১৪. উম্মুল মু’মিনীন উম্মু সালামা (রা)
রাসূল (ﷺ)-এর পবিত্র স্ত্রীগণ হলেন মুমিনদের জন্য মাতৃতুল্য। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন
النبى أولى بالمؤمنين من أنفسهم وأزواجه أمهاتهم.
নবী মুমিনদের নিকট তাদের নিজেদের অপেক্ষা অধিক ঘনিষ্ঠ আর তার স্ত্রীগণ তাদের মাতা (সূরা-৩৩ আহযাব : আয়াত-৬) তাই মুমিনদের মাতা ও রাসূল (ﷺ)-এর পবিত্র স্ত্রীগণ জান্নাতে যাবে এটাই স্বাভাবিক। যাদের সাথে রাসূল (ﷺ)-এর দাম্পত্য জীবন অতিবাহিত হয়েছে তারা জাহান্নামে যাবে আর রাসূলজান্নাতে থাকবেন এটা অসম্ভব কথাও বটে। তাই রাসূল (ﷺ)-এর সাথে তাদের সম্পর্কের কারণেই তারা জান্নাতে যাবেন, এটাই দলিল তাদের জান্নাতে যাওয়ার।
নাম ও পরিচয়
রাসূল (ﷺ)-এর ষষ্ঠ স্ত্রী ছিলেন উম্মু সালামা (রা)। তার মূল নাম ছিল হিন্দ। ডাক নাম উম্মু সালামা। এ নামেই তিনি পরিচিত হয়ে আছেন। পিতার আসল নাম সুহাইল, ডাক নাম আবূ উমাইয়া। ইনি কুরাইশ বংশের মাখজুম গোত্রের লোক। মায়ের নাম আতিকা। পিতার দিক থেকে তার বংশ তালিকা ছিল- হিন্দ বিনতে আবু উমাইয়া সুহাইল ইবনে মুগীরা ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে ওমর ইবনে মাখজুম। আর মায়ের দিক থেকে হিন্দু বিনতে আতিকা বিনতে আমের ইবনে রাবীয়াহ ইবনে মালেক কেনানা।
সামাজিক মর্যাদা
উম্মু সালামা (রা)-এর পিতা-মাতা উভয় দিক থেকেই তৎকালীন আরবের খুবই মর্যাদাসম্পন্ন বংশের লোক ছিলেন। তাঁর পিতা আবু উমাইয়া ছিলেন আরবের একজন ধনাঢ্য ব্যক্তি। তিনি এতটাই উদার, দানশীল এবং হৃদয় খোলা মানুষ ছিলেন যে, যাদুর রাকিব’ উপাধিতে ভূষিত হন। মাঝে মধ্যে যখন সফরে যাওয়ার প্রয়োজন হত তখন আৰূ উমাইয়া পুরো কাফেলার ব্যয়ভার নিজেই বহন করতেন। এজন্যই তাঁর উপাধি দেয়া যাদুর রাকিব’ বা মুসাফিরের পাথেয়।
প্রথম বিবাহ
উম্মু সালামা (রা)-এর প্রথম বিয়ে হয় তারই চাচাত ভাই আবদুল্লাহ ইবনে আবদুল আসাদের সাথে। তিনি রাসূল (ﷺ)-এর দুধ ভাই ছিলেন। মূল নাম আবদুল্লাহ হলেও পরবর্তীতে তিনি আবু সালামা নামেই পরিচিতি লাভ করেন।
ইসলাম গ্রহণ ও হিযরত
ইসলামের একান্ত প্রাথমিক অবস্থায়, যখন ইসলাম কবুল করা মানে বিপদের পাহাড়কে নিজের মাথায় তুলে নেয়ার মত অবস্থা ঠিক এ বিপদ সঙ্কুল অবস্থায় উম্মু সালামা এবং তাঁর স্বামী পরিবার পরিজনের তীব্র বিরোধিতার মুখে ইসলাম কবুল করেন। স্বাভাবিকভাবেই তাদের ওপর নেমে আসে নানা অত্যাচার-নির্যাতন। শেষ পর্যন্ত মক্কায় টিকতে না পেরে তারা অন্যান্য মুসলমানদের সাথে স্বামী-স্ত্রী উভয়ে আবিসিনিয়া হিজরত করেন। এখানেই তাদের প্রথম সন্তান সালামা জন্মগ্রহণ করেন। এ পুত্র সালামার নামেই স্বামী আবু সালামা এবং স্ত্রী উম্মু সালামা নামে খ্যাতি লাভ করেন। জানা যায়, আবিসিনিয়ার আবহাওয়া সালামা পরিবারের স্বাস্থ্যের অনুকূলে ছিল। যে কারণে তারা বাধ্য হয়ে মক্কায় ফিরে আসেন। পরবর্তীতে রাসূল (ﷺ)-এর নির্দেশে মদীনায় হিজরত করেন।
হিজরতের করুণ চিত্র
এখানে উল্লেখ্য যে, উম্মু সালামা (রা) মদীনায় হিজরতকারী প্রথম মহিলা। কিন্তু মদীনায় হিজরতের অভিজ্ঞতা ছিল খুবই তিক্ত ও দুঃখজনক। ঐতিহাসিক ইবনে আসীর সে ঘটনাটি উম্মু সালামার জবানীতেই পেশ করেছেন। তিনি বলেন, ‘আবূ সালামা যখন মদীনা যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন, তখন তাঁর কাছে একটি মাত্র উট ছিল। তিনি আমাকে এবং আমার পুত্র সালামাকে তার পিঠে সওয়ার করান। তিনি নিজে উটের লাগাম ধরে রওয়ানা করেন। বনু মুগীরা ছিল আমার সমগোত্রীয়।
এ গোত্রের লোকেরা আমাদেরকে দেখে ফেলে এবং আবু সালামাকে বাধা দিয়ে বলে যে, আমরা আমাদের কন্যাকে এত খারাপ অবস্থায় যেতে দেবো না। তারা আবু সালামার হাত থেকে লাগাম ছিনিয়ে নেয় এবং আমাকে সঙ্গে নিয়ে চুলে যায়। ইতোমধ্যে আবু সালামার বংশের লোক বনু আবদুল আসাদ এসে পৌঁছে। তারা পুত্র সালামাকে ছিনিয়ে নেয় এবং বনু মুগীরাকে জানিয়ে দেয় যে, তোমরা তোমাদের কন্যাকে স্বামীর সাথে যেতে না দিলে আমরাও আমাদের শিশুকে তোমাদের কন্যার সাথে কিছুতেই যেতে দেবো না।
এখন আমি, আমার স্বামী এবং পুত্র সন্তান তিনজনই একে অপর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লাম। শশাকে-দুঃখে আমার অবস্থা বেগতিক। যেহেতু হিজরতের হুকুম হয়েছিলো, তাই আবু সালামা মদীনায় চলে যান। আমি একা রয়ে যাই। প্রতিদিন ভোরে ঘর থেকে বের হতাম এবং একটা পাহাড়ে বসে বসে সন্ধ্যা পর্যন্ত ক্রন্দন করতাম। প্রায় এক বছর আমাকে এ অবস্থায় কাটাতে হয়। একদিন বনু মুগীরার এক ব্যক্তি, যিনি ছিলেন আমার বন্ধু, আমার এ অস্থিরতা দেখে দয়া পরবশ হয়ে তার বংশের লোকদেরকে একত্রিত করে বললেন, আপনারা এ অসহায়কে কেন ছেড়ে দিচ্ছেন না? একে তো আপনারা স্বামী এবং সস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছেন। তার এ কথাগুলো বেশ কাজ করেছে। শেষ পর্যন্ত তাদের মনে দয়ার উদ্রেক হয়। তারা আমাকে অনুমতি দিয়ে বলে যে, তোমার ইচ্ছে হলে স্বামীর কাছে যেতে পারো। এটা শুনে বনু আবদুল আসাদের লোকেরাও আমার কাছে সন্তান ফেরত দেয়। এবার উটের পিঠে হাওদা বেঁধে পুত্র সালামাকে বুকে নিয়ে সওয়ার হই। আমি ছিলাম সম্পূর্ণ একা। এ অবস্থায় কোবায় পৌছি। সেখানে ওসমান ইবনে তালহা ইবনে আবু তালহার সাথে সাক্ষাৎ হয়। তিনি আমার অবস্থা জানতে পেরে জিজ্ঞেস করেন, তোমার সাথে কেউ আছে। আমি বললাম, না, আমি একা।
আর আমার এ শিশু সন্তান। তিনি আমার উটের লাগাম ধরে টেনে নিয়ে যান। আল্লাহ সাক্ষী, তালহার চেয়ে ভাল লোক আরবে আমি পাইনি। মনযিল এলে আমার অবতরণ দরকার হলে তিনি গাছের আড়ালে চলে যেতেন। রওয়ানা কার সময় হলে তিনি উট নিয়ে আসতেন। আমি ভালোভাবে বসলে তিনি উটের লাগাম ধরে আগে আগে গমন করতেন। গোটা পথ এভাবে কাটে। মদীনা পেীছে বনু আমর ইবনে আওফ-এর জনপদ কোবা অতিক্রমকালে ওসমান ইবনে আবু তালহা আমাকে জানান যে, তোমার স্বামী এ গ্রামে আছেন। আবু সালামা এখানে অবস্থান করছেন।
তার উপর নির্যাতন
আমরা যদি ইসলাম প্রচারের প্রথম দিকে নজর দেই তাহলে দেখবো হিজরতকালীন সময়ে আবু সালামার গোত্রের ওপর যে অত্যাচার-নির্যাতন হয়েছে, যে কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে অন্যদের বেলায় তেমন হয়নি। উম্মু সালামা নিজেই বলেন, ইসলামের জন্য আবু সালামার গোত্রকে যে কষ্ট স্বীকার করতে হয়েছে, তা আহলে বাইতের আর কাউকে সইতে হয়েছে বলে আমার জানা নেই।
উম্মু সালামা এমনই মর্যাদাবান পিতার সন্তান ছিলেন যে, যখন হিজরতকালে তিনি মদীনার কোবা পল্লীতে পৌছান তখন তাঁর পরিচয় জানতে পেরে কেউই তা বিশ্বাস করতে চায়নি। কারণ ঐ জাহেলী যুগেও কুরাইশ বংশের আবূ উমাইয়ার মত সাপ্ত পরিবারের মহিলারা এমনি একা বেড়াতেন না। কিন্তু উম্মু সালামার ব্যাপারটা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। তিনি ইসলামের হুকুম আহকাম সর্বোপরি আল্লাহর নির্দেশকে নিজের জীবনের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করতেন। এর কিছুদিন পর হজ্জ করার জন্য কিছু লোক যখন মক্কার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয় তখন উম্মু সালামা তার পরিবারের কাছে একটা চিঠি পাঠান। এবার সবাই বিশ্বাস করে যে, সত্যিই তিনি কুরাইশ বংশের আবু উমাইয়ার সন্তান।
স্বামীর সাথে স্বাক্ষাত ও উহুদ যুদ্ধে অংশগ্রহণ
আল্লাহর মেহেরবাণীতে স্বামীর সাথে সাক্ষাৎ হয়। আবু সালামার সন্ধান দিয়ে ওসমান ইবনে আবূ তালহা মক্কা ফিরে যান। এ ঘটনাটি উম্মু সালামার ওপর খুব প্রভাব ফেলে। তিনি তার সারা জীবনেও ঘটনাটি ভুলেন নি এবং ওসমান ইবনে তালহার মহানুভবতার কথা স্মরণ করতেন। তিনি প্রায়ই বলতেন,
مارايت ايبا تط أثر من عثمان بن طلة.
“আমি কখনো ওসমান ইবনে তালহার চেয়ে ভাল সাথী কাউকে দেখিনি। মদীনায় স্বামীর সাথে একত্রিত হওয়ার পর তারা আবার সাংসারিক জীবন শুরু করেন। কিন্তু বেশিদিন একত্র থাকা সম্ভব হয়নি। এরই মধ্যে ডাক আসে ওহুদ যুদ্ধের বীর যোদ্ধা আবু সালামা ওহুদ যুদ্ধে বীরবিক্রমে ঝাপিয়ে পড়েন। এ যুদ্ধে তিনি বহু শত্রু সৈন্যকেও নিধন করেন। তবে শক্রর নিক্ষিপ্ত একটি তীর তাঁর বাহুতে এসে বিদ্ধ হয়। জখমটা ছিল মারাত্মক। দীর্ঘ একমাস চিকিৎসার পর তিনি কোনো রকম সুস্থ হয়ে ওঠেন। জানা যায় এ ঘটনারও দু’বছর এগার মাস পর রাসূল (ﷺ)-এর নির্দেশে তিনি কতন এলাকায় একটি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। স্বামীর শাহাদাত বরণ এ যুদ্ধে প্রায় এক মাস সময় লেগে যায়। এখানেও তিনি আঘাতপ্রাপ্ত হন। যতদূর জানা যায়, এ আঘাতটা তার পূর্বের জখমকে কাঁচা করে দেয় এবং তিনি মদীনায় ফিরে আসেন। জখমের তীব্রতা বাড়তে থাকে। এ অবস্থায় তিনি তার স্ত্রী উম্মু সালামা (রা)-কে এ বলে সান্ত্বনা দিতেন।
“আমি রাসূলে করীম-এর নিকট শুনেছি, কেউ যদি কোনো বিপদের সম্মুখীন হয় তাহলে দুঃশ্চিন্তা না করে সে যেন বলে, ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। কারণ, আল্লাহর সান্নিধ্য পাওয়ার অনুভূতিই মু’মিনের জীবনে বিপদের মুহূর্তে প্রশান্তি দিতে পারে। তিনি এ বলেও প্রার্থনা করতে বলেছেন
اللهم عند احتسبت مصيبني هذه اللهم الفني برا بثها الأعطاه الله عزوجل.
“হে আল্লাহ! আমি আমার এ বিপদে তোমার কাছেই প্রতিদান চাচ্ছি। তুমি আমাকে এর চাইতেও উত্তম পুরস্কারে ভূষিত করো, আল্লাহ অবশ্যই তাকে তা দান করবেন।’ আবু সালামার অবস্থা ক্রমশ খারাপের দিকে যাচ্ছিল। একদিন সকালে রাসূলে করীম – তাকে দেখার জন্যে উপস্থিত হলেন। চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যের খোজ-খবর নিয়ে যখন তিনি প্রত্যাবর্তন করছিলেন, ঠিক সে মুহূর্তেই আবু সালামা (রা) ইনতেকাল করলেন। রাসূলে করীম আর নিজ হাতে তার চোখ দুটি বুজিয়ে দিলেন এবং আল্লাহর কাছে এ বলে প্রার্থনা করলেন
اللهم اغفر لأبي سلمة، وارفع درجته في المقرين واڅئفة في عقبه فى الغابرين واغفرلنا وله با رب العلمین
‘হে আল্লাহ! তুমি আবু সালামার সমস্ত গুনাহ মাফ করে দাও, তাঁর মর্যাদাকে বৃদ্ধি করে তোমার প্রিয় ও নিকটতম বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত করো, তার পরিবার-পরিজনের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব গ্রহণ করো এবং তাকে ও আমাদের সকলকে ক্ষমা করো। তার কবরকে আলোকিত ও প্রশস্ত করে দাও। রাসূল থেকে তার স্বামী কর্তৃক বর্ণিত সেই দু’আ উম্মু সালামা (রা) স্মরণ হলো। তিনি- ‘হে আল্লাহ বিপদে তোমার কাছেই এর প্রতিদান চাচ্ছি’- পর্যন্ত বলে থমকে গেলেন এবং মনে মনে বললেন : “আবু সালামার চেয়ে উত্তম জীবন সঙ্গী আর কে হতে পারে?
হিজরী ৪ সালের জমাদিউল উখরার ৯ তারিখে তিনি ইন্তেকাল করেন। উম্মু সালামার গর্ভে আবু সালামার ঔরসজাত দুইজন পুত্র সন্তান ছিল- সালামা ও উমার ও ২ জন কন্যা ছিল যয়নব (রা) ও রুকাইয়া (রা)।
রাসূল (ﷺ)-এর সান্ত্বনা ও দোয়া
আবু সালামার মৃত্যু সংবাদ পেয়ে রাসূল তার বাড়িতে ছুটে যান। শোকাহত পরিবারের প্রতি আন্তরিক সমবেদনা ও গভীর শোক প্রকাশ করেন। উম্মু সালামা যখন খুবই কাতর হয়ে বার বার বলছিলেন, “অসহায় অবস্থায় কেমন মৃত্যু হয়েছে হায়!’ তখন রাসূলতাকে ধৈর্যধারণ করবার ও মরহুমের মাগফেরাতের জন্য দু’আ করতে বলেন। বিষয়টি সুনানে নাসাঈ নামক গ্রন্থের ৫১১ পৃষ্ঠায় এভাবে উল্লেখ করা হয়েছে- রাসূল উম্মু সালামা (রা)-কে বললেন, বলো,
اللهم اخلفني خيرا مثها.
‘হে আল্লাহ! আমাকে তার চেয়ে উত্তম উত্তরাধিকারী দাও। এরপর নবীজী আবু সালামার মৃতদেহ দেখতে যান এবং অতি গুরুত্বের সাথে তার জানাযার সালাত পড়ান। এ জানাযার সালাতে তিনি ৯টি তাকবীর বলেন। তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনার ভুল হয়নি তো? বললেন, ইনি হাজার তাকবীরের যোগ্য ছিলেন। ইন্তেকালের পর তার চোখ খোলা ছিল। নবীজী নিজ হাতে তার চোখ বন্ধ করে দেন এবং তার জন্য মাগফেরাতের দু’আ করেন।
স্বামীর প্রতি তার ভালবাসা
উম্মু সালামা (রা) তাঁর স্বামী আবু সালামাকে প্রাণ দিয়ে ভালবাসতেন। আর এ কারণে একবার তার স্বামীকে বললেন, ‘যদি কোনো স্ত্রীর স্বামী জান্নাতবাসী হয়, আর স্ত্রী তার স্বামীর মৃত্যুর পর পুনর্বিবাহ না করে, তবে আল্লাহ সে স্ত্রীকেও তার স্বামীর সঙ্গে জান্নাতে স্থান দান করেন। এরূপ যদি স্ত্রীর মৃত্যু হয় তবে স্বামীও তার সঙ্গে জান্নাতে প্রবেশ করে। অতএব, হে আবু সালামা! আসুন আমরা উভয়ে চুক্তি করি যে, আপনার পরে আমি অথবা আমার পরে আপনি আর বিয়ে করবেন না। উত্তরে আবু সালামা (রা) বললেন, কিন্তু পুনঃ বিয়ে সুন্নাত। আচ্ছা তুমি কি আমার উপদেশ মান্য করবে? উম্মু সালামা (রা) বললেন, কেন করবো না? আপনার আনুগত্য ছাড়া আমি আর কোনো কিছুতে খুশি হতে পারবো কি? তখন আবু সালামা (রা) বললেন, তবে শুন! আমি মারা গেলে আমার পরে তুমি বিয়ে করে ফেলে। এরপর আবু সালামা দু’আ করলেন, হে আল্লাহ! আমার পরে সালামাকে আমার থেকে উত্তম স্থলাভিষিক্ত দান করো।’
আবু সালামার দোয়া
উম্মু সালামা (রা) বলেন, “আমার স্বামী আবু সালামা (রা)-এর মৃত্যুর পর আমি ভাবতাম যে, তার থেকে উত্তম ব্যক্তি কে হতে পারে? এর কিছুদিন পরেই রাসূল (ﷺ)-এর সাথে আমার শুভ পরিণয় অনুষ্ঠিত হয়।
রাসূল (ﷺ)-এর সাথে বিবাহ
আবু সালামার ইনতেকালের সময় উম্মু সালামা অন্ত:সত্ত্বা ছিলেন। সস্তান (যয়নব) ভূমিষ্ঠের পর বিধবা উম্মু সালামা যখন অত্যন্ত অসহায় ও দরিদ্র অবস্থায় দিনাতিপাত করছিলেন তখন আবু বকর (রা) তার অসহায়ত্বের কথা বিবেচনা করে বিয়ের প্রস্তাব দেন। কিন্তু তিনি এ বিয়েতে রাজি হননি। এক বর্ণনায় আছে ওমর (রা)-ও বিয়ের প্রস্তাব দেন। অবশ্য অন্য বর্ণনা মতে ওমর (রা) নিজের জন্য এ প্রস্তাব দেননি। বরং রাসূল (ﷺ)-এর হয়ে তিনি এ প্রস্তাব পেশ করেছিলেন। আসলে ইসলামের জন্য উম্মু সালামার অপরিসীম ত্যাগ, স্বামীর মৃত্যুর পর ছোট ছোট বাচ্চাদের নিয়ে করুণ অবস্থা ইত্যাদির কথা চিন্তা করেই রাসূল (ﷺ) এ প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন।
উম্মু সালামা (রা) ছিলেন সুসাহিত্যিক, কাব্যপটু ও অসাধারণ পাণ্ডিত্বের অধিকারিণী একজন আত্মমর্যাদাবোধ সম্পন্ন মহিলা। নবী এর স্ত্রীদের মধ্যে সমস্ত দিক দিয়ে আয়েশা (রা)-এর পর তার স্থান ছিল। রূপ-সৌন্দর্য, জ্ঞান প্রজ্ঞায় বিভূষিতা এ মহিলার পক্ষে রাসূল (ﷺ)-এর প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়া সম্ভব ছিল না। তাই তিনি প্রস্তাবকারী ওমর (রা)-কে পরিষ্কার ভাষায় বললেন, “আমি ব্যক্তিগতভাবে রাসূল (ﷺ)-এর প্রস্তাবকে স্বাগত জানাচ্ছি। এর সাথে সাথে আমি রাসূল (ﷺ)-এর দরবারে তিনটি আরজ পেশ করছি
ক. আমি আভিজাত্যের অহংকারে অহংকারী মেয়ে বা আমার স্বভাবে আত্মবোধ অত্যাধিক।
খ. আমি একজন বিধবা মহিলা, আমার সন্তানাদি আছে।
গ. আমি একা, বিয়ের কাজ সম্পাদন করার আমার কেউ নেই।
ওমর (রা) উম্মু সালামার এ আরজ শোনার পর বললেন, হে উম্মু সালামা, তুমি কেমন মহিলা! আমার প্রস্তাবে রাজি হওনি। এখন রাসূলে করীম (ﷺ)-এর প্রস্তাবেও শর্তারোপ করছে!’ বুদ্ধিমতি উম্মু সালামা উত্তর দিলেন, হে ওমর ইবনুল খাত্তাব! আমার ইয়াতিম সন্তান আছে। আমি নিঃস্ব! আমি আমার বাস্তব অবস্থা রাসূল (ﷺ)-এর দরবারে কেবল তার অবগতির জন্য পেশ করছি। এ কোন ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ কিংবা অহংকারবোধের বহি:প্রকাশও নয়।
সব কথা শুনে রাসূল উম্মু সালামাকে বললেন, “হে উম্মু সালামা! তোমার যে ইয়াতিম সন্তানদের কথা উল্লেখ করেছে তাদের লালন-পালনের ব্যবস্থা আল্লাহই করবেন, আর তোমার কেউ নেই সে সমস্যার সমাধান হবে। তার উত্তরে উন্মু সালামা ছেলে ওমরকে বললেন, যাও মহানবীএর সাথে আমার বিয়ের ব্যবস্থা কর। এর কিছুদিন পর রাসূ এর সাথে তার বিয়ে হয়। সময়টা ছিল হিজরী চতুর্থ সালের শাওয়াল মাস।
বিয়ের সময় রাসূল (ﷺ) উম্মু সালামাকে দুটি যাতা, একটি কলসী এবং খুরমার বাকলে ভর্তি একটি চামড়ার বালিশ দান করেছিলেন। উম্মু সালামা ছিলেন খুবই সুন্দরী ও লজ্জাবতী মহিলা। তাই দাম্পত্য জীবনে স্বাভাবিক হতে একটু বিলম্ব হয়। নবী করীম (ﷺ) তার গৃহে আসতেই তিনি লজ্জায় কন্যা যয়নবকে কোলে নিয়ে বসে থাকতেন। বিয়ের পর ৪ জন সন্তান-সন্ততিসহ উম্মু সালামা নবীজীর গৃহে আসেন এবং সংসার জীবন শুরু করেন। নবী স্ত্রীগণ দুটি দলে বিভক্ত ছিলেন। এর একটির নেতৃত্বে ছিলেন আয়েশা (রা) এবং অপরটির নেতৃত্বে ছিলেন উম্মু সালামা (রা)।
উম্মু সালামার বিচক্ষণতা
উপস্থিত বুদ্ধির জোরে উম্মু সালামা (রা) হদায়বিয়ার সন্ধির সময়ে যে সংকটের সৃষ্টি হয়েছিল তা থেকে উত্তরণে রাসূলকে সহযোগিতা করেছিলেন। ঘটনাটি ছিল হুদায়বিয়ার সন্ধি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর রাসূল সেখানেই সকলকে কুরবানী করার নির্দেশ প্রদান করেন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে কেউই রাসূল (ﷺ)-এর হুকুম মত কাজ করেন নি। বরং চুপচাপ বসেছিলেন। আসলে বাহ্যত হুদায়বিয়ার সন্ধিটা ছিল বাহ্যিকভাবে মুসলমানদের স্বার্থের বিরুদ্ধে। যে কারণে মুসলমানেরা খুবই মনঃকষ্টে ভুগছিলেন।
রাসূল (ﷺ) কুরবানী করার জন্য পর পর তিনবার নির্দেশ দেন কিন্তু তবুও ৫ মুসলমানেরা যখন কুরবানী না করে চুপ রইলেন তখন অত্যন্ত বিষন্ন মনে তিনি নিজ তাঁবুতে ফিরে গেলেন এবং উম্মু সালামার কাছে পূর্বাপর সকল কিছু খুলে বললেন। উম্মু সালামা তখন রাসূলকে বললেন, আপনি কাউকে কিছুই বলবেন না বরং বাইরে গিয়ে নিজের কুরবানী নিজে করে ফেলুন এবং ইহরাম ত্যাগ করার জন্য মাথার চুল কেটে ফেলুন। তাঁর কথামত রাসূল বাইরে বেরিয়ে এসে নিজের কুরবানী নিজে করলেন এবং মাথা মুড়িয়ে (ন্যাড়া করে) ফেললেন। এরপর দেখা গেল একে একে সবাই রাসূল (ﷺ)-এর অনুসরণে কুরবানী করলেন এবং ইহরাম ত্যাগ করলেন। এমন কি মাথা মুড়ানোর জন্য মোটামুটি ভিড় লেগে গিয়েছিল যে, কার আগে কে মাথা মুড়াবে।
বুঝা যায় উম্মু সালামা (রা) কেমন বুদ্ধিমতি মহিলা ছিলেন। তার বুদ্ধিভিত্তিক ও মনস্তাত্বিক সিদ্ধান্তের কারণেই সেদিন বড় ধরনের সংকট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়েছিল। এ ব্যাপারে ইমামুল হারামাইন বলেছেন, মহিলা জগতের ইতিহাসে সঠিক সিদ্ধান্ত দানের এত বড় দৃষ্টান্ত আর নেই।’ (যুরকানী ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-২৭২)
তাঁর মেধা
উম্মু সালামা সম্পর্কে মাহমুদ বিন লবিদ বলেন, ‘যদিও মহানবী (ﷺ)-এর সকল পত্নী আল্লাহর রাসূলের প্রচুর হাদীস স্মৃতিতে ধারণ করেছিলেন, তবু তাদের মধ্যে আয়েশা (রা) এবং উম্মু সালামা (রা)-এর কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না। তিনি রাসূল (ﷺ)-এর মতই সুন্দর সুরে কুরআন তিলাওয়াত করতে পারতেন এবং ছাত্রদের শেখাতেন। তিনি রাসূল (ﷺ)-এর প্রত্যেকটি কথা অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে শুনতেন, মনে রাখতেন এবং আমল করার চেষ্টা করতেন। মুসনাদে আহমদ গ্রন্থে ইবনে কিয়াম লিখেছেন, “উম্মু সালামার ফতোয়াসমূহ যদি একত্রিত করা যায় তাহলে তা দিয়ে একটি ক্ষুদ্র পুস্তিকা তৈরি হতে পারে।”
হাদীস শিক্ষা ও সম্প্রসারণে উম্মু সালামা (রা)-এর অবদান
হাদীস শিক্ষা ও বর্ণনায় উম্মু সালামা (রা)-এর অবদান অনস্বীকার্য। হাদীস বর্ণনা ও প্রচারে আয়েশা (রা)-এর পরেই তার স্থান। এ সম্পর্কে মাহমূদ ইবনে লবীদ বলেন
كثيرا ولا گان ازواج النبي * بحفظ من حديث النبي لا يعايشة و أم سلمة.
“রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর স্ত্রীগণের বহু হাদীস মুখস্থ ছিল। তবে আয়েশা ও উম্মু সালামা (রা)-এর কোন প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না”। (আনসাবুল আশরাফ, ১ম খণ্ড, পৃ. ৪১৫; হায়াতুস সাহাবা)
হাদীস শুনার প্রতি উম্মু সালামা (রা)-এর প্রবল আগ্রহ ছিল। একদিন তিনি চুলের বেনী বাধাচ্ছিলেন। এমন সময় রাসুভাষণ দেয়ার জন্য মসজিদের মিম্বারে দাঁড়ালেন। তিনি কেবল, “ওহে লোক সকল! বলেছেন, আর অমনি উম্মু সালামা (রা) চুল বিন্যস্তকারিণীকে বললেন, ‘চুল বেঁধে দাও।’ সে বললো, এত তাড়াহুড়া কিসের? কেবল তো ওহে লোক সকল! বলেছেন। উম্মু সালামা (রা) বললেন : আমরা কি লোক সকলের অন্তর্ভুক্ত নই। অত:পর তিনি নিজেই চুল বেঁধে দ্রুত উঠে যান এবং দাঁড়ানো অবস্থায় রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পূর্ণ ভাষণটি শুনেন। (মুসনাদ আহমাদ, ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃ. ৬৯৭)
এমনিভাবে হাদীস শিক্ষার প্রতি তার যেমন তীব্র আকাঙ্ক ছিল, তেমনিভাবে হাদীস বর্ণনা ও সম্প্রসারণের প্রতিও ছিলেন তিনি যথেষ্ট সজাগ ও যত্নবান। তিনি রাসূলুল্লাহ ছাড়াও তাঁর পূর্ব স্বামী আবু সালামা ইবনে আব্দুল আসাদ (মৃ.৪/৬২৫) এবং নবী কন্যা ফাতিমা (রা) (মৃ.১১৬৩২) থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন। (তাহযীবুত তাহযীব, ১২শ খন্ড, পৃ. ৪৮৩)।
তার থেকে বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা ৩৭৮টি। তন্মধ্যে ১৩ (তের) টি মুত্তাফাকুন আলাইহি। আর এককভাবে ইমাম বুখারী (র) ৩ (তিন) টি এবং ইমাম মুসলিম ১৩ (তের) টি হাদীস বর্ণনা করেছেন। সিয়ারু আ’লামিন নুবালা। মুসনাদ আহমাদ, ৬ষ্ঠ খণ্ড, ২৮৯-৩২৪ পৃষ্ঠায় তাঁর হাদীসগুলো সংকলিত হয়েছে। আমাদের পরিসংখ্যান অনুযায়ী তার থেকে বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা পুনরুক্তিসহ সহীহ আল-বুখারীতে ৪৮টি, সহীহ মুসলিমে ৩৯ টি, জামে’ আত-তিরমিযীতে ৩৯ টি, সুনান আবু দাউদে ৫০ টি, সুনান আন নাসাঈতে ৬৮ টি এবং সুনান ইবনে মাজায় ৫২ টি সংকলিত হয়েছে। উম্মু সালামা (রা)-এর থেকে বর্ণিত হাদীসে শারঈ বিধি-বিধান, ইবাদত, সামাজিক, রাজনৈতিক, পারিবারিক, নারী বিষয়ক, পবিত্রতা, শিক্ষা, চিকিৎসা প্রভৃতি বিষয় স্থান লাভ করেছে। নিম্নে তার বর্ণিত হাদীস থেকে বিষয় ভিত্তিক দু’একটি করে হাদীস উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা হলো।
শারঈ বিধান বিষয়ক
أن امراة من أسلم قال .. عن أم سلمة (رضی) زوج النبي لها بي، كانت زوجها توی عثها وهى بلى، قطبها أبو السنابل بن بنگ، قابث أن تثير. قال : والله ما بل أن تثكيه تشي تشتيى أخر الأجنبي، نگفت تریبا تین عشر ليال، ثم جاءت النبي نال إثليجي.
১. উম্মু সালামা (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, সুবাই’আ নামে আসলাম গোত্রের এক মহিলার স্বামী মারা যায়, সে ছিল গর্ভবতী। (গর্ভপাত হওয়ার পর) আবুস সানাবিল ইবনে কাক তাকে বিবাহের প্রস্তাব দিলে সে তা অস্বীকার করলো। অত:পর লোকটি বলল : আল্লাহর কসম। দু ইদ্দতের শেষ ইদ্দত অর্থাৎ চার মাস দশ দিন অতিক্রান্ত না হওয়া পর্যন্ত তোমার বিবাহ করা ঠিক হবে না। মহিলাটি দশ দিন পর্যন্ত অবস্থান করলো। অতঃপর নবী কারীম-এর কাছে এসে এ সব কথা জানাল। নবী বললেন : তুমি বিবাহ করতে পার। (সহীহ আল বুখারী, ২য় খণ্ড পৃ-১৩৯; মুসনাদে আহমদ, ২য় খণ্ড, পৃ. ৮০২)
۲. عن لبنان بي بنار أنه سأل أم سنة (رضي) عن الرجل يصبح جبا أصوم و قالت : كان رسول الله يصبح جب ثم يصوم .
২. সুলায়মান ইবনে ইয়াসার উম্মু সালামা (রা)-কে জিজ্ঞেস করলেন, যদি কেউ ভোরে নাপাকী হয়ে যায় ঐ দিন রোযা রাখতে পারবে উর্দু সালামা (রা) বললেন : নবী-ভোরে জুনুবী (অপবিত্র হয়ে উঠলেও ঐ দিন রোযা রাখতেন। (সহীহ মুসলিম, ১ম খণ্ড, পৃ. ৩৫৪)
من شرب 3. عن أم سلمة (رضی) ثالث : نال رسول الله في اناء من دهب وفضة نائما يجرجر في بطنه نارا من
৩. উম্মুল মু’মিনীন উম্মু সালামা (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী . বলেছেন, যে ব্যক্তি রূপা বা সোনার পাত্রে পান করল, সে যেন তার পেটে দোযখের আগুন ভর্তি করল। (বুখারী ২য় খণ্ড, পৃ-১৩৯)
وعنده .. عن أم سلمة (رضی) تالت : كثت عند النبي نمونه قاب إبن أم مكتوم و ذلك بعد أن أمرنا بالحجاب . تال: احتجا مثه تلنا:يارسول الله و اليس أعمى؟ لا بتصرا ولا بعرفنا قال النبي صلى الله عليه وسلم : اعتبار آن انتماء السما بصرانه.
৪. উম্মু সালামা (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন : আমি নবী -এর কাছে ছিলাম। সেখানে মায়মূনাও (রা) ছিলেন। ইবনে উদ্ম মাকতুম আসলেন। এটা পর্দার বিধান নাযিল হবার পরের ঘটনা। নবী বললেন, তোমরা তার থেকে পর্দা কর। আমরা বললাম : হে রাসূল সে তো অন্ধ, আমাদেরকে দেখতেও পারছে না, চিনতেও পারছে না। নবী বললেন : তোমরা কি অন্ধ, তোমরা কি তাকে দেখতে পাচ্ছো না? (সুনানে আবু দাঊদ, ২য় খন্ড, পৃ. ৫৬৮)
ইবাদত বিষয়ক
.. عن أم سلمة (رضی) أن النبي و اشتبنظ لبل؛ قال : ماذا أنزل الله من الفتنة، ما ذا أنزل من الخير انني من واجب الحجرات : الأرب محاسبة في الدنيا عارية بون في الآخرة .
৫. উম্মু সালামা (রা) হতে বর্ণিত। নবীর কোন এক রাতে ঘুম থেকে জেগে বললেন : সুবহানাল্লাহ! কতই না ফিতনা এবং ধনভাণ্ডার এ রাতে নাযিল হয়েছে। এমন কে আছে যে, হজরার অধিবাসীদেরকে জাগাবে? এমন অনেক লোক আছে যারা দুনিয়ায় কাপড় পরিধান করছে, অথচ আখিরাতে তারা হবে
.. عن أم سلمة (رض) قالت : شكوت إلى النبي أشتكي، قال : وفي من وراء الناس وانت راكبة، تطفت و رسول الله صلى إلى جانب البيت، وهو بشرا بالطور و گناب مسطور .
৬. উম্মু সালামা (রা) বলেন, হজ্জে আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট অসুস্থতার অভিযোগ করলে তিনি বললেন : সাওয়ারে আরোহিনী হয়ে লোকদের পিছনে পিছনে তুমি তাওয়াফ কর। আমি তাওয়াফ করলাম, আর রাসূলুল্লাহ কাবা গৃহের পার্শ্বে সূরা তুর পাঠ করে সালাত পড়ছিলেন। (মুসলিম ১ম খণ্ড, পৃ.৪১৩)
أن ۷. عن أم سلمة (رض) قالت : علمني رسول الله أقول عند أذان المغرب : اللهم ان هذا البان كبلك و انبار اي فاغفرلي. نهارك و أصوات
৭. উম্মু সালামা (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ আমায় মাগরিবের আযানের পরে এ
اللهم إن هذا إثبان لبلة وادبار نهارك وأصوات عانى فاغفرلي .
রাতের আগমন, দিবসের পশ্চাত গমন এবং আপনার আহ্বানের আওয়াজ।
۸. عن أم سلمة (رضی) قالت : ما رأيت النبي و بوم شهرين متتابعين الأ شعبان و رمضان.
৮. উম্মু সালামা (রা) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন : আমি নবীকে শাবান ও রমযান মাস ছাড়া অন্য কোন মাসে ক্রমাগত দু’ মাস রোযা রাখতে দেখিনি।
عن زينب بنت أبي سلمة عن أم سلمة (رضی) زوج النبي ه أن رسول الله له شيع جثة شم باب حجرته تخرج البهم قال : إنما أنا بشر وانه بانيني الصم تكتمل بثينهم ابل بين بعض احس انه صادق تاثضی که من نضبت له بي مسلم قائما هى قطع من النار،
৯. যয়নব বিনত আবু সালামা (রা) উম্মু সালামা (রা) থেকে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ তার হজরার দরজায় ঝগড়াকারীদের আওয়াজ শুনতে পেলেন। তাদের নিকট বের হয়ে এসে বললেন : আমি একজন মানুষ। ঝগড়াকারীরা আমার নিকট আসে। তাদের একেক জন অন্য জনের চেয়ে অধিক বাকপটু। আমার মনে হয় যে, সে সত্য বলেছে। অতঃপর তার পক্ষে আমি রায় দিয়ে দেই। কোন মুসলমানের অধিকার হরণ করে কারো পক্ষে রায় চলে গেলে, তার জানা উচিত সেটা হলো দোজখের আগুনের একটা টুকরা। সে ইচ্ছা করলে সেটা বহন করতে পারে, আবার ত্যাগও করতে পারে। (মুসলিম, ২য় খণ্ড, পৃ. ৭৪)।
রাজনৈতিক বিষয়ক
أنه قال : ستثم ۱۰. عن أم سلمة (رض) عن النبي علبگم امرا تتعرفون و تثبیرون نم گره برى، و من آنگر ت سلم ولكن من رضى وتابع . تالوا يا رسول الله الا قاتلهم ؛ قال : لا، ما صلوا .
১০. উম্মু সালামা (রা) নবীন থেকে বর্ণনা করেন। রাসূলুল্লাহ বলেছেন : এমন কিছু শাসক তোমাদের ওপর নিয়োগ করা হবে। তোমরা তাদেরকে চিনবে এবং অস্বীকার করবে। যে ব্যক্তি অপছন্দ করবে সে নিষ্কৃতি পাবে। আর যে অস্বীকার করবে, সে নিরাপত্তা লাভ করবে। কিন্তু যে তুষ্ট হবে এবং অনুগত্য প্রকাশ করবে সে ক্ষগ্রিস্ত হবে। লোকজন বলল : হে আল্লাহর রাসূল আমরা কি তাদের সাথে যুদ্ধ করবো? নবী বললেন : না, যতক্ষণ পর্যন্ত তারা সালাত পড়ছে। (মুসলিম ২য় খন্ড, পৃ. ১২৮-১২৯)
অর্থনৈতিক বিষয়ক
۱۱. عن أم سلمة (رض) قالت : قلت يا رسول الله ان يي أجر إن أثنت علی بن ابی سك انتا می بینی؛ قال النبى : آنفقى علبهم قلك أجر ما أثقلت عليهم.
১১, উম্মু সালামা (রা) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন : আমি রাসূলুল্লাহকে বললাম আবু সালামার সন্তান-সন্ততি-তারা আমার সন্তান তাদের ওপর আমি যদি সম্পদ ব্যয় করি তবে কি আমার পুণ্য হবে নবী বললেন : তুমি তাদের জন্য ব্যয় কর। এর প্রতিদান তুমি অবশ্যই পাবে। (বুখারী, ১ম খণ্ড, পৃ. ১৯৮)
۱۲. عن أم سلمة (رضی) قالت : كث البس أوضاها من ذهب . فقلت يا رسول الله أنه قال : ما بلغ أن تؤدى زكاته
১২. উম্মু সালামা (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন ; আমি স্বর্ণালংকার পরে রাসূলুল্লাহকে বললাম, ইহা কি সঞ্চিত ধন ভাণ্ডারের অন্তর্ভুক্ত। রাসূল বললেন : তা নিসাব পরিমাণ হলে এবং তার যাকাত আদায় করলে তা সঞ্চিত ধনের মাঝে গণ্য হবে না। (আবু দাউদ, ১ম খণ্ড, পৃ. ২১৮)
পরিবার ও পারিবারিক বিষয়
لما تزوج أم سلمة ۱۳. عن أم سلمة (رض) أن رسول الله أقام عندما ثلاثا ، وقال : إنه ليس بك على أشيك وان، إن شثت سب لك بم بنائی۔
১৩, উম্মু সালামা (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ তাকে বিবাহ করে তিন দিন তার কাছে অবস্থান করলেন এবং বললেন : আমি এমন কাজ করবো না যার কারণে তোমাকে তোমার লোকদের মধ্যে অপমানিত হতে হবে। তুমি যদি চাও তবে সাত দিন তোমার কাছে কাটাবো। যদি সাত দিন তোমার কাছে কাটাই, তবে আমার অন্যান্য স্ত্রীদের কাছেও সাতদিন করে কাটাবো। (বুখারী ১ম খণ্ড, পৃ. ২৮৯)
14. عن أم سلمة (رضی) ئالت : لم بگن ثوب أحب إلى من يبص. رسول الله
১৪. উম্ম সালামা (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন : কামীস-এর চেয়ে কোন পোশাকই রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট অধিক প্রিয় ছিল না। (মুসনাদে আহমদ, ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃ.-২৫০)
পবিত্রতা বিষয়ক
۱۰. عن أم سلمة (رضی) قالت : إن امرأة من المسلمين ا ثر : إنها ثالث با رسول الله ایی امراة وقال الجنابة ، قال : إنما يعني أن تخشى راسي افانت علبه تئا.
১৫. উম্মু সালামা (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন : জনৈকা মুসলিম মহিলা রাসূলুল্লাহকে বললেন : আমার চুল খুব ঘন ও ঝুটি বাঁধা। আমি কি জানাবাত হতে পবিত্র হওয়ার জন্য চুল কমিয়ে ফেলবো? নবী বললেন : তিনবার চুলে পানি ঢালাই তোমার জন্য যথেষ্ট হবে। (আবু দাউদ, ১ম খণ্ড, পৃ. ৩৩)।
كان يقتلها وهو صائم 16. عن أم سلم (رضی) أن النبي
১৬. উম্মু সালামা (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন : নবী রোযা অবস্থায় তাকে চুম্বন দিতেন এবং তাঁরা দুজন একই পাত্র থেকে গোসল করতেন। (মুসনাদে আহমাদ, ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃ. ৩৪৩)
শিক্ষা বিষয়ক
۱۷. عن عبد الله بن ابی ملبئ عن أم سلمة (رضی) آنها بسم الله الرحمن غيرها قراءة رسول الله ذكرت او گل الرحيم الحمد لله رب العالمين . الرحمن الرحيم . مالك يوم الي . بقطع قرائته أية أ.
১৭. আব্দুল্লাহ ইবন আবু মুলায়কা উম্মু সালামা (রা) থেকে বর্ণনা করেন। উন্ম সালামা (রা) রাসূলুল্লাহ -এর কুরআন পাঠ প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে বিসমিল্লাহ্-এর পর সূরা ফাতিহার প্রথম তিনটি আয়াত উল্লেখ করে বললেন : রাসূলুল্লাহর প্রতি আয়াতে থেমে থেমে তিলাওয়াত করতেন। (আবু দাউদ, ২য় খণ্ড, পৃ. ৫৫৬।)
চিকিৎসা বিষয়ক
۱۸. عن أم سلمة (رضی) أن النبي * رأى في بينها جارية . فقال : استرقوا لها فإن بها النظرة . في وجهها
১৮. উম্মু সালামা (রা) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন : নবীন তার ঘরে এক মেয়েকে দেখলেন, যার চেহারায় কালো কুচকে দাগ পড়ে গিয়েছে। নবী বললেন : দুআ পড়ে তাতে ফুঁক দাও। কেননা এতে নজর লেগেছে।
এরূপ অনেক গুরুত্বপূর্ণ হাদীস আমরা তার থেকে লাভ করে থাকি।
উম্মু সালামা (রা) অতিশয় লাজুক প্রকৃতির মহিলা ছিলেন। বিয়ের পর রাসূল (ﷺ) যখন উম্মু সালামা (রা)-এর ঘরে আসতেন তখন তিনি লজ্জার কারণে মেয়ে যয়নবকে কোলে করে বসে থাকতেন। এ অবস্থা বেশ কিছু দিন বহাল ছিল। তারপর ধীরে ধীরে পরিস্থিতির উন্নতি হয়। উম্মু সালামা (রা) ছিলেন অত্যন্ত আমলদার একজন মহিলা। বিদায় হজ্জের সময় তিনি অসুস্থ ছিলেন। কিন্তু যথার্থ ওজর থাকা সত্ত্বেও যখন তিনি রাসূল (ﷺ)-এর সাথে গমন করেন, তখন রাসূল তাওয়াফ সম্পর্কে বললেন, “উম্মু সালামা, ফজরের সালাত চলাকালে উটের পিঠে সওয়ার হয়ে তুমি তাওয়াফ করবে।’
তিনি মাসে সোমবার, বৃহস্পতিবার ও জুমাবার রোযা রাখতেন। কুরআনের পবিত্রতার আয়াত তার ঘরেই নাযিল হয়। তিনি সালাতের মুস্তাহাব সময় ত্যাগ করা লোকদের উদ্দেশ্যে বলেন, নবীজী যোহরের সালাত তাড়াতাড়ি পড়তেন, আর তোমরা আছরের সালাত তাড়াতাড়ি পড়।’ উম্মু সালামা উদার হাতে দান-খয়রাত করতেন। তিনি একটি খেজুর হলেও তা ভিখারীর হাতে দিতে বলেছেন।
রাসূল (ﷺ)-এর ইন্তেকালের পর উম্মু সালামা (রা) স্বামীর স্মৃতি ধরে রাখার জন্য তার চুল মুবারক একটা রূপার কৌটায় সংরক্ষণ করে রাখেন এবং দর্শনার্থীদের দেখাতেন। উম্মু সালামা (রা) চমৎকার স্বাস্থ্যের অধিকারিণী ছিলেন। তিনি তৎকালীন আরবের একজন রূপবতী মহিলা ছিলেন। রাসূল (ﷺ)-এর কোনো সন্তান তার ঔরসে জন্মগ্রহণ করেন নি। পূর্ববর্তী স্বামী আবু সালামার ঘরে তার দু’পুত্র সালামা ও ওমর এবং দু’ কন্যা দুররা ও বাররা জন্মগ্রহণ করেন। বারবার নাম রাসূল পরিবর্তন করে রাখেন যয়নব। সালামা বড় হলে হামযা (রা)-এর কন্যা উসামার সাথে বিয়ে দেন। দ্বিতীয় পুত্র ওমর আলী (রা)-এর শাসনামলে ফারেস ও বাহরাইনের শাসনকর্তা ছিলেন।
ওফাত
উম্মুল মু’মিনীন উম্মু সালামা (রা) ৬৩ হিজরী সনে ৮৪/৮৫ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। উম্মুল মু’মিনীনদের মধ্যে তিনিই সর্বাপেক্ষা দীর্ঘায়ু লাভ করেছিলেন। আবু হুরায়রা (রা) জানাযার সালাত পড়নি। জানাযা শেষে তাকে মদীনার জান্নাতুল বাকীতে সমাধিস্থ করা হয়।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন