২১. উম্মুল মু’মিনীন মারিয়া কিবতিয়া (রা)

২১. উম্মুল মু’মিনীন মারিয়া কিবতিয়া (রা)

রাসূল (ﷺ)-এর পবিত্র শ্রীগণ হলেন মুমিনদের জন্য মাতৃতুল্য। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন –

التبى أولى بالمؤمنين من النسيم وأزواجه أمهاتهم.

নবী মুমিনদের নিকট তাদের নিজেদের অপেক্ষা অধিক ঘনিষ্ঠ আর তার স্ত্রীগণ তাদের মাতা (সূরা আহযাব : আয়াত-৬)

তাই মুমিনদের মাতা ও রাসূল (ﷺ)-এর পবিত্রীগণ জান্নাতে যাবে এটাই স্বাভাবিক। যাদের সাথে রাসূল (ﷺ)-এর দাম্পত্য জীবন অতিবাহিত হয়েহে তারা জাহান্নামে যাবে আর রাসূল জান্নাতে থাকবেন এটা অসমৰ কথাও বটে। তাই রাসূল (ﷺ)-এর সাথে তাদের সম্পর্কের কারণেই তারা জান্নাতে যাবেন, এটাই দলিল তাদের জান্নাতে যাওয়ার।

হুদায়বিয়ার সন্ধি সংঘটিত হওয়ার পর রাসূল পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রগুলোতে রাষ্ট্রপ্রধানদের নিকট দূত মারফত ইসলাম গ্রহণের দাওয়াত সম্বলিত চিঠি প্রেরণ করেন। এ চিঠির প্রেক্ষিতে মিসরের খ্রিস্টান শাসক মুকাওকিস সৌহার্দ্র ও শুভেচ্ছার নির্দশনস্বরূপ আপন চাচাত বোন মরিয়ম বা মারিয়া কিবতিয়াকে রাষ্ট্রীয় পর্যাপ্ত উপঢৌকনসহ তৎকালীন প্রথানুসারে মুসলিম রাষ্ট্র প্রধান রাসূল (ﷺ)-এর দরবারে উপহারস্বরূপ প্রেরণ করেন।

অপর এক বর্ণনামতে উপঢৌকনস্বরূপ প্রেরিত মহিলার সংখ্যা ছিল চারজন। ইবনে কাহীরের বর্ণনামতে সবত অপর দুই মহিলা এ ভগ্নীদ্বয়ের খাদিমা (দাসী)-স্বরূপ ছিলেন। এ উপঢৌকনের সাথে মাবুর নামক একজন খোজা দাস (তিনি ছিলেন মারিয়ার ভ্রাতা) এবং দুলদুল নামক সাদা রংয়ের একটি খচ্চরও প্রেরিত হয়েছিল। আরও ছিল এক হাজার মিছকালে স্বর্ণ ও (বিশটি) রেশমী কাপড়, এগুলো প্রেরণ করা হয় রাসূল (ﷺ)-এর দূত হাতিব ইবনে আবী বালতা’আর মাধ্যমে। হাতিব (রা) তাদের নিকট ইসলামের দাওয়াত পেশ করলে মারিয়া ভগ্নীদ্বয় ইসলাম গ্রহণ করেন এবং মানূর পরে মদীনায় রাসূল (ﷺ)-এর হাতে ইসলাম গ্রহণ করেন।

রাসূল আন্তর্জাতিক রাজনীতির দিকে লক্ষ্য রেখে এ উপহার ও উপঢৌকন গ্রহণ করেন। এ সকল উপঢৌকন পাওয়ার পর সর্বপ্রথম রাসূল মারিয়ার নিকট ইসলামের দাওয়াত পেশ করেন। মারিয়া আনন্দের সাথে এ দাওয়াত কবুল করেন ও ইসলাম গ্রহণ করেন। এরপর মারিয়ার সম্মতিতে সম্পূর্ণ ইসলামী বিধান মোতাবেক রাসূল তাকে বিয়ে করেন। এভাবে মিসরের রাষ্ট্র প্রধান মূকাওকিসের উপহারের সঠিক মূল্যায়ন করেন। অন্য বর্ণনা মতে, রাসূল মারিয়াকে নিজের দাসী হিসেবে রাখেন এবং সীরীনকে হাসসান ইবনে ছাবিত (রা)-কে প্রদান করেন। তার গর্ভে ‘আবদুর রাহমান ইবন হাসসান জন্মগ্রহণ করেন। সপ্তম হিজরী সালের শেষের দিকে এ বিয়ে সংঘটিত হয়। এরপর রাসূল আর কোন বিয়ে করেন নি। আর আল্লাহর পক্ষ থেকেও রাসূল (ﷺ)-এর জন্য নতুন কোনো বিয়ে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে আয়াত নাযিল হয়। আল্লাহ বলেন

لأجل لك الا من بعد و أن تبدل بهن من ازواج ولو أعجبك شهن .

অর্থ । এরপর আর কোনো নারী আপনার জন্য হালাল নয় এবং তাদের পরিবর্তে অন্য স্ত্রী গ্রহণ করাও হালাল নয়। যদিও তাদের সৌন্দর্য আপনাকে আকর্ষিত করে।’ (সূরা-৩৩ আহাৰ : আয়াত-২)

অন্য বর্ণনা মতে, মারিয়া হলেন রাসূল (ﷺ)-এর বান্দী ও তাঁর পিতা হলেন শামউন। সমস্ত বান্দীদের মধ্যে রাসূল তাকেই পর্দা করার নির্দেশ প্রদান করেন। মারিয়া কিবতিয়ার গর্ভে জন্মগ্রহণ করে রাসূল (ﷺ)-এর অন্যতম পুত্র সন্তান ইব্রাহীম। আওয়ালী নামক স্থানে হিজরী ৮ম সালে তাঁর জন্ম হয়। এখানেই মারিয়া (রা) বাস করতেন। এখানে ইব্রাহীমের জন্ম হওয়ার কারণে স্থানটি মাশরাবাই ইব্রাহীম’ নামে পরিচিতি লাভ করে। ইব্রাহীমের জন্মকালে ধাত্রী নিযুক্ত ছিলেন প্রখ্যাত সাহাবী আবু রাফের পত্নী বিবি সালমা। তিনি যখন রাসূল -এর দরবারে হাজির হয়ে পুত্র সন্তান হওয়ার শুভ সংবাদটি দেন তখন রাসূল খুশি হয়ে তাকে একজন গোলাম দান করেন। ইব্রাহীমের জন্মের সংবাদে রাসূল খুব খুশি হন। সাতদিনের দিন তার আকীকা দেয়া হয় এবং মাথা মুড়িয়ে চুলের ওজন পরিমাণ রূপা গরীবদের মাঝে দান করে দেন। এ দিনেই মুসলিম জাতির পিতা ইব্রাহীম (আ:)-এর নামে তার নামকরণ করা হয় ইব্রাহীম।

সদ্য প্রসূত শিশু ইব্রাহীমকে দুধ পান করানোর জন্য অনেক আনসার মহিলা প্রার্থী হন। শেষে খাওলা বিনতু যায়দুল আনসারীকে দাই নিযুক্ত করেন। এ জন্য রাসূল (ﷺ) তাকে কয়েকটি ফলবান খেজুর গাছ দান করেন।

খাওলা বিনতে যায়দুল উলু রাফে নামেও পরিচিত ছিলেন। তিনি তার স্বামী বারা বিন আউদুর সাথে মদীনার উপকণ্ঠে বাস করতেন। বাবা পেশায় ছিলেন কর্মকার। এ জন্য তার বাড়ি প্রায়ই দেয়ায় আচ্ছন্ন থাকতো। তবুও রাসূল সন্তানের টানে প্রায়শ সেখানে যেতেন এবং ইব্রাহীমের খোঁজ খবর নিতেন। সতের বা আঠার মাস বয়সের সময়ে ইব্রাহীম ধাত্রী মাতা খাওলার গৃহেই ইন্তেকাল করেন। তাঁর মৃত্যু সংবাদ পেয়ে রাসূল সাহাবী আবদুর রহমানসহ সেখানে ছুটে যান। হাত বাড়িয়ে মৃত ইব্রাহীমকে কোলে তুলে নেন। আর তখনি রাসূল (ﷺ)-এর দুচোখ দিয়ে বাধ ভাঙা জোয়ারের মত পানি নেমে আসে। আবদুর রহমান আরজ করেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ আপনার অবস্থা এমন কেন? রাসূল বলেন, আজ আমার অপত্য স্নেহ অশ্রু বিন্দু হয়ে ঝরে পড়ছে। রাসূল তার প্রিয়তম পুত্রের মৃত্যুতে ভীষণ মর্মাহত হন। তার চক্ষু হতে অশ্রু প্রবাহিত হয়। এ অবস্থায় তিনি বললেন : চক্ষু অশ্রুভারাক্রান্ত, অস্তর ব্যথিত, কিন্তু মুখে এমন কথা বলতে পারি না যা আল্লাহ তা’আলা অপছন্দ করেন। হে ইবরাহীম! আমরা তোমার বিচ্ছেদে শোকাভিভূত। আল্লাহর নির্দেশমত আমরা (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন) পড়ছি। ফাদল ইবনে আব্বাস (রা) বা উম্মু বুরদা (রা) তাঁকে গোসল দেন। ছোট খাটিয়ায় করে জানাযা বহন করা হয়।

ইব্রাহীমের মৃত্যুর দিন ঘটনাক্রমে সূর্যগ্রহণ হয়েছিল। সকলে বলাবলি করতে লাগলো যে, রাসূল (ﷺ)-এর পুত্র মারা গেছে বলেই আজ সূর্যগ্রহণ হয়েছে। তারা বলতে লাগলো, আকাশ শোকাভিভূত হয়ে পড়েছে, সে জন্যই দুনিয়ায় বিদঘুটে অন্ধকার নেমে এসেছে। কিন্তু বিশ্ব সংস্কারক রাসূল যখন এ সংবাদ শুনলেন তখনই তিনি এ কুসংস্কারের মূলোৎপাটন করার জন্য সকলকে ডেকে বললেন, ‘সূর্যগ্রহণ এবং চন্দ্রগ্রহণ হচ্ছে আল্লাহর নিদর্শন। কারো জীবন ও মরণের সঙ্গে এগুলোর কোনোই যোগাযোগ নেই। সুতরাং গ্রহণ লাগা বা না লাগার পেছনে কারো মৃত্যুর কোনো সম্বন্ধ নেই।’ ইব্রাহীমের লাশ ছোট একটা খাটে করে আনা হয়। রাসূল নিজে পুত্রের জানাযা পড়ান। তারপর তাঁকে বিশিষ্ট সাহাবী উসমান বিন মাউনের কবরের পাশে দাফন করা হয়। তার লাশ কবরে নামান উসামা ও ফল বিন আব্বাস। রাসূল দাফন শেষ হওয়া পর্যন্ত সেখানে দাঁড়িয়েছিলেন। পরে কবরের ওপর সামান্য পানি ছিটিয়ে দেয়া হয় এবং নির্দিষ্ট চিহ্ন দিয়ে কবরটিকে চিহ্নিত করা হয়। খোলাফায়ে রাশেদার প্রথম ও দ্বিতীয় খলিফা আবু বকর ও ওমর (রা) মারিয়া (রা)-কে অত্যন্ত সম্মানের চোখে দেখতেন। রাসূল (ﷺ)-এর ইন্তেকালের পর উভয় খলিফাই তার প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। এমন কি মারিয়া কিবতিয়ার মৃত্যুর পর তার আত্মীয়-স্বজনকেও উক্ত দু’জন খলিফা সম্ভাব্য সকল সাহায্য সহযোগিতা করেছেন।

ওফাত

ইব্রাহীম (রা)-এর মৃত্যুর পাঁচ বছর পর মারিয়া কিবতিয়া ইন্তেকাল করেন। তাকে জান্নাতুল বাকীতে দাফন করা হয়।

সকল অধ্যায়

১. ১. উম্মুল মু’মিনীন খাদীজা (রা)
২. ২. উম্মুল মু’মিনীন আয়েশা (রা)
৩. ৩. উম্মুল মুমিনীন হাফসা (রা)
৪. ৪. মারইয়াম (আ)
৫. ৫. আছিয়া (আ)
৬. ৬. উম্মু সুলাইম (রা)
৭. ৭. যয়নব বিনত রাসূলুল্লাহ
৮. ৮. রুকাইয়া বিনত মুহাম্মদ
৯. ৯. উম্মু কুলছুম বিনত নবী করীম (ﷺ)
১০. ১০. ফাতিমা বিনত রাসূলিল্লাহ
১১. ১১. সুমাইয়া (রা)
১২. ১২. উম্মুল মুমিনীন সাদা বিনতে যামআ (রা)
১৩. ১৩. উম্মুল মুমিনীন যয়নব বিনতে খুযাইমা (রা)
১৪. ১৪. উম্মুল মু’মিনীন উম্মু সালামা (রা)
১৫. ১৫. উম্মুল মুমিনীন যয়নব বিনতে জাহাশ (রা)
১৬. ১৬. উম্মুল মু’মিনীন জুয়াইরিয়া (রা)
১৭. ১৭. উম্মুল মুমিনীন উম্মু হাবীবা (রা)
১৮. ১৮. উম্মুল মু’মিনীন সফিয়্যা (রা)
১৯. ১৯. উম্মুল মুমিনীন মায়মূনা (রা)
২০. ২০. উম্মুল মুমিনীন রায়হানা (রা)
২১. ২১. উম্মুল মু’মিনীন মারিয়া কিবতিয়া (রা)
২২. ২২. হালীমা (রা)
২৩. নবী করীম (ﷺ)-এর বহু বিবাহের সমালোচনার প্রতিবাদ

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন