ভয় – শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়

শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়

ভয়

বেলা তিনটা হইতে সন্ধ্যা ছটা পর্যন্ত ষ্টেশনে গাড়ি আসে না। ষ্টেশন খাঁ-খাঁ করে।

ষ্টেশন-মাষ্টার বাসায় চলিয়া যান। অ্যাসিষ্ট্যান্ট যিনি, তাঁহার না থাকিলে নয়। টেলিগ্রাফের যন্ত্র সাজানো টেবিলটির কাছে একটি টুলের উপর তাঁহাকে বসিয়া থাকিতে হয়।

খালাসীদের মধ্যে কেহ কেহ বা এই সময়টায় গ্রামের ভিতর চাল-ডাল কিনিতে যায়, কেহ-বা ঘুমায়, আবার কেহ-বা আধ মাইল-খানেক দূরে ফটকের কাছে গিয়া জটলা করে।

এই ফটকটি রেল-কোম্পানীর ফটক। পাকা একটি সড়ক এখানে রেল লাইনের উপর দিয়া পার হইয়া গিয়াছে। সড়কের উপর গাড়ি-ঘোড়া লোকজনের যাতায়াত। আজকাল আবার মোটর-বাস চলিতেছে। ট্রেনের সঙ্গে ধাক্কা লাগিবার সম্ভাবনা। কাজেই রেল কোম্পানীকে এখানে একটি ফটক তৈরি করিতে হইয়াছে। এবং শুধু ফটক নয়— ফটকের কাছে টালির একখানি ছোট ঘর। ফটকরক্ষী রাম সিং-এর জন্য।

খালাসীদের মজলিস বসে রাম সিং-এর ঘরখানির মধ্যে। মজলিসের প্রধান আকর্ষণ—রঞ্জন। কালো রঙের পাতলা ছিপছিপে ঢ্যাঙ্গা এবং কুঁজো একটি লোক। কাজকর্ম কোথাও কিছু করে না। ষ্টেশনেই ঘরবাড়ি, আত্মীয়-স্বজন কেহ তাহার কোথাও আছে কিনা কে জানে, ট্রেন আসিয়া দাঁড়াইলে যাত্রীদের কাছে ভিক্ষা করিয়া কাঁদিয়া কাটিয়া হাত পাতিয়া যাহা পায়—তাহাই লইয়া গিয়া রাম সিং-এর কাছে গচ্ছিত রাখে, রাম সিং-এর হাতে-গড়া রুটি খাইয়া তাহার দিন কাটে, রাত্রে এই ফটকের ঘরের মধ্যে রাম সিং-এর কাছে শোয়।

অদ্ভুত এই রঞ্জন!

খালাসীরা সুবিধা পাইলেই তাহাকে লইয়া জটলা পাকায়। রঞ্জন ভারি মজার মজার গল্প বলে। তাহারা শোনে।

রঞ্জন বলে, তাহার সাহস নাকি অত্যন্ত বেশি।

বলিয়া আরম্ভ করে,-–একদিন—অমাবস্যার রাত। চারিদিকে ঘুটঘুটে আঁধার। কোলের মানুষ চেনা যায় না। আছি শ্বশুর-বাড়িতে; বৌ-এর সঙ্গে কয়েকদিন ধরেই ঝগড়া চলছিল। হঠাৎ সেদিন রাগারাগি হলো। রাত তখন দুপুর। এমন রাগারাগি হলো যে, বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লাম।

বেরিয়ে পড়ে যাই কোথায়?

বাইরে এসে ভাবলাম—বাড়ি যাওয়া যাক্।

বাড়ি সেখান থেকে পাঁচ ক্রোশ দূরে। সেই অন্ধকার রাত। হাতে না আছে লণ্ঠন, না আছে একটা ছড়ি।

চলতে লাগলাম।

চলেছি ত চলেইছি। ধানের মাঠে-মাঠে রাস্তা। বর্ষাকাল। মাঠে কাদা হয়েছে।

ছপ ছপ করে মাঠগুলো পার হয়ে উঠলাম গিয়ে পাকা রাস্তায়। পাকা রাস্তার দুপাশে বাঁশের ঝাড়ে বাতাস লেগে কটূ কট্ করে শব্দ হচ্ছে, জঙ্গলের মাঝখানে শেয়ালগুলো মাঝে মাঝে চেঁচিয়ে উঠছে। রাস্তায় জনপ্রাণী নেই। অন্য লোক হলে হয়ত মরেই যেতো। আমার সাহস খুব বেশি, তাই সে-সব কিছু গ্রাহ্য না করে হন্ হন্ করে এগিয়ে চললাম।

কিছু দূর গিয়ে রাস্তাটা ছেড়ে দিয়ে ডানহাতি একটা নদী পেরোতে হয়। প্রকাণ্ড নদী। ওপারে হয়ত জল একটুখানি আছে, কিন্তু এপারে শুধু বালি।

নামলাম নদীতে। জায়গাটার নাম শ্মশান ঘাটা। আশপাশের গাঁয়ের লোক সেখানে মড়া পোড়ায়। দিনের বেলা সেপথ দিয়ে হেঁটে যেতে লোকে ভয় করে। আমারও গা’টা একবার ছম্ করে উঠলো। কিন্তু ওই পর্যন্তই। ভয় কিসের? বালির ওপর দিয়ে হেঁটে চলেছি। মস্ মস্ করে শব্দ হচ্ছে। হঠাৎ কী যেন একটা নরম জিনিসের গায়ে পা ঠেকলো। থমকে দাঁড়ালাম। দেশলাই থাকলে জ্বেলে দেখতাম। কিন্তু কিছু নেই। পা দিয়ে নেড়ে চেড়ে বুঝলাম— হাত, পা, মাথা, চুল—সবই রয়েছে, একটা আস্ত মানুষ! হঠাৎ মনে পড়লো, কিছুদিন আগে শুনেছিলাম, নদীর ধারে দু’তিনখানা গাঁয়ে ভয়ানক কলেরা হচ্ছে। হয়ত সেই কলেরার মড়া। না পুড়িয়ে শ্মশানে ফেলে দিয়ে গেছে। তা হোক্। পাশ কাটিয়ে চলে গেলাম। কিন্তু যেতে গিয়ে, দেখি—চলা দায়। যেদিকে যাই, সেদিকেই হয়ত কারও হাত মাড়িয়ে ফেলি, কারও পা, কারও বা মাথার খুলিতে হোঁচট খেয়ে পড়তে পড়তে সামলে নিই সুমুখেই দেখি কয়েকটা শেয়াল খ্যাক খ্যাক্ করে চিৎকার করতে করতে ছুটোছুটি করছে, মড়া নিয়ে টানাটানি করে’ তারা ঝগড়া বাধিয়েছে হয়ত।

আরও খানিকটা এগিয়ে যেতেই মনে হলো যেন সেই নদীর মাঝখানে জনকয়েক কালো কালো লোক বসে বসে ফিস্ ফিস্ করে গল্প করছে। ভাবলাম হয়ত তারা গ্রাম থেকে নড়া নিয়ে এসেছে। কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস্ করলাম, ‘কে?’

একটা লোক যেন কথা বলতে যাচ্ছিল, মনে হলো বাকি লোকগুলো এক সঙ্গে ফিস্ ফিস্ করে তাকে নিষেধ করলে। ব্যাপার কি বুঝতে পারলাম না।

‘কে হে তোমরা কথা কইছ না যে!’ বলে যেই একটুখানি এগিয়ে গেছি, দেখি না, সবাই মিলে একসঙ্গে কঁক-কঁক গক-গঁক করতে করতে বালির ওপর থপ থপ করে লাফিয়ে লাফিয়ে দূরে সরে গেল।

বুঝলাম, মানুষ নয়, মানুষ বলে ভুল করেছিলাম। ওগুলো শকুনি।

ভাবলাম, ভূতপ্রেত কত-কি থাকতে পারে, কাজ নেই আর বেশিক্ষণ শ্মশান থেকে। তাড়াতাড়ি নদীটা পার হয়ে যাই।

তাড়াতাড়ি নদী পার হচ্ছি। সুমুখে জল। জলে নামতেই দেখি, আমার আগে-আগে জলের ওপর ছপ ছপ করে কে যেন এগিয়ে যাচ্ছে। এবার আর ভাল করে না দেখে কথা কইব না ভেবে আমিও তাড়াতাড়ি এগিয়ে চললাম। কাছাকাছি আসতেই অন্ধকারেও চিনতে পারা গেল—কালো মত লম্বা একটা মানুষ। ভয়ে ভয়ে বললাম, – ‘কে?’

‘আমি।’

যাক, বাঁচা গেল। তবু একটা সঙ্গী মিলেছে।

বললাম, ‘কোত্থেকে আসছ? যাবে কোথায়?’

কোত্থেকে আসছে সে কথা আর বললে না। বললে, ‘যাব পাথরকুচি।’

বললাম, ‘চল তোমার সঙ্গেই যাই। ভালই হলো।’

পাথরকুচি থেকে আমাদের গ্রাম প্রায় ক্রোশখানেক দূরে।

দুজনে নদী পার হলাম।

ওপারে গিয়ে—সে যায় আগে-আগে আমি যাই পিছু-পিছু

চলা-পথে অনেকদিন হাঁটিনি। ভাবলাম, পাথরকুচির লোক, পথ সে চেনে নিশ্চয়ই।

চলুক যেদিকে যাচ্ছে।

দু’একটা কথা জিজ্ঞেস করলাম। জবাব দেয় না।

বললাম, তুমি কি জাত?’

বললে, ‘বাউরি।’

তা হবে। গরিব লোক। সারাদিন খেটেখুটে সন্ধেয় হয়ত মদ খেয়ে কোথাও পড়েছিল। জ্ঞান হতেই আবার উঠে সে বাড়ি চলেছে। নেশা হয়ত এখনও ঠিক কাটেনি, তাই ভাল করে কথা বলছে না।

দু’জনে চলেছি তো চলেইছি। পথ আর ফুরোয় না।

বললাম, ‘এ কিরে, কোনদিকে চলেছিস? পথ ঠিক চিনিস তো?’

বললে, ‘হ্যাঁ।’

ক’ঘণ্টা চলেছি ঠিক মনে নেই। দুজনে একটা বাগানের ভেতর গিয়ে ঢুকলাম। পাশেই একটা ইটের পাঁজা। হঠাৎ একটা শব্দ হ’তেই দেখি, ইটের পাজার কাছে সাদা একটা বাছুর যেন ছুটোছুটি করছে। পাশেই একটা গাছের কাছে যেন সুড়ুৎ করে আর একটা শব্দ হলো। সেদিকে তাকাতেই দেখলাম, তিনটি ছোট ছোট বেঁটে বামনের মত মানুষ আমাদেরই দিকে এগিয়ে আসছে। মানুষ তিনটে অদ্ভুত রকমের। তিনজনেরই মাথায় ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া চুল, পা-গুলো উল্টো দিকে বাঁকানো। ভূতের পা শুনেছি ওইরকম হয়। তবে কি ভূত নাকি?

এতক্ষণে আমার গায়ের লোমগুলো খাড়া হয়ে উঠলো।

খুব জোরে জোরে বলে উঠলাম—রাম! রাম!

ব্যস, যেই ‘রাম’ ‘রাম’ বলা, আমার সঙ্গের সেই লোকটা দেখতে দেখতে ওই বামন তিনটের মত ছোট হয়ে গেল। এতক্ষণে বুঝলাম—ওরে শালা! তুমি মানুষ নও, – তুমিও ভূত!

আমি দেখলাম, ছুটে সেখান থেকে পালিয়ে যদি যাই তো বেটারা পেয়ে বসবে। আর অন্ধকারে সেই অজানা রাস্তায় যাবই বা কোথায়? বুক ফুলিয়ে সেইখানেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রাম-নাম উচ্চারণ করতে লাগলাম। ভূত চারটে তখন ইটের পাজার কাছে সরে গেছে। সেই যে বাছুরের মত যেটাকে দেখেছিলাম, সেটাও ঠিক তাদেরই মত হয়ে সঙ্গীদের কাছে এসে দাঁড়ালো। সেটার রঙটা কিন্তু সাদাই রইলো। সে-ব্যাটা বোধহয় সাহেব-ভূত। এই পাঁচটা ভূত তখন সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে পাঁচ-দুগুণে দশটা প্রকাণ্ড লম্বা লম্বা হাত বের করে আমায় ডাকতে লাগলো-আঁয়! আয়! আঁয়!’

রাম-নাম করছি আর কি করব ভাবছি, হঠাৎ দূরের গাঁয়ে একটা মোরগ ডেকে উঠলো। ঠাণ্ডা বাতাস অনেকক্ষণ থেকেই বইছিল। বুঝলাম—সকাল হয়ে গেছে।

বাঁচা গেল।

চারিদিক ফরসা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভূতগুলো হঠাৎ আমার চোখের সুমুখ থেকে একে একে কেমন করে যে কোনদিক দিয়ে উধাও হয়ে গেল বুঝতে পারলাম না।

.

এমনি একটি দুটি নয়, কত গল্প।।

গল্প শুনিয়া শুনিয়া শেষে এমন হইল যে, খালাসীগুলো রঞ্জনের কাছে গল্প শুনিতেও ছাড়ে না, অথচ অন্ধকারে একা কোথাও যাইতে হইলে ভয়ে মরে।

দু’একজন খালাসী রঞ্জনকে জিজ্ঞাসা করে, ‘আচ্ছা, এত এত কাণ্ড যে করেছ রঞ্জন, তোমার ভয় কোনোদিন পায়নি?’

কথাটা রঞ্জন হাসিয়া উড়াইয়া দেয়। বলে ‘পাগল। নিজে ভয় পেলে কি এত-সব করতে পারি, তাহলে এতদিন মরেই যেতাম।’

‘তা বটে!’

সে কথা সত্যি।

.

সেদিন সায়েব-ভূতের গল্প চলিতেছিল।

একটা সায়েব-ভূত কেমন করিয়া রঞ্জনের হাত হইতে একদিন একটা পাঁঠার মুণ্ডু কাড়িয়া লইতে আসিয়াছিল—তাহারই গল্প।

রাত্রি তখন প্রায় এগারোটা। সন্ধ্যায় একটুখানি জ্যোৎস্না উঠিয়াছিল। তাহার পর চাঁদ ডুবিয়া গিয়া আবার চারিদিক অন্ধকার হইয়া গেছে।

রাম সিং বাহিরে লাইনের ধারে বসিয়া গাঁজা টানিতেছিল। রঞ্জনও গাজা খায়।

নিজের খাওয়া শেষ হইলে রাম সিং ডাকিল, ‘এসো রঞ্জন, টানবে তো এসো।’

রঞ্জন এদিক-ওদিক তাকাইয়া বলিল, ‘নিয়েই এসো না কল্‌কেটা এইখানে।’

রাম সিং বলিল, ‘গাড়ি পেরোবে, আমার যাবার উপায় নেই। তুমি এসো।’

চারজন খালাসী বসিয়া বসিয়া গল্প শুনিতেছিল। রঞ্জন তাহাদেরই একজনকে বলিল, ‘যা না ভাই, নিয়ে আয় কলকেটা।’

কেহই আর যাইতে চায় না। এ-উহার মুখ চাওয়া-চাওয়ি করিতে থাকে।

রঞ্জনও ওঠে না।

সকলেরই মনে কেমন যেন সন্দেহ হইল। একজন খালাসী বলিয়া উঠিল, ‘কেন, তোমারও ভয় পাচ্ছে নাকি রঞ্জন?’

রঞ্জন খুব জোরে হো হো করিয়া খানিকটা হাসিয়া বলিল, ‘দূর বোকা! হাতী-ঘোড়া গেল তল… শেষকালে কিনা এই কলকে আনতে যেতে আমার ভয়। তোরা সব হলি কি রে! আমি এত কাণ্ড করলাম আর তোরা এই সামান্য ঘর থেকে বেরিয়ে কলকেটা এনে দিতে পারিস না?’

রঞ্জন আর কিছুতেই উঠে না। বলে, ‘শোন, তারপর কি হলো শোন।’ বলিয়া তাহার অর্ধসমাপ্ত গল্পটি আবার আরম্ভ করিবার আগে একবার গলাটা তাহার পরিষ্কার করিয়া লয়। ওদিকে গাজার কলিকার আগুন হয়ত নিভিয়া গেল; মন তাহার পড়িয়া থাকে সেইখানেই। অথচ সেখানেও যাইতে পারে না, গল্পও তেমন জমে না।

অবশেষে রাম সিং নিজেই উঠিয়া আসিয়া কলিকাটা রঞ্জনের হাতে দিয়া তাহাকে এই অবস্থা-সঙ্কট হইতে বাঁচায়।

কিন্তু তাহার এই অনুরক্ত শ্রোতা কয়টির সেইদিন হইতে মনে কেমন যেন একটা খট্‌কা লাগিয়া থাকে।

তবে কি রঞ্জনের সব বানানো গল্প নাকি?

সত্য গোপন করিয়া চিরকাল ধরিয়া একটা মানুষ কখনও পৃথিবীর আর সকলকে ঠকাইতে পারে না। সত্য একদিন প্রকাশ হইয়া পড়ে। সে নিজে ঠকে।

রঞ্জনের বেলাও তাহাই হইল।

একটু একটু করিয়া একদিন সকলে জানিয়া ফেলিল যে, রঞ্জন অত্যন্ত ভীতু। তাহাই সে গোপন করিয়া এতদিন সকলকে উল্টা বুঝাইয়াছে।

তখন আর যায় কোথা!

খালাসীরা তাহাকে ক্ষেপাইতে থাকে। যে তাহাকে দেখিতে পায় সে-ই একটুখানি বলিতে

কসুর করে না।

‘কি হে, রঞ্জন যে! বল না তোমার সেই মামদো ভূতের গল্পটা, বল না শুনি।’

‘আচ্ছা রঞ্জন, কেমন করে তুমি ভূতের সঙ্গে যুদ্ধ করেছিলে?’

‘কটা।’

রঞ্জনের কালো মুখও লাল হইয়া উঠে। কখনও বা তাহাদের ধমক দিয়া সরাইয়া দেয়, কখনও বা নিজেই সরিয়া পড়ে।

.

ক্ষেপায় না শুধু রাম সিং।- সে-ই তাহার একমাত্র আশ্রয়।

ফটকের ঘরে গল্প বলার মজলিস এখন ভাঙ্গিয়াছে।

বেলা তিনটা হইতে ছটা পর্যন্ত সময়টা এখন যেন তাহার আর কাটিতেই চায় না। রাম সিং-এর কাছে চুপ করিয়া বসিয়া থাকে। কখনও-বা বসিয়া বসিয়া গাঁজা টানে।

গাঁজা টানিতে টানিতে তাহাদের সুখ-দুঃখের কথা হয়।

রাম সিং বলে, তাহার আপনার বলিতে আর কেহ নাই।

রঞ্জনও একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বলে, ‘আমারও। একটি মেয়ে ছিল তার শ্বশুরবাড়িতে। কচি একটি মেয়ে রেখে শুনছি সেটাও মরেছে।’

এমনি করিয়া এই দুই আত্মীয়-স্বজন বন্ধুবান্ধবহীন প্রৌঢ়ের দিন কাটিতে থাকে।

রাম সিং বলে, ‘আমি আর বাঁচব না ভাই।’

রঞ্জন বলে ‘আমিও।’

কিন্তু মরা-বাঁচার কর্তা যিনি, তিনি হয়ত ইহাদের এই কথাবার্তা শুনিয়া অলক্ষে থাকিয়া একটুখানি হাসেন।

মরিব বলিলেই মরা হয় না।

মৃত্যু যখন আসে তখন একেবারে অকস্মাৎ আসিয়া পড়ে। কাহারও মুখ চাহিয়া কখনও সে থমকিয়া দাঁড়ায় না।

.

বছরখানেক পরে রাম সিং সত্যই একদিন শয্যা গ্রহণ করিল এবং সাতদিন ক্রমাগত জ্বর ভোগের পর একদিন সকালে সে ক্ষীণকণ্ঠে ডাকিল ‘রঞ্জন।’

রঞ্জন কাছেই বসিয়াছিল। বলিল, ‘কি?’

রাম সিং বলিল, ‘চললাম।’

‘সে কি রামসিং! ছি! ওকথা বলতে নেই।’

বলিয়া বন্ধুকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে রঞ্জন কাঁদিয়া ফেলিল।

চোখের জল গোপন করিবার জন্য যেমনি সে মুখ ফিরাইয়াছে রাম সিং আবার ডাকিল, ‘রঞ্জন।’

চোখ মুছিয়া রঞ্জন বলিল, ‘কি। কি হয়েচে তোমার বল তো রাম সিং?’

রামসিং বলিল, ‘বুকের ভেতরটা আমার কেমন যেন করছে রঞ্জন। কেউ আমার নেই জানি, তবু আজ মরতে কেমন যেন কষ্ট হচ্ছে ভাই।’

শিয়রের কাছে রঞ্জন চুপ করিয়া বসিয়াই রহিল।

রাম সিং তাহাকে আরও কাছে সরিয়া আসিতে বলিয়া চুপি চুপি বলিল, ‘কিছু টাকা আছে। অনেক দিন থেকে জুগিয়ে রেখেছিলাম। তোমাকেই দিয়ে গেলাম, তুমি খরচ কোরো।’

বলিয়া সে তাহার বালিসের তলাটি দেখাইয়া দিয়া হাঁপাইতে লাগিল।

তাহার পরও সে আধঘণ্টা বাঁচিয়া ছিল, কিন্তু তাহাকে ঠিক বাঁচিয়া থাকা বলে না, সে যেন মৃত্যুকে প্রাণপণে ঠেকাইয়া রাখিবার ব্যর্থ চেষ্টা মাত্র।

.

চেষ্টা সফল হইল না।

আরও দশজন ঠিক যেমন করিয়া মরে রাম সিংও মরিল ঠিক তেমনি করিয়াই। রাত্রি তখন প্রভাত হইয়াছে।

ষ্টেশন-মাষ্টার নিজে কয়েকজন খালাসী এবং রঞ্জনকে সঙ্গে লইয়া শবদাহ করিয়া ষ্টেশনে ফিরিয়া যখন আসিলেন বেলা তখন প্রায় দুইটা।

সকলেই বলিতে লাগিল, বুড়ার টাকা ছিল।’

ষ্টেশন-মাষ্টার রঞ্জনকে কাছে ডাকিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘তুমি তো শেষ পর্যন্ত কাছেই ছিল ওর, টাকা-কড়িগুলি কী করলে বল দেখি?’

রঞ্জন এদিক-ওদিক তাকাইয়া ঢোঁক গিলিয়া বলিল, ‘কই টাকাকড়ির কথা তো কিছু আজ্ঞে—জানি না আমি!’

কথাটা রঞ্জন গোপন করিল।

ভাবিয়াছিল, দুনিয়ায় তাহার আর নিজের বলিতে কেই-বা আছে, খাইতে পরিতে দিবারও কেহ নাই, সুতরাং রাম সিং-এর এই টাকার কথা কাহাকেও সে বলিবে না। তাহাই লইয়া সে যেখানে হোক চলিয়া যাইবে এবং এই টাকাগুলি ভাঙ্গিয়াই জীবনের বাকি কয়টা দিন কাটাইয়া দিবে।

ষ্টেশন মাষ্টার বিশ্বাস করিলেন না।

বলিলেন, ‘এখন তুই কী করবি ভেবেছিস? থাকবি কোথায়?’

রঞ্জন বলিল, ‘এইখানে যেখানে হোক পড়ে থাকব হুজুর।’

‘খাবি কি? গাঁজার পয়সা কে জোগাবে?’

রঞ্জন কি জবাব দিবে প্রথমে ভাবিয়া না পাইয়া হাত জোড় করিয়া ভয়ে থরথর করিয়া কাঁপিতে কাঁপিতে কাঁদিয়া ফেলিল। বলিল, ‘গাড়িতে গাড়িতে ভিক্ষে করব হুজুর, দু-এক পয়সা যা পাই…’

তাহার কান্না দেখিয়া মাষ্টারের দয়া হইল। বলিলেন, ‘তার চেয়ে তুই এক কাজ কর রঞ্জন। রাম সিং-এর কাজটা তুই নে। ওই ঘরে গিয়ে থাক, আঠারো টাকা মাইনে, মন্দ কি, তোর ভালই হবে।’

কিন্তু তাহাতে রঞ্জনের আপত্তি আছে।

দিনের বেলা কাজ করিতে আপত্তি নাই, কিন্তু রাত্রে—ওখানে ওই নিরিবিলি জায়গায় একা, তাহার উপর রাম সিং যে ঘরে তাহার চোখের সুমুখে মরিয়াছে, সেই ঘরে বাস করা তাহার পক্ষে অসম্ভব।

ষ্টেশন মাষ্টার হাসিলেন। রঞ্জনের সাহসের কথা তখন জানাজানি হইয়া গেছে। তিনিও জানিতেন। বলিলেন, ‘চুপ করে রইলি যে? ভয় পাবে? দূর বোকা! ভয় কিসের?’

এমন সময় ঘরের ভিতর ক্রিং ক্রিং করিয়া টেলিগ্রাফের ঘণ্টা বাজিল। মাষ্টার মশাই ভিতরে চলিয়া গেলেন।

তাহার স্থির সিদ্ধান্ত কিছুই আর সেদিন হইল না। একজন খালাসী গিয়া রাম সিং-এর কাজ করিতে লাগিল।

.

ষ্টেশন-ঘরের বাহিরের বারান্দায় ওজন করা লোহার যন্ত্রটার উপর কাপড় গায়ে দিয়া জড়োসড়ো হইয়া রঞ্জন দিবারাত্রি শুইয়া থাকে।

মাষ্টারমশাই লোকটি খুব ভাল মানুষ। প্রথম দিন তাহাকে তিনি বাসায় ডাকিয়া লইয়া গিয়া এক পাতা ভাত দিয়াছিলেন।

দ্বিতীয় দিন কেহ আর তাহাকে ডাকে নাই।

ট্রেনের কয়েকজন যাত্রীর কাছে ভিক্ষা করিয়া তিন আনা পয়সা পাইয়াছিল। তাই দিয়া দুপুরে সে গাঁজা কিনিয়া আনিয়া ফটকের কাছে বসিয়া বসিয়া সারাদিন সে গাঁজাই খাইয়াছে আর ভাবিয়াছে—কি করা যায়।

খালি পেটে গাঁজা টানিয়া নেশা তাহার বেশ ভালই ধরিয়াছিল, সন্ধ্যার আগেই সে ফটকের কাছ থেকে উঠিয়া আসিয়া আবার তাহার সেই নির্দিষ্ট স্থানটিতে আসিয়া বসিল।

কখন ঘুমাইয়া পড়িয়াছিল মনে নাই। সকালে ঘুম ভাঙ্গিতেই রঞ্জন তাহার কোমরে হাত দিয়াই চমকিয়া উঠিল। এদিক-ওদিক হাতড়াইয়া, কাপড় ছাড়িয়া, উঠিয়া দাঁড়াইয়া দেখিল, রাম সিং-এর দেওয়া তাহার সেই টাকার থলেটি উধাও।

কে লইয়াছে, কেমন করিয়া লইয়াছে কিছুই সে বুঝিতে পারিল না। এ সম্বন্ধে কাহাকেও কিছু জিজ্ঞাসা করিবার উপায় নাই, চেঁচাইয়া কাঁদিয়া ছুটিয়া বেড়াইতে পারে না, – কি যে করিবে বুঝিতে না পারিয়া হতভম্বের মত রঞ্জন ফ্যাল ফ্যাল করিয়া তাকাইয়া মাথায় হাত দিয়া চুপ করিয়া বসিয়া পড়িল।

মাথাটা তাহার ঘুরিতেছিল, সঙ্গে সঙ্গে মনে হইল, তাহার চোখের সুমুখে সমস্ত বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডও যেন ঘুরিতেছে।

একটি দিনের মধ্যেই রঞ্জনের অবস্থা হইল ঠিক পাগলের মত। দেখিয়া মনে হইতে লাগিল, এই একটি দিনেই তাহার বয়স যেন বাড়িয়া গেছে। চোখ দুইটা কোটরে ঢুকিয়াছে, গাল দুইটি বসা, চুলগুলো উস্কোখুস্কো, দৃষ্টি উদাস। একদিকে যাইতে আর একদিকে যায়, ডাকিলে সাড়া দেয় না, কি বলিতে যে কি বলে নিজেই তাহা বুঝিতে পারে না।

টাকার শোকে পুরা দুটি দিন সে জলগ্রহণ করিল না।…

তিন দিনের দিন গলা দিয়া আর কথা বাহির হয় না। একেবারে মরিবার মত অবস্থা।

ষ্টেশন মাষ্টার তাঁহার বাসা হইতে ষ্টেশনে আসিতেছিলেন, হঠাৎ পথের মাঝখানে হাতজোড় করিয়া টলিতে টলিতে রঞ্জন তাঁহার পথ আগলাইয়া দাঁড়াইল। —’হুজুর!’

‘কিরে! এ কি চেহারা তোর?’

রঞ্জন বলিল, ‘ফটকের চাকরিটি আমায় দিন।’

মাষ্টার-মশাই বলিলেন, ‘দিতেই তো চেয়েছিলাম রে গাধা।’

রঞ্জন বলিল, ‘আজ তাহলে আমি আমার ছোট নাতনীটিকে নিয়ে আসি হুজুর। তাকেই কাছে রাখব।’

মাষ্টারের দয়া হইল। বলিলেন, ‘তাই যা। আমার বাসায় খেয়ে যাস।’

দু’দিন না খাইয়া অন্তরাত্মা তাহার কাঁদিতেছিল; খাবার নামে মাষ্টার মশাই-এর পায়ের কাছে একেবারে ভূলুণ্ঠিত হইয়া একটি প্রণাম করিয়া বলিল, ‘যে আজ্ঞে।’

ফটকের চাকরিটি করিবার ইচ্ছা তাহার মোটেই ছিল না, তবু তাহাকে করিতে হয়।

পেটের জ্বালা বড় জ্বালা!

মানুষ দেয় ত বিধাতা দেয় না। টাকাগুলি থাকিলে এ-কষ্ট আর সহ্য করিতে হইত না।

সাত বছরের ছোট নাতনীটি! নাম কালী, পায়ে মল, নাকে নোলক, — চব্বিশ ঘণ্টা দাদামশাই-এর কাছে কাছে থাকে, রান্নার সময়ে এটা সেটা যোগাড় করিয়া দেয়, শুকনো কাঠ কুড়াইয়া আনে, ফুঁ দিয়া দিয়া উনান ধরায়, এক-একদিন তরি-তরকারি আনিবার জন্য একলাই সে হাটে যায়। দূর হইলেও হাটে যাওয়ার কষ্ট কিছুই নাই। যাইবার সময় রঞ্জন তাহাকে ‘বাসে’ চড়াইয়া দেয়, পানিহাটির হাটের কাছে পথের ধারে গিয়া নামে, আসিবার সময় আবার ‘বাসে’ চড়িয়া চলিয়া আসে। বাসওয়ালারা সকলেই তাহাকে চেনে। টিকিট করিতে হয় না।

রঞ্জন দিনের বেলা বলে, ‘কালী, ঘুমো। ‘

তাহার পর সন্ধ্যা হইতে তাহার জাগিবার পালা। ঘুম পাইলেও রঞ্জন তাহাকে ঘুমাইতে দেয় না। গল্প বলিয়া বলিয়া জাগাইয়া রাখে, কোনোদিন যদি বা ঢুলিয়া ঢুলিয়া পড়ে তো রঞ্জন তাহাকে সজোরে একটা চিমটি কাটিয়া দেয়, শেয়াল ডাকিলে ভয় দেখায়, গাছের তলার অন্ধকারকে দেখাইয়া বলে, ‘ওইখানে ভূত আছে, ঘুমোলেই ধরে নিয়ে যাবে।’ বলিয়া নিজেই সে চোখ বুজিয়া তাহাকে জড়াইয়া ধরে।

কিন্তু কালীর সে এক অদ্ভুত ব্যাপার। দিনের বেলা যতই সে ঘুমাক না কেন, সন্ধ্যা হইলে রাজ্যের ঘুম আসিয়া তাহাকে জড়াইয়া ধরে, চোখ দুইটা ছোট হইয়া আসে। রঞ্জনের পায়ের কাছে মাটির উপরেই সে ঘুমাইয়া পড়িতে চায়।

রঞ্জন বলে, ‘আসুক তবে রাম সিং, ধরুক তোকে!

রাম সিং-এর আসা তেমন আশ্চর্য কিছু নয়।

সেদিন সে রাত্রের ট্রেনখানা পার করিয়া উত্তর দিকের ফটকটা বন্ধ করিবে, এমন সময় রাস্তার ধারের ওই বাঁশগাছের তলা হইতে এমন একটা শব্দ তাহার কানে আসিয়া ঢুকিল যে, সে না পারিল ছুটিয়া পলাইতে, না পারিল সাহস করিয়া আগাইয়া দেখিতে! –অবিকল রাম সিং-এর গলার কাশির খুকখুক শব্দ। কালী ছিল দূরে দাঁড়াইয়া, তাহাকেও কাছে ডাকিবার মত সামর্থ্য নাই, রঞ্জনের আপাদ-মস্তক তখন শিহরিয়া উঠিয়াছে, মাথার ভিতরটা ঝিম্ ঝিম্ করিতেছে, পা দুইটার অবস্থা নিতান্ত খারাপ, – সে যেন কাঠের পা। না পারে আগাইতে, না পারে পিছাইতে!

আর একদিন অমনি—রাত্রি তখন দুইটা বাজিয়া গেছে, সাড়ে-তিনটার গাড়িটা পার করিবার জন্য রঞ্জনের ঘুম ভাঙিয়াছে। অন্ধকার রাত্রি। কালী আর কিছুতেই উঠে না। যত উঠাইবার চেষ্টা করে, ততই সে হাউ-মাউ করিয়া কাঁদিয়া ওঠে। অবশেষে ভাবিল, সে নিজেই বাহির হইবে। হাতে লণ্ঠন—ভাবনা কী! রাম সিং তাহার অনিষ্ট কিছু করিবে না।

সাহসে ভর করিয়া হড়াম করিয়া দরজা খুলিয়া যেমন বাহির হওয়া অমনি—

‘বাপ রে!’ বলিয়া লণ্ঠন-সমেত ডিগবাজি খাইয়া গড়াইতে গড়াইতে রঞ্জন একেবারে ফটকের কাছে।

মরে নাই—এই তাহার চৌদ্দপুরুষের ভাগ্য!

হাত কাটিয়াছে, নাক কাটিয়াছে, পায়ের খানিকটা ছড়িয়া গিয়া রক্ত পড়িয়াছে। লণ্ঠনের কাঁচটা অত্যন্ত পুরু, ছিটকাইয়া দূরে পড়িয়াও সেটা ভাঙ্গে নাই।

সেইদিন হইতে তাহার ধ্রুব বিশ্বাস – রাম সিং এখনও সে জায়গাটার মায়া পরিত্যাগ করিতে পারে নাই। এখনও সে রোজই সেখানে আসে। সাদা ধপধপে কাপড় পরিয়া খড়ম পায়ে দিয়া দরজার কাছে হাত পাতিয়া সে গাঁজা খাইতে চায়।

সেদিন তাহাকে সে স্বচক্ষে দেখিয়াছে।

রঞ্জনকে সে অত্যন্ত ভালবাসিত, এবং ভালবাসিত বলিয়াই বোধ করি সেদিন সে তাহাকে ভয় পাইয়া পড়িয়া যাইতে দেখিয়া তৎক্ষণাৎ অদৃশ্য হইয়া গেল, তাহা না হইলে কলিকাটা হয়ত চাহিয়াই বসিত।

রঞ্জন ভাবে তাহার সাহস আজকাল অত্যন্ত বাড়িয়াছে বলিয়াই এখানে সে কাজ করিতে পারে, অন্য লোক হইলে কবে পলাইত তাহার ঠিক নাই।

অন্ধকার রাত্রে একটুখানি বাতাস বহিলেই রাস্তার পাশে বাঁশঝাড়গুলো ঝড় ঝড় কট্‌ কটূ করিয়া নানারকম শব্দ করিতে থাকে, ‘বাস’ চলাচল থামিবামাত্র শেয়াল-ডাকা শুরু হয়, তাহার উপর ভূতের উৎপাত।

যে তাহার টাকা চুরি করিয়াছে রঞ্জন তাহাকে মনে-মনে অভিসম্পাত করে। আজ যদি তাহার সে টাকাগুলি থাকিত! হায় হায়, বৃথাই তাহা হইলে এ লাঞ্ছনা তাহাকে আর সহ্য করিতে হইত না। হে ভগবান! যে তাহার টাকা লইয়াছে সে যেন মরে। ওই টাকা তাহার যেন শ্রাদ্ধে খরচ হয়!

বলিতে বলিতে ঝর ঝর করিয়া সে কাঁদিয়া ফেলে।

.

এমনি করিয়াই দিন চলে।

কালী এখন বেশ বড় হইয়াছে। রান্নাবান্না নিজেই করে। কিন্তু ঘুম তাহার এখনও ঠিক তেমনিই আছে।

রঞ্জন তাহাকে গালাগালি দেয়। মর্ হারামজাদী, ওই ঘুমিয়ে ঘুমিয়েই মর্ তুই।’

কালী হাসে। বলে, ‘এত গালাগালি কেন দাও বল ত তুমি, লোকে শুনলে যে হাসে।’

রঞ্জন আজকাল সমস্ত দুনিয়াটার উপরেই সর্বদা চটিয়াই থাকে। বলে, ‘হাসে ত’ তোর কি হারামজাদী! তুই মর্ না। ম’লেই ত আমি বাঁচি।’

‘আমিও বাঁচি।’ বলিয়া কালী রাগ করিয়া ঘরের কাজকর্ম ফেলিয়া চুপ করিয়া বসিয়া থাকে।

রঞ্জন তখন আবার নিজেই ধীরে ধীরে উঠিয়া যায়। গায়ে হাত দিয়া বলে, ‘রাগ করেছিস দিদি? ছি! বুড়োর উপর রাগ করতে আছে?’

বলিয়া নিজেই খানিকটা কাঁদে। বলে, ‘আমার কপাল! নইলে এত লোক মরে, আর আমি বেঁচে থাকি।’

ফটকের দক্ষিণ দিকে মাইলখানেক দূরে ছোট্ট একখানি গ্রাম, নাম—হরিশপুর

হরিশপুরে সেদিন এক মহা অঘটন ঘটিল। বিদেশী এক ভদ্রলোক আসিয়াছিলেন— গ্রামে হোমিওপ্যাথী ডাক্তারী করিতে। ভাবিয়াছিলেন, ছোট গ্রাম, ওখানে বসিলে হয়ত পয়সা-কড়ি হইতে পারে। তাই শহর ছাড়িয়া একা আসিয়া হরিশ পুরে তিনি বাস করিয়াছিলেন। ইচ্ছা ছিল—ভবিষ্যতে উন্নতি যদি কোনোদিন করিতে পারেন তখন মেয়েছেলে আনিবেন।

কিন্তু এমনি বিধির নির্বন্ধ যে, মেয়েছেলে তাঁহাকে আনিতে হইল না, হঠাৎ সকালে একদিন তাঁহার কলেরা হইল এবং সেই নির্বান্ধব অবস্থায় স্ত্রী-পুত্র-কন্যা আত্মীয়-স্বজন হইতে বহুদূরে রাত্রি আটটার সময় হরিশপুরগ্রামেই তিনি প্রাণত্যাগ করিলেন।

কলেরা হইবার পর হইতেই গ্রামের লোক সেবাযত্নের ত্রুটি কিছুই করে নাই। দুপুরে তাঁহার বাড়িতে একখানা টেলিগ্রামও করিয়াছে কিন্তু তখনও পর্যন্ত দেশ হইতে কেহ আসিয়া পৌঁছে নাই।

মুস্কিল বাধিল সৎকারের ব্যবস্থা লইয়া। মৃতদেহ এমন করিয়া ঘরের মধ্যে ফেলিয়া রাখা চলে না, তাহার উপর কলেরা রোগী গ্রাম হইতে যত শীঘ্র বাহির করিয়া দেওয়া যায় ততই ভালো, অথচ মুখাগ্নি করিবার লোক একজনও দেশ হইতে না আসা পর্যন্ত কি-ই বা করা যায়—এই লইয়া সকলেই অত্যন্ত চিন্তিত হইয়া পড়িল।

শীতকাল। এমনিই সহজে লোকজন ঘরের বাহির হইতে চায় না, তায় আবার রাত্রিকালে ক্রোশখানেক পথ অতিক্রম করিয়া শ্মশানে যাইতে কেহই প্রথমে রাজি হইল না। পরে জনকয়েক ছোকরাকে অতিকষ্টে রাজি করাইয়া ডাকিয়া আনা হইল। বাড়ি বাড়ি কাঠ-কয়লা সংগ্রহ করিয়া গাড়ি বোঝাই দিয়া একজন চাষার ছেলে সেগুলা সর্বাগ্রে শ্মশানে ফেলিয়া দিয়া আসিল। যে চারজন লোক দয়া করিয়া শবদাহের জন্য প্রস্তুত হইয়া আসিয়াছিল, কথা হইল, মৃতদেহটিকে তাহারা গ্রাম হইতে বাহির করিয়া লইয়া গিয়া ফটকের কাছে কোথাও নামাইয়া রাখিয়া অপেক্ষা করিবে। এখনও যখন লোকজন কেহ তাঁহার দেশ হইতে আসিল না, রাত্রি সাড়ে বারোটা কিংবা দেড়টার ট্রেনে নিশ্চয়ই আসিবে, এবং আসিলে তাহাকে ওই ফটকের পাশ দিয়াই গ্রামে আসিতে হইবে, সুতরাং ওই পথে তাহাকে একেবারে শ্মশানে লইয়া যাওয়াই ভালো।

সেদিন বোধকরি অমাবস্যার রাত্রি। কোলের মানুষ চেনা যায় না-এত অন্ধকার। একজন লণ্ঠন লইয়া আগে আগে চলিল, আর বাকি চারজনে ছোট একটি দড়ির খাটিয়ায় মৃতদেহ লইয়া পশ্চাতে চলিতে লাগল। চারজনে ভারী মৃতদেহ অতখানা পথ বহিয়া লইয়া যাওয়া শক্ত। মাঝে মাঝে নামাইয়া কাঁধ পালটাইয়া ফটকের কাছে তাহারা যখন আসিয়া পৌঁছিল, সাড়ে বারোটার গাড়িটা তখনও আসে নাই। সবেমাত্র একটা বাস পার হইয়া গেল বলিয়া ফটক তখনও খোলা। রঞ্জনের ঘরে আলো জ্বলিতেছিল। দেখা গেল, সে খাইতে বসিয়াছে। শব-বাহকেরা পরামর্শ করিল যে, জানিতে পারিলে রঞ্জন হয়ত মৃতদেহ এখানে নামাইতে দিবে না সুতরাং তাহাকে কিছু না জানানোই উচিত।

এই ভাবিয়া নীরবে তাহারা ফটক পার হইয়া খাটিয়াটাকে ধীরে ধীরে লাইনের পাশে নামাইয়া রাখিয়া সকলে মিলিয়া রঞ্জনের ঘরের দরজার কাছে গিয়া ডাকিল, ‘কি করছ রঞ্জন, খেতে বসেছ নাকি?’

এত রাত্রে লোকজন দেখিয়া রঞ্জন অবাক হইয়া একবার তাহাদের মুখের পানে তাকাইল। কিন্তু কাহাকেও ভাল চিনিতে না পারিয়া বলিল, ‘কে?’

গুরুপদ বলিল, ‘আমি গুরুপদ—হরিশপুরের। চিনতে পারছ না?

গুরুপদকে রঞ্জন চেনে। বাজারের ফেরত বাস হইতে নামিয়া প্রায়ই সে রঞ্জনের কাছে গাঁজা খাইয়া যায়।

গুরুপদ বলিল, ‘খাও, ততক্ষণ আমরা তামাকটা তৈরি করি। সাড়ে বারোটার গাড়িতে একজন লোক আসবে ভাই, কে আর যায় ষ্টেশন পর্যন্ত, ভাবলাম, এই পথেই তো আসবে, তার চেয়ে এইখানে বসে বসে তামাকটাও খাওয়া যাক, গল্পও করা যাক।’

এত রাত্রে গল্প করিবার লোক পাইয়া রঞ্জন অত্যন্ত খুশি হইয়াই তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করিয়া বাহিরে আসিল।

গাঁজা খাইয়া গল্প করিতে করিতে ট্রেন আসিয়া পৌঁছিল।

কিন্তু বসিয়া বসিয়া আরও এক ছিলিম গাঁজা খাইয়া তাহারা বহুক্ষণ অপেক্ষা করিয়াও দেখিল, হরিশপুরের কোনও লোক সে পথ দিয়া পার হইল না। এ ট্রেনেও কেহ আসে নাই।

আবার সেই রাত্রি দেড়টায় ট্রেন।

তাহার পর তিনটায়।

রঞ্জন বলিল, ‘নিয়মকানুন সব ঘন ঘন বদলাচ্ছে। বুঝলে গুরুপদ, আগে বেশ ছিল। আমার হয়েছে মুস্কিল। রাত জেগে জেগে হয়রান হয়ে গেলাম ভাই।’

গুরুপদ জিজ্ঞাসা করিল, ‘তাহলে তো সারারাতই তুমি এক রকম জেগে রইবে বল? বাহাদুরী করিয়া রঞ্জন বলিল, ‘জেগে কি রকম? এই শীতকালে ঠায় এই পথের ধারে বসে বসে আমায় পাহারা দিতে হয় সেই তিনটে পর্যন্ত। তিনটের পর একটু গড়িয়ে নিই অভ্যেস হয়ে গেছে, বুঝলে গুরুপদ, অভ্যেস হয়ে গেছে।’

গুরুপদ তাহার সঙ্গীদের চোখের ইসারা করিয়া বলিল, ‘আর কেন, ওঠো তাহলে। উঠি রঞ্জন।’

এতক্ষণ বেশ ছিল। রঞ্জন বলিল, ‘বসোই না। দেড়টার ট্রেন আর কতক্ষণ! দেখেই যাও।’

‘না, সে আর আসবে না বোধহয়।’ বলিয়া গুরুপদ তাহার সঙ্গীদের ফটকের বাহিরে লইয়া গিয়া চুপি চুপি বলিল, ‘যা হয় হবে এবার দেখা যাবে কাল সকালে। শীতে আর আমাদের কর্মভোগ কেন, চল বাড়ি যাই।’

বাড়ি যাইবার ইচ্ছা সকলেরই। কিন্তু তবু এ ব্যাপারটা কেমন যেন কাহারও উচিত বলিয়া মনে হইল না। মৃতদেহ পড়িয়া রহিল পথের পাশে—তাহারা বাড়ি চলিল—

অনুচিত বুঝিয়াও এক পা এক পা করিয়া আগাইতে আগাইতে তাহারা মাঠের মাঝে অনেকখানি পথ চলিয়া আসিল।

হঠাৎ সেই ঘন অন্ধকার শীত-রাত্রির নিস্তব্ধতা ভেদ করিয়া পশ্চাদ্দিক হইতে কাহার যেন একটা বিকট চিৎকার তাহাদের কানে আসিয়া বাজিতেই সকলেই একসঙ্গে থমকিয়া দাঁড়াইয়া পড়িল।

উৎকর্ণ হইয়া আবার তাহারা শুনিবার চেষ্টা করিল কিন্তু আর কিছুই শোনা গেল না।

গুরুপদ হো হো করিয়া হাসিয়া উঠিল। বলিল, ‘ব্যাটা দেখেছে এইবার। দেখেই হয়ত আঁৎকে চেঁচিয়ে উঠেছে। বুঝলি?’

সকলেই একটুখানি কৌতুক অনুভব করিল। বলিল, ‘ঠিক্। তাই বটে।’

বলিয়াই আর সেদিকে কর্ণপাত না করিয়া আবার তাহারা পথ চলিতে লাগিল।

পথের ধারে একটা চণ্ডীমণ্ডপে আলো জ্বালিয়া আগাগোড়া মুড়ি দিয়া বসিয়া তখনও পর্যন্ত জনকয়েক মুরুব্বি-মাতব্বরগোছের লোক ডাক্তারবাবুর এই আকস্মিক মৃত্যুর কথা লইয়াই আলোচনা করিতেছিল, এত শীঘ্র তাহাদের শ্মশান হইতে ফিরিয়া আসিতে দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিল, ‘হয়ে গেল এরই মধ্যে? সে কি রে?’

আগাগোড়া ব্যাপারটা গুরুপদ তাহাদের জানাইয়া বলিল, ‘আমরা আর পারব না বাপু এই শীতের রাতে মড়া আগলে বসে থাকতে। তোমরা যাহোক এর ব্যবস্থা-টেবস্থা কর।’

কিন্তু সকলেই তাহাদের দোষ দিতে লাগিল।

ছি ছি, তোরা করেছিস কি! লোক না এলো, অপেক্ষা করতে না পারলি, – তোরা দাহ করেই ফিরে এলি না কেন? রাত্রিকাল—মড়া ফেলে দিয়ে এলি, শেয়ালে কুকুরে টানাটানি করবে। ছি বাবা ছি। চল্–আমরাও যাই, চল হে চল, আহা বিদেশী ব্রাহ্মণ—’

বলিতে বলিতে সেই পথেই তাহাদের আবার ফিরাইয়া লইয়া বৃদ্ধেরাও চলিল। গুরুপদ সারারাস্তা শুধু এই কথা বলিতে বলিতে চলিল যে, না, এত বোকা বেকুব তাহারা নয়, মড়াটাকে শেয়াল-কুকুরে টানাটানি কখনই করিবে না। মৃতদেহ তাহারা নিরাপদ স্থানেই রাখিয়া আসিয়াছে, রঞ্জন সারারাত জাগিয়া সেখানে পাহারা দিবে।

তাহারা ফটক পার হইয়া লাইনের ধারে গিয়া দেখিল, তাহারা যাহা বলিয়াছিল ঠিক তাই। রঞ্জন পাহারা দিতেছে কি না কে জানে, তবে দেখা গেল, মৃতদেহের অত্যন্ত সন্নিকটে সে শুইয়া রহিয়াছে।

শুইয়া থাকিবার কারণ অনুসন্ধান করিতে গিয়া হাতের লণ্ঠন দুইটা তুলিয়া তাহারা যাহা দেখিল, তাহা যেমন বিস্ময়কর তেমনি ভয়াবহ! রঞ্জন বোধকরি মৃতদেহের ঢাকা খুলিয়া দেখিতে গিয়াছিল, এবং দেখিতে গিয়া ভয়ে সে আঁতকাইয়া চিৎকার করিয়া ঘুরিয়া পড়িয়াছে।

ঘুরিয়া পড়িয়া আর উঠিতে পারে নাই।

দারুণ ভয়ে তাহার হৃৎস্পন্দন সহসা বন্ধ হইয়া গেছে।

বন্ধু গুরুপদ ঈষৎ হাসিয়া বলিল, ‘সেই যে শব্দ—বলেছিলাম না! – আমার অনুমান কখনও ব্যর্থ হয় না।’

.

রঞ্জন বলিত, ‘নাতনীটা শুধু ঘুমোতেই এসেছে।

সে কথা সত্য।

কালীর ঘুম তখনও ভাঙ্গে নাই। বাহিরে যে এতবড় একটা কাণ্ড ঘটিয়া গেছে তাহার বিন্দুবিসর্গও সে জানে না।

না জানাই ভালো।

আহা ঘুমোক!

অধ্যায় ১ / ১৮

সকল অধ্যায়

১. ভয় – শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়
২. প্রেতপুরী – শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়
৩. ভয়ঙ্কর – শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়
৪. ভূতুড়ে বই – শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়
৫. কি? – শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়
৬. নমস্কার – শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়
৭. অসম্ভব – শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়
৮. ন্যাড়া নন্দী – শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়
৯. ভূতের গল্প – শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়
১০. ভীষণ কাণ্ড – শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়
১১. যবনিকা – শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়
১২. আতঙ্ক – শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়
১৩. প্রেতিনী – শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়
১৪. জীবন নদীর তীরে – শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়
১৫. সত্যি নয় – শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়
১৬. ভূতুড়ে খাদ – শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়
১৭. ঘরোয়া ভূত – শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়
১৮. কে তুমি? – শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন