৬. উম্মু সুলাইম (রা)

৬. উম্মু সুলাইম (রা)

তালহা (রা)-এর স্ত্রী উম্মু সুলাইমকেও নবী কারীম জান্নাতের সুসংবাদ দিয়েছেন। বেলাল (রা)-কে নবী কারীম (ﷺ) জান্নাতে একটি ঘরের সুসংবাদ দিয়েছেন।

قال أريت الجنة عن جابر بن عبد الله (رض) أن رسول الله قرابت امراة ابي طلحة ثم سمعت شش امامی فاذا بلال .

জাবের বিন আবদুল্লাহ (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেছেন : আমাকে জান্নাত দেখানো হল, আমি আবু তালহা (রা)-এর স্ত্রী উম্মু সুলাইমকে সেখানে দেখতে পেলাম, অতঃপর আমি সামনে অগ্রসর হয়ে কোন মানুষের চলার আওয়াজ পেলাম, হঠাৎ দেখলাম বেলাল (রা) কে।

(মুসলিম : কিতাবুল ফাযায়েল, বাব মিন ফাযায়েল উম্মে সুলাইম)

পরিচিতি

উম্মু সুলাইম (রা) বিন্ত মিলহান ইব্ন খালিদ ইবন জুনদুব ইবন ‘আমির ইবন গানাম ‘আদী ইবন নাজ্জার। তাঁর প্রকৃত নাম সম্পর্কে মতবিরোধ রয়েছে, সাহলা, রুমায়লা রুমায়’আ, উনায়ফা, গুমায়সা, রুমায়সা ইত্যাদি নামের উল্লেখ আছে। তার মাতা মুলায়কা বিনত মালিকও ছিলেন নাজ্জার গোত্রের। সে গোত্রেরই মালিক ইবন নাদীর নামীয় এক ব্যক্তি ছিল তার স্বামী। রাসুলুল্লাহ (ﷺ)-এর বিখ্যাত খাদিম আনাস (রা) তাদেরই পুত্র ছিলেন।

ইসলাম গ্রহণ

তিনি অন্যান্য আনসারীর সঙ্গে প্রথম দিকেই ইসলাম গ্রহণ করেন। এজন্য তাঁর স্বামী রাগান্বিত হয়ে সিরিয়ায় চলে যায় এবং সেখানেই মৃত্যুবরণ করে। তারপর নাজ্জার গোত্রীয় আবু তালহা তাঁকে বিবাহের প্রস্তাব দেন। কিন্তু তিনি তখনও ইসলাম গ্রহণ না করায় উম্মু সুলাইম (রা) সম্মতি দেন নাই। অতঃপর আবু তালহা ইসলাম গ্রহণে রাযী হয়ে উম্মু সুলাইম-এর সম্মুখে কালিমা তায়্যিবা পাঠ করেন। তখন মাতার নির্দেশে আনাস (রা) আবু তালহার সঙ্গে তাঁর মাতার পুনর্বিবাহের ব্যবস্থা করেন।

পুত্র আনাসকে রাসুলের খেদমতে অর্পণ

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) হিজরত করে মদীনায় আগমন করলে উম্মু সুলাইম (রা) পুত্র আনাসকে সঙ্গে নিয়ে রাসূল (ﷺ)-এর খিদমতে উপস্থিত হন এবং বলেন, “আমার পুত্র আনাসকে আপনার খেদমতে পেশ করছি। আপনি তাকে কবূল করুন এবং তার জন্য দু’আ করুন।” রাসূলুল্লাহ আমাসের জন্য দু’আ করলেন। মদীনায় মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব বন্ধনের যে ব্যবস্থা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) করেছিলেন, সে সম্পর্কিত বৈঠক উম্মু সুলাইমের গৃহেই অনুষ্ঠিত হয়েছিল।

যুদ্ধের অবদান

উম্মু সুলাইম (রা) অতি উৎসাহের সাথে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর, সঙ্গে কয়েকটি জিহাদে শরীক হন। মুসলিমের একটি বর্ণনা থেকে জানা যায়, রাসূলুল্লাহ উম্মু সুলাইম (রা) এবং কয়েকজন আনসারী মহিলাকে যুদ্ধের সময় তার সঙ্গে নিতেন, যাতে তারা মুজাহিদদেরকে পানি পান করাতে এবং তাদের মধ্যে কেহ আহত হলে তার সেবা-শুশ্রুষা করতে পারেন। উহুদ যুদ্ধে মুসলিমগণ যখন মুশরিকদের অকস্মাৎ আক্রমণে কিছুটা বিপদগ্রস্ত হয়েছিলেন তখনও উম্মু সুলাইম (রা) দৃঢ়তার সাথে তার কর্তব্য পালন করে যেতে ছিলেন। তাঁর পুত্র আনাস বর্ণনা করেছেন, তিনি উম্মুল-মু’মিনীন আয়েশা (রা) ও উম্মু সুলাইমকে মশক ভর্তি করে পানি আনতে এবং আহতদের তা পান করতে দেখেছেন (বুখারী, কিতাবুল-মাগাযী, বাব ১৮)।

হুনায়ুন-এর যুদ্ধেও উম্মু সুলাইম (রা) তরবারি হস্তে উপস্থিত ছিলেন। তরবারি দিয়ে তিনি কি করবেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) জিজ্ঞাসা করলে উম্মু সুলাইম (রা) বলেন, “কোন মুশরিক নিকটে আসলে আমি তার পেট কর্তন করব।” এ উত্তর শুনে রাসূলুল্লাহর স্মিত হাস্য করেন। খায়বারের যুদ্ধেও (৭ম হি.) তিনি অংশগ্রহণ করেছিলেন। এ সময় রাসূলুল্লাহ উম্মুল-মু’মিনীন সাফিয়া (রা)-কে বিবাহ করেন। উম্মু সুলাইম তখন সাফিয়্যা (রা)-কে নববধূর সাজে সাজিয়ে দিয়েছিলেন।

পঞ্চম হিজরীতে উম্মুল মু’মিনীন যয়নব (রা)-এর সাথে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর বিবাহ সম্পন্ন হলে সুলাইম বড় এক পাত্রে ফিরনি প্রস্তুত করে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর খেদমতে উপস্থিত করেন। রাসূল (ﷺ)-এর অত্যধিক ভালবাসতেন। প্রায়ই তিনি দ্বিপ্রহরে তাঁর গৃহে বিশ্রাম করতেন। তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পবিত্র দেহ হতে স্বেদ বিন্দু এবং তার কোমল কেশ পড়ে গেলে তাও উম্মু সুলাইম সংগ্রহ করে রাখতেন। একবার রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর গৃহে তাঁর মশকে মুখ লাগিয়ে পানি পান করেন। উম্মু সুলাইম (রা) তখনই মশকটির মুখ কেটে নিজের কাছে সংরক্ষিত করেন। বিদুষী উম্মু সুলাইম (রা) কয়েকটি হাদীস বর্ণনা করেছেন। তাঁর পুত্র আনাস (রা), আবদুল্লাহ ইবন ‘আব্বাস (রা), যায়েদ ইবন ছাবিত (রা), আবু সালামা, (রা) ও ‘আমর ইবন ‘আসিম (রা) তাঁর নিকট হতে হাদীস বর্ণনা করেছেন। তিনি ফিকহী মাসাইল সম্পর্কেও ভাল জ্ঞান রাখতেন। একবার ‘আবদুল্লাহ ইবন ‘আব্বাস এবং যায়েদ ইবন ছাবিত (রা)-এর মধ্যে একটি মাসআলা সম্পর্কে মতবিরোধ হলে তারা সিদ্ধান্তের জন্য উম্মু সুলাইমের স্মরণাপন্ন হয়েছিলেন। তিনি স্ত্রীলোক সংক্রান্ত মাসআলা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে নিঃসঙ্কোচে জিজ্ঞাসা করতেন। মহৎ চরিত্রের অধিকারিণী উম্মু সুলাইম (রা) তাঁর প্রথম স্বামী ইসলাম গ্রহণ না করায় তাকে পরিত্যাগ করেন। আবূ তালহা বিবাহের প্রস্তাব দিলে তিনি ইসলাম গ্রহণের শর্ত আরোপ করেছিলেন এবং বলেছিলেন, “তুমি যে ইলাহ-এর ইবাদত কর তার তো মৃত্তিকা হতে উৎপন্ন কাষ্ঠ দ্বারা নির্মিত। আর বৃক্ষের পূজা করতে তোমার কি লজ্জা করে না?” (ইসাবা, ৪খ, ৪৬১)

ধৈর্যশীলা উ সুলাইম (রা)

পরম ধৈর্যশীলা উম্মু সুলাইম তার অতি স্নেহের পুত্র আবু ‘আমির ইন্তেকাল করলে শুধু সবর অবলম্বন করেন নাই বরং স্বামী আবু তালহা সন্ধ্যায় বাড়ি আসলে শোক সম্বরণ করে প্রতিদিনের মত যত্ন সহকারে তার আহারের ব্যবস্থা করেন এবং রাত্রে তার কাছেই শয়ন করেন।

পরে শোক সংবাদটি এভাবে তাঁকে শোনান

কেহ তোমার নিকট সাময়িকভাবে কিছু গচ্ছিত রাখলেও পরে ফেরত চাইলে তুমি কি তা ফেরত দিতে অস্বীকার করবে? আবু তালহা বলেন, কখনই নয়। উম্মু সুলাইম আরও বলেন, ঘটনাটি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট বর্ণনা করলে তিনি বলেন, “এ রাত্রিটি তোমাদের উভয়ের জন্য বরকতময় রাত্রি ছিল।” সে রাত্রিতেই তিনি গর্ভবতী হন এবং পুত্র জন্মিলে তার নাম রাখা হয় ‘আবদুল্লাহ।

একবার তার স্বামী আবু তালহা গৃহে এসে তাঁকে বললেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ক্ষুধার্ত আছেন, কিছু খাদ্য পাঠিয়ে দাও।” উম্মু সুলাইম পুত্র আনাসের মারফত কিছু রুটি একটি কাপড়ে জড়িয়ে পাঠিয়ে দিলেন। রাসূলুল্লাহ আনাসকে দেখে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমাকে কি আবু তালহা আমাদেরকে আহারের দাওয়াত দিতে পাঠিয়েছে।” আনাস বললেন, হ্যা রাসূলুল্লাহ তার নিকট উপস্থিত সাহাবীদের সাথে নিয়ে আবু তালহার গৃহে গমন করলেন। খাদ্য পরিমাণে খুব স্বল্প হওয়ায় আবু তালহা খুব বিচলিত হলেন। কিন্তু উম্মু সুলাইম স্থির চিত্তে বললেন, আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূল সবই জানেন। অতঃপর রাসূলুল্লাহ গৃহে প্রবেশ করলে সে কয়টি রুটি ও সামান্য কিছু তরকারি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সম্মুখে পরিবেশন করলেন। আল্লাহ তাতে এমন বরকত দিলেন যে, রাসূলুল্লাহ ও তার সাথের সাহাবীগণ তৃপ্তি সহকারে আহার করলেন। হাদীসে অনেক সৎ গুণের অধিকারিণী উম্মু সুলাইম-এর ফযীলত বর্ণনা করা হয়েছে। তাঁর মৃত্যু সন জানা নেই। অনুমিত হয়, তিনি খিলাফাতে রাশিদার আমলের প্রথম দিকেই ইন্তেকাল করেন। এক মতে তিনি খলীফা উছমান (রা)-এর খিলাফাত আমলে ইন্তেকাল করেন। তার প্রথম স্বামীর ঔরসে আনাস ও দ্বিতীয় স্বামীর ঔরসে আবদুল্লাহ এ দুই পুত্র ছিলেন।

সকল অধ্যায়

১. ১. উম্মুল মু’মিনীন খাদীজা (রা)
২. ২. উম্মুল মু’মিনীন আয়েশা (রা)
৩. ৩. উম্মুল মুমিনীন হাফসা (রা)
৪. ৪. মারইয়াম (আ)
৫. ৫. আছিয়া (আ)
৬. ৬. উম্মু সুলাইম (রা)
৭. ৭. যয়নব বিনত রাসূলুল্লাহ
৮. ৮. রুকাইয়া বিনত মুহাম্মদ
৯. ৯. উম্মু কুলছুম বিনত নবী করীম (ﷺ)
১০. ১০. ফাতিমা বিনত রাসূলিল্লাহ
১১. ১১. সুমাইয়া (রা)
১২. ১২. উম্মুল মুমিনীন সাদা বিনতে যামআ (রা)
১৩. ১৩. উম্মুল মুমিনীন যয়নব বিনতে খুযাইমা (রা)
১৪. ১৪. উম্মুল মু’মিনীন উম্মু সালামা (রা)
১৫. ১৫. উম্মুল মুমিনীন যয়নব বিনতে জাহাশ (রা)
১৬. ১৬. উম্মুল মু’মিনীন জুয়াইরিয়া (রা)
১৭. ১৭. উম্মুল মুমিনীন উম্মু হাবীবা (রা)
১৮. ১৮. উম্মুল মু’মিনীন সফিয়্যা (রা)
১৯. ১৯. উম্মুল মুমিনীন মায়মূনা (রা)
২০. ২০. উম্মুল মুমিনীন রায়হানা (রা)
২১. ২১. উম্মুল মু’মিনীন মারিয়া কিবতিয়া (রা)
২২. ২২. হালীমা (রা)
২৩. নবী করীম (ﷺ)-এর বহু বিবাহের সমালোচনার প্রতিবাদ

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন