৭. যয়নব বিনত রাসূলুল্লাহ
পরিচিতি
নবী করীম (ﷺ)-এর কন্যা সায়িদা যয়নব (রা) যিনি আল্লাহর রাস্তায় শাহাদাত বরণ করেন। উম্মুল মু’মিনীন আয়েশা (রা) তার প্রসঙ্গে নবী করীম (ﷺ)-এর বাণী উল্লেখ করেছেন
“সে ছিল আমার সবচেয়ে ভালো কন্যা। আমাকে ভালোবাসার কারণেই তাকে কষ্ট পেতে হয়েছে।” (হায়াতুস সাহাবা-১/৩৭২) ।
যয়নবের (রা) সম্মানিতা মা উম্মুল মু’মিনীন খাদীজাতুল কুবরা (রা)। যিনি মুহাম্মদ (ﷺ)-এর রিসালাতের প্রতি সর্বপ্রথম ঈমান আনার (বিশ্বাস স্থাপনের) অনন্য গৌরবের অধিকারীনী। তার মহত্ত্ব ও মর্যাদা এত বিশাল যে, বিগত সমূহের নারীদের মধ্যে কেবল মারইয়ামের (আ) সাথে যা তুলনীয়। ইমাম আজ-জাহাবী বলেন
زینب بنت رسول الله واكب أخوانها من المهاجرات
“যয়নব হলেন নবী করীম (ﷺ)-এর মেয়ে এবং তার হিজরতকারিণী সায়্যিদাত বোনদের মধ্যে সকলে বড়।” (সিয়ারু আ’লাম আন-নুবালা-২/২৪৬)
আবু আমর বলেন, যয়নব (রা) তাঁর পিতার কন্যাদের মধ্যে জ্যেষ্ঠ। এ বিষয়ে কোন মতপার্থক্য নেই। আর যারা ভিন্নমত পোষণ করেন তারা ভুলের মধ্যে আছেন। তাদের দাবীর প্রতি গুরুত্ব প্রদানের কোন হেতু নেই। তবে মতপার্থক্য যে বিষয়ে আছে তা হলো, নবী করীম (ﷺ)-এর ছেলে মেয়েদের মধ্যে যয়নব প্রথম সন্তান, না কাসিম? বংশবিদ্যা বিশারদদের একটি দলের মতে আল কাসিম প্রথম ও যয়নব দ্বিতীয় সন্তান। ইবনুল কালবী যয়নব (রা)-কে প্রথম সন্তান বলেছেন। ইবনে সা’দের মতে, যয়নব (রা) কন্যাদের মধ্যে সবার বড়। ইবন হিশাম নবী করীম (ﷺ)-এর সন্তানদের ধারাবাহিকতা এভাবে সাজিয়েছেন
أكبر بيبو القاسم، ثم الطب، ثم الطاه، وائبر بتانه ، ثم زينب، ثم أم كلثوم، ثم اطمه.
“নবী করীম (ﷺ)-এর বড় ছেলে আল কাসিম, তারপর যথাক্রমে আত-তায়্যিব ও আত- তাহির। আর বড় কন্যা রুকাইয়া, তারপর যথাক্রমে যয়নব, উষ্ম কুলসুম ও ফাতিমা।” (আস্-সীরাতুন নাবাবিয়্যা-১১৯০)। পিতা মুহাম্মদ (ﷺ)-এর নবুওয়াত প্রাপ্তির দশ বছর পূর্বে যয়নব (রা)-এর জন্ম হয়। তখন নবী করীম (ﷺ)-এর বয়স ত্রিশ এবং মা খাদীজা (রা)-এর পঁয়তাল্লিশ বছর। যয়নব (রা)-এর শৈশব জীবনের তেমন কোন তথ্য পাওয়া যায় না। তারও জীবনটি সম্পূর্ণ অন্ধকারেই রয়ে গেছে। তার জীবন প্রসঙ্গে যতটুকু জানা যায় তা তার বিয়ের সময় থেকে।
বিবাহ
নবী করীম (ﷺ) -এর কন্যাদের মধ্যে সর্বপ্রথম যয়নব (রা)-এর বিয়ে অল্প বয়সে অনুষ্ঠিত হয়। তখনও পিতা মুহাম্মদনেবুওয়্যাত প্রাপ্ত হননি। ইমাম-আজ-জাহাবী এ মত গ্রহণ করতে পারেননি। তিনি বলেন
ذكر ابن سعد أن أبا العاصي تزوج بزينب تبل النبوة وهذا
ইবনে সা’দ উল্লেখ করেছেন যে, আবুল আস যয়নবকে আবদুল উয নবুওয়াতের পূর্বে বিয়ে করেন। এ এক অবাস্তব কথা। (সিয়ারু আ’লাম আন-নুবালা-২২৪৬)
যা হোক স্বামী আবুল আস ইবন আর-রাবী” ইবন আবদুল উয্যা ছিলেন যয়নবের খালাতো ভাই। মা বাদীজা (রা)-এর আপন ছোট বোন হালা বিত খুওয়াইলিদের সন্তান।
বিয়ের সময় মা খাদীজা (রা)-এর উপহার
বিয়ের সময় বাবা-মা কন্যাকে যে সকল উপহার সামগ্রী দিয়েছিলেন তার মধ্যে ইয়ামেনী আকীকের একটি হারও ও ছিল। হারটি দিয়েছিলেন মা খাদীজা (রা)। পিতা মুহাম্মদ ওহী লাভ করে নবী হলেন। কন্যা যয়নব (রা) তার মার সাথে মুসলমান হলেন।
স্বামী আবুল আসের ইসলাম গ্রহণ না করা
স্বামী আবুল আস তখন ইসলাম গ্রহণ করেননি। নবী করীম (ﷺ) মদীনায় হিজরত করলেন। পরে যয়নব (রা) স্বামীকে মুশরিক অবস্থায় মক্কায় রেখে মদীনায় হিজরত করেন। নবী করীম (ﷺ) ময়নব (রা) ও আবুল আসের মধ্যে গভীর সম্পর্ক এবং ভদ্রোচিত কর্মপদ্ধতির প্রায়ই প্রশংসা করতেন। আবুল আস যেহেতু শিরকের ওপর স্থির ছিলেন, এ কারণে ইসলামের বিধান অনুযায়ী উচিত ছিল, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটিয়ে দেয়া। কিন্তু নবী করীম (ﷺ) মক্কায় সে সময় শক্তিহীন ছিলেন। ইসলামী শক্তি তেমন শক্তিশালী ছিল না। তাছাড়া কাফিরদের জুলুম- অত্যাচারের প্লাবন সবেগে প্রবাহমান ছিল। এদিকে ইসলামের প্রচার প্রসারের গতি ছিল মহুর ও প্রাথমিক পর্যায়ের। এ সকল কারণে তাঁদের স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ না ঘটানোই নবী করীম (ﷺ) সমীচীন মনে করেন।
আবুল আস স্ত্রী যয়নব (রা)-কে খুবই ভালোবাসতেন এবং সম্মানও করতেন। কিন্তু তিনি পূর্বপুরুষের ধর্ম ত্যাগ করে প্রিয়তমা স্ত্রীর নতুন দ্বীন কবুল করতে কোনভাবেই রাজী হলেন না। এ অবস্থা চলতে লাগলো। এদিকে নবী করীম (ﷺ) ও কুরাইশদের মধ্যে মারাত্মক দ্বন্দ ও সংঘাত আরম্ভ হয়ে গেল। কুরাইশরা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করতে লাগলো; তোমাদের সর্বনাশ হোক! তোমরা মুহাম্মাদের কন্যাদের বিয়ে করে তার দুশ্চিন্তা নিজেদের ঘাড়ে তুলে নিয়েছে। তোমরা যদি এ সকল কন্যাকে তার নিকট ফেরত পাঠাতে তাহলে সে তোমাদের ছেড়ে তাদেরকে নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়তো। তাদের মধ্যে অনেকে এ কথা সমর্থন করে বললো- এ তো অতি চমৎকার যুক্তি। তারা দল বেধে আবুল আসের নিকট গমন করে বললো, আবুল আস, তুমি তোমার স্ত্রীকে তালাক দিয়ে তার পিতার নিকট পাঠিয়ে দাও। তার পরিবর্তে তুমি যে কুরাইশ সুন্দরীকে চাও, আমরা তাকে তোমার সাথে বিয়ে দেব। আবুল আস বললেন, আল্লাহর কসম! না তা হয়না। আমার স্ত্রীকে আমি ত্যাগ করতে পারিনা। তার পরিবর্তে সমস্ত মহিলা আমাকে দিলেও আমার তা পছন্দ নয়। এ কারণে রাসূল তার আত্মীয়তাকে খুব ভালো মনে করতেন এবং প্রশংসা করতেন। যয়নব (রা) স্বামী আবুল আসকে গভীরভাবে ভালোবাসতেন। স্বামীর প্রতি তার ভালোবাসা ও ত্যাগের অবস্থা নিম্নের ঘটনা দ্বারা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
নবুওয়্যাতের ১৩ তম বছরে নবী করীম (ﷺ) মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করেন। যয়নব (রা) স্বামীর সাথে মক্কায় থেকে যান। কুরাইশদের সাথে মদীনার মুসলমানদের সামরিক সংঘাত আরম্ভ হলো। কুরাইশরা মুসলমানদের সাথে যুদ্ধের উদ্দেশ্যে বদরে একত্রিত হলো। নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও আবুল আস কুরাইশদের সাথে বদরে গেলেন। কারণ, কুরাইশদের মধ্যে তার যে স্থান তাতে গমন করে কোন উপায় ছিল না।
বদরের বন্দীদের সাথে আবুল আস
বদরে কুরাইশরা শোচনীয় পরাজয় বরণ করে। তাদের বেশ কিছু নেতা নিহত হয় এবং বহু সংখ্যক যোদ্ধা বন্দী হয়। আর বাকীরা পালিয়ে প্রাণ বাঁচায়। ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস! এ বন্দীদের মধ্যে নবী করীম (ﷺ) জামাই যয়নব (রা)-এর স্বামী আবুল আসও ছিলেন। ইবন ইসহাক বলেন, আবদুল্লাহ ইবন যুবাইর ইবন নু’মান (রা) তাকে বন্দী করেন। তবে আল ওয়াকিদীর মতে ব্রিাশ ইন আস- সাম্মাহর (রা) হাতে তিনি বন্দী হন।
বদরের বন্দীদের মুক্তিপণ
বদরের বন্দীদের প্রসঙ্গে মুসলমানদের সিদ্ধান্ত হলো, মুক্তিপণ নিয়ে ছেড়ে দেয়া হবে। বন্দীদের সামাজিক মর্যাদা এবং ধনী-গরীব প্রভেদ অনুযায়ী এক হাজার থেকে চার হাজার দিরহাম মুক্তিপণ নির্ধারিত হলো। বন্দীদের প্রতিনিধিরা ধার্যকৃত মুক্তিপণ নিয়ে মক্কা-মদীনা ছুটাছুটি আরম্ভ করে দিল। নবী দুহিতা যয়নব (রা) স্বামী আবুল ‘আসের মুক্তিপণসহ মদীনায় লোক পাঠালেন।
আবুল আসের মুক্তিপণ
আল-ওয়াকিদীর মতে আকুল আসের মুক্তিপণ নিয়ে মদীনায় আগমন করেছিল তার ভাই আমর ইবন রাবী। যয়নব মুক্তিপণ দিরহামের বদলে একটি হার প্রেরণ করেছিলেন। এ হারটি তার মা খাদীজা (রা) বিয়ের সময় তাকে উপহার দিয়েছিলেন। নবী করীম (ﷺ) হারটি দেখেই বিমর্ষ হয়ে পড়লেন এবং নিজের বিষন্ন মুখটি একখানা পাতলা বস্ত্র দিয়ে ঢেকে ফেললেন। জান্নাতবাসিনী প্রিয়তমা স্ত্রী ও অতি আদরের কন্যার স্মৃতি তার মানসপটে ভেসে উঠেছিল। কিছুক্ষণ পর নবী করীম (ﷺ) সাহাবীদের লক্ষ্য করে বললেন: যয়নব তার স্বামীর মুক্তিপণ হিসেবে এ হারটি প্রেরণ করেছে। তোমরা ইচ্ছে করলে তার বন্দীকে ছেড়ে দিতে পার এবং হারটিও তাকে ফেরত দিতে পার। সাহাবীরা বললেন : হে আল্লাহর রাসূল! আপনার সন্তুষ্টির জন্য আমরা তাই করবো। সাহাবীরা রাজী হয়ে গেলেন। তাঁরা আবুল আসকে মুক্তি দিলেন, আর সে সাথে ফেরত দিলেন তার মুক্তিপণের হারটি। তবে নবী করীম (ﷺ) যয়নবকে মদীনায় পাঠিয়ে দিলেন।
নবী করীম (ﷺ) যয়নব (রা)-কে নেওয়ার জন্য আবুল আসের সংঙ্গে যায়েদ ইবনে হারিছাকে (রা) প্রেরণ করেন। তাকে বাতান” অথবা “জাজ” নামক স্থানে অপেক্ষা করতে বলেন! যয়নব (রা) মক্কা থেকে সেখানে পৌছলে তাকে নিয়ে মদীনায় চলে আসতে বলেন। আবুল আস মক্কায় পৌছে যয়নব (রা)-কে মদীনায় যাওয়ার অনুমতি দেন। যয়নব (রা) সফরের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত আছেন, এমন সময় হিন্দ বিনত উতবা এসে উপস্থিত হলো। প্রস্তুতি দেখে বললো : মুহাম্মাদের কন্যা, তুমি কি তোমার বাবার নিকট যাচ্ছে? যয়নব (রা) বললেন, এ মুহুর্তে তো তেমন উদ্দেশ্য নেই, তবে ভবিষ্যতে আল্লাহর যা ইচ্ছা হয়। হিন্দ বিষয়টি বুঝতে পেরে বললো : বোন, এটা গোপন করার কি আছে। সত্যিই যদি তুমি যাও, তাহলে পথে দরকার পড়ে এমন কোন কিছু দরকার হলে রাগ না রেখে বলে ফেলতে পার, আমি তোমার খিদমতের জন্য প্রস্তুত আছি। নারীদের মধ্যে শত্রুতার সে বিষাক্ত প্রভাব তখনও বিস্তার লাভ করেনি যা পুরুষদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল। এ কারণে যয়নব (রা) বলেন ; হিন্দ যা বলেছিল, অন্তরের কথাই বলেছিল। অর্থাৎ আমার যদি কোন জিনিসের দরকার হতো, তাহলে অবশ্যই সে তা পূরণ করতো। কিন্তু সে সময়ের অবস্থা চিন্তা করে আমি অস্বীকার করি।
যয়নব (রা) কিভাবে মক্কা থেকে মদীনায় পৌছেন সে বিষয়ে সীরাতের গ্রন্থসমূহের বিভিন্ন রকম বর্ণনা পাওয়া যায়। এখানে কতিপয় উল্লেখ করা হলো : ইবন ইসহাক বলেন, সফরের প্রস্তুতি শেষ হলে যয়নব (রা)-এর দেবর কিনানা ইবন রাবী একটি উট এনে দাঁড় করালো। যয়নব উটের পিঠের হাওদায় উঠে বসলেন। আর কিনানা নিজের ধনুকটি কাঁধে ঝুলিয়ে তীরের আটিটি হাতে নিয়ে দিনে দুপুরে উট হাঁকিয়ে অদূরে জী-তুয়া উপত্যকায় তাদের দু জনকে ধরে ফেললো । কিনানা কুরাইশদের আচরণে ক্ষিপ্ত হয়ে কাঁধের ধনুকটি হাতে নিয়ে তীরের ধমকি শ্রবণ করে সামনে ছড়িয়ে দিয়ে বললো : তোমাদের কেউ যয়নবের নিকটে যাওয়ার চেষ্টা করলে তার সিনা হবে আমার তীরের লক্ষ্যস্থল। কিনা ছিল একজন দক্ষ তীরন্দাজ। তার নিক্ষিপ্ত কোন তীর সচরাচর লক্ষ্যভ্রষ্ট হতে। তার এ হুমকি আবু সুফইয়ান ইবন হারব শ্রবণ করে তার দিকে একটু এগিয়ে গিয়ে বললো
‘ভাতিজা, তুমি যে তীরটি আমাদের দিকে তাক করে রেখেছে তা একটু ফিও। আমরা তোমার সাথে একটু আলাপ করতে চাই। কিনানা তীরটি নামিয়ে বললো, কি বলতে চান, বলে ফেলুন। আবু সুফইয়ান বললো : তোমার কাজটি ঠিক হয়নি। তুমি প্রকাশ্যে দিনে দুপুরে মানুষের সামনে দিয়ে যয়নবকে নিয়ে বের হয়েছে, আর আমরা বসে বসে তা দেখছি। গোটা আরববাসী জানে বদরে আমাদের কী অবস্থা হয়েছিল এবং যয়নবের বাপ আমাদের কী সর্বনাশটাই না করেছে। তুমি যদি এভাবে প্রকাশ্যে তার কন্যাকে আমাদের নাকের উপর দিয়ে নিয়ে যাও তাহলে সবাই আমাদেরকে কাপুরুষ ধারণা করবে এবং এ কাজটি আমাদের জন্য অপমান বলে বিবেচনা করবে। তুমি আজ যয়নবকে বাড়ী ফিরিয়ে নিয়ে যাও। কিছুদিন সে স্বামীর ঘরে থাকুক। এ দিকে জনগণ যখন বলতে শুরু করবে যে, আমরা যয়নবকে মক্কা থেকে যেতে বাধা দিয়েছি, তখন একদিন তুমি গোপনে তাকে তার বাবার নিকট পৌছে দিও। কিনানা আবু সুফিয়ানের কথা মেনে নিয়ে যয়নবসহ মক্কায় ফিরে এল। যখন ঘটনাটি মানুষের মধ্যে জানাজানি হয়ে গেল, তখন একদিন রাতের অন্ধকারে সে আবার যয়নবকে নিয়ে মক্কা থেকে বের হলো এবং ভাইয়ের নির্দেশ মত নির্দিষ্ট স্থানে তাকে তার পিতার প্রতিনিধির হাতে তুলে দিল। যয়নব (রা) যায়েদ ইবন হারিছা (রা) সাথে মদীনায় পৌছলেন। তাবারানী উরওয়া ইবন যুবাইর থেকে বর্ণনা করেছেন।
এক ব্যক্তি যয়নব বিন্ত নবী করীম (ﷺ)-কে সাথে নিয়ে মক্কা থেকে বের হলে কুরাইশদের দুই ব্যক্তি পিছু ধাওয়া করে তাদের ধরে ফেলে। তারা যয়নব (রা)-এর সংগী লোকটিকে কাবু করে যয়নব (রা)-কে উটের পিঠ থেকে ফেলে দেয়। তিনি একটি পাথরের উপর ছিটকে পড়লে দেহ ফেটে রক্ত বের হয়ে যায়। এ অবস্থায় তারা যয়নব (রা)-কে মক্কায় আবু সুফিয়ানের নিকট নিয়ে যায়। আবু সুফিয়ান তাকে বনী হাশিমের কন্যাদের নিকট সোপর্দ করে। পরে তিনি মদীনায় হিজরত করেন। উঠের পিঠ থেকে ফেলে দেয়ায় তিনি যে আঘাত পান, আমরণ সেখানে ব্যথা অনুভব করতেন এবং সে ব্যথায় শেষ পর্যন্ত মৃত্যুবরণ করেন। এজন্য তাঁকে শহীদ মনে করা হতো। আয়েশা (রা) বর্ণনা করেছেন।
নবী করীম (ﷺ)-এর কন্যা যয়নব কিনানার সাথে মক্কা থেকে মদীনার উদ্দেশ্যে বের হলো। মক্কাবাসীরা তাদের পিছু ধাওয়া করলো। হাব্বার ইবনুল আসওয়াদ সর্বপ্রথম যয়নবকে ধরে ফেললো। সে যয়নবের উটটি তীরবিদ্ধ করলে সে পড়ে গিয়ে আঘাত পেল। সে সন্তান সম্ভবা ছিল। এ আঘাতে তার গর্ভের সন্তানটি নষ্ট হয়ে যায়। অতঃপর বনু হাশিম ও বনু উমাইয়া তাকে নিয়ে বিবাদ আরম্ভ করে দিল। অবশেষে সে হিন্দু বিন্ত উতবার নিকট থাকতে লাগলো। হিন্দ প্রায়ই তাকে বলতো, তোমার এ বিপদ তোমার বাবার জন্যেই হয়েছে। একদিন নবী করীম (ﷺ) যায়েদ ইবন হারিছাকে বললেন, তুমি কি যয়নবকে আনতে পারবে? যায়েদ রাজি হলো। নবী করীম (ﷺ) যায়েদকে একটি আংটি দিয়ে বললেন, এটা নিয়ে যাও, যয়নবের নিকট পৌছাবে। “আংটি নিয়ে যায়েদ মক্কার দিকে চললো। মক্কার উপকণ্ঠে সে এক রাখালকে ছাগল চরাতে দেখলো । সে তাকে জিজ্ঞেস করলো, তুমি কার রাখাল? বললো, “আবুল ‘আসের”। আবার জিজ্ঞেস করলো, ছাগলগুলো কার? বললো, যয়নব বিনতে মুহাম্মাদের। যায়েদ কিছু দূর রাখালের সাথে চললো। তারপর তাকে বললো, আমি যদি একটি জিনিস তোমাকে দেই, তুমি তা যয়নবের নিকট পৌছে দিতে পারবে? রাখাল রাজি হলো। যায়েদ তাকে আংটিটি দিল, আর রাখাল সেটি যয়নবের হাতে পৌছে দিল। সেই দু ব্যক্তির একজন হাব্বার ইবন আল-আসওয়াদ। সে ছিল খাদীজার (রা) চাচাতো ভাইয়ের ছেলে। তাই সম্পর্কের দিক থেকে সে যয়নবের মামাতো ভাই। আর দ্বিতীয়জন হিল নাফে ইবন আবদি কায়েস অথবা খালিদ ইবন আবদি কায়েস। তাদের এমন অহেতুক বাড়াবাড়িমূলক আচরণের জন্য নবী করীম (ﷺ) ভীষণ বিরক্ত হন। তাই তিনি নির্দেশ দেন।
ان ظقثم بهار بن الأسود والرجل الذي سبق معه الى
যদি তোমরা হাববার ইবন আল- আসওয়াদ ও সে ব্যক্তিটি যে তার সাথে যয়নবের দিকে এগিয়ে যায়, হাতের মুঠোয় পাও, তাহলে তাকে আগুনে পুড়িয়ে ফেল। কিন্তু পরদিন তিনি আবার বলেন
اني كنت آمركم بتعريق فديين الرجليني إن أخذموما، ثم رايت انه لا ينبغي لأحد أن يعب بالنار الا الله، نان ظفرتم
“আমি তোমাদেরকে বলেছিলাম, যদি তোমরা এ দু ব্যক্তিকে ধরতে পার,আগুনে পুড়িয়ে মারবে। কিন্তু পরে আমি ভেবে দেখলাম এক আল্লাহ ব্যতীত আর কারো জন্য কাউকে আগুন দিয়ে শাস্তি দেয়া উচিত নয়। তাই তোমরা যদি তাদেরকে ধরতে পার, হত্যা করবে। কিন্তু পরে তারা মুসলমান হয় এবং নবী করীম (ﷺ) তাদেরকে ক্ষমা করে দেন। (বুখারী, কিতাবুল জিহাদ বাবু লা ইউয়াজ্জাৰু বিভাজবিল্লাহ ; আল- ইসাবা: হবার ইবন আল- আসওয়াদ ৩য় খণ্ড; আনসাবুল আশরাফ – ১/৩৫৫৭,৩৯৮, সিয়ারু আললাম আন-নুবালা-২/২৪৭, ইবন হিশাম- ১/৫৭)
যয়নব (রা) রাখালকে জিজ্ঞেস করলো, তোমাকে এটি কে দিয়েছে বললো, একটি লোক। আবার জিজ্ঞেস করলো, তাকে কোথায় ছেড়ে এসেছো? বললো, তুমি আমার উটের পিঠে আমার সামনে বস।’ যয়নব বললো, না, আপনিই আমার সামনে বসুন। এভাবে যয়নব যায়েদের (রা) পিছনে বসে মদীনায় পৌছলেন। নবী করীম (ﷺ) প্রায়ই বলতেন, আমার সবেচেয়ে উত্তম কন্যাটি আমার জন্যই কষ্ট ভোগ করেছে। সীরাতের গ্রন্থসমূহে যয়নব (রা)-এর মক্কা থেকে মদীনা পৌছার ঘটনাটি একাধিক সূত্রে পৃথকভাবে বর্ণিত হতে দেখা যায়। যেহেতু তাদের দুজনের মধ্যের সম্পর্ক অতি চমক্কার ছিল, এ কারণে যয়নব (রা)-এর মদীনায় চলে যাওয়ার পর আবুল আস অধিকাংশ সময় খুবই বিমর্ষ থাকতেন। একবার তিনি যখন সিরিয়া সফরে ছিলেন তখন যয়নব (রা)-এর কথা স্মরণ করে নিজের পংক্তি দুটি আওড়াতে থাকেন ।
ذكرت تب لما ورگت آزما + قلت سقيا لشخص يسكن الرما۔ بنت الأميين جزاها الله صالح + وكل بثل بثنى بالذي علما .
“যখন আমি “আমি” নামক স্থানটি পার হলাম তখন যয়নবের কথা মনে হলো। বললাম, আল্লাহ তা’আলা ঐ ব্যক্তিকে সজীব রাখুন যে হারামে বসবাস করছেন। আমীন মুহাম্মদের কন্যাকে আল্লাহ তা’আলা উত্তম প্রতিদান দিন। আর প্রত্যেক স্বামী সে কথার প্রশংসা করে যা তার ভালো জানা আছে।” (তাবাকাত-৮/৩২; আনসাবুল আশরাফ-১৩৯৮)
মক্কার কুরাইশদের যে বিশেষ গুণের কথা কুরআনে ঘোষিত হয়েছে শীতকালে ইয়ামেনের দিকে এবং গ্রীষ্মকালে শামের দিকে তাদের বাণিজ্য কাফিলা গমন করে। আবুল আসের মধ্যেও এ গুণটির পূর্ণ বিকাশ ঘটেছিল। মক্কা ও শামের মধ্যে সবসময় তার বাণিজ্য কাফেলা যাতায়াত করতো। তাতে কমপক্ষে একশো উটসহ দুইশো আরোহী থাকতো। তাঁর ব্যবসায়িক বুদ্ধি, সততা ও আমানতদারিতার জন্য মানুষ তার নিকট নিজেদের পণ্যসন্সর নিশ্চিন্তে সমর্পণ করতো। ইবন ইসহাক বলেন, অর্থ-বিত্ত, আমানদতারী ও ব্যবসায়ী হিসেবে তিনি মক্কার গণমান্য মুষ্টিমেয় ব্যক্তিবর্গের অন্যতম ছিলেন। স্ত্রী যয়নব (রা) থেকে বিচ্ছেদের পর আবুল আস মক্কায় অবস্থান করতে লাগলেন। হিজরী ৬ষ্ঠ সনের জামাদি-উল আওয়াল মাসে তিনি কুরাইশদের ১৭০ উটের একটি বাণিজ্য কাফিলা নিয়ে সিরিয়া যান। বাণিজ্য শেষে মক্কায় প্রত্যাবর্তনের পথে কাফিলাটি যখন মদীনার নিকটবর্তী স্থানে তখন নবী করীম (ﷺ) সংবাদ পেলেন। তিনি এক শত সত্তর সদস্যের একটি বাহিনীসহ যায়েদ ইবন হারিছাকে (রা) প্রেরণ করলেন কাফিলাটিকে ধরার জন্য। ঈস নামক স্থানে দুটি দল মুখোমুখি হয়। মুসলিম বাহিনী কুরাইশ কাফিলার বাণিজ্য সম্ভারসহ সকল লোককে বন্দী করে মদীনায় নিয়ে যায়। তবে আবুল আসকে ধরার জন্য তারা তেমন চেষ্টা চালালো না। তিনি পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেন।
অবশ্য মূসা ইবন উকবার মতে, আবু বাশীর ও তার বাহিনী আবুল আসের কাফিলার উপর হামলা চালায়। উল্লেখ্য যে, এ আবু বাশীর ও আরও কতিপয় লোক হুদায়বিয়ার সন্ধির পর ইসলাম গ্রহণ করেন। তবে সন্ধির শর্তানুযায়ী মদীনাবাসীরা তাদের আশ্রয় দিতে অক্ষমতা প্রকাশ করে। ফলে মক্কা থেকে পালিয়ে তারা লোহিত সাগরের তীরবর্তী এলাকায় বসবাস করতে থাকেন। তাঁরা সংঘবদ্ধভাবে মক্কার বাণিজ্য কাফিলার উপর অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে লুটপাট করতে থাকেন। তারা কুরাইশদের জন্য বাধা হয়ে দাঁড়ান। তাঁদের ভয়ে কুরাইশদের ব্যবসায়-বাণিজ্য বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়।
অবশেষে মক্কার কুরাইশরা বাধ্য হয়ে তাদেরকে মদীনায় ফিরিয়ে নেয়ার জন্য নবী করীম (ﷺ)-কে অনুরোধ করে। যা হোক, আবুল আস তাঁর কাফেলার এ পরিণতি দেখে মক্কায় গমন না করে ভীত সন্ত্রস্তভাবে রাতের অন্ধকারে চুপে চুপে মদীনায় প্রবেশ করলেন এবং সোজা যয়নব (রা)-এর নিকট পৌছে আশ্রয় চাইলেন। যয়নব তাঁকে নিরাপত্তার আশ্বাস দিলেন। কেউ কিছুই জানলো না। রাত পার হলো। নবী করীম (ﷺ) সালাতের উদ্দেশ্যে মসজিদে গেলেন। তিনি মিহরাবে দাঁড়িয়ে আল্লাহু আকবার” বলে তাকবীর তাহরীমা বেঁধেছেন। পিছনের মুকতাদীরাও তাকবীর তাহরীমা শেষ করেছে। এমন সময় পিছনে মহিলাদের কাতার থেকে যয়নব (রা)-এর কণ্ঠস্বর ভেসে এলো- ওহে জনমণ্ডলী, আমি মুহাম্মদের কন্যা যয়নব। আমি আবুল আসকে নিরাপত্তা দিয়েছি, আপনারাও তাকে নিরাপত্তা দিন। “নবী করীম (ﷺ) সালাত শেষ করে লোকদের দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করলেন, আমি যা শুনেছি তোমরাও কি তা শুনছো?”
লোকেরা জবাব দিল, হ্যা, হে আল্লাহর রাসূল! রাসূল বললেন, যার হাতে আমার জীবন, সে সত্তার কসম, আমি এ ঘটনার কিছুই জানি না। কী আশ্চর্য! মুসলমানদের একজন দুর্বল সদস্যরাও শক্রকে নিরাপত্তা দেয়। সে সকল মুসলমানদের পক্ষ থেকে নিরাপত্তা দিয়েছে। অতঃপর নবী করীম (ﷺ) ঘরে গিয়ে কন্যাকে বললেন, আবুল আসের থাকার সম্মানজনক ব্যবস্থা করবে। তবে জেনে রেখ, তুমি আর তার জন্য হালাল নও। যতক্ষণ সে মুশরিক থাকবে। যয়নব (রা) পিতার নিকট আবেদন জানালেন আবুল আসের কাফিলার লোকদের অর্থসম্পদসহ মুক্তিদানের জন্য। নবী করীম (ﷺ) সে বাহিনীর লোকদের আহ্বান করলেন যারা আবুল আসের কাফিলার উট ও লোকদের ধরে নিয়ে এসেছিল। তিনি তাদের বললেন, আমার ও আবুল আসের মধ্যে যে সম্পর্ক তা তোমরা জান। তোমরা তার বাণিজ্য সম্ভার আটক করেছে। তার প্রতি সদয় হয়ে তার মালামাল ফেরত দিলে আমি আনন্দিত হবে। আর তোমরা রাজী না হলে আমার কোন আপত্তি নেই। আল্লাহর অনুগ্রহ হিসেবে তোমরা তা ভোগ করতে পার। তোমরাই সে মালের অধিক হকদার। তারা বললো, হে আত্মাহর রাসূল! আমরা তার সবকিছুই ফেরত দিচ্ছি।
আবুল আসের ইসলাম গ্রহণ
আবুল আস চললেন তাদের সাথে মালামাল বুঝে নিতে। রাস্তায় তারা আবুল আসকে বললো, শোন আবুল আস, কুরাইশদের মধ্যে তুমি একজন মর্যাদাবান ব্যক্তি। তাছাড়া তুমি নবী করীম (ﷺ)-এর চাচাতো ভাই এবং তাঁর কন্যার স্বামী। তুমি এক কাজ কর। ইসলাম গ্রহণ করে মক্কাবাসীদের এ মালামালসহ মদীনায় থেকে যাও। বেশ আরামে থাকবে। আবুল “আস বললেন, তোমরা যা বলছে তা ঠিক নয়। আমি আমার নতুন দ্বীনের জীবন আরম্ভ করবো শঠতার মাধ্যমে আবুল আস তার কাফিলা ছাড়িয়ে নিয়ে মক্কায় পৌছলেন। মক্কায় প্রত্যেকের মাল বুঝিয়ে দিয়ে তিনি বললেন, হে কুরাইশ সম্প্রদায়! আমার নিকট তোমাদের আর কোন কিছু পাওনা আছে কি? তারা বললো না। আল্লাহ তোমাকে উত্তম প্রতিদান দান করুন। আমরা তোমাকে একজন চমৎকার প্রতিশ্রুতি পালনকারী রূপে পেয়েছি। আবুল আস বললেন, আমি তোমাদের হক পূর্ণরূপে আদায় করেছি। এখন আমি ঘোষণা করছি
أشهد أن لا إله إلا الله وأن محمدا عبده ورسوله.
“আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আল্লাহ ব্যতীত কোন মাবুদ নেই এবং মুহাম্মদ তাঁর একজন বান্দা ও রাসূল।” মদীনায় অবস্থানকালে আমি এ ঘোষণা দিতে পারতাম। কিন্তু তা দেইনি এ জন্যে যে, তোমরা মনে করতে আমি তোমাদের সম্পদ আত্মসাৎ করার উদ্দেশ্যেই এমন করেছি। আল্লাহ যখন তোমাদের যার যার মাল ফেরত দানের তাওফীক আমাকে দিয়েছেন এবং আমি আমার দায়িত্ব থেকে নাজাত পেয়েছি, তখনই আমি ইসলামের ঘোষণা দিচ্ছি।’ এটি হিজরী সপ্তম সনের মুহাররম মাসের ঘটনা। এরপর আবুল আস (রা) জন্মভূমি মক্কা থেকে হিজরত করে মদীনায় নবী করীম (ﷺ)-এর খিদমতে উপস্থিত হন। নবী করীম (ﷺ) সম্মানের সাথে আবুল আসকে (রা) গ্রহণ করেন এবং তাদের বিয়ের প্রথম আকদের ভিত্তিতে স্ত্রী যয়নব (রা)-কেও তার হাতে সোপর্দ করেন। যয়নব (রা) স্বামী আবুল আসকে তাঁর পৌত্তলিক অবস্থায় মক্কায় রেখে এসেছিলেন। এ কারণে স্বাভাবিকভাবেই তাদের বিবাহ-বিচ্ছেদ ঘটেছিল বলে ধরে নেয়া যায়। পরে আবুল আস যখন ইসলাম গ্রহণ করে মদীনায় আসলেন তখন নবী করীম (ﷺ) যয়নবকে তার নিকট ফিরিয়ে দিলেন। এখন প্রশ্ন হলো, প্রথম আকদের ভিত্তিতে যয়নবকে প্রত্যার্পণ করেছিলেন, না আবার নতুন আকদ হয়েছিল? এ বিষয়ে দুই রকম বর্ণনা পাওয়া যায়। আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস (রা) বলেন
ان رسول الله صلى الله علبه وسلم رة إبنته الى ابی العاص بعد سنين بنگاجها الأول ولم يحدث صدائا .
নবী করীম (ﷺ) তার কন্যাকে অনেক বছর পর প্রথম বিয়ের ভিত্তিতে আবুল ‘আসের নিকট ফিরিয়ে দেন এবং কোন রকম নতুন মোহর ধার্য করেননি। (ইবনে হিশাম-১/৬৫৮-৫৯; তিরমিজী (১১৪৩); ইবনে মাজাহ: সিয়ারু আ’লাম আন-নূবালা-২/২৪৯)
ইমাম শা’বী বলেন
أسلمت زینب وهاجرت، ثم أشتم ابو العاص بعد ذلك وما نرق بينهما.
‘যয়নব ইসলাম গ্রহণ করেন এবং হিজরতও করেন। তারপর আবুল আস ইসলাম গ্রহণ করেন। নবী করীম (ﷺ) তাদের বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটাননি। (তাবাকাত-৮/২৪৯)
এর কারণ হিসেবে বলা হয়েছে যে, তখনও পর্যন্ত সূরা আল-মুমতাহিনার নিম্নের আয়াতটি নাযিল হয়নি
بابها الذين أما إذا ام المؤمنات مهاجرات ناشئحتهن، الله أعلم بابانون، قان علمتموهن مژمئات تلا ترجعون الى التقالي، هن چ لهم ولا هم يحلون لهن .
“হে ঈমানদারগণ, যখন তোমাদের নিকট ঈমানদার নারীরা হিজরত করতে আসে তখন তাদেরকে পরীক্ষা কর। আল্লাহ তাদের ঈমান প্রসঙ্গে সম্যক অবগত আছেন। যদি তোমরা জান যে তারা ঈমানদার, তবে আর তাদেরকে কাফিরদের নিকট ফেরত পাঠিও না। এরা কাফিরদের জন্যে হালাল নয় এবং কাফিররা এদের জন্যে হালাল নয়।” (সূরা-৬০ মুমতাহিনাহ : আয়াত-১০)
আলোচ্য আয়াত ব্যক্ত করছে যে, যে মহিলা কোন কাফির পুরুষের স্ত্রী ছিল, এরপর সে মুসলমান হয়ে গেছে, তার বিয়ে কাফিরের সাথে এমনিতেই বাতিল হয়ে গেছে। এখন তারা পরস্পরের জন্যে হারাম।
একই ধরণের কথা কাতাদাও বলেছেন। তিনি বলেন
اذا أسلمت اثرا قبل زوجها، ثم انزلت برائ بث تسبب له عليها، إلأ بخطبة.
এ ঘটনার পরে অবতীর্ণ হয় সুরা আল- বারায়াত। অতঃপর কোন স্ত্রী তার স্বামীর পূর্বে ইসলাম গ্রহণ করলে নতুন করে আকদ ব্যতীত স্ত্রীর ওপর স্বামীর কোন ধরনের অধিকার থাকতো না।’ (তাবাক-৮/৩২) কিন্তু তার পূর্বে মুসলিম মহিলারা স্বামীর ইসলাম গ্রহণের পর নতুন আকদ ব্যতীতই স্বামীর নিকট ফিরে যেতেন।
ان النبى صلى الله عليه وسلم رد على أبي العاص بنگاع جديد ومهر جديد.
রাসূল নতুন বিয়ে ও নতুন মোহরের ভিত্তিতে যয়নবকে আবুল আসের নিকট প্রত্যার্পণ করেন। ইমাম আহমাদ বলেন : এটি একটি দুর্বল হাদীস। (তিরমিজী (১১৪২); তাবাকাত-৮/৩২; সিয়ারু আ’লাম আন-নুবালা-২/২৪৮)
সনদের দিক দিয়ে আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস (রা)-এর বর্ণনাটি যদিও অপর বর্ণনাটির ওপর প্রাধান্যযোগ্য, তবুও ফকীহগণ দ্বিতীয়বার আকদের বর্ণনাটির ওপর আমল করেছেন। তারা ইবন আব্বাসের (রা) বর্ণনাটির এরূপ ব্যাখ্যা দিয়েছেন যে, যেহেতু দ্বিতীয় আকুদের সময় মোহর ও অন্যান্য বিষয় অপরিবর্তিত ছিল, তাই তিনি প্রথম আকদ বলে বর্ণনা করেছেন। অন্যথায় এ ধরণের বিচ্ছেদে দ্বিতীয়বার আকৃদ আবশ্যক। ইমাম সুহায়লীও এরূপ কথা বলেছেন। যয়নব (রা) পিতা নবী করীম (ﷺ) ও স্বামী ‘আস (রা) উভয়কে গভীরভাবে ভালোবাসতেন। ভালো দামী পোশাক পরতে আগ্রহী ছিলেন। আনাস বিন মালেক (রা) একবার তাঁকে একটি রেশমী চাদর গায়ে দেয়া অবস্থায় দেখতে পান। চাদরটির পাড় ছিল হলুদ বর্ণের।
ওফাত
যয়নব (রা)-এর ইন্তেকালের অল্প কিছুদিন পর তার স্বামী আবুল ‘আসও (রা) ইন্তেকাল করেন। বালাজুরী বলেন, ইসলাম গ্রহণের পর তিনি নবী করীম (ﷺ)-এর সাথে কোন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেননি এবং হিজরী ১২ সনে ইন্তেকাল করেন। যুবাইর ইবনুল আওয়াম (রা) ছিলেন তার মামাতো ভাই। মৃত্যুর আগে তাঁকেই উত্তরাধিকারী বানিয়ে যান।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন