নবী করীম (ﷺ)-এর বহু বিবাহের সমালোচনার প্রতিবাদ

নবী করীম (ﷺ)-এর বহু বিবাহের সমালোচনার প্রতিবাদ

ইয়াহুদী-খ্রিস্টানসহ ইসলাম ও মুসলিম বিদ্বেষী জ্ঞানপাপী খোদাদ্রোহীরা একাধিক স্ত্রী রাখার ব্যাপারে রাসূল (ﷺ)-এর কঠোর সমালোচনা এবং তার মর্যাদার ওপর কটাক্ষ করতে দেখা যায়। তারা বিশ্বনবী ও বিশ্বসংস্কারক পূত পবিত্র চরিত্রর অধিকারী রাসূল (ﷺ)-এর পবিত্র চরিত্রের ব্যাপারে প্রশ্ন তোলেন। রাসূল তাঁর পবিত্র যৌবনের সিংহভাগ সময় ব্যয় করেন তার থেকে ১৫ বছর বড় একজন বিধবা নারীকে স্ত্রী বানিয়ে। প্রথম স্ত্রী খাদিজা (রা)-এর ইন্তেকালের পর তার বয়স যখন ৫১/৫২ বছর তখন তার মাঝে নারীভোগের চেতনা আসল তা কখনো বিশ্বাসযোগ্য নয়।

মুসলমানদের অন্তরে সন্দেহের বীজ রোপণ করা এবং ইসলামের প্রবর্তক বিশ্বনবীর প্রতি অমুসলিমদের অন্তরে ঘৃণা আর অসমর্থনের মনোভাব সৃষ্টি করাই হচ্ছে মূলত: এদের অহেতুক অপপ্রচারের আসল ও ব্যর্থ উদ্দেশ্য। কোন কোন মুসলিম যুবকের ইয়াহুদী প্ররোচনার জবাবে অপারগতা এবং দুর্বলতা প্রকাশ হয় বিধায় এ সম্পর্কে কিছু লেখার প্রয়োজন মনে হচ্ছে। অন্যথায় এরূপ সমালোচনাকারীদের সমালোচনার প্রতিবাদে কলম ধরার কোন প্রয়োজন ছিল। অসত্যের মুকাবিলায় সত্যের সম্মুখে নতশির হওয়ার লোক এরা নয়। সঠিক তথ্য অবগত হওয়ার পরও ওরা বিভ্রান্তি বর্জন করে না। ওদের এরূপ ভূমিকার বিবরণ দিয়ে আল্লাহ ইরশাদ করেন-

لما جاء هم ما عروا كفروا به لعنه الله على الكافرين.

অর্থ: জ্ঞাত বস্তু তাদের নিকট আসলে তারা তা প্রত্যাখ্যান করে, কাফেরদের ওপর আল্লাহর অভিশাপ। (সূরা-২ আল বাক্বারা : আয়াত-৮৯)

نائهم لا بگونه (أي بثلون ان رسول الله، ولكن الطالبين بأبنات اللي بجدون .

অর্থ: তারা আপনাকে মিথুক বলে না, (অর্থাৎ, আপনি রাসূল তা তারা জানে) কিন্তু জালেমরা আল্লাহর আয়াতসমূহ অস্বীকার করে থাকে। (সূরা-৬ আন’আম : আয়াত-৩৩)

তাই এদের ভিত্তিহীন সমালোচনার মুখোশ উন্মোচন এবং সঠিক তত্ত্ব প্রকাশের তাগিদে আমরা বলতে চাই যে, অধিক বিবাহ রাসূল (ﷺ)-এর চরিত্র মাধুরী, তাঁর দয়া-মায়া, উদারতা, ধৈর্য-সহ্য, শিষ্টাচারিতা, মহত্ব এবং নবুওয়াতের উৎকর্ষতার পরিচায়ক। কেননা –

১. যৌবনের ২৫তম বয়সে টগবগে যুবক বিশ্বনবী সমাজের নিকট নির্মল ও পূত-পবিত্র চরিত্রের প্রতীক হিসেবে পরিগণিত ছিলেন। যৌবনের তাড়নায় উদভ্রান্ত হয়েছেন, অপকর্মে সাড়া দিয়েছেন, এমনকি কোন মহিলার প্রতি এরূপ মন-মানসিকতা নিয়ে ভ্রুক্ষেপ করেছেন, তার ঘোর শক্ররাও তার প্রতি এমন দোষারোপ করতে সাহস করেনি। ৪০ বছর বয়সের মহিলা খাদীজাকে বিবাহ করেন, তাও নিজের খাহেশে নয়, বরং খাদীজার প্রস্তাবে। তখন তার বয়স ছিল ২৫ বছর। যৌবনের পুরো সময়, গোটা যৌবনকাল এরূপ এক বয়স্কা মহিলাকে নিয়েই কাটিয়ে দেন, আর কোন বিবাহ করেননি। তার ৫০ বছর বয়সের সময় ৬৫ বছর বয়স্কা স্ত্রী খাদীজার মৃত্যু হয়। যদি তিনি নারী ভোগের কামনায় উদ্বেলিত স্বভাবের হতেন, তাহলে এ দীর্ঘসময় আরো দু-চারটি বিবাহ করে নিতেন। কারণ আরবের সেরা সুন্দরীরা তাকে বিয়ে করতে আগ্রহী ছিলেন। কারণ এটাই ছিল যৌবনের আসল মুহূর্ত, এ মুহূর্তেই নারীভোগের প্রতি মানুষের আকর্ষণ অধিক হয়ে থাকে।

খাদীজা (রা)-এর আগেও আরো দুইটি বিবাহ হয়েছিল। রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ও মানবিক কারণেই তাকে বিবাহ করেন। ২৫ বছর বয়সে একজন বয়স্কা মহিলাকে বিবাহ করে যৌবনের পুরো সময় তাকে নিয়ে কাটিয়ে দেয়া সমালোচনাকারীদের অসারতা প্রমাণের জন্য যথেষ্ট নয় কি? যাদের অন্তর ব্যাধিমুক্ত, যারা ন্যায় ও নিরপেক্ষ বিচারক, যারা শুভবুদ্ধির অধিকারী, তাদের জন্য এতটুকুই যথেষ্ট। খাদীজা (রা)-এর মৃত্যুর পর অবশ্যই তিনি একাধিক বিবাহ করেছেন। কিন্তু কেন করেছেন, কোন প্রয়োজনে করেছেন, এ ব্যাপারে সমালোচনাকারীদের চক্ষু অন্ধ হলেও বুদ্ধিজীবি এবং সঠিক পর্যালোচনাকারীদের চক্ষু অন্ধ নয়।

২. খাদীজা (রা)-এর মৃত্যুর পর বিশ্বনবী সাওদা (রা)-এর মত একজন বিধবা মহিলাকে বিবাহ করেন। ইসলামের প্রথম আহ্বানে সাড়া দিয়ে ইসলাম গ্রহণের পর মক্কার জালেম কাফেরদের নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে স্বামী সুকরান মৃত্যুবরণ করলে বৃদ্ধা এ মহিলার জীবনে নেমে আসে চরম নৈরাশ্য ও হতাশা। মোটা স্বাস্থ্যের অধিকারীণী ও অনুভূতিহীনা এই বিধবাকে কে বিবাহ করবে তাকে কে আশ্রয় দেবে! কারও তার প্রতি আকর্ষণ নেই। হাবশায় হিজরতকারিণী দুঃখিনী বিধবা বৃদ্ধা মহিলাকে বিবাহ করে তার প্রতি করুণা এবং সহনশীলতা প্রদর্শন করা বিশ্বনবীর পক্ষেই সম্ভব হয়েছে। কারণ এমন কোন মানবের পক্ষে সম্ভব নয় যে, নিজের বয়সের চেয়ে ৪ বছর বড় বা সমান এবং মোটা নারীকে বিবাহ করে জীবন কাটানো।

৩. এরপর তিনি আয়েশা (রা)-কে বিবাহ করেন। স্ত্রীদের মধ্যে কেবল আয়েশাই ছিলেন কুমারী। আল্লাহর ইশারাতেই এ বিবাহ কাজ সম্পাদিত হয়। তখন আয়েশা (রা)-এর বয়স ছিল ৬/৭ বছর আর রাসূল (ﷺ)-এর বয়স ছিল ৫২ বছর। আবু বকর সিদ্দীক (রা)-এর মত একজন নিঃস্বার্থ কর্মীর মন জয় করাও একটি অন্যতম কারণ। তার সাথে বন্ধুত্বকে সুদৃঢ় করার তাগিদেও এ বিবাহ ছিল একটি উপযুক্ত উপায় এবং পদক্ষেপ। আবু বকর সিদ্দীক (রা) ছিলেন প্রথম ইসলাম গ্রহণকারী একজন নির্ভিক মুসলিম। সততা, সরলতা ও শিষ্টাচারিতার কারণে আরব সমাজে একজন নির্ভরযোগ্য ও বিশেষ ব্যক্তিত্ব হিসেবে তাকে মূল্যায়ন করা হত। তিনি হলেন ইসলাম এবং ইসলামের মহানবী মুহাম্মাদ-এর জানমাল কুরবানকারী প্রধান ব্যক্তিত্ব। তার কন্যা ব্যতীত কে বিশ্বনবীর স্ত্রী হওয়ার মর্যাদার অধিকারিণী হতে পারে সে ব্যতীত কে হতে পারে উম্মুল মু’মিনীনের শিরোপার অধিকারিণী? এ বিবাহের ফলশ্রুতিতে সৃষ্ট সম্পর্ক এবং আনুগত্যের ফলে আবু বকর সিদ্দীক (রা)-এর ইসলাম প্রচার প্রসারের ভূমিকা তাকে মুসলিম উম্মার সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তি এবং নবীর প্রধান খলীফার মর্যাদায় সমাসীন করেছে।

৪. এরপর ওমর (রা)-এর কন্যা হাফসাকে তিনি বিবাহ করেন। তার প্রথম স্বামী খুনাইস ইনে হ্যাফা ওহুদের যুদ্ধে শাহাদাত বরণ করার পর রাসূল (ﷺ) বিবাহ করেন। বিধবা হাফসার চিন্তাগ্রস্ত পিতা ওমর (রা) স্বীয় কন্যার আশ্রয় খুঁজে আবু বকর এবং উসমানের নিকট বিবাহ প্রস্তাব করেন। সেখান থেকে ব্যর্থ হওয়ার পর অধিচিত্তে রাসূল (ﷺ)-এর মহান দরবারের শরণাপন্ন হন। এমনকি আবু বকর এবং উসমানের মত প্রাণপ্রিয় বন্ধুদের অসম্মতি প্রকাশের অসহনীয় বেদনার কথাও বিশ্বনবীর গোচরীভূত করেন। এ মুহূর্তে রাসূল ওমর (রা)-কে সান্ত্বনা দিয়ে ইরশাদ করেন : হাফসাকে তাদের তুলনায় উত্তম ব্যক্তি বিবাহ করবে। ওমর (রা)-কে সান্ত্বনা প্রদান, মুসলিম উম্মার শ্রেষ্ঠতম দুজন মহামানবের মধ্যে সমঝোতা সৃষ্টি এবং হিজরতকারিণী বিধবা হাফসার প্রতি আন্তরিকতা প্রদর্শনের তাগিদে এ বিবাহ যে কত গুরুত্বপূর্ণ এবং উপযুক্ত পদক্ষেপ ছিল তা বলাই বাহুল্য।

৫. এরপর রাসূল যয়নব বিনতে খুযাইমা (রা)-কে বিবাহ করেন। তার প্রথম স্বামী উবায়দা ইবনে হারিছ বদরের যুদ্ধ সূচনাকারী তিন জনের একজন ছিলেন। বদরের যুদ্ধে আহত হয়ে উবায়দার শাহাদাত বরণ করার পর আশ্রয় হিসেবে রাসূল যয়নবকে বিবাহ করেন, কিন্তু বিবাহের ৮ মাস পর রাসূল (ﷺ)-এর জীবদ্দশায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

৬. এরপর রাসূল উম্মু সালামা (রা)-কে বিবাহ করেন। উম্মু সালামা (রা)-এর প্রথম স্বামী আবু সালামা রাসূল (ﷺ)-এর দুধ ভাই ছিলেন। স্ত্রীকে নিয়ে হাবশা এবং মদীনায় হিজরত করেন। আবু সালামা বদর এবং ওহুদ উভয় যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এবং ওহুদের যুদ্ধে আহত হয়ে শাহাদাত বরণ করেন। দুই দুইটি হিজরত অতঃপর স্বামীর শাহাদাত বরণের কারণে উম্মু সালামা (রা) অসহায় এবং দুঃখ-কষ্টের চরম সীমায় উপনীত হন। রাসূল (ﷺ)-এর চাচাতো এবং দুধ ভাই আবু সালামার এতীম সন্তানাদির প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করে দুধ শরীক ভাইয়ের হক আদায় করা রাসূল (ﷺ)-এর জন্য একান্ত কর্তব্য ছিল। উম্মু সালামা (রা) ছিলেন উচু খান্দান এবং সম্মানী বংশের মহিলা। ইসলাম এবং মুসলমানের জন্য ছিল তার অসাধারণ ত্যাগ ও কুরবানী। স্বামীর মৃত্যুর কারণে এতীম সন্তানাদির লালন-পালন কষ্টে একাকী জীবন যাপন দুরূহ হয়ে পড়েছিল। এমতাবস্থায় এই বিবাহ তার প্রতি বিশ্বনবীর সহানুভূতি বৈ অন্য কিছু নয়।

৭. এরপর নবী করীম (ﷺ)-এর আপন ফুফাতো বোন যয়নব বিনতে জাহাশ (রা)-কে বিবাহ করেন। তার প্রথম বিবাহ হয় রাসূল (ﷺ)-এর অত্যন্ত প্রিয় গোলাম পালকপুত্র যায়েদ ইবনে হারেছার সাথে। এ বিবাহের মূল কারণ ছিল জাহেলী যুগের গলদ প্রথার মূলোৎপাটন করা। কেননা সে যুগে পালকপুত্রকে আপন পুত্র মনে করা হত এবং পালকপুত্রের স্ত্রীকে পালক পিতার জন্য বিবাহ করা হারাম মনে করা হত। এ কুপ্রথার মূলোৎপাটনের জন্যই এ বিবাহ অনুষ্ঠিত হয়।

৮. এরপর রাসূল বনু মুসতালিকের মহিলা জুওয়াইরিয়াকে আযাদ করে তাকে বিবাহ করেন। পিতা গোত্র প্রধানের প্রস্তাবে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার তাগিদেই এ বিবাহ কাজ সম্পন্ন হয়। ফলে সাহাবায়ে কেরাম রাসূল (ﷺ) -এর প্রতি সম্মান প্রদর্শনম্বরূপ বিনা শর্তে এবং বিনিময় গ্রহণ করা ব্যতীত বনু মুসতালিকের সমস্ত বন্দীকে মুক্ত করে দেন। আর তারা সকলেই ইসলাম গ্রহণ করে। বস্তুত: এ বিবাহ ছিল বনু মুসতালিকের জন্য বিরাট রহমত এবং বরকতস্বরূপ এবং সমগ্র মুসলিম জাতির জন্য একটি শিক্ষণীয় আদর্শ।

৯. এরপর রাসূল (স) আবু সুফিয়ানের কন্যা উম্মু হাবীবাকে বিবাহ করেন। তার প্রথম বিবাহ হয় উবায়দুল্লাহ ইবনে জাহাশের সাথে । উম্মু হাবীবা (তার প্রথম স্বামীর সাথে হাবশায় হিজরত করেন। কিন্তু উবায়দুল্লাহ সেখানে মুরতাদ হয়ে মৃত্যুবরণ করে। হাবশা থেকে আসার পর দুঃখিনী বিধবা মহিলার প্রতি সমবেদনা এবং সম্মানস্বরূপ মক্কার কাফেরদের অবিস্মরণীয় নেতা আবু সুফিয়ানের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের একান্ত প্রয়োজনে এ বিবাহ ছিল খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।

প্রকারান্তরে এ বিবাহের কারণে রাসূল (ﷺ)-এর প্রতি তার শত্রুতার চেতনা শিথিল হয়ে পড়ে, আন্তরিকতা বৃদ্ধি পায় এবং ইসলাম ও মুসলমানের বিরুদ্ধে তার অভিযান একেবারেই বন্ধ হয়ে যায়। বরং তার অন্তরে লুক্কায়িত অনুভূতির ফল মক্কা বিজয়ের সুপ্রভাতে প্রকাশ্যে ইসলাম গ্রহণের সূরতে প্রকাশ পায়। তার ইসলাম গ্রহণ মক্কার হাজার হাজার কাফেরদের জন্য ইসলাম গ্রহণের পথ সুগম করে। তিনি তার জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ইসলামের বীর মুজাহিদ ও একনিষ্ঠ নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বিভিন্নমুখী অভিযান ও রণকৌশলে এবং বুদ্ধি পরামর্শের জন্য যেমন ছিলেন তিনি বিশ্বনবীর লক্ষ্যের পাত্র, তেমনি ছিলেন সমস্ত সাহাবায়ে কেরামের জন্য বিশেষ কেন্দ্রবিন্দু। তিনি এবং তার আনুগত্যকারী সকলেই ইয়ারমুক ও শামসহ বিভিন্ন যুদ্ধ অভিযানে গুরুত্বপূর্ণ এবং অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।

১০. এরপর ইয়াহুদীদের ঐতিহাসিক নেতা হুয়াই ইবনে আখতাবের কন্যা খায়বারের যুদ্ধে বন্দীকৃত সফিয়া ইসলাম গ্রহণে ধন্য হলে রাসূলতাকে আযাদ করে বিবাহ করেন। ইয়াহুদী নেতা হুয়াই ইবনে আখতাব এবং ইয়াহুদী সম্প্রদায়ের সাথে সম্পর্ক স্থাপন, তাদেরকে ইসলামী আক্বীদা বিশ্বাসের প্রতি আকৃষ্টকরণের জন্য এ বিবাহ ছিল অত্যন্ত উপকারী। এরা একজন নবীয়ে উম্মীর শুভাগমনের কথা তাওরাত এবং ইঞ্জীলের সূত্রে অবহিত ছিল। অবহিত ছিল বলেই তারা গোপনে বিশ্বনবীর বিষয়ে সম্পূর্ণ বিশ্বাসী ছিল কিন্তু পরশ্রীকাতরতা এবং শত্রুতা ছিল তাদের জন্য বাধা। এমতাবস্থায় সন্ধি চুক্তিতে আবদ্ধ ইয়াহুদীদের শত্রুতার অগ্নি নির্বাপিতকরণ এবং ইসলামের প্রতি তাদের সমর্থন ও আনুগত্য আদায়ের কামনা বাসনার নিরিখে এ বিবাহ ছিল অত্যন্ত ফলদায়ক উপায় ও কৌশল।

১১. এরপর রাসূল মাইমূনা বিনতে হারিছকে বিবাহ করেন। তিনি হচ্ছেন আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস, খালেদ ইবনে ওয়ালীদ, এবং জাফর তাইয়্যারের সন্তানাদির খালা। ২৬ বছর বয়সে তিনি বিধবা হন। হিজরী ৭ সনে কাজা উমরা আদায় করে ফেরার পথে তায়ীম নামক স্থানের নিকটবর্তী এলাকা ছারিফ নামক স্থানে রাসূল (ﷺ)-এর সাথে তার বিবাহ হয়। একজন সম্মানী দুঃখিনী বিধবা মহিলাকে আশ্রয় দেয়া এবং উম্মতের সম্মুখে আদর্শ স্থাপন করাই ছিল বিশ্ব নবীর এ বিবাহের মূল উদ্দেশ্য। এটা ছিল রাসূল (ﷺ)-এর সর্বশ্রেষ্ঠ বিবাহ। তারপর রাসূল (ﷺ)-এর নিকট রায়হানা ও মারিয়া কিবতিয়া (রা) হাদিয়া স্বরূপ আসলে তাদেরকে প্রথমে দাস হিসেবে রাখার সিদ্ধান্ত নিলে তাদের পছন্দ মোতাবেক ও আল্লাহর নির্দেশে তাদেরকে উম্মাহাতুল মু’মিনীনদের অন্তর্ভুক্ত করেন। অবশ্য কারো কারো মতে রায়হানা ও মারিয়া কিবতিয়া (রা) রাসূল (ﷺ)-এর স্ত্রীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না। তারা ছিলেন রাসূল (ﷺ)-এর দাসী।

রাসূল মূলত কয়েকটি কারণে একাধিক বিবাহ করেছেন-

১. আসলে ওহুদ যুদ্ধে ৭০ জন সাহাবী শহীদ হওয়ার ফলে ইসলামের সেই প্রথম যুগেই বিধবাদের একটি লম্বা কাফেলা দাঁড়িয়ে যায়। যারা ছিলেন একান্তই অসহায়। কারণ মুসলমান হওয়ার কারণে তাদের আত্মীয়-স্বজনরা তাদেরকে একটু আশ্রয় পর্যন্তও দিতে রাজি ছিল না। এমতাবস্থায় রাসূল (ﷺ) এ অসহায় মুসলমান বিধবা মহিলাদেরকে বিয়ে করার জন্য সাহাবীদেরকে উৎসাহ দিতে থাকেন। নিজেও এ ব্যাপারে এগিয়ে আসেন।

২. আত্মীয়তার সম্পর্ক বাড়ানোর জন্য।

৩. পারিবারিক একান্ত বিষয়গুলোকে উম্মতকে জানানোর জন্য।

৪. পোষ্যপুত্রের স্ত্রী বিয়ে করা যায় এ বিধান চালু করার জন্য।

৫. মুখটাকা ভাইয়ের মেয়েও বিবাহ করা যায় তা বাস্তবায়ন করণার্থে।

৬. একান্তই ইসলামের স্বার্থে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণে।

৭. সর্বোপরি আল্লাহর নির্দেশে সকল বিয়ে অনুষ্ঠিত হয়। এখানে একটি বিষয় পরিষ্কার হওয়া প্রয়োজন যে, চারের অধিক বিবাহ করা অবৈধ ঘোষিত হওয়ার পূর্বেই রাসূল (ﷺ)-এর এ সব বিবাহ হয়েছিল। নিষেধাজ্ঞার আয়াতে অতিরিক্ত স্ত্রীদেরকে তালাক দিতে বলা হয়নি। আল্লাহ ইরশাদ করেন –

بابها الثبى انا أحللنا لك أزواجك التي أثبت أجورهن وما لگن ببب ما أنا، الله علية بنات عتة وبنات مايك بنات الك ونات الأتك التي هاجون من د وامرأة مؤمن إن وهبت نفسها للنبي إن أراد النبي أن ي ثيرها خالصة لك من دون المؤمنين ما قد علمناما ترضنا عليهم في أزواجهم وما ملكت أيمانهم يكبلا بگون عليك تخرج مد وكان الله غفوراربما.

অর্থ: হে নবী! যাদের মোহরানা আদায় করেছেন আপনার জন্য সে স্ত্রীদেরকে হালাল করেছি এবং আপনার করায়ত্ব দাসীদের আপনার জন্য হালাল করেছি। আর আপনার চাচাতো, ফুফাতো, মামাতো এবং খালাতো বোন যারা আপনার সাথে হিজরত করেছে তাদেরকে বিবাহের জন্য হালাল করেছি এবং কোন মুমিন নারী নিজেকে নবীর নিকট সমর্পণ করলে নবী তাকে বিবাহ করতে ইচ্ছা পোষণ করলে তাও হালাল। এটা কেবল আপনার জন্য; অন্য কোন মুমিনের জন্য হালাল নয়। যাতে আপনার কোন অসুবিধা না হয়। মু’মিনদের স্ত্রী এবং দাসীদের ব্যাপারে আমি যা নির্ধারণ করেছি তা আমার জানা আছে। আল্লাহ ক্ষমাশীল পরম দয়ালু। (সূরা আহযাব : আয়াত-৫০)

চারের অধিক বিবাহের এ বিষয়টি বিশ্বনবী এবং তার স্ত্রীদের জন্য একান্ত ব্যতিক্রমধর্মী একটি বিষয়। তাছাড়া রাসূলায় শারীরিকভাবে ৪০ জন পুরুষের শক্তি রাখতেন। এরূপ ব্যতিক্রম আরো অনেক ব্যাপারে রয়েছে। যেমন ; তার প্রতি বাধ্যতামূলক কিয়ামুল্লাইল, বিরতিহীন রোজা এবং তার পরিবারের পক্ষে যাকাত ফিতরা গ্রহণ করা হারাম হওয়া, তার কোন উত্তরাধিকারী না থাকা, নবীর স্ত্রীদের প্রতি গোনাহের শাস্তি অধিক নির্ধারণ করা, অধিক নেক আমল করার বাধ্যতামূলক নির্দেশ ইত্যাদি। এ সবকিছুই বিশ্বনবী এবং তার পত্নীদের জন্য একান্ত এবং ব্যতিক্রমী নির্দেশ। আল্লাহ ইরশাদ করেন –

بانساء النبي من بات منگن بفاحشة مبينة بضاعف لها العذاب ضعفيني ، وكان ذلك على الله يسيرا . ومن يقتت مشگن لله ورسوله وعمل صالحا وتها أجرها مرتين واعتدنا لها رزقا گریما.

অর্থ: হে নবী পত্নীগণ! তোমাদের কেউ অশ্লীল কাজ করলে তাকে দ্বিগুণ শাস্তি দেয়া হবে। যা আল্লাহর জন্য খুবই সহজ। আর যে আল্লাহর এবং তার রাসূলের অনুগত হবে আর নেক কাজ করবে আমি তাকে দুবার পুরস্কার দিব এবং আমি তার জন্য সম্মানজনক রিযিক প্রস্তুত রেখেছি। (সূরা আহযাব : আয়াত-৩০-৩১) এরপর অধিক বিবাহ থেকে রাসূলকে নিষেধ করা হয়েছে। আল্লাহ ইরশাদ করেন-

حل كك التاين بث ولا أن تبدل به من أزواج وكو أعجبك سنه الأ ما ملكت يمينك وكان الله على

অর্থ: এরপর কোন নারী আপনার জন্য হালাল নয় এবং তাদের পরিবর্তে অন্য স্ত্রী গ্রহণ করাও হালাল নয়, তাদের রূপলাবণ্য আপনাকে মুগ্ধ করলেও। (সূরা আহযাব : আয়াত-৫২)

চারের অধিক স্ত্রীদেরকে তালাক দেয়ার নির্দেশ না দেয়ার পিছনে তাদের প্রতি এহসান, দয়া-মায়া, মানবতা প্রদর্শন ইত্যাদি হেকমত বিদ্যমান রয়েছে। যদি তাদের কতককে তালাক দেয়া হত, তাহলে তারা বিরাট বিপদের সম্মুখীন হত, তাদের কোন আশ্রয় থাকত না। কেননা বৃদ্ধা রূপহীনা বিধবাদেরকে বিবাহ করতে কেউ সম্মত হতনা। অপরপক্ষে এ বিবাহসমুহের বর্ণিত উদ্দেশাবলী সম্পূর্ণ ভাবেই বিনষ্ট হত। তাদেরকে সম্মান প্রদর্শনের পর অসম্মান প্রদর্শন করা হত, খাতামুন্নাবী এবং শ্রেষ্ঠ নবীর স্ত্রী হওয়ার সৌভাগ্য অর্জনের পর তাদেরকে অপদস্ত করা হত। যদি রাসূল তাদেরকে তালাক দিতেন, তাহলে তা হত তার শিষ্টাচারিতা এবং উত্তম চরিত্রের জন্য বিরাট কলংক। তিনি সমগ্র বিশ্ব সৃষ্টির প্রতি রহমতস্বরূপ আল্লাহর এই ঘোষণার অবমাননা সাব্যস্ত হত। বস্তুত: তাদেরকে তালাক দেয়া শ্রেষ্ঠ নবী এবং বিশ্বনবীর জন্য মোটেই শোভনীয় হত না। তাছাড়া আল্লাহ তাআলা রাসূল (ﷺ)-এর স্ত্রীদেরকে মুসলমানদের জননী ঘোষণা করেছেন। এ ঘোষণার মাধ্যমে উম্মতের পক্ষে নবী পত্নীদের সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। ইরশাদ হয়েছে –

النبي اولى بالمؤمنين من انفسهم وازواجه أمهاتهم.

অর্থ: নবী মু’মিনদের নিকট তাদের নিজেদের অপেক্ষা অধিক ঘনিষ্ঠ আর তার স্ত্রীগণ তাদের মাতা। (সূরা আহযাব: আয়াত-৬)

এ সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে নবীর স্ত্রীদেরকে বিবাহ করা উম্মতের জন্য হারাম করা হয়েছে। নবীপত্নীদেরকে বিবাহ করা নবীর প্রতি অবমাননা এবং নবীর সাথে অসদাচরণ হিসেবে এটা অমার্জনীয় অপরাধ বলে গণ্য। আল্লাহ ইরশাদ করেন –

وما كان لكم أن تؤذوا رسول الله و أن تنكحوا ازواجه من بعده أبدا ، إن ذلگم كان عند الله عظيما

অর্থ: আল্লাহর রাসূলকে কষ্ট দেয়া এবং তার ওফাতের পর তার পত্নীদেরকে বিবাহ করা তোমাদের জন্য হালাল নয়। এটা আল্লাহর নিকট বড় অপরাধ । (সূরা আহযাব : আয়াত-৫৩)

ইসলামের শত্রু এবং পরশ্রীকাতর লোকদেরকে রাসূল (ﷺ)-এর সমালোচনা করে এ কথাও বলতে শোনা যায় যে, তিনি ৫৩ বছর বয়সে অল্প বয়সের কুমারী কন্যা আয়েশাকে বিবাহ করলেন কি করে? কিন্তু এদের এরূপ সমালোচনা আমাদের দৃষ্টিতে মাকড়সার জালের মত। আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন

منير العنكبوت ائت بیا د وان أوهن البيوت لبيت

অর্থ: তারা মাকড়সাতুল্য, যে ঘর বানায় আর সমস্ত ঘরের মধ্যে মাকড়সার ঘরই তো অধিক দুর্বল। (সূরা আনকাবুত : আয়াত-৪১)

‘অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে, অনেক মুসলমানকেও এ ব্যাপারে সন্দিহান এবং দুর্বলমনা প্রতীয়মান হয়। তারা এ ব্যাপারে প্রশ্নের সম্মুখীন হলে অথবা কেউ এ ব্যাপারে তাদেরকে কু-ধারণা দিলে তারা হতভম্ব এবং কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে। চোখে মুখে কোন দিশা পায় না, আবার অনেকে তো তাদের সাথে হ্যা মিলিয়ে জাহান্নামের পথে ধাবিত হয়ে যায়। এর জবাবে আমরা বলতে চাই যে, হে মুসলিম সমাজ! এ বিষয়টিকে শক্রদের দৃষ্টিতে বিবেচনা করা সমীচীন নয়। সাদাকে কালো, সুন্দরকে অসুন্দর, হালালকে হারাম এবং সম্ভবকে অসম্ভবের দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার বিশ্লেষণ করা সঠিক হবে না। মিথ্যা অপপ্রচারক, সত্য গোপনকারী, সত্যের সাথে অসত্য মিশ্রণকারী, গোমরাহ, পাপাচারী, অশ্লীল এবং ফ্লিমবাজদের গালগল্প, তাদের রচিত বইপুস্তক, প্রবন্ধ এবং নাটকের চশমায় রাসূল (ﷺ)-এর বিষয়গুলোর প্রতি দৃষ্টি আরোপ করা ন্যায়সংগত হবে না। বরং ইসলাম, ঈমান এবং ব্যাধিমুক্ত অন্তরে এ ব্যাপারটি বিবেচনা করতে হবে। আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের দুশমন কাফের মুনাফিক, ফাসেক, ফাজের কিয়ামতের হিসাব নিকাশে অবিশ্বাসীদের হাতিয়ার হওয়া মুসলমানদের জন্য মোটেই মঙ্গলজনক নয়।

কারণ এ বিবাহ রাসূল আবু বকর সিদ্দীক (রা), আয়েশা (রা) এবং মুসলিম জাতির জন্য অতীব বরকতময় এবং চিরন্তন আদর্শ। স্ত্রীদের মধ্যে আয়েশা (রা)-এর স্থান সবার উপরে । তাকে রাসূল (ﷺ) কুমারী অবস্থায় বিবাহ করেন। তার প্রতি ছিল রাসূল (ﷺ)-এর অফুরন্ত ভালবাসা, দয়া মমতা এবং একান্ত প্রেম। সুতরাং যে রাসূলের আনন্দে আনন্দ, তার খুশীতে খুশী এবং তার শান্তিতে প্রশান্তি বোধ করে না সে আবার কেমন মুসলমান? এতো ঈমানের দুর্বলতা, অন্তরের কলুষতা এবং মহব্বতের দাবীর অসারতার বাস্তব প্রমাণ। রাসূলের জন্য এবং তার উম্মতের জন্য আল্লাহ যা হালাল করেছেন তা হারাম করার অধিকার কার আছে? শ্রেষ্ঠ নবীর সাথে শ্রেষ্ঠতমা মহিলা আয়েশা  (

রা)-এর বিবাহ মহান রাব্বল আলামীনের তত্ত্বাবধানে তাঁর নির্দেশক্রমেই হয়েছে, তা কেউ অস্বীকার করতে পারে? বুখারী শরীফ, মুসলিম শরীফ ও তিরমিযী শরীফে বলা হয়েছে যে, আল্লাহর নির্দেশক্রমে স্বয়ং জিবরাঈল (ﷺ) রেশমের সবুজ কাপড় পরিহিত অবস্থায়। আয়েশা (রা)-কে রাসূল (ﷺ)-এর সম্মুখে হাজির করত বলেছিলেন যে, এ মহিলা ইহকাল এবং পরকাল উভয় জগতের জন্য আপনার স্ত্রী।

এ বিবাহের ব্যবস্থাপনায় আছেন একজন ফিরিশতা, অহীপ্রাপ্ত নবী, এবং নবীর পরম বন্ধু, ছাওর পাহাড়ের সাথী, পবিত্র কুরআনের ভাষায় শ্রেষ্ঠতম মানব আবু বকর সিদ্দীক (রা) এবং সমস্ত সাহাবায়ে কেরাম। আর আয়েশা (রা) হচ্ছেন উম্মুল মু’মিনীন, সমকালীন মহিলাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম মহিলা। যাদের নিকট পিতৃতুল্য বয়সের স্বামীর সাথে অপ্রাপ্ত বয়স্কার বিবাহ অযৌক্তিক এবং আলোভনীয় মনে হয়, তাদের চিন্তা-ভাবনা করা উচিত যে, তাদের এ চিন্তা ও উক্তি মহান আল্লাহকে দোষারোপ করার শামিল কি না? তাদের একথাও বিবেচনা করা বাঞ্ছনীয় যে, এখানে কোন রহস্য এবং স্বতন্ত্র কোন কিছু থাকতে পারে। রাসূল আয়েশার সাথে এমন শিষ্টাচারিতার সাথে ব্যবহার করতেন যে, আয়েশা বয়সে ছোট একথা তিনি কখনও বুঝতে পারতেন না। আর বয়সের কারণে ব্যবহারের তারতম্য না হওয়াই স্বাভাবিক ছিল। কারণ তিনি আল্লাহর প্রিয় এবং দয়ালু নবী ছিলেন।

পবিত্রতা চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য এবং আল্লাহ প্রদত্ত তীক্ষ্ণ বুদ্ধির অধিকারী ছিলেন তিনি। তিনি ছিলেন ন্যায়নিষ্ঠার প্রতীক। তিনি নবী হিসেবে যেমন ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ, তেমনি স্বামী হিসেবে এবং পরিবারের জন্যও শ্রেষ্ঠ এবং উত্তম ব্যক্তি হওয়াই স্বাভাবিক ছিল। প্রকারান্তরে এ বিবাহ তার রিসালাত এবং নবুওয়াতের জন্য ছিল উজ্জ্বল প্রমাণ। রাসূল (ﷺ)-এর সাথে জীবন-যাপনকালে আয়েশা (রা) কখনও ভাবতেও পারেননি যে, তিনি বস্তুজগতের নেয়ামত থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। আয়েশা (রা) যেমন ছিলেন কুমারী এবং সুন্দরী, তেমনি আল্লাহ তাঁর নবীকে অতি সুন্দর এবং যৌবন শক্তিতে পরিপূর্ণতা দান করেছিলেন। যৌবন শক্তি, যৌন প্রক্রিয়া এবং জীবন পরিক্রমায় তার কোন নজীর যুবকদের মধ্যেও ছিল না। তদুপরি তার প্রতি সদা সর্বদা অহী নাযিল হত। নবী হিসেবে রাসূল শারীরিক শক্তির প্রশ্নে বিশেষত্বের অধিকারী ছিলেন। অনেক সাহাবার মতে রাসূল (ﷺ) ৪০ জন শক্তিশালী পুরুষের সমান শক্তির একাই অধিকারী ছিলেন। তিনি ইচ্ছা করলে জীবন পক্তিতে পরিপূর্ণ সুন্দরী, তেমনি এ একই রাত্রে সমস্ত স্ত্রীদের সাথে মিলিত হতে এবং তাদের হক পরিপূর্ণভাবে আদায় করতে পারতেন, যা কোন সাধারণ লোকের পক্ষে মোটেও সম্ভব নয়। রূপ সৌন্দর্যের প্রশ্নে রাসূল (ﷺ)-এর কোন নজীর ছিল না। এমন কি ইউসুফ (a) -এর তুলনায়ও তিনি অধিক রূপ সৌন্দর্যের অধিকারী ছিলেন। কোন কোন সময় তা প্রকাশও পেয়ে যেত। সাহাবী বারা (রা) বলেন, রাসূল মধ্যম আকারের লোক ছিলেন। একদিন (পাড়ে কাজ করা) লাল রংয়ের পোষাক পরিহিত অবস্থায় রাসূলকে দেখেছি। এমন রূপের লোক আর আমি কোনদিন দেখিনি এবং শুনিওনি। এ বিবাহের কারণে আয়েশা (রা) যে পদমর্যাদার অধিকারী হন কোন বিবেক বুদ্ধির অধিকারী মহিলা তার আকাক্ষী না হয়ে পারে না। এ বিবাহের কারণেই তিনি শ্রেষ্ঠ নবীর প্রিয়তমা স্ত্রী এবং উম্মুল মু’মিনীন হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। জান্নাতের উচ্চমর্যাদার সুসংবাদ দুনিয়ার বুকেই লাভ করেন। পবিত্র কুরআনে তার প্রশংসার বর্ণনা বিদ্যমান রয়েছে। সূরায়ে নূরের প্রায় এগারোটি আয়াতে তার চারিত্রিক পবিত্রতা এবং উৎকর্ষতার কথা স্বয়ং আল্লাহ ঘোষণা করেছেন। এ গভীর তত্ত্ব এবং রহস্যময় প্রত্যেকটি আয়াতই মুসলিম উম্মাহ এবং সমগ্র মানব জাতির জন্য দিক নির্দেশনা প্রদান করেন। পূতঃপবিত্র এ সমাজ গড়ে তোলার জন্য এর প্রত্যেকটি আয়াতই সীমাহীন গুরুত্ব রাখে। তার পবিত্রতা এবং আদর্শ স্ত্রী হওয়ার কথা স্বয়ং আল্লাহ ঘোষণা করে ইরশাদ করেন

بو ون الطيبات للطيبين والطيبون للطيبات أولئ

অর্থ: সচ্চরিত্রা নারীগণ সচ্চরিত্র পুরুষের জন্য এবং সচ্চরিত্র পুরুষগণ সচ্চরিত্রা নারীদের জন্য। লোকেরা যা বলে তারা তা হতে সম্পূর্ণ পাক-পবিত্র, তাদের জন্য রয়েছে ক্ষমা এবং সম্মানজনক জীবিকা। (সূরা নূর : আয়াত-২৬)

হে আয়েশা! আল্লাহর পক্ষ থেকে আপনার পবিত্রতার বর্ণনা আপনার জন্য মুবারক হোক। আপনি যে কত মহান এবং কত মহান আপনার পদমর্যাদা! আয়েশার প্রতি অপবাদের বর্ণনা সম্বলিত আয়াত যতবার মানুষ তেলাওয়াত করবে, পাঠ করবে এবং গবেষণা করবে, তাদের অন্তরে আয়েশা (রা)-এর পবিত্রতা এবং চরিত্রগত নির্মলতা প্রস্ফুটিত হবে এবং হতে থাকবে।

আয়েশা (রা) বিশ্বনবীর জীবদ্দশাতেই বিশিষ্ট ফকীহা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে অসংখ্য মাসআলা-মাসায়েল তিনি রাসূল (ﷺ)-এর নিকট থেকে শিক্ষা লাভ করেন। ফলে সমকালীন এবং পরবর্তী যুগে নারী সমাজের অগণিত সমস্যাবলীর সমাধানের জন্য তিনি নবীর সরাসরি প্রতিনিধিত্ব করেন। সারা বিশ্বের লোকেরা বিশেষত: মহিলারা রাসূল (ﷺ)-এর জীবদ্দশায় এবং তার ওফাতের পর মদীনায় সমবেত হতেন। আর তিনি তাদেরকে আল্লাহ পাকের হুকুম-আহকাম এবং রাসূল (ﷺ)-এর সুন্নাতের তরবিয়াত করতেন। তার নির্দেশিত মাসআলা-মাসায়েল এবং বর্ণিত হাদীসমূহ ফিকাহের কিতাবসমূহে অদ্যাবধি সুসংরক্ষিত রয়েছে এবং মুসলিম উম্মাহ তার দ্বারা সীমাহীন উপকৃত হয়ে চলেছেন।

তার জীবদ্দশায় সাহাবায়ে কেরামও তার প্রতি মুখাপেক্ষী ছিলেন। রাসূল (ﷺ)-এর গভীর এবং রহস্যময় তত্ত্ব, তার ইবাদত, সালাত, সিয়াম, হজ্জ, উমরা, পানাহার, পোষাক-পরিচ্ছদ, বস্তু বিরাগিতা, দ্বীনতা-হীনতা, মুনাজাত-কান্নাকাটি, যুদ্ধ-সন্ধি, ভিতর-বাহির মোটকথা রাসূল (ﷺ)-এর আদর্শ জীবনের বিস্তারিত বিষয়াদি উম্মতের নিকট পৌছানো তিনি একনিষ্ঠ মাধ্যম এবং সূত্র। যাদের আয়েশা (রা)-এর জীবনী সম্পর্কে নূন্যতম জ্ঞান আছে তারা নিঃসন্দেহে একথা বলতে বাধ্য যে, বিশ্বনবীর আদর্শ জীবনকে সুসংরক্ষিত করে সঠিক সুন্দরভাবে উম্মতের নিকট পৌঁছানোর জন্য আল্লাহ আয়েশা (রা)-কে বিশেষভাবে নির্বাচন করেছিলেন এবং তিনি তার দায়িত্ব যথাযথভাবেই আদায় করেছেন। আয়েশা (রা)-এর বিবাহ আবু বকর সিদ্দীক (রা)-এর জীবনেও বিরাট প্রভাব বিস্তার করতে সমর্থ হয়। এ বিবাহের বরকতে আবু বকর সিদ্দীক (রা)-এর ঈমানী শক্তি, রাসূল (ﷺ)-এর সাথে বন্ধুত্ব বন্ধন, সিদ্দীকী মকাম, আত্মীয়তার সম্পর্ক ও আধ্যাত্মিক শক্তি বৃদ্ধি পায় এবং সুদৃঢ় হয়।

মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে বিশ্বনবী (ﷺ) সাহাবায়ে কেরাম তথা সমগ্র মুসলিম জাতিকে আবু বকর সিদ্দীক (রা)-এর মর্যাদা, উম্মতের প্রতি তার এহসান অবদান এবং কুরবানীর কথা উল্লেখ করে নিদর্শনস্বরূপ নির্দেশ দেন- “মসজিদের দিকের সমস্ত দরজা বন্ধ করে দাও, কেবলমাত্র আবু বকরের দরজা খুলে রাখ।” রাসূল (ﷺ)-এর এ অসিয়তের কারণে আজও আবু বকর সিদ্দীক (রা)-এর সে দরজা খোলা আছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত খোলা থাকবে। তাকে রাসূল “সিদ্দীক” খেতাবে ভূষিত করেন।

আয়েশা (রা) বিশ্ব মুসলিম নারী সমাজের জন্য এক অবিস্মরণীয় আর্দশ। তিনি ১৯ বছর বয়সে বিধবা হন এবং ৬৭ বছর বয়স পর্যন্ত একাকী জীবন যাপন করেন। বিশ্বনীর অন্যান্য স্ত্রীর মত আয়েশা (রা)-এর বিবাহও উম্মতের ওপর হারাম করে দেয়া হয়। যৌবনের এ দীর্ঘ মুহূর্তে তিনি পাক পবিত্রতা, শিষ্টাচারিতা, সংযমশীলতা, দূরদর্শিতা, ধৈর্যশীলতা এবং আল্লাহভীরুতার পরিচয় দেন। কোনদিন তিনি স্বামীর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেননি। রাসূল (ﷺ)-এর স্ত্রী হিসেবে অর্জিত সম্মান মর্যাদাকে অক্ষুন্ন রাখেন, জান্নাতের সর্বোচ্চ স্থানে নবীর স্ত্রীর মর্যাদা লাভের গৌরবকে অগ্রাধিকার দেন। যে সমস্ত নারী যৌবনকালে বিধবা হয়ে যান এবং মৃত স্বামীর স্মরণে তার এতীম সন্তান-সন্ততির লালন পালনের তাগিদে অথবা তাকদীরের ফয়সালার কারণে অবিবাহিত জীবন যাপন করতে হয় আয়েশা (রা) তাদের জন্য উজ্জ্বল আদর্শ। আয়েশা (রা) প্রমাণ করেছেন যে, নারী সমাজ অতি মহান, তারা বস্তু পরাধীন নয়, তারা লোভাতুর নয়, তারা যৌবনের লাগামকে নিয়ন্ত্রণ করতে সুসক্ষম। আয়েশা (রা) ছিলেন বিশ্বনবীর পর বিশ্বজগতের প্রধান ব্যক্তিত্ব আবু বকর সিদ্দীক (রা)-এর কন্যা। ভদ্রতা শিষ্টাচারিতা, চারিত্রিক উৎকর্ষতা, আন্তরিক পবিত্রতা এবং ঈমানী শক্তির প্রশ্নে আবূ বকর সিদ্দীক (রা)-এর উত্তরসূরী।

বিবাহিত জীবনে নবীর সান্নিধ্যে, অহীর পরশে স্বয়ং রাসূলের সাহচর্যে সরাসরি বস্তু বিরাগিতার শিক্ষা গ্রহণ করেন। বস্তু সামগ্রী অথবা আল্লাহ এবং তার রাসূলকে গ্রহণের কথা স্ত্রীদেরকে বলা হলে মাতা-পিতা এবং মুরুব্বীদের পরামর্শ গ্রহণ উপেক্ষা করে আল্লাহ এবং আল্লাহর রাসূল ও আখেরাতকে গ্রহণের কথা সকল স্ত্রীদের পূর্বে আয়েশাই প্রথম ঘোষণা করেন। তিনি বয়সে ছোট হতে পারেন কিন্তু সেদিন তিনি নজীরবিহীন বুদ্ধিমত্তা, মেধা এবং দূরদর্শিতার পরিচয় দেন। আল্লাহ আয়েশা (রা) এবং নবীপত্নী সকলের প্রতি সন্তুষ্ট থাকুন। প্রসঙ্গত: এখানে পরিবার-পরিজন এবং আত্মীয়দের সাথে রাসূল (ﷺ)-এর আচার-ব্যবহার, চলাফেরা, উঠাবসা, কথাবার্তা, জীবন যাপন প্রণালী কেমন ছিল তা বর্ণনা করা যেতে পারে। তার জীবন ধারণ উপকরণ ছিল খুবই স্বাভাবিক। তার প্রয়োজনের অতিরিক্ত জীবনোপকরণ গ্রহণ না করার বিষয়টি সকলকে অবাক করে রাখত। কৃচ্ছতা অবলম্বন ছিল তার জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য দিক । আয়েশা (রা)-এর সূত্রে উরওয়া বলেন, রাসূল (ﷺ)-এর ঘরে মাসের পর মাস আগুন জ্বলত না, শুধুমাত্র খেজুর এবং পানির উপর যথেষ্ট করা হত। হ্যা কোন কোন সময় আনসারী সাহাবীগণ দুধ পাঠাতেন যা তিনি এবং তার পরিবার-পরিজন পান করতেন। রাসূল (ﷺ)-এর এ অবস্থা অভাব অনটনের কারণে নয়, কারণ তিনি বিশ্ব বিজয়ী ছিলেন, গনীমতের মালসহ রাষ্ট্রীয় কোষাগারেরও তিনি একচ্ছত্র অধিকারী ছিলেন। উম্মতের বেশুমার অর্থ সামগ্রী তার নিয়ন্ত্রণে ছিল। কিন্তু তাঁর হাত ছিল সম্পূর্ণ প্রশস্ত। তাই সবকিছুই তিনি গরীব মিসকীনদের স্বার্থে ব্যয় করে দিতেন, দান-খয়রাত করে দিতেন।

জাবের (রা) বলেন, রাসূল কোন প্রার্থনাকারীকে ফেরত পাঠাতেন না। আনাস (রা) বলেন, রাসূল (ﷺ)-এর নিকট যে কেউ প্রার্থনা করত সে এমনকি কোন কাফেরও প্রার্থনা করে বিমুখ হয়ে ফিরেনি। একবার জনৈক কাফের রাসূল (ﷺ)-এর দরবারে প্রার্থনা জানালে অসংখ্য বকরী দিয়ে তার নিকট ওজরখাহী করেন। কাফের লোকটি ছিল অত্যন্ত ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন। সে রাসূল (ﷺ)-এর দান-খয়রাতের প্রশস্ততা দেখে অনুপ্রাণিত হয় এবং স্বীয় সম্প্রদায়ের লোকদেরকে একত্রিত করে বলেন, হে লোকসমাজ! তোমরা সকলেই ইসলাম গ্রহণ কর, তাহলে তোমাদের অভাব-অনটন দূরীভূত হবে। এভাবে অনেক লোক অর্থ সম্পদের লোভে ইসলাম গ্রহণ করে। কিন্তু কিছুদিন রাসূল কোন এবং সাহাবীদের সাহচর্যে থাকার পর তাদের অন্তর থেকে বস্তু আকর্ষণ সমূলে নির্মূল হয়ে যেত এবং আল্লাহ ও তার রাসূল এবং ইসলামের আক্বীদা বিশ্বাস তাদের অন্তরে সুদৃঢ় হত। বস্তু সামগ্রী ও বস্তু আকর্ষণ পরিহারের এই অপূর্ব আদর্শ তিনি এবং তার পরিবার-পরিজনের নজীরবিহীন বৈশিষ্ট্য। এ পৃথিবী এর শোভাসামগ্রী যে ক্ষণস্থায়ী আর ঈমান আমলের প্রতিফল ও আখেরাতের জান্নাত যে স্থায়ী এবং চিরস্থায়ী একথা তার ভাল করেই বিশ্বাস ছিল। তাই তিনি আখেরাতের এবং জান্নাতের চিরস্থায়ী ভোগ সামগ্রী লাভের কামনায় দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী বস্তুসামগ্রী বর্জন করার উজ্জ্বল আদর্শ স্থাপন করেন, মানব জাতিকে এ আদর্শের প্রতি অনুপ্রাণিত করেন এবং তার দিকে আহ্বান জানান। ফকীর মিসকীন এবং অভাবগ্রস্ত লোকেরা বিশ্বনবী হন এবং তার পবিত্র পরিবার-পরিজনকে এমন অভাবগ্রস্ত এবং সম্বলহীন দেখতে পায় যার কোন নজীর নেই।

অপরপক্ষে ধনাঢ্য সমাজ নবী করীম (ﷺ) ও তার পরিবার-পরিজনের সংযমশীলতা, কৃচ্ছতা অবলম্বন পরিদর্শন করে প্রকৃত সাফল্যের সন্ধান পায়। সংযমশীলতা এবং বিলাসিতা পরিহারের দিক নির্দেশনা লাভ করে গরীব মিসকীনের প্রতি দান-খয়রাতের হাত প্রশস্তকরণে অনুপ্রাণিত হয়। মূলত: আল্লাহ তার নবীকে গরীব ধনী সকলের জন্যই আদর্শ নবী হিসেবে পাঠিয়েছিলেন। তিনি ইরশাদ করেন

لقد كان لكم في رسول الله أسوة حسنة لمن كان يرجو الله واليوم الأخر وذكر الله كثيرا.

অর্থ: যারা আল্লাহ এবং আখেরাতকে ভয় করে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে তাদের জন্য রাসূলের মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ। (সূরা-৩৩ আহযাব : আয়াত-৩৩)

রাসূল (ﷺ)-এর সাথে সীমাহীন অভাব অনটনের মধ্য দিয়ে কৃচ্ছতা অবলম্বন এবং সংকটময় জীবন যাপন করা প্রথম স্ত্রীদের জন্য অসহনীয় এবং কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। সে কারণে সকল স্ত্রী রাসূল (ﷺ)-এর দরবারে তাদের কষ্টের কথা ব্যক্ত করেন এবং এ ব্যাপারে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের আবেদন জানান। কিন্তু রাসূল (ﷺ) এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেন এবং কারো নিকট এ ব্যাপারে যোগাযোগ করতে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। এমতাবস্থায় আবু বকর সিদ্দীক (রা) এবং ওমর (রা) সহ সাহাবায়ে কেরাম ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য একাধিকবার অনুমতি প্রার্থনা করে ব্যর্থ হন। আবু বকর সিদ্দীক (রা) আয়েশা (রা)-এর প্রতি এবং ওমর (রা) হাফসা (রা)-এর প্রতি ক্ষিপ্ত হয়ে বলেন, সাবধান! তোমরা রাসূলকে বিরক্ত কর না এবং তার সামর্থ্যের বহির্ভূত কোন কিছু তার নিকট প্রার্থনা কর না। আয়েশা এবং হাফসা উভয়ই অনুতপ্ত হন এবং ভবিষ্যতে রাসূল (ﷺ)-এর নিকট কোন কিছু প্রার্থনা না করার প্রতিজ্ঞা ব্যক্ত করেন। এ মুহূর্তে নিম্নোক্ত আয়াত অবতীর্ণ হয়

ايها النبي قل لأزواجك إن ثمن بين الحياة الدنيا وزينتها قتالين أمتنگ واگن راحا جب . وان ردن الله ورسوله والدار الآخرة فان الله أعة گن بلتستان مشگن أجرا عظيما.

অর্থ: হে নবী! আপনি আপনার স্ত্রীদেরকে বলুন, তোমরা যদি পার্থিব জীবন এবং তার বিলাসিতা কামনা কর, তবে আস আমি তোমাদের জন্য ভোগসামগ্রীর ব্যবস্থা করে দিই এবং সৌজন্যের সাথে তোমাদেরকে বিদায় করি। আর যদি তোমরা আল্লাহ, তাঁর রাসূল এবং আখেরাত কামনা কর তবে তোমাদের মধ্যকার নেককারদের জন্য আল্লাহ মহাপুরস্কার প্রস্তুত করে রেখেছেন। (সূরা আহযাব : আয়াত-২৮-২৯)

এ আয়াত নাযিল হওয়ার পর রাসূল সর্বপ্রথম সর্বাধিক প্রিয়তমা স্ত্রী আয়েশাকে লক্ষ্য করে ইরশাদ করেন, হে আয়েশা! আমি তোমাকে একটি কথা বলব, তুমি তোমার মাতা-পিতার পরামর্শ ব্যতীত উত্তর প্রদানে তাড়াহুড়া কর না। আয়েশা (রা) বললেন, সে কথাটি কি? রাসূল মা তাকে আয়াত তিলাওয়াত করে আয়াতের সারমর্ম সম্পর্কে অবগত করলেন। আয়েশা (রা) বললেন, এ ব্যাপারে মাতা-পিতার সাথে পরামর্শ করার কোন প্রয়োজন নেই, আমি আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলকে গ্রহণ করলাম। এরপর পর্যায়ক্রমে রাসূল তাঁর সকল পত্নীকে আয়াতের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে অবহিত করলেন। তারা সকলেই একই পথ অবলম্বন করেন, বস্তু সামগ্রী এবং সহায় সম্পদের উপর আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলকেই প্রাধান্য দেন। মৃত্যু পর্যন্ত তারা আর কোন দিন দুনিয়া এবং দুনিয়াবী মরীচিকার প্রতি আকর্ষিত হননি বরং বস্তু বিরাগিতায় নিমগ্ন থাকেন। আবু সাঈদ মাকনূরী বলেন, বকরীর ভুনা গোশত নিয়ে লোকেরা আবু হুরায়রা (রা)-কে পানাহারের নিমন্ত্রণ জানালে তিনি এ বলে নিমন্ত্রণে সাড়া দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন যে, রাসূল কোনদিন ময়দার রুটি পেট পুরে পরিতৃপ্ত হয়ে আহার করনেনি। এমতাবস্থায় তিনি দুনিয়া থেকে বিদায় গ্রহণ করেছেন। আয়েশা (রা) বলেন, রাসূল ৩০ সা আটার বিনিময়ে স্বীয় ‘দেরা’ (লৌহ বর্ম) ইয়াহুদীর নিকট বন্ধক রেখে মৃত্যুবরণ করেন। এ আলোচনার পর যাদের অন্তর রোগাগ্রস্ত অথবা যারা আল্লাহ এবং রাসূলের চরম শত্রু, তারা ছাড়া আর কেউ রাসূল (ﷺ)-এর সমালোচনা করতে পারে কি? পারে কি এমন কটুক্তি করতে যার কঠোর নিষেধাজ্ঞা প্রদান করে আল্লাহ ইরশাদ করেছেন

ق وا بين يدي الله ورسوله . ايها الذين أمنوا

অর্থ: হে মু’মিনগণ! তোমরা আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের সামনে অগ্রণী হয়ে।’ (সূরা হুজরাত : আয়াত-১)

বস্তুত: ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান এবং ইসলাম প্রবর্তিত শরী’আত স্থান, কাল ও পাত্র নির্বিশেষে সকলের জন্য ব্যাপক এবং উপযুক্ত। ইসলামী শরী’আত পিতা-মাতা এবং অভিভাবকদেরকে মোটেই এ অধিকার দেয়নি যে, তারা হীন স্বার্থ অথবা ব্যক্তি ও অর্থ স্বার্থ উদ্ধারের জন্য কন্যাদেরকে কুফুবিহীন বিবাহে বাধ্য করবে। যার যা খুশী তাই করবে এতো নিরেট সীমালংঘন এবং জুলুম। ইসলাম ইনসাফের ধর্ম, কি করে ইসলামে এরূপ অনুমতি থাকতে পারে? কেউ যদি ইসলামকে এই মনে করে তাহলে এটা হবে তার মারাত্মক ভুল। যাতে মানুষ নারী সমাজকে পশ্চিমাদের মত ভোগবিলাসের উপকরণ মনে না করে এবং যাতে নারী সমাজের আল্লাহ প্রদত্ত সম্মান অক্ষুন্ন থাকে, এ জন্যই বিবাহ শাদীর ক্ষেত্রে ইসলামী শরীআতে জরূরী এবং প্রয়োজনীয় শর্তাবলী এবং বিধি-নিষেধ রাখা হয়েছে। কন্যার মতামত গ্রহণ, কুফুবিহীন বিবাহ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করা, কুরআন সুন্নাহ বিরোধী বিবাহ-শাদীকে বাতিল বলে ঘোষণা দেয়া, জালেম এবং অত্যাচারী স্বামীর অধিকার খর্ব করে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটানোর মুসলিম কাজীর অধিকার এরই অন্তর্ভুক্ত। ইসলাম বিশেষজ্ঞ মনীষীগণ বিবাহ সংক্রান্ত বিধি-নিষেধে স্থান, কাল, পাত্রের নিরিখে আললাচনা করে সে দর্শন এবং যুক্তির বিশদ বিবরণ প্রকাশ করেছেন, তাতে বিবাহ সংক্রান্ত আইন কানুনে ইসলামী শরী’আতের বৈশিষ্ট্য দিবালোকের ন্যায় সুস্পষ্ট হয়। সুস্পষ্ট হয় যে, ইসলামী নিয়ম শৃংখলাই স্থান, কাল এবং পাত্র নির্বিশেষে নারী সমাজের মান মর্যাদা এবং অধিকার সুসংরক্ষণে একমাত্র অদ্বিতীয় ব্যবস্থাপনা। তবে ইসলাম নাবালেগা অথবা অপ্রাপ্ত বয়স্কা ও বয়স্কদের ব্যাপারেও কোন কোন ক্ষেত্রে অনুমতি প্রদান করেছে। কিন্তু তা করেছে প্রয়োজন এবং বিশেষ অবস্থার খাতিরেই। যাতে মানুষ সেখানেই হীন স্বার্থ উদ্ধারের সুযোগ না পায় সেজন্য উপযুক্ত শর্তাবলী আরোপ করেছে। এ সমূহ শর্তাবলী উপেক্ষা করার মোটেই অবকাশ নেই।

তথ্যসূত্র

১. হাদীস চর্চায় মহিলা সাহাবীদের অবদান – ড. মোঃ শফিকুল ইসলাম

২. আহলে বাইত বা বিশ্বনবীর পরিবার – নাসির হেলাল, সুহৃদ প্রকাশনী

৩. আসহাবে রাসূলের জীবন কথা- মুহাম্মদ আবদুল মাবুদ; প্রথম প্রকাশ, ১-৩ খণ্ড। বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার।

৪. বিশ্বনবীর সাহাবী তালিবুল হাশেমী; অনুবাদ : আবদুল কাদের, দ্বিতীয় সংস্করণ, ১-৫ম খণ্ড, আধুনিক প্রকাশনী, ঢাকা।

৫. মহিলা সাহাবী- নিয়া ফতেহপুরী, আনুবাদ : গোলাম সোবহান সিদ্দিকী, তৃতীয় প্রকাশ- ১৯৯৫; আল ফালাহ পাবলিকেশন্স।

৬. রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সহধর্মিনীগণ- আলহাজ্জ মৌঃ মোঃ নূরুজ্জামান, দ্বিতীয় প্রকাশ-১৯৯৬, বাংলাদেশ তাজ কোম্পানী লিঃ।

৭. বিশ্বনবীর দাম্পত্য জীবন- ফজলুর রহমান মুন্সী। প্রথম প্রকাশ- ১৯৮৬। বাংলাদেশ তাজ কোম্পানী লিঃ, ঢাকা।

৮. আসমাউর রিজাল বা রাবী চরিত মাইন উদ্দিন সিরাজী, আল-বারাকা লাইব্রেরী, ঢাকা ।

৯. আসমাউর রিজাল বাংলা- আকূল মোহছেন আবদুল্লাহ আল মাহমুদ, প্রথম প্রকাশ ১৯৯৪, ছাহাবা প্রকাশনী, লক্ষ্মীপুর।

১০. বহুবিবাহ ইসলাম ও মুহাম্মদ আহমদ মনসুর, প্রকাশকাল- ১৯৯৫। তাসনিম পাবলিকেশন্স, মিরপুর ঢাকা।

১১. সংগ্রামী নারী- মোহাম্মদ নূরুজ্জামান, আধুনিক প্রকাশনী, ঢাকা।

১২. নবী পরিবারের প্রতি ভালবাসা- মাওলানা মাহমুদুল হাসান, মজলিসে ইলমী, দক্ষিণ যাত্রাবাড়ী, ঢাকা, আগস্ট- ১৯৯৫।

১৩. মহিলা সাহাবী তালিবুল হাশেমী, আধুনিক প্রকাশনী, ঢাকা, প্রথম প্রকাশ জুন-১৯৯০।

১৪. আর রাহীকুল মাখতুম । প্রকাশক- সোনালী সোপান

১৫. ইসলামী বিশ্বকোষ, বিভিন্ন খণ্ড – ইসলামী বিশ্বকোষ প্রকল্প, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ।

১৬. সংক্ষিপ্ত ইসলামী বিশ্বকোষ, ১ম ২য় খণ্ড – দ্বিতীয় সংস্করণ, নভেম্বর ১৯৮৭।

ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ।

অধ্যায় ২৩ / ২৩

সকল অধ্যায়

১. ১. উম্মুল মু’মিনীন খাদীজা (রা)
২. ২. উম্মুল মু’মিনীন আয়েশা (রা)
৩. ৩. উম্মুল মুমিনীন হাফসা (রা)
৪. ৪. মারইয়াম (আ)
৫. ৫. আছিয়া (আ)
৬. ৬. উম্মু সুলাইম (রা)
৭. ৭. যয়নব বিনত রাসূলুল্লাহ
৮. ৮. রুকাইয়া বিনত মুহাম্মদ
৯. ৯. উম্মু কুলছুম বিনত নবী করীম (ﷺ)
১০. ১০. ফাতিমা বিনত রাসূলিল্লাহ
১১. ১১. সুমাইয়া (রা)
১২. ১২. উম্মুল মুমিনীন সাদা বিনতে যামআ (রা)
১৩. ১৩. উম্মুল মুমিনীন যয়নব বিনতে খুযাইমা (রা)
১৪. ১৪. উম্মুল মু’মিনীন উম্মু সালামা (রা)
১৫. ১৫. উম্মুল মুমিনীন যয়নব বিনতে জাহাশ (রা)
১৬. ১৬. উম্মুল মু’মিনীন জুয়াইরিয়া (রা)
১৭. ১৭. উম্মুল মুমিনীন উম্মু হাবীবা (রা)
১৮. ১৮. উম্মুল মু’মিনীন সফিয়্যা (রা)
১৯. ১৯. উম্মুল মুমিনীন মায়মূনা (রা)
২০. ২০. উম্মুল মুমিনীন রায়হানা (রা)
২১. ২১. উম্মুল মু’মিনীন মারিয়া কিবতিয়া (রা)
২২. ২২. হালীমা (রা)
২৩. নবী করীম (ﷺ)-এর বহু বিবাহের সমালোচনার প্রতিবাদ

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন