শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়
বিপদ এক একটা মানুষের জীবনে ঠিক এমনি করিয়াই আসে। কেন আসে কেহ কিছুই বলিতে পারে না, কখন আসে তাহারও কোনও স্থিরতা নাই। তবু আসে।
শুনিলাম আমাদের প্রকাশেরও ঠিক তাহাই হইয়াছে।
অনেকদিন চুপচাপ বসিয়া থাকিবার পর চল্লিশ টাকা মাহিনার একটি চাকরি পাইয়া কি খুশিই না সে হইয়াছিল! পথে সেদিন আমার সঙ্গে দেখা। বলিল, ‘যাক ভাই, এতদিন পরে বাঁচা গেছে। একটা চাকরি পেয়েছি।’
কিন্তু চাকরি না পাইলেও তাহার বিশেষ ক্ষতি ছিল বলিয়া তো মনে হয় না। জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘কেন রে?’ চাকরি না পেলেই বা তোর এমন কি ক্ষতিটা হতো শুনি? বাবা চাকরি করছেন, দাদা করছেন—কলিকাতায় নিজের বাড়ি, অভাব কিসের?’
প্রকাশ হাসিয়া বলিল, ‘বিয়ে করেছি, বৌ-এরও তো সাধ-আহ্লাদ আছে। নিজে রোজগার না করলে—’
কথাটা তাহাকে আর শেষ করিতে হয় নাই। বুঝিয়াছিলাম। প্রকাশের বৌ আমি দেখিয়াছি। পরমা সুন্দরী বলিতে যাহা বুঝায় সে বোধহয় তাহার চেয়েও বেশি। তেমন বৌ খুব কম লোকেরই ভাগ্যে জোটে! না চাহিতেই তাহাকে দিতে ইচ্ছা করে সেকথা সত্য। অথচ এই বয়সে বৌ-এর সাধ মিটাইবার জন্য বাপ-দাদার কাছে টাকা চাহিতে প্রকাশ চায় না।
সুতরাং চাকরি পাইয়া প্রকাশের খুশি হইবারই কথা।
অলক্ষ্যে থাকিয়া বিধাতা তখন হাসিয়াছিলেন কিনা জানি না। কারণ দু-তিন মাস পার হইতে না হইতেই শুনিলাম— প্রকাশ ভারি বিপদে পড়িয়াছে। যে বিপদের কথা বলিতেছিলাম—সেই বিপদ।
প্রকাশ তাহার জন্য প্রস্তুত হইয়া ছিল না। একেবারে অকস্মাৎ সম্পূর্ণ অতর্কিত অবস্থায় নিশীথ-রাত্রির ঝড়ের মত প্রচণ্ড বিক্রমে বিধাতার দেওয়া বিপদ আসিয়া প্রকাশকে আক্রমণ করিয়াছে এবং শুধু আক্রমণ করিয়াই ক্ষান্ত হয় নাই, তাহাকে একেবারে ধরাশায়ী করিয়া দিয়াছে।
বাবা তাহার সেদিন আফিস হইতেই ফিরিলেন—রোগ নাই, ব্যাধি নাই, দিব্য সুস্থ সবল মানুষ, আহারাদি শেষ করিয়া নিশ্চিত্তমনে শয়ন করিয়াছিলেন, রোগ ব্যাধির কথা তিনি চিন্তাও করেন নাই, হঠাৎ মধ্য রাত্রে শোনা গেল—তাঁহার কলেরা হইয়াছে। কলিকাতা শহর—ডাক্তারের অভাব নাই, চিকিৎসার ত্রুটিও কিছু হইল না, সেবাশুশ্রূষাও যথেষ্ট, কিন্তু প্রভাত হইতে না হইতে নাড়ী তাঁহার ক্ষীণ হইয়া আসিল, মুখের কথা মুখেই আটকাইয়া রহিল, স্ত্রী পুত্র কন্যা বধু জামাতা নাতি-নাতনীর কান্নায় কোলাহলে বাড়ি একেবারে মুখরিত হইয়া উঠিল; কেহই তাঁহাকে ছাড়িয়া দিতে চায় না, –তবু তিনি ছাড়িয়া গেলেন।।
যাইবার বয়স হইয়াছিল, তাহার যাওয়াটা আকস্মিক হইলেও তত বেশি অপ্রত্যাশিত নয়, কিন্তু এমনি বিধাতার বিচার, শ্মশান হইতে মৃতদেহের সৎকার করিয়া ফিরিতে না ফিরিতেই তাহার জ্যেষ্ঠ পুত্র শশাঙ্ক সহসা শয্যা গ্রহণ করিল। — প্রকাশের দাদা শশাঙ্ক।
শশাঙ্ক গেল এবং তাহার ঘণ্টাখানেকের মধ্যে শশাঙ্কর দশ-এগারো বছরের একটি ছেলে!
উপরি-উপরি তিনজন।
বাড়িতে পুরুষ ব্যাটাছেলের মধ্যে রহিল একমাত্র — প্রকাশ।
এত বড় এই সংসারের বিরাট বোঝা এতদিন বাবা ও দাদায় ভাগাভাগি করিয়া বহন করিতেছিলেন, তাঁহাদের অন্তরালে থাকিয়া প্রকাশ কিছুই বুঝিতে পারে নাই, এইবার সমস্ত দায়িত্বভার আসিয়া পড়িল তাহারই ঘাড়ে।
বাবা কিছুই রাখিয়া যাইতে পারেন নাই। বাড়িখানি ছিল বন্ধকী, দেনার দায়ে তাহাও গেল। দাদার ছিল মাত্র দুহাজার টাকার জীবনবীমা। সে টাকা গেল বৌদিদির হাতে। বৌদিদি বলিলেন, ‘ও টাকা আমি দেবো না ভাই, আমার দু-দুটো আইবুড়ো মেয়ে, তাদের বিয়ে দিতে হবে।’
প্রকাশের মাত্র এই চল্লিশটি টাকার ভরসা। শহরের মাঝখানে থাকা তাহার পক্ষে অসম্ভব। শহরতলীতে একটি টিনের বাড়ি ভাড়া লইয়া তাহারা উঠিয়া গেল।
.
বেচারা প্রকাশ! কতদিন বসিয়া বসিয়া শুধু তাহারই কথা ভাবিয়াছি। দেখা হইলে সে আর সহজে আমাকে ছাড়িতে চায় না। বলে, ‘চাকরি নেওয়ার জন্যে তখন কত কথাই বলেছিলি, কিন্তু এখন?’
তাহাই ভাবি। প্রকাশ যদি তখন চাকরি না লইত, আজ তাহা হইলে তাহাদের কষ্টের আর সীমা থাকিত না। ভগবানের একটা বিচার তো আছে!
প্রকাশ বলে, কিন্তু ভাই নীলিমাকে যদি না পেতাম তাহলে এ কষ্ট বোধহয় আমি সহ্য করতে পারতাম না। নীলিমার মুখের পানে তাকিয়ে আমি সব দুঃখ ভুলে যাই।’
এত দুঃখের মাঝখানে স্ত্রীই তাহার একমাত্র সান্ত্বনা। রূপ এবং গুণ—দুইই একসঙ্গে পাওয়া বড় সহজ কথা নয়। তা সে যত বড় অভাগাই হোক, এদিক দিয়া সে ভাগ্যবান।
সেদিন বলিলাম, ‘তোর কোনও দুঃখই থাকবে না প্রকাশ, আমার মনে হয় ওই তোর স্ত্রীর জন্যেই আবার দেখিস তোর সবই হবে।’
প্রকাশ ঈষৎ হাসিয়া বলিল, ‘নীলিমাকে আজ এইকথা আমি বলব গিয়ে।’
.
মাকে লইয়া তীর্থভ্রমণে বাহির হইয়াছিলাম, কলিকাতায় ফিরিলাম প্রায় এক বৎসর পরে। প্রকাশের কোনও খবর রাখি নাই।
সেদিন থিয়েটার দেখিতে গিয়াছি। থিয়েটার যখন ভাঙ্গিল রাত্রি তখন প্রায় বারোটা। শীতকাল। গায়ের কাপড়টা ভাল করিয়া গায়ে জড়াইয়া জড়সড় হইয়া পথ চলিতেছিলাম। দূরে একটা পানের দোকানের সুমুখে কে একটা লোক দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া কি যেন কিনিতেছে। দেখিতে ঠিক প্রকাশের মত। দেখিলাম, লোকটা দেশলাই জ্বালিয়া সিগারেট ধরাইল। প্রকাশ বিড়ি সিগারেট কখনও খায় না। কাজেই সে প্রকাশ নয় ভাবিয়াই পাশ কাটাইয়া চলিয়া যাইতেছিলাম, কাছে গিয়া ভাল করিয়া আর একবার তাহার মুখের পানে তাকাইতেই দেখি—সত্যই প্রকাশ। মাথার চুল বড় বড়, দেখিতে অনেকটা রোগা হয়ে গেছে, সহজে তাহাকে আর চিনিবার উপায় নাই। ডাকিলাম, ‘প্রকাশ।
আমার মুখের পানে তাকাইয়া চোঁ করিয়া সিগারেটটা টানিয়া খানিকটা ধোঁয়া ছাড়িয়া বলিল, ‘আয়! অনেকদিন পরে দেখা হলো।’
এই বলিয়া সে আমার পাশে পাশে পথ চলিতে লাগিল। কেমন যেন উদাসীন ভাব। এতদিন পরে দেখা হইলে আগে সে যেমন করিয়া আমাকে জড়াইয়া ধরিত এখন আর যেন সে ব্যগ্র ব্যাকুলতা নাই।
জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘সিগারেট ধরলি কতদিন? আগে তো ওসব খেতে দেখিনি।
বলিল, ‘হ্যাঁ ধরেছি।’
‘চেহারাও দেখছি খারাপ হয়ে গেছে।’
স্নান একটুখানি হাসিয়া বলিল, ‘তাই নাকি?’
বলিলাম, ‘কেন নিজে বুঝতে পারিস না?’
বলিল, ‘বুঝে কি লাভ? এই শরীর—শ্মশানে পুড়ে তো একদিন ছাই হয়ে যাবে।’
‘সে আর হবে না কার? তবু যতদিন বেঁচে আছি—’
কথাটা সে আমায় শেষ করিতে দিল না; বলিল, ঠিক বলেছিস। যতদিন বেঁচে আছি সুখে বাঁচতে হবে। সেই চেষ্টাই তো করছি আজকাল।’
কথাগুলো তাহার কেমন কেমন যেন মনে হইতেই তাহার মুখের পানে তাকাইলাম। বলিলাম, ‘কী বলছিস প্রকাশ? আমার ভয় হয় তুই শেষে না পাগল হয়ে যাস!’
‘পাগল হব কি রে!’ বলিয়া প্রকাশ হো হো করিয়া হাসিয়া উঠিল।
তাহার সে হাসিটাও যেন কেমন একরকম বলিয়া মনে হইল। বুঝিলাম তাহার দুঃখের মাত্রা বোধহয় বাড়িয়াছে। জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘এখানে এই এত রাত্রে কোথায় এসেছিলি?’
প্রকাশ বলিল, ‘থিয়েটার দেখতে।’
‘থিয়েটার দেখতে?’
হ্যাঁ। এখানে আজকাল আমি প্রায়ই আসি।’
ভাবিতেছিলাম, এমনিই হয়। এমনি করিয়াই হয়ত সে আজকাল আনন্দ খুঁজিয়া বেড়াইতেছে। দুজনেই নীরবে পথ চলিতেছিলাম। প্রকাশই প্রথমে কথা বলিল। সিগারেটটা শেষ টান টানিয়া পথের উপর ছুঁড়িয়া ফেলিয়া দিয়া বলিল, ‘ওই পুতুল-মেয়েটি দেখতে অনেকটা নীলিমার মত। তাই ওকে আমি প্রায়ই দেখতে আসি।’
হাসিয়া বলিলাম, ‘নীলিমা সেকথা জানে!’
কথাটার কোনও জবাব না দিয়া দেখিলাম সে তাহার পকেট হইতে আবার আর একটা সিগারেট বাহির করিয়া ধরাইতেছে।
বলিলাম, ‘আজকাল এত সিগারেট খাচ্ছিস, থিয়েটার দেখছিস, মাইনে কি তোর বেড়েছে প্ৰকাশ?’
ঘাড় নাড়িয়া প্রকাশ বলিল, ‘হ্যাঁ, আজকাল দেড়শ’ পাই। নীলিমা অবশ্য দেখে যায়নি। সে মরবার পরেই এই চাকরিটা পেলাম।’
তাহার কথাটা শুনিয়া একেবারে স্তম্ভিত হইয়া গেলাম।
‘কি বললি প্রকাশ? নীলিমা মারা গেছে?’
‘তা আজ প্রায় মাস পাঁচ ছয় হয়ে গেল।’
‘কি হয়েছিল?’
কিছু না। সামান্য জ্বর।’
‘চিকিৎসা করিয়েছিলি?’
‘আমাদের পাড়ার নেপাল ডাক্তার একদিন দেখেছিল। তখন আমি চল্লিশ টাকা মাইনে পেতাম, তার ওপর মাসের শেষ।’
আবার আমরা নীরবেই পথ চলিতে লাগিলাম। পথ তখন নির্জন হইয়া আসিয়াছে। ফুটপাথের উপর আমাদের দু জোড়া জুতার শব্দ ছাড়া আর কোনও শব্দ নাই।
প্রকাশ বলিল, ‘আরে দূর-দূর! ডাক্তার দেখলেই কি মানুষ বাঁচে নাকি! কেউ বাঁচবে না ভাই, তুইও মরবি, আমিও মরব।’
ইহার উপর আর কথা চলে না। চুপ করিয়া রহিলাম।
কিছুক্ষণ পথ চলিবার পর প্রকাশ জিজ্ঞাসা করিল, ‘ভগবান বিশ্বাস করিস?’
বলিলাম, ‘করি।’
প্রকাশ হাসিয়া বলিল, ‘আমিও করতাম।… এখন দেখছি বিশ্বাস করে কোনও লাভ নেই। নীলিমা মরবার সময় যে কান্না আমি কেঁদেছিলাম, আর যে প্রার্থনা আমি জানিয়েছিলাম, তা শুনে ভগবান তো ভগবান, শয়তানেরও দয়া করবার কথা। কিন্তু তোর নিষ্ঠুর ভগবান আমার সে প্রার্থনা শোনে নি।’
এই বলিয়া সে কিয়ৎক্ষণ চুপ করিয়া রহিল। প্রাণপণে সিগারেট টানার চোঁ চোঁ শব্দ ছাড়া আর কিছুই শুনিতে পাইলাম না।
খানিকটা প্রচুর ধোঁয়ার সঙ্গে প্রকাশ যেন তাহার মনের অনেকখানি গ্লানি দূর করিয়া দিয়া বলিয়া উঠিল, ‘কিছু না রে, কিচ্ছু না! দুনিয়ার প্রায় সবখানাই ফাঁকি। যতদিন বেঁচে আছিস যা খুশি তাই কর্—ফূর্তি করে কাটিয়ে দে। তারপর মৃত্যু যেদিন আসবে কেউ তাকে আটকাতে পারবে না।… মৃত্যুকে ভয় আর করি না, বুঝলি? সেজন্যে সর্ব্বদাই নিজেকে প্রস্তুত করে রেখেছি।’
প্রকাশ এইবার চুপ করিয়া আবার কি যেন ভাবিতে লাগিল। কথায় কথায় আমরা অনেক দূর আসিয়া পড়িয়াছিলাম।
রাস্তার ট্রামগাড়ি অনেকক্ষণ বন্ধ হইয়া গেছে। মাঝে মাঝে দু’একটা বাস এখনও চলিতেছিল।
প্রকাশ বলিল, ‘তোকে আমি অনেক দূর টেনে নিয়ে এলাম। না?’
বলিলাম, ‘তাতে আর কি হয়েছে। তোর সঙ্গে কতদিন দেখা হয়নি বল ত?
প্রকাশ বলিল, হ্যাঁ, আজ রাত্রে যদি মরে যাই তো কাল আর দেখা হবে না।’
দু’জনে আরও খানিক দূর চলিলাম। প্রকাশ একবার হাঁচিল।
বলিলাম, ‘বেশ হিম পড়ছে।’
ঘাড় নাড়িয়া প্রকাশ বলিল, ই, ঠান্ডা লাগল বোধ হয়।’
বলিলাম, ঠান্ডায় ঠান্ডায় আর বেশি ঘুরে বেড়ানো উচিত নয়। চারিদিকে অসুখ-বিসুখ হচ্ছে।’
প্রকাশ আর কোনও কথা না বলিয়া একবার এদিক-ওদিক তাকাইয়া ফুটপাথ হইতে রাস্তায় নামিল। ঠিক সেই সময় একটা বাস পার হইতেছিল। চলন্ত গাড়িটাকে হাতের ইসারায় থামাইয়া প্রকাশ বোধ করি হিমের ভয়েই তাহার হাতল ধরিয়া গাড়িতে উঠিয়া পড়িল। — চললাম, আবার দেখা হবে।’
ঘণ্টা বাজাইয়া সশব্দে গাড়ি ছাড়িয়া দিল।
একদৃষ্টে কিয়ৎক্ষণ সেইদিক পানে তাকাইয়া দাঁড়াইয়া রহিলাম।
তাহার পর জনশূন্য শহরের পথ। কদাচিৎ দু-একটা মানুষে-টানা রিকশা গাড়ি ঠুং ঠুং করিয়া পার হইয়া যাইতেছে। পথের দু’ধারে নিদ্রিত নিস্তব্ধ বড় বড় অট্টালিকা। কোথাও কাহারও সাড়াশব্দ নাই। শীতে ও কুয়াশায় সব যেন ঝিমাইয়া পড়িয়াছে। যে পথে আসিয়াছিলাম আবার সেই পথ ধরিয়াই একাকী বাড়ি ফিরিতে লাগিলাম। দূরে কোথায় যেন শবযাত্রীর দল ‘বল হরি হরিবোল’ বলিয়া চিৎকার করিয়া উঠিল। কুয়াশাচ্ছন্ন শীতরাত্রির নিস্তব্ধতা ভেদ করিয়া সে শব্দ আমার কানের ভিতর দিয়া হৃৎপিণ্ডে আসিয়া ধ্বক করিয়া আঘাত করিল। শহরের চারিদিকে তখন বসন্তের মড়ক্ লাগিয়াছে। পথের দু’ধারে প্রাচীর গাত্রে ল্যাম্পপোস্টে যেখানে-সেখানে বড় বড় লাল লাল অক্ষরে কর্পোরেশন নোটিশ দিয়াছে—অবিলম্বে বসন্তের টীকা না লইলে মৃত্যুর সম্ভাবনা। সর্বনাশ! সেকথা এতদিন আমার মনেই ছিল না। ছি! ছি! প্রকাশের মত পাগলটার সঙ্গে এতক্ষণ ধরিয়া ঠান্ডায় ঠান্ডায় ঘুরিয়া বেড়ানো আমার অত্যন্ত অন্যায় হইয়াছে। ঠান্ডা লাগিয়া- জ্বর জ্বালা হইলেই ত…
আসন্ন মৃত্যুর অজানা আতঙ্কে আমার পা হইতে মাথা পর্যন্ত শির্ শির্ করিয়া উঠিল।
.
দিন-দুই পরে ডাকে একখানি চিঠি পাইলাম। খুলিয়া দেখি প্রকাশের চিঠি।
আমাকে চিঠি লিখিবার প্রয়োজন তাহার কোনওদিনই হয় নাই। আজ তাই সর্বপ্রথমে চিঠির নীচে তাহার নাম দেখিয়া একটুখানি বিস্মিত হইলাম। চিঠিখানি বড় নয়। মাত্র তিন চার লাইন লেখা।
লিখিয়াছে—
হাতে টাকাকড়ি যাহা ছিল ফুরাইয়া গিয়াছে। তুমি যদি ভাই দয়া করিয়া দশটি টাকা লইয়া কাল একবার এখানে আসিতে পার ত বড় ভাল হয়। ইংরেজি মাসের পয়লা তারিখে আপিসের মাহিনা পাইলেই টাকা পরিশোধ করিব। ইতি—প্ৰকাশ।
থিয়েটার দেখিয়া ফূর্তি করিয়া যেরকম ভাবে সে টাকা খরচ করিতে আরম্ভ করিয়াছে, এমনি অভাব যে তাহার একদিন হইবে তাহা জানা কথা।
যাই হোক, দশটি টাকা লইয়া পরদিন সকালেই প্রকাশের সঙ্গে দেখা করিতে গেলাম।
বেলেঘাটার একটা গলির মধ্যে অনেক খোঁজাখুঁজির পর তাহার বাড়ির নম্বর মিলিল। চারিদিকে টিনের বস্তি। মাঝখানে একটা পুকুর। সদর দরজা ঠেলিয়া ঘরে ঢুকিতেই কমবয়সী একটি মহিলা ঘোমটা টানিয়া সরিয়া গেলেন, আর একজন বর্ষীয়সী আমার কাছে আগাইয়া আসিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘কার বাড়ি?’
বলিলাম, ‘প্রকাশের।
দেওয়ালের ওপারে আঙ্গুল বাড়াইয়া দেখাইয়া দিয়া বলিলেন, ‘ওই দিকে যাও বাছা, এদিকে নয়।’
সেখান হইতে বাহিরে আসিয়া আবার আর একটা দরজায় গিয়া কড়া নাড়িতেই ছোট একটি ছেলে দরজার কাছে আসিয়া দাঁড়াইল। বলিল, ‘কাকাবাবুকে ডাকছেন?’
বলিলাম, ‘কে তোমার কাকাবাবু? প্রকাশ?’
ছেলেটি একবার আমার মুখের পানে তাকাইয়া ফিক্ করিয়া হাসিয়াই ছুটিয়া পলাইল।
ভারি মুস্কিলে পড়িলাম। এইবার জোরে জোরে প্রকাশের নাম ধরিয়া ডাকিতেই তাহার সাড়া পাওয়া গেল। পাশের একটা বাড়ি হইতে প্রকাশ বলিল, ‘নারকেল গাছটার পাশের গলি দিয়ে এগিয়ে আয়।’
দেখিলাম, পাশেই নারকেল গাছ এবং তাহার পাশেই নোংরা একটা অত্যন্ত সঙ্কীর্ণ গলি। নারকেল গাছের গায়ে একটা নম্বরের প্লেট পেরেক দিয়ে মারা আছে।
এবার আর দরজায় গিয়া কড়া নাড়িতেও হইল না, ডাকিতেও হইল না, দেখিলাম, দরজার পাশের ঘরখানি খোলা এবং সেই ঘরের একপাশে বিছানাপাতা তক্তপোষের উপর প্রকাশ একটা সাদা চাদর গায়ে দিয়া শুইয়া আছে।
বলিলাম, ‘বেশ জায়গায় বাড়ি নিয়েছিস প্রকাশ! ছ’নম্বর বাড়ি কি এখানে সবগুলোই নাকি?’
প্রকাশ হাসিয়া বলিল, ‘ননীদার বাড়ি ঢুকেছিলি বুঝি? ও একটা ভারি মজা হয়ে গেছে ভাই। ননীদার বাড়ির নম্বর ‘নয়’। তার দরজার প্লেটা গেছে উল্টে। তাই ইংরেজি নয়, ছয় হয়ে বসে আছে। একটা পেরেক ঠুকে প্লেটা সোজা করে বসাবার সময় আর ননীদার হয়ে ওঠে না। বোস্।’
বিছানার উপরেই প্রকাশ উঠিয়া বসিয়াছিল। আমিও তাহারই একপাশে চাপিয়া বসিলাম। বলিলাম, কই তোর অসুখের কথা ত লিখিসনি চিঠিতে? কিরকম অসুখ? কবে থেকে?’
প্রকাশ বলিল, ‘সেই যে থিয়েটার দেখে ঠান্ডা লাগিয়ে এলাম যেদিন, সেই রাত্রি থেকেই জ্বর। টাকা এনেছিস?’
পকেট হইতে দশ টাকার নোটখানি বাহির করিয়া তাহার হাতে দিলাম। উপবাসক্লিষ্ট শুষ্ক ম্লান মুখখানি তাহার সহসা উজ্জ্বল হইয়া উঠিল। বলিল, ‘বাঁচলাম। এ শালা এমন জায়গা যে দশটা টাকা কারও কাছে ধার পাবার উপায় নেই।’
বলিলাম, ‘আমার ভাই আজ একটু দরকার আছে, তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে হবে।’
‘সে কি রে! এত বেলা হয়েছে, খেয়ে যাবিনি?’
বলিলাম, ‘না।’
বলিয়াই উঠতে যাইতেছিলাম, প্রকাশ বলিল, ‘বোস্ না!’
মনে হইল আরও কি যেন সে বলিতে চায়। বাধ্য হইয়া বসিতে হইল।
প্রকাশ খানিক ইতস্তত করিয়া এটা-সেটা অবান্তর প্রশ্ন করিয়া শেষে বলিল, ‘যেদিন সেই অসুখের কথা বলছিলি, আমাদের পাড়াতেও হয়েছে দু’একটা।’
জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘বসন্ত?’
ঘাড় নাড়িয়া প্রকাশ বলিল, হুঁ। তুই টিকে নিয়েছিস?’
বলিলাম, ‘নিয়েছি।’
প্রকাশ একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া চুপ করিয়া রহিল।
জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘তুই নিনি?’
সেকথার কোন জবাব না দিয়া প্রকাশ বলিল, ‘হোমিওপ্যাথি ওষুধ খেলেও চলে, না কি বল্?’
চলে কি চলে না ঠিক জানি না, কাজেই তাহার জবাব দেওয়া আমার পক্ষে একটুখানি শক্ত হইয়া পড়িল।
প্রকাশ বলিল, ‘ওই-সবের চিকিৎসা করে এমন একজন ভাল ডাক্তার তোর জানা আছে?’
বলিলাম, ‘কেন বল্ দেখি! আমাদের পাড়ায় একজন আছেন জানি।’
সংবাদটা শুনিয়া প্রকাশ উল্লসিত হইয়া উঠিল। বলিল, তাকে একবার পাঠিয়ে দিতে পারিস? কত নেয় বল দেখি?’
বলিলাম, ‘কিছুই নেন না, শুধু যাওয়া-আসার খরচ দিলেই হয়।’
প্রকাশ তৎক্ষণাৎ উঠিয়া দাঁড়াইল। সুমুখে দেওয়ালের কাছে একটা বাক্স খুলিয়া একটি টাকা আনিয়া আমার হাতে দিয়া বলিল, ‘তুই গিয়ে তাঁকে পাঠিয়ে দিস্ ভাই, আমার এই বাড়ির পাশে—ছোট্ট একটি ছেলের,… আহা, বেচারার কেউ কোথাও নেই বুঝলি? আজই আমার বাড়ির ঠিকানা দিয়ে পাঠিয়ে দিস্ যেন, ভুলিনি।’
পাশের বাড়ির ছেলের কিছুই হয় নাই। বুঝিলাম প্রকাশ মিথ্যা বলিতেছে। তা বলুক। তাহাকে লজ্জা দিয়া লাভ নাই।
মৃত্যু ও ব্যাধিকে প্রকাশ ভয় করে না বলিয়াছিল, অথচ মৃত্যুর আশঙ্কায় মুখে তাহার আজ আতঙ্কের ছায়া পড়িয়াছে দেখিলাম।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন