১৫. উম্মুল মুমিনীন যয়নব বিনতে জাহাশ (রা)

১৫. উম্মুল মুমিনীন যয়নব বিনতে জাহাশ (রা)

রাসূল (ﷺ) -এর পবিত্র স্ত্রীগণ হলেন মুমিনদের জন্য মাতৃতুল যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেন-

النبى أولى بالمؤمنين من أنفسهم وأزواجه أمهاتهم.

নবী মুমিনদের নিকট তাদের নিজেদের অপেক্ষা অধিক ঘনিষ্ঠ আর তার স্ত্রীগণ তাদের মাতা (সুরা-৩ আহযাব : আয়াত-৬)

তাই মু’মিনদের মাতা ও রাসূল (ﷺ)-এর পবিত্র স্ত্রীগণ জান্নাতে যাবে এটাই স্বাভাবিক। যাদের সাথে রাসুল এর দাম্পত্য জীবন অতিবাহিত হয়েছে তারা জাহান্নামে যাবে আর রাসূল (ﷺ) জান্নাতে থাকবেন এটা অসম্ভব কথাও বটে। তাই রাসূল (ﷺ)-এর সাথে তাদের সম্পর্কের কারণেই তারা জান্নাতে যাবেন, এটাই দলিল তাদের জান্নাতে যাওয়ার।

আল্লাহ তা’আলা আসমানে আমার আকদ সম্পন্ন করেছেন, আর আমার বিয়েতেই নবীজী গোশত-রুটি দিয়ে ওলীমার ব্যবস্থা করেছেন।’ কথাগুলো তার বিয়ের ব্যাপারে গর্বভরে বলতেন যয়নব বিনতে জাহাশ (রা)।

নাম ও পরিচয়

তাঁর নাম যয়নব। পূর্বে তাঁর নাম ছিল বুররাহ। ডাক নাম উম্মু হাকাম। বাবার নাম জাহাশ। তিনি তৎকালীন আরবের সম্মানিত ব্যক্তিদের অন্যতম ছিলেন। তার মায়ের নাম ছিল উমাইয়া বিনতে আবদুল মুত্তালিব। অর্থাৎ যয়নব বিনতে জাহাশ (রা) ছিলেন রাসূল (ﷺ)-এর আপন ফুফাতো বোন।

বংশ তালিকা

তাঁর বংশ তালিকা ছিল এ রকম, যয়নব বিনতে জাহাশ ইবনে রুবাব ইবনে ইয়ামার ইবনে সোবরা ইবনে মুবরা ইবনে কাসীর ইবনে গানাম ইবনে দুদরান ইবনে আসাদ খুযাইমা।

ইসলাম গ্রহণ

পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সাথে তিনি নবুওয়াতের সূচনালগ্নে ইসলাম গ্রহণ করেন। সে সূত্রে তিনি সাবেকুনাল আউয়ালুনদের তথা প্রথম ইসলাম গ্রহণকারীর পর্যায়ভুক্ত হওয়ার গৌরব অর্জন করেছিলেন। পিতা জাহাশ পূর্বেই ইনতেকাল করেন। তাই তিনি এ সৌভাগ্য হতে বঞ্চিত হন।

হিযরত

অবিশ্বাসী মক্কাবাসীদের অত্যাচার যখন সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যায় তখন রাসূল (ﷺ)-এর নির্দেশে পরিবারের অন্যান্য সদস্যের সাথে যয়নব (রা) আবিসিনিয়ায় হিজরত করেন। পরে সেখান থেকে মদীনায় হিজরত করেন। নবী করীম (ﷺ)-এর অভিভাকত্বাধীনে অবস্থান করেন।

দাস প্রথা ও যায়েদ

তৎকালীন আরব সমাজে অন্যান্য পণ্য সামগ্রীর সাথে বাজারে মানুষও বেচাকেনা হতো। যাদেরকে বাজারে পণ্য সামগ্রীর মত বেচাকেনা করা হতো তারা ক্রীতদাসরূপে পরিচিত ছিল। নবুওয়্যাতের পূর্বে ও সূচনালগ্নেও এ প্রথা চালু ছিল। পরবর্তীকালে রাসূল খোলাফায়ে রাশেদা, সাহাবাগণ ও পরবর্তীকালের মুসলিম শাসকগণ ধীরে ধীরে এ কু-প্রথার বিলুপ্তি সাধন করেন। সেই জাহেলী যুগের প্রথা অনুযায়ী খাদীজা (রা)-এর ভাতিজা হাকীম ইবনে খুযাইমা বাজার থেকে যায়েদ ইবনে হারিসা নামের এক দাস বালককে কিনে এনে ফুফুকে উপহার হিসেবে দিলেন। পরবর্তীতে খাদীজা প্রিয় দাস যায়েদকে স্বামী মুহাম্মদ (ﷺ)-এর খেদমতের জন্য দিয়ে দিলেন। কিন্তু দয়ার সাগর, সর্বমানবতার মুক্তিদূত, রাহমাতুল্লিল আলামীন তাকে আযাদ (মুক্ত) করে দিলেন। এমনকি আপন পালক পুত্র হিসেবে তাকে গ্রহণ করলেন। রাসূল এমএর ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে যায়েদ ইসলাম কবুল করলেন এবং অচিরেই নিজেকে কুরআন হাদীসের জ্ঞানে সমৃদ্ধ করে তুললেন।

যায়েদের সাথে যয়নবের বিয়ে

এ ক্রীতদাস যায়েদ (রা)-এর সাথে রাসূল (ﷺ)-এর আপন ফুফাতো বোন অনিন্দ্য সুন্দরী যয়নব বিনতে জাহাশ (রা)-এর বিয়ে দেন। রাসূল (ﷺ)-এর উদ্দেশ্য ছিল মানুষের মধ্যে সমতা ফিরিয়ে আনা। সব মুসলমান সমান, সকলে ভাই ভাই, আশরাফ-আতরাফের কোনো বালাই ইসলামে নেই। ইসলামের সাম্য প্রতিষ্ঠা করতে গিয়েই তিনি একজন সদ্য আযাদপ্রাপ্ত ক্রীতদাসের সাথে আরবের সর্বশ্রেষ্ঠ বংশ, কুরাইশ বংশের মেয়ে তাও আবার নিজেরই ফুফাতো বোনকে বিয়ে দেন। কিন্তু নারীসূলভ মানসিকতার কারণে যয়নব (রা) এ বিয়েকে ভাল মনে মেনে নিতে পারেন নি। যে কারণে বিয়ের প্রায় এক বছর একত্রে বসবাস করার পরও তাদের মধ্যে সার্বিক অর্থে কোনো ভাল সম্পর্ক গড়ে উঠেনি। ফলে যায়েদ (রা) প্রচণ্ড অশান্তির মধ্যে দিনাতিপাত করছিলেন। আসলে যয়নব (রা) বিয়ের আগেই রাসূল (ﷺ)-এর খেদমতে যায়েদ (রা) সম্বন্ধে আরজ করেছিলেন, আমি তাকে আমার জন্য পছন্দ করি না।’ তিনি শুধু রাসূল (ﷺ)-এর নির্দেশ মেনে নেয়ার জন্যই এ বিয়েতে রাজি হয়েছিলেন।

যায়েদ-যয়নব বন্ধ

কিন্তু যখন দুজনের মধ্যে মোটেই বনিবনা হচ্ছিল না তখন একদিন যায়েদ (রা) এসে রাসূলকে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল যয়নব আমার কথার ওপর কথা বলে তর্ক করে, আমি তাকে তালাক দিতে চাই।’ একথা শুনে রাসূল যায়েদ (রা)-কে আল্লাহুর ভয় দেখিয়ে তালাক দেয়া থেকে বিরত থাকতে বললেন। কারণ তালাক দেয়া শরীয়তে জায়েয হলেও অপছন্দনীয়। এমন কি বৈধ কাজসমূহের মধ্যে এ কাজটি নিকৃষ্টতম ও সর্বাধিক ঘৃণিত। যে কারণে রাসূল তাকে প্রশ্ন করলেন, “তুমি কি তার মধ্যে কোন ত্রুটি দেখতে পেয়েছো?’ যায়েদ উত্তর করলেন না! কিন্তু আমি তার সংগে বসবাস করতে পারবো না। রাসূল তাকে আদেশের সুরে বললেন, বাড়িতে গিয়ে তোমার স্ত্রীর দেখাশোনা কর, তার সংগে ভাল আচরণ কর এবং আল্লাহকে ভয় কর। কারণ আল্লাহ বলেছেন, “তোমাদের স্ত্রীদের প্রতি সদাচরণ কর আর আল্লাহকে ভয় কর। কিন্তু তাদের সম্পর্ক এমন পর্যায়ে পৌছেছিল যে শেষ পর্যন্ত যায়েদ (রা) রাসূলনিষেধ করার পরও যয়নব (রা)-কে তালাক দিয়ে দেন। এ বিষয়টি সূরা আহযাবে এভাবে বর্ণিত হয়েছে-

وإذ تقول للذي انعم الله عليه وانعمت عليه أمسك علبة زوجك وانتي الله.

অর্থ: “হে নবী! সে সময়ের কথা স্মরণ কর, যখন তুমি সে ব্যক্তিকে বলেছিলেন যে, যার প্রতি আল্লাহ এবং তুমি অনুগ্রহ করেছিলে, তোমার স্ত্রীকে পরিত্যাগ করো না এবং আল্লাহকে ভয় কর।’ সূরা-৩৩ আহযাব : আয়াত-৩৭)

নিরীহ যয়নব

যায়েদ (রা) যখন যয়নব (রা)-কে তালাক দিলেন তখন জনগণের মধ্যে জল্পনা কল্পনা চলতে লাগলো, ক্রীতদাসের তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীকে কে-ই বা বিয়ে করবে। সত্যি কথা বলতে কি, তালাকপ্রাপ্তা হওয়ার পর যয়নব (রা) হয়ে গেলেন অবজ্ঞা ও ঘৃণার পাত্রী। এ অবস্থা থেকে যয়নব (রা)-কে রেহাই দিতে আল্লাহ রাসূল (ﷺ)-এর সাথে তাকে বিয়ে দেয়ার মনস্থ করলেন। তাই যয়নব (রা) তালাকপ্রাপ্তা হওয়ার পর ইদ্দত পুরা হলে রাসূলে করীম তাকে বিয়ে করার ইচ্ছে প্রকাশ করেন। কিন্তু জাহেলী প্রথা সেখানে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। কারণ যায়েদ (রা) ছিলেন রাসূল (ﷺ)-এর পালক পুত্র। তক্কালীন আরবের লোকজন পালক পুত্রকে আপন পুত্রের মতই মনে করতো। যায়েদ (রা) ঐ সময়ে যায়েদ ইবনে মুহাম্মদ নামেই পরিচিত ছিলেন। ফলে রাসূল অপবাদের আশংকা করছিলেন। তাছাড়া মুনাফিকদের তর্জন গর্জনও ছিল।

কুপ্রথার মূলৎপাটনে আয়াত নাযিল

যা হোক, আল্লাহ রাব্বল আলামীন চাচ্ছিলেন সকল প্রকার কুসংস্কারের মূলোৎপাটন করে নির্ভেজাল একটি ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠা করার জন্য রাসূলকে দুনিয়াতে প্রেরণ করেন। তাই আল্লাহ রাব্বল আলামীন সবকিছু নিরসনকল্পে ঘোষণা করলেন-

ماکان محمد ابا احد من وجالگم ولكن رسول الله واتم اليه ، وكان اللي شي عب.

অর্থ : তোমাদের পুরুষদের মধ্যে মুহাম্মদ কারো পিতা নন বরং তিনি আল্লাহর রাসূল এবং সর্বশেষ নবী। [সূরা-৩৩ আহযাব : আয়াত-৪০]

আল্লাহ রাব্বল আলামীন আরও ঘোষণা করেন –

وخفى في نفسك ما الله مبديه وتخشى الناس ، والله أحق أن تخشه.

তুমি অন্তরে তা গোপন করছিলে, যা আল্লাহ প্রকাশ করতে চেয়েছিলেন, তুমি মানুষকে ভয় করছ, অথচ আল্লাহই তো বেশি ভয় পাওয়ার যোগ্য। [৩৩-আহযাব :৩৭)

বিয়ের প্রস্তাব যায়েদ কর্তৃক

রাসূল নিশ্চিন্ত হলেন। এরপর তিনি যায়েদকেই পাঠালেন বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যয়নব (রা)-এর কাছে। তিনি যয়নব (রা)-এর গৃহে গিয়ে বললেন, ‘আল্লাহর রাসূল তোমাকে বিয়ে করতে চান। তিনি বললেন, “এটা খুব ভাল কথা। তবে ইন্তেখারা করে সিদ্ধান্ত নেব।’

তিনি ইন্তেখারায় বসে গেলেন। ইতোমধ্যেই আল্লাহর পক্ষ থেকে রাসূলও যয়নব (রা)-এর বিয়ের ব্যাপারে আয়াত নাযিল হল –

لما تضی زید مثها وطرا زوجنگها لكي لا يكون على المؤمنين تخرج في ازواج أثعبانهم اذا قضوا مثهن وطراد وكان أمر الله تثو؟.

অর্থ: অতঃপর যায়েদ যখন তার সাথে স্বীয় প্রয়োজন সমাপ্ত করল তখন আমি তাঁকে তোমার নিকট বিয়ে দিলাম। যাতে প্রয়োজন পুরো করার পর মুখ ডাকা পুত্রের স্ত্রীদের ব্যাপারে মুমিনদের ওপর কোনো দোষারোপ না চলে। আল্লাহর ইচ্ছে তো পূরণ হবেই।’ সূরা-৩৩ আহযাব : আয়াত-৩৭]।

সরাসরি আল্লাহর পক্ষ থেকে, তখন আমি তাকে তোমার নিকট বিয়ে দিলাম। এমন কথা নাযিল হওয়ার পর বিয়ের কাজ সম্পন্ন করা হল। সময়টা ছিল ৫ম হিজরীর জিলক্বদ মাস। এ জন্যেই যয়নব (রা) গর্ব করে বলতেন, ‘আমার বিয়ে স্বয়ং আল্লাহ দিয়েছেন।

বিয়ের অনুষ্ঠান

এ বিয়েতে বেশ আনন্দ করা হয়। বৌভাত অনুষ্ঠানে আনসার ও মুহাজিরদের প্রায় তিনশ জনকে দাওয়াত করা হয়। খাওয়ার মেনু ছিল গোশত-রুটি। একেক বারে দশজন করে লোক খেতে বসছিলেন। কিন্তু শেষ দলের লোকজন খাওয়া শেষ হওয়ার পরও বসেছিলেন। তারা নানা গল্পে মেতে উঠলেন। ফলে রাত ক্রমেই গভীর হতে লাগলো।

পর্দার আয়াত

রাসূল লজ্জার কারণে মেহমানদেরকে উঠতে বলতে পারছিলেন না, অথচ খুব অস্বস্তি অনুস্ব করছিলেন। ঠিক এ সময়ে আল্লাহর পক্ষ থেকে পর্দার আয়াত নাযিল হয়। ইরশাদ হচ্ছে-

 بایها الذين أمنوا لاتدخلوا بيوت النبي إلا أن يؤذن لكم واتادا إلى طعام غير نظرين إنه, ولكن اذا دهیم تا طعنئم فانتشروا ولامستانسين لحدثت د إن ذلگم گان بژی النبی بستحي منكم ، والله لايستحي من الحقد واذا سألتموهن متاعا فسئلوهن من وراء حجاب.

অর্থ: হে ঈমানদার লোকেরা! তোমাদেরকে অনুমতি দেয়া না হলে তোমরা নবী গৃহে প্রবেশ করবে না। অবশ্য দাওয়াত পেলে যাবে, তবে ডাকার আগে গিয়ে অনর্থক বসে থাকবে না। বরং ডাকবার পরে যাবে, খাওয়ার পরে চলে আসবে। বসে গল্প-গুজবে রত হবে না। নিশ্চয় এটা নবীর জন্য কষ্টদায়ক। তিনি তোমাদেরকে বলতে সংকোচ বোধ করেন, কিন্তু আল্লাহ সত্য কথা বলতে সংকোচ বোধ করেন না। তোমরা নবীর স্ত্রীদের নিকট কিছু চাইলে পর্দার আড়াল থেকে চাইবে।’ (সূরা-৩৩ আহযাব : আয়াত-৫৩]

এ আয়াত নাযিল হওয়ার পর রাসূল দরজায় পর্দা ঝুলিয়ে দেন। ফলে লোকদের ভেতরে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। রাসূল ও যয়নব (রা)-এর বিয়ের ফলে আরবের দীর্ঘদিনের প্রচলিত একটি ভ্রান্ত ধারণার অবসান ঘটে, তা হল-পালক পুত্র আদৌ আপন পুত্র হতে পারে না। ফলে তার স্ত্রীকে বিয়ে করাও দোষণীয় নয়। ইসলাম পরিষ্কারভাবে ১৪ জন নারীকে বিয়ে করা নিষিদ্ধ করেছে। বাকী সকলকে বিয়ে করা জায়েয। এ ১৪ জনের মধ্যে পালক পুত্রের স্ত্রীর কথা নেই।

বিয়ের বৈশিষ্ট্য

এ বিয়ের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য রয়েছে, তা হল –

১. জাহেলী যুগে পালক পুত্র আসল পুত্রের মর্যাদাসম্পন্ন ছিল। এ প্রথার বিলুপ্তি ঘটানো হয়েছে।

২ লোকদেরকে আদেশ করা হয় যে, কাউকে তার প্রকৃত পিতা ব্যতীত অনন্যর সাথে পিতৃ পরিচয়ে সম্পর্ক করা যাবে না।

৩. মানুষের মধ্যে উঁচু-নীচুর কোনো ব্যবধান থাকবে না।

৪. আল্লাহ ওহীর মাধ্যমে যয়নব (রা)-এর বিয়ে দেন।

৫. যয়নবের সাথে বিয়ের সময় পর্দার আয়াত নাযিল হয় এবং পর্দা প্রথার প্রচলন

৬. একমাত্র যয়নবের বিয়েতেই আঁকজমকপূর্ণভাবে অলিমা অনুষ্ঠান করা হয়। ও শারীরিক গঠনের দিক দিয়ে জয়নব (রা) ছিলেন ক্ষুদ্রকায় কিন্তু সুন্দরী ছিলেন। সাথে সাথে শোভন শারীরিক গঠন ছিল তার।

চরিত্র মাধুর্য

তিনি অত্যন্ত দ্বীনদার, পরহেযগার, উদার, দয়ার্দ্রচিত্ত, বিনয়ী ও সৎ স্বভাবী ছিলেন। আর তিনি ছিলেন পরিশ্রমী একজন মহিলা। তিনি হস্তশিল্পের কাজে খুবই পারদর্শী ছিলেন। তিনি নিজ হাতে রোজগার করে সংসার চালাতেন। তার পরহেযগারিতার ব্যাপারে রাসূল (ﷺ)-এর সাক্ষ্য পাওয়া যায়। একবার সাহাবীদের মধ্যে রাসূল (ﷺ) কিছু মাল বিতরণ করছিলেন। কিন্তু স্ত্রী যয়নবের পরামর্শক্রমে তা কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ রাখেন। এতে ওমর (রা) রাগ করে যয়নবকে ধমক দিলে রাসূল বলেন, ‘ওমর! যয়নবকে কিছু বললো না। সে খুবই আল্লাহ ভীরু ও ইবাদতের সময় ক্রন্দনশীলা।’

একবার ওমর (রা) বায়তুল মাল থেকে যয়নবকে এক বছরের খরচ পাঠিয়ে দেন। যয়নব (রা)-এর সামান্য অংশ একটি চাদরে ঢেকে রেখে বাকী সমস্ত কিছু গরীব মিসকীনদের মধ্যে বণ্টন করে দেয়ার জন্য পরিচারিকাকে নির্দেশ দেন। এ সময় পরিচারিকা আরজ করলেন, আম্মাজান! গরীবদের মাঝে আমিও একজন। সুতরাং এ মাল থেকে আমিও কিছু পেতে পারি। বিবি যয়নব বললেন, চাদরে ঢাকা যা আছে সবই তোমার, বাকীগুলো তুমি দান করে দাও।’ সব কিছু দান করার পর তিনি মহান রাব্বল আলামীনের উদ্দেশ্যে আরজ করলেন, ইয়া রাব্বাল আলামীন! বায়তুল মাল থেকে দান যেন আর আমাকে গ্রহণ করতে না হয়। তাঁর এ মুনাজাত কবুল হয় অর্থাৎ ঐ বছরেই তিনি। ইন্তেকাল করেন।

স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য

যয়নব বিনতে জাহাশ (রা) ছিলেন আত্মমর্যাদা সম্পন্না মহিলা। মুহাম্মদ ইবনে ওমর বর্ণনা করেন যে, একদিন যয়নব (রা) নবীজীকে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি আপনার অন্য স্ত্রীদের মত নই। তাদের মধ্যে একজনও এমন নেই, যার বিয়ে পিতা-ভাই বা বংশের অন্য কারো অভিভাবকত্বে সম্পন্ন হয়নি। একমাত্র আমিই ব্যতিক্রম। আল্লাহ তা’আলা আমাকে আসমান থেকে আপনার স্ত্রী করেছেন। আয়েশা (রা) বলেছেন,

مارايت امرأة تطفي الدين من زيت.

‘আমি দ্বীনের ব্যাপারে যয়নব (রা) থেকে উত্তম কোনো মহিলা দেখিনি।’ (আল-ইসতীয়ব-২/৭৫৪)

মূসা ইবনে তারেক যয়নব (রা) সম্পর্কে আয়েশা (রা) থেকে উদ্ধৃত করে বলেন, দ্বীনদারী, তাকওয়া, সত্যবাদিতা, আত্মীয়-স্বজনদের প্রতি সহানুভূতি, দানশীলতা এবং আত্মত্যাগে তার চেয়ে উত্তম মহিলা আর কেউ ছিল না। আয়েশা (রা) তাঁর সম্বন্ধে আরও বলেছেন, আল্লাহ তা’আলা যয়নব বিনতে জাহাশের প্রতি রহম করুন। সত্যি দুনিয়ায় তিনি অনন্য মর্যাদা লাভ করেছেন। আল্লাহ তা’আলা স্বীয় নবীর সাথে তাকে বিয়ে দিয়েছেন এবং তার প্রসঙ্গে কুরআনের আয়াত নাযিল হয়েছে। তাঁর সম্বন্ধে উম্মু সালামা (রা) বলেন,

وام . گائن صالح صوام

“তিনি ছিলেন অতি নেককার, অধিক সিয়াম পালনকারী এবং অতি ইবাদতকারী।

হাদীস শিক্ষা ও সম্প্রসারণে তাঁর অবদান

যয়নব বিনতে জাহাশ (রা) মর্যাদা সম্পন্ন মহিলা সাহাবী ছিলেন। বিভিন্ন কর্মের পাশাপাশি তিনি অল্প পরিমাণে হলেও নবীন থেকে হাদীস শিক্ষা ও তা বর্ণনা কার্যেও অবদান রেখেছেন। তিনি রাসূলুল্লাহর থেকে ১১টি হাদীস বর্ণনা করেছেন। ইবনে হাজার (র) আল-ইসাবা গ্রন্থে উল্লেখ করেন যে, যয়নব (রা) নবী থেকে কতিপয় হাদীস বর্ণনা করেছেন। হাদীস পুনরুক্তিসহ বুখারীতে ৫টি, মুসলিমে ৩টি, তিরমিযীতে ২টি, আবু দাউদে ২টি, নাসাঈতে ২টি ও ইবনে মাজায় ২টি সংকলিত হয়েছে।

তার থেকে বর্ণিত হাদীসের কয়েকটি নিম্নে উল্লেখ করা হলো –

1. عن زينب بنت جحشي (رض) انها قالت : اشتبنظ النبى و من النوم خمرا وجهه يقول : لا إله إلا الله ويل للعرب من شر قد اقترب تتح اليوم من ردم يأجوج ومأجوج مثل هذه وقد ثبان تسعين أو مائة . قبل : أنهي وفينا الصالحون ؛ قال : نعم إذا تم البث.

১. যয়নব বিনত জাহাশ (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন : নবী একদা রক্তিম বর্ণের চেহারা নিয়ে ঘুম থেকে জেগে উঠলেন। তিনি বললেন : আল্লাহ ছাড়া কোন উপাস্য নেই। আরবদের জন্য বিপদ সমাগত। ইয়াজুজ-মাজুজ এর প্রাচীরের দ্রি আজ এ পর্যন্ত উন্মুক্ত করে ফেলা হয়েছে (বর্ণনাকারী সুফিয়ান) তার হাতের আঙ্গুল দিয়ে ৯০ বা ১০০-এর আকৃতি করে দেখালেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে জিজ্ঞেস করা হলো- আমরাও কি ধ্বংস হয়ে যাবো অথচ আমাদের মাঝে পুণ্যবানগণ রয়েছে? নবী বলেলেন : হ্যা, যখন অন্যায় অধিক হবে, তোমরাও ধ্বংস হয়ে যাবে। (মুসলিম, ২য় খণ্ড, পৃ-৩৮৮)

أنا ۲. عن زينب بنت جحش (رض) قالت : ل للنبي مشتاض قال : تجس ايام اثراها ثم تي تي الظهر وتعجل التضر وتغتسل وتوتاتور العشاء وتغتسل منهما مبقاء المغرب و وتغتسل للنجر.

২. যয়নব বিনত জাহাশ (রা) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন : আমি নবী কে বললাম, যে, আমি ইস্তিহাযা (অনিয়ন্ত্রিত স্রাব)-এ আক্রান্ত। নবী বললেন : তুমি তোমার পূর্ব নির্ধারিত হায়যের দিনগুলোতে অপেক্ষা করবে। অতঃপর গোসল করে যোহরকে কে বিলম্ব করত আসরকে তাড়াতাড়ি করবে। অতঃপর গোসল করে উভয় ওয়াক্ত সালাত পড়বে। অনুরূপ মাগরিব কে বিলম্ব করে এশা কে এগিয়ে এসে গোসল করে উভয় সালাত একত্রে পড়বে। আর ফজরের জন্যও আলাদা গোসল করবে। (সুনানে নাসাই ১ম খণ্ড পৃ.-৬৫-৬৬)।

3. عن زينب بنت جحشي (رضی) أنه كان لها خضب بن فيه. صفر . قالت : گشت ارجل راست رسول الله

৩. যয়নব বিনত জাহাশ (রা) হতে বর্ণিত। তার হলুদ রঙের একটি চিরুনী ছিল যা দ্বারা তিনি রাসূল (ﷺ)-এর মাথা চিরুনী করে দিতেন। (সুনান ইবনে মাজাহ)।

৪. যয়নব বিনতে আবু সালাম (রা) বলেন : তিনি যয়নাব বিনত জাহাশের (রা) নিকট আসলে তিনি বললেন : আমি রাসূলুল্লাহকে মিম্বারে দাঁড়িয়ে বলতে শুনেছি তিনি বলেছেন, আত্মাহ ও পরকালে বিশ্বাসী কোন নারীর জন্য বৈধ নয় মৃত ব্যক্তির জন্য তিন দিনের অধিক শোক প্রকাশ করা। তবে স্বামীর মৃত্যুতে স্ত্রী চার মাস দশ দিন শোক পালন করতে পারে। তাঁর থেকে হাদীস বর্ণনাকারীদের মধ্যে ছিলেন মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল্লাহ ইবন জাহাশ (তার ভ্রাতুস্পুত্র), উম্মু হাবীবা বিনতে আবু সুফিয়ান, যয়নব বিনতে আবু সালামা, কুলছুম বিনতুল মুসতালাক (র) প্রমুখ সাহাবী ও তাবেঈদের নাম সবিশেষ উল্লেখযোগ্য।

ওফাত

হিজরী ২০ সালে ওমর (রা)-এর শাসন আমলে ৫৩ বছর বয়সে তিনি ইন্তেকাল করেন। ইন্তেকালের সময় শুধু একটি মাত্র গৃহ ছাড়া আর কিছুই ছিল। তার স্মৃতি চিহ্ন এ গৃহটি উমাইয়া খলীফা ওয়ালীদ ইবনে আবদুল মালেক ৫০ হাজার দিরহামের বিনিময়ে তার আত্মীয়-স্বজনের নিকট থেকে ক্রয় করে মসজিদে নববীর আন্তর্ভুক্ত করেন। মৃত্যুর পূর্বে তিনি তার কাফনের কাপড় তৈরি করে যান। এ ব্যাপারে তিনি অসিয়ত করেন যে, ওমর আমার জন্য কাপড় পাঠাতে পারে। এমন হলে এক প্রস্থ কাপড় ছদকা করে দেবে।’ তার অসিয়ত অনুযায়ী রাসূলে করীম (ﷺ) – এর খাটে করে তাকে দাফন করতে নিয়ে যাওয়া হয়। এ খাটে করে আবু বকর (রা)-এর লাশও বহন করা হয়। তবে আবূ বকর (রা)-এর পর যাদের লাশ বহন করা হয়, তাদের মধ্যে যয়নব (রা) ছিলেন প্রথম মহিলা।

ওমর (রা)-এর নির্দেশে মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে জাহাশ, উসামা ইবনে যায়েদ, আবদুল্লাহ ইবনে আবু আহমদ ইবনে জাহাশ এবং মুহাম্মদ ইবনে তালহা তার লাশ কবরে নামান। এঁরা সবাই ছিলেন যয়নব (রা)-এর নিকটাত্মীয়। আয়েশা (রা) তাঁর মৃত্যুতে শোকাহত হয়ে বলেছিলেন, ‘ভাগ্যবতী অনন্য মহিলা বিদায় নিয়েছেন। এতীমরা হয়ে পড়েছে অস্থির ব্যাকুল। তিনি ছিলেন এতীমদের আশ্রয়স্থল। ওমর (রা) তার জানাযার সালাত পড়ান। তাকে জান্নাতুল বাকীতে দাফন করা হয়। আকীল এবং হানাফিয়ার কবরের মধ্যস্থলে তার কবরের অবস্থান। তার দাফন করার দিন প্রচণ্ড গরম পড়েছিল। এজন্য ওমর (রা) সেখানে তাঁবু গাড়েন। জানা যায় কবর খননের জন্য জান্নাতুল বাকীতে এটা ছিল প্রথম তাবু।

সকল অধ্যায়

১. ১. উম্মুল মু’মিনীন খাদীজা (রা)
২. ২. উম্মুল মু’মিনীন আয়েশা (রা)
৩. ৩. উম্মুল মুমিনীন হাফসা (রা)
৪. ৪. মারইয়াম (আ)
৫. ৫. আছিয়া (আ)
৬. ৬. উম্মু সুলাইম (রা)
৭. ৭. যয়নব বিনত রাসূলুল্লাহ
৮. ৮. রুকাইয়া বিনত মুহাম্মদ
৯. ৯. উম্মু কুলছুম বিনত নবী করীম (ﷺ)
১০. ১০. ফাতিমা বিনত রাসূলিল্লাহ
১১. ১১. সুমাইয়া (রা)
১২. ১২. উম্মুল মুমিনীন সাদা বিনতে যামআ (রা)
১৩. ১৩. উম্মুল মুমিনীন যয়নব বিনতে খুযাইমা (রা)
১৪. ১৪. উম্মুল মু’মিনীন উম্মু সালামা (রা)
১৫. ১৫. উম্মুল মুমিনীন যয়নব বিনতে জাহাশ (রা)
১৬. ১৬. উম্মুল মু’মিনীন জুয়াইরিয়া (রা)
১৭. ১৭. উম্মুল মুমিনীন উম্মু হাবীবা (রা)
১৮. ১৮. উম্মুল মু’মিনীন সফিয়্যা (রা)
১৯. ১৯. উম্মুল মুমিনীন মায়মূনা (রা)
২০. ২০. উম্মুল মুমিনীন রায়হানা (রা)
২১. ২১. উম্মুল মু’মিনীন মারিয়া কিবতিয়া (রা)
২২. ২২. হালীমা (রা)
২৩. নবী করীম (ﷺ)-এর বহু বিবাহের সমালোচনার প্রতিবাদ

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন