১৯. উম্মুল মুমিনীন মায়মূনা (রা)
রাসূল (ﷺ)-এর পবিত্র স্ত্রীগণ হলেন মুমিনদের জন্য মাতৃতুল্য। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন-
النبى أولى بالمؤمنين من آئسهم وأزواجه أمهاتهم.
নবী মুমিনদের নিকট তাদের নিজেদের অপেক্ষা অধিক ঘনিষ্ঠ আর তার স্ত্রীগণ তাদের মাতা (সূরা-৩ আহযাব : আয়াত-৬)
তাই মুমিনদের মাতা ও রাসূল (ﷺ)-এর পবিত্র স্ত্রীগণ জান্নাতে যাবে এটাই স্বাভাবিক। যাদের সাথে রাসূল (ﷺ)-এর দাম্পত্য জীবন অতিবাহিত হয়েছে তারা জাহান্নামে যাবে আর রাসূল জান্নাতে থাকবেন এটা অসম্ভব কথাও বটে। তাই রাসূল (ﷺ)-এর সাথে তাদের সম্পর্কের কারণেই তারা জান্নাতে যাবেন, এটাই দলিল তাদের জান্নাতে যাওয়ার।
নাম ও পরিচয়
পূর্বে তার নাম ছিল বাররা। উম্মাহাতুল মু’মিনীনদের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর নাম রাখা হয় মায়মূনা। তাঁর পিতার নাম হারেস এবং মাতার নাম হিন্দু বিনতে আউফ।
বংশনামা
তার বংশ তালিকা হল, বাররা বিনতে হারেস ইবনে হাজন ইবনে বুইর ইবনে হাযাম ইবনে রোতবা ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে হেলাল ইবনে আমের ইবনে সা’আসা’আ ইবনে মু’আবিয়া ইবনে বকর ইবনে হাওয়াযেন ইবনে মনসুর ইবনে ইকরামা ইবনে খলিফা ইবনে কায়েস ইবনে আয়লান ইবনে মুদার। আর তার মায়ের দিক দিয়ে বংশ তালিকা হল, বাররা বিনতে হিন্দ বিনতে আউফ ইবনে যাহাইর ইবনে হারেস ইবনে হামাতা ইবনে জারাশ। মায়মূনা ছিলেন কুরাইশ বংশের হাওয়াযিন গোত্রের হারেসের কন্যা; যিনি সাআসাআ নামক এলাকায় বসবাস করতেন। অপরদিকে তিনি ছিলেন রাসূল (ﷺ)-এর চাচা আব্বাস (রা)-এর শালিকা এবং বিশ্বখ্যাত সেনাপতি খালিদ বিন ওয়ালিদের খালা। অন্যদিকে তিনি উম্মুল ফযল লুবাবাতুস সুগরার বোন ছিলেন।
প্রথম বিবাহ
মাসউদ বিন আমর বিন উমায়ের সাকাফীর সঙ্গে তার প্রথম বিয়ে হয়েছিল। কিন্তু দাম্পত্য জীবনে বনিবনা না হওয়াতে মাসউদ মায়মূনাকে তালাক দেন।
দ্বিতীয় বিবাহ
পরে আবু রহম ইবনে আবদুল্লাহর সাথে তাঁর দ্বিতীয় বিয়ে হয়। এ আৰূ রহম সপ্তম হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন। ফলে মায়মুনা সম্পূর্ণ নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করতে থাকেন। এমতাবস্থায় তার দুলাভাই আব্বাস (রা) উদ্যোগী হয়ে রাসূল (ﷺ)-এর নিকট বিয়ের প্রস্তাব পেশ করেন। ইসলামের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে রাসূল ৫১ বছর বয়স্কা বৃদ্ধা মায়মুনাকে বিয়ে করতে রাজি হন।
রাসূল (ﷺ)-এর সাথে বিবাহ
সপ্তম হিজরী সালের জিলকদ মাসে হুদায়বিয়ার সন্ধি অনুসারে রাসূলই ওমরাতুল কাজা পালন করার উদ্দেশ্যে মক্কা রওয়ানা হন। এ সময় জাফর ইবনে আবূ তালিবকে মায়মুনার কাছে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে পাঠানো হয়। তিনি আব্বাস ইবনে আবদুল মুত্তালিবকে উকিল নিযুক্ত করেন। রাসূল ওমরার উদ্দেশ্যে যে ইহরাম বাধেন, সেই অবস্থায় এ বিয়ে সম্পন্ন হয়। আব্বাস (রা) এ বিয়ে পড়ান। ওমরা পালন শেষে মদীনা ফেরার পথে সরফ” নামক স্থানে এ বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়। এ বিয়ের মোহরানা ধার্য করা হয় ৫০০ দিরহাম। কেউ কেউ বলেন মায়মূনা ছিলেন রাসূল (ﷺ)-এর সর্বশেষ স্ত্রী। তাদের মতে রায়হানা ও মারিয়া কিবতিয়া দাসী ছিলেন স্ত্রী নয়। তবে ঘটনাচক্রে মনে হয় তারাও স্ত্রী ছিলেন। তারা রাসূল স্ত্রী ছিলেন এটাই অধিক যুক্তিযুক্ত। এখানে তাদেরকে স্ত্রী হিসেবেই গ্রহণ করা হল।
বিয়ের ফলাফল
রাসূল ও মায়মূনার এ বিয়ে সম্পন্ন হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত আব্বাস ও খালিদ বিন ওয়ালিদ ইসলাম কবুল করেন নি। মূলত এ বিয়ের ফলেই এ দু’জন বিশাল ব্যক্তিত্ব ইসলাম কবুল করেন এবং ইসলামের শক্তি বৃদ্ধি করেন। আসলে এ বিয়ের প্রভাব ছিল সুদূর প্রসারী। এ প্রসঙ্গে স্যার সৈয়দ আমীর আলী বলেন, ‘মায়মুনাকে মুহাম্মদ মক্কায় বিয়ে করেছিলেন। তিনি ছিলেন তার আত্মীয় ও পঞ্চাশের উর্ধ্বে ছিল তার বয়স। এ বিয়ে আত্মীয়তার অবলম্বন হিসেবেই শুধু কাজ করেনি; অধিকন্তু এ ইসলামের জন্য লাভ করেছিল দু’জন বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব ইবনে আব্বাস এবং ওদের দুর্ভাগ্যজনক যুদ্ধে কুরাইশের অশ্বারোহী দলের সেনাপতি ও পরবর্তীকালে গ্রীক বিজেতা খালিদ বিন ওয়ালিদ। অনেকের ধারণা রাসূল (ﷺ) মায়মুনাকে বিয়ে না করলে খালিদ বিন ওয়ালিদ কোনোদিন হয়তো ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করতেন না। সুতরাং একথা নির্বিধায় বলা যায় যে, এ বিয়ে ইসলামের ও মুসলমানদের জন্য কল্যাণ বয়ে এনেছিল।
চরিত্র মাহাত্ম
মায়মূনা অত্যন্ত পরহেযগার একজন মহিলা ছিলেন। তিনি আল্লাহর ভয়ে সর্বদা কম্পিত থাকতেন এবং কান্নাকাটি করতেন। তিনি ছোটখাট আদেশ নিষেধকে সমান গুরুত্ব দিতেন। একবার এক মহিলা অসুস্থ অবস্থায় মানত করলো যে, সুস্থ হলে বায়তুল মুকাদ্দাস গিয়ে সালাত পড়বে। আল্লাহ তা’আলা তাকে রোগ মুক্ত করলে মানত পুরা করার উদ্দেশ্যে বায়তুল মুকাদ্দাস গমনের জন্য মায়মুনার নিকট বিদায় নিতে আসে। মায়মুনা (রা) তাকে বুঝিয়ে বলেন যে, অন্যান্য মসজিদে সালাত আদায়ের চেয়ে মসজিদে নব্বীতে সালাত আদায়ের সওয়াব হাজার গুণ বেশি। তুমি এখানে থেকেই মসজিদে নববীতে সালাত আদায় কর। তাঁর সম্পর্কে আলশা (রা) বলেন, মায়মূনা ছিলেন আমাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আল্লাহকে ভয়কারিণী এবং আত্মীয়তার সম্পর্কের প্রতি সবচেয়ে বেশি। যত্নবান মহিলা। একবার তার এক আত্মীয় বেড়াতে আসেন। কিন্তু তার মুখ দিয়ে মদের গন্ধ আসছিল। তাই মায়মুনা (রা) ক্ষেপে গিয়ে বললেন, ভবিষ্যতে আর কখনো আমার কাছে আসবে না।
হাদীস শিক্ষা ও সম্প্রসারণে তার অবদান
মায়মূনা (রা) রাসূল (ﷺ)-এর ইন্তেকালের পরও দীর্ঘ দিন জীবিত ছিলেন। মহানবী এর অনেক হাদীসই উম্মুল মু’মিনীনদের মাধ্যমে পরবর্তীদের কাছে সম্প্রসারিত হয়েছে। মায়মুনা (রা)-এর অবদান এ ক্ষেত্রে মোটেই নগণ্য নয়। রাসূলুল্লাহ ও হতে তিনি হাদীস শিক্ষা লাভ করেছেন এবং তা বর্ণনাও করেছেন। ইবনুজ জাওযী (র) বলেন : মায়মুনা (রা) থেকে ৭৬টি হাদীস বর্ণিত হয়েছে। তন্মধ্যে সহীহাইন তথা সহীহ বুখারী ও মুসলিমে ১৩টি হাদীস সংকলিত হয়েছে। ইমাম বুখারী ও মুসলিম যৌথভাবে ৭টি, ইমাম বুখারী এককভাবে ১টি এবং ইমাম মুসলিম (র) এককভাবে ৫টি হাদীস বর্ণনা করেছেন। আমাদের পরিসংখ্যান অনুযায়ী তার থেকে বর্ণিত হাদীস পুনরুক্তিসহ বুখারীতে ২১টি, মুসলিমে ১৮টি, তিরমিযীতে ৪টি, আবু দাউদে ১৫টি, নাসাঈতে ২৬টি এবং ইবনে মাজায় ১১টি সংকলিত হয়েছে। তার থেকে আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস, আবদুল্লাহ ইবনে শাদ্দাদ, আবদুর রহমান ইবনে সায়েব, ইয়াযিদ ইবনে আছম প্রমুখ সাহাবীগণ হাদীস বর্ণনা করেছেন। তার থেকে বর্ণিত হাদীসগুলো দ্বীন ও দুনিয়ার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্বলিত।। নিয়ে তার থেকে বর্ণিত কিছু হাদীস উল্লেখ করা হলো –
1. عن ميمونة (رض) أن النبي & ال عثا بقا ثم صلی و لم يتوضأ.
১. মায়মূনা (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী তাঁর নিকট (একদা) বকরীর কাঁধের মাংস খেলেন, অত:পর সালাত পড়লেন, কিন্তু অযু করলেন না।
۲. عن ميمونة (رض) أن رسول الله * شيل عن قارة سقطت في سن ؛ قال القوقا وما حولها وكلوا سنگم.
২. মায়মূনা (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল ঘি বা মাখনে ইদুর পতিত হওয়া সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হয়ে বললেন, ইঁদুর ও তার পার্শ্ববর্তী বিটুকু ফেলে দিয়ে তোমরা তোমাদের ঘি খেতে পার।
٣. عن ميمونة (رض) قالت : كان رسول الله له بثضج معي وانا حائض وبيني وبينه ئوب.
৩. মায়ামূনা (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ আমার ঋতুস্রাব অবস্থায় আমার সাথে শয়ন করতেন। তার ও আমার মাঝে কাপড়ের ব্যবধান থাকতো।
له .. عن ميمونة (رض) قالت : أذنيه لرسول الله من الجنابة، ننل كتبه مرتين أو ثلاثا. ثم أدخل في الإناء ثم اثر به على وجه وتمسكه بشماله، ثم ضرب بشماله الأرضي لها دلگا، ثم توضأ وضو يلصلوة، ثم أثرة على رأسه ثلاث فتات م قب، ثم غسل سایر جسده، ثم تنحى عن مقامه ذلك ننل رجليه، ثم آئبه بالثدي فرده .
৪. মায়মূনা (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন : আমি রাসূলুৱাহ -এর জানাবতের গোসল নিকট থেকে লক্ষ্য করেছি। তিনি প্রথমে দু’হাতের কজি দু’তিনবার ধৌত করেন। অত:পর হাত পাত্রে দিয়ে লজ্জাস্থানে পানি দেন এবং বাম হাত দিয়ে তা ভালভাবে পরিষ্কার করেন। অত:পর সালাতের ন্যায় অ্যু করেন। এরপর তিন কোষ পানি মাথায় দিলেন, অতঃপর সমস্ত শরীর ধৌত করলেন। এরপর ঐ স্থান থেকে সরে এসে পা ধৌত করেন। অতঃপর আমি রুমাল নিয়ে আসি তবে তিনি তা গ্রহণ করেন নি।
.. عن ميمونة (رض) تالث : كان النبي * إذا سجد لوشاءت بهم أن تمر بين يديه تموت.
৫. মায়মূনা (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী (ﷺ) যখন সিজদা দিতেন, কোন বকরীর বাচ্চা তার দুহাতের পাশ দিয়ে অতিক্রম করতে চাইলে করতে পারতো ।
.. عن ميمونة بنت الحارث (رض) آنها اعتنت لبدة في ، نذكر ذلك لرسول الله صلى الله عليه زمان رسول الله وسلم، قال : لاعطبتها اڅواللي كان أعظم أجرك
৬. মায়মূনা বিনত আল-হারিস (রা) রাসূলের যামানায় একজন ক্রীতদাসীকে আযাদ করে মুক্ত করে দেন। অত:পর রাসূলুল্লাহ-এর নিকট এ কথা বর্ণনা করলে তিনি বললেন, তুমি যদি ঐ অর্থ তোমার ভাই ইবনুল হারিসকে দিতে তবে অধিক সাওয়াব পেতে।
۷. عن ميمونة (رض) قالت : أثدي لمولاة لتاشا بن قال : ألا تغتم إهابها الصدقة، فمات، تمر بها النبي أي جودها، فانثنم به ؟ قالوا :یا رسول الله و انها مئة قال : انا حرام أكلها.
৭. মায়মূনা (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন ; আমাদের জনৈক দাসীকে একটি বকরী উপহার দেয়া হলো। বকরীটি মরে গেল। রাসূল বকরীর পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন, বললেন : তোমরা কি এর চামড়া পরিশোধন (দাবাগত) করে তা ব্যবহার করবে না? তারা বললেন, হে রাসূল (ﷺ) এটা তো মৃত। নবীন বললেন, এর গোশত খাওয়া হারাম, চামড়া ব্যবহার করা নয়।
তাঁর বর্ণিত অনেক হাদীস থেকে তার ফিকহী সূক্ষ্মতার পরিচয় মেলে।
উদাহরণস্বরূপ একটি হাদীস উল্লেখ করা হলো : একবার ইবনে আব্বাস (রা) মলিন মুখে বসে আছেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “বৎস! তোমার কি হয়েছে। বললেন, উম্মু আম্মার (তাঁর স্ত্রী) আমার চুলে চিরুনী করে দিতো, অথচ সে আজ-কাল মাসিক স্রাবে ভুগছে। তিনি বললেন, কী চমৎকার! আমার ঐ রকম দিনে নবীন আমার কোলে মাথা মুবারক রেখে শুইতেন, কুরআন শরীফ পড়তেন, আমি ঐ অবস্থায় মসজিদে বিছানা (চাটাই) রেখে আসতাম। বৎস! হাতেও কি এসব হয় কখনও ?
ওফাত
রাসূল (ﷺ)-এর পদাঙ্ক অনুসরণে সতত তৎপর, পরোপকারী, দানশীলা, গোলাম আযাদকারিণী মায়মুনা (রা) হিজরী ৬১ সালে সরফ’ নামক স্থানে ইন্তেকাল করেন। উল্লেখ্য যে, এ সরফে তার বিয়ে হয়েছিল। এটা তার জীবন ইতিহাসের এক স্মরণীয় ঘটনা। ওফাতের সময় তিনি আয়েশা ও উম্মু সালামা (রা)-কে ডেকে এনে বলেন, সাধারণত সতীনদের মধ্যে যা হয়ে থাকে মাঝে মধ্যে আমাদের মধ্যেও সে রকম হয়ত হয়ে যেত, আমি এ ব্যাপারে লজ্জিত। আপনারা আমাকে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। আয়েশা বলেন, আমি তাকে ক্ষমা করে তার জন্য মাগফিরাতের দোয়া করি। এতে তিনি সন্তুষ্ট হয়ে বললেন। তুমি আমাকে খুশী করেছ আল্লাহ তোমায় খুশী করুন। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস তার জানাযার সালাত পড়েছিলেন এবং তিনি লাশ কবরে নামিয়েছিলেন। লাশ বহনের সময় আবদুল্লাহ বলেছিলেন, সাবধান। এ উম্মুল মুমিনীনের লাশ। বেয়াদবী করো না, এমন কি তোমরা নড়াচড়াও করো না। খুব যত্ন সহকারে বহন করবে।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন