২২. হালীমা (রা)
নাম ও পরিচয়
হালীমা আস-সাদিয়া (রা) মুহাম্মদ (ﷺ)-এর দুধ-মাতা, যিনি পরবর্তীতে সাহাৰীয়া হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন। তিনি ছিলেন মক্কার পার্শ্ববর্তী গ্রামে বসবাসরত বানু সা’দ ইবন বার গোত্রের মেয়ে। তাঁর পিতার নাম ছিল আবু যু’আয়ব আব্দুল্লাহ ইবনুল-হারিছ ইবন শিজনা এবং স্বামীর নাম ছিল আল-হারিছ (রা) ইবন আবদুল উয্যা।
অন্য নারীর দুই পান করানোর কারণ
আরবের অভিজাত শ্রেণীর মধ্যে এ প্রথা প্রচলিত ছিল যে, তারা নবজাতকে শিশুকে দুগ্ধপানের জন্য গ্রামে পাঠাতেন যাতে শিশু বিশুদ্ধ ও নির্ভেজাল আরবী ভাষা শিখতে পারে এবং গ্রামের নির্মল আলো-বাতাস সেবনে শিল্প দৈহিক গঠন বলিষ্ঠ হয়।
দুপোয্য-শিশুর খোজে হালীমা
নবী করীম (ﷺ) ভূমিষ্ঠ হওয়ার বছর যথারীতি হালীমা (রা) তাঁর গোত্রের অন্যান্য নারীদের সাথে দুগ্ধপোষ্য শিশুর খোঁজে স্বামীসহ মক্কায় আগমন করলেন। তাঁর সঙ্গে ছিল স্বীয় দুগ্ধপোষ্য শিশু আব্দুল্লাহ, একটি বয়:বৃদ্ধ উস্ত্রী ও একটি দুর্বল গাধা। দুর্বল গাধায় আরোহণ করার কারণে তারা সকলের শেষে মক্কায় প্রবেশ করলেন। সকলের নিকটই নবী করীম (ﷺ)-কে পেশ করা হল। কিন্তু তারা যখনই শুনল যে, শিশুটি এতীম তখনই তাকে রেখে অন্য শিশুর খোজে চলে গেল। কারণ তাদের ধারণা ছিল যে, মেয়াদ শেষে যখন শিশুকে প্রত্যার্পণ করা হবে তখন শিশুর পিতা কর্তৃক যে মোটা অংকের উপহার দেয়া হয়ে থাকে, এ ক্ষেত্রে তা পাওয়া যাবে না।
হালীমা (রা) অন্য কোনও শিশু না পেয়ে স্বামীকে বলবেন : আল্লাহর কসম। সঙ্গীদের নিকট খালি হাতে প্রত্যাবর্তন করা আমি খারাপ মনে করছি। তাই অবশ্যই উক্ত ইয়াতীমের নিকট যাব এবং তাকে গ্রহণ করব। স্বামী হারিছ ইন আবদুল উয্যা তাতে দ্বিমত পোষণ করলেন না। অত:পর হালীমা (রা) নবী করীম (ﷺ)-কে দুগ্ধপোষ্য শিশু হিসেবে গ্রহণ করে তখন তার সাথে দুগ্ধপোষ্য শিশু ও একটি বয়:বৃদ্ধ উস্ত্রী ছিল। হালিমা বলেন যে, উস্ত্রীর দুধে আমরা পরিতৃপ্ত হতে পারতাম না। ফলে আমার স্তনের দুধেও শিশুটির পেট পূর্ণ হত না। তাই অনাহারের ফলে তার কান্নার কারণে রাত্রিতে আমরা ঠিকমত ঘুমাতে পারতাম। কিন্তু মক্কার শিশুটিকে কোলে নিয়ে যখন সওয়ারীর নিকট ফিরে আসলাম তখন দেখলাম আমার স্তন দুধে পরিপূর্ণ হয়ে গেছে। অত:পর সে ও তার দুধ ভাই উহা পান করে পরিতৃপ্ত হয়ে গেল এবং ঘুমিয়ে পড়ল। আমার স্বামী স্ত্রীর দুগ্ধ দোহন করতে গিয়ে দেখলেন, উন্ত্রীর বাঁট দুধে পরিপূর্ণ। আমরা তৃপ্তিসহকারে উহা পান করলাম। অত:পর সে দিন আমরা সবচেয়ে উত্তম রাত যাপন করলাম।
আমার স্বামী বললেন হালীমা আল্লাহর কসম! আমি দেখতে পেয়েছি যে, তুমি একটি বরকতময় শিশু গ্রহণ করেছ। অত:পর যখন আমরা আমাদের সে দুর্বল গাধাটিতে আরোহণ করলাম তখন সেটি দ্রুত গতিতে অন্যান্য সকলকে পিছনে ফেলে ছুটে চলল। আমার সঙ্গীগণ আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করতে লাগল, হে আবু যু’আয়বের কন্যা। একি সে গাধাটি। সেটি ছিল দুর্ভিক্ষের বছর। অথচ আমাদের ছাগলগুলো চারণভূমি থেকে আহারে পরিতৃপ্ত ও বাটে দুঞ্জভর্তি অবস্থায় ঘরে ফিরত। অথচ অন্যদের ছাগল ক্ষুধার্ত ফিরত। ফলে কারো ছাগলে এক ফোটা দুধও থাকত না। গোত্রের লোকজন এটা দেখে তাদের রাখালদেরকে বলত, হালীমার ছাগলগুলো যেখানে বিচরণ করে তোমরাও সেখানে চরাও। কিন্তু তাতেও কোনো ফল হল না। পূর্বের ন্যায় তাদের ছাগল অনাহারে দুধবিহীন অবস্থায় ফিরতে লাগল। সব কিছুতেই আমরা বরকত ও কল্যাণ পেতে থাকলাম।
এমনিভাবে দুই বছর কেটে গেল। অত:পর হালীমা (রা) তাকে মক্কায় নিয়ে আসলেন এবং একাধারে বরকত ও কল্যাণ ধরে রাখার জন্য তার মাতার নিকট মক্কার আবহাওয়া খারাপ ও মহামারীর প্রাদুর্ভাব হওয়ার কথা বলে আরও কিছু সময় বাড়িয়ে নিলেন। এর কয়েক মাস পর যখন নবী করীম (ﷺ)-এর বক্ষ বিদারণের (শা’স-সার) ঘটনা ঘটল তখন তিনি তাঁকে নিয়ে মক্কায় আসলেন এবং আমিনার নিকট প্রত্যর্পণ করলেন। এক বর্ণনামতে নবী করীম (ﷺ) ৬ বছর বয়সকাল পর্যন্ত হালীমা (রা)-এর নিকট ছিলেন।
হালীমা (রা)-এর ইসলাম গ্রহণ
হালীমা (রা) ঠিক কখন ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন তা সঠিকভাবে জানা না গেলেও অনুমান করা হয় যে, ইসলামের প্রথম দিকে নবী করীম (ﷺ)-এর মক্কায় অবস্থানকালেই তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। কারণ ইসলামের দাওয়াত তার কর্ণগোচর হতেই যে তিনি উহা বিশ্বাস করবেন এটাই স্বাভাবিক। যেহেতু শৈশবে তিনি নবী করীম (ﷺ)-কে অত্যন্ত নিকট থেকে দেখার সৌভাগ্য লাভ করেছিলেন এবং তখন থেকে তার মনে এ দৃঢ় প্রত্যয় জন্মেছে যে, এ শিতকালে একজন মহামানব হবেন, তজ্জন্যই তাঁর স্বামী হারিছ ইবন আবদুল উযযা মক্কায় তাঁর কথা শ্রবণ করে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। তিনি মুসলমান হয়ে স্বগোত্রে ফিরে আসলে তার মুখে শুনে হালীমা (রা) ইসলাম গ্রহণ করে থাকবেন। দুধমাতার সম্মানে রাসূল কখনো কখনো হালীমা (রা) নিকট আগমন করতেন। নবী করীম (ﷺ) তাঁকে আপন মাতার ন্যায় অতিশয় সম্মান ও শ্রদ্ধা করতেন। তাঁর বসার জন্য নিজের দেহের চাদর বিছিয়ে দিতেন।
আবু-তুফাইল (রা) বলেন : নবী করীম (ﷺ) একবার জিইরানায় গোশত বন্টন করেছিলেন। আমি তখন বালক ছিলাম। আমি উটের একটি অংশ নিলাম। তখন সেখানে গ্রাম্য এক মহিলা আগমন করল। মহিলাটি নবী করীম (ﷺ)-এর নিকটে গেলে তিনি তার জন্য স্বীয় চাদর বিছিয়ে দিলেন। মহিলাটি তার উপর বসলেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম, মহিলাটি কে? লোকজন উত্তর দিল, তিনি নবী করীম (ﷺ)-এর দুধমাতা। আতা ইবুন।
ইয়াসার সূত্রে বর্ণিত যে, রাসূল (ﷺ)-এর দুধমাতা হালীমা (রা) হুনাইনের দিন তাঁর নিকট আগমন করলে নবী করীম (ﷺ) তার সম্মানে উঠে দাঁড়ান এবং নিজের চাদর বিছিয়ে দেন। অত:পর হালীমা (রা) তার উপর বসেন। হালীমা (রা)-এর আব্দুল্লাহ নামক এক পুত্র এবং উনায়সা ও খিমা (মতান্তরে হুযাফা) নামক দুই কন্যা ছিল। খিমা, আশ-শায়মা’ নামে পরিচিত ছিলেন। তিনি মাতা হালীমা (রা)-এর দুগ্ধপোষ্য সন্তান (মুহাম্মদ (ﷺ)-কে লালন-পালনে সহযোগিতা করেন। হাইনের যুদ্ধে তিনি হাওয়াযিন গোত্রর অন্যানন্যর সাথে মুসলমানদের হাতে বন্দী হয়ে আসেন। মুহাম্মদ রিদাঈ (দুগ্ধজাত) সম্পর্কের খাতিরে তার সাথে অতিশয় সম্মান ও মর্যাদাপূর্ণ আচরণ করেন এবং উপহার দিয়ে আযাদ করে দেন।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন