীপতি তাহাকে যথেষ্ট সাহস দিয়া নিশ্চিন্তে বসিয়া থাকিতে বলিয়া সেখান হইতে বাহির হইয়া গেলেন। প্রচুর মদ্যপান করিয়া তখন তিনি নেশায় একেবারে চুর হইয়া ___
পায়ে হাঁটিয়া নয়, ট্যাক্সি করিয়া বাসন্তীকে লইয়া তিনি গঙ্গার ধারে গিয়া হাজির হইলেন। অন্ধকারে জোনাকীর মত চারিদিকে তখন আলো জ্বলিয়াছে। ট্যাক্সি ছাড়িয়া দিয়া সেইদিনের সেই বৃদ্ধের নির্দেশমত বহু দূরের যে ঘাটে নৌকা পাওয়া যায় সেইখানে গিয়া একজন মাঝিকে ডাকিয়া বলিলেন, চলো, আমাদের একটুখানি ওপার থেকে বেড়িয়ে আনবে চল।’
দু-তিন জন মাঝি একসঙ্গে রাজি হইল। তাহাদের মধ্যে একজনকে ডাকিয়া শ্রীপতি বাসন্তীকে লইয়া নৌকোর পাটাতনের উপর গিয়া বসিলেন। নৌকা ছাড়িয়া দিল।
শ্রীপতি একটিবারের জন্যও বাসন্তীর মুখের পানে আজ আর তাকাইতে পারেন নাই! নিতান্ত উদাসীন অন্যমনস্কের মত বাসন্তীর দু-একটা কথার তিনি জবাব দিতেছিলেন মাত্র।
নৌকা যখন মাঝ দরিয়ায়, শ্রীপতির বুকের ভিতরটা তখন গুরগুর করিতেছে, হাত দুইটা থরথর করিয়া কাঁপিতেছে। তা কাঁপুক। শ্রীপতি বলিলেন, ‘এইখানে উঠে বোস—এই আমার পাশে। ওখানে বসলে হাওয়া আর পাবে কোথায়?’
বাসন্তী ধীরে ধীরে অতি সাবধানে স্বামীর পাশে একেবারে নৌকার কিনারে গিয়া বসিল। বলিল, ‘হ্যাঁগা, এখানে বসতে যে ভয় করছে।’
‘ভয় কিসের? এই তো তোমায় আমি জড়িয়ে ধরে আছি।’
বাসন্তী বলিল, ‘আজ তুমি আবার মদ খেয়েছ? ছি!’
‘বেশ করেছি। এখানেও ওইসব কথা! চুপ কর!’
‘হ্যাঁ, ভাল কথা বলতে গেলে তোমার রাগ হয়।’
‘হ্যাঁ-হয়! তোমার জ্বালায় আমি গেলাম দেখছি।’
বাসন্তী বলিল, ‘তা আমার জ্বালা আর তোমায় বেশিদিন সইতে হবে না গো, যে-রোগে আমায় ধরেছে এ-রোগ আর তোমার গঙ্গার হাওয়ায় সারবে না।
‘তবে এই গঙ্গার জলে সারুক।’ বলিয়াই শ্রীপতি তাহাকে জলের দিকে সজোরে ঠেলিয়া দিলেন।
কিন্তু আশ্চর্য, বাসন্তী কোন সময় প্রাণপণে নৌকাটা দু’হাত দিয়া চাপিয়া ধরিয়াছে। সে একটুখানি টাল খাইয়া সামলাইয়া লইল, নৌকাটাও একটুখানি নড়িল। এবং তাহার ফল হইল এই যে, শ্রীপতির মনের ইচ্ছা বাসন্তীর বুঝিয়া ফেলিতে আর দেরি হইল না। অন্ধকার নদীর উপর বাসন্তী তাহার স্বামীর মুখের পানে সকরুণ দৃষ্টিতে তাকাইয়া থাকিয়া বলিল, ‘ও, এতদিন ত’ তোমার এ মনোভাব আমি বুঝতে পারিনি। এই জন্যেই আমায় গঙ্গায় তুমি নিয়ে আসবার জন্যে এত ব্যস্ত হয়েছিলে?’
শ্রীপতি বলিলেন, ‘এসব তুমি কি বলছ বাসন্তী?
বাসন্তী বলিল, ‘ঠিকই বলছি। তা তুমি বললেই পারতে!’
বলিতে বলিতে বাসন্তীর গলার আওয়াজ দারুণ অভিমানে রুদ্ধ হইয়া আসিল, চোখ দিয়া দরদর করিয়া জল গড়াইয়া পড়িল। বলিল, ‘বাঁচা আমার আর উচিত নয় তা আমি জানি। কিন্তু তোমারই জন্যে মরতে পারিনি! ভালই হল, মরবার পথ দেখিয়ে দিলে।’
এই বলিয়া হাত বাড়াইয়া বাসন্তী তাহার স্বামীর পায়ের ধুলা মাথায় লইয়া তাঁহাকে একটি প্রণাম করিল এবং দেখিতে দেখিতে সেই অতলস্পর্শ গঙ্গার জলে ঝুপ্ করিয়া লাফাইয়া পড়িয়া প্রবল স্রোতের তলায় কোন দিক দিয়া যে তলাইয়া গেল কিছুই ঠিক ঠাহর হইল না।
‘গেল – গেল’ বলিয়া শ্রীপতি হাত বাড়াইয়া চিৎকার করিয়া উঠিলেন, মাঝি দুইজন হাঁ হাঁ করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল, শীতের এই কনকনে ঠাণ্ডা জলের উপর একজন মাঝি ঝাঁপাইয়া পড়িল, কিন্তু বৃথাই কিয়ৎক্ষণ সাঁতার কাটিয়া এদিক-ওদিক খুঁজিয়া শেষে নৌকোয় উঠিয়া বলিল, ‘না বাবু লাশ তলিয়ে গেছে।’
শ্রীপতির মুখে কথা নাই, চোখে জল নাই। নিশ্চল পাষাণ মূর্তির মত তখন তিনি একেবারে শক্ত কাঠ হইয়া গিয়া একদৃষ্টে নদীর জলের দিকে তাকাইয়া আছেন।
নৌকোর মোড় ফিরাইয়া মাঝিরা তীরে আসিয়া পৌঁছিল। ঠক্ ঠক্ করিয়া কাঁপিতে কাঁপিতে শ্রীপতি নৌকা হইতে অবতরণ করিলেন। মাঝিদের পয়সা না দিয়াই তিনি চলিয়া যাইতেছিলেন। হঠাৎ কি ভাবিয়া ফিরিয়া দাঁড়াইলেন। পকেটে হাত দিয়া চার-পাঁচটা টাকা একসঙ্গে তুলিয়া আনিয়া না শুনিয়াই তিনি একজন মাঝির হাতে তুলিয়া দিয়া ফ্যাল ফ্যাল করিয়া সেই অন্ধকার কৃষ্ণবর্ণ স্রোতস্বিনীর দিকে কিয়ৎক্ষণ তাকাইয়া রহিলেন, তাহার পর সহসা কিশোরীর কথা মনে পড়িতেই তাড়াতাড়ি কোথায় কোন দিক দিয়া যে অদৃশ্য হইয়া গেলেন কেহই দেখিতে পাইল না।
মাঝিরা বলাবলি করিতে লাগিল—লোকটা পাগল হইয়া গেছে।
শহরের পথে আসিয়া শ্রীপতির ইচ্ছা করিতেছিল, পায়ে হাঁটিয়া নয়, গাড়ি চড়িয়াও নয়, উড়িয়া যদি তিনি কিশোরীর কাছে গিয়া পৌঁছিতে পারেন তো ভাল হয়।
যাক্, বাসন্তীর কথা ভাবিয়া আর লাভ নাই। এইবার কিশোরীকে লইয়া সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে নিশ্চিত্তে নির্ভাবনায় পরমানন্দে তাঁহার দিন কাটিবে।
কিন্তু অবাক কাণ্ড, শ্রীপতি গাড়ি হইতে নামিয়া উন্মাদের মত ছুটিয়া গিয়া কিশোরীর ঘরে ঢুকিয়া দেখিলেন ঘর অন্ধকার, কিশোরী নাই।
ডাকিলেন, ‘কিশোরী। কিশোরী!’
অন্ধকার ঘরের মধ্যে কাহারও কোনও সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না।
আলো জ্বালিয়া দেখিলেন, ঘরের আসবাবপত্র যেখানে যেমনটি ঠিক তেমনিই আছে, শুধু যে হাতবাক্সে তাঁহার বাড়ি বিক্রির সমস্ত টাকা তিনি রাখিয়াছেন, সেই গহনা ও টাকার বাক্সটি নাই, আলমারির কাপড় জামার মধ্যে ভাল ভাল যাহা তাহাই লইয়া গিয়াছে।
খুনে আসামীকে আশ্রয় দেওয়ার ভয়েই বুঝি কিশোরী পলায়ন করিয়াছে! কিম্বা আর কিছু মতলব আছে কি না তাই বা কে জানে!
নিঃসম্বল শ্রীপতি পথে-পথে কিশোরীর অনুসন্ধান করিয়া ফেরেন।
কিন্তু কোথায় কিশোরী? স্বেচ্ছায় যে-নারী নিরুদ্দেশ হইয়াছে তাহাকে খুঁজিয়া বাহির করা কঠিন। তবু শ্রীপতির খুঁজিবার বিরাম নাই। তাঁহার জীবনের যা কিছু সম্বল সবই তো তাহারই কাছে।
.
সেদিন অমনি এক গভীর রাত্রে কলিকাতার একটি জনহীন নোংরা পথে শ্রীপতি ঘুরিয়া বেড়াইতেছিলেন, সহসা তাঁহার মনে হইল, কানের কাছে কে যেন বলিল, ‘ওগো শুনছ?’
শ্রীপতির সর্বাঙ্গ রোমাঞ্চিত হইয়া উঠিল। স্পষ্ট বাসন্তীর কণ্ঠস্বর। পিছন ফিরিয়া দেখিল, কেহ নাই।
সেই দিন হইতে শ্রীপতির আবার এক নূতন উপসর্গ জুটিয়াছে। দিনে দুপুরে যখন-তখন কেবলই মনে হয়, বাসন্তী তাঁহার পিছু ধরিয়াছে। সুমুখে কিশোরী, পশ্চাতে বাসন্তী! শ্ৰীপতি কি যে করিবেন কিছুই বুঝিতে পারেন না।
অস্নাত অভুক্ত ক্ষুধার্ত শ্রীপতির তবু সন্ধানের বিরাম নাই। কিন্তু দিবারাত্রি কোনও অশরীরী প্রেতাত্মা যদি এমনি করিয়া তাঁহার পশ্চাদ্ধাবন করে তো তিনি চলেনই বা কেমন করিয়া!
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন