১০. ফাতিমা বিনত রাসূলিল্লাহ
عن المسور بن مخرمة (رض) أن رسول الله و ئا فاطمة بضاتي من أغضبها أغضبني.
মিসওয়ার ইবনে মাখরামাহ (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূল (ﷺ) ইরশাদ করেছেন, ফাতিমা আমার অংশ বিশেষ, যে তাকে কষ্ট দিল সে আমাকেই কষ্ট দিল। (বুখারী : হাদীস নং-৩৭৬৭)
মারইয়াম বিনতে ইমরান, ফাতেমা বিনতে মুহাম্মদ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর স্ত্রী খাদীজা, ফেরাউনের স্ত্রী আছিয়া জান্নাতী রমণীদের সরদার হবে।
سيدات نساء أهل الجنة عن جابر (رض) قال قال رسول الله بعد مریم بنت عمران فاطمه وخديجة وأسب امرأة فرعون .
জাবের (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ ইরশাদ করেছেন : জান্নাতী রমণীদের সরদার মারইয়াম বিনতে ইমরান এর পরে ফাতেমা, খাদীজা ও ফেরাউনের স্ত্রী আছিয়া। (তাবরানী : সিলসিলা আহাদিস সহীহা লি আলবানী; হাদীস নং-১৪৩৪))
জন্ম ও বংশ পরিচয়
নবী করীম (ﷺ)-এর নবুওয়্যাত প্রাপ্তির পাঁচ বছর আগে উম্মুল কুরা তথা মক্কা নগরীতে ফাতিমা (রা) জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা দু’জাহানের সর্দার রাসূল এবং মাতা গোটা বিশ্বের নারী জাতির নেত্রী, প্রথম মুসলমান উম্মুল মুমিনীন খাদীজা বিন্ত খুওয়াইলিদ (রা)। ফাতিমার যখন জন্ম হয় তখন মক্কার কুরাইশগণ পবিত্র কাবা ঘরের সংস্কার কাজ চালাচ্ছে। সেটা ছিল মুহাম্মদ (ﷺ)-এর নবুওয়্যাত প্রাপ্তির পাঁচ বছর পূর্বের ঘটনা। ফাতিমার জন্মগ্রহণে তার পিতা-মাতা দারুণ খুশী হন।
ফাতিমা ছিলেন কনিষ্ঠা মেয়ে। মা খাদীজা (রা) তার অন্য সন্তানদের জন্য ধাত্রীর ব্যাবস্থা করলেও ফাতিমাকে ধাত্রীর হাতে ছেড়ে দেননি। তিনি তার অতি আদরের ছোট কন্যাকে নিজে দুধ পান করান। এভাবে ফাতিমা (রা) একটি পূতঃপবিত্র ঘরে তার মহান পিতা-মাতার তত্ত্বাবধানে লালিত-পালিত হয়ে বেড়ে ওঠেন এবং নবুওয়্যাতের স্বচ্ছ ঝর্ণাধারায় স্নাত হন।
শ্রেষ্ঠত্বের কারণ
ফাতিমা (রা)-এর মহত্ব, মর্যাদা, আভিজাত্য ও শ্রেষ্ঠত্বের যেসব কথা উল্লেখ করা হয় তার কারণ সংক্ষেপে নিম্নে প্রদত্ত হলো
১. তাঁর পিতা মানব জাতির আদি পিতা আদম (ﷺ)-এর শ্রেষ্ঠ সন্তান রাহমাতুল্লিল আলামীন বিশ্বনবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।
২ তাঁর মা জগতের নারী জাতির নেত্রী, সর্বপ্রথম ইসলাম গ্রহণকারী উম্মুল মু’মিনীন খাদীজা বিন্ত খুওয়াইলিদ (রা)।
৩. স্বামী ইহকাল ও পরকালের নেতা আমীরুল মু’মিনীন আলী (রা)।
৪. তাঁর দুই পুত্র-আল-হাসান ও আল-হুসাইন (রা) জান্নাতের যুবকদের দুই মহান নেতা এবং নবী করীম (ﷺ)-এর সুগন্ধি ।
৫. তাঁর এক দাদা শহীদদের মহান নেতা হামযা (রা)।
৬. অন্য এক দাদা প্রতিবেশীর মান-মর্যাদার রক্ষক, বিপদ-আপদে মানুষের জন্য নিজের অর্থ-সম্পদ ব্যয়কারী, উলঙ্গ ব্যক্তিকে পোশাক দানকারী, অভুক্ত ও অনাহারে- ক্লিষ্টকে খাবার দানকারী আব্বাস ইবন আবদুল মুত্তালিব (রা)। ও তার এক চাচা মহান শহীদ নেতা ও সেনা নায়ক জাফর ইবন আবু তালিব (রা)।
ইসলাম গ্রহণ
নবী করীম (ﷺ)-এর ওপর ওহী অবতীর্ণ হওয়ার পর উম্মুল মু’মিনীন খাদীজা (রা) সর্বপ্রথম তার প্রতি ঈমান আনেন এবং তাঁর নবুওয়্যাতকে সত্য বলে গ্রহণ করেন। আর নবী করীম (ﷺ)-এর প্রতি প্রথম পর্বে যেসব নারী ঈমান গ্রহণ করেন তাদের পুরো ভাগে ছিলেন তাঁর পূতঃ পবিত্র কন্যাগণ। তারা হলেন: যায়নাব, রুকাইয়া, উম্মে কুলছুম ও ফাতিমা (রা)। তারা তাদের পিতার নবুওয়্যাত ও রিসালাতের প্রতি ঈমান গ্রহণ করেন তাঁদের মহিয়ষী মা খাদীজার (রা)-এর সাথে। ইবন ইসহাক আয়েশা (রা)-এর সূত্রে বর্ণনা করেন। তিনি বলেছেন : আল্লাহ যখন তাঁর নবীকে নবুওয়্যাতে ভূষিত করলেন তখন খাদীজা ও তাঁর কন্যারা ইসলাম গ্রহণ করেন। এভাবে নবী করীম (ﷺ)-এর সন্তানগণ তাদের মায়ের সাথে প্রথম ভাগেই ইসলামের আঙ্গিনায় প্রবেশ করেন এবং তাঁদের পিতার নবুওয়াতের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেন। নবুওয়াত প্রাপ্তির আগেই তারা উন্নত মানের নৈতিক গুণাবলিতে বিভূষিত হন। ইসলামের পরে তা আরো সুশোভিত ও সুষমামণ্ডিত হয়ে ওঠে।
ইমাম আয-যুরকানী শারহুল মাওয়াহিব’ গ্রন্থে ফাতিমা ও তার বোনদের প্রথম পর্বে ইসলাম গ্রহণের কথা বলেছেন এভাবে ; তার কন্যাদের কথা উল্লেখের দরকার নেই। কারণ, নবুওয়্যাতের পূর্বেই তাদের পিতার জীবন ও আচার-আচরণ দৃঢ়ভাবে অনুসরণ ও শক্তভাবে আঁকড়ে ধরার বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। অন্য এক জায়গায় আ-যুরকানী নবী-দুহিতাদের ইসলাম গ্রহণের অগ্রগামিতা প্রসঙ্গে বলেছেন এভাবে : মোটকথা, আগেভাগে তাদের ইসলাম গ্রহণের বিষয়ে কোন প্রমাণের দরকার নেই। সর্বাধিক সত্য, সর্বাধিক অভিজাত পিতৃত্ব এবং সর্বোত্তম ও সর্বাধিক স্নেহময়ী মাতৃত্বের ক্রোড়ে বেড়ে ওঠার কারণে তারা লাভ করেছিলেন তাদের পিতার সর্বোত্তম আখলাক তথা নৈতিকতা এবং তাদের মাতা থেকে পেয়েছিলেন এমন বুদ্ধিমত্তা যার কোন তুলনা চলেনা পূর্ববর্তী ও পরবর্তীকালের কোন মহিলার সাথে। কাজেই রাসূল পরিবারের তথা তাঁর স্ত্রী-কন্যাদের ইসলাম ছিল স্বচ্ছ-স্বভাবগত ইসলাম। ঈমান ও নবুওয়্যাত দ্বারা যার পুষ্টি সাধিত হয়। মহত্ব, মর্যাদা ও উন্নত নৈতিকতার ওপর যারা বেড়ে ওঠেন।
শৈশব-কৈশোরে পিতার সহযোগিতা
নবী করীম (ﷺ)-এর ওপর ওহী অবতীর্ণ হলো। তিনি আল্লাহ রাব্বল আলামীনের আদেশ অনুযায়ী মানুষকে ইসলামের দিকে ডাকতে লাগলেন এবং ইসলামের প্রচার-প্রসারে পুরোপুরি আত্মনিয়োগ করলেন। আর এজন্য তিনি যত দুঃখ-কষ্ট, বিপদ-আপদ, অত্যাচার-নির্যাতন, অস্বীকৃতি, মিথ্যা দোষারোপ ও বাড়াবাড়ির মুখখামুখী হলেন, সবকিছুই তিনি উপেক্ষা করতে লাগলেন। এক পর্যায়ে কুরাইশরা নবী করীম (ﷺ)-এর সাথে চরম বাড়াবাড়ি ও শত্রুতা করতে লাগলো। তারা তাকে উপহাস করতে লাগলো, তাঁর প্রতি মানুষকে ক্ষেপিয়ে তুলতে শুরু করলো। ফাতিমা (রা) তখন জীবনের শৈশব অবস্থা অতিক্রম করেছেন।
পিতা যে তাঁর জীবনের একটা কঠিন সময় অতিবাহিত করছেন, কন্যা ফাতিমা এত অল্প বয়সেও তা উপলব্ধি করতে পারতেন। অনেক সময় তিনি পিতার সাথে ধারে কাছে এদিক ওদিক গমন করতেন। একবার দুরাচারী উকবা ইবন আবী মুজতকে তাঁর পিতার সাথে এমন একটি অশালীন আচরণ করতে দেখেন যা তিনি আজীবন ভুলতে পারেননি। আসলে তার জন্মের কোন ঠিক- ঠিকানা ছিল । একজন নিকৃষ্ট ধরণের পাপাচারী ও দুবৃত্ত হিসেবে সে বড় হয়ে ওঠে। তার জন্মের এ কালিমা ঢাকার জন্য সে সব সময় আগ বাড়িয়ে নানা রকম দুকর্ম করে কুরাইশ নেতৃবৃন্দের প্রীতিভাজন হওয়ার চেষ্টা করতো। একবার উকবা মক্কার পাপাচারী পৌত্তলিক কুরাইশদের একটি সমাবেশে বসা ছিল। কিছু সংখ্যক কুরাইশ নেতা বললো : এ যে মুহাম্মদ সিজদায় আছেন। এখানে উপস্থিতদের মধ্যে এমন কে আছে, যে উটের এ পচাগলা নাড়ী-ভুঁড়ি উঠিয়ে নিয়ে তার পিঠে ফেলে আসতে পারে? নরাধম উকবা অতি আগ্রহ সহকারে এ অপকর্মটি করার জন্য রাজী হয়ে বললো : আমি যাচ্ছি। তারপর সে দ্রুত পচা নাড়ী-ভূঁড়ির দিকে চলে গেল এবং সেগুলো উঠিয়ে সিজদারত মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর পিঠের উপর ফেলে দিল। দূর থেকে কুরাইশ নেতারা এ দৃশ্য দেখে অট্ট হাসিতে ফেটে পড়লো। নবী করীম (ﷺ) সিজদা থেকে উঠলেন না। সাথে সাথে এ সংবাদ বাড়ীতে ফাতিমা (রা)-এর কানে গেল। তিনি ছুটে এলেন, অত্যন্ত দরদের সাথে নিজ হাতে পিতার পিঠ থেকে ময়লা সরিয়ে ফেলেন এবং পানি এনে পিতার শরীরে লাগা ময়লা পরিষ্কার করেন। তারপর সে পাপাচারী দলটির দিকে এগিয়ে গিয়ে তাদেরকে অনেক কটু কথা শুনিয়ে দেন। নবী করীম (ﷺ) সালাত শেষ করে দু’হাত উঠিয়ে দু’আ করলেন
اللهم عليك بشيبة بن ربيعة، اللهم عليك بأبي جهل بن عقبة بن أبي مبط، اللهم عليك هشام، اللهم علي بامية بن خلف.
“হে আল্লাহ! তুমি শায়বা ইবন রাবীআকে পাকড়াও কর, হে আল্লাহ! তুমি আবু জাহূল ইবন হিশামকে ধর, হে আল্লাহ! তুমি উকবা ইবন আবী মুঈতকে সামাল দাও, হে আল্লাহ তুমি উমাইয়া ইবন খালাফের খোজ খবর নাও। নবী করীম (ﷺ)-কে হাত উঠিয়ে এভাবে দু’আ করতে দেখে পাষণ্ডদের হাসি থেমে যায়। তারা ভীত- শঙ্কিত হয়ে পড়ে। আল্লাহ তাঁর প্রিয় নবীর দুআ কবুল করেন। উল্লেখিত চার দুবৃত্তের সবাই বদরে নিহত হয়। উল্লেখ্য যে, উকবা বদরে মুসলমানদের হাতে বন্দী হয়। নবী করীম (ﷺ) তাকে হত্যার আদেশ করেন।
তখন সে বলে : মুহাম্মদ! আমার হোই মেয়েগুলোর জন্য কে থাকবে বলেন : জাহান্নাম। তারপর সে বলে, আমি কুরাইশ হওয়া সত্ত্বেও আমাকে তুমি হত্যা করবো বললেন : হ্যাঁ। তারপর তিনি সাহাবীদের দিকে তাকিয়ে বলেন : তোমরা কি জান এ লোকটি আমার সাথে কিরূপ আচরণ করেছিল। একদিন আমি মাকামে ইবরাহীমের পিছনে সিজদারত ছিলাম। এমন সময় সে এসে আমার ঘাড়ের উপর পা উঠিয়ে এতো জোরে চাপ দেয় যে, আমার চোখ দুটি বের হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। আরেকবার আমি সিজদায় রত আছি। এমন সময় সে কোথা থেকে বকরীর বর্জ্য এনে আমার মাথায় ঢেলে দেয়। ফাতিমা দৌড়ে এসে তা সরিয়ে আমার মাথা ধৌত করে দেয়।
মুসলমানদের হাতে এ পাপিষ্ঠ উকবার জীবনের সমাপ্তি ঘটে। সেই কিশোর বয়সে ফাতিমা পিতার হাত ধরে একদিন কা’বার আঙ্গিনায় গমন করেন এবং তিনি দেখলেন, পিতা যেই না হাজরে আসওয়াদের নিকটে গেছেন অমনি একদল পৌত্তলিক একযোগে তাঁকে ঘিরে ধরে বলতে লাগলো । আপনি কি সে ব্যক্তি নন যিনি এমন এমন কথা বলে থাকেন। তারপর তারা একটা একটা করে গুণে বলতে থাকে : আমাদের বাপ-দাদাদের গালি দেন, উপাস্যদের দোষের কথা বলেন, বুদ্ধিমানও বিচক্ষণ ব্যক্তিবর্গকে নির্বোধ ও বোকা মনে করেন।
তিনি বলেন : হাঁ, আমিই সে ব্যক্তি। এর পরের ঘটনা দেখে বালিকা ফাতিমার শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। তিনি ভয়ে কাতর হয়ে পড়েন। দেখেন তাদের একজন তাঁর পিতার দেহের চাদরটি তার গলায় পেঁচিয়ে জোরে টানতে শুরু করেছে। আর আবু বকর (রা) তাদের সামনে দাঁড়িয়ে অত্যন্ত উত্তেজিত কণ্ঠে বললেন : তোমরা একটি লোককে শুধু এ জন্য হত্যা করবে যে, তিনি বলেন- আল্লাহ আমার রব ও পালনকর্তা লোকগুলো আগুন ঝরা দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালো। তাঁর দাড়ি ধরে টানলো, তারপর মাথা ফাটিয়ে রক্ত ঝরিয়ে ছাড়লো। এভাবে আবু বকর (রা) সেদিন নিজের জীবন বিপন্নকর পাষণ্ডদের হাত থেকে মুহাম্মদকে ছাড়ালেন। ছাড়া পেয়ে তিনি বাড়ীর পথ ধরলেন। কন্যা ফাতিমা পিতার পিছনে পিছনে চললেন। পথে স্বাধীন ও দাস যাদের সাথে দেখা হলো প্রত্যেকেই নানা রকম অশালীন মন্তব্য ছুড়ে মেরে ভীষণ কষ্ট দিল। নবী করীম (ﷺ) সোজা বাড়ীতে চলে গেলেন এবং মারাত্মক ধরনের বিধ্বস্ত অবস্থায় বিছানায় এলিয়ে পড়লেন। বালিকা ফাতিমার চোখের সামনে এ ঘটনা সংঘটিত হলো।
শি’আবে আবী তালিবে ফাতিমা
কুরাইশরা নবী করীম (ﷺ)-এর উপর নির্যাতন চালানোর নতুন পদ্ধতি বের করলো। এবার তাদের নির্যাতনের হাত বনু হাশিম ও বনু আবদুল মুত্তালিবের প্রতিও সম্প্রসারিত হলো। মক্কার মুশরিকরা তাদেরকে বয়কট করার দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিল। নবী করীম (ﷺ) তাদের নিকট নত না হওয়া পর্যন্ত তাদের সাথে ক্রয়-বিক্রয়, কথা বলা ও উঠাবসা বন্ধ। একমাত্র আবু লাহাব ছাড়া বনু হাশিম ও বনু আবদুল মুত্তালিব মক্কার উপকণ্ঠে শি’আবে আবী তালিব’- এ আশ্রয় নেয়। তাদেরকে সেখানে অবরোধ করে রাখা হয়। অবরুদ্ধ জীবন এক সময় ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। “শিআব’- এর বাইরে থেকেও সে সময় ক্ষুধায় কাতর নারী ও শিশুদের আহাজারি ও কান্নার আওয়াজ শোনা যেত। এ অবরুদ্ধদের মধ্যে ফাতিমা (রা) ও ছিলেন। এ অবরোধ তার স্বাস্থ্যের উপর দারুণ প্রভাব ফেলে। এখানে অনাহারে থেকে যে অপুষ্টির শিকার হন তা আমরণ বহন করে চলেন। এ অবরোধ প্রায় তিন বছর চলে। অবরুদ্ধ জীবনের দুঃখ-বেদনা না ভুলতেই তিনি আরেকটি বড় ধরনের দুঃখের সম্মুখীন হন। স্নেহময়ী মা খাদীজা (রা) যিনি তাঁদের সকলকে আগলে রেখেছিলেন, যিনি অতি নীরবে পুণ্যময় নবীগৃহের যাবতীয় দায়িত্ব পালন করে চলছিলেন, তিনি তখন ইন্তেকাল করেন। তিনি আল্লাহর নবী রাসূলে করীম (ﷺ)-এর যাবতীয় দায়িত্ব যেন কন্যা ফাতিমার ওপর অর্পণ করেন। তিনি অত্যন্ত আত্মপ্রত্যয় ও দৃঢ়তার সাথে পিতার পাশে এসে দাঁড়ান। পিতার আদর ও স্নেহ অধিক মাত্রায় পেতে থাকেন। মদীনায় হিজরতের পূর্ব পর্যন্ত মক্কায় পিতার দাওয়াতি কার্যক্রমের সহযোগী হিসেবে অবদান রাখতে থাকেন। আর এ কারণেই তার ডাক নাম হয়ে যায়- উম্মু আবীহা’ (তার পিতার মা)।
হিজরত ও ফাতিমা
নবী করীম (ﷺ) যে রাতে মদীনায় হিজরত করলেন সে রাতে আলী (রা) যে দুঃসাহসিক ভূমিকা পালন করেন, ফাতিমা (রা) অতি নিকট থেকে তা স্বচক্ষে দর্শন করেন। আলী (রা) নিজের জীবন বাজি রেখে কুরাইশ পাষগুদের ধোঁকা দেয়ার উদ্দেশ্যে নবী করীম (ﷺ)-এর বিছানায় শুয়ে থাকেন। সে ভয়াবহ রাতে ফাতিমাও বাড়ীতে অবস্থান করছিলেন। অত্যন্ত নির্ভীকভাবে কুরাইশদের সব চাপ প্রত্যাখ্যান করেন। তারপর আলী (রা) তিন দিন মক্কায় থেকে নবী করীম (ﷺ)-এর নিকট গচ্ছিত অর্থ-সম্পদ মালিকদের নিকট প্রত্যার্পণ করে মদীনায় রওয়ানা হন। ফাতিমা ও তার বোন উম্মু কুলছুম মক্কায় রয়ে গেলেন। নবী করীম (ﷺ) -মদীনায় একটু স্থির হওয়ার পর পরিবারের লোকদের নেয়ার জন্য একজন সাহাবীকে প্রেরণ করলেন। আর সেটা ছিল নবুওয়্যাতের ১৩ তম বছরের ঘটনা। ফাতিমা (রা)-এর বয়স তখন ১৮ বছর। মদীনায় পৌছে তিনি দেখেন সেখানে মুহাজিররা শান্তি ও নিরাপত্তা খুঁজে পেয়েছেন। বিদেশ-বিভুঁইয়ের একাকীত্বের অনুভূতি তাদের মধ্য থেকে লোপ পেয়েছে। নবী করীম (ﷺ) মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক করে দিয়েছেন। তিনি নিজে আলীকে (রা) দ্বীনি ভাই হিসেবে গ্রহণ করেছেন।
বিয়ে
হিজরী দ্বিতীয় সনে বদর যুদ্ধের পরে আলী (রা)-এর সাথে ফাতিমা (রা)-এর শুভ বিবাহ সম্পন্ন হয়। একথাও বর্ণিত হয়েছে যে, নবী করীম (ﷺ) আয়েশা (রা)-কে ঘরে উঠিয়ে নেয়ার চার মাস পরে আলী- ফাতিমার বিয়ে হয় এবং বিয়ের নয় মাস পরে তাঁদের ফুলশয্যা হয়। বিয়ের সময় ফাতিমা (রা)-এর বয়স পনেরো বছর সাড়ে পাঁচ মাস এবং আলী (রা)-এর বয়স একুশ বছর পাঁচ মাস। আল-ইসতীআব’ গ্রন্থে ইবনু আবদিল বার উল্লেখ করেছেন যে, আলী (রা) ফাতিমা (রা)-কে বিয়ে করেন নবী করীম (ﷺ) -এর মদীনায় আসার পাঁচ মাস পরে রজব মাসে এবং বদর যুদ্ধ থেকে প্রত্যাবর্তনের পর তাদের বাসর (ফুলশয্যা) হয়। ফাতিমার বয়স তখন আঠারো বছর। তাবারীর তারিখে বলা হয়েছে, হিজরী দ্বিতীয় সনে হিজরতের বাইশ মাসের মাথায় যিলহাজ্জ মাসে ‘আলী ও ফাতিমা (রা)-এর বাসর হয়। বিয়ের সময় আলী (রা) ফাতিমার চেয়ে বয়সে চার বছরের বড় ছিলেন। আবু বকর (রা) ও ওমর (রা)-এর মত উচু মর্যাদার অধিকারী সাহাবীগণও ফাতিমা (রা)-কে স্ত্রী হিসেবে পেতে আগ্রহী ছিলেন। তাঁরা নবী করীম (ﷺ) -এর নিকট প্রস্তাবও দেন। কিন্তু তিনি অত্যন্ত বিনয় ও নম্রতার সাথে প্রত্যাখ্যান করেন। হাকিমের মুসতাদরিক ও নাসাঈর সুনানে বর্ণিত আছে যে, আবু বকর ও ওমর (রা) উভয়ে ফাতিমাকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। নবী করীম (ﷺ) তাদেরকে বলেন : সে এখনো ছোট। একটি বর্ণনায় এসেছে, আবু বকর প্রস্তাব দিলেন। নবী করীম (ﷺ) বললেন : আবু বকর! তার প্রসঙ্গে আল্লাহর সিদ্ধান্তের অপেক্ষা কর। আৰূ বকর (রা) একথা ওমর (রা)-কে জানালে জবাবে ওমর (রা) বললেন : তিনি তো আপনার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন।
তারপর আবু বকর (রা) ওমর (রা)-কে বললেন : এবার আপনি নবী করীম (ﷺ)-এর নিকট ফাতিমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিন। ওমর (রা) প্রস্তাব দিলেন। নবী করীম (ﷺ) আবু বকরকে যে কথা বলে ফিরিয়ে দেন, ওমরকেও ঠিক একই কথা বলেন। ওমর (রা) আবু বকরকে সে কথা বললে তিনি মন্তব্য করেন: ওমর, তিনি আপনার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন। তারপর ওমর (রা) আলী (রা)-কে বলেন, আপনিই ফাতিমার উপযুক্ত পাত্র। আলী (রা) বলেন, আমার সম্পদের মধ্যে এ একটি মাত্র বর্ম ছাড়া তো আর কিছু নেই। আলী-ফাতিমার বিয়েটি কিভাবে হয়েছিল সে বিষয়ে কতিপয় বর্ণনা পাওয়া যায় সেগুলো প্রায় কাছাকাছি। নিমে কতিপয় উপস্থাপন করা হলো। তাবাকাতে ইবন সা’দ ও উসদুল গাবা গ্রন্থের একটি বর্ণনা মতে আলী (রা) ওমরের কথামত নবী করীম (ﷺ)-এর নিকট গমন করেন এবং ফাতিমাকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। নবী করীম (ﷺ) সাথে সাথে নিজ উদ্যোগে আলী (রা)-এর সাথে ফাতিমাকে বিয়ে দেন। এ সংবাদ ফাতিমার কানে পৌছলে তিনি কাঁদতে শুরু করেন। অতঃপর নবী করীম (ﷺ) ফাতিমার কাছে গমন করেন এবং তাঁকে লক্ষ্য করে বলেন : ফাতিমা! আমি তোমাকে সবচেয়ে বড় জ্ঞানী, সর্বাধিক বিচক্ষণ এবং প্রথম ইসলাম গ্রহণকারী ব্যক্তির সাথে বিয়ে দিয়েছি। অন্য একটি বর্ণনায় এসেছে, আলী (রা) প্রস্তাব দানের পর নবী করীম (ﷺ) বলেন : ফাতিমা! আলী তোমাকে স্মরণ করে। ফাতিমা কোন জবাব না দিয়ে নীরব থাকেন। অতঃপর নবী করীম (ﷺ) বিয়ের কাজ সমাধা করেন। অন্য একটি বর্ণনা আছে : মদীনার আনসারদের কতিপয় মানুষ আলীকে বলেন : আপনার জন্য তো ফাতিমা আছে। একথার পর আলী নবী করীম (ﷺ)-এর নিকট গমন করেন। নবী করীম (ﷺ) বলেন: আবু তালিবের ছেলের কি দরকার? আলী ফাতিমার প্রসঙ্গে কথা বলেন। নবী করীম (ﷺ)-কেবল মুখে উচ্চারণ করলেন : মারহাবান ওয়া আহলান। এর বেশী আর কিছু বললেন না। আলী নবী করীম (ﷺ)-এর নিকট থেকে উঠে অপেক্ষমান আনসারদের সে দলটির নিকট গেলেন। তারা জিজ্ঞেস করলেন :খবর কী? আলী বললেন- আমি জানিনা। তিনি আমাকে মারহাবান ওয়া আহলান” ছাড়া কিছু বলেননি। তারা বললেন : আলী নবী করীম (ﷺ) -এর পক্ষ থেকে আপনাকে এতটুকু বলাই কি যথেষ্ট নয়। তিনি আপনাকে পরিবারের সদস্য বলে স্বাগতম জানিয়েছেন। ফাতিমার সাথে কিভাবে বিয়ে হয়েছিল সে প্রসঙ্গে আলী (রা)-এর বর্ণনা এ রকম : নবী করীম (ﷺ)-এর নিকট ফাতিমার বিয়ের প্রস্তাব এলো। তখন আমার এক দাসী আমাকে বললেন : আপনি কি একথা জানেন যে, নবী করীম (ﷺ) -এর নিকট ফাতিমার বিয়ের প্রস্তাব এসেছে। আমি বললাম না। সে বললো : হ্যাঁ প্রস্তাব এসেছে। আপনি নবী করীম (ﷺ) -এর নিকট কেন যাচ্ছেন ? আপনি গেলে নবী করীম (ﷺ) ফাতিমাকে আপনার সাথেই বিয়ে দিবেন। বললাম : বিয়ে করার মত আমার কিছু আছে কি?
সে বললো : যদি আপনি নবী করীম (ﷺ)-এর নিকট গমন করেন তাহলে তিনি অবশ্যই আপনার সাথে তার বিয়ে দিবেন। আলী (রা) বলেন : আল্লাহর কসম! সে আমাকে এভাবে আশা-ভরসা দিতে থাকে। পরিশেষে আমি একদিন নবী করীম (ﷺ)-এর কাছে আসলাম। তার সামনে বসার পর আমি যেন বোবা হয়ে গেলাম। তার মহত্ত্ব ও তাঁর মধ্যে বিরাজমান গাম্ভীর্য ও ভীতির ভাবের কারণে আমি কোন আলাপই করতে পারলাম । এক সময় তিনিই আমাকে প্রশ্ন করলেন। কি জন্য এসেছে? কোন দরকার আছে কি? আলী (রা) বলেন : আমি নীরব রইলাম। নবী করীম (ﷺ) বললেন : নিশ্চয়ই ফাতিমার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছে। আমি বললাম : হ্যাঁ। তিনি বললেন : তোমার নিকট এমন কিছু আছে কি যা দ্বারা তুমি তাকে হালাল করবে? বললাম : আল্লাহর কসম, হে আল্লাহর রাসূল! নেই। তিনি বললেন : যে বর্মটি আমি তোমাকে দিয়েছিলাম তা কি করেছে? বললাম : সেটা আমার নিকট আছে। আলীর জীবন যে সত্তার হাতে তার কসম, সেটা তো একটি “হুতাশী” বর্ম। তার দাম চার দিরহামও হবে না।
নবী করীম (ﷺ) বললেন : আমি তারই বিনিময়ে ফাতিমাকে তোমার সাথে বিয়ে দিলাম। সেটা তার নিকট পাঠিয়ে দাও এবং তা দ্বারাই তাকে হালাল করে নাও।
আলী (রা) বলেন : এ ছিল ফাতিমা বিনতে নবী করীম (ﷺ)-এর মোহর। আলী (রা) খুব তাড়াতাড়ি বাড়ী গিয়ে বর্মটি নিয়ে আসেন। মেয়ের সাজগোজের জিনিসপত্র ক্রয় করার জন্য নবী করীম (ﷺ) সেটি বিক্রি করতে বলেন। বর্মটি উসমান ইবন আক্ষান (রা) চার শো সত্তর (৪৭০) দিরহামে ক্রয় করেন। এ অর্থ নবী করীম (ﷺ)-এর হাতে দেয়া হয়। তিনি তা বিলালের (রা) হাতে দিয়ে কিছু আতর-সুগন্ধি ক্রয় করতে বলেন, আর অবশিষ্ট যা থাকে উম্মু সালামার (রা) হাতে দিতে বলেন। যাতে তিনি তা দিয়ে মেয়ের সাজগোজের জিনিস ক্রয় করতে পারেন।
সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে গেল নবী করীম (ﷺ) সাহাবীদের আহ্বান করেন। তারা হাযির হলে তিনি ঘোষণা দেন যে, তিনি তাঁর কন্যা ফাতিমাকে চারশো মিছকাল রূপার বিনিময়ে আলী (রা)-এর সাথে বিয়ে দিয়েছেন। তারপর আরবের প্রথা অনুযায়ী মেয়ের পক্ষ থেকে নবী করীম (ﷺ) ও বর আলী (রা) নিজে সংক্ষিপ্ত খুতবা দান করেন। তারপর উপস্থিত অতিথি সাহাবায়ে কিরামের মধ্যে খোরমা ভর্তি একটা পাত্র পেশ করা হয়।
ফাতিমা (রা)-এর বিয়ের খুতবা
ফাতিমা ও আলী (রা)-এর বিয়েতে প্রদত্ত নবী করীম (ﷺ)-এর খুতবা।
الحمد لله المحمود بنشميه، المعبود بقدرته، الموهوب من عذابه، المرغوب فبما عنده، ألاف أمره في سمائه واژضه الذي خلق الخلق بندرته، ومبرم باشگاه، وأعزهم بدينه، وأكرمهم بنبيه محمد صلى الله عليه وسلم، ثم أن الله تعالى جعل المصاهرة لاحقا، وأمرا مفترضا، وشج ربه الكام، والزمه الإنام، قال تبارك اشه، تعالى ذكره : وهو الذي خلق من الماء بشرا فجعله نسبا وصهرا وگان رب تیرا نام الله يجري الى تضانه ولگير تضاء قدر، ولگني تثر أجل يشر الله ماشا. ويشيت وعثه أم الكتاب . ثم إن ربی آمری آن ازوج فاطمة من علي بن أبي طالب، وقد زوجتها إياه على أربعمائة مثقال فضة، إن رضي بذلك على .
যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহর যিনি তাঁর দান ও অনুগ্রহের কারণে প্রশংসিত, শক্তি ও ক্ষমতার জোরে উপাস্য, শাস্তির কারণে ভীতিপ্রদ এবং তার নিকট যা কিছু রয়েছে তার জন্য প্রত্যাশিত। আসমান ও যমীনে তিনি স্বীয় বিধান বাস্তবায়নকারী। তিনি তার শক্তি ও ক্ষমতা দ্বারা এ সৃষ্টিজগত সৃষ্টি করেছেন, তারপর বিধি নিষেধ দ্বারা তাদেরকে পার্থক্য করেছেন, দ্বীনের মাধ্যমে তাদেরকে শক্তিশালী করেছেন এবং তাঁর নবী মুহাম্মদ (ﷺ)-এর দ্বারা তাদেরকে সম্মানিত করেছেন। অতঃপর আল্লাহ তা’আলা বিবাহ ব্যবস্থাকে পরবর্তী বংশ রক্ষার পন্থা এবং একটি অবশ্যকরণীয় কাজ করে দিয়েছেন। এর দ্বারা রক্ত সম্পর্ককে একটির সাথে আরেকটি সংযুক্ত করে দিয়েছেন। এ ব্যবস্থা সৃষ্টি জগতের জন্য বাধ্যতামূলক করেছেন। (জামহারাতু খুব আল-আরাব-৩/৩৪৪)
যার নাম অতি বরকতময় এবং যাঁর স্মরণ সুমহান, তিনি বলেছেন : তিনিই পানি থেকে সৃষ্টি করেছেন মানুষকে, অতঃপর তাকে রক্তগত বংশ ও বৈবাহিক সম্পর্কশীল করেছেন। তোমার প্রতিপালক সবকিছু করতে সক্ষম। অতএব আল্লাহর নির্দেশ চূড়ান্ত পরিণতির দিকে ধাবিত হয়। প্রত্যেকটি চূড়ান্ত পরিণতির একটি নির্ধারিত সময় আছে। আর প্রত্যেকটি নির্ধারিত সময়ের একটি শেষ আছে। আল্লাহ যা ইচ্ছা বিলীন করেন এবং স্থির রাখেন। আর মূল গ্রন্থ তাঁর নিকটই রয়েছে।
অতঃপর, আমার প্রতিপালক আমাকে আদেশ করেছেন, আমি যেন আলীর সাথে ফাতিমার বিয়ে দিই। আর আমি তাকে চার শত মিছকাল’ রূপার বিনিময়ে তার সাথে বিয়ে দিয়েছি- যদি এতে আলী সন্তুষ্ট থাকে। নবী করীম (ﷺ)-এর খুতবার পর তক্কালীন আরবের প্রথানুযায়ী বর আলী (রা) ছোট্ট একটি খুতবা দেন। প্রথমে আল্লাহর হামদ ও ছানা এবং রাসূলের প্রতি দুরূদ ও সালাম পেশ করেন। তারপর বলেন
قان اجتماعا مما قدره قدره الله تعالی اورضية، والگا ما أمر الله به وأذن فيه، وهذا محمد صلى الله عليه وسلم قد زوجني فاطنة ابنته على صداي أربعمائة درهم وثمانين درهما، ورضيت به اشتلوه، وكفى بالله شهيدا .
“আমাদের এ মজলিশ, আল্লাহ যা নির্ধারণ করেছেন এবং তার প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন। আর বিয়ে হলো, আল্লাহ যা আদেশ করেছেন এবং যে বিষয়ে অনুমতি দান করেছেন। এ যে মুহাম্মদ তার মেয়ে ফাতিমার সাথে আমাকে চার শত আশি দিরহাম মোহরের বিনিময়ে বিয়ে দিয়েছেন। আমি তাতে সন্তুষ্ট হয়েছি। অতএব আপনারা তাঁকে জিজ্ঞেস করুন। সাক্ষী হিসেবে আল্লাহই যথেষ্ট।” (প্রাগুক্ত-৩/৩৪৫)
এভাবে অতি সাধারণ ও সাধারণভাবে আলীর সাথে রাসূলের কন্যা ফাতিমাতু যাহরার বিয়ে সম্পন্ন হয়। অন্য কথায় ইসলামের দীর্ঘ ইতিহাসের সবচেয়ে মহান ও গৌরবময় বৈবাহিক সম্পর্কটি স্থাপিত হয়।
বাসর ও ওলীমা অনুষ্ঠান
আসমা বিনত উমাইস (রা) যিনি আলী-ফাতিমা (রা)-এর বিয়ে ও তাদের বাসর ঘরের সাজ-সজ্জা দেখেছিলেন, তিনি বলেছেন, খেজুর গাছের ছাল ভর্তি বালিশ- বিছানা ব্যতীত তাদের আর কিছু ছিল না। আর বলা হয়ে থাকে আলী (রা)-এর ওলীমার চেয়ে উত্তম কোন ওলীমা সে সময় আর হয়নি।
সে ওলীমা কেমন হতে পারে তা অনুমান করা যায় এ বর্ণনার মাধ্যমে : আলী (রা) তার একটি বর্ম এক ইহুদীর নিকট বন্ধক রেখে কিছু যব আনেন। তাদের বাসর রাতের খাবার কেমন ছিল তা এ বর্ণনা দ্বারা সহজেই অনুমান করা যায়। তবে এ বিয়ে উপলক্ষে বনূ আবদুল মুত্তালিব আঁকজমকপূর্ণ এমন একটা ভোজ অনুষ্ঠান করেছিল যে, তেমন অনুষ্ঠান নাকি ইতিপূর্বে তারা আর করেনি। সহীহাইন ও আল-ইসাবার বর্ণনা মতে তাহলো, হামযা (রা) যিনি মুহাম্মাদ ও আলী উভয়ের চাচা, দুটো বুড়ো উট যবেহ করে আত্মীয়-স্বজনদের খাইয়েছিলেন।
বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হলে আগত আত্মীয়-মেহমানগণ নব দম্পতির শুভ ও কল্যাণ কামনা করে একে একে বিদায় নিল। নবী করীম (ﷺ) উম্মু সালামা (রা)-কে আহ্বান করেন এবং তাঁকে মেয়ের সাথে আলীর বাড়ীতে যাওয়ার জন্য বললেন। তাদেরকে এ কথাও বলে দিলেন, তারা যেন সেখানে নবী করীম (ﷺ) যাওয়ার অপেক্ষা করেন। বিলাল (রা) এশার সালাতের আযান দিলেন। নবী করীম (ﷺ) মসজিদে এশার জামা’আতের ইমামতি করলেন। তারপর আলী (রা)-এর বাড়ী গমন করলেন। একটু পানি আনতে বললেন। পানি আনা হলে মহাগ্রন্থ আল কুরআনের কিছু আয়াত তিলাওয়াত করে তাতে ফুঁক দিলেন। সে পানির কিছু বর-কনেকে পান করাতে বললেন। বাকী পানি দিয়ে নবী করীম (ﷺ) নীচে ধরে রাখা একটি পাত্রের মধ্যে ওযু করলেন। সে পানি তাদের দু’জনের মাথায় ছিটিয়ে দিলেন। তারপর এ দু’আ পাঠ করতে করতে যাওয়ার জন্য উঠলেন।
اللهم بارك فيهما، وبارك عليهما، وبارك لهما في نسلهما .
“হে আল্লাহ! তুমি তাদের দু’জনের মধ্যে বরকত দান কর। হে আল্লাহ! তুমি তাদের দু’জনকে কল্যাণ দান কর। হে আল্লাহ! তাদের বংশধারায় সমৃদ্ধি দান কর।” (আ’লাম আন-নিসা-৪/১০৯)।
অন্য একটি বর্ণনায় এসেছে, যাবার সময় তিনি কন্যাকে লক্ষ্য করে বলেন : “ফাতিমা! আমার পরিবারের সর্বোত্তম সদস্যের সাথে তোমার বিয়ে দেয়ার বিষয় কোন ত্রুটি করিনি।” ফাতিমা চোখের পানি সংবরণ করতে পারেননি। পিতা কিছু সময় চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকেন।
তারপর পরিবেশকে হালকা করার জন্য অত্যন্ত আবেগের সাথে মেয়েকে বলেন : “আমি তোমাকে সবচেয়ে শক্ত ঈমানের অধিকারী, সবচেয়ে বড় জ্ঞানী, সবচেয়ে উত্তম নৈতিকতা ও উন্নত মন-মানসের অধিকারী ব্যক্তির নিকট গচ্ছিত রেখে যাচ্ছি।”
সংসার জীবন
মদীনায় আগমনের পর রজব মাসে এ বিয়ে অনুষ্ঠিত হয়। আর হিজরী দ্বিতীয় সনে বদর যুদ্ধের পর আলী (রা) তার স্ত্রীকে উঠিয়ে নেয়ার জন্য একটি ঘর ভাড়া করতে সক্ষম হন। সে ঘরে বিত্ত-বৈভবের কোন স্পর্শ ছিল না। সে ঘর ছিল অতি সাধারণ মানের। সেখানে কোনো দামী আসবাবপত্র, খাট-পালঙ্ক, জাজিম, গদি কোন কিছুই ছিল না। আলীর ছিল কেবল একটি ভেড়ার চামড়া, যা বিছিয়ে তিনি রাতে দ্রিা যেতেন এবং দিনে সেটি মশকের কাজে ব্যবহার হতো। কোন চাকর-বাকর ছিল না।
দারিদ্র্যের কঠোর বাস্তবতার সম্মুখীন
বাবার ঘর থেকে ফাতিমা যে স্বামীর ঘরে গমন করেন সেখানে কোন প্রাচুর্য ছিল না। বরং সেখানে যা ছিল তাকে দারিদ্রের বাস্তবতাই বলা সঙ্গত। সে ক্ষেত্রে তার অন্য বোনদের স্বামীদের আর্থিক অবস্থা তুলনামূলক অনেক ভালো ছিল। যায়নাবের বিয়ে হয় আবুল আসের (রা) সাথে। তিনি মক্কার অন্যতম ধনী ব্যক্তি ছিলেন। রুকাইয়া ও উম্মু কুলছুমের (রা) বিয়ে হয় মক্কার বড় ধনী ব্যক্তি আবদুল উযূ ইবন আবদুল মুত্তালিবের দুই ছেলের সাথে । ইসলামের কারণে তাদের ছাড়াছাড়ি হয়ে যাওয়ার পর একের পর একজন করে তাদের দু’জনেরই বিয়ে হয় উসমান ইবন আফফানের (রা) সাথে। আর উসমান (রা) ছিলেন একজন সম্পদশালী ব্যক্তি। তাদের তুলনায় আলী (রা) ছিলেন একজন নিতান্ত দরিদ্র মানুষ। তার নিজের অর্জিত সম্পদ বলে যেমন কিছু ছিল না, তেমনি উত্তরাধিকার সূত্রেও কিছু পাননি। তাঁর পিতা মক্কার সবচেয়ে সম্মানিত ব্যক্তি ছিলেন। তবে তেমন অর্থ-বিত্তের মালিক ছিলেন না। আর সন্তান ছিল অনেক। তাই বোঝা লাঘবের জন্য মুহাম্মদ (ﷺ) ও তার চাচা আব্বাস তার দু ছেলের লালন-পালনের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এভাবে মুহাম্মাদের পরিবারের সাথে আলী (রা) যুক্ত হন। এখানে একটি প্রশ্ন দেখা দিতে পারে যে, আলী (রা)-এর মত মক্কার সভ্রান্ত বংশীয় বুদ্ধিমান যুবক এত সীমাহীন দারিদ্র্যের মধ্যে থাকলেন কেন? এর জবাব আলী (রা)-এর জীবনের মধ্যেই খুঁজে পাওয়া যায়। মুহাম্মাদ নবী হলেন। আলী (রা) কিশোরদের মধ্যে সর্বপ্রথম তাঁর প্রতি ঈমান আনলেন। ইবন ইসহাকের বর্ণনা অনুযায়ী তখন তার বয়স দশ বছর। আর তখন থেকে তিনি রাসূল (ﷺ)-এর জীবনের সাথে জড়িয়ে পড়েন। নবী যত কঠিন বাস্তবতার সম্মুখীন হয়েছেন, আলীকেও তার মুখোমুখী হতে হয়েছে। মক্কার অভিজাত ব্যক্তিবর্গের পেশা ছিল ব্যবসা। এখানে আলী (রা)-এর জীবন যেভাবে আরম্ভ হয় তাতে এ পেশার সাথে জড়ানোর সুযোগ ছিল কোথায়? মক্কার কুরাইশদের সাথে ঠেলা-ধাক্কা করতেই তো অনেক বছর কেটে যায়। মদীনায় গেলেন একেবারে খালি হাতে। সেখানে নতুন স্থানে নতুনভাবে দাওয়াতী কাজে জড়িয়ে পড়লেন। এর মধ্যে বদর যুদ্ধ এসে গেল। তিনি যুদ্ধে গেলেন। যুদ্ধের পর গণীমতের অংশ হিসেবে নবী করীম (ﷺ) -আতাকে একটি বর্ম দিলেন। এ প্রথম তিনি একটি সম্পদের মালিক হলেন। আলী (রা) যে একজন নিতান্ত দরিদ্র মানুষ ছিলেন তা ফাতিমার জানা ছিল। তাই, বালাযুরীর বর্ণনা যদি সত্য হয়-নবী করীম (ﷺ) ফাতেমাকে যখন আলীর প্রস্তাবের কথা বলেন তখন ফাতিমা আলীর দারিদ্র্যের কথা উল্লেখ করেন। তার জবাবে নবী করীম (ﷺ) বলেন : “সে ইহকালে একজন নেতা এবং পরকালেও সে সত্যনিষ্ঠ ব্যক্তিদের একজন হবে। সাহাবীদের মধ্যে তার জ্ঞান বেশী। সে একজন বিচক্ষণও। তাছাড়া সর্বপ্রথম সে ইসলাম গ্রহণ করেছে।”
এ বর্ণনাটি সত্য হতেও পারে। কারণ, বিয়ে-শাদীর এ রকম পর্যায়ে অভাব দারিদ্র্য বিবেচনায় আসা বিচিত্র কিছু নয়। ফাতিমা (রা) আঠারো বছর বয়সে স্বামী গৃহে যান। সেখানে যে বিত্ত-বৈভবের কিছু মাত্র চিহ্ন ছিল না, সে কথা সব ঐতিহাসিকই বলেছেন। সে ঘরে গিয়ে পেলেন খেজুর গাছের ছাল ভর্তি চামড়ার বালিশ, বিছানা, এক জোড়া যাতা, দু’টো মশক, দু’টো পানির ঘাড়া, আর আতর-সুগন্ধি। স্বামী দারিদ্র্যের কারণে ঘর- গৃহস্থালীর কাজ-কর্মে তাকে সহায়তা করার জন্য অপেক্ষাকৃত কঠিন কাজগুলো করার জন্য কোন চাকর-চাকরাণী দিতে পারেননি। ফাতিমা (রা) একাই সব রকমের কাজ সম্পাদন করতেন। যাতা ঘুরাতে এবং ঘর-বাড়ী ঝড় দিতে দিতে পরিহিত পোশাক ময়লা হয়ে যেত । তার এভাবে কাজ করা আলী (রা) মেনে নিতে পারতেন না। কিন্তু তাঁর করারও কিছু ছিল না। যতটুকু পারতেন নিজে তার কাজে সাহায্য করতেন। তিনি সর্বদা ফাতিমার স্বাস্থ্যের ব্যাপারে সতর্ক থাকতেন। কারণ, মক্কী জীবনে নানারকম প্রতিকূল অবস্থায় তিনি যে অপুষ্টির শিকার হন তাতে বেশ ভগ্নস্বাস্থ্য হয়ে পড়েন। ঘরে-বাইরে এভাবে দু’জনে কাজ করতে করতে তারা বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েন। একদিন আলী (রা) তার মা ফাতিমা বিন্ত আসাদ ইবনে হাশিমকে বলেন : তুমি পানি আনা ও বাইরের অন্যান্য কাজে নবী করীম (ﷺ)-এর কন্যাকে সাহায্য কর, আর ফাতিমা তোমাকে বাড়ীতে গম পেষা ও রুটি বানাতে সাহায্য করবে। এ সময় ফাতিমার পিতা নবী করীম (ﷺ) অঢেল যুদ্ধলব্ধ সম্পদ ও যুদ্ধবন্দীসহ বিজয়ীর বেশে একটি যুদ্ধ থেকে মদীনায় প্রত্যাবর্তন করলেন।
একদা আলী (রা) বললেন : ফাতিমা! তোমার এমন কষ্ট দেখে আমার বড় দুঃখ হয়। আল্লাহ তা’আলা বেশ কিছু যুদ্ধ বন্দী দিয়েছেন তুমি যদি তোমার বাবার নিকট গমন করে তোমার সেবার জন্য যুদ্ধ বন্দী একটি দাসের জন্য আবেদন জানাতে! ফাতিমা ক্লান্ত-শ্রান্ত অবস্থায় হাতের যাতা পাশে রাখতে রাখতে বলেন : আমি যাব ইনশাআল্লাহ। তারপর বাড়ীর আঙ্গিনায় একটু বিশ্রাম নিয়ে চাদর দিয়ে গা-মাথা ঢেকে আস্তে আস্তে পিতৃগৃহের দিকে অগ্রসর হলেন।
পিতা তাঁকে দেখে নরম স্বরে জিজ্ঞেস করলেন ; মা! কেন এসেছে? ফাতিমা বললেন : আপনাকে সালাম জানাতে এসেছি। তিনি লজ্জায় পিতাকে মনের কথাটি প্রকাশ করতে পারলেন না। বাড়ী ফিরে এলেন এবং স্বামীকে সে কথা বললেন। আলী (রা) এবার ফাতিমাকে সাথে নিয়ে নবী করীম (ﷺ) -এর নিকট গেলেন। ফাতিমা পিতার সামনে লজ্জায় মুখ নীচু করে নিজের প্রয়োজনের কথাটি এবার বলে ফেললেন। পিতা তাকে বললেন ; মহান আল্লাহর কসম! তোমাদেরকে আমি একটি দাসও দিব না। আহলুস সুফফার মানুষেরা না খেয়ে নিদারুণ কষ্টে আছে। তাদের জন্য আমি কিছুই করতে পারছিনে। এগুলো বিক্রি করে সে অর্থ আমি তাদের জন্য ব্যয় করব।
একথা শ্রবণ করার পর তারা স্বামী-স্ত্রী উভয়ে পিতাকে ধন্যবাদ দিয়ে ঘরে ফিরে আসেন। তাদেরকে এভাবে খালি হাতে ফেরত দিয়ে স্নেহশীল পিতা যে পরম শান্তিতে দিনাতিপাত করতে পেরেছিলেন তা কিন্তু নয়। সারাটি দিন কর্মক্লান্ত আদরের মেয়েটির চেহারা তার মনের আয়নায় ভাসতে থাকে।
সন্ধ্যা হলো। ঠাণ্ডাও ছিল প্রচণ্ড। আলী-ফাতিমা শক্ত বিছানায় নিদ্রা যাওয়ার চেষ্টা করছেন। কিন্তু এত ঠাণ্ডায় কি ঘুম আসে? এমন সময় দরজায় করাঘাতের শব্দ। দরজা খুলতেই তারা দেখতে পান পিতা মুহাম্মাদ দাড়িয়ে। তিনি দেখতে পান, এ প্রবল শীতে মেয়ে-জামাই যে কম্বলটি গায়ে দিয়ে দ্রিা যাওয়ার চেষ্টা করছে তা এত ছোট যে দুজন কোন রকম গুটিশুটি মেরে থাকা যায়।
মাথার দিকে টানলে পায়ের দিকে বেরিয়ে যায়। আবার পায়ের দিকে সরিয়ে দিলে মাথার দিক খোলা হয়ে যায়। তারা এ মহান অতিথিকে স্বাগতম জানানোর জন্য পেরেশান হয়ে পড়েন। তিনি তাদেরকে পেরেশান না হয়ে যে অবস্থায় আছে সেভাবে থাকতে বলেন। তিনি তাদের অবস্থা অন্তর দিয়ে গভীরভাবে উপলব্ধি করেন, তারপর ভদ্রভাবে বলেন : তোমরা আমার নিকট যা চেয়েছিলে তার চেয়ে উত্তম কিছু কি আমি তোমাদেরকে বলে দিব?
তারা দু’জনই এক সাথে বলে উঠলেন : বলুন, হে আল্লাহর রাসূল! তিনি বললেন : জিবরাঈল আমাকে এ শব্দ বা বাক্যগুলো শিখিয়েছেন : প্রত্যেক সালাতের পরে তোমরা দুজন দশবার সুবহানআল্লাহ্, দশবার আলহামদুলিল্লাহ্ ও দশবার আল্লাহু আকবার পাঠ করবে। আর রাতে যখন নিদ্রা যাওয়ার উদ্দেশ্যে বিছানায় যাবে তখন । তেত্রিশবার, সুবহানআল্লাহ্ তেত্রিশবার, আলহামদুলিল্লাহ্ চৌত্রিশবার আল্লাহু আকবার পাঠ করবে। একথা বলে তিনি কন্যা-জামাইকে রেখে দ্রুত চলে যান।
এ ঘটনার প্রায় ৩৫ বছর পরেও আলী (রা)-কে নবী করীম (ﷺ)-এর শিখানো এ কথাগুলো আলোচনা করতে শোনা গেছে। তিনি বলতেন; নবী করীম (ﷺ) আমাদেরকে এ কথাগুলো শিক্ষা দেওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত আমি একদিনও তা বাদ দেইনি। একবার একজন ইরাকী প্রশ্ন করেন : সিফফীন যুদ্ধের সে ভয়াবহ রাতেও না? তিনি খুব জোর দিয়ে বলেন : সিফফীন সে রাতেও না।
এ বিষয়ে আরেকটি ঘটনার কথা উল্লেখ করা যায়। আলী (রা) একবার দারুণ অভাব-অনটনে পড়লেন। একদিন স্ত্রী ফাতিমা (রা)-কে বললেন, যদি তুমি নবী (ﷺ)-এর নিকট গমন করে কিছু চেয়ে আনতে তাহলে ভালো হতো। ফাতিমা (রা) গেলেন। তখন রাসূল (ﷺ)-এর নিকট উম্মু আইমান (রা) বসা ছিলেন। ফাতিমা দরজায় খটখট আওয়াজ করলেন। রাসূল (ﷺ)উম্মু আইমানকে বললেন : নিশ্চয়ই এটা ফাতিমার হাতের টোকা। এমন সময় সে আমাদের নিকট আসল যখন সে সাধারণত আসতে অভ্যস্ত নয়। ফাতিমা (রা) প্রবেশ করে বললেন হে আল্লাহর রাসূল! এ ফেরেশতাদের খাবার হলো তাসবীহ-তাহলীল ও তাহমীদ। কিন্তু আমাদের খাবার কি বললেন : সে সত্তার কসম যিনি আমাকে সত্যসহকারে প্রেরণ করেছেন, মুহাম্মাদের পরিবারের রান্না ঘরে তিরিশ দিন যাবত আগুন জ্বলে না। আমার নিকট কিছু ছাগল এসেছে, তুমি চাইলে পাঁচটি ছাগল তোমাকে দিতে পারি। আর তুমি যদি চাও এর বদলে আমি তোমাকে পাঁচটি কথা শিখিয়ে দিতে পারি যা জিবরাঈল আমাকে শিখিয়েছেন।
ফাতিমা (রা) বললেন : আপনি বরং আমাকে সে পাঁচটি কথা শিখিয়ে দিন যা জিবরাঈল আপনাকে শিখিয়েছেন। রাসূল বললেন, বল –
با اول الأولين، با أخر الأخرين، واذا القوة المتب، وباراجم المساکین، با ارحم الراحمین۔
ফাতিমা (রা) এ পাঁচটি কথা শিখে আলী (রা)-এর নিকট প্রত্যাবর্তন করলেন। ফাতিমাকে দেখে আলী (রা) প্রশ্ন করলেন : খবর কি? ফাতিমা বললেন: আমি দুনিয়া পাওয়ার প্রত্যাশা নিয়ে তোমার নিকট থেকে গমন করেছিলাম, কিন্তু ফিরে এসেছি পরকাল নিয়ে। আলী (রা) বললেন : আজকের দিনটি তোমার জীবনের সর্বোত্তম দিন। (কান আল-“উম্মাল-১/৩০২; হায়াত আস-সাহাবা-১/৪৩)
ছোটখাট দাম্পত্য কলহ
সে কৈশোরে একটু বুদ্ধি-জ্ঞান হওয়ার পর থেকে ফাতিমা যে অবস্থায় যৌবনের এ পর্যায়ে পৌঁছেছেন তাতে আনন্দ-ফুর্তি যে কি জিনিস তাতে তিনি অবগত নন। পিতা তার নিকট থেকে নিকটে বা দূরে যেখানেই থাকেন না কেন সবসময় তার জন্য উদ্বেগ উৎকণ্ঠার কোন সীমা থাকেনা। তিনি যখন যুদ্ধে গমন করেন তখন তা আরো শত গুণ বৃদ্ধি পায়। তাছাড়া ছোটবেলা থেকেই পিতাকে আগলে রাখতে রাখতে তার নিজের মধ্যেও একটা সংগ্রামী চেতনা গড়ে উঠেছে। তাই সুযোগ পেলে তিনি রণাঙ্গনে ছুটে যান।
উহুদ যুদ্ধে তাই তাকে আহত যোদ্ধাদেরকে পটি বাধতে, তাদের ক্ষতে ঔষধ লাগাতে এবং মৃত্যুপথযাত্রী শহীদদেরকে পানি পান করাতে দেখা যায়। যখন গৃহে অবস্থান করতেন তখন চাইতেন স্বামীর সোহাগভরা কোমল আচরণ। কিন্তু আলী (রা)-এর জীবনের যে ইতিহাস তাতে তার মধ্যে এ কোমলতার সুযোগ। কোথায়? তার জীবনের সম্পূর্ণটাই তো হলে কঠোর সংগ্রাম, তাই তাঁর মধ্যে কিছুটা রূঢ়তা থাকা বিচিত্র কিছু নয়। ফলে তাদের উভয়ের সম্পর্ক মাঝে মধ্যে উত্তপ্ত হয়ে উঠতো। পিতার কানেও সে কথা পৌছে যেত। তিনি ছুটে যেতেন এবং ধৈর্যের সাথে দুজনের মধ্যে আপোষ মীমাংসা করে দিতেন।
বর্ণিত আছে যে, একদিন নবী করীম (ﷺ) নিকে সন্ধ্যার সময় একটু ব্যস্ততার সাথে মেয়ের বাড়ীর দিকে গমন করতে দেখা গেল, চোখে-মুখে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার ভাব। কিছুক্ষণ পর যখন সেখান থেকে বের হলেন তখন তাকে বেশ আনন্দিত দেখা গেল। সাহাবায়ে কিরাম বললেন : হে আল্লাহর রাসূল! আপনাকে এক অবস্থায় প্রবেশ করতে দেখলাম, আর এখন বের হচ্ছেন হাসি-খুশী অবস্থায়। তিনি জবাব দিলেন : আমার সবচেয়ে বেশী প্রিয় দু’জনের মধ্যে আপোষ-মীমাংসা করে দিলাম তাতে আমি খুশী হবো না। আরেকবার ফাতিমা (রা) আলী (রা)-এর রূঢ়তায় কষ্ট পান। তিনি বলেন : আমি নবী করীম (ﷺ)-এর নিকট নালিশ জানাবো- একথা বলে ঘর থেকে বের হন। আলীও (রা) তার পেছনে ছুটলেন। ফাতিমা তার স্বামীর প্রতি যে কারণে ক্ষুব্ধ ছিলেন তা পিতাকে অবহিত করলেন, মহান পিতা বেশ কোমল ভাষায় বুঝিয়ে তাকে খুশী করেন। আলী (রা) স্ত্রীকে নিয়ে বাড়ী ফেরার রাস্তায় বলেন: আল্লাহর কসম! তুমি অখুশী হও এমন কিছুই আমি আর কখনো করবো না।
ফাতিমার বর্তমানে আলী (রা)-এর দ্বিতীয় বিয়ের আকাংক্ষা
ফাতিমা (রা) না চাইলেও এমন কতিপয় বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটতে যা তাকে ভীষণ বিচলিত করে তুলতো। তাঁর স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করে ঘরে সতীন এনে উঠাবে ফাতিমা তা মোটেই মেনে নিতে পারেন না। আলী (রা) দ্বিতীয় বিয়ের ইচ্ছা করলেন। তিনি সহজভাবে হিসাব কষলেন, শরী’আতের বিধান মতে দ্বিতীয় বিয়ে করা তো জায়েয। অন্য মুসলিম নারীদের ক্ষেত্রে যেমন এক সাথে চারজনকে রাখা জায়েয তেমনিভাবে রাসূল (ﷺ)-এর মেয়ের সাথেও অন্য আরেকজন স্ত্রীকে ঘরে আনাতে কোন দোষ নেই।
তিনি ধারণা করলেন, এতে ফাতিমা তাঁর প্রতি তেমন রাগ করবেন না। কারণ, তাঁর পিতৃগৃহেই তো এর দৃষ্টান্ত রয়েছে। আয়েশা, হাফসা ও উম্মু সালামা (রা) তো এক সাথেই আছেন। তাছাড়া একবার বনূ মাখযুমের এক নারী চুরি করলে তার শাস্তি মওকুফের জন্য মহিলার আত্মীয়রা উসামা ইবন যায়েদের মাধ্যমে নবী করীম (ﷺ)-এর নিকট আবেদন করে।
তখন নবী করীম (ﷺ) বলেছিলেন : তুমি আল্লাহর নির্ধারিত শাস্তি রহিত করার জন্য সুপারিশ করছে? তারপর তিনি উপস্থিত জনতার উদ্দেশ্যে একটি ভাষণ দেন। তাতে বলেন : তোমাদের পূর্ববর্তী বহু জাতি ধ্বংস হয়েছে এ জন্য যে, তাদের কোন গণ্যমান্য ব্যক্তি চুরি করলে তারা তাকে ছেড়ে দিত। আর দুর্বল কেউ চুরি করলে তার ওপর “হদ” বা নির্ধারিত শাস্তি হাত কেটে দিত। এ বক্তব্যের মাধ্যমে আলী এ সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, ফাতিমাও তো অন্য আর দশজন মুসলিম রমণীর মত । এমন একটি সরল মনে আলী (রা) আরেকটি বিয়ের চিন্তা করেছিলেন, কিন্তু এর প্রতিক্রিয়া যে এত ভয়াবহ আকার ধারণ করবে আলী (রা)-এর কল্পনায়ও তা আসেনি। আমর ইবন হিশাম ইবন আল-মুগীরা আল-মাখযুমীর কন্যাকে বিয়ের প্রস্তাব প্রেরণ করবেন, একথা প্রকাশ করতেই ফাতিমা ক্ষোভে-উত্তেজনায় ফেটে পড়লেন। নবী করীম (ﷺ) ও রাগান্বিত হলেন। আমর ইবন হিশাম তথা আবু জাহেলের কন্যার সাথে আলীর বিয়ের প্রস্তাবের কথা ফাতিমার কানে যেতেই তিনি পিতার নিকট ছুটে গিয়ে অনুযোগের সুরে বলেন : আপনার সম্প্রদায়ের জনগণ ধারণা করে, আপনার কন্যার স্বার্থ ক্ষুন্ন হলেও আপনি রাগ করেন না। এ আলী তো এখন আবু জাহেলের কন্যাকে বিয়ে করছে।
আসলে কথাটি শ্রবণ করে নবী করীম (ﷺ) দারুণ ক্ষুব্ধ হন। কিন্তু বিষয়টি ছিল বেশ কঠিন। কারণ, এখানে আলী (রা)-এর অধিকারের প্রশ্নও জড়িত ছিল। ফাতিমাকে রেখেও আলী আরো একাধিক বিয়ে করতে পারেন। সে অধিকার আল্লাহ তাকে দিয়েছেন। এ অধিকারে নবী করীম (ﷺ) কিভাবে বাধা দিবেন? অন্যদিকে কলিজার টুকরো কন্যাকে সতীনের ঘর করতে হবে এটাও বড় দুঃখের বিষয়।
তাই বলে আল্লাহ যা হালাল করেছেন তা কি তিনি হারাম করতে পারেন না, তা পারেন না। তবে এখানে সমস্যাটির আরেকটি দিক আছে। তা হলো আলীর প্রস্তাবিত কনে আবু জাহেল আমর ইবন হিশামের কন্যা। আলীর গৃহে তাঁর স্ত্রী হিসেবে আল্লাহর রাসূলের কন্যা এবং আল্লাহর শত্রুর কন্যা এক সাথে অবস্থান করতে পারে? এ সেই আবু জাহেল, ইসলামের প্রতি যার নিকৃষ্ট শক্রতা এবং রাসূল ও মুসলমানদের উপর নির্দয় যুলুম-নির্যাতনের কথা রাসূল ও মুসলমানদের স্মৃতি থেকে এখনো মুছে যায়নি। আল্লাহর এ শক্র একদিন কুরাইশদেরকে বলেছিল: ওহে কুরাইশ গোত্রের জনগণ! তোমরা এ মুহাম্মদকে আমাদের উপাস্যদের দোষ-ত্রুটি বর্ণনা করে বেড়াতে, আমাদের পূর্বপুরুষকে গালিগালাজ করতে এবং আমাদের বুদ্ধিমান ব্যক্তিবর্গকে বোকা ও নির্বোধ বলে বেড়াতে দেখছে, তা থেকে সে বিরত হবে না। আমি আল্লাহর নামে কসম করে বলছি, আগামীকাল আমি এমন একটি বড় পাথর নিয়ে বসে থাকবো। যখনই সে সিজদায় যাবে অমনি সে পাটি দিয়ে আমি তার মাথাটি চূর্ণ-বিচূর্ণ করে ফেলবো। তখন তোমরা আমাকে বনু আবদে মান্নাফের হাতে সোপর্দ অথবা তাদের হাত থেকে রক্ষা, যা খুশী তাই করবে।
সে কুরাইশদের সমাবেশ রাসূলকে বিদ্রুপ করে বলে বেড়াতো : “ওহে কুরাইশ সম্প্রদায়! মুহাম্মদ ধারণা করে জাহান্নামে আল্লাহর যে সৈনিকরা তোমাদেরকে শাস্তি দিবে এবং বন্দী করে রাখবে তাদের সংখ্যা মাত্র উনিশজন। তোমরা তো তাদের চেয়ে সংখ্যায় অধিক। তোমাদের প্রতি এক শো’ জনে কি তাদের একজনকে রুখে দিতে পারবে না তখন নাযিল হয় কুরআনের নিম্নোক্ত আয়াত
وما من أصحاب النار اهنگ ما جلتا عدهم إلا فتنة الذين كفروا .
“আমি ফেরেশতাগণকে করেছি জাহান্নামের প্রহরী ; কাফিরদের পরীক্ষাস্বরূপই আমি তাদের এ সংখ্যা উল্লেখ করেছি।” (সূরা-৭৪ মুদ্দাচ্ছির : আয়াত-৩১)
এ সেই আবু জাহেল যে আখনাস ইবন শুরাইককে যখন সে তার নিকট তার শ্রবণকৃত কুরআন প্রসঙ্গে জানতে চেয়েছিল, বলেছিল : তুমি কী শুনেছো? আমরা ও বনূ আবদে মান্নাফ মর্যাদা নিয়ে ঝগড়া-বিবাদ করলাম। তারা মানুষকে আহার করালো, আমরাও করালাম । তারা মানুষের দায়িত্ব কাঁধে নিল আমরাও নিলাম। তারা মানুষকে দান করলো; আমরাও করলাম। এভাবে আমরা যখন বাজির দুই ঘোড়ার মত বরাবর হয়ে গেলাম তখন তারা বললো : আমাদের মধ্যে নবী আছে, আকাশ থেকে তার নিকট ওহী আসে। এখন এ নবী আমরা কিভাবে পাব? আল্লাহর কসম! আমি কখনো তার প্রতি ঈমান আনবো না, তাকে বিশ্বাসও করবো না। এ সেই আবু জাহেল যে কোন মর্যাদাবান ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ করেছে শ্রবণ করলে তাকে ভয়-ভীতি দেখাতো, হেয় ও অপমান করতো। বলতো : তুমি তোমার পিতাকে, যে তোমার চেয়ে উত্তম ছিল, ত্যাগ করেছো? তোমার বুদ্ধিমত্তাকে আমরা নির্বুদ্ধিতা বলে প্রচার করবো, তোমার অভিমত ও সিদ্ধান্তকে আমরা ভুল-ভ্রান্তিতে পূর্ণ বলে প্রতিষ্ঠা করবো এবং তোমার মান-মর্যাদা ধুলোয় মিশিয়ে দিব।’
আর কোন ব্যবসায়ী যদি ইসলাম গ্রহণ করতো, তাকে বলতো: আল্লাহর শপথ! আমরা তোমার ব্যবসায় লাটে উঠাবো, তোমার অর্থ-সম্পদের বারোটা বাজিয়ে ছাড়বো। আর ইসলাম গ্রহণকারী দুর্বল হলে শারীরিক শাস্তি দিয়ে তাকে ইসলাম ত্যাগের জন্য চাপ দিত। এ সেই আবু জাহেল যে মক্কার শিবে আবী তালিবের অবরোধকালে হাকীম ইবন হিশাম ইবন খুওয়াইলিদকে তার ফুফু খাদীজার (রা) জন্য সামান্য কিছু খাবার নিয়ে গমন করতে বাধা দিয়েছিল। এ অভিশপ্ত ব্যক্তি তার পথ রোধ করে দাঁড়িয়ে বলেছিল : তুমি বনূ হাশিমের জন্য খাবার নিয়ে যাচ্ছো? আল্লাহর কসম! এ খাবার নিয়ে তুমি যেতে পারবে না। মক্কায় চলো, তোমাকে আমি অপমান করবো। সে পথ ছাড়তে অস্বীকার করলো। সেদিন দু’জনের মধ্যে তুমুল লড়াই হয়। এরই প্রেক্ষিতে নাযিল হয়
ان شجرت القوم . طعام الأثيم. گالمهلي يغلى في البطون تقلي الحميم.
“নিশ্চয়ই যাক্কুম- বৃক্ষ পাপীর খাবার। গলিত তামার মত তাদের পেটে ফুটতে থাকবে। ফুটন্ত পানির মত।” (সূরা-৪৪ আদ-দুখান : আয়াত-৪৩)
এ আবু জাহেল মক্কায় আগত নাজরানের একটি খ্ৰীষ্টান প্রতিনিধি দলের মুখোমুখী হয়। তারা এসেছিল মক্কায় মুহাম্মাদ এর নবুওয়্যাত লাভের সংবাদ পেয়ে তার প্রসঙ্গে আরো তথ্য হাসিলের উদ্দেশ্যে। তারা নবী করীম (ﷺ)-এর সাথে সাক্ষাতের পর তার কথা শ্রবণ করে ঈমান আনে। তারা নবী করীম (ﷺ)-এর মজলিস থেকে বেরিয়ে আসার পরই আবু জাহেল তাদের সামনে এসে দাঁড়ায় এবং তাদেরকে উদ্দেশ্য করে বলে-
‘আল্লাহ তোমাদের কাফেলাটিকে ব্যর্থ করুন। পিছনে রেখে আসা তোমাদের স্বধর্মাবলম্বীরা তোমাদেরকে প্রেরণ করেছে এ লোকটি প্রসঙ্গে তথ্য নিয়ে যাবার জন্য। তার নিকট তোমরা একটু স্থির হয়ে বসতে না বসতেই তোমাদের ধর্ম ত্যাগ করে তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে বসলে? তোমাদের চেয়ে বেশী নির্বোধ কোন কাফেলার কথা আমার জানা নেই।
এ আবু জাহেল নবী করীম (ﷺ)-এর মদীনায় হিজরতের অব্যবহিত পূর্বে কুরাইশদেরকে বলেছিল, কুরাইশ গোত্রের প্রতিটি শাখা থেকে একজন করে সাহসী ও চালাক-চতুর যুবক নির্বাচন করে তার হাতে একটি করে তীক্ষ্ণ তরবারি তুলে দেবে। তারপর একযোগে মুহাম্মাদের উপর হামলা চালিয়ে এক ব্যক্তির মত এক আঘাতে তাকে হত্যা করবে। তাতে তার রক্তের দায়-দায়িত্ব কুরাইশ গোত্রের সকল শাখার ওপর সমানভাবে বর্তাবে।
নবী করীম (ﷺ) রাতে মদীনায় হিজরত করলেন। পরের দিন সকালে কুরাইশরা তার খোঁজে বেরিয়ে পড়লো। তাদের মধ্যে আবু জাহেলও ছিল। তারা আবু বকরের (রা) ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে হাঁকডাক দিতে শুরু করলো- আবু বকর (রা)-এর কন্যা আসমা (রা) বের হয়ে আসলেন। তারা প্রশ্ন করলো : তোমার বাবা কোথায়? তিনি বললেন : আল্লাহর শপথ! আমার বাবা কোথায় তা আমার জানা নেই। তখন যাবতীয় অশ্লীল ও দুষ্কর্মের হোতা আবু জাহেল তার হাতটি উঠিয়ে সজোরে আসমার গালে এক থাপ্পড় বসিয়ে দেয়। আসমার কানের দুলটি ছিটকে পড়ে গেল।
বদরে যখন দু’পক্ষ যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ার তোড়জোড় করছে তখন কুরাইশ বাহিনী এক ব্যক্তিকে প্রেরণ করলে শত্রু বাহিনীর সংখ্যা ও শক্তি প্রসঙ্গে তথ্য নিয়ে আসার জন্য। সে ফিরে এসে যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার বিষয়ে সতর্ক করে দিল। হাকীম ইবন হিশাম ইবন খুওয়াইলিদ গেলেন উতবা ইবন রাবী’আর নিকট এবং তাকে লোক-লস্করসহ প্রত্যাবর্তন করার অনুরোধ জানালেন। উতবা নিমরাজি ভাব প্রকাশ করে সে হাকীমকে আবু জাহেলের নিকট প্রেরণ করলো। কিন্তু আবু জাহেল যুদ্ধ ব্যতীত হাকীমের কথা কানেই তুললো না।
এ সেই আবু জাহেল, বদরের দিন নবী করীম (ﷺ) যে সাতজন কট্টর কাফিরের প্রতি বদ-দু’আ করেন, সে তাদের অন্যতম। এ যুদ্ধে সে অভিশপ্ত কাফির হিসেবে মৃত্যুবরণ করে। তার মাথাটি কেটে নবী করীম (ﷺ)-এর সামনে আনয়ন করলে তিনি আল্লাহর প্রশংসা করেন। নবী করীম (ﷺ) আবু জাহেলের উটটি নিজের কাছে রেখে দেন। এর চার বছর পর উমরার উদ্দেশ্যে যখন মক্কার দিকে যাত্রা করেন তখন উটটি কুরবানীর পশু হিসেবে সংগে নিয়ে চলেন। পথে হুদায়বিয়াতে কুরাইশদের দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হয়ে সেখানেই উটটি কুরবানী করেন।
ইসলামের এ জাতীয় শত্রুর কন্যা কি নবী করীম (ﷺ)-এর কন্যা ফাতিমা (রা)-এর সতীন হতে পারে। তাই আল্লাহ ও তাঁর নবী করীম (ﷺ) তা প্রত্যাখ্যান করেন। নবী করীম (ﷺ) রাগান্বিত অবস্থায় ঘর থেকে বেরিয়ে মসজিদের দিকে গমন করেন এবং সোজা মিম্বরে গিয়ে ওঠেন। তারপর উপস্থিত ব্যক্তিবর্গের উদ্দেশ্যে নিম্নের ভাষণটি দেন-
“বনু হিশাম ইবন আল-মুগীরা আলীর সাথে তাদের কন্যা দেয়ার বিষয়ে আমার অনুমতি চায়। আমি তাদেরকে সে অনুমতি দিব না। আমি তাদেরকে সে অনুমতি দিব না। আমি তাদেরকে সে অনুমতি দিব না। তবে আলী ইচ্ছা করলে আমার কন্যাকে তালাক দিয়ে তাদের কন্যাকে বিয়ে করতে পারে। কারণ, আমার কন্যা আমার শরীরের একটি অংশের মত। তাকে যা কিছু অস্থির করে তা আমাকেও অস্থির করে, আর যা তাকে কষ্ট দেয় তা আমাকে কষ্ট দেয়। আমি তার দ্বীনের বিষয়ে সঙ্কটে পড়ার ভয় করছি।”
তারপর তিনি তার জামাই আবুল আসের প্রসঙ্গ উত্থাপন করেন। তার সাথে বৈবাহিক আত্মীয়তার ভূয়সী প্রশংসা করেন। তিনি বলেন
সে আমাকে কথা দিয়েছে এবং সে কথা সত্য প্রমাণিত করেছে। সে আমার সাথে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে এবং তা পূরণ করেছে। আমি হালালকে হারাম করতে পারবো না। অনুরূপভাবে হারামকেও হালাল করতে পারবো না। তবে আল্লাহর রাসূলের কন্যা ও আল্লাহর শত্রুর কন্যার কখনো সহ অবস্থান হতে পারে না।
আলী (রা) মসজিদে ছিলেন। চুপচাপ বসে শ্বশুরের বক্তব্য শ্রবণ করলেন। তারপর মসজিদ থেকে বের হয়ে ধীরে ধীরে বাড়ীর পথ ধরলেন। এক সময় বাড়ীতে পৌছলেন, সেখানে দুঃখ ও বেদনায় ভারাক্রান্ত ফাতিমা বসা আছেন। আলী (রা) ধীরে ধীরে তাঁর পাশে গিয়ে বসলেন। কিছু সময় চুপ করে বসে থাকলেন। কি বলবেন তা যেন স্থির করতে পারছেন না। যখন দেখলেন ফাতিমা কান্নাকাটি করছেন, তখন ক্ষমা প্রার্থনার ভঙ্গিতে আস্তে করে বললেন ফাতিমা! তোমার অধিকার প্রসঙ্গে আমার ভুল হয়েছে। তোমার মত ব্যক্তিরা ক্ষমা করতে পারে। কিছু সময় কেটে গেল, ফাতিমা কোন জবাব দিলেন না। তারপর এক সময় বললেন : আল্লাহ আপনাকে ক্ষমা করুন। এবার আলী (রা) একটু সহজ হলেন। তারপর মসজিদের সব ঘটনা তাকে বর্ণনা করেন। তাঁকে একথাও বলেন যে, নবী করীম (ﷺ) বলেছেন, আল্লাহর রাসূলের কন্যা ও আল্লাহর শত্রুর কন্যার সহঅবস্থান কখনো সম্ভব নয়। ফাতিমার দুচোখ পানিতে ভরে গেল। তারপর তিনি সালাতে দাড়িয়ে গেলেন।
আবু জাহলের সে কন্যার নাম নিয়ে মতপার্থক্য রয়েছে। সর্বাধিক প্রসিদ্ধ মতে জুওয়াইরিয়া। তাছাড়া আল-“আওরা, আল-হানকা জাদাম ও জামীলাও বলা হয়েছে। ইসলাম গ্রহণ করে তিনি নবী করীম (ﷺ)-এর নিকট বাই’আত হন এবং নবী করীম (ﷺ) -এর কতিপয় হাদীসও স্মৃতিতে সংরক্ষণ করেন। ‘আলী (রা) তাঁর প্রস্তাব তুলে নেন এবং আবু জাহেলের কন্যাকে উতাব ইবন উসাইদ বিয়ে করেন। এ ঘটনার পর ফাতিমা (রা) জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আলী (রা)-এর একক স্ত্রী হিসেবে অতিবাহিত করেন। ফাতিমা (রা)-এর ইন্তিকালের পূর্ব পর্যন্ত তিনি দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রহণ করেননি। ফাতিমা হাসান, হুসাইন, উম্মু কুলছুম ও যয়নব-এ চার সন্তানের মা হন।
দ্বিতীয় বিয়ের ইচ্ছের এ ঘটনাটি ঘটেছিল যখন
এখানে একটি প্রশ্ন থেকে যায়, তা হলো- আলী (রা) কখন এ দ্বিতীয় বিয়ের ইচ্ছা করেছিলেন? ইতিহাস ও সীরাতের গ্রন্থাবলিতে নবী করীম (ﷺ)-এর উল্লিখিত গুরুত্বপূর্ণ ভাষণটি বর্ণিত হলেও কেউ তার সময়কাল সুনির্দিষ্টভাবে বর্ণনা করেননি। অথচ এটা রাসূল (ﷺ)-এর জীবন ও তাঁর পরিবারের জন্য ছিল একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। তাই কোন কোন বিশেষজ্ঞ নানাভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করে এ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, এটা ছিল আলী-ফাতিমা (রা)-এর বিবাহিত জীবনের প্রথম দিকের ঘটনা। আর সুনির্দিষ্টভাবে তা হয়তো হবে হিজরী দ্বিতীয় সন, তৃতীয় সনে তাদের প্রথম সন্তান হাসান জন্মগ্রহণের পূর্বে। অবশ্য এটা সম্পূর্ণ অনুমান ভিত্তিক অভিমত; এর সপক্ষে কোন বিস্তারিত দলিল-প্রমাণ নেই।
হাসান- হাইনের জন্ম
আলী-ফাতিমা (রা)-এর জীবনে যে মেঘ দেখা দিয়েছিল তা কেটে গেল, জীবনের এক কঠিন পরীক্ষায় তারা সফলতার সাথে উত্তীর্ণ হলেন। অভাব ও টানাটানির সংসারটি আবার প্রেম-প্রীতি ও সহমর্মিতায় পরিপূর্ণ হল। এরই মধ্যে হিজরী তৃতীয় সনে তাদের প্রথম সন্তান হাসানের জন্ম হলো। ফাতিমার পিতা রাসূলকে সুসংবাদ দেয়া হলো।
তিনি দ্রুত ছুটে গেলেন এবং আদরের কন্যা ফাতিমার সদ্যপ্রসূত সন্তানকে দু’হাতে নিয়ে তার কানে আযান দেন এবং গভীরভাবে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকেন। গোটা মদীনা যেনো আনন্দ-উৎসবে মেতে ওঠে। নবী করীম (ﷺ)-এর নাতি হাসানের মাথা মুড়িয়ে তার চুলের সমপরিমাণ ওজনের রুপা-গরীব মিসকীনদের মধ্যে দান করে দেন। শিশু হাসানের বয়স এক বছরের কিছু বেশী হতে না হতেই চতুর্থ হিজরীর শা’বান মাসে ফাতিমা (রা) দ্বিতীয় সন্তান উপহার দেন। আর এ শিশু হলেন হুসাইন। তিনি শিশু হাসানকে দু’হাতের উপর রেখে দোলাতে দোলাতে নিম্নের বাক্যটি আবৃত্তি করতেন
إن بنى شبة النبي ليس شبيها بقلي.
‘আমার সন্তান নবীর মত দেখতে, আলীর মত নয়।
হাসান-লাইনের প্রতি নবী করীম (ﷺ) -এর আদর ও স্নেহ
নবী করীম (ﷺ)-এর অতি আদরের এ দুই নাতি যেমন তার অন্তরে প্রশান্তি বয়ে আনে তেমনি তাদের মা ফাতিমার দু’কোল ভরে দেয়। খাদীজার (রা) মৃত্যুর পর নবী করীম (ﷺ) বেশ কয়েকজন রমণীকে স্ত্রীর মর্যাদা দান করেন, কিন্তু তাঁদের কেউই তাকে সন্তান উপহার দিতে পারেননি। পুত্র সন্তানের যে অভাববোধ তার মধ্যে ছিল তা এ দুই নাতিকে পেয়ে দূর হয়ে যায়। এ দুনিয়ায় তাদের মাধ্যমে নিজের বংশধারা বিদ্যমান থাকার সম্ভাবনায় নিশ্চিন্ত হন। এ কারণে তার পিতৃস্নেহও তাঁদের ওপর বর্তায়। আর তাই এতে বিয়ের কিছু নেই যে, তিনি তাদের দু’জনকে নিজের ছেলে হিসেবে অভিহিত করেছেন।
আনাস ইবন মালিক থেকে বর্ণিত হয়েছে, নবী করীম (ﷺ) ফাতিমা (রা)-কে বলতেন, ছেলে দুটোকে ডাক। তারা নিকটে এলে তিনি তাদের শরীরের গন্ধ শুকতেন এবং জড়িয়ে ধরতেন। উসমান ইবন যায়েদ (রা) বলেছেন, আমি একদিন কোন একটি প্রয়োজনে নবী করীম (ﷺ)-এর ঘরের দরজায় খটখট আওয়াজ দিলাম। তিনি দেহের চাদরে কিছু জড়িয়ে বেরিয়ে এলেন। আমি বুঝতে পারলাম না চাদরে ঢেকে রেখেছেন কি জিনিস?
তিনি চাদরটি সরালে দেখলাম, হাসান ও হুসাইন। তারপর তিনি বললেন : এরা। দু’জন হলো আমার ছেলে এবং আমার কন্যার ছেলে। হে আল্লাহ! আমি এদের দু’জনকে ভালোবাসি, আপনিও তাদেরকে ভালোবাসুন। আর তাদেরকে যারা ভালোবাসে তাদেরকেও ভালোবাসুন।
আল্লাহ রাব্বল আলামীন ফাতিমা আয-যাহরা’র প্রতি বড় দয়া ও অনুগ্রহ করেছেন। তিনি তার মাধ্যমে রাসূল (ﷺ)-এর বংশধারা সংরক্ষণ করেছেন। তেমনিভাবে আলী (রা)-এর ঔরসে সর্বশেষ নবীর বংশধারা দান করে আল্লাহ তাঁকেও এক চিরকালীন সম্মান ও মর্যাদায় ভূষিত করেছেন। রক্ত সম্পর্কের দিক দিয়ে আলী (রা) নবী করীম (ﷺ)-এর নিকটতম জামাই। তার দেহে পরিচ্ছন্ন। হাশেমী রক্ত বহমান ছিল। নবী করীম (ﷺ) ও আলী (রা)-এর বংশধারা আবদুল মুত্তালিবে গিয়ে মিলিত হয়েছে। উভয়ে ছিলেন তাঁর নাতি। আলী (রা)-এর পিতা আবু তালিব নবী করীম (ﷺ)-কে পুত্রস্নেহে লালন পালন করেন।
পরবর্তীতে নবী করীম (ﷺ) সে পিতৃতুল্য চাচার ছেলে ‘আলীকে পিতৃস্নেহে পালন করে নিজের কলিজার টুকরা মেয়েকে তার নিকট সোপর্দ করেন। কাজেই নবী করীম (ﷺ) -এর নিকট আলী (রা)-এর স্থান ও মর্যাদা ছিল অত্যুচ্চ। আলী (রা) বলেন, একদিন আমি নবী করীম (ﷺ)-কে প্রশ্ন করলাম : আমি ও ফাতিমা – এ দু’জনের মধ্যে কে আপনার নিকট অধিক প্রিয় বললেন : ফাতিমা তোমার চেয়ে আমার নিকট অধিক প্রিয়। আর তুমি আমার নিকট তার চেয়ে অধিক সম্মানের পাত্র।
এ জবাবের মধ্যে নবী করীম (ﷺ) -এর নিকট ফাতিমা ও আলী (রা)-এর স্থান ও মর্যাদা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এ কারণে শত ব্যস্ততার মাঝে সুযোগ পেলেই তিনি ছুটে যেতেন তার সবচেয়ে প্রিয় এ দম্পতির ঘরে এবং অতি আদরের নাতিদ্বয়কে কোলে তুলে নিয়ে স্নেহের পরশ বুলাতেন। একদিন তাদের ঘরে গমন করে দেখেন, আলী-ফাতিমা ঘুমিয়ে আছেন, আর শিশু হাসান খাবারের জন্য কান্না জুড়ে দিয়েছে। তিনি তাঁদের দুজনের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটালেন না। হাসানকে কোলে নিয়ে বাড়ীর আঙ্গিনায় বাধা একটি ছাগীর কাছে চলে যান এবং নিজ হাতে ছাগীর দুধ দোহন করে হাসানকে পান করিয়ে তাকে শান্ত করেন।
আর একদিনের ঘটনা। নবী করীম (ﷺ) ফাতিমা- আলী (রা)-এর বাড়ীর পাশ দিয়ে ব্যস্ততার সাথে কোথাও গমন করছেন। এমন সময় হুসাইনের কান্নার আওয়াজ তার কানে ভেসে আসল। তিনি বাড়ীতে প্রবেশ করে কন্যাকে তিরস্কারের সুরে বললেন : তুমি কি জান না, তার কান্না আমাকে কষ্ট দেয়।
কন্যা যয়নব ও উবু কুলছুমের জন্ম
এরপর এ দম্পতির সন্তান সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। হিজরী ৫ম সনে ফাতিমা (রা) প্রথম কন্যার মা হন। নানা নবী করীম (ﷺ) তার নাম রাখেন “যয়নব”। উল্লেখ্য যে, ফাতিমার এক সহোদরার নাম ছিল “যয়নব” মদীনায় হিজরতের পর ইনতিকাল করেন। সেই যয়নবের স্মৃতি তার পিতা ও বোনের অন্তরে বিদ্যমান ছিল। সেই খালার নামে ফাতিমার এ কন্যার নাম রাখা হয়। এর দু’বছর পর ফাতিমা (রা) দ্বিতীয় কন্যার মা হন। তারও নাম রাখেন নানা নবী করীম (ﷺ) নিজের অপর মৃত কন্যা উম্মু কুলছুমের নামে। এভাবে ফাতিমা (রা) তাঁর কন্যার মাধ্যমে নিজের মৃত দু’বোনের স্মৃতিকে বাঁচিয়ে রাখেন। ফাতিমা (রা)-এর এ চার সন্তানকে জীবিত রেখেই নবী করীম (ﷺ) আল্লাহ রাব্বল আলামীনের সান্নিধ্যে চলে যান।
ফাতিমা (রা)-এর সব সন্তানই ছিল নবী করীম (ﷺ)-এর কলিজার টুকরা বিশেষত: হাসান ও হুসাইনের মধ্যে তিনি যেন নিজের পরলোকগত পুত্র সন্তানদেরকে খুঁজে পান। তাই তাদের প্রতি ছিল বিশেষ মুহাব্বত (ভালবাসা)। একদিন তিনি তাদের একজনকে কাঁধে করে মদীনার বাজারে ঘুরছেন। সালাতের সময় হলে তিনি মসজিদে প্রবেশ করলেন এবং তাকে খুব আদরের সাথে এক পাশে বসিয়ে সালাতের ইমাম হিসেবে দাঁড়িয়ে গেলেন। কিন্তু এত দীর্ঘ সময় সিজদায় কাটালেন যে পিছনের মুক্তাদিরা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল। সালাত শেষে কেউ একজন জিজ্ঞেস করলো : হে আল্লাহর রাসূল! আপনি এত দীর্ঘ সিজদা করেছেন যে, আমরা ধারণা করেছিলাম কিছু একটা ঘটেছে অথবা ওহী নাযিল হয়েছে। জবাবে তিনি বললেন : না, তেমন কিছু ঘটেনি। আসল ঘটনা হলো, আমার ছেলে (নাতি) আমার পিঠে বসেছিল। আমি চেয়েছি তার ইচ্ছা পূর্ণ হোক। তাই তাড়াতাড়ি করিনি। একদিন নবী করীম (ﷺ) মিম্বরের উপর বসে ভাষণ দিচ্ছেন। এমন সময় দেখলেন হাসান ও হুসাইন দুই ভাই লাল জামা পরিধান করে উঠা-পড়া অবস্থায় হেঁটে আসছে। তিনি ভাষণ বন্ধ করে মিম্বর থেকে নেমে গিয়ে তাদের দু’জনকে উঠিয়ে সামনে এনে বসান। তারপর তিনি উপস্থিত শ্রোতাকে উদ্দেশ্য করে বলেন : আল্লাহ সত্যই বলেছেন
انا أثوانگم واولادكم فثئ.
‘তোমাদের সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি পরীক্ষা বিশেষ। (সূরা-৬৪ তাগাবুন: আয়াত-১৫)
আমি দেখলাম, এ শিশু দুটি হাঁটছে আর পড়ছে। এ দৃশ্য দেখে সহ্য করতে না পেরে কথা বন্ধ করে তাদেরকে উঠিয়ে এনেছি।
আরেকদিন তো দেখা গেল, শিশু সাইনের দুধের উপর নবী করীম (ﷺ)-এর হাত। আর তার দু’পা নবী করীম (ﷺ)-এর দু’পায়ের উপর। তিনি তাকে শক্ত করে ধরে বললেন, উপরে বেয়ে ওঠো। হুসাইন উপরের দিকে উঠতে উঠতে এক সময় নানার বুকে পা রাখলো। এবার তিনি হাইনকে বললেন : মুখ খোল। সে হা করলো। তিনি তার মুখে চুমু দিয়ে বললেন, “হে আল্লাহ! আমি তাকে ভালোবাসি এবং সেও আমাকে ভালোবাসে। তাকে যারা ভালোবাসে আপনি তাদের ভালোবাসুন।
একদিন নবী করীম (ﷺ) কিছু সংখ্যক সাহাবীকে সঙ্গে করে কোথাও দাওয়াত খেতে যাচ্ছেন। রাস্তায় হুসাইনকে তার সমবয়সী শিশুদের সাথে খেলতে দেখলেন। নবী করীম (ﷺ) দু’হাত বাড়িয়ে তাকে ধরতে এগিয়ে গেলেন। সে নানার হাতে ধরা না দেয়ার জন্য একবার এদিক, একবার ওদিক ছুটাছুটি করতে থাকে। নবী করীম (ﷺ) হাসতে হাসতে তার সামনে গিয়ে দাঁড়ান। এক সময় তাকে ধরে নিজের একটি হাতের উপর বসান এবং অন্য হাতটি তার চিবুকের নীচে রেখে তাকে চুমু দেন। তারপর বলেন : হুসাইন আমার অংশ এবং আমি হুসাইনের অংশ।
ফাতিমার বাড়ীর দরজায় আবু সুফিয়ান
সময় অতিবাহিত হতে লাগল। ইসলামের আলোতে গোটা আরবের অন্ধকার বিদূরিত হতে চললো। এক সময় নবী করীম (ﷺ) মক্কা অভিযানের প্রস্তুতি নিতে লাগলেন। মদীনায় ব্যাপক সাড়া পড়ে গেল। এ অভিযানে নারী-পুরুষ সকলেই অংশ নিবে। মক্কায় এ সংবাদ সময় মত পৌছে গেল। পৌত্তলিক কুরাইশদের হৃদকম্পন শুরু হলো। তারা ভাবলো এবার আর রক্ষা নেই। অনেক কিছু চিন্তা-ভাবনার পর তারা মদীনাবাসীদেরকে তাদের সিদ্ধান্ত থেকে বিরত রাখার জন্য আবু সুফিয়ান ইবন হারবকে মদীনায় প্রেরণ করলো। কারণ, ইতোমধ্যে তার কন্যা উম্মু হাবীবা রামলা (রা) ইসলাম গ্রহণ করেছেন এবং নবী করীম (ﷺ) তাকে স্ত্রীর মর্যাদা দান করেছেন। অতএব তাকে দিয়েই এ কাজ সম্ভব হবে।
আলী ও ফাতিমা অভিযানে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নিলেন। রওয়ানা দেয়ার পূর্বে একদিন রাতে তারা সফরের প্রস্তুতি গ্রহণ করছেন। নানা স্মৃতি তাদের মানসপটে ভেসে উঠছে। মাঝে মাঝে তারা স্মৃতিচারণও করছেন। আট বছর পূর্বে যে মক্কা তারা পিছনে রেখে চলে এসেছিলেন তা কি তেমনই আছে তাদের স্মৃতিতে তখন ভেসে উঠছে মা খাদীজা (রা), পিতা আবু তালিবের ছবি। এমনই এক ভাব-বিহ্বল অবস্থার মধ্যে যখন তারা তখন হঠাৎ দরজায় খটখট আওয়াজ হলো। এত রাতে আগন্তুক কে তা দেখার জন্য আলী (রা) দরজার দিকে অগ্রসর হলেন। ফাতিমাও সে দিকে তাকিয়ে থাকলেন। দরজা খুলতেই তারা দেখতে পেলেন আবু সুফিয়ান ইবন হারব দণ্ডায়মান। এ সেই আবু সুফিয়ান, যিনি মক্কার পৌত্তলিক বাহিনীর পতাকাবাহী এবং উহুদের শহীদ হামযা (রা)-এর বুক কেঁড়ে কলিজা বের করে চিবিয়ে ছিল যে হিন্দ, তার স্বামী।
আবু সুফিয়ান বলতে লাগলেন, কিভাবে মদীনায় আগমন করেছেন এবং কেন এসেছেন, সে কথা। বললেন : মক্কাবাসীরা মুহাম্মাদের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য, তার সাথে একটা সমঝোতায় পৌছানোর উদ্দেশ্যে তাকে প্রেরণ করেছে। তিনি নিজের পরিচয় গোপন করে মদীনায় প্রবেশ করেছেন এবং সরাসরি নিজের কন্যা উম্মুল মু’মিনীন উম্মু হাবীবা রামলা (র)-এর ঘরে হাযির হয়েছেন। সেখানে নবী করীম (ﷺ)-এর বিছানায় বসার জন্য উদ্যত হতেই নিজ কন্যার নিকট বাধাপ্রাপ্ত হয়েছেন। কারণ, তিনি একজন মুশরিক, অপবিত্র।
আল্লাহর নবী করীম (ﷺ)-এর পবিত্র বিছানায় বসার যোগ্যতা তার নেই। কন্যা বিছানাটি গুটিয়ে নেন। মনে বড় ব্যথা নিয়ে তিনি রাসূল (ﷺ)-এর নিকট গমন করেন এবং তার সাথে অভিযানের নিকট থেকেও একই আচরণ লাভ করেন। তারপর যান ওমরের (রা) নিকট। তিনি তার বক্তব্য শ্রবণ করে বলেন : আমি যাব তোমার জন্য সুপারিশ করতে নবী করীম (ﷺ) -এর নিকট আল্লাহর কসম!
ভূমিতে উদগত সামান্য উদ্ভিদ ব্যতীত আর কিছুই যদি না পাই, তা দিয়েই তোমাদের সাথে লড়বো।
এ পর্যন্ত বলার পর আবু সুফিয়ান একটু নীরব হলেন, তারপর একটা ঢোক গিলে আলী (রা)-কে লক্ষ্য করে বললেন ; ওহে আলী! তুমি আমার সম্প্রদায়ের প্রতি সবচেয়ে বেশী সদয়। আমি একটা প্রয়োজনে তোমার নিকট এসেছি। অন্যদের নিকট থেকে যেমন নিরাশ হয়ে ফিরেছি, তোমার নিকট থেকে সেভাবে ফিরতে চাই না। তুমি আমার জন্য একটু নবী করীম (ﷺ) -এর নিকট একটু সুপারিশ কর। আলী (রা) বললেন : আবু সুফিয়ান! তোমার অনিষ্ট হোক। আল্লাহর কসম! নবী করীম (ﷺ) একটি বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলছেন। সে বিষয়ে আমরা কোন কথা বলতে পারি না।
এবার আবু সুফিয়ান পাশে নীরব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ফাতিমার দিকে তাকালেন এবং পাশের বিছানায় সদ্য ঘুম থেকে জাগা ও মায়ের দিকে এগিয়ে আসা হাসানের দিকে ইঙ্গিত করে ফাতিমাকে বললেন: ওহে মুহাম্মাদের কন্যা! তুমি কি তোমার এ ছেলেকে বলবে, সে যেন মানুষের মাঝে দাঁড়িয়ে তার গোত্রের লোকদের নিরাপত্তার ঘোষণা দিক এবং চিরকালের জন্য গোটা আরবের নেতা হয়ে থাক?
ফাতিমা জবাব দিলেন : আমার এ এতটুকু ছেলে মানুষের সামনে দণ্ডায়মান হয়ে কাউকে নিরাপত্তা দেওয়ার ঘোষণা দেয়ার বয়স হয়নি। আর নবী করীম (ﷺ)-কে ডিঙ্গিয়ে কেউ কাউকে নিরাপত্তা দিতে পারে না।
হতাশ অবস্থায় আবু সুফিয়ান যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ালেন। দরজা পর্যন্ত গমন করে একটু থামলেন। তারপর কোমল কন্ঠে বললেন : আবু হাসান (আলী)! মনে হচ্ছে বিষয়টি আমার জন্য অত্যন্ত জটিল হয়ে গেছে। তুমি আমাকে একটু পরামর্শ দাও।
আলী (রা) বললেন : আপনার প্রয়োজন হবে এমন কোন পরামর্শ আমার জানা নেই। তবে আপনি হলেন কিনান (কুরাইশ গোত্রের একটি শাখা) গোত্রের নেতা। আপনি নিজেই জনমণ্ডলীর সামনে দণ্ডায়মান হয়ে নিরাপত্তার আবেদন করুন। তারপর নিজের জন্মভূমিতে প্রত্যাবর্তন করুন।
আবু সুফিয়ান বললেন : এটা কি আমার কোন কাজে আসবে? আলী (রা) কিছু সময় নীরব থেকে বললেন : আল্লাহর কসম! আমি তা মনে করি না। কিন্তু আমি তো আপনার জন্য এছাড়া আর কোন রাস্তা দেখছিনা।
আবু সুফিয়ান আলী (রা)-এর পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে চলে গেলেন। আর এ দম্পতি ঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়ে মহান আল্লাহ রাব্দুল আলামীনের অসীম ক্ষমতার কথা চিন্তা করতে লাগলেন। তারা ভাবতে লাগলেন উম্মুল কুরা মক্কা, কাবা কুরাইশদের বাড়ীঘর ইত্যাদির কথা।
মক্কা বিজয় অভিযানে ফাতিমা (রা)
দশ হাজার মুসলমান সঙ্গীসহ নবী করীম (ﷺ) মদীনা থেকে মক্কার দিকে রওয়ানা করলেন। আট বছর পূর্বে কেবল আবু বকর সিদ্দীক (রা)-কে সঙ্গে নিয়ে রাতের অন্ধকারে মক্কা থেকে হিজরত করে মদীনায় চলে আসেন। নবী পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সাথে ফাতিমাও এ মহা বিজয় ও গৌরবজনক ফিরে আসা প্রত্যক্ষ করার জন্য এ কাফেলায় শরীক হলেন। আট বছর পূর্বে তিনি একদিন বড় বোন উম্মু কুলছুমের সাথে মক্কা ছেড়ে মদীনায় চলে এসেছিলেন। তার অন্য দুই বোন রুকাইয়া ও যয়নাবও হিজরত করেছিলেন। কিন্তু আজ এ বিজয়ী কাফেলায় তাঁরা নেই। তাঁরা মদীনার মাটিতে ইন্তেকাল করেছেন।
আর কোনদিন মক্কায় ফিরে আসবেন না। অতীত স্মৃতি স্মরণ করতে করতে ফাতিমা কাফেলার সাথে চলছেন। এক সময় কাফেলা “মাররুজ জাহরান” এসে পৌছলো এবং শিবির স্থাপন করলো। দিন শেষ হতেই রাতের প্রথম ভাগে মক্কার পৌত্তলিক বাহিনীর নেতা আবু সুফিয়ান ইবন হারব এসে হাযির হলেন। মক্কাবাসীদের প্রসঙ্গে নবী করীম (ﷺ)-এর সিদ্ধান্ত জানার জন্য সারা রাত তিনি তার দরজায় অপেক্ষা করলেন। ভোর হতেই তিনি নবী করীম (ﷺ)-এর সামনে হাযির হয়ে ইসলাম গ্রহণের ঘোষণা দেন।
তারপর সেখান থেকে বের হয়ে সোজা মক্কার পথ ধরেন। মক্কায় পৌছে একটা উঁচু টিলার উপর দণ্ডায়মান হয়ে উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা দেন: ওহে কুরাইশ বংশের জনগণ! মুহাম্মাদ এমন এক বিশাল বাহিনী নিয়ে আসছেন যার সাথে তোমরা কখনো পরিচিত নও। যে ব্যক্তি আবু সুফিয়ানের ঘরে প্রবেশ করবে সে নিরাপদ, যে নিজ ঘরের দরজা বন্ধ করে বসে থাকবে সে নিরাপদ, আর যে মসজিদে প্রবেশ করবে সে নিরাপদ।’
ঘোষণা শ্রবণ করে মক্কার অধিবাসীরা নিজ নিজ ঘরে এবং মসজিদুল হারামে প্রবেশ করল। নবী করীম (ﷺ) যী তুওয়া”-তে বাহনের পিঠে অবস্থান করে সেনাবাহিনীকে বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত করে প্রত্যেক ভাগের জন্য একজন করে নেতা নিয়োগ করেন এবং কে কোন রাস্তায় মক্কায় প্রবেশ করবে তা নির্ধারণ করেন। একটি ভাগের নেতা ও পতাকাবাহী হন সা’দ ইবন উবাদা আল-আনসারী (রা)।
তিনি আবার আলী (রা)-কে বলেন: পতাকাটি আপনিই নিন। এটি হাতে করে আপনি মক্কায় প্রবেশ করবেন। এর পূর্বে আলী (রা) খায়বারে, বানী কুরায়জার যুদ্ধে নবী করীম (ﷺ)-এর এবং উহুদ যুদ্ধে মুহাজিরদের পতাকাবাহী ছিলেন।
মক্কা বিজয়ের দিন নবী করীম (ﷺ) আযাখির’ -এর পথে মক্কায় প্রবেশ করে মক্কার উঁচুভূমিতে নামলেন। উম্মুল মু’মিনীন খাদীজার (রা) কবরের অনতিদূরে তার জন্য তাঁবু টানানো হয়। সঙ্গে কন্যা ফাতিমা আয-যাহরাও ছিলেন। মক্কা থেকে যেদিন ফাতিমা (রা) মদীনায় গমন করছিলেন সেদিন আল-হুওয়াইরিছ ইবন মুনকি তাকে তার বাহনের পিঠ থেকে ফেলে দিয়ে জীবন বিপন্ন করে ফেলেছিল। সে স্মৃতি তার দীর্ঘদিন পর জন্মভূমিতে ফিরে আসার আনন্দকে ম্লান করে দিচ্ছিল। নবী করীম (ﷺ) ও সে কথা ভুলেননি।
তিনি বাহিনীকে বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত করে একজন পরিচালক নির্ধারণ করে দেন। কারা কোন রাস্তায় মক্কায় প্রবেশ করবে তাও বলে দেন। তাদেরকে নির্দেশ দেন তারা যেন অহেতুক কোন যুদ্ধে লিপ্ত না হয়। তবে কিছু মানুষ যাদের নাম উচ্চারণ করে বলেন, এরা যদি কাবার গিলাফের নীচেও আশ্রয় নেয় তাহলেও তাদের হত্যা করবে তাদের মধ্যে আল-হুয়াইরিছ ইবন মুনকিযও ছিল। তাকে হত্যার দায়িত্ব অর্পিত হয় ফাতিমা (রা)-এর স্বামী আলী (রা)-এর ওপর।
নবী করীম (ﷺ)-এর চাচাতো বোন উম্মু হানী বিবৃত আবী তালিব, মক্কার হুরায়রা ইবন আবী ওয়াহাবের স্ত্রী। তিনি বলেছেন, নবী নবী করীম (ﷺ) মক্কার উঁচু ভূমিতে আসার পর বনূ মাখযুমের দুই ব্যক্তি আল-হারিছ ইবন হিশাম ও যুহাইর ইবন আবী উমাইয়া ইবন আল-মুগীরা পালিয়ে আমার ঘরে আশ্রয় নেয়। আমার ভাই আলী ইবন আবী তালিব (রা) আমার সাথে দেখা করতে এসে তাদেরকে দেখে ভীষণ রেগে যান। আল্লাহর নামে কসম করে তিনি বলেন : আমি অবশ্যই তাদেরকে হত্যা করব।
অবস্থা বেগতিক দেখে আমি তাড়াতাড়ি দরজা বন্ধ করে নবী করীম (ﷺ) -এর নিকট ছুটে গেলাম। সেখানে পৌছে দেখি, তিনি একটি বড় পাত্রে পানি নিয়ে গোসল করছেন এবং ফাতিমা তাঁকে কাপড় দিয়ে আড়াল করে দাঁড়িয়ে আছেন। নবী করীম (ﷺ) গোসল সেরে আট রাকআত চাশতের সালাত আদায় করলেন, তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন : উম্মু হানী, কি জন্য এসেছো? আমি তাকে আমার বাড়ীর ঘটনাটি বললাম। তিনি বললেন : তুমি যাদেরকে আশ্রয় দিয়েছে আমিও তাদের আশ্রয় দিলাম। যাদের তুমি নিরাপত্তার ওয়াদা করেছ আমিও তাদের নিরাপত্তা দান করলাম। আলী তাদের হত্যা করবে না।
মক্কা নগরীতে ফাতিমা (রা)-এর প্রথম রাতটি কেমন কেটেছিল সে কথাও জানা যায়। তিনি অত্যন্ত আবেগতাড়িত হয়ে পড়েন। প্রিয়তমা সম্মানিতা মায়ের কথা, দুই সহোদরা যয়নব ও রুকাইয়ার স্মৃতি তার মানসপটে ভেসে উঠছিল। মক্কার অধিবাসীরা তাঁর পিতার সাথে যে নির্মম আচরণ করেছিল সে কথা, মক্কায় নিজের শৈশব-কৈশোরের বিভিন্ন কথা তার স্মৃতিতে ভেসে উঠছিল।
সারা রাত তিনি দু’চোখের পাতা একসাথে করতে পারেননি। ভোরবেলা মসজিদুল হারাম থেকে বিলালের কণ্ঠে ফজরের আযান ধ্বনিতে হলো। আলী (রা) বিছানা ছেড়ে সালাতে গমনের প্রস্তুতির মধ্যে একবার প্রশ্ন করলেন, ফাতিমা তুমি কি ঘুমাওনি? তিনি একটা গভীর আবেগ মিশ্রিত কণ্ঠে জবাব দিলেন : আমি সম্পূর্ণ জাগ্রত থেকে বিজয়ীবেশে এ ফিরে আসাকে উপভোগ করতে চাই। ঘুমিয়ে পড়লে গোটা বিষয়টিই না জানি স্বপ্ন বলে ভ্রম হয়।
এরপর তিনি সালাত আদায়ের উদ্দেশ্যে দাঁড়িয়ে যান। সালাত আদায় শেষে একটু ঘুমিয়ে নেন।
ঘুম থেকে জাগ্রত হয়ে সে বাড়ীটিতে যাওয়ার ইচ্ছা করেন যেখানে তাঁর জন্ম হয়েছিল। যে বাড়ীটি ছিল তার নিজের ও স্বামী আলীর শৈশব-কৈশোরের চারণভূমি। কিন্তু সে বাড়ীটি তাদের হিজরতের পর আকীল ইবন আবী তালিবের অধিকারে চলে যায়। মক্কা বিজয়ের সময়কালে একদিন উসামা ইবন যায়েদ (রা) নবী করীম (ﷺ) ওকে জিজ্ঞেস করেন: মক্কায় আপনারা কোন বাড়ীতে উঠবেন। জবাবে তিনি বলেন: আকীল কি আমাদের জন্য কোন বাসস্থান বা ঘর বাকী রেখেছে?
এ সফরে তার দুমাসের অধিক মক্কায় অবস্থান করা হয়নি। অষ্টম হিজরীর রমজান মাসে মক্কায় আসেন এবং একই বছর যুল কাদা মাসের শেষ দিকে উমরা আদায়ের পর পিতার সাথে মদীনায় প্রত্যাবর্তন করেন। এ সময়ে তিনি জান্নাতবাসিনী মা খাদীজা (রা)-এর কবর যিয়ারত করেন। নবম হিজরীতে সনে নবী করীম (ﷺ)-এর তৃতীয় কন্যা, উসমানের (রা) স্ত্রী উম্মু কুলছুম (রা) ইন্তেকাল করেন। দশম হিজরীতে নবী করীম (ﷺ)-এর স্ত্রী মারিয়া আল-কিবতিয়্যার গর্ভজাত সন্তান ইবরাহীমও ইন্তেকাল করেন। এখন নবী করীম (ﷺ)-এর সন্তানদের মধ্যে একমাত্র ফাতিমা আয-যাহরা ব্যতীত আর কেউ জীবিত থাকলেন না।
পিতা অন্তিম রোগশয্যায়
এর পরে আসল সে মহা মুসীবতের সময়টি। হিজরী ১১ সনের সফর মাসে ফাতিমা (রা)-এর মহান পিতা রোগাক্রান্ত হলেন। নবী পরিবারের এবং অন্য মুসলমানরা ধারণা করলেন যে, এ হয়তো সামান্য রোগ, অচিরেই সেরে উঠবেন। কেউ ধারণা করলেন না যে, এ তার অস্তিম রোগ। পিতা কন্যাকে আহ্বান করলেন। সঙ্গে সঙ্গে পিতার আহ্বানে সাড়া দিয়ে তার ঘরের দিকে বেরিয়ে পড়লেন। নবী করীম (ﷺ)-এর শয্যাপাশে তখন আয়েশা (রা) সহ অন্য স্ত্রীগণও বসা। এ সময় ধীর স্থির ও গভীরভাবে কন্যা ফাতিমাকে অগ্রসর হতে দেখে পিতা তাকে স্বাগতম জানালেন এভাবে-
(মারহাবা ইয়া বিনতে)
হে আমার মেয়ে! স্বাগতম।
তারপর তাকে চুমু দিয়ে ডান পাশে বসান এবং কানে কানে বলেন, তার মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে এসেছে। ফাতিমা কেঁদে ফেলেন। তার সে কান্না থেমে যায় যখন পিতা তার কানে কানে আবার বলেন-
أن تگونی انك او اهل بیی نوقابی یافاطمه الأترض سيدة نساء المؤمنين او سيدة نساء هذه الأمة
“আমার পরিবারবর্গের মধ্যে তুমি সর্বপ্রথম আমার সাথে মিলিত হবে। ফাতিমা! তুমি কি এতে সন্তুষ্ট নও যে, ঈমানদার নারীদের নেত্রী হও? অথবা নবী করীম (ﷺ) একথা বলেন, তুমি এ উম্মতের নারীদের নেত্রী হও তাতে কি সন্তুষ্ট না” এ কথা শ্রবণের সাথে সাথে ফাতিমার চেহারায় আনন্দের আভা ফুটে উঠলো। তিনি কান্না থামিয়ে হেসে দিলেন। তার এমন আচরণ দেখে পাশেই বসা আয়েশা (রা) অবাক হলেন। তিনি মন্তব্য করেন
مارايت كاليوم فرقا أقرب إلى ژن .
“দুঃখের অধিক নিকটবর্তী আনন্দের এমন দৃশ্য আজকের মত আর কখনো দেখিনি।” পরে এক সুযোগে তিনি ফাতেমাকে জিজ্ঞেস করেন : তোমার পিতা কানে কানে তোমাকে কি বলেছেন? জবাবে তিনি বললেন : আমি নবী করীম (ﷺ)-এর গোপন কথা প্রকাশ করতে অক্ষম।
ماذا على من شم تية أحمد الأشم مدى الزمان واليا صممت على الأيام عن لياليا. بت على مصانب کو انها
১. ‘যে ব্যক্তি আহমাদের কবরের মাটির ঘ্রাণ নেয় গোটা জীবন সে যেন আর কোন সুগন্ধির ঘ্রাণ না নেয়।
২. আমার ওপর যে সকল বিপদ আপতিত হয়েছে যদি তা হতো দিনের ওপর তাহলে তা রাতে পরিণত হতো।’
সাহাবায়ে কিরাম (রা) নবী করীম (ﷺ)-এর দাফন-কাফন শেষ করে তাকে সান্ত্বনা দানের উদ্দেশ্যে ফাতিমা (রা)-এর নিকট আসেন। তিনি আনাস (রা)-কে জিজ্ঞেস করে বসেন । আপনারা কি নবী করীম (ﷺ)-কে দাফন করে এসেছেন। তিনি জবাব দিলেন : হা। তিনি বললেন : নবী করীম (ﷺ)-কে মাটিতে ঢেকে দিতে আপনাদের অন্তর সায় দিল কেমন করে? তারপর তিনি নবী করীম (ﷺ) -এর স্মরণে নিম্নের চরণগুলো আবৃত্তি করেন-
شمس النهار وأظلم العصر ان أغبر أقاق السماء وګورت تالارض من بعد النبي كئيبة أشقار عكيه گيرة الرجفان وكتبگه مضژوگل بمان . تلبگه شرق البلاد وغربها والبيت و الأشتار والأركان الطود العظيم جوده وليب با اتم الرشي المبارك ضوه صلى عليك منول القران .
১. আকাশের দিগন্ত ধুলিমলিন হয়ে গেছে, মধ্যাহ্ন-সূর্য ঢাকা পড়ে গেছে এবং যুগ অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে গেছে।
২. নবীন-এর পরে ভূমি কেবল বিষন্ন হয়নি, বরং দুঃখের তীব্রতায় বিদীর্ণ হয়েছে।
৩. তার জন্য কাঁদছে পূর্ব-পশ্চিম, মাতম করছে সমগ্র মুদার ও ইয়ামান গোত্র।
৪. তার জন্য কাঁদছে বড় বড় পাহাড়-পর্বত ও বিশালকায় দালানসমূহ।
৫. হে খাতামুন নাবিয়্যীন, আল্লাহর জ্যোতি আপনার প্রতি বর্ষিত হোক।
আল-কুরআনের নাযিলকারী আপনার প্রতি করুণা বর্ষণ করুন। অনেকে উপরিউক্ত চরণগুলো ফাতিমা (রা), আর পূর্বোক্ত চরণগুলো আলীর রচিত বলে উল্লেখ করেছেন। ফাতিমা (রা) পিতার কবরের পাশে দাঁড়িয়ে এ চরণ দুটি আবৃত্তি করেন
وغاب مثبت ثا الوحي والكتب انا فقدناك فقد الآژض وابلها قلبت تبلك كان الموت صادقا لما تعبت وحالت دون الكثب.
১. ভূমি ও উট হারানোর মত আমরা হারিয়েছি আপনাকে। আপনার অদৃশ্য হওয়ার পর ওহী ও কিতাব আমাদের থেকে অদৃশ্য হয়ে গেছে।
২. হায়! আপনার আগে যদি আমাদের মৃত্যু হতো! আপনার মৃত্যু সংবাদ শ্রবণ করতে হতো না এবং মাটির ঢিবিও আপনার মাঝে অন্তরায় হতো না।
বিয়ের পরেও ফাতিমা (রা) পিতার সংসারের সকল বিষয়ের খোঁজ-খবর রাখতেন। অধিকাংশ সময় তাঁর সৎ মা’দের ছোটখাট রাগ-বিরাগ ও মান-অভিমানের বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতেন। যেমন নবী করীম (ﷺ) উসুল মু’মিনীন আয়েশাকে গভীরভাবে ভালোবাসতেন। একথা সকল সাহাবী সমাজের জানা ছিল। এ কারণে নবী করীম (ﷺ) যেদিন আয়েশা (রা)-এর ঘরে কাটাতেন সেদিন তারা অধিক পরিমাণে হাদিয়া-তোহফা পাঠাতেন। এতে অন্য স্ত্রীগণ ক্ষুব্ধ হতেন। তারা চাইতেন নবী করীম (ﷺ) যেন লোকদের নির্দেশ দেন, তিনি যেদিন যেখানে থাকেন মানুষ যেন সেখানেই যা কিছু পাঠাবার, পাঠায়।
কিন্তু সে কথা নবী করীম (ﷺ)-কে বলার সাহস কারো হতো না। এ জন্য তারা সবাই মিলে তাদের মনের কথা নবী করীম (ﷺ) -এর নিকট পৌছে দেওয়ার জন্য নবী করীম (ﷺ)-এর কলিজার টুকরা ফাতিমা (রা)-কে বেছে নেন। নবী করীম (ﷺ) ফাতিমা (রা)-এর বক্তব্য শ্রবণ করে বললেন, “মা, আমি যা চাই, তুমি কি তা চাও না? ফাতিমা (রা) পিতার ইচ্ছা বুঝতে পারলেন এবং ফিরে এলেন। তার সৎ মায়েরা আবার তাকে পাঠাতে চাইলেন : কিন্তু তিনি রাজি হলেন না।
রণাঙ্গনে : রণাঙ্গনে ফাতিমা (রা)-এর রয়েছে এক উজ্জ্বল ভূমিকা। উহুদ যুদ্ধে নবী করীম (ﷺ) শরীরে ও মুখে আঘাত পেয়ে আহত হলেন। পবিত্র দেহ থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগলো। কোন কিছুতে যখন রক্ত বন্ধ করা যালি না তখন ফাতিমা (রা) খেজুরের চাটাই আগুনে পুড়িয়ে তার দুই ক্ষতস্থানে লাগিয়ে দেন।
এ বিষয়ে ইমাম আল-বায়হাকী বলেন : মুহাজির ও আনসার নারীগণ উহুদের উদ্দেশ্যে ঘর থেকে বের হলেন। তারা তাদের পিঠে করে পানি ও খাবার বহন করে নিয়ে গেলেন। তাদের সাথে ফাতিমা বিনতে নবী করীম (ﷺ) ও বের হন। যুদ্ধের এক পর্যায়ে তিনি যখন পিতাকে রক্তরঞ্জিত অবস্থায় দেখলেন, তাঁকে জড়িয়ে ধরলেন। তার চেহারা থেকে রক্ত মুছতে লাগলেন। আর নবী করীম (ﷺ)-এর মুখ থেকে তখন উচ্চারিত হচ্ছিল
اشتد غضب الله على قوم دما وجه رسول الله صلى الله عليه وسلم.
আল্লাহর শক্ত ক্রোধ পতিত হয়েছে সে জাতির ওপর যারা আল্লাহর নবী করীম (ﷺ)-এর চেহারাকে রক্তরঞ্জিত করেছে। (আল-বায়হাক :দালায়িল আন-নুবুওয়াহু-৩/২৮৩)
উহুদে ফাতিমা (রা)-এর ভূমিকার বর্ণনা প্রসঙ্গে মহান সাহাবী সাহল ইবন সা’দ বলেছেন : নবী করীম (ﷺ) আহত হলেন, সামনের দাঁত ভেঙ্গে গেল, মাথায় তরবারি ভাঙ্গা হলো, ফাতিমা বিনতে নবী করীম (ﷺ) রক্ত পরিষ্কার করতে লাগলেন, আর আলী (রা) ঢালে করে পানি ঢালতে লাগলেন। ফাতিমা (রা) যখন দেখলেন, যতই পানি ঢালা হচ্ছে ততই রক্ত বেশী বের হচ্ছে তখন তিনি একটি চাটাই উঠিয়ে আগুনে পুড়িয়ে ছাই কলেন এবং সে ক্ষতস্থানে লাগালেন। আর তখন রক্তপড়া বন্ধ হয়।
উহুদ যুদ্ধে নবী করীম (ﷺ)-এর চাচা ও ফাতিমা (রা)-এর দাদা হামজা (রা) শহীদ হন। তিনিই ফাতিমা (রা)-এর বিয়ের সময় ওলীমা অনুষ্ঠান করে মানুষকে আহার করান। ফাতিমা (রা) তাঁর প্রতি দারুণ মুগ্ধ ছিলেন। তিনি আজীবন হামজা (রা)-এর কবর যিয়ারত করতেন এবং তার জন্য কেঁদে কেঁদে আল্লাহর দরবারে দু’আ করতেন।
অন্যান্য যুদ্ধেও ফাতিমা (রা)-এর যোগদানের কথা জানা যায়। যেমন খন্দক ও খায়বার অভিযানে অংশগ্রহণ করেন। এ খায়বার বিজয়ের পর তথাকার উৎপাদিত গম থেকে তার জন্য নবী করীম (ﷺ) ৮৫ ওয়াসক নির্ধারণ করে দেন। মক্কা বিজয়েও তিনি নবী করীম (ﷺ)-এর সফরসঙ্গী হন। মূতা অভিযানে নবী করীম (ﷺ) এ তিন সেনাপতি-মায়িদ ইবন আল-হারিছা, জাফর ইবন আবী তালিব ও আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহাকে (রা) প্রেরণ করেন। একের পর এক তারা তিনজনই শহীদ হলেন। এ সংবাদ মদীনায় পৌছলে ফাতিমা (রা) তাঁর প্রিয় চাচা জাফরের (রা) শোকে ‘ওয়া’ আম্মাহু” বলে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। এ সময় নবী করীম (ﷺ) সেখানে উপস্থিত হন এবং মন্তব্য করেন যে কাঁদতে চায় তার জাফরের মত মানুষের জন্য কাঁদা উচিত।
ফাতিমা (রা)-এর মর্যাদা
তার মহত্ত্ব, মর্যাদা ও বৈশিষ্ট্য অনেক। রাসূলের পরিবারের মধ্যে আরো অনেক মর্যাদাবান ব্যক্তি আছেন। কিন্তু তাদের মাঝে ফাতিমা (রা)-এর অবস্থান এক বিশেষ মর্যাদাপূর্ণ আসনে। সূরা আল আহযাবের আয়াতে তাতহীর (পবিত্রকরণের আয়াত) এর নুযূল ফাতিমা (রা)-এর বিশেষ মর্যাদা ও বৈশিষ্ট্য প্রমাণ করে।
انما يريد الله ليذهب عثم الرجس أهل البيت ويطهركم
“হে নবী-পরিবার! আল্লাহ তো কেবল চান তোমাদের থেকে অপবিত্রতা দূর করতে এবং তোমাদের সম্পূর্ণরূপে পবিত্র করতে।’ (সূরা-৩৩ আহযাব : আয়াত-৩)
উম্মুল মু’মিনীন আয়েশা (রা) বলেন
رأيت رسول الله دعا عليا وناطة ونا ويا رضى الله عنهم القى عليهم وما قال : اللهم هؤلاء أهل بی قاذهب عنهم الرجس وطهرهم تطهيرا.
আমি নবী করীম (ﷺ)-কে দেখলাম, তিনি আলী, ফাতিমা, হাসান ও হুসাইন (রা)-কে আহ্বান করলেন এবং তাদের মাথার উপর একখানা বস্ত্র ফেলে দিলেন। তারপর বললেন : হে আল্লাহ! এরা আমার পরিবারের সদস্য। তাদের থেকে অপবিত্রতা দূর করে দিন এবং তাদেরকে সম্পূর্ণরূপে পবিত্র করুন! (মুখতাসার তাফসীর ইবনে কাছীর-৩/৯৪)
আনাস ইবন মালিক (রা) বলেন, নবী করীম (ﷺ) -আলোচ্য আয়াত নাযিলের পর ছয় মাস পর্যন্ত ফজরের সালাতে যাওয়ার সময় ফাতিমা (রা)-এর ঘরের দরজা অতিক্রম করাকালে বলতেন
Sالصلاة با أهل البيت، آل
সালাত, ওহে নবী-পরিবার! সালাত। তারপর তিনি পাঠ করতেন।
إنما يريد الله ليذهب عنكم الرجس أهل البيت ويطهركم
ইমাম আহমাদ (র) আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূলআলী ফাতিমা, হাসান ও হুসাইনের (রা) দিকে তাকালেন তারপর বললেন
(সূরা-৩৩ আহযাব : আয়াত-৩৩)
أنا رب لمن اربیگم، سلم لمن سالمگم .
তোমাদের সঙ্গে যে লড়াই করে আমি তাদের জন্য লড়াই, তোমাদের সাথে যে শাস্তিও সন্ধি স্থাপন করে আমি তাদের জন্য শান্তি। (সিয়ারু আ’লাম আন-নুবালা’-২১২৩)
এ নবী পরিবার প্রসঙ্গে নবী করীম (ﷺ)-এর অন্য একটি বাণীতে এসেছে
لابغضنا أهل البيت أحد الأ أدخله الله النار.
‘যে কেউ আহলে বায়ত’ বা নবী-পরিবারের সাথে শত্রুতা করবে আল্লাহ তাকে জাহান্নামে প্রবেশ করাবেন।’ (প্রাগুক্ত)।
নবম হিজরীতে নাজরানের একটি খ্রীষ্টান প্রতিনিধি দল নবী করীম (ﷺ)-এর নিকট আসে এবং ঈসা (আ) প্রসঙ্গে তারা অহেতুক বিতর্কে লিপ্ত হয়। তখন আয়াতে মুবাহালা অবতীর্ণ হয়। মুবাহালার অর্থ হলো, যদি সত্য ও মিথ্যার ব্যাপারে দুই পক্ষের মধ্যে বাদানুবাদ হয় এবং যুক্তিতর্কে মীমাংসা না হয়, তাহলে তারা সকলে মিলে আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করবে, যে পক্ষ এ বিষয়ে মিথ্যাবাদী, সে যেন ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। এভাবে প্রার্থনা করাকে “মুবাহালা’ বলা হয়। এ মুবাহালা বিতর্ককারীরা একত্রিত হয়ে করতে পারে এবং গুরুত্ব বৃদ্ধি করার জন্য পরিবার-পরিজনকেও একত্রিত করতে পারে। মুবাহালার আয়াতটি হলো
من حاجة فيه من بعد ماام من العلم تقل تعالوا ندع آباءنا وأباكم وانا ونام وانا وانگم ثم نبتهل فنجعل لعنت الله على الغنيين.
তোমার নিকট জ্ঞান আসার পর যে কেউ এ প্রসঙ্গে তোমার সাথে তর্ক করে তাকে বল এসো, আমরা ডাকি আমাদের পুত্রগণকে, তোমাদের পুত্রগণকে, আমাদের নারীগণকে, তোমাদের নারীগণকে, আমাদের নিজদেরকে ও তোমাদের নিজেদেরকে, অতঃপর আমরা বিনীত আবেদন করি এবং মিথ্যাবাদীদের ওপর দেই আল্লাহর অভিশাপ।’ (সূরা আলে ইমরান :আয়াত-৬১)
আলোচ্য আয়াত নাযিলের পর নবী করীম (ﷺ) প্রতিনিধি দলকে মুবাহালার আহ্বান জানান এবং তিনি নিজেও ফাতিমা, আলী, হাসান ও হুসাইনকে (রা) সাথে নিয়ে মুবাহালার জন্য প্রস্তুত হয়ে আসেন এবং বলেন : হে আল্লাহ! এ আমার পরিবার পরিজন। আপনি তাদের থেকে অপবিত্রতা দূর করে তাদেরকে সম্পূর্ণরূপে পবিত্র করুন। এ বাক্যগুলো তিনবার বলার পর উচ্চারণ করেন।
اللهم اجعل ذرائك وترگانك على آل محمد كما جعلتها على آل إبراهيم إنك حميد مجيد.
‘হে আল্লাহ আপনি আপনার দয়া ও অনুগ্রহ মুহাম্মাদের পরিবার-পরিজনকে দান করুন। (সহীহ মুসলিম : ফাদায়িল আস-সাহাবা; মুসাদ-৪১০৭; মুখতাসার তাফসীর ইবনে কাছীর-১/২৮৭-২৮৯)
যেমন আপনি করেছেন ইবরাহীমের পরিবার পরিজনকে। নিশ্চয় আপনি প্রশংসিত ও সম্মানিত। নবী করীম (ﷺ) একদিন ফাতিমা (রা)-কে বলেন
إن الله تعالى يرضى لرضاك ويغضب لغضب .
মহান আল্লাহ তোমার খুশীতে খুশী হন এবং তোমার অসন্তুষ্টিতে অসন্তুষ্ট হন।’ (তাহযীব আত-তাহযীব-১২/8৪২; আল-ইসাবা-৪/৩৬৬)
নবী করীম (ﷺ) যখন কোন যুদ্ধ বা সফর থেকে প্রত্যাবর্তন করতেন তখন প্রথমে মসজিদে গিয়ে দুই রাকআত সালাত আদায় করতেন। তারপর ফাতিমার ঘরে প্রবেশ করে তার সাথে সাক্ষাত করে স্ত্রীদের নিকট যেতেন। একবার ফাতিমা (রা) রোগাক্রান্ত হলে নবী করীম (ﷺ) দেখতে গেলেন। জিজ্ঞেস করলেন মেয়ে! কেমন আছ?
ফাতিমা বললেন: আমার কষ্ট আছে। সেটা আরো বৃদ্ধি পায় এজন্য যে, আমার খাবার কোন কিছু নেই।
নবী করীম (ﷺ) বললেন : মেয়ে! তুমি বিশ্বের সকল মহিলার নেত্রী হও এতে কি সন্তুষ্ট নও? ফাতিমা বললেন : বাবা! তাহলে মারইয়াম বিন্ত ইমরানের অবস্থান কোথায়?
জবাবে নবী করীম (ﷺ) বললেন । তিনি ছিলেন তাঁর সময়ের মহিলাদের নেত্রী, আর তুমি হবে তোমার সময়ের মহিলাদের নেত্রী।
মহান আল্লাহর কসম! আমি তোমাকে ইহকাল ও পরকালের একজন নেতার সাথে বিয়ে দিয়েছি। নবী করীম (ﷺ) তাকে-(সাইদাতুন নিসাই আহলিল জান্নাত)
জান্নাতের অধিবাসী মহিলাদের নেত্রী বলে ঘোষণা দিয়েছেন। আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাসে (রা)-এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, নবী করীম (ﷺ) বলেছেন,
سنيدة نساء أهل الجنة مريم ثم فاطمة بنت محمد ثم خديجة ثم أسب امراة فرعون .
জান্নাতের অধিবাসী মহিলাদের নেত্রী হলেন ধারাবাহিকভাবে মারইয়াম, ফাতিমা বিত মুহাম্মদ খাদীজা ও ফিরআউনের স্ত্রী আছিয়া।’ (সাহাবিয়াত-১৪০)
একদা নবী করীম (ﷺ) মাটিতে চারটি রেখা টানলেন, তারপর মানুষদেরকে বললেন, তোমরা কি জান এটা কি? সকলে বললো : আল্লাহ ও তাঁর নবীই ভালো জানেন। তিনি বললেন : ফাতিমা বিন্ত মুহাম্মদ, খাদীজা বিনত খুওয়াইলিদ, মারয়াম বিনত ইমরান ও আছিয়া বিবৃত মুযাহিম (ফিরআউনের স্ত্রী)। জান্নাতের মহিলাদের ওপর তাদের রয়েছে এক বিশেষ মর্যাদা। ফাতিমা (রা)-এর ব্যক্তিত্বের প্রতি যে এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য আরোপ করা হয়েছে তা নবী করীম (ﷺ)-এর আলোচ্য হাদীছে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে
تتناك من نساء العالمين مریم بنت عمران وخديجة بنت ويلد وفاطمة بنت محمد واسبة امراة فرعون .
দুনিয়ার মহিলাদের মধ্যে তোমার অনুসরণের জন্য মারইয়াম, খাদীজা, ফাতিমা ও ফির’আউনের স্ত্রী আছিয়া যথেষ্ট। (তিরমিযী; আল-মানাকি)
নবী করীম (ﷺ)-এর সবচেয়ে বেশী স্নেহের ও প্রিয় পাত্রী ছিলেন ফাতিমা (রা)। একবার নবী করীম (ﷺ)-কে জিজ্ঞেস করা হলো : হে আল্লাহর রাসূল! আপনার সবচেয়ে বেশী প্রিয় ব্যক্তিটি কে বললেন : ফাতিমা। ইমাম আজ-জাহাবী বলেন
كان أحب النساء إلى رسول الله قاط ومن الرجال على
মহিলাদের মধ্যে নবী করীম (ﷺ)-এর সবচেয়ে বেশী প্রিয় ছিলেন ফাতিমা (রা) এবং পুরুষদের মধ্যে আলী (রা)। একদা আলী (রা) নবী করীম (ﷺ)-কে জিজ্ঞেস করলেন : ফাতিমা ও আমি এ দুজনের মধ্যে কে আপনার সর্বাধিক প্রিয়। তিনি বললেন : তোমার চেয়ে ফাতিমা আমার নিকট অধিক প্রিয়।
আল্লাহর প্রিয় পাত্রী
ফাতিমা (রা) যে আল্লাহর প্রিয় পাত্রী ছিলেন কোন কোন অলৌকিক ঘটনায় তার প্রমাণ পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে একবার সামান্য খাবারে আল্লাহ যে বরকত ও সমৃদ্ধি দান করেছিলেন তা উল্লেখ করা যায়। বিভিন্ন বর্ণনায় ঘটনাটি যেভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে তার সারাংশ হলো, একদিন তার একটি প্রতিবেশিনী তাকে দুটি রুটি ও এক টুকরা গোশত উপহার হিসেবে প্রেরণ করলো। তিনি সেগুলো একটি বাসনে ঢেলে ঢেকে দিলেন। তারপর নবী করীম (ﷺ)-কে আহ্বান জন্য ছেলেকে পাঠালেন। নবী করীম (ﷺ) আসলেন এবং ফাতিমা (রা) তার সামনে থালাটি পেশ করলেন। এরপরের ঘটনা ফাতিমা (রা) বর্ণনা করেছেন এভাবে –
আমি থালাটির ঢাকনা খুলে দেখি সেটি রুটি ও গোশতে ভরপুর। আমি দেখে তো বিস্ময়ে হতবাক! বুঝলাম, এ বরকত আল্লাহর পক্ষ থেকে। আমি আল্লাহর প্রশংসা করলাম এবং তার নবীর ওপর দরূদ পাঠ করলাম। তারপর খাবার ভর্তি বাসনটি নবী করীম (ﷺ)-এর সামনে পেশ করলাম। তিনি সেটি দেখে আল্লাহর প্রশংসা করে প্রশ্ন করলেন : মেয়ে! এ খাবার কোথা থেকে এসেছে?
বললাম : বাবা! মহান আল্লাহর নিকট থেকে এসেছে। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা বেহিসাব রিযিক দান করেন।
নবী করীম (ﷺ) বললেন : আমার প্রিয় মেয়ে। সে আল্লাহর প্রশংসা যিনি তোমাকে বনী ইসরাঈলের মহিলাদের নেত্রীর মত করেছেন। আল্লাহ যখন তাকে কোন খাদ্য দান করতেন এবং সে প্রসঙ্গে তাকে জিজ্ঞেস করা হতো, তখন তিনি বলতেন : এ আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে। নিশ্চয় আল্লাহ যাকে ইচ্ছা বে হিসাব রিযিক দান করেন।
সে খাবার নবী করীম (ﷺ) আলী ফাতিমা, হাসান, হুসাইন এবং রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সকল স্ত্রী ভক্ষণ করেন। তাঁরা সবাই পেট ভরে খান। তারপরও থালার খাবার একই রকম থেকে যায়। ফাতিমা সে খাবার প্রতিবেশীদের মধ্যে বিলিয়ে দেন। আল্লাহ সে খাবারে অনেক বরকত ও কল্যাণ দান করেন।
নবী করীম (ﷺ) একবার দুআ করেন, আল্লাহ যেন ফাতিমাকে ক্ষুধার্ত না রাখেন। ফাতিমা বলেন, তারপর থেকে আমি আর কখনো ক্ষুধার্ত হইনি। ঘটনাটি এরকম একদিন নবী করীম (ﷺ) ফাতিমা (র)-এর ঘরে প্রবেশ করলেন। তখন তিনি যাতায় গম পিষছিলেন। দেহে জড়ানো ছিল উটের পশমের তৈরী পোশাক। মেয়ের এ অবস্থা দেখে পিতা কেঁদে দেন এবং বলেন : ফাতিমা! পরকালের সুখ-সম্ভোগের জন্য দুনিয়ার এ তিক্ততা গিলে ফেল। ফাতিমা উঠে পিতার সামনে এসে দণ্ডায়মান হলেন। পিতা কন্যার দিকে তাকিয়ে দেখলেন, প্রচণ্ড ক্ষুধায় তার চেহারা রক্তন্য হয়ে পাণ্ডুবর্ণ হয়ে গেছে। তিনি বললেন : ফাতিমা! কাছে এসো। ফাতিমা পিতার সামনে এসে দাঁড়ালেন। পিতা একটি হাত মেয়ের কাঁধে রেখে এ দু’আ উচ্চারণ করেন
اللهم مشبع الجاعة ورافع الضب إرفع فاطمة بنت محمد.
ক্ষুধার্তকে আহার দানকারী ও সংকীর্ণতাকে দূরীভূতকারী হে আল্লাহ! তুমি ফাতিমা বিনত মুহাম্মাদের সংকীর্ণতাকে দূর করে দাও।’ (আ’লাম আন-নিসা-৪/১২৫)
কথাবার্তা, চালচলন, উঠাবসা প্রতিটি ক্ষেত্রে ফাতিমা (রা) ছিলেন নবী করীম (ﷺ)-এর প্রতিচ্ছবি। আয়েশা (রা) বলেন
تاط تنشى ماتخطي مشيتها مشية رسول الله صلى الله عليه وسلم۔
ফাতিমা (রা) হাঁটতেন। তার হাঁটা নবী করীম (ﷺ)-এর হাঁটা থেকে একটুও এদিক ওদিক হতো না। সততা ও সত্যবাদিতায় তার কোন জুড়ি ছিল না। আয়েশা (রা) বলতেন
مارايت أحدا كان أدق تهجة من قاطنة إلا أن يكون الذي
আমি ফাতিমা (রা)-এর চেয়ে অধিক সত্যভাষী আর কাউকে দেখিনি। তবে তিনি যার কন্যা (নবী তার কথা অবশ্য স্বতন্ত্র। (মুসাফাহাহ ও মুয়ানাকা অধ্যায় : মিশকাত)
আয়েশা (রা) আরো বলেন
ما ودينا برسول الله و من مارايت أحدا كان أشبه فاطمة، وكانت إذا دخلت عليه قام إليها، قبلها ورحب
253ai3, 4 ‘আমি কথাবার্তা ও আলোচনায় নবী করীম (ﷺ)-এর সাথে ফাতিমা (রা)-এর চেয়ে অধিক মিল আছে এমন কাউকে দেখিনি। ফাতিমা (রা) যখন নবী করীম (ﷺ)-এর নিকট আসতেন, তিনি উঠে দাড়িয়ে তাকে নিকটে টেনে নিয়ে চুমু দিতেন, স্বাগত জানাতেন। ফাতিমাও পিতার সাথে একই আচরণ করতেন। নবী করীম (ﷺ) যে পরিমাণ ফাতিমা (রা)-কে ভালোবাসতেন, সে পরিমাণ অন্য কোন সন্তানকে ভালোবাসতেন না। তিনি বলেছেন
فاطمه بضع يمني من أغضبها أغضبني.
ফাতিমা আমার শরীরের একটি অংশ। কেউ তাকে অসন্তুষ্ট করলে আমাকেই অসন্তুষ্ট করবে।’
ইমাম আস-সুহাইলী আলোচ্য হাদীসের ভিত্তিতে বলেছেন, কেউ ফাতিমা (রা)-কে মন্দ কথা বললে কাফির হয়ে যাবে। তিনি তার অসন্তুষ্টি ও নবী করীম (ﷺ)-এর অসভুষ্টি এক করে দেখেছেন। আর কেউ নবী করীম (ﷺ) ওকে ক্রোধাধিত করলে কাফির হয়ে যাবে।
ইবনুল জাওযী বলেছেন, নবী করীম (ﷺ)-এর অন্য সকল কন্যাকে ফাতিমা (রা) এবং অন্য সকল স্ত্রীকে আয়েশা (রা)-এর সম্মান ও মর্যাদায় অতিক্রম করে গেছেন। আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত হয়েছে। নবী করীম (ﷺ) বলেছেন : একজন ফেরেশতাকে আল্লাহ আমার সাক্ষাতের অনুমতি দেন। তিনি আমাকে এ সুসংবাদ দেন যে, ফাতিমা হবে আমার উম্মতের সকল মহিলার নেত্রী এবং হাসান ও হুসাইন হবে জান্নাতের অধিবাসীদের নেতা। এ বিষয়ে তিনি আলী (রা)-কে বলেন : ফাতিমা আমার শরীরের একটি অংশ। অতএব তার অসন্তুষ্টি হয় এমন কিছু করবে না।
পিতার প্রতি ফাতিমা (রা)-এর ভালোবাসা
নবী করীম (ﷺ) যেমন কন্যা ফাতিমা (রা)-কে গভীরভাবে ভালোবাসতেন তেমনি ফাতিমাও পিতাকে প্রবলভাবে ভালোবাসতেন। পিতা কোন সফর থেকে যখন প্রত্যাবর্তন করতেন তখন সর্বপ্রথম মসজিদে প্রবেশ করে সালাত আদায় করতেন। তারপর কন্য ফাতিমার ঘরে গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করে নিজের ঘরে যেতেন। এটা তাঁর নিয়ম ছিল। একদা নবী করীম (ﷺ) এক সফর থেকে ফাতিমার ঘরে যান। ফাতিমা (রা) পিতাকে জড়িয়ে ধরে চোখে-মুখে চুমু দেন। তারপর পিতার চেহারার দিকে তাকিয়ে কাঁদতে শুরু করেন।
নবী করীম (ﷺ) বলেন : কঁদছো কেন মা? ফাতিমা (রা) বললেন : হে আল্লাহর রাসূল! আপনার মুখমণ্ডল বিবর্ণ হয়ে গেছে এবং আপনার পরিধেয় পোশাকও ময়লা, নোংরা হয়েছে। এ দেখেই আমার কান্না পাচ্ছে। নবী করীম (ﷺ) বললেন : ফাতিমা, কেঁদো না। আল্লাহ তোমার পিতাকে একটি বিষয়ের দায়িত্ব দিয়ে প্রেরণ করেছেন। ইহজগতের শহর ও গ্রামের প্রতিটি ঘরে তিনি তা পৌছে দেবেন। সম্মানের সঙ্গে হোক বা অপমানের সঙ্গে।
নবী করীম (ﷺ)-এর তিরস্কার ও সতর্ককরণ
নবী করীম (ﷺ)-এর এক প্রিয়পাত্রী হওয়া সত্ত্বেও দুনিয়ার সুখ-ঐশ্বর্যের প্রতি সামান্য আগ্রহ দেখলেও নবী করীম (ﷺ) তাকে তিরস্কার করতে কুষ্ঠিত হতেন না। নবী করীম (ﷺ) পার্থিব ঠাটবাট ও চাকচিক্য অপছন্দ করতেন। তিনি নিজে যা পছন্দ করতেন না তা অন্য কারো জন্য পছন্দ করতেন না। একবার স্বামী আলী (রা) একটি সোনার হার ফাতিমা (রা)-কে উপহার দেন। তিনি হারটি গলায় পরে আছেন। এমন সময় নবী করীম (ﷺ) আসেন এবং হারটি তার চোখে পড়ে। তিনি বলেন, ফাতিমা! তুমি কি চাও যে, লোকেরা বলুক আল্লাহর রাসূল (ﷺ)-এর কন্যা আগুনের হার গলায় পরে আছে। ফাতিমা পিতার অসন্তুষ্টি বুঝতে পেরে হারটি বিক্রি করে দেন এবং সে অর্থ দিয়ে একটি দাস খরিদ করে মুক্ত করে দেন। একথা নবী করীম (ﷺ) অজানার পর বলেন-
الحمد لله الذي تجي فاطمة بن الثار .
যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহর যিনি ফাতিমাকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করছে।’ (আত-তারগীব ওয়াত তারহীব-১/৫৫৭; মুসনাদ-৫/২৭৮, ২৭৯; নিসা; হাওলার রাসূল ১৪৯)।
আরেকটি ঘটনা। নবী করীম (ﷺ) কোন এক যুদ্ধ থেকে ফিরলেন। অভ্যাস অনুযায়ী তিনি ফাতিমা (রা)-এর ঘরে প্রবেশ করবেন। ফাতিমা (রা) পিতাকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য ঘরের দরজায় পর্দা ঝুলালেন, দুই ছেলে হাসান ও হুসাইন (রা)-এর হাতে একটি করে রূপার চুড়ি পরালেন। ভাবলেন, এতে তাদের নানা নবী করীম (ﷺ) খুশী হবেন। কিন্তু ফল বিপরীত হলো। নবী করীম (ﷺ) ঘরে প্রবেশ না করে ফিরে গেলেন। বুদ্ধিমতি কন্যা ফাতিমা (রা) বুঝে গেলেন, পিতা কেন ঘরে প্রবেশ না করে ফিরে গেলেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি পর্দা নামিয়ে ছিড়ে ফেলেন এবং দুই ছেলের হাত থেকে চুড়ি খুলে ফেলেন। তারা কাঁদতে কাঁদতে তাদের নানার নিকট চলে যায়। তখন নবী করীম (ﷺ)-এর মুখ থেকে উচ্চারিত হয়, এরা আমার পরিবারের সদস্য। আমি চাইনা পার্থিব সাজ-শোভায় তারা শোভিত হোক।
একবার নবী করীম (ﷺ) ফাতিমা, ‘আলী, হাসান ও হুসাইনকে (রা) বললেন, যাদের সঙ্গে তোমাদের লড়াই, তাদের সাথে আমারও লড়াই, যাদের সঙ্গে তোমাদের শান্তি ও সন্ধি তাদের সঙ্গে আমারও শান্তি ও সন্ধি। অর্থাৎ যাদের প্রতি তোমরা অখুশী তাদের প্রতি আমিও অখুশী, আর যাদের প্রতি খুশী, তাদের প্রতি আমিও খুশী। নবীর অতি আদরের মেয়ে ফাতিমা (রা)-কে সব সময় স্পষ্ট করে বলে দিতেন যে, নবীরকন্যা হওয়ার কারণে আখিরাতে নাজাত পাওয়া যাবে না। সেখানে মুক্তির একমাত্র উপায় হবে আমল ও তাকওয়া। একবার তিনি ভাষণে বলেন
بامنشیش اشتروا القسم أغنى عثم من الله بنى شئتما مالي، لا شيئا، … يافاطمة بنت محمد أغنى من الله شيئا.
হে কুরাইশ সম্প্রদায়! তোমরা তোমাদের নিজ নিজ সত্তাকে খরিদ করে নাও। আল্লাহর নিকট আমি তোমাদের জন্য কিছুই করতে পারবো না। হে ফাতিমা বিত মুহাম্মদ! তুমি আমার সম্পদ থেকে যা ইচ্ছা আমার নিকট চেয়ে নাও। তবে আল্লাহর নিকট তোমার জন্য কিছুই করতে পারবো না। (বুখারী-৬/১৬ (তাফসীর সূরা আশ শুআরা); নিসা’ হাওলার রাসূল ১৪৯)
তিনি একথাও বলেন
يافاطمة بنت محمد القذى نفسك من النار، قائی لاأملك من الله ضرا ولاتثما.
“হে মুহাম্মদ -এর কন্যা ফাতিমা তুমি নিজেকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা কর। আমি আল্লাহর নিকট তোমার উপকার ও অপকার কিছুই করতে সক্ষম হবে না।’ এক মাখযুমী নারী চুরি করলে তার গোত্রের জনগণ নবী করীম (ﷺ)-এর প্রীতিভাজন উসামা ইবন যায়েদ (রা)-এর মাধ্যমে সুপারিশ করে শাস্তি মওকুফের চেষ্টা করে। তখন নবী করীম (ﷺ) বলেন
وأيم الله لو أن فاطمة إبتة مند سرقت لقطعت يدها .
আল্লাহ তা’আলার কসম! ফাতিমা বিন্ত মুহাম্মাদও যদি চুরি করে তাহলে আমি তার হাত কেটে দেব। (বুখারী : আল-হুদূদ; মুসলিম : বাবু কিতউস সারিক (১৬৮৮)
পিতার উত্তরাধিকার দাবী
নবী করীম (ﷺ) ইন্তেকাল করলেন। তাঁর উত্তরাধিকারের প্রশ্ন দেখা দিল। ফাতিমা (রা) সোজা খলীফা আবু বকর (রা)-এর নিকট গেলেন এবং তাঁর পিতার উত্তরাধিকার বণ্টনের আবেদন জানালেন। আবু বকর (রা) তাঁকে নবী করীম (ﷺ)-এর নিম্নোক্ত হাদীসটি শোনান
لاورث ماترکنا صدقة .
আমরা যা কিছু রেখে যাই সবই সাদকা হয়।
তার কোন উত্তরাধিকার হয় না। তারপর তিনি বলেন, এরপর আমি তা কিভাবে বণ্টন করতে পারি? এ জবাবে ফাতিমা (রা) একটু কষ্ট হলেন। ফাতিমা (রা) ঘরে ফিরে এসে রোগাক্রান্ত হয়ে পড়লেন। এ রকমও বর্ণিত হয়েছে যে, আবু বকর (রা)-এর জবাবে ফাতিমা (রা) কষ্ট পান এবং আবু বকর (রা)-এর প্রতি এত অসন্তুষ্ট হন যে, মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তাঁর সাথে কোন কথা বলেননি।
কিন্তু ইমাম আশ-শাবীর (র) একটি বর্ণনায় জানা যায়, ফাতিমা (রা) যখন রোগাক্রান্ত হয়ে পড়েন তখন আলী (রা) তার নিকট গিয়ে বলেন, আবু বকর (রা) তোমার সাথে দেখা করতে চাচ্ছেন। ফাতিমা (রা) আলী (রা)-কে প্রশ্ন করলেন ; আমি তাকে দেখা করার অনুমতি দেই তাতে কি তোমার সম্মতি আছে? আলী (রা) বললেন : হ্যা। ফাতিমা (রা) অনুমতি দিলেন। আবু বকর (রা) ঘরে প্রবেশ করে কুশল বিনিময়ের পর বললেন আল্লাহর কসম! আমি আমার অর্থ-বিত্ত, পরিবার-পরিজন গোত্র সবকিছু পরিত্যাগ করতে পারি আল্লাহ, আল্লাহর নবী করীম (ﷺ) এবং আপনারা আহুলি বাইত তথা নবী পরিবারের সদস্যদের সন্তুষ্টির বিনিময়ে। আবু বকর (রা)-এর এমন কথায় ফাতিমা (রা)-এর মনের সব কষ্ট দূর হয়ে যায়। তিনি খুশী হয়ে যান।
ইমাম আজ-জাহাবী (র) এ তথ্য উল্লেখ করার পর মন্তব্য করেছেন, স্বামীর ঘরে অন্য পুরুষের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে হলে স্বামীর অনুমতি নিতে হয়- এ সুন্নাত প্রসঙ্গে ফাতিমা (রা) জানতেন। এ ঘটনা দ্বারা সে কথা জানা যায়। এখানে উল্লেখিত এ বর্ণনা দ্বারা বুঝা যায় ফাতিমা (রা)-এর অন্তরে পূর্বে কিছু অসন্তুষ্টি থাকলেও পরে তা দূর হয়ে যায়। তাছাড়া একটি বর্ণনায় একথাও জানা যায় যে, ফাতিমা (রা) মৃত্যুর আগে আবু বকর (রা)-এর স্ত্রীকে অসীয়াত করে যান, মৃত্যুর পরে তিনি যেন তাকে গোসল দেন।
মৃত্যু
ফাতিমা (রা)-এর অপর তিন বোন যেমন তাদের যৌবনে ইন্তেকাল করেন তেমনি তিনিও নবী করীম (ﷺ)-এর ইন্তিকালের আট মাস, মতান্তরে সত্তর দিন পর দুনিয়া ত্যাগ করেন। অনেকে নবী করীম (ﷺ)-এর ইন্তেকালের দুই অথবা চার মাস অথবা আট মাস পরে তার ইন্তেকালের কথাও বলেছেন। তবে এটাই সঠিক যে, নবী করীম (ﷺ)-এর ইন্তেকালের ছয় মাস পরে হিজরী ১১ সনের ৩ রমাদান মঙ্গলবার রাতে ২৯ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। নবী করীম (ﷺ)-এর ভবিষ্যদ্বাণী- আমার পরিবারের মধ্যে তুমিই সর্বপ্রথম আমার সঙ্গে মিলিত হবে’- সত্যে পরিণত হয়।
নবী করীম (ﷺ) -এর নবুওয়্যাত লাভের পাঁচ বছর পূর্বে যদি ফাতিমা (রা)-এর জন্ম ধরা হয় তাহলে মৃত্যুকালে তাঁর বয়স ২৯ বছর হয়। আর কেউ কেউ বলেছেন যে, নবুওয়্যাত লাভের এক বছর পর ফাতিমা (রা)-এর জন্ম হয়, এ হিসেবে তার বয়স ২৯ বছর হবে না। যেহেতু অধিকাংশ সীরাত বিশেষজ্ঞ মনে করেন, মৃত্যুকালে ফাতিমা (রা)-এর বয়স হয়েছিল ২৯ বছর, তাই তার জন্যও হবে নবুওয়্যাতের পাঁচ বছর আগে।
আল-ওয়াকিদী বলেছেন, হিজরী ১১ সনের ৩ রমজান ফাতিমা (রা)-এর ইনতিকাল হয়। আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) জানাযার সালাত পড়ান। আলী ফাদল ও আব্বাস (রা) কবরে নেমে দাফন কাজ সম্পন্ন করেন। তাঁর অসীয়াত মত রাতের বেলা তাঁর দাফন করা হয়। এ কথাও বর্ণিত হয়েছে যে, ‘আলী, মতান্তরে আবু বকর (রা) জানাযার সালাত পড়ান। স্বামী আলী (রা) ও আসমা বিত উমাইস (রা) তাকে গোসল দেন।
ফাতিমা (রা)-এর শেষ রোগ প্রসঙ্গে ইতিহাসে তেমন কোন তথ্য পাওয়া যায় না। মারাত্মক কোন রোগে আক্রান্ত হয়ে কিছুদিন শয্যাশায়ী ছিলেন, এমন কোন বর্ণনা পাওয়া যায় না। উম্মু সালমা (রা) বলেন, ফাতিমা (রা)-এর ইন্তেকালের সময় আলী (রা) পাশে ছিলেন না। তিনি আমাকে ডেকে পাঠান এবং বলেন, আমার গোসলের জন্য পানির ব্যবস্থা করুন। নতুন পরিচ্ছন্ন বস্ত্র বের করুন, পরবো। আমি পানির ব্যবস্থা করে নতুন কাপড় বের করে দিলাম। তিনি ভালভাবে গোসল করে নতুন পোশাক পরেন। তারপর বলেন, আমার বিছানা করে দিন, বিশ্রাম করবো। আমি বিছানা করে দিলাম। তিনি কিবলামুখী হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লেন। তারপর আমাকে বলেন, আমার বিদায়ের সময় অতি নিকটে। আমি গোসল করেছি। দ্বিতীয়বার গোসল দেওয়ার দরকার নেই। আমার পরিধেয় পোশাকও খোলার দরকার নেই। এরপর তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।
আলী (রা) ঘরে প্রবেশের পর আমি তাকে এসব ঘটনা বললাম। তিনি ফাতিমা (রা)-এর সে গোসলকেই যথেষ্ট মনে করলেন এবং তাকে সে অবস্থায় দাফন করেন। এ রকম বর্ণনা উম্মু রাফি থেকেও পাওয়া যায়। কোন কোন বর্ণনায় রয়েছে যে, আলী (রা) মতান্তরে আবু বকর (রা)-এর স্ত্রী তাঁকে গোসল দেন। জানাযায় খুব কম মানুষ অংশগ্রহণের সুযোগ পায়। তার কারণ, রাতে তাঁর ইন্তেকাল হয় এবং আলী (রা) ফাতিমার অসীয়াত অনুযায়ী রাতেই তাকে দাফন করেন। তাবাকাতের বিভিন্ন স্থানে এ রকম বর্ণনা এসেছে। আয়েশা (রা) বলেন, রাসূলে করীম (ﷺ)-এর পরে ফাতিমা (রা) ছয় মাস জীবিত ছিলেন এবং রাতের বেলা তাকে দাফন করা হয়।
লজ্জা-শরম ছিল ফাতিমা (রা)-এর স্বভাবের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। মৃত্যুর সময় নিকটবর্তী হলে তিনি আসমা বিন্ত উমাইস (রা)-কে বলেন, মহিলাদের লাশ উম্মুক্ত অবস্থায় যে গোরস্থানে নিয়ে যাওয়া হয়, এ আমার পছন্দ নয়। এতে বেপর্দা হয়। নারী- পুরুষের লাশের ক্ষেত্রে কোন পার্থক্য করা হয় না। পুরুষরা যে মহিলাদের লাশ খোলা অবস্থায় বহন করেন, এ তাদের একটা মন্দ কাজ। আসমা বিত উমাইস (রা) বললেন, আল্লাহর রাসূলের মেয়ে! আমি হাবশায় একটি ভাললা পদ্ধতি দেখেছি। আপনি অনুমতি দিলে দেখাতে পারি। একথা বলে তিনি খেজুরের কিছু ডাল আনলেন এবং তার উপর একটি কাপড় টানিয়ে পর্দার মত করলেন। এ পদ্ধতি ফাতিমা (রা)-এর বেশ পছন্দ হলো এবং তিনি বেশ আনন্দিত হলেন।
পর্দার মধ্য দিয়ে ফাতিমা (রা)-এর লাশ কবর পর্যন্ত নেওয়া হয়। ইসলামের সর্বপ্রথম এভাবে তার লাশটিই নেওয়া হয়। তার পরে উম্মু মু’মিনীন যয়নব বিত জাহাশের লাশটিও এভাবে কবর পর্যন্ত বহন করা হয়। আলী (রা) স্ত্রী ফাতিমা (রা)-এর দাফন-কাফনের কাজ সমাধা করে যখন ঘরে ফিরলেন তখন তাঁকে বেশ বিষন্ন ও বেদনাকাতর দেখাচ্ছিল। শোকাতুর অবস্থায় বার বার নীচের চরণগুলো আবৃত্তি করছিলেন
وصاحبها حتى الممات عليل وكل الذي دون الفراق قليل دليل على أن لايدوم ليل. آري على الدنيا على گبرة لگتی اجتماع من خللين فرقة وان انتقادي فاطمة بعد أحمد
১. আমি দেখতে পাচ্ছি আমার মধ্যে ইললৌকিক রোগ-ব্যাধি প্রচুর পরিমাণে বাসা বেঁধেছে। আর একজন দুনিয়াবাসী মৃত্যু পর্যন্ত রোগগ্রস্তই থাকে।
২. ভালোবাসার মানুষের প্রতিটি মিলনের পরে বিচ্ছেদ আছে। বিচ্ছেদ ব্যতীত মিলনের যে সময়টুকু তা অতি সামান্যই।
৩. আহমদ -এর পরে ফাতিমা (রা)-এর বিচ্ছেদ একথাই প্রমাণ করে যে, কোন বন্ধুই চিরকাল অবস্থান করে না। (আলাম আন-নিসা-৪/১৩১)
আলী (রা) প্রতিদিন ফাতিমা (রা)-এর কবরে গমন করতেন, স্মৃতিচারণ করে কাঁদতেন এবং নিম্নের এ চরণ দুটি আবৃত্তি করতেন
قبر الحبيب تكم يرد جوالي أملك بعدی ځلة الأحباب .
مالی مررت على القبور مسلم بابر مالك الأثجيب مناديا
১. “আমার একি দশা হয়েছে যে, আমি কবরের উপর সালাম করার জন্য আগমন করি; কিন্তু প্রিয়ার কবর আমার প্রশ্নের কোন জবাব দেয় না। ”
২. “হে কবর! তোমার কী হয়েছে যে, তোমার আহ্বানকারীর আহ্বানে সাড়া দাও না? তুমি কি তোমার প্রিয়জনের ভালোবাসায় বিরক্ত হয়ে উঠেছে?
দাফনের স্থান
আল-ওয়াকিদী বলেন, আমি আবদুর রহমান ইবন আবিল মাওলাকে বললাম, অধিকাংশ মানুষ ধারণা করে থাকে ফাতিমা (রা)-এর কবর বাকী গোরস্থানে। আপনি কী মনে করেন? তিনি জবাব দিলেন : বাকী’তে তাকে দাফন করা হয়নি। তাকে আকীলের বাড়ীর এক কোনে দাফন করা হয়েছে। তার কবর ও রাস্তার মধ্যে পার্থক্য ছিল প্রায় সাত হাত।
হাদীস বর্ণনা
ফাতিমা (রা) নবী করীম (ﷺ)-এর আঠারোটি হাদীস বর্ণনা করেছেন। তার মধ্যে একটি হাদীস মুত্তাফাকুন আলাইহি অর্থাৎ আয়েশা (রা)-এর সনদে বুখারী ও মুসলিম সংকলন করেছেন। ইমাম আবু দাউদ, ইবন মাজাহ্ ও তিরমিযী তাঁদের নিজ নিজ সংকলনে ফাতিমা (রা)-এর বর্ণিত হাদীছ সংকলন করেছেন। আর ফাতিমা (রা) থেকে যারা হাদীস বর্ণনা করেছেন তারা হলেন : তার কলিজার টুকরা দুই ছেলে-হাসান, হুসাইন, স্বামী আলী ইবন আবী তালিব,উম্মুল মু’মিনীন আয়েশা, সালমা উম্মু রাফি’ আনাস ইবন মালিক, উম্মু সালামা, ফাতিমা বিন্ত আল-হুসাইন (রা) ও আরো অনেকে। ইবনুল জাওযী বলেন, একমাত্র ফাতিমা (রা) ব্যতীত নবী করীম (ﷺ)-এর অন্য কোনো কন্যা নবী করীম (ﷺ)-এর কোন হাদীস বর্ণনা করেছেন বলে আমরা জানি না।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন